Main menu

আমি সেইভাবেই লিখছি, যেইভাবে আমি কথা কই… সাহিত্যিক ভাষায় না: ইসমত চুগতাই

ইসমত চুগতাইরে চিনছিলাম তার ‘লিহাফ’ বইটা দিয়া। যিনি আমারে বইটা দিছিলেন, তিনি চাইতেন আমি ইসমতরে শুধু মান্টোর সমসাময়িক কেউ হিসেবে না চিইনা আলাদা একজন লেখক হিসেবে চিনি। আলাদা একটা এনটিটি। সেই চেনার জার্নির জের ধইরাই এই ইন্টারভিউর কাছে আসা। উনি এইখানে অনেক কথার জবাব দিছেন নিজের মতো কইরা, আবার অনেক জায়গায় হয়তো ঘুরায়া ফিরায়া একই কথা কইছেন। সেই একই কথা কওয়াটা আমার কাছে তার একটা জেদ মনে হইছে। তার লেখাগুলার মতোই, তার আলাপের মাঝেও সেই জেদটা এড়ায় যাওন যায় না।

তিনি নিজেই নিজেরে বারবার বেমানান হিসাবে তুইলা ধরছেন। তিনি কখনো কোনো সংগঠনে টিকতে পারেন নাই কেন– সেইটার কারণ হিসাবেও তিনি তার অতি খোলামেলা হওয়ার স্বভাবটারে আগায় রাখছেন। ইসমত খোঁচা দিতে জানেন। তার লেখাতেও, ইন্টারভিউতেও। সেই খোঁচা দেয়ার জন্য সাহস দরকার হয়, আর সেই সাহস তার ছিল। তবু কেন তিনি লিহাফের পর থাইকা লেখায় আগের মতো খোলামেলা হইতে পিছপা হইছেন, সেইটা আমার মাথায় ঢোকে নাই। তাইলে কি তার সাহসেরও একটা পরিসীমা ছিল?

এই ইন্টারভিউর অনেক জায়গায় তারে কিছু কিছু বিষয়ে, বিশেষ কইরা সাহিত্যের দিকটায় পিউরিটান বইলা ভুল হইতে পারে। মনে হইতে পারে, তিনি বেশ কিছু লেখারে হালকা বা সস্তা বইলা উড়ায় দিতে চাইছেন। তবে পুরাটা পড়লে খেয়াল হয়, হয়তো তিনি সবসময় এক্সিলেন্সের দিকে ছুটতে চাইছেন। নিজের লেখার ক্ষেত্রেও, অন্যের লেখার পাঠক হিসাবেও।

তার নিজেরে নিয়া একটা অন্যরকম অহঙ্কার ছিল। কিন্তু অহঙ্কারটা তারে কখনো ‘বড় লেখক’ হইবার তকমাতে রাখে নাই তার নিজের কাছেই। তিনি বরং অন্যরকম কেউ হয়ে বেশি ভালো ছিলেন। লেখার সাবজেক্টের জন্য তিনি কল্পনার আশ্রয় কম নিছেন, বরং আশপাশ দেখার চোখটারে ঘষামাজা কইরা তুলছেন। চেনা গণ্ডি, চেনা মানুষগুলা বাইরের পরত ছাইড়া তার লেখায় ধরা দিছে। নিজের মায়ের কাছ থাইকা পাওয়া অনাদর তারে প্রথম বুঝাইছে, নারীর মা বা স্ত্রী হওয়া ছাড়া একটা আলাদা পরিচয় আছে, ভাবনার জগত আছে।

লেবেল দেয়া প্রোগ্রেসিভ রাইটারদের সাথে তার নিত্য ওঠাবসা ছিল, সেইটায় সন্দেহ নাই। তার লেখার ধরনেও সময়ের আগে থাকার, নারীর যৌনতারে নতুন লেন্সে এক্সপ্লোর করবার বিষয় থাকছে। অথচ তিনি প্রোগ্রেসিভ লেবাস আলাদা কইরা ধরার জন্য নিজের ব্যক্তিগত ধ্যানধারণারে অযথা একটা শেইপ দিতে চান নাই। আর তাই হয়তো সোজা বইলা দিতে পারছেন, সাহিত্যের চাইতে তার সংসার তার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। এইটায় ভুরু কোঁচকানোর মতো একটা বিষয় ঘটতে পারত, কিন্তু এইটাও ভাবতে হবে যে ইসমত চুগতাই রাখঢাক ভালোবাসতেন না। তিনি তার প্রায়োরিটি তার মনমর্জিমতো বাইছা নিতে জানতেন। লেখক হিসাবেও, ব্যক্তি হিসাবেও। এবং অবশ্যই, একজন নারী এবং নারীবাদী হিসাবেও।

অনিন্দিতা চৌধুরী

মাহফিল: আপনারে উর্দু সাহিত্যের গইড়া উঠার পিছনে একজন কারিগর মনে করা হয়। আপনার প্রথম দিকের কিছু লেখার কথা কি বলতে পারেন? সেইসাথে কীভাবে প্রথম দিকের গল্পগুলা উর্দু লেখার জগতে আপনারে বড়সড় একটা জায়গা কইরা দিল, সেটাও।

ইসমত: আমি এই গ্রেড দেয়ার সিস্টেমে বিশ্বাস করি না, কোনো জিনিসেই। আর ‘বড়সড় জায়গা’ বলতে এমনিতেও কী বুঝাইতে চাইতেছেন? আমি যখন লেখা শুরু করি, তখন একটা ঝোঁক ছিল– বিভিন্ন রোমান্টিক বিষয় নিয়া লেখা অথবা প্রগ্রেসিভ ধরনের লেখালেখির। তাই আমি যখন লেখা শুরু করলাম, লোকজন খুবই তব্দা খায়া গেল, কারণ আমি কোনো রাখঢাক ছাড়াই লেইখা ফেলতাম। শুরুর দিকে সবাই ভাবসে যে এগুলা আমার ভাই, মানে আজিম বেগ চুগতাইয়ের লেখা। তাদের ধারণা, আমার ভাইই ছদ্মনাম নিয়া লিখতেছে। এমনকি তার মাথায়ও চিন্তা আইল, “আমার নাম আর স্টাইল নিয়া কে লিখতেছে?” আমরা ভাইবোন বইলাই মনে হয় আমাদের স্টাইলটা এক রকম ছিল।

এছাড়াও আমি ঠিক আপনাগো ‘সাহিত্যিকভাবে’ লিখি নাই। আমি সেইভাবেই লিখছি, যেইভাবে আমি কথা কই। খুবই সহজ ভাষায়, সাহিত্যিক ভাষায় না। মুখের ভাষা আর লেখার ভাষার মধ্যের ফারাকটা তো বোঝেন। আমি ব্যাকরণের হিসাবে মোটামুটি ভুলভাল বাক্যেই লিখতাম, কারণ বলার সময় আমরা এমনেই বইলা থাকি। তাই আমি এভাবেই লেইখা যাইতাম। এমনকি জানেন, আমার উর্দুও বেশ কমজোর ছিল। কারণ আলিগড়ে আমি পড়াশোনা করছি ইংরেজিতে। ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক– সবই ছিল ইংরেজিতে, তাই উর্দুরে ঠিক আমার মাতৃভাষা কওন যায় না। এই ভাষাতে লিখতে তাই আমারে বেশ বেগ পাইতেই হইছে। আমারে সবসময় ইংরেজিতেই লিখতে হইতো তাই উর্দুর দিকে নজর দেওনের জন্য খুব কম সময়ই পাইতাম আমি। তখন উর্দু অত ইম্পর্ট্যান্টও ছিল না। নিজেদের ভাষা হওয়ায়ই আমরা যেন এইটারে তেমন পাত্তা দেই নাই। তাই বলা যায়, আমার উর্দু ছিল বেশ ভুলে ভরা, কিন্তু তারপরও আমি লিখতে শুরু করলাম। ঠিক আমার ভাষাটা লোকের নজর কাড়ে নাই। নজর কাড়সে আমার কোনো ভণিতা ছাড়াই লেইখা ফেলার স্বভাবটা।

মাহফিল: তাইলে সেই স্বভাবটা নিয়াই কিছু বলেন।

ইসমত: এইটা আসছে আমার ফ্যামিলি থাইকা। আমরা সবাইই খুব সোজাসাপ্টা ধরনের ছিলাম– আমার আব্বা, ভাইয়েরা, সবাই। আমরা কখনো আলাদা কইরা বসতাম না যে নারীরা একদিকে আর পুরুষরা অন্যদিকে। আমার আব্বা খুবই প্রগ্রেসিভ ঘরানার মানুষ ছিলেন এবং তার মনও আছিল অনেক উদার। তিনি সবার লাইগা সমান শিক্ষায় বিশ্বাস রাখতেন। ভাইদের লগে আমারেও সমান সুযোগই দিছেন। ঘোড়দৌড় থাইকা শুরু কইরা, সবকিছুই।

মাহফিল: আপনারা কয় ভাইবোন আছিলেন?

ইসমত: সব মিলাইয়া দশজন। ছয় ভাই আর চার বোন। এর মাঝে আমি আছিলাম নয় নাম্বার, এরপরে আরেকটা ছোট ভাই। আমাদের পুরা ছুট দিয়া রাখা হইতো। প্রতি রবিবারে আমরা শ্যুট করতে যাইতাম, ঘোড়া চড়তে যাইতাম। এক এক কইরা সবই করছি। আমি কখনো নিজেরে কোনো পোলার চাইতে কম মনে করি নাই। আমি তাদের লগে গাছে চড়তাম, সব জায়গায় ঘুরতে যাইতাম। আমার মাঝে নিজেরে নিয়া কখনো কোনো ইনফিরিয়রিটি আছিল না। আমার কখনো মনে হয় নাই যে আমি নারী বইলা লাজুক বা চুপচাপ হইতে হইব। এইটার কারণ অবশ্যই আমার বাইড়া উঠাটা। এছাড়া আমরা যৌনতার আলাপটাও বেশ খোলামেলাভাবেই করতাম, এমনকি আমাদের বাড়িতে ‘সেক্স’ জিনিসটা কখনো ট্যাবু হইয়া উঠে নাই। আমরা এসব নিয়া আলাপ করতে পারতাম। তখনো কোনো কোনো জায়গায় প্রেগন্যান্সির বিষয়টা পর্যন্ত মনে করা হইত গোপন কোনো বিষয়। কেউ কেউ এইটা নিয়া আলাপ করতে লজ্জা পাইত। তবে আমাদের বাড়িতে আমাদের ভাবীদের প্রেগন্যান্সি নিয়া খোলামেলা আলাপ হইতো। আমরা জীবনের মূল বিষয়গুলা খুব সহজভাবেই জানতাম, কারণ এইগুলা নিয়া নরমালি আলাপ করা হইত। অবশ্য সেই সময়ে সেইটারে বেশ অদ্ভুত কাজ মনে করা হইত এবং আমাদের সবাইরে লোকে পাগল কইত। অদ্ভুত আর পাগল।

মাহফিল: এগুলা কি আলিগড়ের ঘটনা?

ইসমত: হ্যাঁ। আমার আব্বা আছিলেন ডেপুটি কালেক্টর আর চাকরির কারণে তারে বিভিন্ন জায়গায় যাইতে হইত। আগ্রারে বেশ ব্যাকওয়ার্ড জায়গা বলা চলে। আমার মনে আছে। তবে আমরা ওখানে শুধু দুই বছরই থাকসিলাম, এরপর আবার আলিগড়ে ফেরত চইলা আসছি। আমার আব্বার লোকের সমালোচনা নিয়া কখনো কোনো মাথাব্যথা আছিল না। আমাদের সবাইরেই আদতে সোজাসাপ্টা, বদমেজাজী আর কাইজ্জাখোর মনে করা হইত।

মাহফিল: এই যে আপনার খোলামেলা স্বভাবটা, সেইটা আপনার ব্যক্তিত্বের অংশ থাইকা ক্রমেই লেখার ভাষা হইয়া উঠলো। আর তারপর আপনার নামটাও দ্রুতই ছড়াইয়া পড়লো।

ইসমত: খুব খারাপ নাম কিন্তু! আমার প্রথম লেখা ছিল একটা ম্যাগাজিনের লাইগা– সাকি (বাংলা করলে শব্দটা হয় ‘সুরা পরিবেশনকারী’)। এইটা লিখছিলাম স্কুলের সময়ে। স্কুলে আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য নাটিকার মতো ছোটখাটো লেখা লিখতাম। তারপর লিখলাম আমার প্রথম ছোট গল্প– গেলা (নির্বোধ)। তারপর আরো দুই-তিনটা লেখা হইলো। এইগুলার পর গিয়া লিখলাম ‘লিহাফ’ (লেপ)। আসলে জানেন, আমি যখন প্রথম লিহাফ লিখলাম, তখন এই বিষয়টা, মানে লেসবিয়ানিজম নিয়া কিন্তু খোলামেলা আলাপ একেবারেই হইত না। আমরা মেয়েরা নিজেগো মধ্যে হয়তো আলাপ করতাম যে এইরকম কিছু একটা আছে। কিন্তু আমরা পুরা বিষয়টা বুঝতে পারতাম না। এইটা নিয়া আমি কোনো বই বা সাহিত্যও পড়ি নাই। তাই গল্পটা লেখার পর আমি নিয়া গেলাম ভাবির কাছে, উনি আমার সমবয়সীই ছিলেন। তিনি গল্পটা পইড়া কিছু চরিত্ররে দেখাইয়া কইলেন, “এইটা অমন, এইটা এমন।” তবে উনি কোনোটারেই নোংরা বা ওরকম কিছু কন নাই। তারপর আমি এইটা দিলাম আমার চৌদ্দ বছর বয়েসী ভাতিজিরে পড়বার জন্য। সে আমার লেখা গল্পগুলা পড়তে খুবই ভালোবাসতো। কিন্তু এইটা পড়ার পর সে কইলো, “এইটা কী লিখছো, আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না।” আমি তারে কইলাম যে এইটা এখন বুঝাইতে পারব না, বড় হবার পরই জানতে পারবা। আমি যখন এই বিষয়টা নিয়া লিখলাম, তখন আসলে মনে হইছিল, আমি কী বোকা! মানে আমি ভাবতাম এরকম জিনিসপাতি নারীদের সাথেই ঘটে, পুরুষরাই শুধু বেশ্যাদের কাছে যায়। কিন্তু নারীরা তো বেশ্যাদের কাছে যাইতে পারে না, তাই তারা এইটা করে। যদিও এই ভাবনা খুবই বোকা বোকা। যেহেতু কারো সাথে কখনো আলাপ হয় নাই, তাই এইটা নিয়া জানতামও না। বাসায় হয়তো যৌনতা নিয়া আলাপ হইত, তবে এই নির্দিষ্ট বিষয়টা কখনো উঠে আসে নাই। এইটারে বিকৃত ভাবা হইত। তাই যখন আমি এই গল্পটা লিখতাম, তখন যেন একটা বোম ফাটলো। সবাই আমারে গালমন্দ করা শুরু করল। কেউ আমার ঠিকানা জানত না, তাই আমার সম্পাদকের বরাতে আমারে বিভিন্ন ধরনের চিঠি পাঠানো হইত।

মাহফিল: কোন ম্যাগাজিন?

ইসমত: আদাব-ই-লতিফ আর সাকি। লিহাফ প্রথমে ছাপা হইছিল আদাব-ই-লতিফে। মানুষজন কইতেছিল যে এইটা খুবই খুবই নোংরা গল্প হইসে আর আমি মানুষটাও খুব নোংরা। আমার পরিবাররে নিয়াও অনেক খারাপ কথা উঠে তখন। আমারে নিয়া সব মিলাইয়া বেশ বাজেভাবে চর্চা হইতেছিল। এরপর আমি বিয়ে করি। যখন প্রথম প্রথম এইসব চিঠি আমার নামে আসত, তখন সম্পাদকরা সোজা আমার কাছে পাঠাইতেন না। বরং প্রথমে তারা খুইলা দেখতেন আর নারী হওয়ার কারণে তারা চান নাই যে আমি কোনো অশ্লীল আচরণের মুখামুখি হই। কিন্তু যখন আমার বিয়েটা হইল, তখন তারা কইলেন যে আমি এখন একজন দায়িত্বশীল মানুষ হইসি। তাই তারা সোজা এই চিঠিগুলা আমার কাছেই পাঠাইতে লাগলেন। ‘লিহাফ’ প্রকাশ পাইবার কিছুদিন পরই বিয়েটা হয়। এইটা লিখছিলাম বেয়াল্লিশে আর এর দুইমাস পরই বিয়ে হইল। তো সেই তাড়া তাড়া চিঠিগুলা ছিল বিভিন্ন নোংরা আলাপে ভরা। আমি এত ভয় আগে কখনো পাই নাই। আর হয়তো সেইজন্যই, এরপর থাইকা ঠিক সেইভাবে আর লিখি নাই। একই ভুল আমি আবার করি নাই। যদি আপনারা আমার লেখালেখি ভালো কইরা খেয়াল কইরা দেখেন, তাইলে দেখতে পাইবেন যে এর পর থাইকা খোলামেলা শব্দ ব্যবহারের বিষয়ে আমি একটু বেশিই সাবধান হয়া গেছিলাম। এমনকি এখন কেউ লিহাফের আলাপ তুললেও আমার কেমন জানি লাগে।

মাহফিল: কিন্তু এই গল্পটা তো উর্দু গল্পের জগতে দারুণ বিপ্লব ঘটায়া দিছিল—

ইসমত: এরপর অবশ্য কিছু সমর্থক জুটছিলেন আমার। তারা কইছিলেন যে গল্প ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু আমি নিজে দুঃখ প্রকাশ করছিলাম এইটা লেখার কারণে। আমি বলছিলাম যে আমি দুঃখিত এই গল্প লেখার লাইগা।

মাহফিল: কারা কারা আপনার পাশে দাঁড়াইছিলেন তখন?

ইসমত: প্রথমে মজনু গোরখপুরী একটা লেখা লিখছিলেন, যদিও আজ পর্যন্ত সেইটা আমার পড়া হয় নাই। তারপর কৃষণ চন্দর এবং এরপর অবশ্যই– মান্টো।

মাহফিল: হ্যাঁ, মান্টো। তারপর আপনি অন্য কাজে জড়ায়া পড়েন। সেইগুলা কী ছিল? আপনি কি যুদ্ধের সময়েও লেখালেখি চালায়া গেছিলেন?

ইসমত: যুদ্ধের সময় আমি উপন্যাস লিখছিলাম– তেহড়ি লাকির (বাঁকা সীমারেখা), একটা বেশ পেটমোটা উপন্যাসই বটে। তখন আমি একটু অসুস্থও ছিলাম। এইটা আমার মেয়ের জন্ম হবার আগের ঘটনা। কিন্তু সেই পুরাটা সময়েই এই বইটা লেখার উপর ছিলাম।

মাহফিল: আপনি প্রোগ্রেসিভ মুভমেন্টের সাথে প্রথম কখন জড়াইলেন? আমি গতকালকে আরেকজন উর্দু লেখকের সাথে আলাপ করলাম, যিনি বললেন যে এই সময়টাতে তিনি তার নিজের কাজেই ব্যস্ত ছিলেন, লেখালেখি ইত্যাদিতে। তারপর একসময় তিনি আবিষ্কার করলেন যে তারে ‘প্রগতিশীল’ ডাকা হইতেছিল এবং এইভাবেই যেন তিনি আন্দোলনে ঢুইকা গেলেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো যোগ দেন নাই, কিন্তু তারপরেও তিনি ছিলেন। আপনার বিষয়টা কেমন?

ইসমত: ছত্রিশ সালের দিকে যখন আমি বিএ পড়াশোনা করতেসিলাম, তখন লাখনৌতে প্রোগ্রেসিভ রাইটারদের প্রথম মিটিংটায় যাই। ওইটাতে প্রেমচাঁদও গেছিলেন। আমি তখন তেমন কিছু একটা বুঝতাম না, কিন্তু আমি ‘আঙ্গারে’ (কয়লা) পড়সিলাম। তারপর অবশ্যই রাশিদ জাহানও ছিলেন। তিনিই কওয়া যায় আমারে বিগড়াইছেন। অন্তত আমার পরিবারের ভাষায়, তা-ই। তিনি অনেক সাহসী ছিলেন। অনেককিছু খোলামেলাভাবে কইয়া দিতে পারতেন। আমি শুধু তারে কপি করতে চাইতাম। আমার উপর তার প্রচুর প্রভাব আছে– তার খোলামেলা চিন্তা-ভাবনার ছাপ আছে। তিনি কইছিলেন যে তুমি যেইটা অনুভব করো, সেইটা প্রকাশ করতে কখনো শরম পাবা না। আমাদের জবানের চাইতে আমার মন বেশি পাকপবিত্র। তিনি এইটা মানতেন যে যদি মনের মধ্যে কিছু একটা থাকে আর তা প্রকাশ না করা যায়, তাহলে মনের মধ্যে না রাইখা বইলা ফেলাই ভালো, কারণ শব্দের মধ্য দিয়া সেই ভাবনাগুলা ডানা মেইলা উড়তে পারে। ভাবনারে বন্দী কইরা রাখার কিছু নাই।

আমি আসলে শুরু থাইকাই প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথে ছিলাম। কিন্তু আমি এত বেশি খোলামেলাভাবে আলাপ করতাম যে আমারে ঠিক ভরসা করা যাইতো না। আমার মন এতটাই খোলামেলা আছিল যে কোনো দলের জন্যই আমারে সদস্য বানানোটা কঠিন ছিল। তারা আমারে সদস্য বানাইত না কারণ আমি সারাক্ষণ যাচ্ছেতাই আলাপ করতাম। আমি আসলে কখনোই এসব আলাপ করতে ভয় পাই না, এমনকি এইটার সামনেও না (টেপ রেকর্ডারের দিকে ইশারা কইরা)। কারণ আমি মনে করি না যে কারো ভালো নাম খারাপ কইরা দেয়া যায় বা কাউরে ওইভাবে বদনাম করা যায়। আমার এইটাও মনে হয় না যে আমার খুব ভালো নাম আছে, যেইটা খারাপ হয়ে যাবে বা আমার খ্যাতিতে কোনো ভাঁটা পইড়া যাবে।

মাহফিল: আপনি বললেন যে আপনি শুরু থাইকাই এই আন্দোলনের একজন সদস্য আছিলেন। এই প্রগতিশীল লোকজন আপনার লেখারে কীভাবে দেখত? আপনি আগেও বলছেন যে কৃষণ চন্দর প্রশংসা করতেন।

ইসমত: এইখানের বেশিরভাগ মানুষই আমার বন্ধু আছিলেন। আমার আত্মীয়ের চাইতেও বেশি কিছু– বন্ধু। তাই কোনো কোনো সময় তারা আমারে প্রশংসা কইরা মাথায় তুলত, আবার সময়মতো আছাড়ও দিত। আমি কোনো ক্ষেত্রেই তাগোরে তেমন সিরিয়াসলি নিতাম না। প্রশংসাও না, নিন্দাও না।

মাহফিল: আপনি কি বলবেন যে উর্দু সাহিত্যে এখনো এই প্রোগ্রেসিভ মুভমেন্টের ভূমিকা দরকার আছে?

ইসমত: আমরা নাম দেয়ার বহু আগে থাইকাই এইটা আছে। আমার মতে, ভক্ত কবীর একজন প্রোগ্রেসিভ লেখক আছিলেন। আমার বিশ্বাস যে মানবতার ভালোর জন্য যারাই ভালো ও সুন্দর কিছু কইছেন, তারাই তেমন লেখক। আর তারা এইটা কিন্তু পঁয়ত্রিশ বা ছত্রিশে শুরু করেন নাই। তারা এই সময়েরও বহু আগে থাইকা আছেন, শুধু এই নাম বা ট্যাগটা দেয়া হয় নাই তখন। আর এই মানুষগুলা থাইকাই যাবেন, ভবিষ্যতেও।

মাহফিল: আপনি ‘প্রগতিশীল’ শব্দটারে বেশি বড় পরিসরে নিয়া ফালাইতেছেন। যে সাহিত্য কোনো না কোনোভাবে মানবতা বা সামাজিক সচেতনতার সাথে যুক্ত, একটা মানবতাবাদ বলা চলে যারে। কিন্তু মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্র বা সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা, স্ট্যালিনবাদ ইত্যাদির দৃষ্টিতে এই প্রগতিশীল সাহিত্যের বিষয়টা কী? আমি বিশেষ কইরা তিরিশ বা চল্লিশের দশকে উর্দু সাহিত্যের ওইসব নির্দিষ্ট উঁচু মানের রাজনৈতিক রচনাগুলার কথা জিগাইতেছি।

ইসমত: কিন্তু আপনি এই দুইটারে আলাদা করতে পারবেন না। এই দুইটা বিষয় সবসময়ই ছিল– রাজনীতি আর সাহিত্য। যখন ডিকেন্স লিখছেন, তখনো, যখন বিপ্লবের পর রাশান সাহিত্যিক লিখছেন, তখনো। সে যাই হোক, আপনি যদি প্রগতিশীল লেখকদের সংগঠনটা নিয়া আলাপ করতে চান, ঠিক আছে। একটা সংগঠন হিসেবে, এইটা বেশ ভালো ছিল। এইটা আমাদের একজন আরেকজনের সাথে দেখা করার সুযোগ দিছে, আমাদের কথা কইবার এবং জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন কিছু শিখবার ছুতা তৈরি কইরা দিছে। আমরা জগতটা সম্পর্কে জানতে পারতেছিলাম। আমার রাজনীতির বিষয়ে তেমন কোনো আগ্রহ আছিল না। তাই এ বিষয়ে তেমন পড়াশোনা না কইরাও এই সময়টাতে আমি অনেক কিছু জানতেছিলাম। তখন আমি ঠিক সিরিয়াস সাহিত্য নিয়া খুব একটা মাথা ঘামাই নাই, কিন্তু মানুষের সাথে আলাপ কইরা অনেক কিছু শিখছি। বিভিন্ন ভাষণ শুনতে গিয়াও শিখছি, মানুষের সাথে দেখা কইরাও। জীবন নিয়া, কম্যুনিজম নিয়া। আর হ্যাঁ, এই কম্যুনিজমের মধ্যে আগ্রহটাও ওই রাশিদ আপার মারফতেই। তারপর আমার আইটি কলেজ, মানে লাখনৌ-এর ইসাবেলা থোবার্ন কলেজে গিয়া এইসব পড়া হইলো। সেখানকার শিক্ষকরা অনেক খোলা মনের মানুষ আছিলেন। এবং সেই দিনগুলাতেও তারা আমাদের প্রতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিষয়ে বেশ সহানুভূতি রাখতেন। তারপর আমি জানতে পারলাম, বৃটিশরা ভারতীয়দের সাথে আসলে কী করছে। এরপর আমি কম্পারেটিভ রিলিজিয়নের একটা ক্লাসে যোগ দিলাম, সেখানেও শিক্ষকরা খুবই উদার মনের ছিলেন। তারাই আমারে প্রথম কম্যুনিজম বিষয়ে শিখাইছিলেন।

কম্যুনিজমের এত এত ভালো দিক আছে, কিন্তু এর মানে এই না যে কম্যুনিস্টদের মধ্যেও সেইসব ভালো জিনিস আছে। কম্যুনিজম হইতেসে একটা ধারণা, ঠিক ইসলাম বা ক্রিশ্চিয়ানিটির মতোই। কিন্তু আপনি গ্যারান্টি দিয়া কইতে পারেন না যে সব মুসলিম মুসলিমই বা সব খ্রিস্টান খ্রিস্টানই। ঠিক সেইভাবেই, সব কম্যুনিস্টরেও কম্যুনিস্ট বলা যায় না।

মাহফিল: আপনার কি মনে হয় যে এই আন্দোলনটার ফলে উর্দু সাহিত্যের অনেক লাভ হইছে?

ইসমত: হ্যাঁ।

মাহফিল: আপনার কি এইটাও মনে হয় যে এই আন্দোলনের কারণে গদ্যের যে লাভ হইছে, কবিতার ক্ষেত্রেও তেমনটাই কওয়া যায়?

ইসমত: কবিতা অনেক ভোগান্তির মধ্য দিয়া গেছে আসলে—

মাহফিল: এই আন্দোলনের মূল অবদানটা আসলে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে হইছিল, এইটা কি মানেন?

ইসমত: কবিরা আসলে অনেক আবেগী মানুষ। তারা হইলো, যাদেরকে বলা যায় ‘স্লোগানবাজ’। কবিতায় আগুনের ফুলকি সাজায়া তারা অনেক সহজেই আবেগে ভাইসা যান। গদ্যের ক্ষেত্রে সেইটা অনেকটা ভানের মতো। আপনি যদি একই জিনিস গদ্যে তরজমা করেন, তাইলে লোক দেখানো মনে হইবো। কিন্তু কবিতায় এইটা করাই যায়। কবিদের আবেগের তো সীমারেখা নাই। তারা আবেগে ডুইবা গেলেও এই আন্দোলনে তারা খুব দ্রুত বদলায়া গেছিলেন। অনেক কবি তাদের কথাও ফেরত নিছিলেন। অনেকেই আন্দোলনের বিষয়ে তাদের ধ্যান-ধারণা পাল্টায়া যাওয়ার কারণে নিজেদের লেখা পরে কাটাছেঁড়া করসেন। কিন্তু আমি একটা শব্দও ফেরত নেই নাই।

মাহফিল: এই আন্দোলনের সময়ে বাইর হইয়া আসা গদ্যগুলা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু সেইরকম ভালো কবিতা কি বাইর হইছে?

ইসমত: সেই বছরগুলাতে, কবিরা খুবই কমবয়েসী ছিলেন আর খুব একটা পোক্তও হন নাই। আমি বিপ্লবী কবিদের কথাও কইতেছি। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিলেন– জোশ সাহেব, তারপর মাজাজ, যারা খুব কম বয়েসেই মারা যান। তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন এবং আর শেষ বয়সে লিখতে পারতেছিলেন না। অন্য কবিরা পাকাপোক্ত হইতে পারেন নাই। তাদের স্লোগানবাজিটাই তাদের অভিশাপ হয়ে দাঁড়াইছিল।

মাহফিল: কিন্তু গদ্যের বিষয়ে কী? অবশ্যই ভালো গল্প অনেক আছে, কিন্তু উপন্যাস…

ইসমত: উপন্যাস লেখার বিষয়টাতে আসলে অনেক বেশি শ্রম দিতে হয় এবং বেশিরভাগ লেখকেরই দেখা যায়, লেখার সময় নাই। লেইখা জীবন কাটানোর মতো সময় থাকে না আসলে। একেকজন লেখক আর কত টাকাই বা পান। শুধু সিনেমাতেই লেখকদের ভালোমতে টাকা পাইতে দেখা যায়। তাই বেশিরভাগ ভালো লেখক ফিল্মের লেখালেখিতে যান। তারা ফিল্মের পয়সায় চলেন, আর মনের আনন্দের জন্য লিখেন। কিন্তু একসাথে দুইটা কাজ করতে গেলে খুব ভালো কিছু কেমনেই বা বাইর হইয়া আসবে?

মাহফিল: তাইলে সহজভাবে কইতে গেলে, সময় আর আর্থিক অবস্থার কারণেই আপনার মনে হয় যে উর্দু লেখকরা ভালো উপন্যাস লিখতে পারতেছেন না।

ইসমত: হ্যাঁ। যখন তাদের কাছে সময় থাকে, তখন তারা ছোটখাটো উপন্যাস লেখেন। যদিও উপন্যাস লেখা হইতেছে। ভালো কি মন্দ, এইটা অন্য প্রশ্ন।

মাহফিল: আপনার কি মনে হয় যে ফিল্ম লাইনের লেখালেখিতে চইলা গেলে লেখকদের উপর বাজে প্রভাব পড়ে? আপনি কি মনে করেন যে বড় পরিসরের অডিয়েন্সের জন্য কিছু একটা লিখতে গেলে ঝামেলার সম্ভাবনা আছে–

ইসমত: কিন্তু তারা তো রুটিরুজির জন্য লিখতেছে! এমনিতে অন্য কোথাও লেখালেখি কইরা তেমন কিছু করতে পারবে না। কেমনে বলা যায় বিষয়টা আসলে…তাদের রুটিরুজিই হইসে ঐ ফিল্ম লাইনের লেখালেখি, তাইলে আমি কেমনে এইটার বিরুদ্ধে কিছু কই? কারণ পেট তো ভরতেছে ওইদিক দিয়াই!

মাহফিল: এইবার একটু উর্দু লেখকদের নিয়া আলাপে যাওন যাক। আপনি মীরাজিরে চিনতেন?

ইসমত: আমার তার সাথে দেখা হইছিল। খুবই নোংরা লোক। কখনোই গোসল করতেন না। আর অনেক কমপ্লেক্সে ভরা একটা মানুষ, খুবই লাজুক আর নার্ভাস ধরনের। লোকে কইত যে তিনি নাকি পার্ভার্ট, আরো অনেক ভালোমন্দই কইত তারে নিয়া। কিন্তু তিনি কিছু কইতেন না। খুবই শান্ত লোক। কবি হিসেবে তার হয়তো তেমন হাত ছিল না। কিন্তু ওইসময় আমি বেশ কম বয়সের ছিলাম আর খুব একটা সাহিত্য নিয়া পড়াশোনাও হয় নাই।

ইসমত: মান্টোর কথা বলেন।

ইসমত: সত্যি কইতে, উনি দারুণ সব গল্প লিখছেন। খোলামেলা ধরনের লোক, যদিও লোকে তারে লম্পট ভাবতো। তিনি খুবই মিশুক লোক আছিলেন। তার লেখালেখিতে অবদমিত ভাবনাগুলা বাইর হইয়া আসত। এইটাই তিনি হইতে চাইছিলেন, তার গল্পের চরিত্রগুলার মধ্য দিয়া। তিনি যৌনতা নিয়া লেখালেখি করছেন। কখনো এইটারে আকর্ষণীয় কইরা তুলছেন, তো কখনো দমবন্ধ। আপনি তার লেখাগুলা পড়লে বুঝবেন যে কোনো চরিত্রই খুব আনন্দ বা রোমাঞ্চ দেয় না। তারা আপনারে আটকায়া ফেলে। সব রোমান্স মাঠে মারা যায়। তার লেখায় কোনো রোমান্সই নাই।

মাহফিল: তার গল্প ‘ঠাণ্ডা গোশত’-এর কথা যদি বলা যায়, খুবই বিখ্যাত গল্প…

ইসমত: খুবই বাজেভাবে লেখা! কাঠামোর দিক দিয়া, ঠিকই আছে। কিন্তু বহুত নোংরা শব্দে ভরপুর। কিন্তু তিনি খুবই চালাক, তাই চালাকি কইরাই লিখছেন। এমনিতে মনে হয় ভালোই গল্পটা। ওই তাপটা টের পাওন যায়, ওই গন্ধগুলা…

মাহফিল: আমি নির্দিষ্ট কইরা এই ছোটগল্পটারেই দেখি, যেমন ধরেন এই ‘অশ্লীলতা’ আর ‘নোংরা শব্দ’ যে আছে, তার মধ্য দিয়া তিনি হিন্দু আর মুসলিমের ম্যাসাকারটারে তুইলা ধরতে চাইছেন। মূল অশ্লীলতা কিন্তু নারী-পুরুষের মধ্যে না, বরং শিখ আর ওই মরা মেয়েটার মধ্যে। মূল অশ্লীলতাটা আসলে ভারত আর পাকিস্তানের মাঝের, খুনাখুনি, ধর্ষণ, লুটতরাজ।

ইসমত: তিনি এইটা লিখতেছেন যে কখনো কখনো ধর্ষণ করলে কী হয়!

মাহফিল: সেইটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি এইটারে প্রতীকীভাবে দেখতে পছন্দ করি। আর আমি পুরা গল্পটা পইড়া মনে হইছে যে ভারতের মানুষই ভারতরে ধর্ষণ করতেছে এবং শেষমেশ নিজেদের মধ্যেই কাটাকাটি কইরা মরে পড়ে থাকতেছে।

ইসমত: এই গল্পটা নিয়া আমি কোনোদিনই সিম্বোলিক কিছু পাই নাই। মান্টো নিপাট ভালো লোক ছিলেন, একেবারেই কোনোরকম নিচু চিন্তা রাখতেন না। দেখতেও তেমনই, যেন একজন সাধুর মতো। আমি যখন তারে এইটা বলতাম, খুবই রাইগা যাইতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি মোটেও কোনো সাধু না। আমি খুবই খারাপ লোক।’

মাহফিল: আপনাদের প্রথম দেখা কই হইছিল?

ইসমত: বিয়াল্লিশে মনে হয়। বোম্বেতে। আলাপের দুই মিনিটের মাথায় আমরা ঝগড়া শুরু কইরা দিছিলাম। মানে আলাপের কিছুক্ষণের মধ্যে মান্টো কইলেন, ‘আপনি তো জানতেন যে লিহাফে কী হইতেছিল, জানতেন না? আপনি জাইনা-বুইঝা লিখছেন।’ আমি বললাম যে অবশ্যই জাইনা-বুইঝা লিখছি। এই গল্পটা কিছুদিন আগেই ছাপা হইছিল আর এইটা নিয়াই আমাদের সব আলাপ, ঝগড়া চলতেছিল। খুবই খোলামেলা লোক ছিলেন।

মাহফিল: আপনার ওই যে লেখাটা– ‘মান্টো, মেরা দোস্ত, মেরা দুশমন’, সেটার পিছনের কাহিনী কী?

ইসমত: মান্টো যখন মারা যান, তখন নকশ-এর একটা ইস্যু বাইর হইছিল, মান্টোসংখ্যা। হায়রে কেমনে ভুগছিল এই লোকটা! এই বছরের জানুয়ারির আঠারো তারিখে সবাই তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করল। আমি তাদেরকে একটা চিঠি দিয়া জিগাইলাম যে কেন এইটা করতেছে তারা। আমি আর্টিকেলটা লিখি নাই, কিন্তু এই দলের চেয়ারম্যানরে জিগাইসিলাম যে মান্টোর মৃত্যুবার্ষিকী কেন পালন করতেছে। সব সময়ে, সব শহরে একটা কইরা মান্টো জন্মায়। তারা খুব খারাপ মানুষ, বিরক্তিকর লোকজন। তারা মানুষরে কষ্ট দেয় এবং এর পরেও নিজেদের নিয়া গর্বে ভোগে। যদিও তাদের একেবারেই বিশ্বাস করা যায় না। তারা মনে করে যে তারা অনেক মহান শিল্পী, মহান মানুষ। তাগোরে মানুষজন বিশ্বাস না করায় বরং তারা অবাক হয়। তারা চায় আপনার টাকাপয়সা, যাই আছে– সব যেন তাদের দিয়া দেন। তারা মনে করে যে তাগোরে সাহায্য কইরা লোকের খুশি হওয়া উচিত। তাগোরে সাহায্য কইরা লোকের ধন্য হওয়া উচিত। তারা এত মহান বইলাই সবসময় আপনারে তাগো মন যোগায়া চলতে হইব। এই মানুষগুলা খুবই নিচ। তারা মিথ্যা কথা বলে, মানুষরে ধোঁকা দেয়, এমনকি গোসলও করে না। তারা কিন্তু যারে বলে ‘হিপ্পি’, তা না। তারা মারামারি করে, অন্য লোকরে কষ্ট দেয় আর চায় যে লোকে তাদের মহান মনে করুক। এইসব লোকরে যদি টাকাপয়সা না দেন, তাহলে গালি দিবে। উল্টাপাল্টা কথা বলবে। তারপর একদিন কেউ মারা যাবে, যেমন মান্টো গেল। সারাজীবন আপনি ওরে এড়ায় গেছেন, ঘেন্না করছেন। সে আপনারে বিভিন্নভাবে শোষণ করছে। কিন্তু সে মারা যাওয়ার পরেই আপনার বোধ হইল যে সে কত মহান মানুষ ছিল। (কণ্ঠে অস্থিরতা।) অনেক লোকের সাথেই এইটা ঘটছে। তাদেরকে ঘেন্না করে একদিকে কোণঠাসা করে সরায়া দেয়া হইছে। মীরাজিও এরকম একজন ছিলেন। এখন সবাই তার প্রশংসা করে। মীরাজি এখন একজন দারুণ সমালোচক আর সবাই তারে নিয়া ভালো ভালো আর্টিকেল লেখে। আমার মনে আছে, তিনি যখন পুনেতে ছিলেন, না খায়া মরতেছিলেন। তিনি মাসের পর মাস গোসল করতেন না, সবাই তারে ঘেন্নার চোখে দেখত, এড়ায়া যাইত– কারণ তিনি টাকা চাইতেন। তারা ভাবত যে তিনি সবাইরে একভাবে শোষণ করতেছেন। আর তিনি মরার পরপরই সবাই তারে পূজা করা শুরু করল। এইটা কেমন মূর্খামি? মৃত মানুষের পূজা করা!

(ইন্টারভিউটার একটা পার্ট)

The following two tabs change content below.
Avatar photo

অনিন্দিতা চৌধুরী

জন্ম ১৯৯৭ সালের ২রা মার্চ, সিলেটে। গদ্য-পদ্য দুইটাতেই নিজের মতো কইরা কলম চালায়া যাইতে ভালোবাসেন। অনুবাদ আর উর্দু সাহিত্যে বিশেষ আগ্রহ আছে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →