এক
…
আর্নেস্ট। এইটাই সত্য। আসলেই: এমন বিরক্তি নিয়া ঘাড় উল্টাইলে কোনো লাভ নাই। কথাটা আসলেই সত্য। আর্টের সোনালী দিনে কোনো আর্ট-ক্রিটিক আছিলো না। ভাস্কর তখন মার্বেল পাথরের ভিত্রে ঘুমায়ে থাকা বিশাল সাদা-গায়ের হার্মিসরে চেঁছে বের করে আনতো। মোম আর সোনার পরত দেওয়ার কারিগররা মূর্তিটারে রং আর টেক্সচার দিতো, আর যখন দুনিয়া তারে দেখতো, পূজা করতো, সরল মনে। বালুর ছাঁচের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে থাকা কাঁসা ঢেলে দিতো, আর লাল ধাতুর নদীটা ঠান্ডা হইতে হইতে ছাঁচের বাঁকগুলায় জমে দেবতার গায়ের গড়ন নিতো। এনামেল বা পলিশ করা মণিমুক্তা দিয়া দৃষ্টিহীনরে দৃষ্টি দিতো। বাটালির নিচে কাঠের তুষগুলা হাইসিন্থ ফুলের পাপড়ির মত কোঁকড়ায়ে পড়তো। আর যখন, কোনো মাটির কারুকাজ করা দেওয়ালঅলা মন্দিরের ঢিমা আলোয়, অথবা সূর্যের আলোতে ফর্সা, চারদিকে পিলার দেওয়া নাটমন্দিরে, লেটো দেবীর পোলা তার পদস্থলের উপ্রে দাঁড়ায়তো, পাশদিয়া ἁβρῶς βαίνοντες δια λαμπροτάτον αἰθέρος৩ {আসমানি জাঁকজমকের ভিত্রে খোলা-খুলি হেঁটে যাওয়া (ইউরিপিদেসের মিডিয়া:৮২৫-৩০)} মানুষগুলা তাদের জীবনে নতুন একটা ইন্ফ্লুয়েন্সের সামনাসামনি হওয়ার অনুভূতি পাইতো, আর একটা খোয়াবি ভাব নিয়া, বা অদ্ভুত তাড়াহুড়া করে ওঠা আনন্দের ভাব নিয়া, বাড়ি যাইতো বা রোজকার কাজে, অথবা ঘুরতে ঘুরতে শহরের ফটক দিয়া পরীর-আছর-পড়া মাঠে বাইরাইয়া পড়তো যেইখানে ফেড্রাস তার পাও ধুইতো, আর, হাওয়ায় ফিসফিসায়ে ওঠা লম্বা চিনার আর ফুলফুটা নিশিন্দার তলে ওইখানে ওই নমর ঘাসের উপ্রে শুইয়া, সৌন্দর্যের আশ্চর্য নিয়া ভাবতে শুরু করতো, আর অনভ্যাসের মুগ্ধতায় নিরব হইয়া পড়তো। ওই দিনগুলাতে আর্টিস্ট স্বাধীন আছিলো। নদীর বাঁক থেকে আঙ্গুলে করে চিনা মাটি তুলে নিতো, আর কাঠ বা হাড্ডির ছুট্টু যন্ত্র দিয়া, মাটিটারে এত মনকাড়া সুন্দর সব রূপে গড়ন দিতো যে, মানুষ ওইগুলা মুর্দারারে খেলার জন্য সাথে করে দিয়া দিতো, টানাগ্রার পাশের ওই হলদিয়া টিলার উপ্রের ধুলা ভরা মাজারগুলাতে এখনও আমরা পুতুলগুলা খুঁজে পাই, চুল, ঠোঁট আর লেবাসে হালকা সোনালী আর ফিকা হইয়া পড়া কড়া লালটা এখনও লেগে আছে। নতুন চুনকাম করা দেওয়ালে, উজ্জ্বল সিন্দুর বা দুধ আর জাফ্রান মেশানো রঙ দিয়া, বেগুনী-সাদা ফুলে ফুটফুটা আস্ফদেল মাঠের ভিত্রে দিয়া মেহনতে হয়রান পাও দুইটা টাইনা যাওয়া মানুষটার ছবি আঁকতো, ‘যার চোখের পাতায় পুরাটা ট্রোজান ওয়ার ভর করে আসছে,’ পলিক্সেনা, প্রিয়মের মেয়ে; অথবা আঁকতো অডিসিয়াসরে, বুদ্ধিমান আর চালুমাল অডিসিয়াস, শক্ত দড়ি দিয়া মাস্তুলের সাথে আঁট করে বান্ধা, যাতে কোনো খেসারত ছাড়া মৎসকন্যারার গান শুনতে পারে, অথবা তারে আঁকতো পরিষ্কার পানির নদী আখেরনের পাড় ধরে ঘুরাফেরা করতেছে, যেইখানে মাছের ভুত নুড়ি পাথরের বিছানার উপ্রে ছটফটায়; অথবা আঁকতো ম্যারাথন মাঠে তহবন্দ পরে মিট্রে মাথায় গ্রিকরার সামনে দিয়া পার্সিয়ানরার ছুটে যাওয়া, বা ছোট সাগর সালামানিয়ানে গ্যালি-নৌকায় গ্যালি-নৌকায় পিতলের গুলুইগুলার টক্কর লাগা। রুপার খড়ি বা কয়লা দিয়া চামড়া বা দেবদারু কাঠের উপ্রে আঁকতো। হালকা সাদা আর গোলাপি রঙের টেরাকোটার উপ্রে মোম দিয়া আঁকতো, জলপাইয়ের রস দিয়া মোমরে গলায়ে আর গরম লোহার সেঁকা দিয়া মোমটারে আবার জমায়ে আঁকতো। তার তুলির পোচগুলা পেনেল, মার্বেল আর লিলেন ক্যানভাসের উপ্রে দিয়া চইলা যাইতে যাইতে সেগুলারে মনকাড়া করে তুলতো; আর জীবন নিজের আপন ছবি দেখে, থমকায়ে যাইতো, রা করার সাহস করতো না। সমস্ত জিন্দেগী, সত্যিই, তার আছিলো, বাজারে বসে থাকা ব্যাপারী থেকে ধরে টিলার উপ্রে চাদ্দর মুড়ি দিয়া শুইয়া থাকা রাখালটা; তেজপাতা গাছের ঝোপে লুকায়ে থাকা নিম্ফ আর দুপুরে বাঁশি বাজানো ফন থেকে নিয়া, দাসরা তাদের তেল চকচকা কাঁধের উপ্রে লম্বা লম্বা সবুজ পর্দাঘেরা পালকিতে করে ময়ুরের পালকের পাংখার বাও দিতে দিতে বয়া নেওয়া রাজা পর্যন্ত সব তার আছিলো। বেটা মানুষ আর বেটি মানুষ, মুখের উপ্রে খুশি বা কষ্ট নিয়া তার সামনে দিয়া চলে যাইতো। সে তাদের দেখতো, আর তাদের গোপন কথাগুলা তার হইয়া যাইতো। ছুরত আর রং দিয়া সে আবার একটা দুনিয়া বানাইতো।
সব রকমের হাতের আর্টেও তার মালিকানা আছিলো। সে ঘুরতে থাকা শানপাত্থরের উপ্রে জওহরটা ধরতো, আর পদ্মনীলাটা এডনিসের বেগুনী পালঙ্ক হইয়া উঠতো, আর গোমেদ পাথরের সাদা আর লালের পরতগুলার ভিত্রে দিয়া আর্টেমিস তার কুত্তার পাল নিয়া দৌড়ায়ে যাইতো। সে স্বর্ণরে পিটায়ে গোলাপ বানাইতো, তারপর গোলাপগুলারে গেঁথে গেঁথে হার বা বাজুবন্ধ। সে স্বর্ণরে পিটায়ে পিটায়ে দিগ্বীজয়ীর মুকুটের জন্য মালা বানাইতো, টিরিয়ান রোবের পামেট বানাইতো, বা রাজবাড়ির মড়ার জন্য মুখোস বানাইতো। রুপার আয়নাটার পিছনে সে নেরেডদের উপ্রে চড়া থেটিসরে খোদাই করতো, অথবা প্রেমে জরজর ফেড্রা আর তার দাসীরে, অথবা পার্সিফোনরে, স্মৃতির জ্বালায় ত্যক্ত, চুলের খোপায় আফিং ফুল গুঁজতেছে। কুমার তার ছাউনির তলে বইতো, আর, নিরব চাকাটা থেইক্যা ফুলের মত করে, গামলাটা তার হাতের নিচে গড়ে উঠতো। গামলার তলাটারে, গলা আর হাতল দুইটারে, সাজাইতো মিষ্টি জলপাইয়ের অথবা কচি অ্যাকান্থাসের পাতা অথবা চোখা চোখা ঢেউ দিয়া। তারপর কালা বা লাল কালিতে পোলাপানের কুস্তি খেলা আঁকতো, অথবা দৌড় খেলা; আজিব সব হেরাল্ডিক ঢাল আর রোদ আটকানের ভিজর-অলা মাথা থেকে পাও পর্যন্ত যুদ্ধের আবরণ পরা নাইট আঁকতো, ঝিনুকের মত রথ থেকে দুই পা উঠানো ঘোড়াগুলার উপর ঝাপায়ে পড়তেছে: আঁকতো বিরাট আয়োজনে খাইতে বসা বা কেরামতি দেখায়তে থাকা দেবতা: আর বিজয় বা বেদনায় কাতরাইতে থাকা নায়ক। মাঝে মাঝে সাদা জমিনে সিন্দুরের দাগ দিয়া দিয়া আঁকতো কাহিল হইয়া আসা জামাই আর তার বৌ, দুই জনরে ঘিরা কামদেব ঘুরঘুর করতেছে— আর আঁকতো কামদেবরে, দোনাতেলোর দেবদূতের মত করে, সোনা দিয়া গিল্টি করা বা আকাশের মত নীল পাখনাঅলা, হাসি মুখে। গামলার বাঁকা জায়গাটাতে তার বন্ধুর নাম লেখতো। ΚΑΛΟΣ ΑΛΚΙΒΙΑΔΗΣ৪ {সুন্দর আলকিবিয়াদেস} বা ΚΑΛΟΣ ΧΑΡΜΙΔΗΣ৫ {সুন্দর খার্মিদিস} তার আমলের গল্পগুলা আমরারে বাখানে। তারপর আবার, চ্যাপটা কাপের ছড়ানো কান্ধার উপ্রে সে ঘুরাফিরা করতে থাকা মাদা হরিণ আঁকতো, অথবা ঘুমায়তে থাকা সিংহ, তার কল্পনা যেমনটা চাইতো। পিচ্চি আতরের বোতলটার গায়ে আফ্রোদিতি তার সাজার ঘরে বসে হাসতো, আর, উদাম গায়ের মেনাডদের সারি নিয়া আঙ্গুরের রসে ভেজা পাওয়ে ডায়নিসাস ওয়াইন-বোতল ঘিরা নাচতো, আরেক দিকে, মশকরার ঢঙে, ফোলা ফোলা মশকের উপ্রে বুড়া সিলেনাস শরীর এলায়ে পড়ে থাকতো, অথবা জাদুর বল্লমটা নাড়াইতো যেইটার আগাটা দেওদার আর আইভি লতার নকশায় পেচানো ছিলো। আর আর্টিস্টরে কাজের মধ্যে রান্দা করার মত কেউ আছিলো না। কোনো দায়সারা বাজে বকা তারে ডিস্টার্ব করে নাই। মতামতের ভয় তার আছিলো না। ইলিসাসের৬ {এথেন্সের একটা ছোট্ট নদী, প্লাতোর ডায়ালগের শান্ত সেটিংয়ে এই নদীর পারের কথা আছে। নদীটার সাথে ফিলোসফিকাল আলাপের একটা যোগাযোগ আছে।} কসম, আর্নল্ড কোনো এক জায়গায় কইছিলো, তখন হিগিনবথাম বলতে কিছু আছিলো না। ইলিসাসেস কসম, গিলবার্ট দোস্ত আমার, তখন কোনো আজাইরা আর্ট-কংগ্রেস আছিলো না, যেইটা প্রদেশে প্রদেশে প্রাদেশিকতা ছড়াইতো আর সস্তামিরে কথা কওয়া শিখাইতো। ইলিসাসের কসম আর্ট বিষয়ে কোনো মাথা খায়া ফালানো মেগাজিন আছিলো না, যেইটার মধ্যে মেহনতিরা, তারা যা বুঝে নাই তা নিয়া বকবক করতো। ওই ছোট্ট গড়ানটার নল-খাগড়ার ঝোপে ছাওয়া দুই পাড়ে কোনো হাইস্যকর জার্নালিজম দেমাগ দেখায়ে এক চেটিয়া জাজের আসন দখল করে নাই, যাদের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়ে মাফ চাওয়া উচিত আছলো। গ্রিকরার কোনো আর্ট-ক্রিটিক আছিলো না। Continue reading →