মীম ও অন্য কয়েকটা কবিতা
ইলিউশন
যে দৃশ্যই চোখে পড়ে, তোমরা বলো, স্বপ্ন — আল মাহমুদ
তাপমাত্রা ১৩। শৈত্যপ্রবাহ।
কিছু মেইনস্ট্রিম দুঃখ, সোয়েটার, মাফলার
আর ডান হাতে মোবাইল ফোন
(৯৯ পয়সা কলরেট, আনলিমিটেড ইন্টারনেট)
গরম রাখে আমাদের।
তোমার হাতে এরোসল আর
ফুসফুসের ভিতর দৌড়াদৌড়ি করতেছে একটা তেলাপোকা
রাস্তার আমকুড়ানিদের ঢিলটা গিয়া পড়লো
আর্মি অফিসারের বউয়ের উপর
এক পা। এক পা। এক পা।
ও আমার অবাস্তব পাখি তুমি চলিয়া গেলে বাস্তব পালক ফেলিয়া।
আর ঘড়ির মতো এক অনুভূতি
(এইটাকে ইলিউশনও বলতে পারো
যতক্ষণ না এইটা তোমাকে যন্ত্রণা দেয়)
আমার বুকের ভিতর তাপমাত্রার মতো ছড়াচ্ছে।
একটা প্যাশনেট ক্লাসরুমে
সাইকোপ্যাথের মতো নর্মাল হয়ে
বসে আছে একটা প্যাশনলেস ছেলে
ডিসাইড করতে পারতেছে না
পড়াশোনার বাইরে আর কি করা দরকার তার
প্রিটেনশান পছন্দ না বলে
কানে ইয়ারফোন লাগায়ে মনের কথা শুনতেছে কেউ কেউ
তোমার এজমা একটা মানুষ হয়ে
শ্বাস নিতেছে তোমার খুব কাছে
তুমি এই ইলিউশনকে ভেঙে দাও
যদি পারো
চোখ দিয়ে
কান দিয়ে
শরীর দিয়ে
হত্যা করো এই মনের পশুকে
.
মিউজিয়ামের
স্পষ্ট কাঁচের ভিতর অস্পষ্ট আয়না
হলুদছোপ, কালো দাগ, ময়লা
.
আমি যে তোমাকে ভালোবাসি
এটা সম্ভবত একটা আইরনি। পরিহাস।
কিন্তু আমি যদি জানতাম আমি তোমাকে কখনোই পাবো না,
তাইলে তো আমি তোমাকে কখনোই পাইতাম না।
তোমার মন তোমার ভিতরে
তোমার শরীর তোমার বাইরে
আর টিভি স্ক্রিনের মতো ব্রেইন ওয়েভগুলা
ধরে রাখে তোমার মনকে
শরীরকে
তোমাকে
এই নাটকের একমাত্র এক্টর তুমি
যে জেনুইন, বিলিভেবল, কনভিন্সিং (ট্রাস্ট মি ডার্লিং)
ঘুমভাঙা ফুলের উপর ভোরের হাওয়ার মতোন
তোমার চোখে সত্যিকারের পানি
আমাদের ভালোবাসার ফেরেশতা একে অপরকে
দেখার জন্য আমাদের যে চোখ উপহার দিছিলো
তা অন্ধ করে ফেলছিলো আমাদের। কিন্তু
অন্যরা তার আগেই দেখে ফেলছিলো,
আমি তোমার মতো হলেও
তুমি মোটেই আমার মতো ছিলা না।
কে তুমি?
(সে কি তুমি নও, ওগো তুমি নও)
[আমার চোখের পিক্সেলে, নার্ভের টিউবগুলায়
পারদের মতো উঠা নামা করতে থাকলা]
চোখ তোমার ইমাজিনেশনকে আহত করে কারণ
সমস্ত স্বপ্নই দুঃস্বপ্ন। কান তোমার সুরকে ভেঙে দেয়
কারণ সমস্ত কথাই তীক্ষ্ণ (যা আমরা শ্রবণ করিলাম ও
অমান্য করিলাম)। আর শরীরের ক্ষমতা অনেক,
সে নিজেকে চোখে চোখে রাখে সবসময়, আড়াল হইতে দেয় না।
“মানুষ যখন আমাকে রিল্যাক্স করতে বলে তখন মনে হয়
তারা চায় না আমি প্রোগ্রেস করি। আর মানুষ যখন আমাকে
চেষ্টা করতে বলে, আমি নিজেকে
আরো হেইট করি”
আমি তো একটা মেশিন
আমি তো একটা আত্না
.
ঘুমের ভিতর মাথাব্যাথার মতো
তুমি এখন তোমার রুমে
পকেটে থাকা ফোনের মতো
তুমি এখন আমার ঘুমে
এখন একটা ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত কর আমাকে,
ভাসাও, ডুবাও, তারপর ভাসাও আবার। আকড়ায়ে ধরো আমাকে
নরম শুশুকের মতো, ধারালো হাঙরের মতো।
একটা দুর্ঘটনা যা ঘটতে পারে নাই কখনো,
বা একটা সুপষ্ট প্রমাণ যা এখনো পাঠানো হয় নাই আসমান থেকে,
সেই নিয়তির মতো বিন্ধা ফেল তুমি আমাকেও।
এখন আমার বন্ধ চোখের নীল শিরাগুলির উপর
কমলা রঙের কুসুম। যেন ভোরের মতো হালকা শরীর নিয়ে
(খাট নাই, পালং নাই) আমার চোখ জুড়ে বসছো তুমি,
আর আমি চোখ মেললেই চমকায় উঠবে ধান খাইতে আসা সব পাখি।
মীম
মীম
নবদীক্ষিত তুমি, পর পর লাল টাইলস টপকে এখনো হাঁটতে পারো না।
এ শহর তোমাকে এমনভাবে বদলে দেয় যা তুমি দেখো নাই, ভাবোও নাই কখনো। চারটা ঋতু এখানে, আমাদের জন্য চারটা জীবন। মাঠ আছে, কিন্তু তাতে মেঠো মাটি নাই। সিমেন্টের বস্তা আছে। নির্মাণাধীন কঙ্কাল। টেপ-টেনিস। ল্যামিনেটিনং মেশিন ভালো লাগে তোমার? ফটোকপি করা লেকচার। দূর-থেকে-সুন্দর। বিবর্ণ পপলার। মীম তুমি দূর-থেকে-সুন্দর, বিবর্ণ পপলার।
এক হাজার কালোহাস তোমাকে ছেড়ে উড়ে যায়, অধিকৃত উপত্যকা থেকে আকাশের নীল গম্বুজ পর্যন্ত দরগাগেট থেকে মন টানা, অর্থাৎ যতক্ষণ মন টানে আরকি। আর তুমি যেতে পারো না মীম, দাঁড়িয়ে থাকো বারান্দায়। পাতাবাহারের ভারী টবের মতো। পাতার জিভের ওপর শিশিরের সর। রাতের মোজাইকে সারারাত ভিজেছে তোমার সবুজ ফ্রক। শাদা হাস শুভ্রতার প্রতীক, আর কালোগুলা সব তোমার। এক হাজার কালো হাস তাদের পালক ছড়িয়ে বসেছে তোমার চোখের মণির ওপর। যারা এক হাজার কালো হাঁসকে একসাথে উড়তে দেখেনি কখনো তারা হয়তো মনে করে এ তোমার ছেলেবেলার নর্মসখী— কালো দীঘি, যার তলায় জমে আছে মরা পালক। তোমার হাঁস কোথায় মীম? তোমার চোখে মরা পালক!
পড়ো মীম
আ— এক — আড়াই
দুই — দ — দেড়
এক— আ — আড়াই
দ — দুই — দেড়
[ভেরি গুড ভেরি গুড ওয়েল ডান]
যারা গভীর ষড়যন্ত্রের সাথে বলে “ভালো আছো?”, তাদেরকে রূদ্ধশ্বাসে বলো “ভালো আছি!” এ ভালো থাকা কোনো অপরাধ নয়। এই কনফিউশন কি কোনো অনুভূতি নয়? একটা ভয়ংকর ঝড় যে আসছে এ কথা আমাদের মন জেনে গেছে। তালগাছের মতো সে তার শরীর আছরাচ্ছে তোমার শরীরবুকে। শেকড় ছিঁড়ে বের হতে চাইছে। এ এক অসম্ভব ধকল মীম। শেকড়বিহীন ঘোড়াগুলির প্রবল উল্লম্ফনে তোমার বুক হাঁপিয়ে ওঠে। পা টলে যায়, দাঁড়িয়ে থাকতে পারো না। কিন্তু বাতাস পড়ে গেছে। আকাশ আরও থমথমে। দেখতে না পেলেও আমাদের বুঝতে বাকি নাই আর। এ ঝড় শেষ না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো স্বপ্নই আমাদের ঘুমাতে দিবে না।
তোমার হাঁসগুলিকে কাছে ডাকো মীম, উড়ে যেতে দিও না!
হাতছাড়া ঘড়িগুলো দেয়ালে ঝুলছে। মুরগীর খোয়ারের মতো ঘরগুলিকে কচ্ছপের খোল ভেবে ঢুকে পড়ছে মানুষ। পিঠ বেয়ে নামা আঙুলের মতো রাত নামছে নিরাপত্তা বেষ্টনী বেয়ে। উঁচু পাঁচিলের জানালা দিয়ে ফালি ফালি কেটে ফেলা চাঁদের ত্বক যখন ঝলমল করে মৃত মানুষের চোখের মতো মার্বেল বাঁধানো ঘরে, তখন তারা ( ভাগ্যের উপত্যকা থেকে যারা বিশ্বাসটাকে সহজে ছুঁড়ে ফেলতে পারলেও অভিশাপ হটাতে পারে নাই) মনের পশুটাকে হত্যা করবে বলে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে ধারালো নখরের সাথে। বিবর্তনবাদ অনুযায়ী তাদের সবচেয়ে বিব্রত জীবনটাই তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। তাদের পিছল শরীর, ফুলকার মতো ফুলে ওঠা রগ, মাথার ভিতর ফুটে উঠছিলো কাবিলের রক্ত, টগবগে গোলাপ।
…আর টাটকা হতে থাকা ক্ষতের মতো জ্বলজ্বল করছে তোমার চোখ। ঘড়িগুলি সব বজ্রাহত গাছের মতো— চুপ। কিন্তু হাতের রেখাগুলি রেডিয়াম ডায়ালের মতো আরো পষ্ট হয়ে উঠেছে। (হাতের রেখার প্রতি তোমার গভীর ফ্যাসিনেশান!)
রাত গভীর হলে ফ্রিজে রাখা আপেল আরো রক্তিম হয়ে উঠে, ছুরি আরো ধারালো, নতুন।
(মীম তুমি যেথা ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার কর, কিন্তু ওই ফ্রিজের নিকটবর্তী হইও না)
এ ঝড় আমাদের এমনভাবে বদলে দেবে যা আমরা দেখি নাই, ভাবিও নাই কখনো।
(বাঘটাকে বাঁচাও প্রভু, রাখালটাকে ঘরে রাখো!)
মীম!
পশু হত্যা করতে গিয়ে তুমি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ো ধারালো নখরের সাথে!
নবদীক্ষিত তুমি, পর পর লাল টাইলস টপকে এখনো হাঁটতে…
তুমি এখন মা
“পাথরও কতক এমন হয় যে, উহা হইতে নদী-নালা প্রবাহিত হয়”
বাকারা, ৭৪
তোমার পিঠে ডানা বন্ধের শব্দ,
তোমার হাতে কালো রঙের ছাতা ফুটানো
মা হয়ে গেছ তুমি
যে শিশু তোমার মনে লুকানো ছিলো
তার
তুমি জানো না সে এখানে কিভাবে আসলো
তবু তোমার চোখে শুধু অতীতের স্বপ্ন
এক প্রতীকের মতো অস্তিত্ব তার
অন্য কোনো সময়ের, অন্য কোনো মনের
সকালের হীরাগুলির মতো সে
জড়ো হয়েছিলো তোমার পায়ের কাছে
(তোমার প্রবালে কাঁটা পা !)
আর তোমার শ্রমেভেজা মুখ
আমার চোখে হয়ে আছে উজ্জ্বল
যে শ্রম তোমার চিন্তার মতো নিঃশব্দ
তোমার ঘামের মতো নিরব
তুমি আজলা ভরে তুলে নিলা সে মুখ
রিফিউজি নৌকা থেকে রিফিউজি শিশুর মতো
দৈনিক পারিশ্রমিকের পর যে চোরাআশীর্বাদ
নেমে আসে ফেরেশতাদের অগোচরে
আর গ্রহণ করলা তাকে
এক ভুলে যাওয়া প্রার্থনার মতো
এক অনন্ত সাগর পারে ডুবে গেল
তোমার চোখের নৌকা
তোমার চোখ মার্বেলের মতো ভারী
তোমার মন পাথরের মতো ভেজা
তুমি এখন পূর্ণবয়স্ক
তুমি এখন মা
অন্যমনস্ক
একটা অন্যমনস্ক মেঘ উড়ে যাচ্ছিলো কোথাও
অথবা তুমিই অন্যমনস্ক ছিলা
মেঘটা ছিলো তোমার মতো
কিংবা তুমি ব্যস্ত ছিলা
বিভোর হয়ে ছিলা
অন্যমনস্ক কোনো কাজে
আর আমার মনে হলো আমি তোমাকে ঘৃণা করি
আমার পকেটে-না-থাকা ছুড়িটা ঢুকায় দেই সোজা
তোমার হৃৎপিণ্ড বরাবর
গভীরে
যেখানে আমি ওই হৃৎপিণ্ডটা ছুঁইলে দেখবো
সে আমার কৃতকর্মে মোটেও অবাক হয় নাই
তার অলস বিড়ালের পেটের মতো নরম ত্বকে
কোনো ঢোক ওঠে নাই; বা টোল পড়ে নাই
এক ধ্যানভাঙা সন্ন্যাসীর মতো লাল ঘৃণা নিয়ে সে
আমার হাতে ঝিমাচ্ছে
যেন আমি তো এরকমই!
একটা শান্ত মেঘের মতো,
বিস্ময় ধীরে ধীরে ছড়ায় পড়লো
আমার শরীরে
মীম
আমিও তো ভিতর থেকে এরকম শক্ত হতে চাই
যেরকম তুমি শক্ত হতে পারো তোমার কথাগুলির উপর
আমি তো এখনো ওই হোপলেসলি নাম্ব
না হয় স্পর্শকাতর!
আমাকে বলছিলা, শক্ত হতে চাইলে নাকি
আগে নরম কিছুকে ভাঙতে হয়
একটা ইটের ঢেলা যেরকম ভাঙতে পারে মাটির পাতিল
কিন্তু এমন নরম জিনিস আমি কোথায় পাই?
তুমিই বা পাইছিলা কোথায়?
সবাই তো তোমার মতোই শক্ত一 কঠিন!
এগুলা জিজ্ঞেস করলেই কেমন বিনীত হয়ে থাকো
ক্লাসে হাইয়েস্ট মার্ক পাওয়ার মতোন
আর কেন যে এত প্রাউড ফিল করো!
এমনিতেও এগুলা কি ম্যাটার করে তেমন ?
অতীতকে তো আমরা কত ভিন্ন ভাবেই মনে রাখি
হইলাম শক্ত বা নরম
সকালে মাথা ব্যথার মতো দিনগুলার
কিছুটা এখনো বাকী আছে一 থাকুক
একটা নাপা, এক চামচ কফি, দুই চামচ দুধ
মানুষের মন
একদিন চা হাতে সকালের পত্রিকায় চোখ বুলাতে বুলাতে যদি দেখেন প্রথম পাতায় বড় হরফে ছাপা হয়েছে: সুন্দরবনে আর একটি বাঘও অবশিষ্ট নাই। তখন হয়তো আপনার মনে হতে পারে বনের পশুটা যেন মনের মধ্যে বেঁচে থাকে।
তাহমিদ রহমান
Latest posts by তাহমিদ রহমান (see all)
- মীম ও অন্য কয়েকটা কবিতা - সেপ্টেম্বর 10, 2024
- একটা নভেলের জন্ম একটা কবিতা দিয়া শুরু হয় – গুন্টার গ্রাস - মার্চ 4, 2024
- তাহমিদ রহমানের কবিতা - সেপ্টেম্বর 11, 2023