আমার জবাব – আবদুল হামিদ খান ভাসানী
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে মাওলানা ভাসানী যখন আবার “সাপ্তাহিক হক-কথা” পত্রিকা ছাপাইতে শুরু করেন, তখন অই পত্রিকাতে একটা কলাম ছাপা হইতো, “আমার জবাব” নামে। পাঠকের প্রশ্নের উত্তর উনি দিতেন। খুব বেশি প্রশ্ন-উত্তর যে ছাপা হইছিল তা না, ছয়টা প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁইজা পাইছি। সংখ্যায় কম হইলেও, অই সময়ের কনটেক্সটেই না খালি, ভাসানীর পলিটিক্যাল পজিশন বুঝার ব্যাপারেও এই ছোট প্রশ্ন-উত্তরগুলা ইম্পর্টেন্ট বইলা আমরা মনে করতেছি।
এডিটর, বাছবিচার
…………………….
[১০ই মার্চ, ১৯৭২]
আবু তাহের, ঘাটাইল: আপনি পাকিস্তান আন্দোলন করিয়াছিলেন ইহা যতদূর সভ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিয়াছেন ইহাও ততদুর সতা। কিন্তু আজ যে সত্য উপলব্ধি করিয়াছেন ২৫ বৎসর আগে তাহা অনুধাবন করিতে পারিলে এত রক্তপাত হইত না। আপনি তজ্জন্য অনুতপ্ত নন কি ?
উত্তর: আমি মোটেই অনুতপ্ত নই। কারণ ২৫ বৎসর পূর্বে যে রাজনীতিতে পাকিস্তান আন্দোলন করিয়াছিলাম আজও তাহাই করিতেছি৷ সেই রাজনীতির ভিত্তি ছিল অর্থনীতি, ক্ষমতার টোপ নহে। হিন্দু জমিদার, মহাজন, জোতদরি, প্রভৃতি শ্রেণী গরীব মুসলমান কৃষক-মজুরদের উপর যে শোষণ ও নির্যাতন চালাইয়াছিল ইহারই প্রতিক্রিয়ায় শোষণমুক্তি আন্দোলনের প্রতীক স্বরূপ আমরা পাকিস্তান আন্দোলন করি। কিন্তু দেখা গেল শোষকের কোন ধর্ম নাই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শোষণ তো গেলই না বরং শোষকের চেহারা বদলিল মাত্র। গরীব আরও গরীব হইল। ধনী আরও ধনী হইল। তাই আবার অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য স্বাধীনতা কায়েম করিয়াছি। রাজনৈতিক চেতনা ও উপলব্ধি নিঃসন্দেহে সমসাময়িক পরিবেশের আলোকে গৃহীত হয় এবং যদি তাহাতে অন্ততঃ তখনকার জন্য হইলেও সত্য ও ন্যায়ের পথে মানুষের কল্যানের সম্ভাবনা নিহিত থাকে তবে সেই আন্দোলন ও জাগরন কোন না কোন অর্থে স্বার্থক ।
[১৭ই মার্চ, ১৯৭২]
শেখ আবদুল আজিজ, ঢাকা: আপনার হক কথায় পরস্পর বিরোধী বিষয় পেশ করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। আপনি প্রগতিশীল রাজনীতিকে বিপ্লবী ছাঁচে ঢালাই করে বাংলাদেশকে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে আলোচ্য বিষয় করছেন। আপনার পত্রিকায়ও সেই আলোকে লেখা বের হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তৎসঙ্গে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার অবতারণা না করলেই ভাল হত। কারণ আগেই বলেছি, তা পরস্পর বিরোধী। আপনি কেন এতে ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছেন?
উত্তর: কোন্টা প্রগতিশীল, কোন্টা বিপ্লবী এসব যাচাই করে আমি কোন দিন রাজনীতি করিনি । বরং আমি যা করেছি তা বিশ্লেষণ করে আপনারা যা খুশী আখ্যা দিয়েছেন! আমার কিছু আসে যায় না। কারণ আমার আসল দ্রষ্টব্য বিষয় হচ্ছে কিসে মানুষের কল্যাণ নিহিত আর আমি ন্যায় ও সত্য পথে আছি কিনা।
ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা ও এর প্রতি মানুষের অন্ধ আকর্ষণকে একসপ্লয়েট করে রাজনীতি করা আমি কোন দিন পছন্দ করি নি। যতদূর জনি, আমি তা করিও নি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নিরেট বস্তুবাদকে ভিত্তি করে কোন রাজনীতি-অর্থনীতিই মানুষের চূড়ান্ত স্থায়ী কলাণ সাধন করতে পারে না। মানুষকে যতদুর বাস্তববাদী হওয়া দরকার ততটুকু তাকে হতেই হবে । এর মানে এই নয় যে তার আত্মার অনন্ত খোরাককে অস্বীকার করবে। সাহিত্য ও ললিতকলা যেমন বস্তুভিত্তিক চেতনার উন্মেষ ঘটাতে পারে ঠিক তেমনি মূল্যবোধ মানুষকে শক্তি এবং সমৃদ্ধি দিতে পারে বলে প্রমাণিত হয়েছে। সেই প্রমাণের অসব্যাখ্যায় ও অপপ্রযোগে যারা রাজনীতি খাড়া করে তারা মানবতার এক নম্বরের দুশমন।
ইতিহাসে দুটি দিকই রয়েছে। একদিকে স্বার্থপর শ্রেণী লোকজনকে ধোঁকা দিয়ে শোষণের কৌশল শক্তিশালী করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সত্যিকার ধর্ম মানুষকে সরল ও সোজা পথে রেখে বিশ্ব শন্তি ও বিশ্ব কল্যাণে অনস্বীকার্য অবদান প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই প্রমানিত হয়েছে, মাছ যেইরূপ পানি ছাড়া জীবিত থাকতে পারেনা ঠিক তেমনি মানুষের আত্মা যে কোন ধর্মের মর্মবাণী অস্বীকার করতে পারে না। ভন্ডদের ধর্মকে ঝেটিয়ে দূর করতে পারলে সত্যিকার ধর্ম মানব জাতির শুধু আত্মিক উন্নতি সাধন করবে না, বিশ্ব শান্তি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ভাব কায়েন করতে যথেষ্ট সাহায্য করবে। তবে হ্যাঁ, ধর্মে মর্ম বাস্তবানুগ ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টি ভঙ্গীতে গবেষণা, যাচাই ও উপস্থাপন করতে হবে।
হয়তবা আমার ধর্মকে জীবনে প্রমাণ করা সম্ভব হবে না, কিন্তু আমি বিশ্বাস কারিগরি সভ্যতা তথা বস্তুতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম বিকাশের ফলে মানব জাতি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হবে ভাবধর্মী আদান প্রদান গ্রহণ করতে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই কথাটি দুনিয়ার সর্বত্র সত্য প্রমাণিত হবে। এর পূর্ব পর্যন্ত জনগণকে সততা ও সাধুতার পথে রাখতে হলে প্রতি দশকে সংস্কৃতির বিপ্লব করে যেতে হবে। ঠিক তেমনি কোন জাতি কেবল ভাববাদী চিন্তাধারায় টিকে থাকতে পারবে না। দুনিয়ার বাস্তব পরিবেশকে মেনে নিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় চেতনাকে যেভাবে প্রয়োগ করছে আমি যতদিন বেঁচে থাকবো তার বিরোধিতা করে যাব।
প্রগতি ও বিপ্লবের সাথে, অন্ততঃ বাংলাদেশে যে বাস্তবতা কামিয়াব হতে যাচ্ছে, মানুষের অন্তরের খোরাক অর্থাৎ সর্বহারার মুক্তি নির্ভর ধর্মীয় মর্মবাণীর বিরোধ রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তাই এসব আলোচনায় আমার পার্শ্ব আকর্ষণ রয়েছে ।
[২৪ শে মার্চ, ১৯৭২]
আবদুল্লাহ আল মামুন, ওয়ারী, ঢাকা: বিগত ২৬শে ফেব্রুয়ারী কৃষক সমিতির সভায় আপনি বলেছন – মানুষকে না ভালবাসলে আল্লাহ্কে ভালবাসা যায় না। বিশ্বমানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হলে আমরা কি অহিংসবাদী হয়ে যাই না? এবং তাতে কি পূজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদীরা মনুষকে শোষণ করবার সুযোগ পাবে না?
উত্তর: ভালবাসাকে কখনো বিভক্ত করা যায় না। সর্বহারা ও পুঁজিপতিকে একই মন ভালবাসে। সর্বহারাকে ভালবেসে আমরা তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আর পুঁজিপতিকে ভালবেসে আমরা তাকে মানুষ রাখতে চাই। চাওয়া পাওয়ায় কোন অপোষ নেই। প্রয়োজনে তাই আমরা হিংসাত্মক পন্থা অবলম্বন করতেও দ্বিধাবোধ করিনা। তাতে আমরা মনেও করিনা যে কোন অন্যায় কাজ করছি। জালেম শোষককে মানুষের কাতারে আনতে চপেটাঘাত, বেত্রাঘাত, পদঘাত যত যা-ই দিতে হয় না কেন — নিশ্চয়ই তা বাঞ্ছিত। এই অর্থে মানবজাতির প্রতিটি সদস্যকে ভালবাসলেও আমরা অহিংসবাদী হয়ে পড়ি না। আমাদের অন্তরের উদ্দেশ্য বা নিয়ত শুধু আল্লাহ্ই জানেন এবং মনে যদি এই ভরসা থাকে যে তিনি যে ইনসাফকে পছন্দ করেন আমরা তাই করছি— তবে আর ভাবানা কিসের। সমগ্র দুনিয়া বিরোধিতা করলেও আমরা তা করে যাব। তাই ভালবাসাকে এক্সপ্লয়েট করবার কোন সুযোগ পূঁজিপতি বা সাম্রাজ্যবাদী পাবে না।
চীন ও রাশিয়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাৰে বহু পুঁজিপতি-জোতদার নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে মানুষের কল্যাণে সর্বস্ব ত্যাগ করে সর্বহারা হয়েছেন। মার্কসের আদর্শ ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচারই লাভ করতো না যদি না এঙ্গেলস তাঁর সম্পদ উজার করে না দিতেন। বিবি খাদিজা ও হযরত উসমানের অঢেল সম্পতির আয় ইসলাম প্রচরে ব্যয় না হলে স্বয়ং রসুলুল্লাকেও (দ:) মহা বিপাকে পড়তে হত। অবশ্য এই প্রসঙ্গে বৃটিশ নাট্যকার দার্শনিক বার্ণাড শ-এর একটি কটাক্ষ আমার মনে পড়ছে। একটি নাটকে তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন, বিশ্বের বড় বড় অসৎ ব্যবসায়ীর অর্থ সাহায্য না পেলে মানবতাবাদী কোন সংস্থাই টিকে থাকতে পারবে না।
[১৬ ই এপ্রিল, ১৯৭২]
নজরুল ইসলাম, টাঙ্গাইল: মানুষের চেয়ে আদর্শ এবং প্রতিষ্ঠানের চেয়ে নীতিই যদি বড় হয় তাহলে বাংলাদেশে যে ভাবে ব্যক্তি পূজা শুরু হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষেতি দেশের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে?
উত্তর: মানুষ, আদর্শ, প্রতিষ্ঠান ও নীতি – এসবের ব্যাপারে চুড়ান্ত কোন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে আমি মনে করি না। অন্ততঃ রাজনীতিতে এগুলো অপেক্ষিক, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের সাইক্লোনে লক্ষ লক্ষ লোক ভেসে গেলে পর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে পারিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর চালে যে অমানবিক রাজনীতি চলছিল তাতে আমি আদর্শের চেয়ে মানুষকে বড় করে দেখেছি। তাই ২৩ বৎসর পূর্বে যে আদর্শে বিজয়ী হয়েছি মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের খাতিরে তা পরিত্যাগও করেছি। আবার লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমানে দাঙ্গা আমাদেরকে দ্বিজাতি তত্ত্বের আদর্শ থেকে এক সময় বিচ্যুত করতে পারে নি। তখন যেমন মুসলিম লীগকে পাটী হিসেবে মুক্তি দাতা মনে করেছি, আবার তেমনি দেশ বিভাগের পর একই পাটী’র সরকারের অন্যায়, অবিচারকে বরদাশত করতে না পেরে বিদ্রোহ করেছি।
ব্যক্তি পুজা, বক্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা ইত্যাদি একটি জাতিতে পরিবেশের আলোকে জেকে বসে ৷ পরিবেশ বদলে গেলেই তা ফসকে যায় । স্থান, কাল, পাত্রের ঊর্ধে সকল পরিবেশে বল্যাণকামী মত ও পথ প্রতিষ্ঠা করলে তা কোন রাজনৈতিক চালই একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারে না। ঠিক তেমনি এর প্রতিষ্ঠাতার ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের আবেদন বিলুপ্ত হয় না। আজ কাল বাংলাদেশে ব্যক্তি পূজা চলতে থাকলে ধরে নিতে হবে পরিবেশ মাফিক সংশ্লিষ্ট নেতা নিজেকে জনসমক্ষে উপস্থাপিত করেছেন। অন্ততঃ কথায় হলে ও তিনি পরিবেশের দাবী মিটিয়েছেন। আবার সেই পরিবেশেই জাতির জন্যে অধিকতর কল্যাণকর বক্তব্য পেশ করেও অপর এক জন ততটুকু পুজ্য নাও হতে পারেন। কারণ হয়ত বা সেই বা বক্তব্য পরিবেশের আলোকে অগ্রগামী অথবা পশ্চাদগামী। যে কারণে সুরেণ বানার্জীকে বাঙ্গালী এক সময় ফুলের মালায় ভরে দিয়েছিল তাকেই আবার নর্দমার ময়লা ছুড়ে মেরেছে। কারণ পরবর্তী কালে তিনি পরিবেশের আলোকে পশ্চাদগামী হয়ে পড়ে ছিলেন। আবার এম, এন, রায় বাঙ্গালীর কল্যানের আদর্শ তুলে ধরলেও ততটুকু পূজ্য হয়ে উঠেন নি যেহেতু তিনি বাংলার পরিবেশের চেয়ে আগ্রগামী ছিলেন। আমাদের বাংলাদেশে আজকের ব্যক্তি পূজায়ও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এতে দেশের ভবিষৎ আমি মোটেই খারাপ দেখিনা। কারণ বর্তমান পরিবেশটির প্রতি মানুষের আকর্ষণ ও মোহ না কাটিয়ে উঠলে সত্যিকারের কল্যাণ হাজির হবে না। সাময়িক একটু প্রশস্তি, অস্বস্তি থাকবে, এই যা। অবশ্যি এর ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। তা হল স্বেচ্ছাচারিতা, সন্ত্রাস ইত্যাদি। জাতিকে এসবের কুফল মোটেই পেতে পারে না যদি একই সঙ্গে প্রগতিশীল আদর্শবাদী রাজনীতিবিদগণ জনগণকে পরিস্থিতির বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন রাখেন। যারা ব্যক্তি পূজা পছন্দ করেন না, তাদের কর্তব্য সেখানেই, দায়িত্ব তাইই।
[১৯শে মে, ১৯৭২]
অবিনাশ ভৌমিক, লক্ষী বাজার, ঢাকা: হুজুর, আপনার হক-কথা’র কোন সংখ্যায়ই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টীর কর্মী অথবা নেতোর দালালি সম্পর্কে রিপোর্ট দেখতে পেলাম না। আপনি কি মনে করেন এসব দোষে দুষ্ট আপনার পার্টীতে কেউ নেই?
উত্তর: আমাদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টীতে দালাল ও দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তি নাই – এই কথা যেমন জোর গলায় বলতে পারিনা, ঠিক তেমনি ‘আছে’ তাও সঠিক করিয়া উল্লেখ করতে পারি না। কারণ এই ধরনের রিপোর্ট যাহাদের বিরুদ্ধে ছিল স্থানায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিস্তর আলোচনা হইয়াছে। ইহার পরও যদি থাকে তবে আমাকে সপ্রমাণ জানাইলে নিশ্চয়ই এ্যাকশন নিব। আপনিই যদি প্রশ্নটির সহিত দুই-একটি নজির পাঠাইতেন তবে অবশ্যই সেমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতাম। হক-কথায় প্রকাশের জন্য দি কোন নাগরিক আমার পার্টীর সদস্য, কর্মী অথবা নেতা সম্পর্কে অভিযোগ প্রেরণ করে সত্য প্রমাণিত হইলে অবশ্যই উহা ছাপা হইবে।
ফাতিমা ফিরোজ, কুমিল্লা: সম্প্রদায়িকতার অভিযাগে অভিযুক্ত হতে হয় এমন কথা থেকে আপনি বিরত থাকছেন না কেন?
উত্তর: বহু বৎসরের রাজনৈতিক জীবনে কখনো আমার ভূমিকা ও বক্তব্যকে জাতি ধর্মশ্রেণী নির্বিশেষে মানিয়া লইতে দেখি নাই। একটি মহল বরাবর পাল্টা ব্যাখ্যা করিয়াছে। আজও ইহাই পুনরাবৃত্তি হইতেছে। ব্যাপারটি খুই স্বাভাবিক। বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিতে পারে এমন কথা চাপাইয়া জনমতকে খণ্ডিত করার উদ্দেশ্য এইসব প্রচার চলিতেছে। কিন্তু ইতিহাস ও সত্যদ্রষ্টা জানে – আমি কাফের, অমি হিন্দুস্থানের দালাল, অমি হিন্দুঘেঁষা, আমি ইসলামের ঘোর শত্রু ইত্যাদি অপবাদ যেমনি কালের বিচারে মিথ্যা প্রমাণিত হইয়াছে, ঠিক তেমনি প্রমাণিত হইবে আমি সাম্পদায়িক নই, আমি চক্রান্তকারী নই। বরং আমি বাংলাদেশের শুধু নয়, ভারতেরই শুধু নয় – সারাবিশ্বের নির্যাতিত, বঞ্চিত শ্রেণী তথ৷ কৃষক-শ্রমিকের কল্যাণ কামনা করিয়া কথ৷ বলি, কাজ করি এবং সংগ্রামে অবতীর্ণ হই। এই সংগ্রামে আমি আপোষহীন, বিরামহীন। এই জন্যই সুবিধাবাদী মহল, পুজিঁবাদী, সামন্তবাদী, সাম্রাজ্যবাদী – তিনি অফিসার, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী যা-ই হউন না কেন আমাকে বরদাশত করিতে পারেন না। পুর্বেই বলিয়াছি, আজও তাহাই ঘটিতেছে। তাহারাই চক্রান্ত করিয়া একটি বক্তব্য দাঁড় করাইতেছে: আমি সাম্প্রদায়িক ও আমি স্বাধীনতা নস্যাৎকারী। আসলে তাহারা বুঝিতেই পারিতেছে না – এই অপপ্রচারই হিন্দুকে হিন্দু, মুসলমানকে মুসলমান হিসাবে গোঁড়া করিয়া তুলিতেছে। অমুসলমানদের স্বার্থে ঘটিয়াছে কিংবা মনে আঘাত লাগিয়াছে আমার এমন একটি কাছের নজিরও শত্রুশিবির তুলিয়া ধরিতে পারিবে না। এবং হিন্দু মুসলমানে সম্প্রীতি বাড়ে এমন কাজ করিয়া এই জীবনে কত গালিগালাজ যে শুনিয়াচি তাহার ইয়াত্তা নাই। আমি হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধ লড়াই করিয়াছি। অর্থনৈতিক শোষন ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে হিন্দু মুসলমান কোন প্রভেদ নাই – এই বিশ্বাস লইয়াই আমি বাংল৷ ১৩২০ সাল হইতে কৃষক মজুরদের আন্দোলন শুরু করিয়াছি।
যাহোক আপনার প্রশ্নটিতে দরদও ফুটিয়া উঠিয়াছে। আপনি হয়ত আমাকে ভালবাসেন। তাই চান না যে আমি এমন অভিযোগে অভিযুক্ত থাকি। কিন্তু প্রথমেই ভাবিয়া দেখুন, কি উদ্দেশ্যে এবং কিসের ভিত্তিতে বিশেষ মহল এইসব কথা প্রচার করিতেছে। তাহাদের উদ্দেশ্য জাতিধর্ম নির্বিশেষে সর্বহারা মানুষের ঐক্য বিনষ্ট করিয়া নিজেদের শাসন ও শোষণ বলবৎ রাখা । আর তাহাদের বক্তব্যের ভিত্তি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ভারতে শোষক শ্রেণীর ধ্বংসাত্মক কাজের কথা বলিলে আমি সাম্প্রদায়িক হইয়া গেলাম, কোন রাজনীতি সচেতন লোক ইহা বলিতে পারে? আমি যাহা বলিতেছি তাহা গোপনীয় কোন কাজ সম্পর্কে নয়, বরং প্রকাশ্য দিবালকেই তাহা ঘটিতেছে। প্রতিটি অমুসলমানের অধিকার সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন থাকুক, ইহাও আমি বলিতেছি। আমি চাই, সকল ধর্মারলম্বী নিজ নিজ ধর্মের ধর্মের মৌল রীতিনীতি গোঁড়ামীমুক্ত মানসিকতায় শিক্ষা লাভ করুক। সরকার যদি এই দায়িত্ব গ্ৰহণ করিতে না চান—স্পষ্ট ভাষায় অচিরেই তাহা জানাইয়া দিতে পারেন। জনগণ যদি ইহার আবশ্যকতা বোধ করেন তবে তাহারা আগের মত নানাবিধ সাহায্যে ধর্মশিক্ষা বহাল রাখিবেন।
বড় বড় বই পড়িয়া অনেক তত্ত্বকথা জানা যায়, অনেক ফরমূলা, থিওরী, ইত্যাদির সহিত পরিচিত হওয়া যায়। কিন্তু বাংলদেশ মানুষের নাড়ী বুঝিতে হইলে শুধু বই পড়িয়া রাজনীতি করিলেই চলিবে না। তাহাদের সহিত একাত্ম হইয়ে যাইতে হইবে। আমি একাত্ম হইয়া বুঝিয়াছি, বাংলাদেশের মানুষের সমস্যার সমাধান একমাত্র সমাজতন্ত্রই দিতে পারবে। অমি উপলব্ধি করিয়াছি — বাস্তব জীবনের গতিশীলতার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা আত্মিক উন্নতিও কামনা করে। মনের ভাষায় এই সত্যটি বাংলাদেশের কৃষক-মজুর, শ্রেণী আমাকে জানাইয়াছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিক্ষিত লোক এই উপলদ্ধিকেই কি বলিতে চায় সাম্প্রদায়িকতা?
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024