ক্বারী আমির উদ্দিন ও মুর্শিদ-কাহিনী Featured

আসরের নামাজ পইড়া, মুগরিবের নামাজের আগ পর্যন্ত, আমি গ্রামের রাস্তায় হাইটা হাইটা সময় পার করতাম। কোমরের পিছনে হাতরে রুজু কইরা, ধীরে ধীরে হাটতাম। গাছপালার দিকে চাইতাম। এইরকম একদিন, আমরার গ্রামের মুজিব ভাইছাব আমারে কইলেন- ‘এহ, তুই দেকি আমির উদ্দিনর লাখান ছাইরে। বাটে লাগের অনকু গান গান্ধিলিবে!’ মুজিব ভাইছাবে আরো কইলা, উনি যখন বগলা ধরতে আমির উদ্দিনের গ্রাম আলম পুরের দিকে যাইতেন, তখন আমির সাবরে মাঝে মাঝে ট্যারা চউখে এইভাবে চাইতে দেখতেন।
আমির সাবের বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছেই। উনার গ্রাম হইতে বিয়া বইয়া আইছিলেন আমার এক দাদি। সেই দাদির এক ছেলেও বিয়া করছিলেন এই গ্রামে। ছোট থাকতে আমি একবার এই চাচীর বাড়িতে গেছলাম। খালারা আমারে এত আপন করছিলেন, কয়েক ঘন্টার লাইগা, এত মায়া করছিলেন, যে মনে পড়তেছে, আমার মাথার উকুন পর্যন্ত বাইছা দিছিলেন উনারা! আমার শরম করতেছিল পরে, এই ভাইবা যে, কি এক কারণে, খালাদের একজনরে এর আগে আমাদের বাড়িতে আমি একটা থাবা মাইরা ফেলছিলাম। উনি এই রাগ রাখেন নাই!
আলম পুর এইরকম একটা উর্বর জায়গা। যেইখানে মানুষের চাষ হয়। মনের চাষ হয়। উনাদের বাড়ি আমাদের এত কাছে, তবুও, কিছু দূরে বটে! কারণ, উনারা ‘ফ’ রে ‘হ’’ বলেন। যেমন, ফাইঞ্জাবীরে কন হাইঞ্জাবী। ফেখরে বলেন হেখ। (আমরা সিলেটিরা ‘প’রে নরমালি ফ কই। মানে, ফাইঞ্জাবী হইল পাঞ্জাবী।) উনাদের গ্রামীন স্বভাব আরেকটু ভিজা, আদ্র।
মাস্টারিকালে, আমার অনেক ছাত্র আছিল এই গ্রামের। ক্লাস সেভেনের মেয়েদের বাংলা পড়াইতাম আমি। পড়ানির পাশাপাশি, এই ক্লাসে গান-টান, আবৃত্তি-টাবৃত্তিও করাইতাম। আলম পুরের এক মেয়ে, ক্লাস সেভেনের, কি একটা উপলক্ষ্যে আমারে কইল, ‘খরিম বেটার গান’। এই কথাখান শুইনা আমার ধাতস্থ হইতে বেশ সময় লাগল। মেয়েটা বাউল আব্দুল করিমের গানের কথা কইতেছে। কিন্তুক, করিমরে ‘বেটা’ কইতেছে। বাংলাভাষীদেরকে বেপারটা বুঝানো খুবই কষ্টের হইবে। কারণ, আমরা সিলেটিরা অনেক সময় পরিচিত, আপন-প্রায় মানুষদেরকে ‘বেটা’ বলি। আর, অপরিচিত বুঝাইতেও বেটা কই! এই ছোট্র মেয়েটা আব্দুল করিমরে ‘খরিম বেটা’ কইতেছে। তার মানে, তাদের গ্রামে/পরিবেশে বাউল আব্দুল করিম একটা ঘরোয়া ঘটনা!
ফকির ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেব এই গ্রামের সন্তান। উনার এক (নাকি দুই?) ছেলে মাদ্রাসায় পড়ত। আমির সাহেবের লগে রিকশায় চইড়া তারা মাদ্রাসায় যাইত। আমার চাচাত ভাইয়ের লগে, আমিও মাদরেসায় যাইতাম। উনি আমারে আংগুল দিয়া দেখাইয়া কইতেন, ‘অউ রিশকাত যাইরা আমির উদ্দিন..’
আমরার মাদরেসাত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান হইত। আলম পুরেরই এক ছেলে, আমার ক্লাসমেইট। জসীম উদ্দিন নাম। একটা সংগীত গাইত। ‘আরে ও মদীনা যানে ওয়ালা…’ এই গান যখন সে গাইত, তখন সবকিছু নিরব হইয়া যাইত। অবশ্য, এই গানের কর্তা কে, তখন জানতাম না। Continue reading