ব্রিটিশ বাংলায় গরু জবাইয়ের রাজনীতি (পার্ট ১) Featured

ব্রিটিশ আমলে মুসলমানদের গরু কোরবানি এবং হিন্দু জমিদারদের প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ ভারতে গরু নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিতর্কের সূত্রপাত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। সূত্রপাতের সূচনা হিন্দু জমিদারদের মাধ্যমে। জমিদারি ব্যবস্থায় প্রজা জমিদারের হুকুম মানতে একপ্রকার বাধ্যই ছিল। যদি জমিদারের হুকুম বে-আইনি হয় তাহলে প্রজা আইনের আশ্রয় নিতে পারতো। কিন্তু আইন কি আইনের গতিতেই চলে? ঔপনিবেশিক শাসনামলে ইংরেজের তৈরি আইনের সুশাসন/সুফল ভোগ করা কি অর্থবিত্ত আর ক্ষমতা ছাড়া সম্ভব ছিল? স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজ সরকার ও তার কর্মচারী প্রাধান্য দিবে জমিদারকে। এবং তাই হয়েছিল। একজন প্রজার পক্ষে জমিদারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা রীতিমতো অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। কারণ, একজন স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এই বোধটুকু ছিল যে, জমিদারের অর্থবিত্ত আর ক্ষমতার কাছে আইন মামুলি ব্যাপার। মাঝখান দিয়ে টাকা-পয়সা আর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের বেহুদা খরচ!
জমিদার আর প্রজার দুয়েকটা কেস যে ইংরেজের দরবারে হাজির হয় নাই, তা না। তার রায়/মীমাংসা হয়েছিল কিভাবে তা দেখাতে, নজির হিসেবে দুয়েকটা কেস পরবর্তীতে পেশ করবো আমরা।
১৮৮৭ সালে মোম্বাইতে অনুষ্ঠিত হয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন। সদস্য হিসেবে অধিবেশনে যোগ দেন রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার শশিশেখর রায়। সেখানে তিনি গরু জবাইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব নাকচ হয়। বলা হয়, এই মুহূর্তে এই প্রস্তাব পাশ করলে তা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যাবে এবং তখন কংগ্রেসের মুসলিম স্বার্থবিরোধী একটি ভাবমূর্তি দাঁড়াবে যা কংগ্রেসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ক্ষতিকর। প্রস্তাব নাকচ হলেও,মুসলমানদের গরু-জবাই ইস্যুতে জমিদারের মনোভাব পরিষ্কার হয়েছিল সেই অধিবেশনে। যে জমিদার এমন প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে তার জমিদারির ত্রিসীমানায় যে মুসলমানরা নিরাপদে গরু জবাইয়ের স্বাধীনতা পাবে না তা হলফ করেই বলা যায়।
রাজশাহীর কেবল শশিশেখর নয়, অন্যান্য জমিদারদের অঞ্চলেও ছিল একই চিত্র। The Moslem Chronicle পত্রিকায় ১৭ মার্চ ১৮৯৫ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, রাজশাহীর খোকসার অন্তর্ভুক্ত পানানগর ও অন্যান্য গ্রামের মুসলমানদের সাথে গরু জবাইয়ের কারণে দুর্ব্যবহার করা হয়। এবং কমিশনারের রিপোর্টের রেফারেন্স উল্লেখ করে বলা হয়, মুসলমান প্রজাদের গরু জবাই এবং গোশত খাওয়ার ব্যাপারে জমিদাররা সরাসরি হস্তক্ষেপ করে।
The Moslem Chronicle পত্রিকার ২০ মে ১৮৯৫ সংখ্যায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ময়মনসিংহের অম্বরিয়া, মুক্তাগাছা ও সন্তোষের জমিদারগণ কয়েকজন গ্রামবাসীকে গরু জবাইয়ের জন্য জরিমানা করেছিলেন। ময়মনসিংহে জমিদারের হস্তক্ষেপের ফলে গরু জবাইয়ের অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কথা জানা যায় আবুল মনসুর আহমদের জবানেও। তিনি লিখেছেন: “বক্রা ঈদে গরু কোরবানি কেউ করিত না। কারণ জমিদারের তরফ হইতে উহা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল। খাশি-বকরি কোরবানি করা চলিত। লোকেরা করিতও তা প্রচুর।” আবুল মনসুর আহমদের জন্ম ১৮৯৮ সালে। শৈশব থেকে সাবালক হওয়া অবধি— ১৯১০-২০ সালের দিকেও— ময়মনসিংহের একই চিত্র ছিল। অর্থাৎ, ১৮৯৫ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের হেরফের পরবর্তী বিশ-ত্রিশ বছরেও হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং আবুল মনসুর আহমদের সাক্ষ্য থেকে বলা যায়, ময়মনসিংহে মুসলমানদের গরু জবাই এবং গোশত খাওয়ার উপর জমিদারদের নিষেধাজ্ঞা উনিশ শতকের শেষদিক থেকেই বলবৎ ছিল।
Continue reading