সিজার পাভিজি’র কবিতা: মরণ আসবে আর নিয়া যাবে চোখগুলি তোমার
সিজার পাভিজি (১৯০৮ – ১৯৫০) ইতালিয়ান ভাষায় লিখতেন, ইংলিশেও লিখছেন কয়েকটা কবিতা। উনি আম্রিকান সাহিত্য ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করছেন, গল্প, উপন্যাস লিখছেন, সমালোচনাও করছেন আর লেখালেখির শুরুতে আর শেষদিকে কবিতা লিখছেন। উনার কবিতাগুলি ডিজঅ্যাফেকশনস নামে ২০০২ সালে ইংরেজি অনুবাদ করছিলেন জিওফ্রি ব্রুক। সেই বই থিকা উনার লাস্ট কবিতার বইটা বাংলায় অনুবাদ করা হইলো। ধারণা করা হয়, হলিউডের এক নায়িকার প্রেমে পইড়া এই কবিতাগুলি উনি লিখছিলেন। দশটা কবিতা আছে বইটাতে। উনি আত্মহত্যা করার পরে এই পাণ্ডুলিপিটা পাওয়া যায়।
এমনিতে এখনকার বাংলা-কবিতার একটা চালু টেকনিক তো আছে যে, একটা কইয়া আপনে আরেকটা বা আরো দশটা জিনিস বুঝাইয়া ফেলতে পারেন। পাভিজি’র টেকনিকটা একটু উল্টা; ঘুইরা ফিরা কয়েকটা ইমেজ উনার, আর সবগুলা ইমেজ খালি কইতে চায়, কি রকম ধরাটা উনি খাইছিলেন। লাইফ এমন একটা লিনিয়ারিটি যা উনি এড়াইতেই পারতেছেন না।
অনুবাদ করা ব্যাপারটা ঠিক একটা চিন্তা/অনুভূতিরে একটা ভাষা থিকা আরকেটা ভাষাতে ট্রান্সফার করা না, বরং একটা চিন্তা/অনভূতিরে আরেকটা নতুন জায়গা থিকা রি-ক্রিয়েট করা। আর এইরকম রি-ক্রিয়েশনের ভিতর দিয়া চিন্তা/অনুভূতিটাই না খালি ভাষাটার চেইঞ্জ হওয়ার রাস্তাগুলিও তৈরি হওয়ার কথা।
ই.হা.।
—————————————————————————————————–
মরণ আসবে আর
নিয়া যাবে চোখগুলি তোমার
——————————————————————————————————-
সি.কে লেখা সি.’র চিঠি।। সকালবেলায় সবসময় ফিরা আসো তুমি।। একটা রক্ত আছে তোমার, একটা শ্বাস।। মরণ আসবে আর নিয়া যাবে চোখগুলি তোমার।। তুমি, মার্চের বাতাস।। পিজা ডি স্প্যানিয়া পার হয়া যাবো আমি।। সকালটা পার হয়।। যেই রাতে ঘুমাও তুমি।। বিলাইগুলি জানবে।। লাস্ট ব্লুজ।।
———————————————————————————————————
সি. কে লেখা সি.’র চিঠি
তুমি,
আলো-ছায়ার মৃদুহাসি
জমে থাকা বরফে-
মার্চের বাতাস,
ডালগুলির ব্যালে
ছড়ায় বরফের উপরে,
গোঙানি আর দ্যুতি
তোমার ছোট্ট “ওহ্” গুলির-
শাদা-পায়ের হরিণী,
চোখ-ধাঁধানো,
যদি আমি জানতাম
তখনো
সরে-যাওয়া মাধুর্য
তোমার সমস্ত দিনগুলির,
ফোমের-মতোন ছড়ানো জরি
তোমার পথগুলির-
প্রতিটা-পরেরদিন জমাট
নুয়ে আছে মাঠে-
তুমি আলো-ছায়ার মৃদুহাসি
তুমি চকমকি হাসির ফোয়ারা।
সকালবেলায় সবসময় ফিরা আসো তুমি
ভোরের আবছা আলো
শ্বাস নেয় তোমার মুখ দিয়া
শূন্য রাস্তাগুলির শেষে।
তোমার চোখের ধূসর আলো-
ভোরের শান্তির ফোঁটা
কালো পাহাড়গুলির উপর।
তোমার পায়ের ছাপ আর তোমার শ্বাস
বাড়িগুলির উপর দিয়া ছুটে যায়
দিন শুরুর বাতাসের মতো।
শহরটা কাঁপে,
পাথরের সুগন্ধি বাতাসে-
তোমার জীবন, ফিরা আসে।
একটা তারা নিভে যায়
ভোরের আলোতে
একটা হঠাৎ বাতাস,
উষ্ণতা, শ্বাস-
রাত এখন শেষ।
তুমি হইলা আলো আর সকাল।
একটা রক্ত আছে তোমার, একটা শ্বাস
একটা রক্ত আছে তোমার, একটা শ্বাস
মাংস দিয়া বানানো তুমি,
চুলের ডগা দিয়া, এমনকি তোমার চাউনিগুলাও
তুমি। দুনিয়া আর গাছগাছালি
মার্চের আকাশ, আলো
ওরা কাঁপে আর দেখায় তোমারে-
তোমার হাসি আর তোমার পায়ের শব্দ
খলবল করে পানির মতো-
তোমার দুই চোখের মাঝখানের ভাঁজ
মেঘের মতো জমে-
তোমার মোলায়েম শরীর
এক টুকরা মাটি, সূর্যের।
একটা রক্ত আছে তোমার, একটা শ্বাস।
এই মাটিতে তুমি বাঁইচা থাকো।
তুমি জানো তার সুবাসগুলি
ঋতুগুলি আর ফিরা আসাগুলি
সূর্যের সাথে খেলা তোমার
তুমি আমাদের সাথে বলতেছো কথা।
বসন্তের নতুন বীজ,
স্বচ্ছ পানি, দুনিয়া,
বাড়তে থাকা নিরবতা,
ছোটবেলায় তুমি খেলছো
অন্য আরেকটা আকাশের নিচে।
তোমার চোখগুলিতে ভাসে সেই নিরবতা,
একটা মেঘ, যেন একটা বসন্ত
জেগে উঠতেছে অনেক ভিতর থিকা।
এখন তুমি হাসো আর নিরবতার উপর
লাফ দিয়া চইলা যাও।
সুস্বাদু ফল বাঁইচা থাকতেছে
একটা ক্লিয়ার আকাশের নিচে,
শ্বাস নিতেছে আর বাঁইচা থাকতেছে
আমাদের এই ঋতু,
তোমার আটকাইয়া রাখা নিরবতাই
শক্তি তোমার। যেমন বাতাসে
ঘাসগুলি জ্যান্ত,
কাঁপতে থাকো তুমি আর হাইসা ওঠো
কিন্তু তুমি, তুমি হইলা দুনিয়া।
তুমি ভয়ংকর শিকড়গুলি।
তুমি সেই দুনিয়া যে অপেক্ষার ভিতরে আছে।
মরণ আসবে আর নিয়া যাবে চোখগুলি তোমার
মরণ আসবে আর নিয়া যাবে চোখগুলি তোমার-
এই তো সেই মরণ, যে থাকে আমাদের সাথে
সকাল থিকা সন্ধ্যা, ঘুমহীন
বধির, পুরান একটা অভিশাপের মতোন
অথবা উদ্ভট পাপ একটা। তোমার চোখগুলি
হয়া উঠবে একটা আজাইরা শব্দ
একটা আটকাইয়া রাখা কান্দা, একটা নিরবতা।
প্রতিটা সকালবেলায় নিজের সাথে একলা হয়া
আয়নার দিকে ঝুঁকে পইড়া তুমি যা দেখো,
এইটা সে-ই। হায় এতোদিনের আশা,
সেইদিন আমরাও জাইনা যাবো
তুমি হইলা জীবন আর তুমি কিছুই না।
মরণ তাকায়া থাকে সবার দিকে
মরণ আসবে আর নিয়া যাবে চোখগুলি তোমার।
একটা পাপরে ত্যাজ্য করার মতোন
একটা মরা মুখের মতোন
আয়নাতে ফিরা আসবে,
একটা বন্ধ ঠোঁট জানি কথা বলতেছে।
প্রচন্ড বোবার ঘূর্ণিতে আমরা নাইমা যাবো, নিচে।
তুমি, মার্চের বাতাস
জীবন তুমি আর মরণ।
মার্চে আসছিলা তুমি
এই নগ্ন দুনিয়াতে-
তোমার কাঁপুনিগুলি থাইকা যায়।
বসন্তকালের রক্ত –
বনফুল অথবা মেঘ –
তোমার আলতো পায়ের ছাপ
দুনিয়াটা তছনছ করে।
যন্ত্রণাটা শুরু হয় আবার।
তোমার আলতো পায়ের ছাপ
ক্ষতটারে আবার খুলে দেয়।
দুনিয়াটা ছিল ঠান্ডা
একটা দুর্বল আকাশের নিচে,
বদ্ধ আর গতিহীন
ঢিমে তালের স্বপ্নটার মতোন
যা ছিল সহ্যের বাইরে।
এমনকি হৃদয়ের গভীরে
জমে যাওয়াটা ছিল মধুর।
জীবন আর মরণের মাঝখানে
আশা ছিল চাপা দেয়া।
এখন প্রতিটা জ্যান্ত জিনিসের
একটা কণ্ঠস্বর আছে আর একটা রক্ত।
এখন দুনিয়াটা আর আকাশ
থরথর করে কাঁপতে থাকে,
আশা তাদেরকে শান্তি দেয়,
সকাল তাদেরকে আচ্ছন্ন করে,
তোমার পায়ের ছাপ তাদেরকে ঢেকে দেয়,
ভোরের বেলায় তোমার শ্বাস।
বসন্তকালের রক্ত,
পুরা দুনিয়া কাঁপতে থাকে
পুরান একটা কাঁপুনি থিকা।
ক্ষতটারে আবার খুলে দাও তুমি।
জীবন তুমি আর মরণ।
তুমি আলতো করে চলে গেছিলা
এই নগ্ন দুনিয়ার উপর দিয়া
একটা সোয়ালো পাখি অথবা মেঘের মতোন
আর হৃদয়ের বয়ে চলা
জেগে উঠে আর ফেটে পড়ে
আর দেখা যায় তারে আকাশের আয়নায়
আর নিজেই দেখায় জিনিসগুলিরে
আকাশে আর হৃদয়ে
যা কষ্ট পায় আর মোচড়ায়
যখন অপেক্ষা করতে থাকে তোমার জন্য।
এখন সকাল, ভোর,
বসন্তকালের রক্ত,
দুনিয়াটা তুমি তছনছ করে দিছো।
আশা কুঁচকাইয়া যায়,
আর তোমার জন্য অপেক্ষা তোমারে ডাকে।
জীবন তুমি আর মরণ।
তোমার পায়ের ছাপ, কি রকম হালকা।
পিজা ডি স্প্যানিয়া পার হয়া যাবো আমি
একটা ক্লিয়ার আকাশ থাকবে তখন।
রাস্তাগুলি খুইলা যাবে
পাইন আর পাথরের পাহাড়গুলির দিকে।
রাস্তাগুলির গোলমাল
থমকে-থাকা বাতাসরে নাড়াবে না।
ঝর্ণার পাশে রং ভরা ফুলগুলি
তাকাইবো সুন্দরীদের মতো
খুশিতে। পায়ে পায়ে ভেসে যাওয়া
উঠানগুলি শুষে নিয়া সব
গাইতে থাকবো সূর্যের গান।
রাস্তাগুলি খুইলা যাবে,
পাথরগুলি গাইবো গান,
আমার মন বাজতে থাকবে, বইতে থাকা
পানির মতোন, ঝর্ণার –
আর এই কণ্ঠস্বর
উঠতে থাকবে সিঁড়ি দিয়া তোমার।
জানালাগুলি জানবে
সকালের বাতাসের সুবাস
আর পাথরগুলিও। একটা দরজা খুলে যাবে।
রাস্তার চিৎকার চেঁচামেচিগুলি
হবে আমার নিজের মনের গন্ডগোল
মুছে যাওয়া আলোতে।
তুমি তো থাকবা তখনো – স্থির আর স্পষ্ট।
সকালটা পার হয়
সকালটা পার হয় ভালোভাবে
আর মরুভূমি হয়া উঠে। তোমার চোখ
খুলে যাইতো এইভাবে। সকাল
হামাগুড়ি দেয়, একটা নিথর
ঝড়, আলোর; চুপচাপ।
তুমি বাঁইচা ছিলা নিরবতায়, জীবন
তোমার চোখের সামনে
(কোন কষ্ট, কোন জ্বর, কোন ছায়া নাই)
সকালের একটা সাগরের মতো, স্পষ্ট।
যেইখানে তুমি থাকো, আলো, সকাল হয়।
তুমি ছিলা জীবন আর সমস্তকিছুই।
তোমার ভিতর জেগে উঠে শ্বাস নিতাম আমরা
একটা আকাশের নিচে, যা আছে এখনো আমাদের সাথেই।
কোন দুঃখ কোন জ্বর নাই তখন
নাই ভারী ছায়া কোন, দিনের,
জড়ো হওয়া আর অন্যরকম। আহ্ আলো,
দূরের স্পষ্টতা, জোর করে
শ্বাস নেয়া, আবারো নিয়া আসে তোমার
স্বচ্ছ আর নিথর চোখগুলিরে, আমাদের কাছে।
তোমার চোখের কোন আলো ছাড়া
সকালটা অন্ধকার।
যেই রাতে ঘুমাও তুমি
এমনকি রাতটাও তোমার মতোন,
দূরের রাত, যার চোখের পানি
নিরবে পড়তে থাকে হৃদয়ের ভিতরে
আর তারাগুলি ক্লান্ত হয়া চলে যায়।
একটা গাল ছুঁইয়া যায় আরেকটা গাল –
একটা ঠান্ডা কাঁপুনি, কেউ
জোর করে আর মিনতি করে তোমারে, একলা
হারায় তোমার ভিতরে, তোমার জ্বরের মধ্যে।
রাতটা কষ্ট পায় আর ভাবে, কখোন আসবে ভোর,
হতভাগ্য হৃদয় তবু যাইতে থাকে তোমার দিকেই।
আহ বন্ধ মুখ, অন্ধকার যন্ত্রণা,
জ্বর যা আসলে শোক, তারাগুলির;
তোমার মতোই আরেকটা ভোরের অপেক্ষা
নিরবতার ভিতর দেখতে থাকে তোমার মুখটারে।
একটা বদ্ধ আর মৃত দিগন্তের মতোন
রাতের ভিতর ছড়াইয়া যাও তুমি।
হতভাগ্য হৃদয় তবু যাইতে থাকে তোমার দিকেই।
একটা দিনের দূরত্বে তুমি ছিলা ভোর।
বিলাইগুলি জানবে
আবারো বৃষ্টি পড়বে
তোমার মসৃণ ফুটপাতে,
একটা হালকা বৃষ্টি
একটা শ্বাসের মতোন
অথবা এক পা হাঁটার মতোন
ঝিরঝির বাতাস আর ভোর
ছড়ায়ে পড়বে আবার
যখন ফিরা আসবা তুমি,
যেন তোমার পায়ের ছাপের নিচে
ফুলগুলি আর সিলিংয়ের মাঝখানে বসা
বিলাইগুলি জানবে।
অন্য আরো দিনগুলি আসবে,
অন্য আরো কণ্ঠস্বরগুলি।
তুমি একলাই হাসবা,
বিলাইগুলি জানবে,
গতকালের দাওয়াত থিকা আইসা
খুইলা রাখা পোশাকগুলির মতোন
পুরান, ফতুর হয়ে যাওয়া
আর আজাইরা শব্দগুলার কথা
তুমি শুনবা।
তুমিও ইশারা করবা।
তুমিও উত্তর দিবা শব্দগুলি দিয়া –
বসন্ত দিনের শুরুতে
তুমিও ইশারা করবা।
বিলাইগুলি জানবে তখন
বসন্ত দিনের শুরুতে
আর হালকা বৃষ্টি
আর হায়াসিন্থ ভোর
তাঁর হৃদয়রে পিষতে থাকে
যে জানে তুমি কোনদিনই ফিরা আসবা না –
তারা সেই বিষন্ন হাসি
যা তুমি নিজের জন্য হাসো।
অন্য আরো দিনগুলি আসবে
অন্য কণ্ঠস্বর আর ফিরা আসাগুলি।
বসন্ত দিনের শুরুতে
ভোরবেলায় কষ্ট পাবো আমরা।
লাস্ট ব্লুজ
এইটা ছিল একটা ফ্লার্ট
তুমি শিওর এইটা জানতা –
কেউ একজন দুঃখ পাইছিল
অনেক দিন আগে।
ব্যাপার না এইটা
সময় পার হয়া যায় –
কোন একদিন তুমি আসছিলা
কোন একদিন তুমি মারা যাবা।
কেউ একজন মারা গেছে
অনেক দিন আগে –
কেউ একজন ট্রাই করছিল
কিন্তু জানতো না।
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (তিন) - নভেম্বর 15, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024