সৈয়দ আলী আহসান: আমার সাক্ষ্য – “আরবী হরফে বাংলা লিখবার প্রস্তাব” নিয়া Featured

১৯৯৪ সালে সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২ – ২০০২) “আমার সাক্ষ্য” নামে একটা বই লেখেন, উনার নামে চালু থাকা নানান ক্রিটিক ও অভিযোগের জায়গায় নিজের পারসপেক্টিভ তুইলা ধরেন
তো, অবভিয়াসলি এইগুলা কোন ভেরিফাইড হিস্ট্রিকাল ট্রুথ না, কিনতু একইসাথে হিস্ট্রিকাল ইভেন্টগুলাতে এনগেইজ থাকা একজন মানুশের বয়ান, যেইটা হিস্ট্রিকাল রেফারেন্স হিসাবে ফুল-প্রুফ ঘটনা না হইলেও একটা রেফারেন্সিয়াল পয়েন্ট, যেই কারনে উনার কথাগুলা সারফেইস লেভেলে থাকা, যাচাই কইরা দেখাটা হিস্ট্রির একটা কাজ
আরেকটা ঘটনা হইতেছে, পাকিস্তান আমলের বেশিরভাগ ঘটনাই আমাদের আলাপে এখনো ট্যাবু হয়া আছে যেন এইগুলা নিয়া কথা বলা যাবে না! কিনতু বাংলাদেশের হিস্ট্রি জানতে ও বুঝতে হইলে তো ইমিডিয়েট পাস্টের দিকেই তো আমাদেরকে তাকাইতে হবে সবচে আগে…
তোো এই জিনিসটা আমরা অনেকেই জানি যে, বাংলা হরফ চেইঞ্জ করার একটা কথা পাকিস্তান আমলে সরকারি-জায়গা থিকা উঠছিল, তো ঘটনাটা কি রকম ছিল – তার একটা ব্যাখ্যা রাখছেন সৈয়দ আলী আহসান, উনার বই থিকা সেই অংশটা ছাপাইতেছি আমরা এইখানে
…
লিপি বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে
…এখন আমরা হরফ পরিবর্তনের কথা বলি না। ভাষা পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না। তবু পাকিস্তানে এই পরিবর্তনের প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু তা কখনই কোন আন্দোলনে রূপ নেয়নি। যাঁরা পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন, তাঁরা ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা এবং সেক্ষেত্রে সরকার পক্ষের সকলেই যে পরিবর্তনের কথা বলছিলেন তা-ও নয়। আমি এখানে ভাষার কথাটা বলব না। লিপি সংক্রান্ত উদ্ভট প্রস্তাবনার কথাই তুলব।
তৎকালীন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে আরবী লিপি প্রচলিত ছিল। সিন্ধী এবং উর্দু দুই-ই লিখিত হত আরবী বা ফারসী হরফে। পশতুও লিখিত হত আরবী হরফে। লোকভাষা হিসেবে পাঞ্জাবে কোন নির্দিষ্ট লিপি ছিল না। শিখরা গুরুমুখী হরফে পাঞ্জাবী লিখতেন এবং মুসলমান ফারসী হরফে। এক কথায়, পশ্চিম পাকিস্তানের সব ক’টি ভাষার জন্য একটি মাত্র বর্ণমালা ছিল এবং তা ছিল আরবী। সমগ্র পাকিস্তানের জন্য তখন ছিল-বাংলা ভাষার জন্য বাংলা হরফ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষার জন্য আরবী হরফ। এই হরফের পরিবর্তনের কথা সরকারীভাবে কখনও নির্দেশিত হয়নি। এ নিয়ে শুধু সরকারীভাবে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়েছিল।
এই আলোচনাটির সূত্রপাত করেছিলেন মরহুম ফজলুর রহমান। তিনি ঢাকার অধিবাসী ছিলেন, কোন ভাষায় তাঁর ভাল দখল ছিল না। এহেন ব্যক্তি আরবী হরফে বাংলা লিখবার একটি প্রস্তাব করেন। ফজলুর রহমান তখন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৯৪৮ সালের জুন কি জুলাই মাসে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ঢাকায় তাঁর বন্ধু মওলা মিয়ার বাসায় অবস্থান করেন। সেখানে একদিন তিনি আলোচনা বৈঠকের আয়োজন করেন। আলোচনায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হর্তেন: ফজলে আহমদ করিম ফজলী-তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব, ওসমান গণী-তিনি ছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, কবি জসীমউদ্দীন এবং আমি। সভায় পাকিস্তানের তথ্য দফতরের একজন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রামের হুরুফুল কোরআন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এক বৃদ্ধ মৌলভী সাহেবও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমরা জানতাম না, কেন আমাদের ডাকা হয়েছে। আলোচনার সূত্রপাতে ফজলুর রহমান সাহেব সভা আহবানের কারণ ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, ‘প্রচুর রক্তপাতের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তান পেয়েছি, এই পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখা এবং বিপদ থেকে মুক্ত রাখা আমাদের কর্তব্য। যেহেতু ভারতবর্ষ থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি, সুতরাং ভারতের কাজ পাকিস্তানকে গ্রাস করা। পশ্চিম পাকিস্তান যেহেতু একটি বিরাট অঞ্চল তাই সেদিকে তাদের দৃষ্টি পড়বে না, তাদের দৃষ্টি পড়বে পূর্ব পাকিস্তানের উপর। তারা যে সৈন্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান দখল করবে তা নয়, তারা নিজেদের সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং সমাজের প্রভাব বলয়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে আনবার চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে বাংলাভাষা তাদেরকে বিরাট সাহায্য করবে। পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা, আমাদের ভাষাও বাংলা। এই বাংলা ভাষার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ যত সহজে সম্ভবপর, অন্য কিছুতে তা সম্ভব নয়। আমাদের ভিন্ন ভাষা হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু ভাষা যেহেতু অভিন্ন, সুতরাং ভাষার প্রকৃতি যদি আমরা পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে অতি সহজে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিমবঙ্গের কবল থেকে রক্ষা করতে পারব। সেই জন্য আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আমাদের বাংলা ভাষার লিখন পদ্ধতির আমরা পরিবর্তন ঘটাব। এই পরিবর্তন ঠিক মত করতে পারলে আমাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। আমি সেজন্য বাংলা ভাষার জন্য আরবী বর্ণমালার প্রবর্তন করতে চাই।’
আমরা ফজলুর রহমানের এই বক্তৃতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। প্রস্তারের অসারতা এবং অবাস্তবতা এত প্রকট ছিল যে, আমরা সকলেই কিছুক্ষণ পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে বসেছিলাম। আমাদের চুপ করে থাকতে দেখে ফজলুর রহমান সাহেব চট্টগ্রামের হুরুফুল কোরআন সমিতির মৌলভী সাহেবকে আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন। মৌলভী সাহেব আরবী হরফে ছাপা একটি বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা আমাদের সামনে পেশ করলেন। তিনি বললেন যে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই পত্রিকাটিকে চালিয়ে আসছেন। বিভিন্ন মাদ্রাসায় এই পত্রিকার অনেক পাঠক আছে। মৌলভী সাহেবের পর ফজলুর রহমান সাহেব একটি তথ্য পেশ করলেন যে, এক সময় নাকি আরবী হরফে বাংলা লিখিত হত। কিছু পুরনো বাংলা পুঁথি পাওয়া গেছে যেগুলো আরবী হরফে লিখিত হয়েছে। Continue reading