Main menu

গল্প: নুংশিতোম্বী এবং আমি – সুধীর নাউরোইবম

[মনিপুরি ভাষার গল্প। বাংলায় অনুবাদ করছেন চিংখৈ অঙোম।]

————-

শৈশবে ইচ্ছেমতোন ছেলেমানুষি করে কাটিয়েছি নুংশিতোম্বী এবং আমি। ন্যাংটো হয়ে সাঁতরেছি নদীর সমস্ত স্রোত; ডুব দিয়েছি, ঝাঁপ দিয়েছি।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

সে খুব দ্রুত দৌঁড়ায়। হালকা পাতলা গড়ন ওর। আমি পারি এমন সব কিছু সেও পারে। কখনও কখনও বেশ লেগে যায় আমাদের। আমি ওর চুল ধরে টানি। চুল ছিঁড়ি। সে কামড় বসায়। বাড়াবাড়ি হয় না কখনই। কিন্তু কেউ কাউকে ছাড়ও দিই না। একসাথেই আমাদের আশৈশব বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো; কখনও আমি সামনে, কখনও সে।

অন্যের গাছের ফল চুরি করতে যেতাম আমরা। ফল ওর খুব প্রিয়। একবার খুব তাড়া খেয়েছিলাম দুজনে। দৌঁড়ে পালিয়েছিলাম। কিন্তু ঐদিন সে একদমই দৌঁড়াতে পারছিলো না। ঐদিন সে ফনেক i পরেছিলো। সে প্রায়ই বলতো, ফনেক পরলে নাকি দ্রুত দৌঁড়ানো যায় না।

আমি বললাম, ‘নুংশিতোম্বী, ফনেকটা হাতে ধরে দৌঁড়া। আজ বোধহয় তুই ধরা খেয়েই ফেললি রে!’

সে তা-ই করলো। তারপর আমরা বাতাসের বেগে ছুটে পালিয়ে এলাম। মালিক রয়ে গেলো অনেক পেছনে। নাগাল না পেয়ে। খুব দ্রুত শ্বাস ফেলছিলাম আমরা। প্রচণ্ড হাঁপিয়ে উঠেছি। হাসছিলামও খুব।

আমি বললাম, ‘আরেকটু হলেই তো ধরা খেতি। কেন ফনেক পরলি?’

‘ইমা ii পরতে বলেছে। ফনেক না পরলে খুব বকা খাই।’

‘কেন?’

‘জানি না!’

 

ফনেক। আতিয়া মাইবম-এর আঁকা ছবি।

ফনেক। আতিয়া মাইবম-এর আঁকা ছবি।

 

সে ফনেক পরতে শুরু করলো। ফল চুরি করতে তারপর থেকে আমি একাই যেতাম। সে দূরেই থাকত — আমার দিকে চেয়ে — আমার ফল নিয়ে আসার অপেক্ষায়। অপেক্ষা এবং চেয়ে থাকায় সে অভ্যস্ত নয়। অথচ তা-ই করতো। অন্য অনেক কাজেও সে আমার সাহায্য নিতে শুরু করল। যেগুলো একাই পারতো, এবং পেরেছে, ওরকম কাজগুলোও আর একা একা করতে না-পারা শুরু হলো ওর। অথচ আমার চেয়ে কিছুমাত্রই কম ছিলো না সে। এটা ওর আলসেমি এবং আহ্লাদি ভেবে তাই রাগও হলো বেশ। আমি ওর উপর রাগ করলাম। বকাও দিলাম অনেক। চুল ধরে টানলাম। চুল ছিঁড়লাম। কিন্তু সে আর কামড় বসায় নি। কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছিল যেন। সেটা ওর ফনেকের কারণে, নাকি তার মার কারণে? আমি জানি না। জানি না কে তাকে এতো দুর্বল করে দিয়েছিলো, এতো বাধা দিয়েছিলো!

নদীতীরের বালি দিয়ে অনেক খেলেছি আমরা। বালিঘর বানিয়ে। তারপর আবার ভেঙে দিয়ে। ভাঙা-গড়ার পার্থক্য বুঝে উঠতে পারি নি। কেবল বুঝেছি খেলাটুকু। খেলার আনন্দটুকু। খেলার আনন্দটুকু ছিলো ভাঙা এবং গড়ায়। আমরা কেবল ঐদিনের কথাই ভেবেছি। ঐদিনের ভালোলাগা।

অথচ খুব অবাক করে দিয়ে একদিন সে বলে উঠলো, ‘চল্ আর না ভাঙি! এভাবে ঘর বানিয়ে বানিয়ে আবার ভাঙতে হয় বুঝি!’

‘তাহলে কী করব?’ আমি জানতে চাইলাম, ‘এভাবেই রেখে যাব?’

‘হ্যাঁ, এভাবেই রেখে যাব। কালও তো খেলব আমরা! কালকের জন্য রেখে যাব।’

আগামীর কথা সে-ই প্রথম শুরু করলো। আগামীর জন্য রেখে দিলাম আমরা। ওটার নাম হলো ‘হয়েংগী য়ূম’ । নতুন আরো কিছু বানালাম — ওরাও হলো ‘হয়েংগী য়ূম’। iii কী অদ্ভুত সুন্দর ছিলো সে ঘরগুলো। ভেঙে-ফেলাগুলোর কথাও মনে পড়ল। ওগুলোও থাকলে কত্তগুলোই না হতো! কত্ত সুন্দরই না হতো! প্রথমবারের মতো আমি অনুভব করলাম সৃষ্টির আনন্দ — আগামীর। কিন্তু আমাদের সেই বালিঘরগুলোর ভবিষ্যৎ আমি জানি না।

 

এক পূর্ণিমায় সে রাধা সাজলো। পোৎলোয় iv পরে সবার সামনে দাঁড়াল নৃত্যের ভঙ্গিমায়। তাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। অলংকারে ভারাক্রান্ত তার চুলের খোঁপা, গলা, বাহু, এবং পোৎলোয়ে আবদ্ধ সে; খুব ধীর ছিলো তার নড়াচড়া, খুব দুর্বল, প্রায় স্থবির।

আমি ইমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইমা, নুংশিতোম্বীর কষ্ট হচ্ছে না?’

‘কেন কষ্ট হবে! নাচের কষ্ট কি আর কষ্ট? তোরা যে খেলিস, তোদের কি কষ্ট লাগে? দেখ্ কী সুন্দর লাগছে ওকে!’

সুন্দর লাগছে! এটা সৌন্দর্য! আমি মানতে চাই না। যত সুন্দরই লাগুক আমি পোৎলোয় পরব না। আমি পরব না। ওর নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে। নুংশিতোম্বীর নিশ্চয় অনেক কষ্ট হচ্ছে।

‘ইমা, সে কি কালও পোৎলোয় পরবে?’

‘না, পরবে না। নাচ শেষ হয়ে গেলে আর পরবে না।’

‘একদমই পরবে না?’

‘ওর যখন বিয়ে হবে তখন অবশ্য আরেকবার পরবে।’

ওর যখন বিয়ে হবে! দিদিটাও বিয়েতে পোৎলোয় পরেছিলো। আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি।

 

পোৎলোয়। আতিয়া মাইবম-এর আঁকা ছবি।

পোৎলোয়। আতিয়া মাইবম-এর আঁকা ছবি।

পরদিন সকালে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘নুংশিতোম্বী, তোর নাচতে ভালো লেগেছে? পোৎলোয় পরতে কষ্ট লাগে নি?’

সে কোনো জবাব দেয় নি। আমি ওকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম।

‘বল্ না, তোর কি কষ্ট হয়েছে? ভালো লেগেছে তোর? তোর একদম ভালো লাগে নি, খুব কষ্ট হয়েছে তোর, না নুংশিতোম্বী? আস্তে আস্তে হাঁটতে তোর একদম ভালো লাগে না, তাই না? তুই সেটা একদম পছন্দ করিস না, না?’

সে একদমই জবাব দেয় নি।

‘চল্ ছোঁয়াছুঁয়ি খেলি,’ আমি ওর হাত ধরে টানলাম। ‘তুই আগে দৌঁড় দিবি। তুই যেখানে ছুঁবি চল্ সেটাই আমাদের শেষ। তুই-ই জিতবি চল্। শুধু খুব জোরে দৌঁড়াবি।’

সে রাজী হয় নি। মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে গিয়েছিল। তারপর আমি সমস্ত বালিঘর ভেঙে ফেলেছিলাম। আমাদের আগামীর ঘরগুলো। ‘হয়েংগী য়ূম’গুলো। খুব রাগ করে।

 

ইমা বলল, ‘ছেলে-মেয়েতে কি আর একসাথে খেলা হয়!’

 

——————————————————-

 

লেখক পরিচিতি:

সুধীর নাউরোইবম এর জন্ম ১৯৬৯, ফেব্রুয়ারিতে। জন্মস্থান: ওইনাম বাজার, নামবোল, মণিপুর, ইন্ডিয়া।

সুধীর নাউরোইবম

সুধীর নাউরোইবম

তিনটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে: য়োকচবি বাংলাদেশ (১৯৯০), মৈ চঙলবা চেক (১৯৯২) এবং লৈই খরা পুন্সি খরা (১৯৯৮)। শেষোক্ত গল্পগ্রন্থটির জন্য ১৯৯৯ সালে নহারোল সাহিত্যপ্রেমী সমিতি, ইম্ফাল তাকে প্রদান করে থোকচম জোগেন্দ্রজীৎ মেমোরিয়েল গোল্ড মেডেল এওয়ার্ড। একই গল্পগ্রন্থের জন্য তিনি ২০০৩ সালে নয়াদিল্লী সাহিত্য একাডেমী এওয়ার্ড লাভ করেন। নুংশিতোম্বী অমসুং ঐ গল্পটি উক্ত গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

চিংখৈ অঙোম

সিলেটবাসী। মণিপুরিভাষী। কবিতাকাহিনি-গান-ছবি-মুভি লিখি, গাই, আঁকি ও বানাই। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: পেবেতকী পেনা (২০১৫)।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →