বই: বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা সংগ্রহ
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের প্রথম কবিতার বই পাবলিশড হইছে উনার ৫৭ বছর বয়সে। কবিতা লিখতেছেন মনেহয় এর আগে থিকাই। এই পর্যন্ত ছয়টা কবিতার বই ছাপাইছেন, ওই সবগুলি বই মিলায়া ‘কবিতা সংগ্রহ’ নামে বই ছাপানো হইছে ২০১৭-তে। ওই বইটা থিকা কয়েকটা কবিতা রাইখা বইটারে প্রমোট করতে চাইতেছি আমরা।
‘থাড-ওয়ার্ল্ড’ কান্ট্রি’র অ্যাফ্লুয়েন্ট পিপলদের যেই মাইগ্রেটেট ক্লাস ক্রিয়েট হইছে এখন, সেইটার প্রথমদিককার লোক মনেহয় উনি। ধর্মে সেক্যুলার, পিরিতে দেহবাদী। পলিটিক্যালি যেই কারণে সৈয়দ আলী আহসান’রে কখনো কবি হিসাবে একসেপ্ট করা যায় নাই, একই বিচারে বি.কে.জি.’রেও নিতে পারা’র কথা না। কিন্তু উনার টাইমের ইন্টেলেকচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং উনারে কিছু বেনিফিট দিছে কবি হিসাবে, দেখার আর বলার জায়গাটাতেও। মোর ফ্লুইড হইতে পারছেন। খারাপ হয় নাই ব্যাপারটা।
ই. হা.।
—————————————————————-
কবিতা সংগ্রহ। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। অরিত্র প্রকাশনী। জুন, ২০১৭। কাভার: শুভ্রা আচার্য বন্দ্যোপাধ্যায়। দাম: ৪০০ টাকা।
—————————————————————–
।। সর্বনাশের শেষটা ।। হাজার হাজার ইতিহাসের ।। তোমার হাত ।। বাতাসের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ।। লাস্ট ট্রেন চলে গেলে ।। এই কারবালায় ।। একটি পাখি তার গান নিয়ে ।। আমরা ঠিক করেছি ।। ভাষার কোলাহল ।।
——————————————————————-
সর্বনাশের শেষটা
তোমার ট্রেন সকাল দশটায়
তুমি যাবে
তোমার বন্ধুর ভাইকে দেখতে
ইসরাইলী বোমায় তার এক পা
উড়ে গেছে
তোমার স্তন আমার মুখের দিকে
তোমার চুল আমার মুখের পাশে
আমি ঠেকিয়ে রাখি
সর্বনাশের শেষটা[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
(আমাদের মুখ, ১৯৯৩)
হাজার হাজার ইতিহাসের
বার্চগুলি মাঠের মধ্যে স্বাভাবিক
সে-স্বাভাবিকতায়
তুমি এলে,
কিছু বাতাস এলো
পাখির ডানা থেকে,
তুমি স্বাভাবিক
বার্চগুলির মতো পাখিটার মতো।
বার্চগুলি শিকড় ছড়িয়ে দিলো
তোমার দুপায়ে,
পাখিটা ডানা উড়িয়ে দিলো
তোমার দু’হাতের গঠনে,
তুমি উড়ে গিয়েও
স্থির হয়ে গেলে,
অদ্ভুত পৃথিবীটায় তুমি ভালোবাসার
পাথর কুড়িয়ে এনেছ,
তুমি পাথর গড়িয়ে দিলে
গুঁড়িয়ে গেলো
বার্চগাছ পাখি আমার হৃদয়,
স্বাভাবিকতাকে তুমি এভাবে
সম্পূর্ণ করে দিলে।
যেন হাজার হাজার ইতিহাসের
যন্ত্রণা
শান্তভাবে কেউ বলে গেলো।
(পুরানো বৃক্ষের ডালপালা, ১৯৯৪)
তোমার হাত
যেন পাবের মধ্যে জ্যাজ
ফুপিয়ে ফুপিয়ে শব্দ ঘুরছে
গলির মধ্যে শব্দ কাঁদতে কাঁদতে
কোথায় চলে যায়,
সেই হচ্ছে দূর
যেদিকে আমরা হাত বাড়িয়ে রাখি,
গলার মধ্যে তোমার নাম কাঁদতে কাঁদতে
কোথায় চলে যায়,
মধ্যরাত্রে স্বপ্নের আদর দিয়ে-ও
তুমি কান্না থামাতে পারো না,
আমার হাতে তুমি হাত রেখে
শব্দের রোদন শুনছ
আমাদের পরিচিত ছ’ফুট লম্বা গায়কটি
কাঁদতে কাঁদতে নাচের মধ্যে
শব্দটিকে থেৎলে দিচ্ছে,
সেই থেৎলানি ফুপিয়ে ফুপিয়ে শব্দ হচ্ছে
তোমার হাত আমার নামকে ডাকছে।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে শব্দ ঘুরছে
গলার মধ্যে শব্দ কাঁদতে কাঁদতে
কোথায় চলে যায়,
সেই হচ্ছে দূর
যেদিকে আমরা তাকিয়ে থাকি।
আমাদের চোখ রোদন হয়ে যায়
ফুপিয়ে ফুপিয়ে শব্দ
কোথায় চলে যায়।
(পুরানো বৃক্ষের ডালপালা, ১৯৯৪)
বাতাসের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস
বাতাসের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস আছে
টের পাই তোমার চোখের দিকে তাকালে,
চাঁদের মধ্যে হাহাকার আছে
টের পাই তোমার চলে যাওয়ার দিকে তাকালে,
আমি টের পাই তোমার দীর্ঘশ্বাস
তোমার গলার নড়াচড়া
তোমার চলে যাওয়া,
আমি আমাদের নিয়ে
সময়ের ভিতরে চলে যেতে থাকি,
দীর্ঘশ্বাস
হাহাকার
উড়াল
মিলিয়ে উতরোল সময়ের দিকে,
তুমি এক সঙ্গে আমার মধ্যে
দীর্ঘশ্বাস
হাহাকার
উড়াল রেখে যাও,
আমি এই নিয়মের বাইরে
তোমাকে নিয়ে চলে যেতে চাই।
তোমার চোখে বাজনা বাজুক
তোমার হাতে নড়তে থাকুক শব্দ।
(আসবাবহীন ঘর, ২০০৫)
লাস্ট ট্রেন চলে গেলে
লাস্ট ট্রেন চলে গেলে রেলওয়ে লাইন যেমন পড়ে থাকে
আমি তেমনি টেনস,
আমাদের শরীর নাকি মিনার
মনে পড়ে?
চাঁদের আলোয় শরীরটা টেনস
আর লাস্ট ট্রেনে তুমি দূরে,
আমাকে ঘিরে পাতা আর চাঁদের জটলা
আমাকে ঘিরে ভুতুড়ে রেললাইন,
তোমার শরীরের সিল্ক
আমার শরীরে এখনো শিউরে ওঠে,
তুমি একটা নিরিবিলি প্রজাপতি
প্রজাপতির দিকে হাত বাড়িয়ে
সেই ছেলেবেলার মতো তোমার দিকে যেতেই থাকি,
তুমি ক্যাথিড্রালের মতো দাঁড়িয়ে থাকো
শূণ্যের ভেতর,
বাড়ি ফিরে নিজেকে নগ্ন করো
আমার দু’চোখে,
আমার দু’চোখ থেকে ঝরতে থাকে
চেস্টনাট পাতা আর চাঁদের আলো,
আমি লাস্ট ট্রেনের মতো টেনস
তোমার দিকে যেতেই থাকি ভুতুড়ে আলোয়।
ক্যাথিড্রালের মতো দাঁড়িয়ে থাকে চাঁদ
আমার পায়ের শব্দ শূণ্যের মধ্যে সঙ্গীত
তোমার শরীরে বাজতে থাকে প্রচন্ড।
(আসবাবহীন ঘর, ২০০৫)
এই কারবালায়
তোমার গলায় নদীর কুহক
পাতা ঝরার সময় শেষ, এখন অন্য সময়
বাতাসের স্রোতের দিকে গাছের পাতারা যেমন নুয়ে আসে,
তেমনি তুমি আমার হাতের ভিতর মুখ লুকিয়ে আমাকে
খুঁজতে থাকো।
আর আমি ডাকি তোমাকে নদীর কুহকের ভিতর থেকে,
আমি আশ্চর্য তোমাকে দেখে
তুমি বলো: বেটি আর কতো মিছে বলবে
আমরা হাসতে হাসতে বেটিকে পৌঁছে দেবো অতীতে,
আমাদের যাত্রা স্বপ্নের ভিতর
আর আমরা স্বপ্নের ভিতর বাস্তবের শক্ত মাটি খুঁজি
আমি কি দেখিনি তোমাকে
উজ্জ্বল স্থির সকল মিথ্যার সামনে,
তুমি হাসো, এই হাসি দগ্ধে মারে সকল নির্লজ্জতা
তোমার মুখ ছুটে যায় বল্লমের মতো সকল মিথ্যার দিকে।
আমার শিয়রে ধান তোলার মাঠ
আমার শিয়রে গাছেদের জ্যোৎস্না
আমার শিয়রে আমের বাগান,
আমি তোমার পাশে বসে থাকি
আকাশকে অতিথি হবার ডাক দিই
আর তুমি হাসতে হাসতে বলো:
বেটিকে পৌঁছে দেবো অতীতে।
অতীত উঠে আসে যুদ্ধের দাবদাহ থেকে
আমার দু’হাত এই কারবালায় আঁজলা ভরা পানি
এই কারবালায় তোমার দুহাতে ভালবাসা।
(আসবাবহীন ঘর, ২০০৫)
একটি পাখি তার গান নিয়ে
একটি পাখি তার গান নিয়ে
আমার পিছু পিছু হাঁটছে,
গলায় স্কার্ফ আর জ্যাকেট পরে আমি হাঁটছি,
নদী কাঁপিয়ে ভেসে আসছে হাসি
বাতাস খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে,
একটা পাখি তার গান নিয়ে
আমাকে ঘিরে ধরেছে,
স্কার্ফটা তুমি কিনে দিয়েছ
জ্যাকেটটা তোমার উপহার,
পাখিটা শাগাল আমাকে দিয়েছেন,
তোমার ভালোবাসা গায়ে জড়িয়ে
আমি পাখিটার পিছনে হেঁটে চলেছি,
তুমি কি প্যারিসে, সিরাকিউসে?
টোকিওতে? স্কুটগার্টে?
নাকি ঢাকায়?
স্কার্ফের মতো পাখিটা গলায় জড়িয়ে
আমি হাঁটছি রাস্তা থেকে রাস্তায়।
(এলুয়ার যেমন ভাবতেন, ২০০৭)
আমরা ঠিক করেছি
আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছি
নিজেদের মধ্যে একা
আমরা ঠিক করেছি এক সঙ্গে আর থাকব না
এটা আমাদের সবচেয়ে বিষণ্ন রাত
আমরা চলে যাচ্ছি
আর নিজেদের কাছে ফিরে আসব না
একটা অস্থিরতা নিজেদের ভিতর
টের পাচ্ছি দু’জনই
কিছু বলছি না
বলার কিছু নেই
যখন সম্পর্ক ভাঙে তখন সবকিছুই ভাঙে
একটা বাতাস আমাদের চুল ওলটপালট করে
তুমি হাত বাড়িয়ে হাত গুটিয়ে নাও
আমি হাত বাড়িয়ে চুপ করে থাকি
কথা জমে আছে
কথা বলি না
আমরা চলে যাচ্ছি
আর নিজেদের কাছে ফিরে আসব না
আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটছি
নিজেদের মধ্যে একা
বিষণ্ন রাত বিষণ্ন রাত
হঠাৎ তুমি হাত বাড়িয়ে আমার চুল ওলটপপালট করে দাও
আমরা হেসে উঠি
আমাদের ভিতর ফের ভালোবাসা জাগে
বিষণ্ন রাত কতদূর চলে যায়।
(হেমন্তের দিকে মুখ করে, ২০১৪)
ভাষার কোলাহল
তোমার ঠোঁটে আমার ঠোঁট
তোমার চোখে আমার চোখের মেঘ
এখন গ্রীষ্ম
আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের কথা ভেবে
নদী ফুলে উঠেছে
রাত নীল
উত্তর মেরুর রাত আমাদের ঘিরে আছে
আমার চোখের মেঘ তোমার চোখে বৃষ্টি আনবে।
আমাদের তৃষ্ণা
আমাদের আনন্দ
আমাদের দাঁতের আনন্দ দু’জনের ত্বকে
তুমি পরিপূর্ণ রমণী
আমি পরিপূর্ণ পুরুষ
চাঁদের দিকে তাকিয়ে
শব্দ জন্মায় রক্তে
যেমন ঠোঁট এবং মুখ মিলে একটা শরীর,
ঠোঁট থেকে মুখ থেকে শব্দ উত্থিত
এই সব শব্দ মানুষ
ঠোঁট থেকে মুখ থেকে আদিগন্ত মানুষের ভাষা
এইভাবে ভাষাকে আমরা রক্ষা করি
ঠোঁট দিয়ে মুখ দিয়ে শরীর দিয়ে রক্ষা করি।
তোমার চোখে ছলছল করে রংয়ের স্বপ্ন।
ভাষার কোলাহল।
(অন্ধকারের শিল্প, ২০১৫)
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024