সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল সম্বন্ধে আলোচনা।। শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী ।।
১৯২৮ সালে (মানে, ৯০ বছর আগে) নীরদ সি চৌধুরী এই লেখাটা ছাপাইছিলেন, শনিবারের চিঠি নামের পত্রিকায়। ক্ল্যাসিক শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী বাংলা-সাহিত্যে গ্রাম্য অশ্লীলতা করার লাইগা আধুনিক কবি-সাহিত্যিকদেরকে বকা-ঝকা করছিলেন। উনার বলার পয়েন্টগুলি সামারি করলে অনেকটা এইরকম হইতে পারে –
১. অশ্লীলতা নতুন কোন জিনিস না। লাইফে তো এইটা আছেই আর আর্টেও অনেকদিন ধইরাই এইটা আছে।
২. অশ্লীলতা আর দুর্নীতি এক জিনিস না। দুর্নীতি হইলো ইথিক্সের মামলা। অশ্লীলতা হইলো এসথেটিকসের জিনিস, আরো কোর ব্যাপার।
৩. অশ্লীলতা করাটা খারাপ কিছু না, কিন্তু করতে পারতে হবে। বাস্তবে যেইটা ঘটে সেইটারে বলতে পারাটাই আর্ট না।
৪. আর্ট হইতেছে এক ধরণের এক ধরণের ট্রান্সফর্মেশন, রস সৃষ্টি, সত্যি কথা বলার কোন মিডিয়াম না। মানে, সত্যি কথা বলাটা আর্টের উদ্দেশ্য না।
৫. আমাদের আধুনিক লেখকরা (মানে ওই সময়ের লেখকরা) আর্ট যেহেতু করতে পারেন না, উনাদের অশ্লীলতাও হয় না।
আমার ধারণা, উনার এই পয়েন্টগুলিতে এতো বছর পরে আইসা এখনকার ‘আধুনিক’রা কোন না কোনভাবে সাবস্ক্রাইব করেন। যেই কারণে, আমাদের ঢাকার ‘আধুনিক’ সমাজে (এখনো সোসাইটি শব্দটা এনাফ বাংলা হইতে পারে নাই, বড়লোকি হিংসা রইয়া গেছে এর শরীরে) জেসপার নোয়েলের ‘লাভ’ সিনেমা নিয়া ‘অশ্লীল’ কিনা সেইটা নিয়া একটু কনফিউজড থাকলেও, পাওলি দামের সেক্সিনেসরে কোনভাবে ‘অশ্লীলতা’ বইলা মনে হইতে পারে না, কিন্তু মুনমুন বা মূয়রী’র বাংলাসিনেমা যে অবশ্যই ‘অশ্লীল’ এই ব্যাপারে কোন ডাউট থাকার কথা না। একটা ব্যাপার হইতে পারে যে, অ্যাজ অ্যা প্রসেস, ইন আর্ট, উই অ্যাকসেপ্ট ইন্টেলেকচুয়ালিটি থ্রু ডিনায়াল। খাজুরাহো বলেন আর হিন্দু বা গ্রীক মিথ বলেন বা লাস্ট সেঞ্চুরির ডি.এইচ.লরেন্সও তাদের নিজেদের টাইমে এতোটা অ্যাকসেপ্টেট হইতে পারেন নাই। টাইম লাগছে। শ্রীনীরদচন্দ্রের আর্টের এলিটিসজমও না মানতে মানতে এখন একভাবে অ্যাবরর্জভড হয়া গেছে, আমাদের আর্ট ভাবনার ভিতরে।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
কারণ, আর্টের জায়গাটাতে ক্লাসের ব্যাপারটা নিয়া আমরা এখনো মেবি ক্রিটিক্যাল হইতে রাজি না। ‘ছোটলোকদের’ আর যা-ই হোক, আর্ট তো হয় না! মাস পিপল যদি বুইঝাই ফেলতে পারে, রস নিতে পারে তাইলে সেইটা আর আর্ট হইলো কেমনে! বা উল্টাটাও, মাস পিপল যেইটাতে রস পায়, আমিও যদি সেইটাতেই আর্টের রস পাইতে থাকি তাইলে সেইটা আর্ট হইতে পারে কিনা? মানে, অশ্লীলতার আলাপটা কোনভাবেই আর্টের আলাপটারে বাদ দিয়া আসতে পারে না।
শ্রীনীরদচন্দ্র অশ্লীলতার বিপক্ষে না, বরং আর্ট করার পক্ষে। আমাদের ‘আধুনিকদের’ অবস্থাও তার চাইতে আলাদা কিছু তো না! যে, আমরা অশ্লীলতা করতে চাই, কিন্তু হয় না। কিন্তু এই হওয়া বা না-হওয়াটারে কোন পাল্লা দিয়া আমরা মাপতে চাইতেছি, সেই জায়গাটাতে কনসানট্রেট করতে পারাটা মেবি বেটার ফোকাসের জায়গা হইতে পারে। আর্টে অশ্লীলতা জায়েজ কি না-জায়েজ এইটা কখনোই কোশ্চেন না, কোশ্চেনটা সবসময়ই এইটা যে, কোনটারে আর্ট বইলা মাইনা নিতে আমরা রাজি অথবা রাজি না।
তো, উনার এই পুরান লেখাটার সিগনিফেন্স মেবি এইটুকই যে, অশ্লীলতার প্রশ্নটারে সার্টেন ওয়ে’তে যে ডিল কইরা আসা হইতেছে অনেকদিন ধইরাই, মেইন কোশ্চেনটারে ডিল না করার ভিতর দিয়া, সেইটা আবার নতুন কইরা চোখে পড়তে পারে।
ই.হা.
…………………………………………………………………………….
সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীল সম্বন্ধে আলোচনা
(শনিবারের চিঠি, ১৩৩৪, চৈত্র;ইং ১৯২৮সন)
॥১॥
“The thing that hath been, it is that which shall be; and that which is done is that which shall be done; and there is now new thing under the sun.
“Is there anything where of it may be said. see, this is new? It hath been already old time, which was before us.“
Ecclesiastes. Ch I, vv.9-10.
আজ আর আধুনিক বাঙালী সাহিত্যিকরা কিছু ন’ন একথা বলিবার জো নাই। তাঁহারা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আনকোরা নতুন একটা তথ্যের আবিস্কার করিয়া ফেলিয়াছেন। এই নবাষ্কিৃত সত্যের তুলনায় আইনস্টানের বৈজ্ঞানিক গবেষণাও অতি পুরাতন কথার চর্বিত-চর্বণ মাত্র। বিদ্রোহপন্থীরা বলেন, সাহিত্য অশ্লীলতার স্থান আছে। তাঁহাদের প্রবন্ধাদি হইতে আর জানিতে পারিলাম, স্বয়ং কালিদাস নাকি তাঁহার কাব্যে সম্ভোগের বর্ণনা করিয়াছেন, এমন কি সেক্সপীয়রও নাকি সার টোবি বেলচের মারফৎ বলিয়াছেন- রুচিবাগীশেরা যাহাই বলুক মদ ও মেয়েমানুষ পৃথিবীতে বরাবরই ছিল, বরাবরই আছে, বরাবরই থাকিবে। এই আবিষ্কারের তরুন সাহিত্যকদের পৃষ্ঠপোষকমহলে ধণ্য ধন্য পড়িয়া গিয়াছে। কেহ তরুন বিপ্লববাদীদের গবেষণার প্রশংসা করিতেছেন, কেহ তাহাদের নব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধি ও মনীষার পরিচয় পাইয়া স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছেন, কে বা তাঁহাদের স্পষ্টবাদিতা, সাহস ও সত্যনিষ্ঠা দেখিয়া অভিভূত হইয়া পড়িয়াছেন।
আজ আমার মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি, জননী বঙ্গভূমি। আর তোমার কিসের দুঃখ মা! তোমার সন্তানের তপস্যায় আজ দেশে শ্লীলের, নীতির, ধর্মের-ভূতের ভগবানের, ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্মে’র মোহ ঘুচিল।
“বিঘ্ন বিপদ দুঃখদহন তুচ্ছ করিল যারা
মৃত্যুগহন পার হইল টুটিল মোহকরা
দিন আগত ওই, ভারত তবু কই”
ভারত তবু কই? ভারত তবু কই, অন্তত বাংলাদেশে তবু কই বলিয়া আক্ষেপ করিবার অধিকার আর আমাদের নেই। বাঙালীর ছেলেও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিতে জানে। সে মৌলিক গবেষণা করিয়া প্রমান করিয়া দিয়েছে সাহিত্য অশ্লীলের স্থান আছে, কালিদাসে অশ্লীলতা আছে !!! আপনারা সকলে হাততালি দিন।
কি শুভ মুহুর্তেই পৃথিবীতে আসিয়াছিলাম। আজ বাঁচিয়া আছি বলিয়াই ত বাংলা সাহিত্য নবীনের, তরুণের, বিদ্রেহের, অশ্লীলের অভিষেক দেখিতে পাইলাম।
“Biss was in that dawn to be alive,
But to be young was very heaven!”
বয়সে অথবা বুদ্ধিতে শিশু হইবার একটা মস্ত বড় সুবিধা এই যে তখন আদেখলেপনা করিতে কোন লজ্জা বা সঙ্কোচ বোধ হয়না। সেই বয়সে ঝাড়ের তিনকোনা কাচ হইতে আরম্ভ করিয়া কুমারসম্ভাবের অষ্টম সর্গে হরগৌরীর মিলনের বর্ণনা পর্যন্ত যাহা-কিছু একটা দেখিয়া হাঁ হইয়া যাইবার একটা অপরসীম, অফুরন্ত, দুর্নিবার ক্ষমতা থাকে। পৃথিবীতে যতই দিন কাটে, যতই অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হইয়া উঠে, ততই অবাক হইয়া যাইবার ক্ষমতাটাও কমিয়া আসে, ততই রাজা সলোমানের মত মনে হয়, হায়! চিরতরুনী পৃথিবীতে চিরবৃদ্ধায় রূপান্তরিত করাই যদি মনের পরিনতির, জ্ঞানের অভিজ্ঞতার ফল হয় তবে এমন জ্ঞানের, এমন অভিজ্ঞতার, এমন মানসিক পরিনতির কি প্রয়োজন ছিল? জ্ঞান যে দুঃখের হেতু। আর এই জগৎ-Vanity of Vanities, all is Vanity!
বৃদ্ধ হিন্দু-সামজেরও এই মত। কিন্তু সাহিত্যিক পূর্বাশার কোলে অশ্লীল ঊষার প্রথমও সলজ্জ রক্তরাগ ফুটিয়া উঠিয়াছে দেখিয়া যাহার পাখীর মত আনন্দকাকলী করিয়া নতুন দিনের আহবান করিতেছেন, তাহাদের উৎসাহ দেখিায় মনে হইতেছে এতদিনে বুঝি হিন্দু সমাজের বৃদ্ধ অপবাদ ঘুচিতে চলিল। অলঙ্কার ও কামশাস্ত্রের নির্দেশমত হাজার বৎসর ধরিয়া কাব্যের পর কাব্য শত শত শ্লোকে নরনারীর অশ্লীলতার নেশা লাগিয়া উঠিতেছিল না। আজ কি সে নিজের জরা আর কাহারও ঘাড়ে চাপাইয়া যযাতির মত যৌবন ও ভোগের কামনা ফিরিয়া পাইল, না সে মরিয়াছে? চৌর-পঞ্চাশৎ, অমরুশতক, শৃঙ্গরতশতকের নির্জলা ব্যান্ডিতে যাহার নেশা হইত না, সে আজ এক পয়সার বিড়ি খাইয়া নেশা করি বলিয়া বড়াই করিয়া বেড়াইতেছে, এ কথাটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। বৃদ্ধ হিন্দু সমাজ আর বাঁচিয়া নাই। সে পাড় মাতাল মরিয়াছে। তাহারই পোশাক পরিয়া এক অর্বাচীন ছোকরা বাপের হুকায় চুরি করিয়া এক টান দিয়াই ঘুরিয়া পড়িয়াছে।
‘কথামালা’ অথবা শ্রীযুক্তা অনুরূপা দেবীর উপন্যাসের পরই ‘গীতগোবিন্দ’ পড়িলে অবশ্য অশ্লীলতার নতুনত্বে অভিভূত হইয়া, কলম্বস যেরূপ আমেরিকা আবিষ্কার করিয়াছিলেন মনোজগতে তেমনি একটা নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করিয়াছি, একথা মনে করা স্বাভাবিক। কিন্তু যে অভাগা কর্মদোষ চরিত্রের এই সহজ, সরল, নির্বোধ অমায়িকতা হইতে বঞ্চিত হইয়াছে তাহার উপায় কি? তাহার কাছে যে অশ্লীলতাকে শ্লীলতার চেয়েও নতুনত্বহীন, বিস্বাদ ও ইতর বলিয়া মনে হয়। মনে হয় বলি কেন? অশ্লীলতা যে বাস্তবিকই অতিশয় পুরাতন ও অতি সুলভ। আজকালকার সাহিত্যিকদের ও তাহাদের বিদ্রোহবায়ুগস্থ পৃষ্ঠপোষকগণের ধারণা ছিল যে অশ্লীলতা প্রথম সৃষ্ট হয় তের-শ চৌত্রিশ সালে বাংলাদেশের কলিকাতা ও ঢাকা শহর। পরে এমন কি ভারতচন্দ্রেও অশ্লীলতা আছে, তখন তাহারা স্বপক্ষে এতগুলি বড় নজীর পাইয়া আহ্লাদে আটখানা হইয়া মৌলিকতার মায়া একেবারে কাটাইয়া ফেলিলেন। আমরা বলি সেকসপীয়র কালিদাসই বা কতদিনের মানুষ। অশ্লীলতা তাহাদের চেয়েও বহু পুরাতন। মানবসমাজে অশ্লীলতা পিরামিডের মত আচল অটল, কিন্তু পিরামিডের অপেক্ষাও প্রাচীন।
আমার যতদুর মনে পড়ে, মিশরের তৃতীয় ‘ডাইনাস্টি’র রাজা স্নেফুরা মিশরের প্রথম পিরামিড নির্মাণ করেন। এডুয়ার্ড মাইয়ুরের গণনা রীতি অনুসারে সে বড়জোর পাঁচ হাজার বৎসরের কথা। আর্টে প্রথম অশ্লীলতা দেখিতে পাই তাহারও অনেক আগে, কোয়াটারনারি যুগের শেষের দিকে, পুরাতন পস্তুর যুগের ওরিনাসিয়ান (Aurignacian) স্তরে। তখন আমরা মানুষ বলিতে যে জন্তুকে বুঝি (Homosapiens) সে সবেমাত্র পশ্চিম ইয়োরোপে দেখা দিয়েছে। মধ্য ইয়োরোপ তখনও চতুর্থ বরফ যুগের (Wurmian glaciation) শুভ্র তুষারে ঢাকা। হস্তী গণেশ (Elephas antiquus) অতিকায় হস্তী (Elephas primigenius), লোমাকৃত গন্ডার (Rhinoceros tichorhinus) বলগা হরিণ (Rangifer taradus) বাইসন (Bos-priscus), গুহাবাসী ভালুক (Ursus Spelaeus) তখনও ফান্সের পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সেই সুদুর অতীতে আমাদের বন্য পুর্বপুরুষেরা (Cromagnonrace) নগ্ন স্ত্রীমূর্তি গড়িয়া (Venus of Brassempony, Venus of Willendorf, Statuttes of Mentone, Vanus of Lassel ও অন্যান্য বহু মূর্তি) অশ্লীলতার চর্চা করিতেছিল। আশ্চর্যের কথা এই, তাহাদিগকে নবীন বাঙালী সমালোচক অথবা এরোপ্লেনের জন্য অপেক্ষা করিতে হয় নাই।
অশ্লীলতার সঙ্গে স্টীম এঞ্জিন, কমিউনিজম অথবা বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারের অম্ন সমস্যার কোনও সম্পর্ক আছে বলিয়া বিশ্বাস আমার কখনই ছিল না। কিন্তু আমার একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল, স্ত্রীপুরুষের দৈহিক মিলনের খোলাখুলি চিত্র হয়ত তরুণ সাহিত্যিকদের না হইলেও সভ্য মানুষেরই কীর্তি। দুঃখের কথা এই যে, এই আমাদের পুর্ববর্তী। সেদিন, নেচার পত্রিকায় পড়িলাম, ফ্রান্সের এক জায়গায় পুরাতন প্রস্তর যুগের একটি উৎকীর্ণ ফলক পাওয়া গিয়াছে। তাহাতে কয়েকটি মন্যুষ্যমুর্তি অধ্যাপক বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক মসিয় মার্সল্যে বুল প্রথমে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চিত্র বলিয়া ভ্রম করিয়াছিলেন। পরে তাহার সহকর্মী অধ্যাপক ডাক্তার ভোর্ণো খোদিত মুর্তিগুলির মাংসপেশী ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণ করিয়া প্রমান করিয়া দিয়াছেন ইহা প্রকৃতপক্ষে সঙ্গমের চিত্র।
মানুষের আদিম অশ্লীলতার সাক্ষী আতিকায় হস্তী, লোমাকৃত গন্ডার, গুহাবাসী ভালুক কত কাল হইল পৃথিবী হইতে লোপ পাইয়াছে। কিন্তু অশ্লীলতার সেই সনাতন সুরধনীটি আজও মানব সমাজকে সরস করিয়া বহিতাছে। তাহার কত রূপই দেখিলাম। আরব্য উপন্যাস (Dr. Mardrus-এর অনুবাদ), বোকাচচো ও বিদ্যাপতিতে অশ্লীলতার রোমান্টিক রূপ; অভিড, লঙ্গান, জয়দেব অশ্লীলাতর ক্লাসিসিজম, খাজুরাহো, কোনারক ও পুরীর মন্দিরের গায়ে, কাসানোভাতে অশ্লীলতার বহ্মবাদ, কনগ্রিভ, ওয়াইচার্লি, ভলতের, ভারতচন্দ্রে অশ্লীলতার নাগরিক রূপ; রাবলে, দ্যা ব্র্যাতোম ও শ্রীশ্রীকৃষ্ণকীর্তনে অশ্লীলতার গ্রামতা।
ভবিষ্য অশ্লীলতা কি রূপ ধরিয়া সাহিত্য দেখা দিবে, মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি না হইলেও আমরা সে বিষয়ে একটি আন্দাজ ফেলিতে পারি। বর্তমানে যুগ গণতন্ত্রের যুগ। গণতান্ত্রিক জগতে বিদ্যাপতি, ভারতচন্দ্র, জয়দেব, কাসানোভার অভিজাত অশ্লীলতার স্থান নাই। রাষ্ট্রে ও সমাজে “অ্যারিস্টোক্রেট’ ও ‘ক্যাপ্টিট্যালিস্ট যে পথে গিয়াছে অশ্লীলতার জমিদারদিগকেও সেই পথেই হইবে। অশ্লীলতার অভিজাতদিগের সম্মুখে অশ্লীলতার মুখে-মজুররা আর মাথা নীচু করিয়া থাকিবে না। কেরানীতে কেরানীতে স্ত্রীলোক সম্বন্ধীয় আলাপ, সমপাঠিনী সম্বন্ধে কুসংস্কার বর্জিত কলেজের ছেলের চাপাগলায় মন্তব্য, দেয়াল পেন্সিল দিয়া লেখা নির্ভীক সত্যনিষ্ঠ শিলালিপি, দৈনন্দিন জীবনের এই সকল অনাম্বর সাদাসিদে, ছোটখাটো, বস্ততান্ত্রিক অশ্লীলতাকে উপকরণ করিয়া অশ্লীলতার প্রোলোটারিয়ান রূপ নতুন কিছু করিয়াছেন বলিয়া বড়াই করিতে পারিবেন না। অশ্লীলতার সহস্র রূপের কথা বলিবার সময়ে আমি সম্রাট নিরোর আমাত্য পেট্রোনিয়াসের রচিত ‘স্যাটিরিকনের‘ কথা ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। বাস্তব ও বস্তিবাসী অশ্লীলতারও আর মৌলিকতা নাই। ’Tis to late to be ambitious’ আমাদের সাহিত্যিকরা জন্মগ্রহণ করিতে প্রায় এক হাজার আটশত সত্তর বৎসর দেরি করিয়া ফেলিয়াছেন আবার শুনিলাম বৎসর সাতেক আগে মিঃ জেমস জয়েসও এই পতিত জমিটুকু ভাল করিয়াই চাষ করিয়াছেন। সত্যই নতুন কিছু নাই। Is there anything where of it may be said, see, this is new? It hath been already of old time, which was before us.
॥২॥
“দেখিলাম ভোর হইয়াছে এবং মোহর আলী এই ঘোর দুর্যোগের দিনেও যথানিয়মে প্রাসাদ প্রদক্ষিণ করিয়া তাহার অভ্যস্ত চীৎকার করিতেছে। হঠাৎ আমার মনে হইল, হয়ত ঐ মেহের আলিও আমার মত এক সময় এই প্রসাদে বাস করিয়াছিল, এখণ পাগল হইয়া বাহির হইয়াও এই পাষাণ রাক্ষসের মোহে প্রত্যহ দক্ষিণ করিতে আসে।
“আমি তৎক্ষণাৎ সেই বৃষ্টিতে পাগলার নিকট ছুটিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, মেহের আলি, ক্যা ঝুট হ্যায় রে?
‘মেহের আলি, ক্যা ঝুট হ্যায় রে’?
“সেই আমার কথায় কোন উত্তর না করিয়া আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া আজগরের কবলে চতুর্দিকে ঘূর্ণ্যমান মোহবিষ্ট পক্ষীর ন্যায় চীৎকার করিতে করিতে বাড়ির চারিদিকে ঘুরিতে লাগিল। কেবল প্রাণপণে নিজেকে সর্তক করিবার জন্য বারংবার বলিতে লাগিল-তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়, সব যুট হ্যায়।”
রবীন্দ্রনাথ
ক্ষুধিত পাষাণ, গল্পগুচ্ছ
সকলেই জানেন যীশুকে যখন বন্দী করিয়া পীলাতের সম্মুখে আনা হয়, তখন পীলাতের প্রশ্নের উত্তরে যীশু বলেন, আমি সত্যকে প্রচার করিবার জন্য এই পৃথিবীতে আসিয়াছি। সে সত্যকে চায়, তাহারই কানে আমার বানী প্রবেশ করিবে।” শুনিবার জন্য আক্ষেপ করিলেন না। কথাটা হয়ত শুনিতে খারাপ, তবুও স্বীকার না করিয়া পারিনা যে, আমি পীলাতের দলে। পীলাত শুধু সত্যকে জানা সম্ভবপর নয় এই সংশয় প্রকাশ করিয়াছিলেন। আমার অবিশ্বাস আর দূরগামী। মানুষ সত্যকে জানিতে চায়, মানুষের জীবনযাত্রার জন্য সত্যের কোনও প্রয়োজন আছে, এই দুইটি কথার একটি কথায়ও আমার আস্থা নাই। সত্যান্বেষী হওয়া আর আত্মঘাতী হওয়া যে একই জিনিস তাহার একটি প্রমাণ সেদিন পাইলাম। এক বিলাতী পত্রিকায় ডাক্তার ফ্রয়েডের কয়েকটি কথা বাহির হইয়াছে। ডাক্তার ফ্রয়েড নাকি বলিয়াছেন, আমার আর বাঁচিতে ইচ্ছা নাই। জীবন বড়ই দুঃখময়। যতই দিন কাটিতেছে আমার এ বিশ্বাস ততই দৃঢ় হইতেছে। যিনি মানুষের রহস্যময় জীবনের মূল সত্যটি আবিস্কার করিয়াছেন, যিনি পৃথিবীর নরনারীকে নিষ্ঠুর মানসিক ব্যাধির হাত হইতে মুক্তির পথ দেখাইয়া দিয়েছেন, তাহার মুখে এ কি কথা? হায় বৈজ্ঞানিক! সত্যের জলধিতে স্নান মানবজীবনের শেষ কথা, তারপর আর কোন রহস্য নাই এই কথাটি জানিয়াছে বলিয়াই কি জীবন তোমার কাছে এত বিস্বাদ, এত নীরস, এত তিক্ত হইয়া গিয়াছে?
শিকার করিতে গিয়া, দৈবক্রমে স্নানরতা আর্টেমিসের অনাবৃত দেহ দেখিয়া ফেলিয়াছে বলিয়া নিষ্পাপ অক্টেয়ন নিজের কুকুরের দংশনে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া প্রাণ হারাইল। বিজ্ঞানবিদকেও জীবনের আর্টেমিসের অভিশাপ লাগিয়াছে। যে প্রেম জীবনের উৎস তাহাকে সাদা চোখে দেখিয়া কেহ জীবনে আস্থা রাখিতে পারে নাই। মসিয় ফ্রান্সের মোরিয়াকের কথায়,বুদ্ধির কাছে প্রেম তো le desert de l’amour প্রেমের মরুভূমি। প্রেমের প্রকৃত রূপ কি সেই বুদ্ধি দিয়া যে বুদ্ধি জীবধর্মের স্পর্ধা আছে তাহার জন্য কি প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে না।
সত্যের মধ্যে কোন সান্তনা নাই, রহস্য ও কল্পনাই জীবনকে মধুময় করিয়া রাখিয়াছে এ কথাট আমি আগেই বলিয়াছি। আজ শুধু একটা সুপরিচিত দৃষ্টান্ত দিয়া এই মোটা কথাটা বুঝাইয়া দিবার চেষ্টা করিব। নারীদেহের আকর্ষণ কত প্রবল তাহার আমরা সকলেই বোধও করি। কিন্তু আজ যদি পৃথিবীর সকল নারী বস্ত্র ত্যাগ করিযা স্বাভাবিক অবস্থায় ঘুরিয়া বেড়াইতে শুরু করিত তবে কি নারীদেহের সেই মাদকতা থাকিত? আমার দেখিত পাই, যে নারীর অঙ্গে বস্ত্রাদি যত বেশী তাহার আকষণ ও তত বেশী। মেয়ে স্কুলের ছাত্রী। অল্পবয়স্ক সাহিত্যিকদিককে স্পষ্টত ও ইঙ্গিত অনেক সময়েই মেয়ে স্কুলের ছাত্রীদের উন্মাদকর মোহ ও আকর্ষনের কথা বলিতে শুনি। ইহার কারণ আর কিছুই নয়, নবীনা বিদুষীদের পোষাক।
সেকেলে মেয়েদের একখানা শাড়ীর জায়গায ইহারা দশখানা কাপড় পরেন, কম্বিনেশনের উপর সেমিজ, সেমিজের উপর বডিস ও পেটিকোট, বডিস ও পেটিকোটের উপর ব্লাউজ ও শাড়ী, তাহার উপর আবার মাঝে মাঝে কার্ডিগান অথবা ফারকোট, ভেলভেটের নাগরা দিয়া পা দুটি ঢাকিয়া দিবার ও চুল টানিয়া দিয়া কান দুটি ঢাকিবার কথা নাই বলিলাম। সত্যকে এতগুলি ভারী ভারী জামা কাপড় দিয়া চাপা দেওয়া হইয়াছে বলিয়াই তো এই সত্য মধুর, এত মোহময় হইয়া উঠিয়াছে। মেডিকেল কলেজের ডিসেকশন টেবিলের উপর অনেক নগ্ন সত্য পড়িয়া থাকে। তাহাদের উদ্দেশ্যে কবিতা লেখা হইয়াছে, এমন কথা তো আজ পর্যন্ত শুনি নাই।
জামা-কাপড়ের উপরই যে নারীদেহের আকর্ষণ নির্ভর করে একথা নতুন নয়। এই সহজ সত্যটি অ্যানথ্রপলজিস্ট মাত্রেরই সুপরিচিত। ওয়েস্টরমার্ক তাহার বিখ্যাত গ্রন্থে এই বিষয়টির বিস্তৃত আলোচনা করিয়া দেখাইয়াছেন নারীদেদেহকে পুরুষের কাছে, পুরুষের দেহকে নারীর কাছে কৌতুহলের বিষয়ে পরিণত করিয়া লোভনীয় করিয়া তুলিবার জন্যই পোশাক ও অলঙ্ককারের ব্যবহার মনুষ্যসমাজে প্রচলিত হইয়াছে। পৃথিবীতের অর্ধেক রূপমোহ, অর্ধেক লাম্পট্য বস্ত্র-ব্যবহারের আনুষঙ্গিক ব্যাপার।
রহস্যের মধ্যে যে জীবনের মাধুর্য এ কথাটা আমাদের সাহিত্যিকরা জানেন না তাহাই বা কি করিয়া বলি? তাহাদিককে তো স্থানে অস্থানে যখন তখন মোনালিজার Inscrutable হাসির কথা বলিতে শুনি। তাই এক একবার আশ্চর্য হইয়া ভাবি এই সত্য কথাটা জানিয়াও ইহারা দুঃশাসনের মত নর নারীর দৈহিক সম্বন্ধের বস্ত্র হরণ করিবার জন্য লাগিয়া গিয়াছেন কেন! তাহারা কি আসলেই রূপমোহকে, প্রেমকে, জীবনকে বিজ্ঞানের হাড়িকাঠে বলি দিয়া সত্যকে জানিবার জন্য বদ্ধ পরিকর, না তাহাদের এই চেষ্টার মধ্যে একটা গোপন ও অজ্ঞানকৃত আত্মপ্রবঞ্চনা আছে।
আত্মপ্রবঞ্চনা যে কোথাও আছে তাহার এই তিনটি প্রমান পাইয়াছি। একসময়ে আমাকে একটি জায়গায় থাকিতে হইত। সেই বাড়ীতে যাহারা থাকিতেন তাহাদের বিজ্ঞানের প্রতি গভীর আসক্তির কোনও লক্ষণ দেখিতে পাই নাই, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানেরও কোন পরিচয় পাই নাই। তাহাদিগকে দুই একবার প্রশ্ন করিয়া দেখিয়াছি, তাহারা চন্দ্র সুর্যের চারিদিকে ঘুরে কি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে এই বিষয়ে কোনও সুস্পষ্ট ধারণা পোষণ করিবার প্রয়োজন বোধ করিতেন না। কিন্তু একদিন দৈবক্রমে সেই বাড়িতে ছয় খন্ড হ্যাভেলক এলিস আসিয়া পড়াতে তাহাদের সুগভীর আমুন্ডসনের দক্ষিণ মেরু আবিস্কারের জন্য প্রতিযোগিতার কথা মনে পড়িয়া গেল। তখন বুঝিলাম মানুষের জড়বিজ্ঞানের প্রতি আসক্তি থাকিতে পারে। সম্প্রতি এই সত্যটিকে আবার প্রত্যেক্ষ করিয়াছি। আমার পুস্তক-বিক্রেতার কাছে শুনিলাম অনেক তাহার কাছ হইতে প্রত্যেক ভলিউমের জন্য পাঁচ টাকা হারে ভাড়া দিয়া হ্যাভেলক এলিসের সুবিখ্যাত গ্রন্থখানা পড়িতে লইয়া যান। যে বাঙালী পাঠক বৎসের পাঁচ টাকার কিনিতে পারেন না, তাহার পক্ষে বিজ্ঞানের জন্য এই কষ্ঠস্বীকার বড়ই আনন্দ ও গৌরবের বিষয়। এই জ্ঞানপিপাসা যে পুরুষদের মধ্যেই আবদ্ধ তাহা নহে। কলিকাতার কোন বিখ্যাত বালিকা বিদ্যালয়ের অবিবাহিতা ছাত্রীদের মধ্যে কোন এক বিশেষ প্রকারের ছবি ক্রয়বিক্রয় হয় বা হইত তাহার অন্তত একটি প্রমাণ আমরা পাইয়াছি।
আজ শুধু মনে পড়িতেছে সেন্ট জনের সেই উক্তি, আর তাহাকে স্মরণ করিয়া প্যাস্কেলের খেদ! “All that there is in this is lust of the eyes, lust of the flesh and pride of life. Unhappy and accursed is the land through which flow these three rivers of fire.”
না না, মানুষের কি দোষ? ক্ষুধিত পাষাণের বক্ষে তিন রাত্রি কাটাইয়া কে কাহার মোহে অজগরের কবলে চর্তুদিকে ঘূর্ণায়মান মোহবিষ্ট পক্ষীর ন্যায় ছুটিয়া যায় নাই? বৃহৎ প্রসাদের পাষাণ-ভিত্তির তলবতী একটা আর্দ্র অন্ধকার গোরের ভিতর হইতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতেছে, তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও, কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া আমাকে লইয়া যাও, আমাকে উদ্ধার কর। আমি কে? আমি কেমন করিয়া উদ্ধার করিব? আমি এই ঘূর্ণ্যমান, পরিবর্তন স্বপ্নপ্রবাহের মধ্যে হইতে কোন কামনাসুন্দরীকে তীরে টানিয়া তুলিব?
এই আকুল আহ্বান মিথ্যা কামনার এই তীব্র অনুভূতি মিথ্যা ইহা জীবধর্মের মায়াজাল মাত্র, এই কথাটা মানুষ বিশ্বাস করিতে জিনিস নাই। দর্শনে বিজ্ঞানে আমরা জীবধর্মেরই দাস। তবু মিথ্যা এই সত্যের বড়াই করিয়া বেড়াইতে হইবে এইটাই সবচেয়ে নিদারুণ পরিহাস।
মানুষের চেতনা ও বুদ্ধি নরনারীর সম্পর্ক সম্বন্ধে সর্বদাই এরূপ সজাগ ও তীক্ষ্ম হইয়া রহিয়াছে কেন, উহার একটা গূঢ় কারণ আছে। মানুষের মধ্যে শুধ মানুষের মধ্যে বলি কেন, সকল প্রাণীর মধ্যেই এই বৃত্তটি অল্পবিস্তর দেখিতে পাওয়া যায় সকল প্রাণীর মধ্যেই প্রজনন-সংক্রান্ত মুখ্য ও গৌন ব্যাপারগুলিকে গোপন করিয়া রাখিবার একটা অভ্যাস আছে। অস্ট্রেলিয়ার আদিম অদিবাসীরা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বর্বর ও অনুন্নত জাতি। তাহাদের মধ্যেও এক দীক্ষা ও দুই একটি বিশেষ উৎসবের সময় ব্যতিত প্রকাশ্যে সঙ্গত হইবার প্রথা নাই। তাহার কারণ নিছক কাম একটা অসুন্দর (Unaessthetic) বৃত্তি। শুধু তাহার সাহায্যে জীবের বংশরক্ষা হইবার উপায় নেই। প্রাণী বীভৎস জিনিসের প্রতি স্বভাবগত আকৃষ্ট হয় না। উদ্দীপিত রাগ অবস্থায় সুন্দর-অসুন্দর বোধ না থাকিলে ও রাগের উদ্দীপনার জন্য সুন্দরের প্রয়োজন আছে। পশু পক্ষীকেও বংশরক্ষার জন্য Secondary sexual character এর aesthetic আবরণের আশ্রয় লইতে হয়। মানুষের পক্ষে এই ছদ্মবেশের প্রয়োজন আরও বেশী।
তাই যদি কেহ জীবজন্মরে হেতু এই গোপনীয় বৃত্তিগুলিকে অনাবৃত করিয়া দেখাইতে চায় তখনই আত্মরক্ষার সংস্কারের আঘাত লাগে। জীবধর্ম পালনের জন্য এই রহস্য ও সৌন্দর্যের ফাঁদ পাতিবার বৃত্তিতেই শ্লীলতা ও অশ্লীলতার বোধের উৎপত্তি। অশ্লীলতা ও দুর্নীতি এক জিনিস নয়। হত্যা, চুরি অথবা ব্যভিচার আমাদের নীতিজ্ঞানে আঘাত দেয় কিন্তু শ্লীলতাবোধকে ক্ষুন্ন করে না। নরনারীর দৈহিক আকর্ষণ সম্বন্ধে খোলাখুলি কথা আমাদের শ্লীলতাবোধে আঘাত দেয়। নীতিজ্ঞান সামাজিক বৃত্তি, শ্লীলতাবোধে দৈহিক বৃত্তি। সেই জন্যই এই দুয়ের মধ্যে শ্লীলতাবোধই বেশী প্রাচীন ও শক্তিশালী।
স্ত্রী পুরুষের সম্পর্কের নিগুঢ় ব্যাপারগুলিকে গোপন করিয়া রাখাই যদি নৈসর্গিক ধর্ম হয় তবে মানুষ এই বিষয়গুলি লইয়া আলোচনা করিতে এত ভালোবাসে কেন, গোপন মারি স্টোপস, হ্যাভেলক এলিস, বাৎস্যায়ন পড়িবার জন্যই তাহার আগ্রহ, কেন? ইহার কারণ মানুষের নিষিদ্ধ জিনিসে প্রতি লোভ। মেন্ডেলিজম সম্বন্ধে যাহার একটু আধটু আলোচনা করিয়াছেন তাহারা জানেন যে জীবের কতগুলি ধর্ম এক একা থাকে না, জোড়ে জোড়ে থাকে। নর নারীর দৈহিক সম্বন্ধের রহস্যকে গোপন করিয়া রাখিবার অভ্যাস ও সেই দৈহিক সম্বন্ধে আলোচনা করিবার ইচ্ছা, এই দুইটি জিনিস পরস্পরবিরোধী হইলে মেন্ডেলীয় ধর্মের মত মানুষের মনের একটি যুগ্মবৃত্তি। বিশুদ্ধ অশ্লীলতা আমার দেখিতে পাই শিশুর মধ্যে. অথবা ইংরেজীত যাহাকে exhibitionism রোগগ্রস্থ ব্যক্তির মধ্যে। শিশুদের একটা স্বাভাবিক অশ্লীলতা আছে। যা কেহ শিশুদের সংসর্গে আসিয়াছেন, তিনিই জানেন যে শিশুর হঠাৎ বিনা কারনে, বিনা উদ্দেশ্যে অত্যন্ত অশ্লীল কথা উচ্চারণ, অশ্লীল চিত্র অঙ্কন অথবা অম্লীল অঙ্গভঙ্গী করিয়া বসে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এ স্বাভাবিক অশ্লীলতা কাটিয়া গিয়া আর একটি রহস্যময় অশ্লীলতা মানুষকে পাইয়া বসে।
যৌবনোন্মুখ বালক-বালিকার মধ্যে স্ত্রী পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক সমদ্ধে একটা অদম্য কৌতুহল, নিজের জীবনে ইহাকে প্রত্যেক করিবার জন্য একটি উন্মত্ত আকাঙ্খা থাকে। এই গভীর মানসিক বৃত্তির সাধারন প্রকাশ শ্লীলতাবিরুদ্ধে রসিকতায়। অশ্লীতা মানবজীবনের একটা স্বাভাবিক ধর্ম তাহাকে ঘরের একাকোণে কোথাও একটু স্থান দিতে হইবে, এই দুইটা কথা স্বীকার করিবার মত সাহস মানুষের যতদিন পর্যন্ত ছিল ততদিন অশ্লীলতাকে দর্শন, বিজ্ঞান, লোকহিত, বিপ্লববাদ, সাহিত্যের আশ্রয় লইতে হয় নাই। কিন্তু সভ্য মানুষ অতি সহজেই জায়গাই আত্মপ্রবঞ্চনা করিতে পারে, তাই আজ সে পুরাতন হাস্যপরায়ণ অসভ্য রসিকতার জায়গায় একটি বর্ণচোরা সহজে জীবধর্ম পালন করিতেছে। শুধু এইটুকুর মধ্যে গৌরব কোথায়? মানুষ যুগ যুগ ধরিয়া এই রহস্যের আলোচনা করিয়াছে তবুও সে সত্যকে পায় নাই, তাহার কৌতুহলও নিবৃত্ত হয় নাই। পাওয়ায় ও না পাওয়ায়, বিরহে ও মিলনে দেহের এই রহস্য নর নারীর জাগরণ ও সুপ্তিকে দুঃস্বপ্নের মত ব্যাপিয়া আছে।
“For days together we have desired to crush a body on our bosom we have belived that a body can be possessed. And here it is at last. with us, we burn and our blood is on fire. By the science of carreses our hands see it; our eyes touch it; is does not defened itself.
It is given to us wholly, entirely. We are one with it. We drink its breath, yet we do not possess. The fierce tide rushes on, beats the living wall, passes over it, comes back, but finds it no more. We said, ‘We thought we had surprised the mysterious movements of the knees, revealed the secret of that which links the shoulders’. But the last inventions of volupte are but vain pursuits. Never, never .shall we find that body we seek”.
(Francois Mauriac, Fleuve do Feu. p. 123-24)
মানুষরে বুদ্ধি অনেক রহস্য ভেদ করিয়াছে, আরও অনেক রহস্য ভেদ করিবে, কিন্তু যে রহস্য তাহার কল্পনায়, তাহার রহস্য সে বেধ করিবে কি করিয়া? যদি কোনদিন মানুষের চোখের সম্মুখে হইতে এই মিথ্যার যবনিকাটুকু সরিয়া যায়, তবে সে সত্যের দেখা পাইবে, কিন্তু জীবনের বিনিময়ে।
“If a man got hold of truth, the sole truth as it is known to God and let it fall from his hands, the world will be annihilated by the shock and the universe will melt away like a dream. Divine truth like a last judgement will reduce it to powder.”
ডাক্তার ফ্রয়েডের কি সেই চরম সত্যের সন্ধান মিলিয়াছে?
॥৩॥
“Poetry may have also an ulterior value as a means to culture or religion because it conveys instruction or softens the passions, or furthers a good cause ; because it brings the poet fame, or money or a quiet conscience. So much the better let it be valued for these reasons too. But its ulterior worth neither is nor can directly determine its poetic worth as a satisfying imaginative experience and this is to be judged entirely from within. The consideration of ulterior ends, whether by the poet in the act of composing or by the reader in the act of experiencing, tends to lower poetic value. It does so because it tends tochangethe nature of poetry by taking it out of its own atmosphere. Fro nature is to be not part, nor yet a copy, of the real worid as we commonly understand that phrase), by itself, independent complete, autonomous.
AC Bradley
Oxford Lectures on Poetry
মানুষের প্রথম আবির্ভাব হইতে আজ পর্যন্ত অশ্লীলতার চিরজয়যুক্ত অভিযান দেখিয়া আমার মনে হয় মানুষের একটা নতুন সংজ্ঞা জাগিয়াছে। লিনিউস বলিয়াছেন, মানুষ Homo sapiens অর্থাৎ বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন জীব। বার্গস বলি মানুষ হোমোসাপিয়েনসও নয় হোমোফায়েরও নয়, মানুষ প্রকৃতপক্ষে হোমো অশ্লীলেনসিস। মানুষ ও অন্যান্য জন্তুর মধ্যে একটা বড় রকমের দেহগত বৈষম্য আছে এ কথাটা ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে হাকসলীর জীব জগতে মানুষের স্থান বইখানা প্রকাশিত হইবার পর আর চলে না। আধুনিক মনস্তত্বাবিদদের গবেষণার ফলে মানুষ ও অন্যান্য জন্তুর মধ্যে বুদ্ধিগত বৈষশ্যে দেয়াল ও বুঝি ভাঙিয়া পড়ে।
তবে মানুষের বৈশিষ্ট্য কোথায়? মেচনিকফ বলেন,
All attempts to demonstrate the presence in the human brain of parts that were abesent in the simian brain have failed. It is a curious fact that man displays a more marked difference from monkeys in the structure of the reproductive system than in the structure of the brain.
(Elie Metchnikoff, Nature of man, P.81)
মানসিক বৃত্তির দিক হইতে আমি বলি, অশ্লীলতা করিবার ও অশ্লীলতাবোধের ক্ষমতাই মানুষের বিশিষ্ট লক্ষণ। ইহাও সেই প্রজনন সংক্রান্ত function-এরই কথা। সেই জন্যই বোধ করি ডাক্তার ফ্রয়েডও বলিয়াছেন Sex-ই মানুষের কর্ম ও চিন্তুার এক ও অদ্বিতীয় উৎস।
মনুষ্য-সমাজে অশ্লীলতা আছে এই কথাটা এত সুপরিচিত যে ইহার পুনরাবৃত্তি একমাত্র শিশুর মুখেই শোভা পায়। এখন প্রশ্ন এই, সাহিত্য ইহাার স্থান আছে কি? আর যদি স্থান থাকিয়া থাকে, তবে কি শর্ত আছে? আমাদের সমালোচকেরা যখন বলেন, সাহিত্য এই জিনিসটির স্থান আছে তখন আমি ইহাদের সরলতা দেখিয়া মুগ্ধ হই। আবার যখন তাহারা বলেন, এই জিনিসটি বাস্তব সত্য সেই জন্যই সাহিত্য ইহার স্থান আছে তখন আমি ইহাদের সরলতা দেখিয়া একেবারে অভিভূত হইয়া পড়ি। আমি শুধু জিজ্ঞাসা করিতে চাই, সাহিত্য কোন জিনিসের স্থান নাই স্ত্রী-পুরুষের আকর্ষণ জীবনের একটা খুব বড় ব্যাপার, ইহার আপেক্ষা কত ছোট খাটো সমান্য ব্যাপার লাইয়া ও তো কত কবিতা, কত গল্প, কত উপন্যাস লেখা হইয়াছে। যে গোরদিগকে দেখিলে আমাদের প্রাণে কবিত্বের উদয় হওয়া দূরে থাকুক, দিগ্বিদিক কবিতা লিখিয়াছেন, ভেরহেরন বর্তমান জগতের কলকারখানা লইয়া কবিতা লিখিযাছেন লুক্রেশিয়াস “নেসার অফ থিঙ্গস” এর রহস্য উদঘাটনকেই তাহার কাব্যের প্রেরণা করিয়া লইয়াছেন মি এইচ জি ওয়েলস ও অন্যান্য লেখকদের কথা বলা নি®প্রয়োজন। বিষয় নির্বাচন সম্বন্ধে মোটা কথাটা এই, লেখক জগতের যে কোনও জিনিস লইয়া যাহা খুশী লিখিতে পারেন শুধু তাহাকে কৃতকার্য হইতে হইবে, র্অথাৎ তাহার রচিত বিষয়কে আর্টের কোটায় নিয়া ফেলিতে অধিকার নাই। যিনি যত বড় বিষয়বস্তু নির্বাচন করিয়া লইবেন, অকৃতকার্য হইলে তাহার অকৃতকার্যতাও তত বড় হইয়া দেখা দিবে। আপনার অবশ্য আমাকে জিজ্ঞাসা কথাটারই বা অর্থ কি? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলিব র্আট অর্থে আমি রূপান্তর বুঝি। রূপান্তর অর্থাৎ ”those various transmutations which forms undrogo in becoming part of aesthetic construction” কথাগুলি ইংলন্ডরে সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্র সমালোচক মিঃ রাজার ফ্রাই-এর।
বাস্তব জীবনে আমরা যাহা কিছু দেখি, তাহার ফটোগ্রাফ যেমন চিত্রকলা নয়, বাস্তব জীবনে আমরা যাহা কিছু দেখি, যাহা কিছু শুনি, যাহা কিছু প্রত্যেক্ষ করি, তাহার বর্ণনা ও তেমনি সাহিত্য নয়। জ্যামিতির সত্য ও আর্টের সত্য প্রায় একদরের জিনিস। দুইয়রেই বাস্তবের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকিয়াও সমন্ধ নাই। একটি দৃষ্টান্ত দিলেই আমি কি বলিতে চাই তাহা পরিস্কার হইবে। আমরা পথে মাঠে ঘাটে কত ধ্বনি তো শুনিতে পাই। যদি কালের সাহায্য সেই ধ্বনিগুলিকে রেকর্ডে আবদ্ধ করিয়া দেওয়া যায় তাহা হইলেই কি সেই ধ্বনিগুলির সমষ্টি সঙ্গীত হইয়া উঠিবে? বাস্তবে জীবনের ধ্বনি হউক, রং হউক, মানষকি অবস্থা হউক, রূপ হউক, ঘটনা হউক যে কোন জিনিসকে উপাদান করিয়া একটি বিশিষ্ট ধরনে সাজাইয়া দেওয়ার নামই আর্ট। সাহিত্যের উদ্দেশ্য রসের সৃষ্টি “to rouse emotion by rhythmic change of state of maid to the meaning of word“ এই কথাটার বিস্তৃত আলোচনা করিবার সময় আজ আর নাই। তাই প্রফেসর ল্যাসেলস এবারক্রম্বিয় একটা বচন উদ্ধৃত করিয়াই আজ ক্ষান্ত হইব। মিঃ এবারক্রম্বি বলিয়াছেন অArt is perfection of experience. জীবনে যাহা কিছু অর্সম্পূণ খন্ড খন্ড বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত, অপূর্ণ অবস্থায় আছে তাহাকে পূর্ণ, অখন্ড, একীভূত করিয়া একটা ‘আইডিয়েল’ (significance) দেওয়াই আর্টের উদ্দেশ্য। কিন্তু এই significance রসের, তথ্যের নয়।
আর্টের এই সংজ্ঞা অনুসারে নবীন সাহিত্যিকরা আর্টিস্ট নন, এ কথা বলিবার সাহস আমার নই। তাহারাও বাস্তাবের অসম্পূর্ণতাকে আর্টিস্টিক পূর্ণতা দিতে পারেন।
“বাংলার কোনে বসে বিপুল জগতের সঙ্গে কথা কই, Tolstoy মেঝের ওপর পা ছড়িয়ে বসে Dostoevsky কাঁধের ওপর হাত রেখে দাড়িয়ে মধুর কর হাসে, রাতের খাবারটুকু Gorkeyর সঙ্গে একত্র খাই Hamsum হাটুতে হাটু ঠেকিয়ে বসে বন্ধুর মতো গল্প করে যায় জ্বরে কপালে Bojer তার কোমল হাতখানি বুলিয়ে দেয় নীল সাগরের কল্লোলিত মায়া তার চোখে, (Anatole) France কতদিন আমার এই ঘরে বসে জিরিয়ে গেছে। সেদিন কুটে কালো ঝড়ো মেঘের মতো Browning এসেছিল -সঙ্গে Barrett রুখু মাথা- রোগা চোখে অপূর্ব বিষন্নতা; ঘরে ঢুকেই বল্লে, আমাদের একটু জায়গা রুখু মাথা, রোগা চোখে অপূর্ব বিষন্নতা; ঘরে ঢুকেই বল্লে, আমাদের একটু জায়গা দিতে পার এখানে? কতদূর থেকে পালিয়ে এসেছি। তিনজন মেঝের ওপর বসে কত গল্প করলাম।“
উপরের দৃষ্টান্তটিকে আমি সাহিত্য বলিয়া স্বীকার করি। কারণ, এখানে লেখক বাস্তবকে অতিক্রম করিয়া আর্ট লোকে পৌছেয়া গিয়াছেন। জীবনে এরূপ অখন্ড, সম্পূর্ণ অন্যরসবর্জিত, নিটোল, বিরাট নির্বুদ্ধিতা দেখিতে পাইবার সৌভাগ আমার হয় নাই, কাহারও হইয়াছে বলিয়াও বিশ্বাস করি না। বাস্তব জীবনে যে হতভাগ্য এতগুলি নাম অন্তত মুখস্থ করিতে পরিয়াছে, সে হাজার বুদ্ধিহীন হইলে এতদুর কান্ডজ্ঞানশূণ্য হইবে না, এ কথাটা আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি। কিন্তু আর্টের মূল্য, আটের সার্থকতা তো বস্তুতন্ত্রের মধ্যে নয়। লেখক বাস্তবকে রূপান্তরিত করিয়া হাজার গোলাপ চোয়ানো একফোঁটা আতরের মত একবিন্দু ‘ইডিয়সি রস’ বাহির করিতে পরিয়াছেন। এই সফলতার মধ্যেই তো তাহার গৌরব।
যদি আমাদের সাহিত্যকরা অন্যজাতীয় রসসৃষ্টিতে সমান ক্ষমতার পরিচয় না দিয়া থাকেন তবে তাহাদের লজ্জিত হইবার কোনও কারণ নাই। সকল ব্যক্তির ও সকল জাতির রসও রূপানুভূতি এক প্রকারের হয় না। মিঃ রজার ফ্রাই বালিয়িাছেন কিউব প্রাশ্চাত্য জাতির সিলিন্ডার অথবা ওভরেড প্রাচ্য জাতির রূপানুভুতির বৈশিষ্ট্য। রসানুভুতির হয়ত এরূপ হইক আমাদের নবীন সাহিত্যেকদের হাত একটি বিশেষ রসে পকিয়া গিয়াছে। সেইজন্য তাহাদের সকল রসসৃষ্টির পিছনেই এই আদি ও অকৃত্রিম রসটি উকি মারিতে চায়। তাহারা করুন রস সৃষ্টি করিতে গিয়া লেখেন ট্রাম চলে লোহার চাকায় লোহার লাইন দুটো পিষে পিষে।” কি মর্মন্তদ বেদনা নীচের উদাহরণটিতে আমাদের কামানল প্রদীপ্ত করিয়া তুলিবার জন্য একটা সুস্পষ্ট চেষ্টা দেখিতে পাই
“দুই হাত দিয়ে পদ্মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর মিঠে মুখখানা আমার মুখের উপর, ওর নরম বুক আমার বুকে এসে লাগছে তার নীচে ওর ছোট্ট হৃদয়ের ভীরু শব্দটুকু শুনিতে পাচ্ছি। লতার মত ওর হাত দুটি আমায় ঘিরে মধুর গন্ধ, পদ্মার বুকে মদের গন্ধ, পদ্মার সর্বাঙ্গে আমার দেয়া ফুলের গন্ধ।”
“তারপর পদ্মা আমার মুখে চুমো দিলে, আবার চুমো দিলে আবার চুমো দিলে, পদ্মা আমায় চুমো দিলো, আমায়, আমায়, আমায়।”
কিন্তু এখানে লেখকের দিক হইতে, নায়কিাকে চুম্বন লাভ করিয়া নায়কের কত দূর বুদ্ধিভ্রংশ হইতে পারে তাহা দেখাইয়া একটা ভাবা গঙ্গারাম রস সৃষ্টি করিবার গৌণ উদ্দেশ্য থাকায় শৃঙ্গার রসের ব্যভিচার ঘটিয়াছে।
এখন সত্যানুসন্ধানের কথা বলি। বিখ্যাত ফরাসী কবি মসিয় পল ভালেরী এক জায়গায় বলিয়াছেন যে, কাব্যের সমালোচনা করিতে গিয়া লোকে যখন দার্শনিক কবি এইরূপ শব্দের ব্যবহার করে তখন তাহারা দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বিসম্বাদী জিনিসকে জড়াইয়া ফেলিয়া শিশুর মত একটা ভুল করিয়া ফেলে বলিয়া মনে হয়। দর্শনের উদ্দেশ্য তত্ত্বানুসন্ধান, কাব্যের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে একটা বিশেষ অবস্থায় লইয়া যাওয়া। অনুভূতি আর জ্ঞান এক জিনিস নয়।
“Parler aujourd’hui de poesie philosophique (fut-ce en invoquant Alfred de Vigny, Leconte de Lisle, et, quelques autres), c’est naivement confondre des conditions et des applications de I’esprit incompatibles entre elles. N’estce pas oublier que le but de celui qui specule est de fixer ou de creer une notion—c’est-a-dire un pouvoir et un instrument de pouvoir, cependant que le poete moderne essaye de produire en vous un etat et de porter cet etat exceptionnel au point d’une jouissance parfaite?”
“Ah, love, let us be true
To one another! for the world which seems
To lie before us like a land of dreams,
So various, so beautiful, so new,
Hath really neither joy, nor love, nor light,
Nor certitude, nor peace, nor help for pain ;
And we are here as on a darkling plain
Swept with confused alarms of struggle and flight,
Where ignorant armies clash by night.”
এই কবিতাটিতে ম্যাথিউ আর্নল্ড অথবা ‘We are such stuff as dreams are made on, our little life is rounded with a sleep’ এই কথাটিতে সেকসপীয়র জীবন ওমানুষ্য সমাজ সম্বন্ধে কোনও তত্ত্বরে প্রচার করিতে চান নাই। জীবন সুখের কি দুঃখের, জীবনের কোনও মূল্য আছে কিনা এ সকল প্রশ্নের সমাধান সাহিত্যর কাজ নয়। মিঃ মিডলটন মারি বলিয়াছেন “The great writer does not really come to conclusions about life ; he discerns a quality in it” তাই কবির কাব্য পড়িয়া আমার দুঃখের হউক, সুখের হউক যে সুরে বাধা আছে কবির গানের সুরের সঙ্গে সঙ্গে সেই সুরে বাজিয়া উঠে।
স্ত্রী পুরুষের দৈহিক আকর্ষণ লইয়া কবিতা বা গল্প লিখিতে গিয়া যাহারা প্রেম মিথ্যা কাম সত্য, অথবা কাম মিথ্যা প্রেম সত্য, এই দইটির তথ্যের যে কোনটিকে প্রমান করিতে চান সাহিত্য তাহাদের স্থান নাই। ক্ষমতা থাকিলে তাহারা দ্বিতীয় বাৎস্যায়ন, কল্যাণমল্ল অথবা হ্যাভেলক এলিস হইতে স্বতন্ত্র। দুই তিন বৎসর পূর্বে ভারতচন্দ্রের কাব্যের সমালোচক প্রসঙ্গে কাব্য অশ্লীলতার স্থান সম্বন্ধে ইংরেজীতে মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় আমি একটু আলোচনা করিয়াছিলাম, সেই প্রবন্ধ হইতে কয়েকটি লাইন করিয়া দিতেছি,
“Bharatchandra treats the charming, bizarre, repelling, pitiful, overpowering facts of sex-life with wit, flippancy, and, as many would consider, indecency. On this question, a war of arguments is likely to be waged between the upholders of the romantic conception of love and the advocates of what, in the absence of a better adjective, has been termed its realistic conception. No controversy could be more irrelevant and less fruitful. Love is too deep-seated, complex and protean, a passion to be contained in either of these two simple entities : sensuality and sentiment. The poet or the novelist’s idea of love, whether as something ethereal and disembodied or something frankly carnal, is not the outcome of a scientific investigation like that of Mr. Havelock Ellis. It is purely ideal (in the artistic sense) and is the result of the process of simplification and selection which is unconsciously and ceaselessly going on the artiest mind and which endows his visions with a beauty and harmony of effect unattainable in real life.”
আমি বলিতে চাই, বাস্তব জীবনের ইন্দ্রিয়পরতস্ত্রতা আর সাহিত্যের আদিরস এক জিনিস নয়। আমরা যখন চিত্রে নরনারীর নগ্নমুর্তি দেখিয়া মোহিত হই, তখন আমরা মানুষের অঙ্গ সংস্থানের কথা ভাবি না, মানবদেহকে অবলম্বন করিয়া আমাদের মনের কল্পলোকে যে রূপ (form) ও সামঞ্জেস্যের (proportion) আদর্শ গড়িয়া উঠিয়াছে তাহারই কথা মনে করি। এই রূপানুভূতির সঙ্গে ইউক্লিডের জ্যামিতির বরঞ্চ যোগ আছে, গ্রে’র অ্যানাটমির কোন যোগ নাই। যদি নগ্ন মনুষ্যমুর্তির চিত্রের নগ্নতা ভিন্ন আর কিছুই না থাকিত, তবে জর্জোনে ও টিশিয়ানের ছবি এবং মাসিক বসুমতি ও ভারতবর্ষে যে সকল বিবসনা, অন্তত সিক্তবসনা সুন্দরীদের ছবি বাহির হয়, তাহার মধ্যে কোন তফাৎ থাকিত না। সাহিত্যও এই কথাটি খাটে। বাস্তবজীবনে কামের ফল অবসাদ। ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিতে সুখ থাকিতে পারে কিন্তু আনন্দ নাই। Omme animal post..tristae সেকসপীয়রও বলিয়াছেন কিন্তু আনন্দ নাই ”Th’expense of spirit in a waste of shame is lust of action” ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির সুখকে ভাবাধিগমনের অবসান হইতে, অবসাদ হইতে বিচ্ছিন্নতার শৃঙ্খল ও অতৃপ্তি হইতে মুক্ত করিয়া একটা অবাস্তব, পূর্ণ ও অখন্ড, অবিচ্ছন্ন, দেহজাত সুখের রসসৃষ্টি করাই, যে সকল অশ্লীল রচনা সাহিত্য বলিয়া স্বীকৃত, তাহার আদর্শ। কিন্তু একটা কথা ভাল করিয়া মনে রাখিতে হইবে-
Consideration of ulterior ends whether by the writer in the act of composing or by the reader in the act of experiencing tends to lower poetic value.
অশ্লীল সাহিত্য লিখিবার সময়ে লেখকের উপরও পড়িবার সময়ে পাঠকের উপর বাস্তব জীবনে দৈহিক উত্তেজনার যে নৈসর্গিক ফল, তাহা যদি হইয়া থাকে তবেই সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্ন আসিয়া পড়িবে। আপনার জনসাধারনের রসিকতা সূক্ষ্ম নয়, সংযমও কঠিন নয়, সেই জন্যই অধিকারীভেদের কথা ওঠে।
বাঙালি লেখকদের অশ্লীল রচনা সাহিত্য কিনা সে প্রশ্নের মীমাংসা কখনই সম্ভবপর হইবে না। তাহারা কি তাহাদের অশ্লীলতার প্রতি নবজাগ্রত নিষ্ঠা ক্ষুন্ন না করিয়া বলিতে পারিবেন যে, এই সকল অকথা কুকথা লিখিবার সময়ে তাহারা ত্রিগুণাতিত ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহাদের মনে পাপচিন্তার লেশমাত্রও ছিল না? পাঠকদের ‘প্লেবিসিটে’ লওয়াই বা কি করিয়া সম্ভব হয়?
তবে আমি একজন পাঠকের পক্ষ হইতে বলিতে পরি তাহার মনে ইহাদের অশ্লীলতা দেখিয়া হাসি-তামাশা করিবার কুপ্রবৃত্তি ভিন্ন অন্য কোন কুপ্রবৃত্তির উদয় হয় নাই। তাহার সহৃদয়তার অভাবের জন্য সে শাস্তিও পাইয়াছে। শত শত পান্ডিতের শত শত বচন উদ্ধৃত করিয়া ও সে রসিক সমাজে আমল পাইতেছে না। সেন্ট পল সত্যই বলিয়াছেন, Though I speak with the tongues of men and of angels and have not clearity I am become as sounding brass, or a thinking cymbal.
মানুষকে ভাল না বাসিলে মানুষের ভালবাসও পাওয়া যায় না। কিন্তু কি করিয়া ভালবাসি বলুন দেখি? ইহাদের অশ্লীলতা করিবার আকাঙ্খা, অথচ অশ্লীলতা করিবার সাহস ও বৈদগ্ধের অভাব দেখিয়া আমার যে শুধু একটা পুরাতন ফরাসী গল্প মনে পড়িয়া যায়! গল্পটা এই-
এক ভদ্রলোকের একটি ছেলে ছিল। একদিন তিনি তাহাকে ডাকিয়া বলিলেন, বাপু, তোমার লেখাপড়া শেষ হইয়াছে। তুমি ল্যাটিন শিখিয়াছে, গ্রীক শিখিয়াছ, ইতিহাস, ধর্ম, নাচাও বাদ দাও নাই। এখন তোমার শুধু সমাজবিজ্ঞান শিখিতে বাকী। কিন্তু এ বিজ্ঞান শিখাইয়া দেওয়া হাজার বড় পন্ডিতেরও কর্ম নয়। এই নাও আমি মাদাম অমুকের কাছে একখানা চিঠি দিয়া দিতেছি। তিনি অনেক দেখিয়াছেন, অনেক শুনিয়াছেন, তিনি তোমাকে একটা মানুষের মত মানুষ বানাইয়া দিতে পারিবেন। তিনি আমাকে বড়ই অনুগ্রহ করিতেন সেই জন্যই আশা করিতেছি, তিনি বাপের জন্য যে কষ্টটুকু স্বীকার করিয়াছেন, ছেলের, জন্যও সেটুকু করিবেন।
ছেলে বাপের চিঠি লইয়া ভদ্রমহিলার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিহ হইল। তাহারও ছেলেটিকে দেখিযা ভালই লাগিল। তিনি তাহাকে সোফায় নিজের পাশে বসাইয়া, সমাজবিজ্ঞান সম্বন্ধে উপদেশ দিতে শুরু করেন। কিন্তু যুবকের মনে কিছুতেই সাহসের সঞ্চার হয় না। দেখিয়া শুনিয়া ভদ্রমহিলা ছাত্রের বুদ্ধি সম্বন্ধে একটু হতাশ হইয়া পড়িলেন। কি করা যায়, আকার ইঙ্গিত, উপদেশ সবই যখন বিফল হইল তখন মহিলাটি শেষ ও সনাতন প্রথা অবলম্বন করিয়া, ‘আমার নিঃশ্বেস বন্ধ হয়ে আসচে’ বলিয়াই মূর্ছিতা হইয়া পড়িলেন। যুবক তাহাকে শুশ্রুষা করিতে ছুটিয়া না গিয়া চাকর বাকরদের জন্য ঘন্টা বাজাইয়া বাড়ীটাকে গীর্জায় পরিনত করিয়া ফেলিল। অমায়িক ভদ্রমহিলাটি তখন চক্ষু একবার অর্ধোন্মীলিত করিয়া কাতর কন্ঠে বলিলেন, যান আপনি শুধু দুজন থাকতে আপনি আমার শুশ্রুষা করতে পারলেন না, আর কি ঝি চাকরের সামনে পারবেন?
বাস্তবিকই গ্রাম্য লোকে অশ্লীলতা করিতে পারে না, অশ্লীলতার জন্য নাগরিকতার প্রয়োজন আছে। আমাদের দেশের সভ্যতা আজও আরণ্য। তাই আমাদের সাহিত্য সংস্কৃত ভাষায় অশ্লীল বলিলে যাহা বুঝায়, এইরূপ অনেক জিনিস আছে, কিন্তু অশ্লীলতা বলিলে সভ্যসমাজে যাহা বুঝায় তাহা নাই। সাহিত্যিক অশ্লীলতারও একটি লাবন্য, একটা সৌষ্ঠব আছে। বর্বরতা যাহা বুঝায়, এরূপ অনেক জিনিস আছে, কিন্তু লাবণ্য, একটা সৌষ্ঠব আছে। বর্বরতা করিলে তাহাকে ক্ষুন্ন না করিয়া কি করিব। রাস্তায়, হাটে, মাঠে, ঘাটে অষ্টপ্রহর যে গ্রাম্যতা দেখিয়াছি, শুনিতেছি, সহ্য করিতেছি, তাহা যদি আজ ছাপার অক্ষরে দেখি তবু সহ্য করিব। কিন্তু ছাপার অক্ষরে দেখিলে ব্যাকারণ ভূল যে বড় বাজে ন তথা বাধ স্বন্ধো যথা বাধতি বাধতে।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024