সিকদার আমিনুল হকের কয়েকটা কবিতা
[pullquote][AWD_comments][/pullquote]‘রেখো মা দাসেরে মনে’ না লিইখা সিকদার আমিনুল হক (১৯৪২ – ২০০৩) লিখছিলেন ‘রেখো না দাসেরে মনে’ – পরে এইরকম ভুল লিইখা কবিতা বানানোর কাজ অনেকেই করছেন; আগেও কেউ কইরা থাকতে পারেন। কিন্তু সি.আ.হ. যে করছিলেন এইটা মনে করার আর দরকার পড়ে না আসলে; এমনিতেও উনি তো রিকোয়েস্ট করছিলেনই মনে না রাখার জন্য। উনারে এই মনে-না-রাখাটা আসলে উনার জন্যও ভালোই হইছে। এখন অনেকে যাঁরা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতোন আধুনিক কবিতা লিখেন উনাদের শক্তি’রে লুকাইতে হয়, কিন্তু যাঁরা সি.আ.হ.’র মতোন কবিতা লিখেন তাঁদেরকে আর লুকাইতে হয় না, কারণ সি.আ.হ. নিজেই এনাফ লুকানো একটা জিনিস হইতে পারছেন, বাংলা-কবিতায়।
তো, উনারে আবিষ্কার করার কিছু নাই। কবিতায় ‘কিছু জিনিস না-বলা’ রাইখা যাঁরা কবিতা করেন, উনারা দেখলে হয়তো ভাবতে পারবেন যে, আরে এই লোকও দেখি আমাদেরই ফলো করতো! তবে সি.আ.হ.’র একটা জিনিস মে বি ভালো যে, গোপন নিয়া উনি তেমন কোন গোপনীয়তা দেখান নাই।
এই কবিতাগুলি ২০০০ সালে আগামী প্রকাশনী’র ছাপানো উনার শ্রেষ্ঠ কবিতা’র সেকেন্ড এডিশন (২০১৫) থিকা নেয়া হইছে।
ই.হা.
———————-
আহত পাওয়া ।। সুলতাকে নিয়ে একগুচ্ছ ।। ভাষাতত্ত্বের এক ছাত্রীকে ।। নিজ মেরুতে দাঁড়িয়ে ।। তোমার বারান্দা ।। কাতরতা তোমাকে দেখি না ।। বেলা দশটার কবিতা ।। গ্রীষ্মের প্রতিভা ।। অতি প্রগলভ শতাব্দীর কবিতা ।। বিষাদে সম্পাদিত এই গ্রহ… ।। সুপ্রভাত হে বারান্দা ।। মধ্যবয়স্কা কাউকে যখন চিঠি লিখি ।। একটি জর্জীয় কবিতার বেদনা ।। মেয়েটি যখন নখ কাটে ।।
———————-
আহত পাওয়া
তোমার চেয়ে দুরূহ যে তাকেই পাওয়া সহজ হলো
এই নিখিলে সহজ পাওয়া যায় না
নির্বিচারে গ্রহণ করার সেই অধিকার জর্জরিত
সমগ্রতার একটু ফাঁকি সয় না।
তোমার মতো আলিঙ্গনে উন্মাদনার দুর্গ তুলে
সরল হাতে শুল্ক নিতে চায় না,
বুকের ক্ষত গাঢ় হলে উপাস্য সে রৌদ্র জলে
এমন শর্ত অনিচ্ছুকের রয় না।
দুই মুকুরে আঞ্চলিকি, কেউ প্রিয় তার কেউ অতিথি
প্রচলিত, করে না বঞ্চনা
তোমার কাছে আহত হলে, অধিকারের দৈর্ঘ্য বাড়ে
এই হিসেবে সবারই পরগণা।
সুলতাকে নিয়ে একগুচ্ছ
সুলতা জানে
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো,
আকাশে মেঘ – দিঘিতে কেন হাঁস,
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
কবিরা কেন নারীর ক্রীতদাস!
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
প্রেমিক কেন থাকে না চিরকাল
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
দহনে শ্রুতি নির্মম বহুকাল
গ্রহণ-বর্জন
কালো মেয়েটিকে ঘিরে আছে তিনজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ
বস, নিয়েরমানস, আরেকজনের নাম জানি না –
কালো মেয়েটি যেন অমৃতা শেরগিলের ছবি
ইচ্ছাকৃত ভারতীয়।
একজনকেও বিশ্বাস করে না সে, একজনও
যথাযথ ডুবুরির পোশাক পরেনি তখনো –
যে পরেছিলো তাকে গিয়ে মেয়েটি কখনো বলবে না
এই চোখ তুমি রাখো।
একটি ঘটনা
পাখির চেয়ে পাখির পালকের প্রসাধন
আজকাল বেশি টানে।
তোমার টিপের নীল, খয়েরির হতভম্ব নীরবতা
মুখস্থ করেছি – !
লাল ভালো নয়, বন্ধুদের কবিতার মতো উগ্র।
যেদিন পরছো ওই ছাই-রঙা; মৃত্যু এসেছিলো।
তুমি ভেবেছিলে এ তো হিম, নাকি এর ধারণাই পবিত্র!
ভিন্ন সংসার
তাঁবুর ভিতরে আলো। বেশিদূর যেতেও হলো না;
দেখা হয়ে গেলো ঘর, র্যাক, বই – বাটিকের কাজ
এবার শরতে তুমি চলে যাবে। তোমাদের খুকু
আপাতত সুস্থ আছে। তোমার ঘরের কড়িকাঠ
সব ভালো। ঝকঝকে। যত্ম করে শিখেছো ইকেবোনা
সারা দিন মগ্ন তাই। হাঙরের গান মাঝে-মাঝে
দেখে কি লাগেনি ভালো, নাকি ভাবো খুব ঈর্ষাতুর?
এসেছিলো কালরাতে। বৃষ্টি এসে রোদ দিয়ে গেলো।
(বাছাই করা অংশ)
ভাষাতত্ত্বের এক ছাত্রীকে
গল্প পড়ে কিন্তু তত লাগে নাই ভালো!
তবু ধন্যবাদ দিই, মামুলি লেখার
এই লাভ! তর্ক হয়, দুরন্ত বুকের
ঝড় দেখে বুঝে ফেলি তুমি যে মেয়েই!
যাকে তুমি শ্লেষ ভাবো, আমি ভাবি মেঘ।
প্রেমে-পড়া অসম্ভব; তবু স্থির রক্তে-
জেগেছিলো কোলাহল, আমার বয়সে
এটুকু যথেষ্ট খুকি, তুমি সুখে থাকো।
শুনেছি ভাষার যন্ত্রে তুমি আজ বলি,
লেখা কি আসল কাজ? প্রেমে-পড়া ভালো!
নিজ মেরুতে দাঁড়িয়ে
লোকে যা বলে তা সত্য নয়-
চেনা প্রতীক এক দশকের ঢলে
কোথায় চলে যায়-
গেরুয়া জল পায় না ছোঁয়া তোমার পদযুগল!
সত্যি নাকি প্রভু?
খুঁজতে হবে-
কিন্তু এইভাবে তো নয়!
তোমার বারান্দা
নিঃশব্দ বারান্দা থেকে তুমি কি দেখতে চাও জানি;
আমাদের খঞ্জ গলি মেঘভর্তি নর্তকী আকাশ,
যেন বালা সরস্বতী জীবনের আহত ঝিলিক
দিয়ে যায় সুন্দরের হাতে হাতে। যাকেই দেখো না
তুমি, আমি কিন্তু তোমাকেই দেখি, তোমাকে ছাড়া তো
কিছুই দেখি না! সারাক্ষণ তোমার বারান্দা আর
যখন থাকো না নিজে, ফ্ল্যাট বাড়িটার পৌঢ় ছায়া
গিলে খাই চোখ দিয়ে; আর তুমি আসছো না
যেন কত যুগ থেকে। দেখলাম শীর্ণ নর্দমায়
বেড়ালের চলাফেরা – দাঁত ভাঙা প্লাস্টিক চিরুনি
কুড়োচ্ছে রাস্তার ছেলে। কাকের প্রখর চোখে ঘৃণা,
চিঠি বিলি করে ডাকঘর, প্রবীণারা ব্যবহৃত
পুরোনো বোতল তুলে রাখে; শুধু অপচয় হতে
দেখি আমাদের প্রেম, শিশুর বলের মতো ছুটে
গিয়ে মজা ইঁদারার তলদেশে কেবল লুকোয়।
আহত নিঃশব্দ আমি এই দৃশ্যে গাঢ় হয়ে থাকি।
তোমার বারান্দা যেন দূরবীন এই পৃথিবীর
আর তাই সহজেই, তোমার দেখার সব বস্তু
উঠে আসে নিমেষেই; কিন্তু তুমি অস্বচ্ছ এখনো
আমার দৃষ্টির কাছে। বহু দূরে আলস্য জড়ানো
শরীরের প্রগতিকে মনে মনে জানাই স্বাগত।
তুমি কি দেখো না মেয়ে, মাঝে মাঝে বহু রাত হলে
হরিণের মতো প্রমত্ত জ্যোৎস্নার নিরাপদ নিচে-
আমাদের দুটো বাড়ি মুখোমুখি জলপান করে?
কাতরতা তোমাকে দেখি না
এলাম সে-পাড়া ছেড়ে। তোমাকে দেখি না বারান্দায়
সেই থেকে। দীর্ঘদিন! –সারা বিশ্বে, শহরে ও গ্রামে
এসেছে বিস্তর ভালো-মন্দ দিন। একভাবে ভালো
নয় কিংবা মন্দ দীর্ঘস্থায়ী নয়। দিন ও রাত্রির
দরজা খুলেছে হেসে আমাদের পুরোনো পৃথিবী।
কেবল একক অন্ধকারে আমার এদিন যায়
অশরীরী মৃত্যু ভয়ে স্তব্ধ স্নিগ্ধ গভীর সন্ধ্যায়,
অথবা ঝড়ের দিনে ছিন্নভিন্ন নির্বোধ মাস্তুলে।
মনে কি তোমার পড়ে? তুমি একা, বেলা দশটার
বারান্দায় স্থির দূত। বাড়ি নয়, যেন গন্ডোলায়
ভাসছে তোমার নিঃসঙ্গতা, বিশ্রী শূন্যতায় তুমি
ভাঁজে ভাঁজে ক্লান্ত শত খন্ড যেন ছাদে ও কার্নিশে।
অযথা গলির রৌদ্রে ভাদ্রের ভ্যাপসা মেঘলোকে
ছড়ায় বিনষ্ট ঘ্রাণ। তোমাকে নিস্পন্দ শব জেনে
উড়ে আসে কিছু কাক। চুতুর্দিকে খাঁ-খাঁ শূনত্যার
তুমুল দাপটে দগ্ধ ছন্নছাড়া দশটার বেলা।
জানি না তোমার নাম; শুধু দেখি ঠান্ডা রন্ধনশালায়
তুমি হেঁট হয়ে বসা। বিদঘুটে পুরুষের ট্রাউজার
দিচ্ছো শুকোতে বাইরে, কিংবা পিঠ আলস্যের
রৌদ্রে মেলা, কৌচে বসে পড়ছো, গ্রীবার মরূদ্যানে
দুপুরের প্রসন্নতা। এত স্নিগ্ধ, এত তন্দ্রাময়
তোমার বিশ্রাম আর নিশ্চিত যান্ত্রিক ওঠা-বসা।
ক্রমাগত দেখে দেখে আমি জানি তোমার সময়
মুহূর্ত মাসের যাবতীয় দৃশ্য, বাস্তবিক আমি।
এখানে আকাশই দেখি। পচে যাওয়া শাদা মেঘ,
দীর্ঘ অনুজ্জ্বল বেলা, অপ্রস্তুত গলির প্রহর।
চিলের নাছোড় ডানা, অকস্মাৎ কোনো স্নানঘরে
মধ্যবয়স্কার মুণ্ডু। ভবঘুরে বাস ফিরে আসে
স্বেচ্ছায় নিজস্ব স্টপে, সব দেখি তোমাকে দেখি না।
আজকাল বই নিয়ে তুমুল শিল্পিত হতে চাই,
লিখি, পড়ি, ছবি দেখি, বাখের সোনাটা শুনে শুনে
প্রথামতো ভালোবাসি গন্ধভরা আপাতত দিন;
স্বচ্ছন্দে নিয়মে চলে, হাত, জিভ, প্রত্যঙ্গের কাজ –
কোথাও বিরতি নেই, কাতরতা তোমাকে দেখি না।
বেলা দশটার কবিতা
সবাই চলেছে কাজে; আমার সহধর্মিণী সেও!
কিন্তু কী আমার কাজ? জানি না কোথায় পৌঁছবো;
উত্তর চল্লিশে পৌঁছে আজও এই মতিচ্ছন্নতার
বুঝি না উৎস কী যে, আমি নই জনপ্রিয়, লিখে
ঘরে বসে বই পড়ে, যে-গ্রন্থ হবে না ছাপা, তার
আপাদমস্তক খুঁটে, পাণ্ডুলিপি ছড়িয়ে টেবিলে
কেন যে প্রহর যায় পরিণামহীন। সকলের
এত কাজ, আকস্মাৎ আমি কেন এতটা স্বাধীন?
আমার সঙ্গীও আছে। এক কাক। তাকে ভয়ানক
স্তব্ধ মনে করি। বিরক্ত হয় না, কার্নিশেই বসে থাকে।
নিতান্ত মাছের লেজ, পোড়া রুটি, বিস্কুটের গুঁড়ো
হৃষ্ট চিত্তে বেছে নেয়। কাজ শেষে আবার ঝিমোয়।
যান্ত্রিক বাঁচার কাজে এই একাগ্রতা, হতে পারে
চেষ্টাকৃত, জন্মলব্ধ, যা-ই হোক, কিন্তু তা নিশ্চিত।
এদিকে আমার কাজ প্রায়শই দুর্ঘটনা আর
দৈবের নির্ভর। – ক্রোধে বিদ্ধ হয়ে তাকে ঈর্ষা করি।
গ্রীষ্মের প্রতিভা
অ্যাসফল্ট চষে-চষে দেখা হলো গ্রীষ্মের প্রতিভা!
রাস্তায়, দোকানে, পার্কে, কুকুরের পিঠে। শীততাপ
ঘর ছাড়া সবাই প্রচন্ড এলোমেলো। এত রুষ্ট
শহরে আসেনি সন্ধ্যা নির্বাতাস আজকের মতো।
প্রখর অরুচি দেখি শরীরের, সমীচীন জেনে
বাক্যালাপও প্রায় বন্ধ। কেউ যদি ঘর্মাক্ত চুম্বন
হুল্লোড়ে ফেলেও আসে, প্রাপকের হয় না বিনোদ।
চেনা তৃষ্ণা উড়ে যায়, ওষ্ঠের দূরত্বে তান্তালস
সহজে পায় না মুক্তি। এই ক্রোধ চলে সারা রাত;
ট্রাউজার, গেঞ্জি ভিজে, সিদ্ধ হয় স্তনের গৌরব।
বেসিনে চমক নেই, প্রিয় গ্রন্থ, শুভেচ্ছার চিঠি
বিরক্তির উৎস মাত্র। কাক নয়, গ্রীষ্মই সরব-
অশ্লীল, কামুকতুল্য,- গনগনে নীলিমার নীল
যেন রুদ্র নজরুল, গান ভুলে রৌদ্রঝলসিত।
অতি প্রগলভ শতাব্দীর কবিতা
কবিতাকে থাকতে দাও একা, অস্পষ্ট আর পরস্ত্রীর মতো পবিত্র। মানুষের হাত, সে স্বচ্ছন্দে নামুক পাতালের নিচে, অন্ধকারে। পাল তোলার জন্যে কবজির জোর এবং পাহাড়ে ওঠর জন্যে শক্ত গোড়ালি এখনো দরকার।
কবিতা সে থাকুক কামনাদাত্রীর ওষ্ঠে, বগলের নিচের ছোটো অন্ধকার, এবং যার প্রণয়িনী নেই, পানশালায় তার শেষ পাত্রে।
কবিতা উজ্জ্বল হও। তুমি বাঁচো। এবং সুবিশাল নারীর প্রশস্ত নিতম্বের মতো দায়িত্ববোধে আবৃত হও!….
মানুষকে তর্ক করতে দাও। জুয়াখেলার ক্রুটি নিয়ে সে চালাক ছুরি। তার পথ ছেড়ে দাও। সমুদ্র আর বালির দ্বীপ তাকে ডাকে। আসবাবের বার্নিশ তাকে দিক আত্মবিশ্বাস! গণিকার প্রণয়সংগীতে সে টুকরো টুকরো করুর তার শৈশব স্মৃতি…
কিন্তু কবিতা, তুমি তো সম্রাট! তোমাকে নিয়ে গল্প করবে ক্ষতবিক্ষত সৈনিক, যারা তোমাকে দ্যাখে না। তুমি সেই কিশোরীর অন্তর্বাস, বৃদ্ধেরা যার রং পর্যন্ত আঁচ করতে পারে না। বেতের চেয়ারে বসে যারা কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
কবিতা তুমি ওঠে! অগ্নিশিখা আর ক্রোধের মতো। পশুর মতো তোমার গর্জন। গুম্ফার সন্ধ্যার মতো তুমি সমগ্র হও। এবং বিষন্ন, কবরের গোলাপের মতো।
এবং যে-নারী প্রায়শ প্রতারণা করে, তার মতো তুমি সমস্ত রাত্রির জন্যে কামার্ত হও…!
(বাছাই করা অংশ)
বিষাদে সম্পাদিত এই গ্রহ…
তোমার চায়ের কাপে রয়েছে আমার ভাবনা, যখন আমি টেবিলের এ-পাশে। তোমার দাঁতে ফলের খোসার লাল টুকরো। কিছুক্ষণ পরে চুমু খেলে যার মালিক হবো আমি; আর সারা রাত্রি স্মরণ করবো তোমার ঘন দমবন্ধ করা তিরষ্কারের নিশ্বাস।
তুমি কী ভাবছো আমি জানি। এক নতুন অশান্তির কথা। আরেকটি নতুন প্রেম, আরেকজন পুরুষের ঘন কালো চুল, আলুথালু আদর, অন্য ধরনের আলিঙ্গন এবং সবশেষে অনির্বচনীয় অধৈর্য্য উত্তেজনা!
তারপর সেই-ই বিতৃষ্ণা, সেই ক্রোধ, পার্কে বসে নখর-শাসানো তর্ক। তৃষ্ণা মিটবার আগেই যথারীতি প্রেমের মৃত্যু হয়। আগে পুরুষের এবং চিরকাল আলিঙ্গন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নারীর। অবিশ্বাস্য, তবু মৃত্যু হয় বন্ধুত্বের এবং স্মৃতিরও।
চামচ দিয়ে তুমি অদৃশ্য দাগ কাটছো টেবিলে; দেখতে পাচ্ছো পর পর এই ছবি। জীবনের। প্রেমের চিরকালের খাটুনির আগে মেয়েরা যেভাবে ভাবে, তার অতিরিক্ত তোমার এক কণাও বেশি মেধা আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
আমি শুধু অপেক্ষা করি। রেস্তোরাঁর বাইরে চাঁদের জন্যে রাতের পরিচারিকার বা নার্সের অপেক্ষার মতো। প্রসূতির প্রথম সন্তানের মুখে প্রথম চুম্বন খাওয়ার মতো।
(বাছাই করা অংশ)
সুপ্রভাত হে বারান্দা
সুপ্রভাত, হে বারান্দা!… দেখলে তো কবি বেঁচে আছে।
পাদরিও চায় না মরে। খাদ্যগুণ, শর্করার ছলে
রোজ ধর্ম-কর্ম খায় একদলা!… কাল মাঝরাতে
দেখেছি অদ্ভুত স্বপ্ন। এক হ্রদে, আমার নৌকায়
আমি চার-জোড়া রূপসীকে পেয়েছি একাই!
গায়িকা মেয়েটি ছোটো, দেহ-মিলনের মতো নয়;
তবে পৃথুলার গন্ধ বেশ সুস্থ!… স্তন ভালো যার
ডেনিশ মেয়েটি হাসে,… ‘তা হলে কোথায় চললাম?’
কেন জাহান্নামে!- শোনো খুকি, গীতা পড়ো নাই বুঝি?
আমরা করবো কাজ, ফল আছে ঈশ্বরের হাতে!
সুপ্রভাত, হে বারান্দা!… দেখলে তো আজও স্বপ্ন দেখি।
শীতের রাত্রির ক্রুটি, মৃত্যু আসে; নিরক্ষর ভূত-
বিছানাটা ছোটো হয়, বেশ ঠান্ডা, কবরের মতো।
তখন খুলতে থাকে কলকব্জা, শরীরের খিল;
আজকাল বিড়ালেরা চলে যায়!… রোজ দুধ দিতে
পাঁচটি টাকার কম লাগে না তো? পেনশন শেষ।
একা জন্মাবার ভুল সকলের, তাই থাকি একা!
তথাপি ভোরেই উঠি!… খাসা! সুপ্রভাত, হে বারান্দা!
ইঁদুরের মতো নয়, ফ্লানেলের সস্তা জামাটায়
দেখলে কেমন ঘুম ঘুমালাম, গতকাল রাতে?
মধ্যবয়স্কা কাউকে যখন চিঠি লিখি
তোমার কাছেই চিঠি লিখছি এখন;
এই একমাত্র খবরের শেষে আর অতিরিক্ত নেই।
তুমি সুন্দর। অনেকখানি পাওয়া যায় একসঙ্গে।
সমস্তটা আমার হলে একসঙ্গে কিছুক্ষণের জন্যে
কে আর কবর, বিচ্ছেদ এসব বিশ্বাস করে!
চিঠি লিখছি আলোয় অথচ অন্ধকারের গন্ধ পাচ্ছি!
মেদ কি অন্ধকার? মাংস কি অন্ধকার? সব গহ্বর কি,
অন্ধকার? – নাকি বসন্ত বলেই আমি আজ এত কামার্ত!
চিঠি তো লিখছি না, যেন বাতাসে উড়তে উড়তে সংগম করছি।
একটি জর্জীয় কবিতার বেদনা
আজ সমুদ্রের কোনো ফসফরাস নেই
তুমি চলে গ্যাছো
আজ সমুদ্রের ওষ্ঠেও কোনো ফসফরাস নেই
তুমি চলে গ্যাছো
তোমার দাঁতের চাপে পড়ে আছে
ভাঙা চকোলেট
তোমার পায়ের অগ্রসর তাপে
সকালের শাদা বালি…
তুমি নেই
তোমার নাভির নিচে অপরাহ্নের সেই অন্ধকারও নেই…
মেয়েটি যখন নখ কাটে
মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়ে কম কষ্ট নয়
কপট করুণা বালিকার…
নখ কাটে বারান্দায়, হাসিও নরম;
যদিও ছুরিতে খুব ধার!
আমি অন্ধ, গন্ধ পাই কিছু আগেভাগে
একটি গল্পের শেষ মন্দ।
যুবকটি পিপাসার কলস খুঁজলে
দেখবে দরজা দ্রুত বন্ধ!
কাটার শুরুটি ভালো, যথেষ্ঠ নিরীহ
মনোরম দৃশ্য… মিথ্যা নয়!
বোকাটা কাতরে শেষ, আগাম দেখেছি
কেমন ঘটবে অভিনয়!
আমার তাতে কি?… দেখলাম দৃষ্টিপূর্ণ
নিটোল পায়ের ডিম তার;
যেহেতু ঘেঁটেছি আগে, বহু আবর্জনা
হলো সরবে কোনো হার!
——————
সিকদার আমিনুল হকের কবিতার বই:
দূরের কার্নিশ (১৯৭৫)। তিন পাপড়ির ফুল (১৯৭৯)। পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা (১৯৮২)। আমি সেই ইলেক্ট্রা (১৯৮৫)। বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকার (১৯৮৭)। পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল (১৯৮৭)। এক রাত্রি এক ঋতু (১৯৯১)। সতত ডানার মানুষ (১৯৯১)। সুপ্রভাত হে বারান্দা (১৯৯৩)। কাফকার জামা (১৯৯৪)। সুলতা আমার এলসা (১৯৯৪)। রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯৫)। লোর্কাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেলো (১৯৯৭)। শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০০)। বিষন্ন তাতার (২০০২)। ঈশিতার অন্ধকার শুয়ে আছে (২০০২)।
————–
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024