না-বলা জিনিসের বয়ান: আল-মাহমুদের অটোবায়োগ্রাফি নিয়া আলাপ
এই লেখাটা ছাপা হইছিল “কবি” নামে বইয়ে, ২০২০ সালে। বইটা কিনতে পারবেন রকমারি‘তে বা ফেসবুক পেইজে (নন-ফিকশন | Facebook)
……………………………………..
বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ। আল মাহমুদ। একুশে বাংলা প্রকাশন। বইমেলা, ২০০৭। প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। ১৯২ পেইজ। ২০০ টাকা।
……………………………………..
আল মাহমুদ-এর বইটা পড়ার পর থিকাই ভাবতেছিলাম যে, এইটা নিয়া লিখবো। কিন্তু লিখার কথাগুলি বলতেছিলাম পরিচিত মানুষজনকে তাই আর লিখা হইতেছিল না। যার ঠিক উল্টা কাজটা আল মাহমুদ করছেন। উনি বলার কথাগুলিরেই লিখিত করছেন। খালি রাজনৈতিক ও সামাজিক না, সাহিত্যেরও নিজস্ব ঘটনা ও ইতিহাস আছে, এইগুলি যে কীভাবে সম্ভব হইতে পারে, তার একটা ধারণা হয়তো এই বইটা পড়লে টের পাওয়া যাইতে পারে।
পারসোনাল দিক থিকা বিচার করলে মনে হইতে পারে যে, একটা ‘পাপ’ না করতে পারার সাফল্যই উনারে বাঁচাইয়া দিছে। বইটাতে উনি নিজের বিয়া’র কয়দিন পরেই আরেক মেয়ের প্রতি তাঁর ’লোভ’-এর কথা বলছেন, এই ধরনের কনফেশন করতে গেলে এক তো হইলো বুকের পাটা লাগে; কারণ বিয়া করা মানেই তো ‘কাম’-এর শেষ না। যেইরকম আমরা ভাবতে পারি যে, ফ্রি সেক্সের অভাবেই সোসাইটিতে রেইপের ঘটনা ঘটতেছে। অথচ ঘটনাটা কোনভাবেই এইরকম না। সিমন দ্য বেভোয়াও কইতেছিলেন, সো-কল্ড “নারী স্বাধীনতার”র পরে ফ্রান্সে হ্যারাসমেন্টের ঘটনা আরো বাইড়া গেছে যে, তুমি তো ফ্রি, তুমি কেন আমার সাথে শুইবা না! এইরকম। মানে, রেইপের ঘটনারে পাওয়ার রিলেশনের জায়গা থিকা না দেইখা ‘সেক্সের অভাব’ – এই জায়গা থিকা দেখতে গেলে মুশকিলই হওয়ার কথা। ডিজায়ার, মোরালিটি আর লাভ – এইগুলা যে একই জিনিস না, এইটা একটা ব্যাপার। আরেকটা হইলো, বলার ইটসেলফ একটা প্লেজার আছে। কনফেশনের একটা আনন্দ আছে। শেষমেশ আল্লা তো উনারে বারবার বাঁচায়াই দিছে! এইটা ধরলেও উনার বলতে পারাটা কিছু জিনিস খোলাসা করে যৌনতা বিষয়ে। কট্টুক বলা যায় আর কট্টুক বলা যায় না – এই বেরিয়ারগুলি। শেষমেশ, বলতে পারাটা একটা ঘটনাই। বিয়া’র পরপরই অন্য মেয়ের প্রতি ‘লোভ’-এর লাইগা তিনি যে চড় খাইছেন, সেইটা যে বলতে পারছেন, এইরকম একটা ট্রান্সপারেন্সি’র বোধই হয়তো সোনালী কাবিন-এর জন্ম দিছে। বা কবিতার এই ট্রান্সপারেন্সিটারে উনি কোন না কোনভাবে লাইফেও নিতে পারছেন।
বলতেছিলাম সাহিত্যের ঘটনা ও ইতিহাস-এর কথা। আসলে এইটা তো উনার নিজের লাইফের ঘটনা, এইখানে ঘটনাগুলি তিনিই সিলেক্ট করছেন এবং বর্ণনা দিছেন, একইসাথে তিনি নিজেও এই ঘটনা-প্রক্রিয়ার অংশ ছিলেন, তাই এই ঘটনা ও বর্ণনাগুলির নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার কোনো কারণই নাই, তাঁর অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি-ই এর মূল নিয়ন্ত্রক, অর্থাৎ যেইটা ন্যারেশন, সে-ই কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ঘটনার ডিরেকশনটারে ঠিক কইরা দিতেছে। যেমন ধরেন, উনি ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের কয়েকদিন আগে শামসুর রাহমানের সাথে দৈনিক পাকিস্তানের (বাংলার) সামনে এবং ২৫ শে মার্চের পরে ইত্তেফাকের সামনে শহীদ কাদরী’র সাথে দেখা হওয়ার ঘটনার কথা, যেইখানে তিনি নিজেই উপস্থিত, সেই বর্ণনা দুইটা খেয়াল কইরা পইড়া দেখেন:
“কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রগতিবাদী কবিরা প্রকৃতপক্ষে শেখ সাহেবের পক্ষাবলম্বন করেননি।…এ সময়কার একটি ঘটনা আমি উল্লেখ করতে চাই। অন্যত্রও করেছি। সেটা হলো, রিকশায় আমি তখনকার দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। গেটে শামসুর রাহমানের সাথে দেখা হলে আমি রিকশা থেকে নেমে এলাম। শামসুর রাহমান বেশ উত্তেজিত হয়ে আমাকে বলতে লাগলেন, আমি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করি। শেখ মুজিবকে সমর্থন করি। তারপর তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন তা এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই না।অথচ আজকালের প্রেক্ষাপট কাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।” (প. ৯১)
“এখানে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি, আমি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে ইত্তেফাকের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য টিকাটুলি গিয়েছিলাম। মতিঝিলের যেখানে শেষ সেখানে একটি ওষুধের দোকানে জরুরি ওষুধ কিনে বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় শহীদ কাদরীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আমাকে দেখে তিনি উচ্চহাস্য করেছিলেন। সে হাসির অর্থ আমার কাছে তখনো যেমন দুর্বোধ্য ছিল আজও দুর্বোধ্য।” (প. ৯৫)
এইটা আল মাহমুদেরই ন্যারেশন। কিন্তু এই ন্যারেশন এটলিস্ট ক্লিয়ার করতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাটা যখন ঘটতেছে তখনো শামসুর রাহমান আর শহীদ কাদরী উনাদের এলিটিস্ট সাহিত্যিক-বোধের জায়গা থিকা পুরাপুরি সাবস্ক্রাইব করতে পারেন নাই কমন পিপলের বাংলাদেশ ধারণাটাতে। এতোটা বিচ্ছিন্নতা হয়তো আশ্চর্য লাগতে পারে এখন আমাদের কাছে, কিন্তু মিথ্যা হওয়াটা মনেহয় পসিবল না। কারণ এখনো পর্যন্ত একসেপশনাল বা আলাদা হইতে পারাটাই আর্ট বা সাহিত্য আমাদের কাছে, কমন বা সাধারণ হইতে পারাটা না। তো, পাবলিকের লগে একমত হইতে পারাটা এখনো যেমন কঠিন, তখনো একইরকমই হওয়ার কথা।
তবে শামসুর রাহমান বা শহীদ কাদরী একই ঘটনার কথা বললে হয়তো একইভাবে বলতেন না। মানুশের চিন্তা-ভাবনা, কাজ-কাম একটা জায়গাতে আটকায়াও থাকে না সবসময়। কিন্তু মজার ব্যাপারটা হইতেছে, শামসুর রাহমান বা শহীদ কাদরী এই ঘটনাগুলিরে কখনোই লিখিত করেন নাই এবং সম্ভবত এইগুলারে সাহিত্যের বাইরের ব্যাপার বলেই মনে করতেন বা করেন। আর আল মাহমুদ তারে বলবার মতো মনে করছেন এবং বলছেন। এই বলতে পারটা যে কতোটা জরুরী তা তিনি তাঁর অস্তিত্ব দিয়াই জানছেন:
“আমাদের অনেক অসাধারণ কাব্য প্রতিভা বক্তৃতা দিতে সারা জীবনেও সম্মত হননি। হয়তো এই ভেবে সম্মত হননি যে, এতে কবির ধ্যান ও জ্ঞানের নীরবতা অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে যায়। আমি এটা এক সময় নিজেও ভাবতাম। কিন্তু আমি যদি বলতে না জানতাম তাহলে আমাকে শেয়াল ও শকুনের খাদ্য হতে হতো।” (প. ৮২)
এই বইটা এই কারণেই স্পেশাল একটা ব্যাপার। কারণ, সাহিত্যে কতটুকু বলা হবে আর কতটুকু অব্যক্ত থাকতে হবে, বলা হবে কিন্তু লিখা হবে না – এই তর্কটারেও তা এক্সপ্লোর করতে পারে একভাবে।
আবার ধরেন, আল মাহমুদ যে সব ঘটনাই বলছেন, এমনটাও কিন্তু না। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ঘটনার কথাই তিনি বলছেন, কিন্তু সব ঘটনার কথা হয়তো বলবার মতো বলে মনে করেন নাই, মানে তিনি না-ই বলতে পারেন, সব ঘটনার কথাই যে বলতে হবে বা মনে রাখতে হবে এইটাও না; বলার প্রসঙ্গটা হইতেছে যে, এইখানে হয়তো একটা নির্বাচন পদ্ধতিও তো আছে, ব্যক্তির অগোচরে, তাঁর ব্যক্তিত্বে, ব্যক্তি-প্রতিভাতে। যেমন, আমি তো এইখানে আল মাহমুদের বইটার পুরাটাই বলতেছি না।
এই বলাবলির ক্ষেত্রেই আবার আল মাহমুদ ‘বেয়াদবি’র প্রসঙ্গ আনছেন:
“আমি তারুণ্যের স্বীকৃতি দিতে কখনো অস্বীকার করিনি। তরুণ কবিদের পদ্যের চেয়েও তাদের চেহারা আমার কাছে রহস্যময় বলে ধারণা হয়েছে। আমার কাছে সাহস করে কোনো তরুণ কবি এসে কথা বলতে চাইলে তাকে প্রশয় দিতে দ্বিধা করি না। তবে কিছু বেয়াদব তরুণ অসঙ্গতভাবে অগ্রজ কবিদের অপমান করতে চাইলে আমি এর জবাব দিতে ছাড়ি না। বেয়াদব তো শিল্পের সব ক্ষেত্রেই আত্মগোপন করে আছে। এরা সাহিত্য শিল্পের কোনো উপকার করে না। তবে অপকার এবং অসংযত আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এরা সাহিত্যে থাকে না কিন্তু এদের দুর্ব্যবহার সাহিত্যের সমালোচকেরা বেশ কৌতূহলের সঙ্গে উল্লেখ করেন, যা আমি কোনোভাবেই সঙ্গত বলে মেনে নিতে পারি না।” (প. ১৮৮)
কিন্তু আমার সন্দেহ, আল মাহমুদ এইখানে বেয়াদবি বলতে এক ধরনের অস্পষ্টতাও বোঝাইতে পারেন। যেমন আল মাহমুদ সিনিয়র বইলা উনার কবিতার সমালোচনা করতে গেলে, ইনাইয়া বিনাইয়া প্রথম উনারে বড় করতে হইবো, তারপর উনার ছোটখাট দোষ ধরতে হইবো – এই টাইপ একটা আলোচনা-সমালোচনার ব্যাপার আমাদের দেশে চালু আছে। বিনয় আর অস্পষ্টতা এবং বেয়াদবি আর স্পষ্টতা যদি সমার্থক হয়া ওঠে তাইলে সত্যি সত্যি সাহিত্যের বিপদ আরো আছে।
মানে, কবিতা তো সোসাইটির বাইরের কিছু না। কবিতার যে কোন বিচারই সবসময় দাঁড়ায় তার অর্থবোধকতার সাপেক্ষে, অর্থাৎ, একটা কবিতা কী কী অর্থ উৎপাদন করতে পারে আর তার অর্থবোধকতাগুলি তৈরী হয় সমাজে বিদ্যমান জ্ঞান-কাঠামোগুলোর ভিতর দিয়াই। কিন্তু একটা কবিতার কবিতা হওয়ার লাইগা দর্শন ও সামাজিক বিজ্ঞানের শর্তগুলারে পূরণ করাটা জরুরি বিষয় না। যেহেতু কবিতা ব্যাপারটা সোসাইটির লগে রিলেটেড, এই কারণে সামাজিক বিজ্ঞানের আন্ডারস্ট্যান্ডিংগুলা দিয়া তারে বিচার করা লাগে, কিন্তু কবিতার লক্ষ্য সোসাইটির ভিতরে নিজেরে গ্রহণযোগ্য কইরা তোলা না, বরং জায়গাগুলারে নতুন কিছু প্রশ্নের কাছে নিয়া যাইতে পারাটাই এর একটা কাজ, মানে, ইন্টেলেকচুয়াল জায়গা থিকা যদি আমরা ভাবতে চাই। আল মাহমুদ এই জায়গাটারে আসলে একভাবে এড়াইছেনই উনার কবিসুলভ প্রজ্ঞার ভিতর দিয়া।
তো, এইরকম ইন্টেলেকচুয়াল বা ক্রিটিক্যাল বিবেচনার বাইরে মিডিয়া ও অন্য সামাজিক সম্পর্কের জায়গাগুলাতে উনি কনসার্নড হইছেন। উনার ক্লেইম অনেকটা এইটা যে, এই সামাজিক যোগাযোগগুলাই আমাদের ক্রিটিসিজমের বেইজ হিসাবে কাজ করতেছে। কথাটা মিথ্যা না, পুরাপুরি। এই জায়গায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিষয়ে আল মাহমুদের বিচারটা উল্লেখ করা যাইতে পারে:
“অথচ শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার সঙ্গে ছিলেন ঈর্ষাকাতর। আমার কবিতা সম্বন্ধে সুযোগ পেলেই অযথার্থ মন্তব্য করতেন। অথচ এই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ই মুক্তিযুদ্ধের কিছু দিন আগে পূর্ব বাংলার কবিতা বলে যে সংকলন বের করেছিলেন, তাতে আমার কবিতাকে এতটাই প্রাধান্য দিয়েছিলেন যে, আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কবিদের এই অন্তর্বিরোধ অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি শক্তির ব্যাপারে কোনো অবস্থাতেই অসহিষ্ণু হতে পারিনি, কারণ পশ্চিমবঙ্গের কবি বলতে এখনো শক্তিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। তার ধারে কাছে কাউকে বিবেচনা করতে পারি না।
আনন্দবাজার পত্রিকায় তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাউকে শীর্ষে তুলতে পারে, আবার কাউকে অন্যায়ভাবে স্তিমিত করে দিতে পারে। এটা অহরহ তারা করে থাকে। কিন্তু অকবিকে কবি বানানোর কোনো চেষ্টাই সফল হয় না, সফল যে হয় না শক্তি চট্টোপাধ্যায়ই তার প্রমাণ।” (পৃষ্ঠা. ১৮৭)
আনন্দবাজার বহুত চেষ্টা কইরাও শক্তিরে অ-কবি বানাইতে পারে নাই। আবার শক্তি আল মাহমুদের কবিতারে পছন্দ না করলেও তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে কবিতার ক্রনোলজিতে আল মাহমুদের কবিতারে অস্বীকার করতে পারেন নাই।
তাই সাহিত্যের ইতিহাস সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসের বাইরের কোনো ব্যাপার না। এইসবের প্রতিফলন সাহিত্যের ইতিহাসে আছে, খুব প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে, স্পেনের গৃহযুদ্ধের কথা, সেইটা আর রাজনৈতিক থাকে নাই, সাহিত্যের ইতিহাসও প্রত্যক্ষভাবে তারে জড়িত করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ, জাসদ এইসব সাহিত্যের ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক ঘটনা। কিন্তু সাহিত্যেরও নিজস্ব ঘটনা ও ইতিহাস আছে, এইসবের বয়ান বেশিরভাগ সময়ই অব্যক্ততার ভিতর থাকে। কেউ তারে মিথ ও কাহিনির রূপ দিতে চায় এবং দিতে পারে, কেউ তারে পাশ ফিরায়, এড়ানোর পথগুলি তৈরি করে, কেউ নিজ নিজ বয়ানগুলিও হাজির করে।
বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস-এর ক্ষেত্রে আল মাহমুদ তাঁর বয়ান হাজির করতে গিয়া তারে বলছেন ‘ষড়যন্ত্র, হিংস্রতা ও প্রতিভাকে অস্বীকারের ইতিহাস’:
“বাংলাদেশে কবিতার ইতিহাস হলো ষড়যন্ত্র, হিংস্রতা ও প্রতিভাকে অস্বীকারের ইতিহাস। এতে প্রকৃত কত কবি যে কাব্য রচনা ত্যাগ করে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন তার কে হিসাব রাখে। অনেকে প্রতিভার ফুৎকারে বাতাসে আগুন ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন। আমার মনে পড়ছে হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, নিলুফার বানু, লতিফা হিলালী ও জিয়া হায়দারের কথা। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথাও আমি সাহস করে বলতে পারি। তিনি যে আড়ম্বর নিয়ে শুরু করেছিলেন তার কী পূর্ণতা পেয়েছে? হয়তো আমার এই বিবরণে বির্তক সৃষ্টি হবে। এটা জেনেই আমার জীবন দৃষ্টি আমি বর্ণনা করে ব্যাখ্যা করেছি। সমালোচনা তো থাকবেই। তবে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি একজন কবির নাম উল্লেখ করব যিনি সাহিত্যের নিয়ম পূর্ণ করেও পূর্ণতার সম্মান এই হিংস্র দেশ থেকে আদায় করতে পারলেন না। অথচ কথাশিল্পী হিসেবে তিনি যদি গণ্য হতে চাইতেন তাহলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে পাই না। জানি না তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন কেন? তিনি তো গদ্যেই মহাকাব্য রচনা করেছেন। তার নাম আলাউদ্দীন আল আজাদ।” (পৃষ্ঠা. ৭৪)
যে নামগুলি তিনি বলছেন, তাতে তাঁর নিজস্ব পছন্দ তো আছেই, কিন্তু একটা পরিক্রমার কথা বা আঁচও কি নাই? কিভাবে একজন কবি সমকালে চিহ্নিত হন বা অচিহ্নিত হয়া থাকতে পারেন, তার একটা নমুনাও পাওয়া যায় কিনা, সেইটা বিবেচনায় রাখতে পারেন। এই প্রসঙ্গটা আরো স্পষ্ট হয় যখন তাঁর বয়ান আগাইতে থাকে:
“আমি কোনো উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে ঢাকায় আসিনি। এসেছিলাম শুধু কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। একটু স্থান, কোথাও অনেকের ফাঁকে নিজের নাম ছাপা হয়েছে এতেই আমি তুষ্ট থাকতাম। কিন্তু ব্যর্থ কবির দল সব সময় প্রকৃত কবিকে চিনে ফেলে। তাকে আর মাথা তুলতে দেয় না। সবাই শুধু মাথায় আঘাত করতে চায়। আর পদের সঙ্গে আমার নাম উচ্চারিত হয়, যেমন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী–তারা আমার সঙ্গী ছিলেন বটে। কিন্তু বন্ধু ছিলেন না। ছিলেন কঠোর ও নির্মম প্রতিদ্বন্দ্বী। সামান্যতম ছাড় তারা আমাকে দেননি। তবে আমি গ্রাম্য লোক বলেই অনেক বিষয়ে কারো পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকিনি।” (পৃষ্ঠা. ৮৯)
এই জায়গাগুলিরে আসলে কে স্পষ্ট করে? কে কারে ধরে রাখে? বা কে কারে অ-নির্বাচিত করে? কীভাবেই বা করে? এইখানে হয়তো সমালোচনার একটা ঘটনা আছে। কিন্তু সত্যিকারভাবে কোনো সমালোচনা সাহিত্য বাংলাদেশে দাঁড়াইছে বইলা আল মাহমুদও মনে করেন না। তাই সমালোচনায় অবিশ্বাসী তিনি নিজেই নিজের সমালোচনা করছেন:
“আমি দাবি করি, আমি জেলখানায় বসে ত্রিশের কবি স্বভাবের বিপরীতমুখী বাকচাঞ্চল্য সৃষ্টিতে পারঙ্গম হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয় এ নিয়ে কোনো বিস্তারিত আলোচনা করার মতো শক্তিধর কোনো সমালোচক বাংলাদেশে ছিল না। ফলে বাংলাদেশের আধুনিক কবিতা মূলত সমালোচনাহীন এক শিল্প তরঙ্গে নিজেকে ফোয়ার মতো ছড়িয়ে দেয়ার আয়োজন পূর্ণ করে তোলে। আর এখন আমি নিজেই কবিতার সমালোচনায় অবিশ্বাসী হয়ে উঠছি।” (পৃষ্ঠা. ১৫৮)
আমার ধারণা তাঁর সমালোচনাটা খারাপ হয় নাই। তবে তিরিশের স্বভাবরে তিনি কীভাবে দেখছেন, সেইটা বললে হয়তো আরো ভালোভাবে বোঝা যাইতো বিষয়টা। হয়তো তিনি বলছেনও অন্য কোথাও। কিন্তু একরকম আন্দাজ করা যাইতে পারে, তিরিশের দশক যেইরকম একটা ফরেন রিয়ালিটিতে আটকা পইড়া গেছিল, উনাদের ইমেজ, অবয়বে দেশি মাল থাকলেও চিন্তার জায়গাটা যে ইউরোপিয়ান, সেইটার জায়গায় আল মাহমুদ এক রকমের ‘দেশি’ রিয়ালিটি থিকা বলতে চাইছেন; যেইটা শহীদ কাদরী করেন না, শামসুর রাহমানও এড়ায়া গেছে ‘গ্রাম্য’ হওয়ার ডরে। কিন্তু আল মাহমুদের এই ‘গ্রাম্য’ হওয়ার নিয়া কোন শরম ছিল না, বরং উনি বেশ প্রাইড নিয়াই বলছেন যে, আমি গ্রাম থিকা আসছি। এই তাকদটা উনার ছিল।
………………………………………………
‘খাঁটি’ বাংলাদেশি কবি আল মাহমুদরে নিয়া একটা কথা
আল মাহমুদের কবিতা তো ভালো। (মানে, আমি উনার কবিতার একটা ক্রিটিক করতে চাইতেছি আসলে, এইজন্য আগে-ভাগে মাফ চাওয়ার মত বইলা নেয়া যে, উনার কবিতা ‘ভালো’।) কিন্তু উনার কবিতার এস্থেটিক্যাল যেই জায়গা, সেইটাতে আমার না-রাজি’র জায়গা’টা আগেও বলছিলাম মনেহয়; এখন আরেকবার বইলা রাখতে চাইতেছি।
আমার ধারণা, আল মাহমুদ’রে যে কলকাতা-পন্থী এস্থেটিক্সরাও নিতে পারেন, এর একটা মেজর কারণ হইতেছে, বাংলাদেশ’রে ‘গ্রাম-বাংলা’ হিসাবে দেখানোর যে তরিকা, সেইখানে উনার কবিতা খুবই ভালোভাবে ফিট-ইন করতে পারে। মানে, বাংলাদেশে যে গ্রাম-বাংলা নাই – তা তো না কিন্তু ‘বাংলাদেশ মানেই যে গ্রাম-বাংলা’ – এই নজির হিসাবে উনার কবিতারে অনেকবেশি নেয়া যায়। মানে, ‘আল মাহমুদের কবিতা হইতেছে বাংলাদেশের কবিতা’ – এইরকম স্টেটম্যান্ট পাইবেন। তো, কোন বাংলাদেশ? বা কেমনে বাংলাদেশ? – এই জিনিসগুলা নিয়া ভাবতে গেলে, ব্যাপারটা দেখতে পারাটা আরো ইজি হইতে পারে মনেহয়।
তো, এর এগেনেস্টে শহীদ কাদরী’র ‘শহুরে’ বা শামসুর রাহমানের ‘মফস্বলী’ বা ‘মিডল-ক্লাসে’র ‘বাংলাদেশ’ বেটার – এই কথা আমি বলতে চাইতেছি না। বরং এই যে ‘গ্রাম-বাংলা’রে ‘হাজার বছরের বাংলাদেশের ঐতিহ্য’র গর্তের ভিতরে ফালানোর চেষ্টা, বা এইভাবে রিড করাটারে খুবই বাজে জিনিস বইলা মনে করি। আর এই জিনিস বা এই ‘বাংলাদেশ’ কলকাতার কলোনিয়াল কালচারের বানানো একটা জিনিস।
আল মাহমুদ এই জিনিস জানতেন না – সেইটা আমার মনেহয় না। তখনকার (১৯৬০ – ১৯৮০) ঢাকার পাওয়ারফুল আরবান মিডল-ক্লাসের (যারা আসলে ছিলেন কলোনিয়াল কলকাতার মিনিয়েচার, এখন মারা যাইতেছেন) ভেড়ার দলে না ঢুইকা ‘খাঁটি’ বাংলাদেশি হইতে চাইছেন উনি। উনার এই উদ্দেশ্যরে ‘মহৎ’ বা ‘চালাকি’ ভাবার চাইতে, এইটা যে একটা ‘ট্রাপ’ এই জিনিসটা মনেহয় আমাদের বুঝতে পারাটা দরকার।
মানে, ‘গ্রাম-বাংলা’ নিয়া কবিতা লেখা যাবে না – তা না; কিন্তু বাংলাদেশের ‘হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য’ নিয়া কবিতা লেখা বা অই প্যাটার্নটারে গ্লোরিফ্লাই করার আগে, আরেকটু ভাবতে পারা তো দরকার। নাকি না?
/২০২০
………………………………………………
উনার গ্রাম্য হইতে পারাটা একদিক থিকা যেমন নতুন একটা পারসপেক্টিভ দেয়, শহরের ইগোটারেও স্যাটিসফাই করে। মানে, সেই ভাবনাটা থিকা দূরে সইরা যায় না কখনোই। তো, উনার কবিতার ক্রিটিক করাটা উদ্দেশ্য না এইখানে। উনার যেইটা জরুরী উপলব্ধি, তা হইতেছে সমালোচনাহীনতা। মনে হইতে পারে যে, অনুল্লেখ-এর ভিতর দিয়াই বর্তমান সময়ে একজন কবি বা লেখকরে মাইরা ফেলা সম্ভব। কিন্তু একটা কবিতা যে কোনো পরিস্থিতিতেই জাইগা ওঠার সম্ভাবনারে ধারণ করতে পারে, আর এই সমালোচনাটা জরুরি তার সেই সম্ভাবনাগুলারে লোকেট করার জন্য।
তবে আল মাহমুদ নিজেও সমালোচনারে এড়াইছেন ‘কাম’-এর বশবর্তী হয়া। একটা ঘটনার কথা তিনি বলছেন, এইভাবে:
“ড. সুমিতা চক্রবর্তী বলে এক মহিলা আমার ওপর একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করলেন। প্রবন্ধটিতে আমার তীব্র সমালোচনা থাকলেও আমার কবিতার যথেষ্ঠ প্রশংসা ছিল। এই প্রবন্ধটি প্রকাশের পরেই সুমিতা চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে সাক্ষাত হয়েছিল।…সুমীতা যাদবপুর ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের সম্ভবত তখন প্রধান ছিলেন। তিনি অনেক বিষয় আলোচনা করেছিলেন, যা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু সাক্ষাতে তার সঙ্গে আমি কোনো তর্কে যাইনি। এর একটা কারণ হতে পারে যে, তিনি আমার দৃষ্টিতে এক সুন্দরী যুবতী বলে প্রতিভাত হয়েছেন। আমি সু-রূপা, লাবণ্যময়ী কোনো ঈভের সঙ্গে বিতর্কে জড়াই না।” (পৃষ্ঠা. ১৫৮)
এই ঘটনা পড়ার পর আল মাহমুদ এর মিটিমিটি, হাসিহাসি চেহারা আমার সামনে ভাসতেছে।
কিন্তু পাঠক তো জানতেই চাইবেন, আল মাহমুদ-এর এইসব কথা ও কাহিনি কতোটা সত্যি? তখনই এই প্রশ্নটা সামনে আসে যে, একজন কবি’র দায়িত্ব কি ‘সত্য’ কথা বলা বা ‘সত্য প্রকাশ’ই কি শিল্পের লক্ষ্য? ‘সত্য’ বিষয়ে ক্রিটিক্যাল না হইলেও ’সত্য-বলা’-কে একটা কাজ হিসাবে দেখলে আল মাহমুদের একটা বয়ান এই প্রসঙ্গে হাজির করা যাইতে পারে:
“কবির জীবন কী রকম হয় তার কোনো দৃষ্টান্ত আমার কাছে নেই। অথচ অনেক কবির জীবন-কাহিনী বা স্মৃতিকথা আমি পাঠ করেছি। একবার এক বিদ্বান ব্যক্তি আমার বই ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ টিভিতে আলোচনা করতে গিয়ে আমাকে প্রশ্ন করেছেন –‘লোকে বলে আপনার এই বইয়ের পঞ্চাশ ভাগ সত্য আর পঞ্চাশ ভাগ মিথ্যা।’ আমি হেসে বললাম, আপনি তো ইংরেজী সাহিত্যের তুখোড় ছাত্র ছিলেন। আধুনিক সাহিত্যের খোঁজ-খবর রাখেন। আপনিই বলুন, একটা বই সেটা আত্মজীবনী হোক বা উপন্যাসই হোক এর পঞ্চাশ ভাগ সত্য হলে এটা কি অকল্পনীয় সাহিত্যে সত্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়? তিনি পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন। কারণ আমার ধারণা এই বইয়ের দ্রুত গতি ও গদ্যের বিদ্যুৎ ওই ভদ্রলোকের আয়ত্তাধীন ছিল না। তিনি রাজনৈতিক পক্ষপাত থেকে আমাকে জব্দ করতে চেয়েছিলেন। হয়তো আজও চান। কিন্তু আমি তাকে একটা কথা বলতে পারি, পঞ্চাশ দশকের যে ক’জন কবি খ্যাতি-অখ্যাতি নিয়ে বেঁচে আছেন তাদের একটিমাত্র জীবন-কাহিনী। আর সেটি হলো ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’।
কবিদের জীবন এরকমই হয়। কোনো কবিই তো সত্য রচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাহিত্যে আসেন না। কিন্তু লোকে তার মিথ্যাকে সত্য ধরে নিয়ে তাকে পুরস্কৃত করে এবং অমরতার মালায় তার নামটি গেঁথে নেয়। আমি অবশ্য অমর হওয়ার বাসনা থেকে কাব্য রচনা করিনি।” (পৃষ্ঠা. ৭৮)
এইখানে বলা যায় যেভাবে বেড়ে উঠি’র কথা, সেইটা কিন্তু সাহিত্যের ঘটনা হিসাবে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয় নাই। হয়তো আবিদ আজাদ-এর ‘কবিতার স্বপ্ন’ বইটা আমার আগেই পড়া ছিল বইলা এতোটা একসাইটেড হইতে পারি নাই। মানে, শেষমেশ কবি আইডেন্টিটিটাও একটা সোশ্যাল কন্সট্রাকশনই তো।
তবু আল মাহমুদ কথা বলতে চাইছেন এবং বলাটা জরুরী মনে করছেন, এই বোধটাই আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হইছে। মনে হইছে, তিনি একটা জীবনের পুরাটাই বেঁচে থাকতে চাইছেন শুধুমাত্র কবিতার জন্যই। ‘সত্য’ হোক বা ‘মিথ্যা’ হোক, এই কথাটাই তিনি বারবার বলার চেষ্টা করছেন, এই বইটাতে। বইটাতে একটা জিনিস এটলিস্ট ক্লিয়ারলি বুঝা গেছে, সাহিত্য সোসাইটির বাইরের কোন দুর্গ না, যেইখানে একলা মনে কোন কবি বইসা কবিতা লিখতেছেন। অন্য সব জায়গার মতো এইখানেও আছে রাজনৈতিক কূট-কৌশল, ব্যক্তিগত জিঘাংসা আর অন্য সব কিছুই। সাহিত্যরে পবিত্র বইলা দেখানোর যেই প্রজেক্ট আল মাহমুদের বইটা এর পার্ট না। একটা সময়ের সাহিত্য অই সময়ের সমাজ-বাস্তবতার বাইরের কোন জিনিস না, বরং সেইটারই একটা ইন্ট্রিগ্রাল পার্ট। এই জায়গা থিকা উনার বলাটারে জরুরি একটা কাজ বইলা মনে করি আমি।
/এপ্রিল, ২০০৮
………………………………….
এই লেখাটা ছাপানো হইছে “কবি” বইয়ে। বইটা কিনতে পারেন এই লিংকে ক্লিক কইরা:
কবি: ইমরুল হাসান – Kobi: Imrul Hasan | Rokomari.com
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (তিন) - নভেম্বর 15, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024