ফররুখ আহমদের কয়েকটা কবিতা
ফররুখ আহমদ বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে বেশ অস্বস্তিকর একটা ঘটনা। প্রথমে উনি আধুনিক কবি আছিলেন; শনিবারের চিঠি’তে উনার কবিতার সমালোচনা করা হইছে, কলকাতার অনেক পত্রিকায় উনার কবিতা ছাপা হইছে এবং উনার লেখালেখির শুরুর সময়টাতে শিখা গোষ্ঠীও উনারে মারাত্মক রকমের প্রেইজ করছেন, আধুনিক কবি বইলা।
কিন্তু ১৯৪৬ এ ‘আজাদ করো পাকিস্তান’ নামে ছোট কবিতার বই ছাপাইয়া উনি এমন একটা জায়াগাতে রিচ করলেন, যেইটারে কলকাতাভিত্তিক বাংলাকবিতাপন্ডিতদের পক্ষে ‘আধুনিক কবিতা’ বইলা মাইনা নেয়াটা একটু মুশকিলেরই হওয়ার কথা। অবশ্য উনি মরার পরে উনার প্রথমজীবনের কবিতা নিয়া বেশ কয়েকটা কবিতার বই ছাপানো হইছে যেইখানে সম্ভবত তার ‘আধুনিক কবি’ ইমেজ আবার কিছুটা রিগেইন করা গেছে।
আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রথমে তারে ‘ইসলামসচেতন’ কইলেও পরে ‘স্বতন্ত্রসংস্কৃতিসচেতন’ বলছেন। বাংলা-কবিতার ধারায় ফররুখ আহমদ এখনো একজন ‘স্বতন্ত্র’ বইলাই আল মাহমুদরে অনেকবেশি ‘এসটোনেসিং’ এবং জসীমউদ্দীন’রে (নন-আধুনিক হওয়ার পরেও) ‘জাতীয়’ ধারার কবি মনে হইতে থাকে।
আল মাহমুদের কবিতায় যেইটা ‘পূর্ববঙ্গীয়’ উচ্চারণ/উপাদান/সাহস/ড্রিম, সেইটা ফররুখ আহমদের উপস্থিতি থিকাই ডিরাইভ করা যায়; কিন্তু তারপরও উনারে ‘আধুনিক’ বলতে গেলে অস্বস্তি লাগার মূল কারণ হইলো তিনি ইসলামের পুনরুজ্জীবন চাইছেন, ইকবালের মতো মর্ডান-ইসলামের একটা এসথেটিকস তৈরির চেষ্টা তিনি করছেন বাংলাকবিতায়। নজরুল ইসলাম’রে উনি কখনোই আদর্শ হিসাবে নেন নাই। ধারণা করা যায়, রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তান ব্যর্থ হওয়ার পরে মোর বাঙালি এবং লেস মুসলমানদের কাছে উনার কবিতার চিত্রকল্পগুলি সময়ের সাথে সাথে দূরবর্তী হইতে হইতে একটা সময় ‘স্বতন্ত্র’ হয়া ওঠে! জসীমউদ্দিনের বাংলা-আবিষ্কারে অবশ্য এইসব নিয়া কোন টেনশনই নাই, প্রি-মর্ডান নজরুলীয় সাম্যই এগজিস্ট করতেছে।
বাঁইচা থাকার সময় ফররুখ আহমদের ছয়টা কবিতার বই ছাপা হইছিল আর মরার পরে দশটার বেশি পান্ডুলিপি ছাপা হইছে। প্রকাশের সময় ধইরা বিভিন্ন সময়ের কবিতা রাখার চেষ্টা করা হইছে এইখানে; লেখার সময় হিসাবে আগ-পিছ আছে।
ই.হা.
________________________________________________
পুরানো মাজারে ।। মন ।। বর্ষার বিষন্ন চাঁদ ।। সিলেট ষ্টেশনে একটি শীতের প্রভাত ।। ভূমিকা ।। কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি ।। বিদায় ।। হাবেদা মরুর কাহিনী (দশ) ।। শীতরাত্রির আলাপ ।।
_____________________________________________
পুরানো মাজারে
পুরানো মাজারে শুয়ে মানুষের কয়খানা হাড়
শোনে এক রাতজাগা পাখীর আওয়াজ। নামে তার
ঘনীভূত রাত্রি আরো ঘন হ’য়ে স্মৃতির পাহাড়।
এই সব রাত্রি শুধু একমনে কথা কহিবার
নিজেদের সাথে। জানি; – মুসাফির-ধূলির অতিথি
প্রচুর বিভ্রমে, লাস্যে দেখেছিল যে তন্বী পৃথিবী
পুঞ্জীভূত স্মৃতি তার জীবনের ব্যর্থ শোক-গীতি:
রাতজাগা পাখীর আওয়াজ: জমা আঁধারের ঢিবি –
যেন এক বালুচর, দুই পাশে তরঙ্গ-সঙ্কুল
জীবনের খরস্রোত, নিষ্প্রাণ বিশুভ্র বালুচরে
কাফনের পাশ দিয়ে বেজে চলে দৃঢ় পাখোয়াজ।
পুরানো ইটের কোলে শোনে কারা সংখ্যাহীন ভুল
ঝরেছে অপরাজেয় অগণিত মৃত্যুর গহ্বরে।
মাজারে কাঁপায়ে তোলে রাতজাগা পাখীর আওয়াজ।।
সাত সাগরের মাঝি (ডিসেম্বর, ১৯৪৪) থেকে
মন
মন মোর আসন্ন সন্ধ্যার তিমি মাছ-
ডুব দিল রাত্রির সাগরে।
তবু শুনি দূর হ’তে ভেসে আসে-যে আওয়াজ
অবরুদ্ধ খাকের সিনায়।
সূর্য মুছিয়াছে বর্ণ গোধুলি মেঘের ক্লান্ত মিনারের গায়,
গতি আজ নাইকো হাওয়ায়
নিবিড় সুপ্তির আগে বোঝে না সে শান্তি নাই তমিস্রা পাথারে।
তবু পরিশ্রান্ত ম্লান স্নায়ুর বিবশ সঞ্চরণে
আতপ্ত গতির স্বপ্ন জমা হয় মনে,
বুঝি চৈত্র অবসন্ন আকাশে আকাশে ফেরে ঝড়ের সংকেত
বুঝি দুঃস্বপ্নের মত ভিড় ক’রে আসে কোটি প্রেত
অমনি
মনের দিগন্তে মোর চমকায় সহস্র অশনি।
শুনি আকাশের ধ্বনি :
তোমার দুর্ভাগ্য রাত্রি মুক্ত পূর্বাশার তীরে
হ’য়েছে উজ্জ্বল,
তোমার অরণ্যে আজ পুরাতন বনস্পতি
ছাড়িয়াছে বিশীর্ণ বল্কল।
দিগন্ত-বহ্নির মত হানা দিয়ে ফেরে সে ভাবনা,
অবসন্ন জনতার মনে দোলে বৈশাখের
বজ্র-দীপ্ত-মেঘ সম্ভাবনা।
রাত্রির সমুদ্র ছাড়ি-মন
প্রভাতের যুক্ত বিহঙ্গম।
আকাশে উধাও ডানা, ছেড়ে যায় পুরাতন লুণ্ঠিত মিনার
ছেড়ে যায় আকাশের বর্ণ বিভা, দিগন্ত কিনার;
বন্দীর স্বপ্নের মত বাঁধামুক্ত মন; -মোর মন।
সিরাজাম মুনীরা (সেপ্টেম্বর ১৯৫২) থেকে
বর্ষার বিষন্ন চাঁদ
বর্ষার বিষন্ন চাঁদ এ রাতেও উঠেছে তেমনি
যেমন সে উঠেছিল হাজার বছর আগেকার
বৃষ্টি-ধোয়া আসমানে। সে রাত্রির অস্ফুটে ব্যথার
মৃদু স্বর আছে এ আকাশে। সেই ক্ষীণ কণ্ঠধ্বনি
আমার মনের তারে বেজে ওঠে আপনা আপনি,
শ্রাবণ মেঘের মাঝে ডুবে যায় চাঁদ যতবার;
যতবার ভেসে ওঠে। দূরে এক অস্পষ্ট মাজার
শতাব্দীর স্মৃতি নিয়ে জাগায় ব্যথার আবেষ্টনী।
হাজার বছর পরে এই চাঁদ বিষন্ন বর্ষার
ব’য়ে নিয়ে যাবে স্মৃতি জনপদে বেদনা-মন্থর;
অস্পষ্ট ছায়ার মত, যেখানে এ রাত্রির দুয়ারে,
খুলে দেবে অন্ধকারে জীবনের বিস্মৃত প্রহর;
বৃষ্টি ধোয়া আসমানে জাগাবে সে এই ক্লান্ত স্বর;
হাজার বছর পরে একবার শুধু একবার।।
মুহূর্তের কবিতা (সেপ্টেম্বর ১৯৬৩) থেকে
সিলেট ষ্টেশনে একটি শীতের প্রভাত
অন্ধকার আজদাহার বেষ্টনীতে প্রাণী ও প্রাণের
সাড়া নেই। এখানে জালালাবাদে দেখি এসে
হিম-সিক্ত কম্বলের মত রাত্রি ঢেকেছে নিঃশেষে
সমস্ত আলোকরশ্মি পৃথিবীর সকল পথের।
ইরানী ছুরির মত তীক্ষ্মধার হাওয়া উত্তরের
সিদ্ধ হয় অনাবৃত তরু শীর্ষে, নিমেষে নিমেষে
তারি স্পর্শ পাই শূন্য প্লাটফর্মে; মাঘ রাত্রি শেষে
সুপ্তিমগ্ন জনপ্রাণী এখন সিলেট শহরের।
বাতাসের দীর্ঘশ্বাস ঝিল্লিও নীরব, পাখীদের
বাসায় নিঃসাড় ঘুম (মৃত্যু নেমে আসে ছদ্মবেশে
পৌত্তলিক অন্ধকারে), সাড়া নাই মুক্ত জীবনের;
মৌন প্রতীক্ষায় ধরা মর্মরিয়া ওঠে তবু ক্লেশে।
তারপর কি আশ্চর্য দেখি চেয়ে প্রতীক্ষার শেষে
প্রশান্ত প্রভাত নামে স্নিগ্ধোজ্জ্বল হাসি দরবেশের।।
মুহূর্তের কবিতা (সেপ্টেম্বর ১৯৬৩) থেকে
ভূমিকা
কবিকে যখন হ’তে হয় কবিরাজ
মহাজন বাক্য মতে বাঁশী হয় বাঁশ;
(যেহেতু মসৃণ চিত্তে জাগে মোটা আঁশ
মিহি সুর-পরিবর্তে কর্কশ আওয়াজ)
তখন সম্ভব নয় কবিতার কাজ।
প্রয়োজনে নিতে হয় হাতে বিপরীত
বংশদন্ড (প্রচলিত বিদ্রুপের রীত্)
মালঞ্চের প্রান্তে তাই ঠাঁই পায় বাঁশ।
(বিশেষ জীবের তরে অতি প্রয়োজন
বাঁশের আবাদ কভু নহে নিরর্থক)
ইত্যাকার কথা ভেবে করিনু পরখ,
অবশ্য হ’য়েছে জানি কাব্য সংকোচন;
(অনন্য উপায়) তাই ত্যক্ত করি মন
অগত্যা দেখাতে হ’ল হংস মাঝে বক।।
শ্রেষ্ঠ কবিতা (জুন ১৯৭৫) থেকে
কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি
কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি। ডিপোতলে এঞ্জিল বিকল –
সুদীর্ঘ বিশ্রান্ত শ্বাস ফেলে জাগে ফাটা বয়লার,
– অবরুদ্ধ গতিবেগ। তারপর আসে মিস্ত্রিদল
গলানো ইস্পাত আনে, দৃঢ় অস্ত্র হানে বারবার।
জ্বলন্ত অগ্নির তাপে এইসব যন্ত্র জানোয়ার
দিন রাত্রি ঘোরেফেরে সুদুর্গম দেশে, সমতলে
সমান্তর, রেলে রেলে, সেতুপথে পার হয়ে আর
অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে দার্জিলিঙে আসামে জঙ্গলে।
আহত সন্ধ্যায় তারা অবশেষে কাঁচড়াপাড়াতে।
দূরে নাগরিক আশা জ্বলে বালবে লাল-নীল-পীত;
উজ্জ্বীবিত কামনার অগ্নিমোহ-অশান্ত ক্ষুধাতে;
কাঁচড়াপাড়ার কলে মিস্ত্রিদের নারীর সঙ্গীত।
(হাতুড়িও লক্ষ্যভ্রষ্ট) ম্লান চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ রাতে
কাঁচড়াপাড়ায় জাগে নারী আর স্বপ্নের ইঙ্গিত।।
হে বন্য স্বপ্নেরা (নভেম্বর ১৯৭৬) থেকে
বিদায়
শুনেছিলাম স্বপ্নঘোরে তোমার নাম,
ছুঁয়েছিলাম কেশরাশি, অলকদাম,
হাজার রাতের কথায় তোমার জেগেছে ভয়;
তোমায় হারাই চিত্ত আমার শংকাময়,
পুরানো চাঁদ দেখি দ্বারে চির নূতন,
চম্পা হ’য়ে ফোটে আমার বিস্মরণ,
প্রাচীন কথায় গাঁথা তোমার নতুন মালা
চির-নতুন পূর্ণিমা ওই চাঁদের থালা;
তোমার প্রেমের জাফরানে আজ সব রঙিন
শাহেরজাদী! বিদায়, দেখ জাগছে দিন।।
হে বন্য স্বপ্নেরা (নভেম্বর ১৯৭৬) থেকে
হাবেদা মরুর কাহিনী (দশ)
বিষণ্ন সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোকে
কাল জেগে উঠেছিল
এক মজা নদীর কাহিনী
(উচ্ছল পারার মত আকাশের সেই আরশি –
মুখ দেখাতো যাতে
সংখ্যাহীন তারা আর চাঁদ,
পাল তুলে যেতো দূরের নৌকা
উদ্দাম স্রোতে ভাসমান রাজহাঁসের মত;
সে নদী এখন গেছে শুকায়ে!
তার বালু-বক্ষে এখন ঘুরে বেড়ায়
তপ্ত হাওয়ার শ্বাসে
বহু যুগ আগের এক বিগত দিনের কান্না)
আর মনে হয়েছিল
এখনো সে নদী পারে বাঁচতে
এখনো সে পারে ফিরে পেতে
তার বহমান তরঙ্গ
উদ্দাম গতিবেগ,
প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাস;
যদি সে খুঁজে পায়
শুধু তার মূলের ঠিকানা।
হাবেদা মরুর কাহিনী (সেপ্টেম্বর ১৯৮১) থেকে
শীতরাত্রির আলাপ
দুনিয়া : সেই উজ্জ্বল আসমানি শামিয়ানা
লুকালো কোথায়, হয়নি আমার জানা।
আসমান : ছিলাম যেখানে, আছি আমি সেখানেই।
পাই না তোমাকে; তোমারি তো দেখা নেই।
দুনিয়া : দু’চোখে আমার মৃত্যুর কালো আঁধি।
আসমান : হিম কুয়াশায় বন্দিনী শাহজাদী।।
তসবিরনামা (ডিসেম্বর ১৯৮৬) থেকে
ফররুখ আহমদ
Latest posts by ফররুখ আহমদ (see all)
- ফররুখ আহমদের কয়েকটা কবিতা - ডিসেম্বর 27, 2013