বাঙ্গালী মুসলমানের সাহিত্য-সমস্যা: কাজী আবদুল ওদুদ
কাজী আবদুল ওদুদের এই লেখাটা ছাপা হইছিল ‘শিখা’ পত্রিকার ফার্স্ট সংখ্যায়, ১৯২৭ সালে। ‘শিখা’ পত্রিকা ছিল ঢাকার ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’র পত্রিকা, বছরে একবার ছাপা হইতো; ১৯২৭ টু ১৯৩১ – এই কয় বছরে ৫টা সংখ্যা ছাপা হইছিল। যদিও ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ ঢাকায় গঠন করা হইছিল ১৯২৬ সালের ১৯শে জানুয়ারিতে আর চালু ছিল ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত।
‘শিখা’ পত্রিকারে ‘সেক্যুলার মুসলিম’ একটা ঘটনা হিসাবে দেখার রেওয়াজ এখনো আছে, কিন্তু আমার ধারণা, এইভাবে দেখার ঘটনাটা খালি ভুলই না, এর সিগনিফেকেন্সের জায়গাটা বরং এড়ায়া যাওয়া হয়।
অই সময়ে নবাব আবদুল লতিফ ‘মুসলিম লিটারারি সোসাইটি’ বানাইছিলেন যখন আবুল হুসেন-কাজী আবদুল ওদুদ ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ বানাইছিলেন; নবাবদের’টা ছিল ইংরেজি ভাষায়, আর উনাদেরটা ছিল বাংলা-ভাষায়। কিন্তু উনারা কলোনিয়াল বাংলাতেই লিখতেন, মানে, অইটাই তো তখন ‘বাংলা-ভাষা’। বাংলা-ভাষা জানা লোকজন, মানে ‘শিক্ষিত’ লোকজনের নিয়াই সভা-টভা করতেন, পত্রিকা ছাপাইতেন। কলকাতার এলিটের বিপরীতে ঢাকার এলিট হইতে চাইতেছিলেন – এইরকম না ভাবলেও, কম-বেশি ‘শিক্ষিত বাঙ্গালীদের’কেই রিপ্রেজেন্ট করতে চাইছেন। (এই লেখাটাতে দেখবেন, এখন ‘লোক-সাহিত্য’ বইলা যে জিনিসটা আছে, সেইটারে উনি লিটারেচার হিসাবে কন্সিডার করতে পারেন নাই।…) ‘মুসলিম’ বলতেছি না কারণ উনাদের ফোকাসটা ‘বাঙালি’ বিষয়ের উপ্রেই ছিল এবং এই বাঙালিদের মধ্যে একটা ‘আধুনিক’ মুসলমান সমাজ তৈরি করতে হবে যারা সমাজের নানানদিক নিয়া আলাপ-আলোচনা করবেন, ইন্টেলেকচুয়াল দিশা দিবেন। বাঙালিদের মধ্যে মুসলিম সমাজের জায়গাটারে পোক্ত করবেন – এইরকম।
মানে, মুসলমানরা বাঙালি না – এইটা কোন মুসলমান ইন্টেলেকচুয়ালের ক্লেইম তো না! এই কথা কইলে ‘সেক্যুলার’ হইতে হবে কেনো! বরং ‘মুসলমানরাও বাঙালি’ – এইটা হইতেছে একটা হিন্দুত্ববাদী ক্লেইম, যার ফলে কোন মুসলমান ইন্টেলেকচুয়াল যদি নিজেরে ‘বাঙালি’ সমাজের লোক ধইরা নিয়া কথা শুরু করেন, তারে ধইরা নেয়া হয় – ‘সেক্যুলার’। এইটা হইতেছে শত বছরের হিন্দুত্ববাদী প্রপাগান্ডার রেজাল্ট। ভুল।
তো, ‘মুসলিম-সাহিত্য সমাজ’ তথা ‘শিখা’ পত্রিকার সিগনিফিকেন্স বেশ কয়েকটা জায়গায়; এক, উনারা একটা ‘সমাজ’ তৈরি করতে চাইতেছেন – এইটা খুবই বড় একটা উদ্দেশ্য, খালি সাহিত্য করার ঘটনা না এইটা, সাহিত্য তো করতেই চাইতেছেন, কিন্তু সাহিত্য করার ভিতর দিয়া একটা ‘সমাজ’ গঠনের দিকে উনারা আগাইতে চাইতেছেন; সেকেন্ড জিনিস হইলো, নামে ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ হইলেও হিন্দু-লেখকরা এইখানে নিষিদ্ধ না, বরং মুসলমান এবং হিন্দু যে দুইটা আইডেন্টিটি – এর রিকগনিশনের জায়গা এইটা, সাবজেক্ট হিসাবে ‘মুসলমান’ হইতেছে ঘটনাটা, সাহিত্যে একটা ‘অস্পৃশ্য’ ‘অদৃশ্য’ কমিউনিটিরে সামনে নিয়া আসা…; থার্ড এর জিওগ্রাফিক্যাল সেন্টার হইতেছে, ‘ঢাকা’, কলকাতা না (মনে রাইখেন সালটা ১৯২৭-৩১), এই জায়গাটারে মনে হইতে পারে এখনকার চিটাগাং, সিলেটের মতন ব্যাপার ঢাকার এগেনেস্টে, কিন্তু পরবর্তী হিস্ট্রির কারণে ব্যাপারটা ঠিক ‘আঞ্চলিক’ হয়া থাকে নাই, আর ক্লেইমটাও ঠিক ‘আঞ্চলিক’ হয়া উঠার না, বরং ঢাকা’রে একটা সেন্টার হিসাবে গইড়া তোলারই; ফোর্থ হইলো, মুসলমান-সমাজের সাহিত্যে যে কোন কন্ট্রিবিউশন নাই – তা না; ‘গরিব’ ও ‘গ্রামের’ মুসলমানদের গান, সংস্কৃতি বরং অনেক পাওয়ারফুল – এই আন্দাজ উনাদের আছে, কিন্তু ‘শিক্ষিত’ মুসলমানদেরই বরং কোন সাহিত্য-সংস্কৃতি নাই, নাই কেন? – এই জিনিসটা উনারা ইনকোয়ারি কইরা বুঝতে চাইতেছেন এবং কিছু করতে চাইতেছেন; তো, ক্লাস-কনশাসনেসের জায়গাটারে উনারা এড়ায়া গেছেন – ব্যাপারটা এইরকম না, উনারা মনে করতেছেন এই ‘শিক্ষিত’ মুসলমানরা তাদের সমাজের প্রতি দায়িত্বটা পালন করতেছেন না, এনগেইজ হইতেছেন না এবং সমাজরে এনগেইজড করতেছেন না, যদিও ‘আধুনিকতার’ পারসপেক্টিভে এই কাজটা উনারা করতেছেন, কিন্তু অইটার ভিতরে ঘটনাটারে আটকায়া ফেললে ভুল হবে আসলে, উনাদের ইন্টার-একশন করার, যাচাই-বাছাই করার জায়গাগুলারে বরং ইগনোর করা হবে। কিন্তু আনফরচুনেটলি এইরকম একটা রিডিং আছে আমাদের দেশে ‘শিখা’ পত্রিকা নিয়া।…
‘শিখা পত্রিকা’ আসলে শেষ হয়া যায় আবুল হুসেন সাহেবের এই জায়গা থিকা সইরা যাওয়ার পরেই। যদিও বলা হয় ‘রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ’ উনার এগেনেস্টে ঝামেলা করতেছিল, ঘটনা ছিল আসলে ঢাকার নবাব পরিবারের লোকজন উনার সোশ্যাল ও পলিটিক্যাল পজিশনগুলারে নিতে পারতেছিল না। এইরকম কথাও আছে যে, উনারে বিচার করার নামে ৪০ হাত নাকে খত দেয়াইছিল, নবাব বাড়ির লোকেরা। (যদিও এই ঘটনার লিখিত কোন ডকুমেন্ট পাই নাই, কিন্তু লেখা হয় নাই বইলা ঘটনা ঘটে নাই – এই কনক্লোশনে যাওয়া মনেহয় ঠিক হবে না। বরং বাংলাপিডিয়ার এন্ট্রিতে এর কিছু ইশারাই আছে।) উনি পরে ঢাকা ভার্সিটির চাকরি ছাইড়া দিয়া কলকাতাতে চইলা যান। উনি চইলা যাওয়ার পরে শিখা পত্রিকার একটা সংখ্যা ছাপা হয়। আর তারপরেই দ্য এন্ড হয়। আর কাজী আবদুল ওদুদ ১৯৪৭ সালে ঢাকা ভার্সিটির চাকরির অফার ফিরায়া দিয়া কলকাতা’তে চইলা যান। উনার এই ডিসিশনে আবুল হুসেনের ঘটনার ট্রমা কি কাজ করে নাই?
২.
তো, যেইটা শুরুতে একটু বলতে নিছিলাম, সাহিত্য বলতে কাজী আবদুল ওদুদ “উচ্চশ্রেণীর” জিনিসরেই বুঝাইছেন, বলছেনও: “বাংলা সাহিত্যে বাংলার উচ্চশ্রেণীর মুসলমানের বিশেষ লক্ষ্যযোগ্য কোন দান নাই; অর্থাৎ এমন দান যার জন্য বাংলার চিত্তে শ্রদ্ধা জেগেছে, তা আপনারা জানেন। কিন্তু বাংলার লোকসঙ্গীতে নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের দান সাদরে গৃহীত হয়েছে…” তো, ‘নিন্মশ্রেণী’ প্রথমেই বাদ। এই বাদ দেয়াটা, দাবি ছাইড়া দেয়াটা ঠিক হয় নাই আর কি। (কলকাতার কবিগুরুরা বরং পরে এরই সাহিত্যিক দখল নিছেন, কলোনিয়াল বেচাবিক্রির বাইরে এখনো এই গ্রাম-বাংলা বেইচা চলতেছেন।…)
কিন্তু যেই জায়গাটাতে উনি ফোকাস করছেন, সেইটা খুব ভালোভাবেই আইডেন্টিফাই করছেন। বলছেন, সাহিত্য হয় না ‘পিওরেটিয়ান’ এর কারণে, ‘খাঁটি বাংলা-ভাষায়’ লেখতে হবে, ‘খাঁটি মুসলমান হইতে হবে’ – এইসব বালছাল তো এখনো আছে সমাজে। ওদুদ সাহেব অই পর্যন্ত গেছেন, কিন্তু এইটা কই থিকা আসছে, সেই পর্যন্ত যান নাই বইলা আমার মনে হইছে। কিন্তু সেইটার ইশারা উনার লেখাতেই আছে কিছুটা। উনি বলছেন, এইখানে যে ‘হিন্দু’ সেই হিন্দু দুনিয়ার মানুশের লগে মিলতে পারে নাই, জাতি-বর্ণ নিয়া পইড়া রইছে, যার এগেনেস্টে মুসলমানদের মধ্যেও ‘সাম্প্রদায়িক’ একটা অবস্থা তৈরি হইছে। তো, এই যে ‘খাঁটি’ হওয়ার লোভ, এইটা যে খালি মুসলমানদের মধ্যে আছে – তা না, কোন হিস্ট্রিক্যাল ইনফিরিয়রিটি থিকা এইটা আসছে। নিজেদের কালচারাল ডিফরেন্সরে নিজেরা না নিতে পারার ঘটনাও থাকতে পারে, পলিটিক্যাল পাওয়ারের বাইরেও।… মুসলমান এবং হিন্দু – দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘বাঙালি’ হিসাবে এই ইনফিরিয়রিটি ইন-বিল্ড আছে মনেহয়। এর একটা ইনকোয়ারি দরকার।… মানে, ঘটনা’টা খালি এইটা না যে, পাকিস্তান বা ইরান-ইরাক-মিডলইস্টের মুসলমান’রা বাঙালি মুসলমানদের এনাফ বা খাঁটি মুসলমান মনে করে না (ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ কইতেছিলেন, বিহারের লোকজন তারে খেপাইতো, বেটা তুই মাছ খাস, মাংস খাস না, তুই আবার কিসের মুসলমান!), বরং নর্থ ইন্ডিয়ান হিন্দুরাও বাঙালি হিন্দুদেরকে একটু কম-হিন্দুই মনে করার কথা। তো, এই ঘটনাগুলা, পারসেপশনগুলা এইখানে আছে। যেইগুলা নিয়া কথা কওয়া হয় না।…
৩.
তো, কাজী আবদুল ওদুদের কথাটা খালি এইটুকই না। বরং উনার লেখাটারে, অই সময়ের ঘটনাগুলারে নতুন ভাবে পড়ার দরকার আছে, নতুন কইরা কথা বলার আগে দেখার দরকার কি কি জিনিস উনারা কইতে চাইছিলেন, কোন জায়গা থিকা বলছিলেন।
নতুন ইতিহাসের কথা ভাবতে হইলে আগে পুরান ইতিহাসের উপর থিকা পর্দা সরাইতে হবে। এইটা করার জন্য কাজী আবদুল ওদুদের লেখাটার লগে যোগাযোগ করাটা, ইন্টারপ্রেট করার জরুরি মনে করতেছি আমরা।
তো আসেন, পুরান লেখাটা পড়ি! নতুন বুঝ বানানোর কোশিশ করি।
/ই.হা.
………………………………………………………………
বাংলার লোকদের দোষ-ত্রুটি নিশ্চয়ই খুব কম নয়। তবু মনে হয়, এদেশের কথা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, কেননা অপেক্ষাকৃত অল্প কালের ব্যবধানে মানুষের চিত্তের অপূৰ্ব্বতার নব নব প্রকাশ এদেশে ঘটেছে। কিন্তু বাংলার ঐতিহাসিককে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, বাংলার গৌরবসামগ্রী এই যে সমস্ত আন্দোলন, যেমন বৈষ্ণব আন্দোলন, ব্রাহ্ম আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ইত্যাদি এ সমস্তের অন্তরে মুসলমান নামধেয় বাংলার এক বিশাল মানব সমাজের কি দান, তাহলে মোটের উপর তৃষ্ণীম্ভাব অবলম্বন ভিন্ন তাঁর হয়ত আর গত্যন্তর থাকে না।
বাংলার মুসলমানের আত্মপ্রকাশের এই দীনতা লক্ষ্য করেই আমাদের কোন কোন সমালোচক বলতে চান বাঙ্গালী মুসলমানের সাহিত্য-সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, শিক্ষা সমস্যা ইত্যাদি বিভিন্নভাবে বিচার করে দেখবার অবসর কোথায়? সেই গোটা সমাজটাই যে একটা সমস্যা।
এই শ্রেণীর সমালোচকদের কথার গুরুত্ব অনেকেই উপলব্ধি করবেন সন্দেহ নাই। বাংলার মুসলমান সমাজের বয়স কম নয়, অন্যূন সাত আট শত বৎসর হবে; এই দীর্ঘ কালেও সে সমাজ যদি এমন কোনো শক্তিমানের সূতিকাগার না হয়ে থাকে—যাঁর কৰ্ম্ম প্রেরণায় সেই সমাজের লোকদের অন্তরে নব নব আশা ও উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছে ও অন্যান্য সমাজের লোকের চিত্তে শ্রদ্ধা ও আনন্দ জেগেছে, তা হলে তার অবস্থা শুধু শোচনীয় নয় অত্যন্ত চিন্তনীয়। তারই ইঙ্গিত করে যদি কেউ বলেন, বাংলার মুসলমান-সমাজ হীন উপকরণে গঠিত, তবে তাতে শুধু অসহিষ্ণু হয়ে আর কি লাভ হবে।
কিন্তু বাস্তবিক কি বাংলার ইতিহাসে মুসলমানের কিছুমাত্র দান নাই? সেকালের মুসলমান নবাব-বাদশাদের দানের কথা ধরতে চাই না; বাংলার সাধারণ মুসলমান, যারা পুরুষানুক্রমে এই বাংলার মাটির উপর জন্মেছেন ও শেষে এই মাটিতেই দেহরক্ষা করেছেন, তাঁরা কি সর্বপ্রকারে এতই দরিদ্র ছিলেন যে শুধু প্রাণ-ধারণের অতিরিক্ত কোন কিছু কল্যাণকর কাজে আত্মনিয়োগ করবার সৌভাগ্য তাদের হয় নাই যাতে করে শনৈঃশনৈঃ-গ্রথিত দেশের ভাব ও কৰ্ম্মসৌধে তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত থাকতে পারে? এই প্রশ্নটি এক সময়ে আমাকে কিছু বিব্রত করেছিল। কিন্তু শীঘ্রই এই কথাটি বুঝে আনন্দিত হয়েছিলাম যে, বাংলার উপর মুসলমান তরু শুধু নিস্ফল হয়ে দাঁড়িয়ে নাই। অতীতের কুক্ষি ঘেঁটে দেখবার তেমন সুযোগ আমার হয় নাই, তবে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে দেখতে পাই, বাংলা স্মরণীয় নীলবিদ্রোহে প্রধানতঃ মুসলমান চাষীই লড়েছিল, অন্যায়ের সামনে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে প্রাণপণ বলে সে-ই বলেছিল—’মানব না’। স্বর্গীয় দীনবন্ধু মিত্র তাঁর নীল দর্পণে’ এক ‘তোরাব’কে অমর করেছেন। কিন্তু মুসলমান চাষী সম্প্রদায়ে ‘তোরাব একশ্চন্দ্র নয়, বহু নক্ষত্রের অন্যতম। আর বহুদেববিহীন, অস্পৃশ্যতা-নির্মুক্ত মুসলমান সমাজের কোলেই এই ‘তোরাব’-এর দল লোভে ভাল।
এই নীলবিদ্রোহের মুসলমান চাষীর কথার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার শিক্ষা বিস্তারে মহসীনের দানের কথা i, ঢাকা নগরীর শ্রীবৃদ্ধি সাধনে ঢাকার নবাবদের দানের কথা মনে হয়েছিল, আর তারই সঙ্গে মনে হয়েছিল, এঁরা ত মুসলমান সমাজে নিঃসঙ্গ নন। কি কারণে নিশ্চয় করে বলা শক্ত, ধনবান মুসলমানেরা ধনকে কোনদিন বহুমূল্য মনে করতে পারেন নাই, তার দানের ধারা অনায়াসে তাঁদের চার পাশে ছড়িয়ে পড়তে বাধা পায় নাই; আর তাতে করে মানুষের অঙ্গনে নিত্যই নব নব আনদ-কুসুম ফুটেছে। একালের চাঁদমিয়া, ফাজেল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ হোসেন প্রভূতিরও দানের কথা যখন ভাবতে যাই তখন বুঝতে পারি, অর্থব্যয়ে চিরঅকাতরচিত্ত মুসলমানের এরা অযোগ্য উত্তরাধিকারী নন। এই যে, মানুষের দল, মুখের ভাষা যাদের ভিতরে অকর্মণ্য, কিন্তু যাদের জীবনের ভিতরে উপলব্ধি করা যায় যেন আদিম কূৰ্ম্মের নীরব বীৰ্য, অথবা আদিম প্রকৃতির প্রাচুর্য, এদের মাহাত্ম সম্বন্ধে অনবগত থাকা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু দেশের জীবনোৎসবে এদের সেবার স্পর্শ লাগে নাই, অথবা ভবিষ্যতে এদের এই প্রাণ-অবদান জাতির আঙ্গিনায় ‘রঙীন হয়ে গোলাপ হয়ে উঠবে না’, একথা অবিশ্বাস্য বলে ভাবতে স্বতঃই ইচ্ছা হয়।
২
সাহিত্য জীবন বৃক্ষের ফুল, জাতি বা সমাজ বিশেষের মগ্নচৈতন্যের রসের যােগানে তার বিকাশ ঘটে। সেই গুঢ় রস বাংলার মুসলমান সমাজের অন্তরে সঞ্চিত আছে কি তাদের সাহিত্য-সমস্যার আলোচনা সম্পর্কে তার সন্ধান নিশ্চয়ই অপ্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু শক্ত প্রশ্ন এই হবে, সাহিত্যে সেই রসের যোগ্য স্ফূর্ত্তি আমরা কবে দেখব? এর উত্তরে যদি বলা যায়, তা কি করে বলব, তাহলে অনেকে শুধু বিরক্ত হবেন না, ক্ষুন্নও হবেন। কিন্তু এ ভিন্ন এ প্রশ্নের আর কিইবা উত্তর আছে? সাহিত্যের বিকাশকে কতকটা তুলনা করা যেতে পারে ফুল ফোটার সঙ্গে। ফুল গাছের মূলে আমরা পরম যত্নে জল ঢালতে পারি, দেশ বিদেশ থেকে তার জন্য ভাল সারও আনতে পারি, তবু ফুল ফুটবে কিনা, অথবা ভাল ফুল ফুটবে কিনা, সে সম্বন্ধে যেমন হুকুম করতে পারি না, সাহিত্য সম্বন্ধেও তেমনি সমাজের ভিতরে স্কুল-কলেজ-লেবরেটারির স্থাপনা, বিচার বিতর্কের সৌকর্যসাধন, ইত্যাদির পরও পরম আগ্রহে কালের পানে চেয়ে থাকা ভিন্ন আর আমাদের কি করবার আছে?
সাহিত্য-সমস্যা বাস্তবিকই কোনো সমাজের সত্যকার সমস্যা নয়। সাহিত্যের বিকাশ যখন কোনো সমাজের ভিতরে মন্দগতি অথবা হতশ্রী হ’য়ে আসে তখন বুঝতে হবে, হয়ত তার এক মৌসুম শেষ হয়ে গেছে, তারপর কিছুদিন কতকটা নিষ্ফল ভাবেই কাটবে অথবা তার জীবনায়োজনে বড় রকমের ত্রুটি উপস্থিত হয়েছে। এই শেষের অবস্থা যে কোন সমাজের পক্ষে মারাত্মক।
বাংলার মুসলমান সমাজে এ পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য সাহিত্যের উদগম হয় নাই, শুধু এই ব্যাপারটিই তার আত্মসম্মানের পক্ষে হয়ত মারাত্মক নয়। কিন্তু সমাজের লোক যে এ পর্যন্ত জাতীয় জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই তেমন গৌরবের আসন লাভ করতে পারে নাই, বরং তাদের মর্যাদা সম্বন্ধে জানতে হলে অনুসন্ধান করে জানতে হয়, এতেই তার অবস্থা সম্বন্ধে আপনা থেকে এসে পড়ে। আর, তার অবস্থা ভাল করে চেয়ে দেখতে গেলে চোখে পড়ে, সত্যই বাংলার মুসলমানের জীবনায়োজন মারাত্মক ত্রুটিতে পরিপূর্ণ যাতে করে মনুষ্যত্বের পূর্ণাঙ্গ পৰ্যাপ্ত বিকাশই সেখানে সম্ভবপর হচ্ছে না, – সাহিত্য-সৃষ্টির কথা সেখানে ভাবা যায় কি করে?
এ সম্পর্কে নানা গুরুতর কথার সম্মুখীন আমাদের হতে হয়। বলা যেতে পারে, সে সমস্তের কেন্দ্রগত কথা এই-ইসলাম কিভাবে মানুষের জন্য কল্যাণপ্রসূ হবে সেই কথাটাই হয়ত আগাগোড়া আমাদের নূতন করে ভাবতে হবে। আমাদের পূর্ববর্তীরা ইসলামের যে রূপ দিতে প্রয়াস পেয়েছেন তা যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন, অন্ততঃ তাকে আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে যে ভাবে লাভ করেছি তার সম্বন্ধে অস্পষ্টতার অপবাদ দেওয়া সম্ভবপর নয়। স্পষ্টভাবেই আমাদের সামনে গ্রহণীয়রূপে বিধৃত ইসলাম নারীর অবরোধ সমর্থন করেছে, সুদের আদান-প্রদানের উপর অভিসম্পাত জানিয়েছে, ললিতকলার চর্চায় আপত্তি তুলেছে, আর চিন্তার ক্ষেত্রে আমাদের দৃঢ়কণ্ঠে বলে দিয়েছে, তোমাদের সমস্ত চিন্তা সব সময়ে যেন সীমাবদ্ধ থাকে কোরআন ও হাদিসের চিন্তার দ্বারা। এই সমস্ত কথাই আমাদের নতুন করে ভেবে দেখতে হবে, ভেবে দেখতে হবে, মুসলমান সমাজের মানুষের কর্ম ও চিন্তার স্বাধীনতায় এইভাবে যে অনেকখানি নূতন রকমের প্রতিবন্ধকতা উপস্থিত করা হয়েছে এতে করে কি সত্যকার কল্যাণ লাভ হয়েছে এই সমস্ত ব্যবস্থার পিছনে যে সাধু উদ্দেশ্য আছে এ কথা বুঝতে পারা কষ্টসাধ্য নয়। সংযম ও পবিত্রতা, পরিশ্রম ও করুণ প্রাণতা, এবং সুন্দর ও মহনীয়ের প্রতি নিবিড় শ্রদ্ধা এ সমস্তের কথা যারা মানুষকে বলতে চেয়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু আমাদের নূতন করে ভেবে দেখার প্রয়োজন এই জন্য যে, সংযম ও পবিত্রতাকে নারীর অবরোধের দ্বারা, পরিশ্রম ও করুণ প্রাণতাকে সুদের আদান প্রদান নিষেধের দ্বারা, ও সুন্দর মহনীয়ের প্রতি শ্রদ্ধাকে মানুষের বুদ্ধি শৃংখলিত করার দ্বারা সম্ভবপর করে তুলতে প্রয়াস পেলে অসম্ভব কিছুর প্রতি হাত বাড়ানো হয় কিনা, অন্যকথায়, তাতে করে মানব প্রকৃতির উপর অত্যাচার করা হয় কিনা, যার জন্য সমস্ত উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
যতটুকু বুঝবার ক্ষমতা আমাদের হয়েছে তাতে মনে হয়, ইসলামের যে রূপ দিতে প্রয়াস পাওয়া হয়েছে, অথবা মানুষকে ইসলামের সার সত্য গ্রহণের উপযোগী করবার জন্য যে পথে চালিত করতে চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে করে মানুষের উপর সত্যই অত্যাচার করা হয়েছে। যে ব্যবস্থায় বড় সত্যের পানে মানুষের চিত্তের আকর্ষণ অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে ইসলামের সমাজ-ব্যবস্থায় তার দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হয় নাই। সে-ব্যবস্থায় যতথানি বিশ্রান দৃষ্টি আছে তার চাইতে অনেকখানি বেশি আছে ব্যস্ততা ও অসহিষ্ণুতা। দৃষ্টান্ত দিয়ে কথাটি বোঝাতে চেষ্টা করব। ইসলামের শ্রেষ্ঠ সত্য তৌহীদ মানবচিত্তের চির মুক্তির বাণী। বার বার মানুষ তার কীর্ত্তির শৃঙ্খলে আদর্শের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে। Every idea is a prison, every heaven is a prison। আর সেই বন্ধনের সামনে বার বার দাঁড়িয়ে বলবার যোগ্য এই বাণী—নাই, আল্লাহু ভিন্ন আর কেউ উপাস্য নাই ; আর সাম্য এই মুক্তি ও অগ্রগতির চির সহচর। মানুষের এই অগ্রগতিতে সংযমের প্রয়োজন নিশ্চয়ই কিছুমাত্র কম নয়—যেমন নদীর জন্য কূলের বাঁধের প্রয়োজন কিছুমাত্র কম নয়। কিন্তু কুলের বাঁধের পত্তন করে ত নদীর সৃষ্টি হয় না, নদীর প্রবাহ আপন প্রয়োজনে কূলের বাঁধের সৃষ্টি করে চলে। মানুষের অগ্রগতির জন্যও প্রয়োজনীয় যে সংযম তারও তেমনিভাবে ভিতর থেকে জন্ম হওয়া চাই, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া সংযমের সত্যকার মূল্য মানুষের জীবনে কত সামান্য। তাই মানুষের যে বন্ধু চান, ইসলামের এই বড় সত্যের পানে মানুষের চিত্ত উন্মুখ হোক, তার কাজ কি এই হওয়া উচিত নয় যে, মানুষের সর্বাঙ্গীন পরিপোষণ ও পরিবর্ধনের সহায়তা তিনি করবেন? কেননা সর্বাঙ্গীন পরিপোষণ ও পরিবর্ধন যার হয় নাই এই দুরের পথের যাত্রী হবার সত্যকার অধিকার তার কোথায়? এর পরিবর্তে বাইরে থেকে বিধি-নিষেধ ও অবরোধ চাপিয়ে চাপিয়ে যে সব মানুষকে সংযত করবার চেষ্টা করা হয়েছে তাদের চিত্তের স্বাভাবিক ফুৰ্ত্তির ত কিছুমাত্র অবকাশ দেওয়া হয় নাই। তারা যে বড় জোর অর্ধ্ব-বিকশিত মানুষ ! তারা কি করে হবে মুক্তিপথযাত্রী!
তারপর ললিতকলার চাকে যে মুসলমান সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে, কোন্ মস্তিষ্কবান ব্যক্তি একে সমর্থন করতে পারেন? নিশ্চয়ই নেতাদের এই হুকুমে মুসলমান তার এত দীর্ঘজীবন সৌন্দর্য্য ও আনন্দবিহীন হয়েই কাটায় নাই; কিন্তু আমাদের ভেবে দেখবার দিন এসেছে যে, সাধারণ সমাজের সম্মতিক্রমে আনন্দ ও সৌন্দৰ্য্য চৰ্চ্চাটা করতে পারে নাই বলে তার সর্বাঙ্গীন ফুৰ্ত্তিতে কতখানি বাধা পড়েছে।
এখানে হয়ত কথা উঠবে, ইসলামে অনেকখানি Puritanism আছে, এবং তার জন্য আমাদের লজ্জিত হবার দরকার করে না। আমি নিজেও ইসলামের এই Puritanic ধাতের জন্য লজ্জিত নই; শুধু এই কথাটুকু বলতে চাই যে, Puritanism এক বৃহৎ মানব সমাজের শ্রেণী বিশেষের করণীয় হতে পারে, তাতে করে সেই সমাজের স্বাস্থ্যের ও সৌন্দর্যের কিছু আনুকল্যই ঘটে। কিন্তু Puritanism-কে এক বৃহৎ মানব-সমাজের বরণীয় করে তুলতে প্রয়াস পেলে Puritanism ব্যর্থ হয়ই, সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাজেরও দুর্ভাগ্যের অবধি থাকে না।
এর একটি দৃষ্টান্ত প্রায় সমসাময়িক কালের বাংলাদেশে আমরা পাই। বাংলা সাহিত্যে বাংলার উচ্চশ্রেণীর মুসলমানের বিশেষ লক্ষ্যযোগ্য কোন দান নাই ; ‘অর্থাৎ এমন দান যার জন্য বাংলার চিত্তে শ্রদ্ধা জেগেছে, তা আপনারা জানেন। কিন্তু বাংলার লোকসঙ্গীতে নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের দান সাদরে গৃহীত হয়েছে যেমন পাগলা কানাইয়ের গান, লালন ফকিরের গান ইত্যাদি। এইসব গানের ভিতরে বুঝতে পারা যায়, ইসলামের একেশ্বরতত্ত্ব গান-রচয়িতাদের মনে স্থান পেয়েছিল। আর তারই সঙ্গে তাঁদের চারপাশের বাউল সাধনা, বৈষ্ণব সাধনা ইত্যাদি মিশেছিল,—সবমিলে কোন এক অসীমের সংবাদে তাঁদের চিত্ত তৃপ্ত ও মধুর হয়েছিল। মাতৃভাষায় রচিত এইসব গান এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছে, আর চাষীদের অভাবগ্রস্ত জীবনে আনন্দ ও তৃপ্তি দিয়েছে তাদের অনন্তের ক্ষুধা অনেক পরিমাণে মিটিয়েছে। কিন্তু মানুষের অন্তরের বেদনার প্রতি ভ্রুক্ষেপহীন আমাদের আলেম সম্প্রদায় শাস্ত্রের ভয় দেখিয়ে শিক্ষা সাধনাহীন সমাজের পৃষ্টপোষকতা আদায় করে পল্লীর মুসলমান চাষীর এই গানের ফোয়ারা বন্ধ করে দিয়েছেন। পরিপূর্ণ ইসলাম মানুষের জন্য যে কল্যাণ ও শান্তি বহন করে, এদের সাধ্য নাই সেই সম্পদ এই চাষীদের দ্বারদেশে বা পৌঁছে দেন; শুধু মাঝখান থেকে হালাল হারাম সম্বন্ধে দুই একটা হুকুম শুনিয়ে ও Puritanism-এর গোয়ার্তুমিতে এদের জীবন নিরানন্দ করে দিয়ে তারা কর্ত্তব্য শেষ করেছেন। এই চাষীদের জীবনকে কিছু সুন্দর ও মহান করবার জন্য এইসব গানের কতখানি সামর্থ্য ছিল আমাদের পুনরায় সেকথা ভাবতে হবে না কি?
এ সম্পর্কে একটি ভাববার মতো কথা আমাদের সামনে এসে পড়েছে। সেটি এই যে, কী নিজের সমাজে কী অন্য সমাজে সত্যকার মুসলমানের চেষ্টা হোক তাঁর উপলব্ধ ইসলামের স্বরূপ মানুষের সামনে ফুটিয়ে তোলা। সেই চেষ্টায় তাঁর কিছুমাত্র শৈথিল্য প্রকাশ না পাক। কিন্তু ঠিক তেমনিভাবে অপরের ইসলাম বা ইসলামের অংশবিশেষের গ্রহণ-ব্যাপারেও স্বাধীনতা অক্ষুণ থাকুক। ধৰ্ম্মে বল প্রয়োগে নিষেধ কোরআনের এই মহতী বাণী মুসলমানের জন্য সত্য হোক।
এ কথাটি বলবার একটি বিশেষ তাৎপৰ্য আছে। অন্য সমাজের লোকদের উপর ধৰ্ম্মের, ব্যাপার কিছুতেই আমরা জবরদস্তি করতে পারি না এ কথা আমাদের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিই মনে স্থান দেন। কিন্তু মুসলমান সমাজের ভিতরকার লোকদের জন্যও যে এ ব্যবস্থা প্রযোজ্য সে কথা ভাবতে আমাদের অনেকেই হয়ত রাজী নন। এ সম্বন্ধে বাংলার শিক্ষিত মুসলমান একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে এক সময়ে আমার কথা হয়েছিল। ধৰ্ম্ম বিষয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা মানতে হবে, আমার এই কথার উত্তরে তিনি প্রশ্ন করলেন, তাহলে মুসলমান কাকে বলব ? আমি বলেছিলাম—যাদের সাধারণতঃ বলা হয়ে থাকে, অর্থাৎ যারা সমাজে জন্মেছে অথবা এতে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁর সঙ্গে এই তর্ক হচ্ছিল আমাদের উভয়ের। জনৈক বন্ধুর কোন তথাকথিত অনৈসলামিক কথার আলোচনা সম্পর্কে। কিন্তু তিনি আমার মত মানতে কিছুতেই রাজি হতে পারছিলেন না। শেষে একটি কথা বলে তাঁকে ভাবিয়ে তুলতে চাইলাম। বললাম, দেখুন, আজ উনি যা বলেছেন, হয়ত দুদিন পরে নিজেই ওখান থেকে ফিরে আসবেন। একটা struggling soul-এর বেদনা আমাদের সমাজ বুঝবে না! কিন্তু তিনি অম্লান বদনে বল্লেন, তা যখন তাঁর শেষ হয়ে যাবে, তখন যেন আবার তিনি মুসলমান সমাজে ফিরে আসেন।
মুসলমান সমাজের কৰ্ম্মকর্তারা যে কি আশ্চর্যভাবে পাষাণ প্রতিমার সেবক পান্তাদের মতো পাষাণচিত্ত হয়ে পড়েছেন, মানুষের মনের কত কামনা, কত বেদনা, কত ভাঙ্গাগড়া, এ সম্বন্ধে তাঁরা যে কত চেতনাহীন হয়ে পড়েছেন, সে সব কথা আজ না ভাবলে আমাদের দুর্দশার পরিমাণ উপলব্ধি করা যাবে না। মানুষের জীবন সুন্দর হোক, কল্যাণময় হোক, সেখানে যে আমি আমার সশ্রদ্ধ সেবা পৌঁছে দিতে পারি, এ ভাব যেন তাঁদের মনের ত্রিসীমানায়ও ঘেঁষে না। তার পরিবর্তে মানুষের মাথায় কতকগুলো বিধি-নিষেধ ছুঁড়ে মেরেই আল্লাহর সৈনিক হওয়ার গৌরব তারা উপলব্ধি করতে চান। মুসলমান সমাজে যে সমস্ত নরনারী বাস করে তারা শুধু মুসলমান নয়, তারা মানুষ দেশ বিদেশের নানা ধর্মের নানা বর্ণের মানুষের আত্মীয়। সেই বিশ্ব বহৎ মানব সমাজের নানা আশা-আকাক্ষার চেষ্টা বিফলতার মধ্য দিয়ে উৎসারিত হচ্ছে এই বাণী যে, মানুষ দুঃসাহসী, তার অনন্ত ক্ষুধা, জড় জগতের বন্ধনই সে মানতে রাজি নয়, চিন্তার জগতের ত কথাই নাই মানুষের এই বাণীর সার্থকতার কোন আয়োজন কি মুসলমান সমাজে করতে হবে না? যা সুন্দর শুধু তাই দিয়ে দৃষ্টি আবৃত করে কি মুসলমান তার সৌন্দর্য বুঝতে পারবে? না একথাও সে বুঝবে যে, এর জন্য সত্যকার প্রয়োজন হচ্ছে সেই সুন্দর বন্ধুকে কিছু দূরে স্থাপন করা, যাতে করে সমস্ত জগত তার চোখে প্রতিভাত হবে, তারই সঙ্গে মিলিয়ে সেই বস্তুর সৌন্দর্য্য সে উপলব্ধি করবে? চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির মুক্তি (emancipation of intellect) এতে শুধু মানুষের অধিকার থাকা উচিত নয়, এই হচ্ছে তার জীবন পথে বিধাতার দেওয়া পাথেয়। যেমন করেই হোক এই পাথেয়ের ব্যবহার মানুষ করে, তবে অনেক সময়ে ভয়ে ভয়ে করে বলে তার অন্তর প্রকৃতির যথোপযুক্ত পুষ্টিলাভ হয় না।
সাহিত্য গানের সুরভি, তাই জ্ঞানচর্চা সমাজে অব্যাহত থাকলে সাহিত্যের জন্য আর কোন ভাবনা থাকে না। কিন্তু সে জ্ঞানচর্চার জন্য প্রয়ােজনীয় মুক্ত বুদ্ধির, অথবা তারও চাইতে বেশী প্রয়োজনীয় সমাজ জীবনে বৈচিত্র্যেমুক্ত বুদ্ধি যার সন্ততি। অবরোধ ও নিরক্ষরতার চাপে আমাদের সমাজের অর্ধেক শক্তি ব্যক্তিত্বহীন ও অকর্মণ্য হয়ে পড়েছে। সেই অর্ধেকের সংস্পর্শে এসে অপরাদ্ধেরও চিত্তবিকাশের অবকাশ কোথায়? মানুষের চিত্ত যার আঘাতে জেগে উঠবে সেই বৈচিত্র্য এমনি করেই আমাদের সমাজে দুর্লভ হয়ে পড়েছে।
সুন্দর ও সবল জীবনের জন্য যত কিছুর প্রয়োজন তার এত অভাব বাংলার মুসলমান কি করে পূরণ করবে, এ কথা ভাবতে গেলে সত্যই অবসন্ন হয়ে পড়তে হয়। কিন্তু আশার অবকাশও যে নাই তা নয়। বাংলার মুসলমান সমাজের অন্তরে সেই গুঢ় জীবনরস যদি সত্যই সঞ্চিত থাকে তবে তার এই সংকট সময়ে তার কোলে তার বীরপুত্রদের জন্ম হবে, যারা তার সমস্ত অভাব সমস্তু বন্ধন ঘুচিয়ে দিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে পূর্ণাঙ্গ মনুষ্যত্বের যোগ্য সূতিকাগার রূপে, তৌহীদের যোগ্য বাহন রূপে। ইসলামের যে তৌহীদ মুফ নির্ধারিত আন ও পূর্ণাঙ্গ মনুষ্যত্বের শিখরই তার যোগ্য অধিষ্ঠান ভূমি। মুসলমান অকারণে ভীত হয়ে সেই অমূল্য মাণিককে অন্ধ বিশ্বাসের গুহায় লুকিয়ে রেখে তার সার্থকতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
৩
সাহিত্যের বিকাশের জন্য সত্যকার প্রয়োজন হচ্ছে সুব্যবস্থিত সমাজ জীবনের জীবনের বহু ভঙ্গিমতাকে যথেষ্ট যত্ন ও শ্রদ্ধা নিয়ে লালন করবার। সেইদিক দিয়ে যে সব ক্রুটি বাঙালী মুসলমানের সমানে রয়েছে, তার মারাত্মকতা কত বেশী তাই একটু বিস্তৃত ভাবে বলতে প্রয়াস পেয়েছি। তবু হয়ত পরিষ্কার করে বলতে পারি নাই। আপনারা নিজেদের চেষ্টায় সেই অসম্পূর্ণতা পুষিয়ে নেবেন। ii
কিন্তু কেউ কেউ বলতে পারেন, কালের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানের সমাজ ব্যবস্থার আবশ্যক। পরিবর্তন আপনা থেকে হয়ে যাবে; কাজেই সে-সব কথা না তুলে বর্তমানে সাহিত্য সম্বন্ধে যে সব কথা বাংলার মুসলমানের চিত্তকে আন্দোলিত করছে তার যোগ্য মীমাংসার চেষ্টা করাই সমীচীন—তাতে করেই ধীরে ধীরে আমাদের সব ত্রুটি খালিত হয়ে যাবে, আর আমাদের সমাজও সুন্দর ও সুব্যবস্থিত অবস্থায় দাঁড়াতে পারবে। একথার উত্তরে শুধু এই বললেই যথেষ্ট হবে যে, কালের ভাণ্ডারে অনন্ত রত্ন রয়েছে কিন্তু প্রাণপনে না চাইলে তার কাছ থেকে কিছুই আদায় করা যায় না। এই প্রাণপণ চাওয়ার পিছনে অবশ্য ইতিহাস আছে। কিন্তু এ বিষয়ে কখনো যেন আমাদের ভুল না হয় যে, যারা পেয়েছে তার সমস্ত দেহমন দিয়ে চেয়েছে। তা ছাড়া সাহিত্য সম্বন্ধে সাধারণতঃ যে সব সমস্যা আজকাল বাংলার মুসলমানের চিত্তকে আন্দোলিত করছে বলে বোধ হচ্ছে সে সব বাস্তবিকই তাদের সামনে প্রবল চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে নাই। উর্দ্দু-বাংলা সমস্যা যে সত্যই তাঁদের জন্য কোন সমস্যা নয়। তার প্রমাণ ত বাংলার মুসলমান সাহিত্যিক ও সাংবাদিকেরা তাঁদের সামান্য ক্ষমতার ভিতর দিয়েও প্রতিনিয়তই দিচ্ছেন; আর বাংলা ভাষায় আরবী ফার্সি শব্দের ব্যবহারের অনুপাত-সমস্যাও সাহিত্যে বাঙ্গালী মুসলমানের খুব অল্পদিনের শিক্ষানবিশীর পরিচায়ক। আরো কিছুদিন গেলেই ও সম্বন্ধে তাঁদের খেয়াল আপনা থেকে দুরস্ত হয়ে যাবে এমন আশা করা যায়। কেননা সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন শুধু শব্দের নয়, বর্ণ ও গন্ধযুক্ত শব্দের। অন্য কথায় শব্দের গায়ে বর্ণ ও গন্ধ মাখিয়ে দিতে পারে এমন চিত্তের, এতটুকুও বুঝবার ক্ষমতা বাঙ্গালী মুসলমানের হবে না এ ধারণা নিয়ে তাদের সাহিত্য সমস্যার আলোচনা করা নিশ্চয়ই বিড়ম্বনা। তবে এই সব সমস্যার সম্পর্কে একটি কথা ভাববার আছে। এইসব সমস্যার ভিতর দিয়ে বাংলার আধুনিক মুসলমানের বিশেষ কামনা ফুটে বেরুতে চাচ্ছে, সেটী এই – ‘বাংলার মুসলমানকে সত্যকার মুসলমান হতে হবে।’
মুসলমানের এই মনোভাবের বিশ্লেষণ করলে প্রধাণতঃ দুইটি চিন্তাধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তার একটিকে বলা যেতে পারে প্রতিক্রিয়া, অন্যটী ক্ষোভ অথবা অনুশোচনা। বাংলা সাহিত্য আজ জগতের দৃষ্টি একটুখানি আকর্ষণ করতে পেরেছে এবং তাতে এর সত্যকার অধিকার আছে। কিন্তু তবু সত্যের অনুরোধে সাহিত্যরসিকদের নিশ্চয়ই বলতে হবে, এ সাহিত্য এখনো খুব বেশী পরিমাণে সাম্প্রদায়িক সাহিত্য; মানুষের দুঃখ ও আনন্দের প্রকাশের চাইতে হিন্দুর বিশেষ দুঃখ ও বিশেষ আনন্দের চর্চ্চাই এতে বেশী। ‘বাংলার মুসলমানকে মুসলমান হতে হবে’ এ হচ্ছে অনেক পরিমাণে মুসলমানের অন্তরে বাংলা সাহিত্যের হিন্দুত্বের প্রতিক্রিয়া। এখানে হয়ত তর্ক হবে—হিন্দুও মানুষ, আর বিশেষকে নিয়েই সাহিত্যের কারবার। কিন্তু তাতে করে আমার কথাটির ঠিক উত্তর দেওয়া হবে না। আমি এখানে বাংলা সাহিত্যের দারিদ্র সম্বন্ধে এই কথাটুকু বলতে চেয়েছি যে, বাংলা সাহিত্যে হিন্দুর যে চিত্র ফুটিয়ে তুলতে প্রয়াস পাওয়া হয়েছে বা হচ্ছে তা অনেকখানি অস্বাভাবিক রকমে হিন্দু অর্থাৎ বিশ্বের আঙ্গিনার এক পাশে তার বিশেষ রুচি ও বিশেষ দুঃখ নিয়ে ফুটে উঠে যে হিন্দু জগতের সঙ্গে তার অবস্থার মোকাবেলা করতে চাচ্ছে সে হিন্দু নয়, কিন্তু বিশ্বের মানবযাত্রীদের পাশ কাটিয়ে তার চণ্ডীমণ্ডপের দাওয়ায় বসে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার কূটতর্কে সময় কাটাচ্ছে যে হিন্দু সেই হিন্দু।
অবশ্য যারা একবার নীচে পড়ে গেছে তাদের উদ্ধারের ইতিহাস অনেক পরিমাণে যে ঘুরপাক খাওয়া ইতিহাস হবে এ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমাদের এই অভিশপ্ত দেশের দুর্ভাগ্যের জের যে আমরা কতকাল টেনে চলব তার প্রমাণ পাওয়া যাবে এইখানে যে হিন্দুর হিন্দুত্বের সংঘাতে তার প্রতিবেশী মুসলমানের অন্তরে শুধু সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতাই জেগেছে। ক্ষোভ অথবা অনুশোচনার ভাবটিকে এই প্রতিক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষোভ অথবা অনুশোচনার ভিতরে যে আর একটা কথা আছে সেটি না বুঝলে আধুনিক বাঙালী মুসলমানের উপর অনেকখানি অবিচার করা হবে। সেটি তার মনের এই একটা বেদনার কথা যে, ইসলাম সুন্দর, ইসলাম মহান, কিন্তু তার যোগ্য প্রকাশ আমরা আমাদের সাহিত্যে দেখছিনে কেন? এই যে বাঙ্গালী মুসলমানের অন্তরে একটুখানি সত্যকার বেদনা জেগেছে এ তার শুভাদৃষ্টেরই পরিচায়ক –
“আমার ব্যথা যখন আনে আমায়
তোমার দ্বারে,
তুমি আপনি এসে দ্বার খুলে দাও
ডাক তারে”
কিন্তু এ সম্পর্কে আমাদের সামান্য একটু নিবেদন করবার আছে। সাহিত্যে যে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান নাই তা নয়; কিন্তু সাহিত্যিক হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খৃস্টানের আর সাম্প্রদায়িক হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টানের এক চেহারা নয়। সাম্প্রদায়িক হিন্দু অথবা মুসলমান তার দৈনন্দিন কাজ ও ব্যবহারের ভিতর দিয়ে প্রধানতঃ জগতকে এই বুঝতে প্রয়াস পায় যে, সে আগে হিন্দু অথবা মুসলমান তারপরে মানুষ। কিন্তু সাহিত্যিক হিন্দু অথবা মুসলমান অন্তরে অন্তুরে জানে সে আগে মানুষ, তারপরে হিন্দু অথবা মুসলমান। মানুষের অন্তরের গভীরতম আনন্দ ও বেদনা নিয়েই সাহিত্যের কারবার, সেইখানে সাহিত্যিক মানুষকে তার সম্প্রদায় ও জাতির আবরণ উন্মোচিত করে দেখেছে তাই মানুষে মানুষে আত্মীয়তাই সে বেশী করে উপলব্ধি করে। সুতরাং সাহিত্যে জাতি ও বিভেদ যেন কতকটা একই ফুলের দেশ ও কালের ভেদভেদ শুধু পাপড়ির বিন্যাস ও রঙ্গের গাঢ়তার বৈচিত্র্যে।
তাই বাংলার সাম্প্রদায়িক মুসলমান আজ ক্ষোভে দুঃখে অপমানে ও কতকটা সত্যকার বেদনায় ইসলামের যে চিত্র মনে মনে আঁকছেন, বাংলার সাহিত্যিক মুসলমানের হাত দিয়ে তারই অবিকল প্রতিচ্ছবি নাও বেরুতে পারে, বরং সেই সম্ভাবনাই বেশী। তবে ইসলাম সম্বন্ধে যদি সত্যকার বেদনা তার চিত্তে জেগে থাকে তবে সাহিত্যে তার এক অনুপম রূপ নিশ্চয়ই ফুটে উঠবে। কিন্তু সাহিত্য যেমন চিরদিন অনুপম তেমনি চিরদিন অভিনব, তাই সাম্প্রদায়িক মুসলমান তার এই কামনার ধনকে প্রথমে নাও চিনে উঠতে পারে।
সাহিত্য সম্বন্ধে বাঙ্গালী মুসলমানের মনের গোপনে আরো বহু সমস্যা আছে, যেমন ইসলামের প্রাচীন ইতিহাসের কোন কোন পর্যায়ের দিকে আমাদের আজ বেশী করে চাইতে হবে অথবা আমাদের মাতৃভাষার সাহিত্যের কোন কোন অংশ আমরা সাদরে গ্রহণ করব, কোন কোন অংশ বন্ধন করে চলব, ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিচারে প্রবৃত্ত হতেও আমরা প্রস্তুত নই, কেননা আগে থাকতে এসব বিচারে প্রবৃত্ত হওয়া আর টাকা পাবার আশায় টাকার থলি তৈরী করা সমান রকমের আহম্মকি। এসব বিচার করবে প্রত্যেক সাহিত্য স্রষ্টা নিজে, আর কি গ্রহণ করবে আর কি বর্জন করবে সেটি নির্ভর করবে তার রুচি ও শক্তির উপরে। তবে একটি কাজ করে বাংলার সাম্প্রদায়িক মুসলমান বাংলার সাহিত্যিক মুসলমানদের কিছু সাহায্য করতে পারেন, সেটা হচ্ছে, কোরআন হাদিস ও প্রাচীন মুসলমান গ্রন্থকারদেৱ ভাল ভাল বইয়ের বাংলা তজ্জমা প্রকাশ করা। অনেক সময় দেখা গেছে, অতি সামান্য উপকরণ থেকেও সত্যকার সাহিত্যস্রষ্টাদের হাতে অনেক বড় সৃষ্টি সম্ভবপর হয়েছে। একটা ফুলকি তাঁদের কল্পনায় আগুন ধরিয়ে দেবার জন্য যেন যথেষ্ট। কিন্তু সেই সামান্য উপকরণটুকুও ত হাতের কাছে চাই।
আর একটী কথা বলে এই আলোচনা শেষ করব। আমাদের কোনো কোনো সাহিত্যিক আদর্শ ও অনুপ্রেরণার জন্য আমাদের আজকাল চাইতে বলছেন উর্দু সাহিত্যের দিকে। সে চাওয়াটা মোটেই দূষণীয় নয়, বরং যত বেশী চিত্তের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় ততই আমাদের জন্য মঙ্গলকর। কিন্তু এর ভিতরে যে একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে, বাংলা সাহিত্যে বাংলার মুসলমানের অনুপ্রেরণা দেবার মত কিছু নাই স্পষ্ট ভাষায়ই বলতে চাই—ওটী দেখার ভুল। উর্দু সাহিত্যের সঙ্গে আমার তেমন পরিচয় নাই; তবে যে সমস্ত সাহিত্যিকের নামোল্লেখ করে বাঙ্গালী মুসলমানকে তাঁদের প্রতি ভক্তিমান হতে বলা হয় তাঁদের কয়েকজনের লেখার সঙ্গে আমার অল্প কিছু পরিচয় আছে এবং সেই পরিচয়ের বলে আমি বরং এর উল্টো কথাই বলতে চাই, বলতে চাই, বাংলার মুসলমানের অন্তরে প্রেরণা দেবার মতো জিনিষ বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যেই বেশী আছে।
বাংলার গত একশত বৎসরের ইতিহাস যে কোন দেশের পক্ষে গৌরবের ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাসের স্রষ্টাদের এ পর্যন্ত সাধারণতঃ দেখা হয়েছে হিন্দুর চোখ দিয়ে, অর্থাৎ, সামান্য সাফল্য লাভে গর্বিতচিত্ত হিন্দুর চোখ দিয়ে। সেই আস্ফালন থেকে মুক্ত হয়ে অথবা তাতে বিরক্ত না হয়ে যদি তাকানো যায় এই শত বৎসরের রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার, মধুসূদন, রাজনারায়ণ, রামতনু, কেশবচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির দিকে—যদি ভাবা যায় একটা মুমূর্ষ হাতির দেহে জীবন ফিরিয়ে আনবার জন্য কি প্রাণপণ সাধনা এঁরা করেছেন, সে সাধনায় কত উদ্বেগ, কত অভিমান, কত নৈরাশ্য, কত উল্লাস, তখন এইসব শক্তিমানদের কারো কারো জাতি-অভিমান বিজাতিবিদ্বেষ ইত্যাদির অর্থ আপনা থেকে পরিষ্কার হয়ে আসে; আর সত্য ও কল্যাণের পথে আমাদের অগ্রজরূপে এদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনও আমাদের অন্তরে সহজ হয়ে পড়ে।
তারপর বাংলা সাহিত্যের কথা। এর ভিতরে দোষ যে ঢের আছে সে সম্বন্ধে আগেই কিছু বলা হয়েছে; কিন্তু সমস্ত দোষ এটি সত্ত্বেও এতে ভাল যেটুকু সম্ভবপর হয়েছে তাকে ডিঙ্গিয়ে যাবার মতো কিছু উর্দুতে পাই নাই; বরং বড় সাহিত্যের যে একটি শ্রেষ্ঠ লক্ষণ মুক্তবুদ্ধি, তার যতটুকু বিকাশ বাংলাতে হয়েছে ততটুকুও সেখানে চোখে পড়ে নাই। তা ছাড়া চিন্তার জগতেও বাঙ্গালী মুসলমান শুধু টুপি দেখে আত্মীয় ঠাওরাবে এ মনোভাব সম্বন্ধে শুধু এই বলা যায় যে, যত শীগগির এ দূর হয়ে যায় ততই আমাদের লজ্জা কমে।
দেশে দেশে দিকে দিকে মানুষ যে যেখানে সত্য ও কল্যাণের সন্ধানী হয়েছে সে আমার ভাই, একথা যদি মুসলমান প্রাণ খুলে না বলতে পারে তবে বৃথাই তার সাম্য ও একেশ্বর-তত্ত্বের অহংকার। আর শুধু মুসলমানের সাহিত্য সৃষ্টি নয়, তার সমস্ত নবসৃষ্টির উৎস এইখানে বাঁধা পড়ে ক্রন্দন করছে।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024