বাংলাদেশে শ্রেণী সংগঠনের ইতিহাস – আবদুল হামিদ খান ভাসানী
সাপ্তাহিক ‘হক-কথা’ পত্রিকার ৮ নাম্বার সংখ্যায়, ১৯৭২ সালের ১৬ই এপ্রিল আবদুল হামিদ খান ভাসানীর এই লেখাটা ছাপা হয়। উনি এই পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন, এডিটর ছিলেন ইরফানুল বারী; পরে ৩০শে এপ্রিল তারিখে এডিটর’রে অই সময়ের আওয়ামী সরকার গ্রেফতার করলে উনি নিজে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসাবে কিছুদিন পত্রিকাটা ছাপাইছিলেন। ১৯৭২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর পত্রিকার পাবলিকেশন বন্ধ কইরা দেয় গর্ভমেন্ট।
এই লেখাটাতে আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ইর্ম্পটেন্ট দুইটা ক্লেইম আছে। এক হইতেছে, আওয়ামী লীগ, সিপিবি বা এমনকি ‘বিপ্লবী’ কমিউনিস্টরাও কৃষক সমিতি’রে সংগঠন হিসাবে তৈরি হইতে দিতে চায় নাই; যেই কৃষক সমিতি’রে ১৯৮০’র দিকেও আমরা কমিউনিস্ট বা ন্যাপ পার্টির অঙ্গ-সংগঠন ভাবতাম, সেইটা আসলে ভাসানীর কাছ থিকা হাইজ্যাক করা একটা জিনিস! কেন উনারা কৃষক সমিতি চান নাই, তার আলাদা আলাদা কারণ অবশ্যই থাকতে পারে, ভাসানী যেইরকম বলছেন, হুবহু একই ঘটনা হওয়ার কোন কারণ নাই, উনাদের নিশ্চয় নিজস্ব পয়েন্ট অফ ভিউ আছে, ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু চান নাই যে – এইটা মিথ্যা না মনেহয়। কিন্তু আমার ধারণা, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে ব্যাপার গোপন না হইলেও, ব্যাপারটা বলাবলির মধ্যে বা কনশাসনেসের মধ্যে এতোটা নাই; আওয়ামী লীগ ও সিপিবি’র এই ‘সহমত ভাই’ এর ঘটনা’ও হিস্ট্রিক্যাল ফ্যাক্ট হিসাবে ভাসানীর মতো এতোটা সাফ কইরা কেউ মনেহয় বলতে পারেন নাই।
আর উনার সেকেন্ড ক্লেইমটা হইতেছে, কৃষক সমিতির ভিতর দিয়া বাঙালি ন্যাশনালিজমের কনশাসনেসের জায়গাটারে উনি স্প্রেড করছেন, যেই কারণে গ্রামের সাধারণ জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে নাই খালি, উনারাই মুক্তিযুদ্ধটা করছে; স্যাক্রিফাইসগুলা করছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চালু যেই ন্যারেটিভ সেইখানে কৃষক সমিতির এই জায়গাটারে আমরা ‘ন্যাপ-সিপিবি’ বইলাই এখনো মিসরিড করি মনেহয়। মানে, যেই সিপিবি-ন্যাপের হাত থিকা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কৃষক সমিতি’রে বাঁচাইতে চাইছিলেন, সেইটা তো পারেন-ই নাই, বরং কৃষক সমিতির এই কন্ট্রিবিউশনরে উল্টা ন্যাপ-সিপিবি বইলা আমরা দেখতে পাই!
ভাসানীর এই লেখা পইড়া এইটারে ট্রাজেডি মনে হইলেও, এই ঘটনারে আসলে একটা হিস্ট্রিক্যাল কমেডিই।
তবে ভাসানীর এই লেখারে সত্য বা মিথ্যার চাইতে উনার পলিটিক্যাল পজিশনের জায়গা থিকা দেখাটা ভালো, যেই ন্যারেটিভ’টা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এখনো মোস্টলি মিসিং একটা জিনিস।
ই.হা.
………………….……………………..
আজ বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি লইয়া জনমনে নানারূপ বিভ্রান্তি সৃষ্টি হইয়াছে। দেশবাসী জানেন যে এই দুইটি সংগঠনকে বহু বাধা বিপত্তি অতিক্রম করিয়া আমি প্রতিষ্ঠা করি। জনগনের বিভিন্ন সংগ্রামের পুরোভাগে থাকার ফলে জনমনে তাহা প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ দুঃখজনক হলেও সত্য যে কিছু সংখ্যক রাজনীতিবিদ – যাহারা আশ্রয় লইয়া ঘোর দুর্দিনে এই সকল সংগঠনে ছিল – আজ রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট বুকে আঁটিয়া আমার সংগঠনের নাম ব্যবহার করিতেছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার জন্য আমার এবং আমার সংগঠনের বিরুদ্ধে নানা প্রকার প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করিয়াছে। অর্থব্যয়ে বিরাট প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করিয়া তাহারা ইহা প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতেছে যে তারাই মূল সংগঠনের লোক। প্রয়োজনবোধে দলে লোক ভিড়াইবার জন্য তাহারা আমার নাম ব্যবহার করিতেও দ্বিধা করে না। জীবনের শেষ অধ্যায়ে দাঁড়াইয়া ইতিহাসকে পরিষ্কার রাখিবার জন্য দেশবাসীর কাছে এই সম্পর্কে আমি তাই কিছু বক্তব্য রাখিতে চাই।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাদেশের কৃষকদের সংগঠিত করিবার জন্য আমি ১৯৫৬ সালে সন্তোষে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করি। সাতচল্লিশের পর বাংলাদেশের কৃষক সংগঠনের কোন অস্তিত্ব ছিল না। শোষণ ও অন্যায়ের কবলে জর্জরিত কৃষকদেরকে সংগ্রামে সংঘবদ্ধ করিবার জন্য কৃষক সমিতি গঠনের প্রস্তাব করি। সেই সময় আমি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমার আওয়ামী লীগের তৎকালীন বন্ধুরা – শেখ মুজিব, অলি আহাদ প্রমুখ তখন এই প্রস্তাবে আপত্তি উত্থাপন করে। তাহাদের বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগ গঠনের সেই সময়ে শ্রেণী সংগ্রাম ভিত্তিক সংগঠন গড়িয়া তুলিলে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় দলে থাকিবে না। তাহারা দুই বছরের জন্য এই সংগঠন গড়া স্থগিত রাখিতে অনুরোধ জানায়। তাহাদের বক্তব্য অনুযায়ী আমি সেই সময় চুপ করিয়া যাই।
পরবর্তী পর্যায়ে স্বায়ত্ত্বশাসন ও পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি ইত্যাদি প্রশ্নে যখন আমি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করিয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন ফরি, তখন পুনরায় আমি এই ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করি। ১৯৫৮ সালের ১ লা, ২ ও ৩রা জানুয়ারিতে ফুলছড়িতে প্রথম কৃষক সম্মেলন আহুত হয় । দুইদিন যাবত কৃষক সমিতি গঠন করা বা না করা সম্পর্কে তুমুল বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ হইতে বাহির হইয়া আসিয়া কমিউনিস্ট কর্মীরা সেই সময় ন্যাশনাল ‘আওয়ামী পার্টিতে সংঘবদ্ধ হইয়াছিল। প্রাক্তন আওয়ামী লীগ সহকর্মীদের মত ইহার ও একই যুক্তি উত্থাপন করে যে যেহেতু মধ্যবিত্তরা রাজনৈতিক দল পরিচালনা করে সেইহেতু শ্রেণী সংগ্রাম ভিত্তিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করিলে এবং শ্রেণী সংগ্রাম শুরু হইলে তাহারা দলে থাকিবে না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকি যে মধ্যবিয়া চলিয়া গেলেও কেবল কৃষকদের লইয়া কৃষক সমিতি করিব। আমার এই দৃঢ় সিদ্ধান্তে তাহারা ঐ প্রস্তাব মানিয়া নেয়। কিন্তু কৌশল পরিবর্তন করিয়া জেলা, মহকুমা তথা প্রতি পর্যায়ে কৃষক সমিতির মূল আসনসমূহ, দখল করিয়া লয় এবং তাহাদের চিন্তা অনুসারে কৃষক সমিতিকে অগ্রসর না করিয়া উহাকে স্থবির করিয়া রাখিয়া দেয়।
১৯৬৩ সালে জেল হইতে বাহির হইয়া আসিয়া আমি পুনরায় কৃষক সমিতি পুনর্গঠনে অগ্রসর হই। কিন্তু বিস্ময়কর হইলেও সত্য, সেই সময় আত্মগোপনকারী ও কমিউনিস্ট কর্মীরা বর্তমানে প্রকাশ্যে যাহাদের অধিকাংশ মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট নামে পরিচিত – কৃষক সমিতি পুনর্গঠন করার ব্যাপারে পুনরায় আপত্তি উত্থাপন করে। কিন্তু তথাপিও সমিতিকে পুনরুজ্জবীত করা হয়।
একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গে কৃষক সমিতির যে সভা হয় একই বন্ধুরা পুনরায় একই ভাবে বাধা প্রদান করে।
কিন্তু কৃষক সমিতি অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলিতে থাকে এবং বাংলাদেশের অনেকেই কৃষক সমিতির পতাকাতলে সমবেত হয়। ইতিমধ্যে এই বন্ধুদের সাথে সম্পর্কছিন্নকারী আরও কিছু “অতিবাম” বন্ধু কৃষক সমিতি করার কাজে বাধা সৃষ্টি করা শুরু করেন। এই দুই বন্ধুরা তাহাদের আদর্শগত লড়াইয়ে পরষ্পর চরম বিরোধী হইলেও কৃষক সমিতি না করার ব্যাপারে ভিন্নভাবে একমত ছিলেন। ১৯৬১ সালে পাকশী কৃষক সম্মেলনের মধ্য দিয়া কৃষক সমিতির যে নতুন কার্যক্রম শুরু করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয় এই সকল বন্ধু তাহাতে যোগদানে বিরত থাকেন। তাহারা এই সম্মেলনকে মেলা, জলসা ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করিয়াছেন। বাঙ্গ বিদ্রুপ করিয়া প্রবন্ধ লিখিয়াছে। কিন্তু তাহাদের সকল বাধাকে উপেক্ষা করিয়া ১৯শে জানুয়ারি ৭০ সালে সন্তোষে ও ১২ই এপ্রিল মহীপুরে ব্যাপক কৃষক জমায়েত ইহাই প্রমাণ করিয়াছে যে দেশের ব্যাপক কৃষক জনতাকে কেউ উপেক্ষা কৱিলেও তাহারা তাহাদের নিজস্ব স্বার্থে, শ্রেণীস্বার্থ সংগঠিত হইতে চায় এবং সংগ্রাম করতে চায়। ভারতীয় সংবাদপত্র ও রেডিও মহীপুরে তিন লক্ষ কৃষক জমায়েতের কথা প্রচার করে।
ইহা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট যে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে এই সকল কৃষক সম্মেলনের সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়া হয়। এই সকল সম্মেলনের ফলে ব্যাপক কৃষক সমাজ গ্রামে গ্রামে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভে জাগিয়া উঠে। শাকশাসকগোষ্ঠীকে উৎখাত করিবার সংগ্রামে তাহারা উদ্বুদ্ধ হয়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের শতকরা পঁচিশ ভাগ লোকও স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে থাকিত যুদ্ধের অবস্থা অন্যরূপ দাড়াইত। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক পাকসরকারের পক্ষে ছিল না এবং তাহারাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। বিহারী বাঙ্গালী দালাল বা এক শ্রেণী তথাকথিত মৌলভী-মওলানা যাহারা বদর বাহিনীতে যোগদান করিয়া অন্যায় ভাবে পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলাইয়া বাংলাদেশের কোটি কোটি ঘর জ্বালাইয়াছে, নিঃস্ব নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করিয়াছে। তাহার মূলে কাজ করিয়াছে ঐ সমস্ত কৃষক শ্রমিকদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা যাহারা লালটুপী, লালপতাকা লইয়া কৃষক-মজুর রাজ কায়েম কর, শ্রমিককৃষক অস্ত্র ধর পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর, কৃষকশ্রমিকদের সংখ্যানুপাতে আইন ও অন্যান্য সংস্থাসমূহে আসন চাই, কৃষকের ভোট অকৃষক নির্বচিত হইতে পারিবে না ইত্যাদি শ্লোগান দিয়া বাংলাদেশে নতুন আবহাওয়া সৃষ্টি করিয়াছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হইবার পর আমি কৃষক সমিতি পুনর্গঠিত করিবার জন্য পুনরায় পদক্ষেপ গ্রহণ করি এবং কিছু দিন পূর্বে সন্তোষে কৃষকসমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক আহ্বান করি। তখন সেই পূর্বতন বন্ধুরা (যাহারা মস্কোপন্থী নামে পরিচিত) যাহারা কৃষক সমিতি গঠন ও শ্রেণী সংগ্রামের ঘোর বিরোধী ছিল, জোর ভাষায় উহার বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়। কারণ ইতিমধ্যেই তাহার অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিত আমার সংগঠনের নাম ব্যবহার করিয়া উহাকে শ্রেণীসংগ্রামের পথ হইতে বিচুত্য করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অদৃষ্টের পরিহাস যে আজ সেই সমস্ত বর্ণচোরা কৃষক দরদী সাজিয়া মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী দেখাইবার জন্য সারা বাংলাদেশ চষিয়া বেড়াইতাছে এবং আমার প্রতিষ্ঠিত কৃষক সমিতি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন কুৎসা প্রচার করিয়া বেড়াইতেছে।
তাহাদের অনুসৃত পথে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করিয়া ঐ সমস্ত লোক তাহার কর্মসূচী অনুযায়ী কাজ করিলে আমার কোন আপত্তি নাই। আমি গণতন্ত্রে মনে প্রাণে বিশ্বাসী। অতএব যেকোন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি মুক্তভাবে কাজ করিবার অধিকারী বলিয়া আমি মনে করি। কিন্তু যে কৃষক সমিতি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি গঠন করিতে আমি বহু নির্যাতন ভোগ করিয়াছি এবং সারাজীবন কৃষক ও ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে কাজ করিয়াছি আর সেই কৃষক সমিতি ও ন্যাপের নাম ভাঙ্গাইয়া এই সকল তথাকথিত কমিউনিস্টরা নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধার কল্পে নানা ভাবে প্রচার চালাইতেছে।
দেশবাসীর কাছে আজ আমি স্পষ্টভাবে বলিতে চাই যে কেবল আজ নয়, অবিভক্ত | বাংলায় কৃষকদের ঋণের বোঝা লাঘব করিতে বাংলা ১৩২৫ সাল হইতে বাংলার ২৮টি জিলায় গ্রামে গ্রামে জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে আমি কৃষক আন্দোলন করিয়াছি – যাহার জন্য তৎকালীন বৃটিশ সরকার কৃষক মজুরদের প্রভাবে আমাকে কতবার কারাগারে পাঠাইয়াছে, বাংলাদেশ হইতে বহিষ্কার করিয়াছে। যাহারা প্রবীণ তাহাৱা সকলেই অবগত আছেন ১৩৩৭ সালে আমি প্রজাস্বত্ব আইনের জন্য টাঙ্গাইলের চারাবাড়ীতে কৃষক সভা অনুষ্ঠিত করি। সেই সময় কৃষকের জমিতে কোন স্বত্ব ছিল না, গাছ বপণ করিতে পারিত কিন্তু জাদিরের বিনা হুকুমে কাটিতে পারিনা, মসজিদ-মন্দির তৈরি করিতে, জলাশয়-পুকুর খনন করিতে পারিত না। ১৩৩৮ সালে সিরাজগঞ্জ শহরের নিকট কাওয়াখোলা ময়দানে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কৃষক জমায়েত হয় এবং আমি সারা বাংলা হইতে একুশ মণ ঋনের তালিকা সংগ্রহ করি। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন চিটাগাং বিভাগীয় রিটায়ার কমিশনার খানবাহাদুর আবদুল মোমেন সাহেব। ঐ সভার চারদিন পূর্বে বাংলার ২৮টি জেলার জমিদারদের অনুরোধ সরকার ১৪৪ ধারা জারী করিয়া বঙ্গ-আসাম প্রজা সম্মেলন বন্ধ করিয়া দিবার চেষ্টা করা হয়। সকলে ঐক্যদদ্ধ ভাবে দাবী জানায় যে ভাসানী সভা করিতে পারিলে বাংলার কোন অঞ্চলে খাজনা আদায় হইবে না, ঋণ পরিশোধ হইবে না। এই সভার মাস ছয়েক পুর্বেই বাংলার জমিদারদের দাবী অনুযায়ী ১২ ঘন্টার মধ্যে ময়মনসিংহ ছাড়ার জন্য বাংলা সরকার আমাকে নির্দেশ প্রদান করে। ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিষ্টেট মিত্র গ্রাহাম টাঙ্গাইলে আমায় হাতে উক্ত নোটিশ প্রদান করিয়া পুলিশ দ্বারা আমাকে ময়মনসিংহ হইতে বাহির করিয়া দিলে আমি সিরাজগঞ্চে উক্ত সম্মেলনের ব্যবস্থা করি। শেষ পর্যন্ত বহু চেষ্টা করিয়া সরকারী নির্দেশ প্রত্যাহার করান হয়। উক্ত সম্মেলনে ঋণ ও সুদ আদায়ের ব্যাপারে মনিটারিয়াদের প্রস্তাব পাশ করা হয়। ১৩৩৯ সালে সুংপুর জেলায় সাঘাটা থানায় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত করি। আসামে দীর্ঘদিন ধরিয়া কৃষদের লাইনসিষ্টেম প্রথা উচ্ছেদের ব্যাপারে আমার ভূমিকার কথা সকলে অবগত আছেন। বাঙ্গাল খেদা আন্দোলনে যুবকদের মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি কাজ করিয়াছি।
অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ, পুজিঁবাদ, সামন্তবাদের নিজে বাল্যকাল হইতে খেলাফত আন্দোলন, কংগ্রেস আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, মুসলিমলীগ আন্দোলন প্রভৃতিতে ধনিক, বুনিক, জমিদার, মহাজন, জায়গীরদার, মীরাশলারদের বিরজ অবিরামভাবে সংগ্রাম করিয়া আমি দীর্ঘকাল, কারাবরণ করিয়াছি। এ সত্যও দেশবাসী অবগত আছে এবং যাহা প্রকাশ করা প্রয়োজন পড়ে না।
কিন্তু আজ এই সকল মস্কোপন্থী তথাকথিত কমিউনিস্টরা আমাকে সাম্রাজ্যবাদী দালাল, পুঁজিবাদের অনুচর, কৃষক মজুরদের শত্রু বলিয়া নানা কৌশলে পুস্তক-পুস্তিকা ছাপাইয়া এবং সভা-সমিতিতে প্রচার করিয়া বেড়াইতেছে। আমি তাহাদের বিরুদ্ধ কিছুই বলিতে চাইনা। কেবল এই সত্যটি মাত্র সকলকে জানাইয়া দিতে চাই যে সত্যের কখনো মৃত্যু হয় না, ন্যায় কখনও অন্যায় হয় না । গায়েবলসীয় নীতি অনুযায়ী একশবার মিথ্যা বলিলে সত্য হয়, ইহা মোটেই সত্য নহে। পৃথিবীতে একই নামে দুইটি দল কখনও কাজ করে না । কিন্তু তথাকথিত এই সকল কমিউনিস্ট বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ও ন্যাপ নামের সংগঠন করতে সর্বত্র চেষ্টা করিতেছে। আমি স্পষ্ট বলিতেছি যে আমি এবং আমার সহকর্মীরা বহু নির্যাতনের মুখে যে কৃষক সমিতি ও ন্যাপ পঠন করিয়াছি তাহার নাম ব্যবহার করিবার অধিকার কাহারও নাই।
কৃষক ক্ষেত-মজুর ভ্ৰাত্ৰাগণ ধোঁকবাজদের কথায় কর্ণপাত করবেন না। যে ত্যাগ, তিতিক্ষার ফলে এই সংগ্রামী সংগঠন সমুহ গড়িয়া উঠিয়াছে, জনতার স্বার্থে দেশের স্বার্থে এবং ভবিষ্যত সংগ্রামের স্বার্থে তাহাকে অটুট রাখুন। সকল ব্যাপারে আমার সহিত শহীদ আসাদনগর (সন্তোষ), টাঙ্গাইল, এই ঠিকানায় সরাসরি যোগাযোগ করুন। জনতার সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান সমূহকে সংগ্রামের সঠিক পথ হইতে বিচ্যুত হইতে দিব না এই প্রতিশ্রুতি আমি দিতে চাই। আপনাদের কাছেও আমার একই আহ্বান।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024