অন হুমায়ূন নন্যাকাডেমিক
বিষয় যা-ই হোক, জাহেদ আহমদ-এর গদ্যে তাঁর শব্দগুলা একে অন্যের সাথে যেই রকমের ঝগড়া-লিপ্ত অবস্থায় থাকে সেইটা এখন পর্যন্ত সবচে র ফরম্যাটে ভাবনারে হাজির রাখার একটা পদ্ধতি হিসাবে ভাবা যাইতে পারে; একইভাবে শব্দগুলা তাদের সাহিত্যিক উত্তরাধিকারের সাথে প্রণয়-সুলভ বন্ধুত্বের ভিতর দিয়া এক ধরণের ডিপার্চারের দিকে আগুয়ান অবস্থায় আছে বইলাই মনে হয়। মানে, শব্দ-ভাষা-ভাবনার ধাঁধা’রে গ্লোরিফাই করার একটা চেষ্টার চাইতে প্রক্রিয়াটারে মোর স্পষ্ট করার চিহ্ন হিসাবেই তাঁর গদ্যরে পড়ার প্রস্তাব করা যাইতে পারে। – ইমরুল হাসান।
_____________________________________________
তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই আমাদের কৈশোরের ম্যাজিশিয়ান। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ দেহ রাখলেন ১৯ জুলাই ২০১২ খ্রিস্টাব্দে। ষাটোর্ধ্ব বয়সে তাঁর এই প্রস্থানদৃশ্য, কোথাও যেন তবু খুব হাহাকারের মতো, ‘বড় বেদনার মতো’ চোখে ভেসে এল নওল পাঠক হিশেবে সেই দিনগুলোতে একাদিক্রমে হুমায়ূনপ্রণীত কাহিনি পাঠকালীন আমাদের ঝাপসা-প্রায় স্মৃতি। কিংবা ঝাপসাও নয় ঠিক, জ্বলজ্বলে, হীরেদ্যুতিকীর্ণ। ছোট্ট করে বলে রাখি এখানে যে, আর-দশপনেরো জনপ্রিয় পথুয়া সাহিত্যিকের সঙ্গে হুমায়ূনের তফাৎ ও তাৎপর্য স্পষ্ট ছিল সবসময়। সেই স্পষ্ট তফাৎ ও তাৎপর্যটুকু তো অবগুণ্ঠিত, অগোচরে রয়ে গেল আমাদের আজও। কোনো সমালোচক, কোনো আলোচনাশাসক, আজোবধি এই দিকটাতে দৃষ্টি দিলেন না। তারা তা দেবেন বলেও ভরসা পাই না। তাঁর কোনো সমালোচক ছিলও না প্রকৃত প্রস্তাবে, ছিল একঢল স্তাবক ও নিন্দুক শুধু। তিনি নিজেও তো দায়ী ছিলেন এই পরিস্থিতির জন্য, হুমায়ূনের দিনযাপনচিত্র তো আমরা মিডিয়াবাহিত দেখে আসছি ইন-ডিটেইলস গত দুইদশক ধরে, অনুমান করতে বেগ হয় না যে তিনি বিদূষকবেষ্টনী প্রেফার করতেন। হয়তো দরকারও ছিল এসবের, এই বিদূষকবেষ্টিত থাকবার, নইলে এখানে চামচিকে ঠেকাতে যেয়ে স্ট্যামিনা খোয়াতে হতো তাঁরে। যেন অনেকটা আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী অবস্থা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। তাঁর প্রস্থানোত্তর সর্বত্র হুমায়ূনবন্দনা আর হুমায়ূনশোক প্রমাণ করে যে, এই ক্ষুদ্রঋণজর্জর সজোরে-গরিব-করে-রাখা দেশের সাক্ষর-অনক্ষর নির্বিশেষ মানুষেরা বাংলাসাহিত্য কতটা ভালোবাসে। হুমায়ূনহীন পৃথিবীর প্রথম হপ্তাদশদিন জুড়ে বাংলাদেশের সর্ববিধ গণমাধ্যম ছিল হুমায়ূনময়। এইটা আদৌ অভাবিত ও অস্বাভাবিক ছিল না তাঁর ক্ষেত্রে, একটা জাতিকে একটানা তিরিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে নাক্ষত্রিক আনন্দে-বেদনায় ভরিয়ে রেখেছিলেন যিনি। কিন্তু বক্ষ্যমাণ এই নিবন্ধ কোনোভাবেই লিট্যারারি ক্রিটিক নয় হুমায়ূনরচনাশৈলীর, সেই ক্রিটিক নিশ্চয় হবে একদিন। এই রচনার অভিপ্রায় বরং, বলা যায়, সেলিব্রেটিং লাইফ উইথ হুমায়ূন আহমেদ।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
ঋজুস্কন্ধ হ, হ্রস্বউকার, দীর্ঘউকার, একার ও হুমায়ূন আহমেদ
খুব রেগে যেতেন হুমায়ূন আহমেদ এই নিবন্ধশিরোনাম দেখে। না, তাঁকে নাম ধরে ডেকে যে প্রাচ্যীয় তমিজ ও আদবের খেলাপ করেছি, সেজন্যে নয়। রেগে যেতেন তাঁর নামের ঘাড়-ভেঙে-দেওয়া দশা দেখে। এইটা আজ প্রায় সকলেই জানেন যে, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নামের আদ্যবর্ণে হ্রস্ব-উকার লিখতেন আলগা করে হ বর্ণের নিচে। এ নিয়ে খুব খুঁতখুঁতানি ছিল তাঁর। শুরুর দিককার দিনগুলোতে লেখকের বই যখন মহাপরাক্রমী প্রকাশকরা ছাপছিলেন, এই ব্যাপারটা তারা আমল দিতেন না অত। উঠতি বয়সী দুই-কলম লিখুয়াদের এত বায়নাক্কা শুনে তো আর সাহিত্যবুজুর্গ প্রকাশকদের চলে না। তারা নিশ্চয় ভাবতেন যে, লেখকের শৌখিন লিখনেচ্ছার আয়ু আর কয়দিন! হুমায়ূন আহমেদের লিখনেচ্ছা বাড়তেই থাকে, এবং বহাল থাকে নাম নিয়ে তাঁর খুঁতখুঁতানিও। উকার হ বর্ণতলায় বসলে যা, গায়ে গায়ে মিশে গেলেও তা। আনিসুজ্জামানের জন্য যা যুক্তি, স্রষ্টা হুমায়ূনের জন্য তা বিরক্তি তো হতেই পারে। কেননা আনিসুজ্জামান বোঝেন ব্যাকরণ, হুমায়ূন বোঝেন নন্দন। সৌন্দর্যস্রষ্টাকে তো বর্ণশিক্ষা দিতে যাওয়া আস্পদ্দা সমতুল। অবশ্যই তাই। পরবর্তীকালে হুমায়ূন আহমেদ এই ব্যাপারটি বাংলাসাহিত্যের বুজুর্গ প্রকাশকদের বুঝিয়ে দেন। প্রকাশকদের সঙ্গে বার্গেইন শুরু করার সামর্থ্য অর্জন করেন দ্রুত। ফলে এই প্রথমবার প্রকাশক মশাইয়েরা বুঝতে শুরু করেন প্রকাশনাশিল্পের প্রাণ সবসময় লেখক, পা ও চলাফেরায়-সহায়ক আরও কিছু প্রত্যঙ্গের কাজ করেন প্রকাশক বড়জোর। দৌরাত্ম্য ও অযথা দাপট কমলো ভজকট প্রকাশকদের। এমন একটা সময় এসেছে এরপর, যখন বছরের পর বছর হুমায়ূন আহমেদকে প্রকাশনাপাড়ায় যেতে হয়নি, খোদ প্রকাশনাপাড়াটাই দিনরাত হুমায়ূনের বাড়ির সামনে দিয়া সাইকেলের বেল বাজাইয়া দুরুদুরু বুকে ঘোরাফেরা করত, যদি ইশারায় যেতে বলেন দয়াপরবশ হয়ে ভেতরবাড়িতে বাংলার কাহিনিকুমার, যদি তিনপাতা দৈর্ঘ্যের একটা মথগল্পও মেলে তো ওই দিয়া গ্রাফিকমিস্তরির কারিকুরির আশ্রয় লইয়া বই একখান বাইর করতে পারলেই জীবন দালানকোঠা। আসলেই তাই। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের কিছু খুঁতখুঁতানি নিয়া সকল প্রকাশককেই হোমওয়ার্ক করে যেতে হতো। তন্মধ্যে একটা হলো, হুমায়ূন নামলিখনকালে কোথাও ‘হু’ বসানো যাবে না, হ্রস্বউকার ( ু ) ‘হ’ বর্ণ থেকে আলগ ঝুলে রইবে নিচের দিকে। এবং ‘হ’ বর্ণ হবে ছিমছাম, বেচারার কাঁধ কুঁজো করে দেয়া যাবে না। তথাস্তু, প্রকাশকদের ভুল হয় নাই বাকি জিন্দেগি। কিন্তু তবু পত্রিকানায়কদের হাতে তো রোজই হুমায়ূন নামটা আদরাহ্লাদ ও কুর্নিশ-কদমবুসি পেত, তখন কোনো গোঁফ-না-গজা কালকের সকালের বা আজকের অপরাহ্নের কোনো সম্পাদকের দৈনিকে এই নিষেধাজ্ঞাধীন কাণ্ডটা হামেশা ঘটত। এবং হুমায়ূন খুব রিয়েক্ট করতেন চোখে পড়লেই। সহচরদের কাছে স্বভাবসুলভ সকৌতুক উষ্মা প্রকাশ করতেন। তবু খুচরো দুইচাইরটা ভুলভাল বাদ দিলে বলা যায়, হুমায়ূন তাঁর নাম নির্ভুলভাবে বাংলাসাহিত্যের পাঠক-দর্শক-লেখক-প্রকাশক-সম্পাদক-চলচ্চিত্রক-সমালোচক-স্থিরচিত্রগ্রাহক-বিজ্ঞাপনপ্রদায়ক-পৃষ্ঠপোষক-শিল্পপরামর্শক সকলের কাছে সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন এবং তাঁর ভাষায় ঘাড়ভাঙা হালত হইতে তিনি রেহাই পেয়েছিলেন। না, ঘাড়ভাঙা ‘হ’ ফিরে এসেছে আবার। অনলাইন প্রকাশনাগুলোতে যত লেখা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে, সর্বত্র হুমায়ূন আহমেদের ঘাড়ভাঙা কাঁচুমুচু-কুঁজো দশা লক্ষ করা যাবে। ব্যাপারটা কি অনবধানবশত, না প্রাযুক্তিক অপারগতা? মানে, অনলাইনে টাইপ/ফন্টসাপোর্ট মিলছে না হুমায়ূনাভিপ্রায় রক্ষাকল্পে? এ-ব্যাপারে এই নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত গোস্তাকি স্বীকারপূর্বক কৈফিয়ৎ এ-ই যে, বেচারা নাচার বাছুর, উপায়ান্তরহারা। কারণ, বাংলা টাইপে বাংলা লিখনচর্চার ইতিহাস তার, মানে এই নিবন্ধকের, কুল্লে কড়ে-গণনীয় কয়েকটা মাস। ফলে সবকিছু সড়গড় হতে স্লো-লার্নার তার আরও থোড়া টাইম লাগবে। কিন্তু অনলাইনারদের তো অত লম্বা টাইম লাগার কথা না। তা, কী জানি ভাই। প্রিয় হুমায়ূন আহমেদের কাছে এই বাবদে সকলের হয়ে করজোড়ে ক্ষমা চাই।
হুমায়ূনের নাম-স্পেলিং শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বাঙালির জনজীবনেও যে কী ব্যাপক প্রভাব রেখেছে সেই গল্পও সংক্ষেপে সেরে লই। তাঁর নামের শেষখণ্ড বঙ্গজ মুসলমানের কমন নাউনগুলোর অন্যতম। হুমায়ূন অত্র পলিদ্বীপে আগমনের আগে কেউ লিখত আহম্মদ, কেউ লিখত আহমদ, সম্প্রতি কেউ কেউ লিখতে শুরু করেছে আহমাদ । সবচে সাধারণ ব্যবহার ছিল একার-আকার-যুক্তবর্ণহীন আহমদ রূপটি। কিন্তু বর্তমানে হেন পদবীর সব নামরূপকাঠামোকেই হুমায়ূনপ্রভাবে প্রতিদিন পর্যুদস্ত হতে হয়। এবং সবাইকেই পড়তে হয় একার-বিড়ম্বনায়। এই তিনপাত্তি নিবন্ধকারের এ-বাবদে বিড়ম্বনার শেষ নাই। লক্ষণীয় যে, একজন লেখক এমনকি তাঁর নামের বানান দিয়েও একটা জাতির দৈনন্দিনতাকে কেমন প্রভাবিত ও গ্রাস করে ফেলতে পারেন। স্মর্তব্য, বাংলাদেশে দিবারাত্রি প্রধানকবি শামসুর রাহমান এক্ষেত্রে ব্যর্থ। তাঁর, শামসুর রাহমানের, নামের টাইটেলাংশ বঙ্গবাসী কিন্তুক গ্রহণ করে নাই। ইনস্যাপারেবল পদবীর অনেক সহকর্মী রয়েছেন আপনার-আমার, তারা প্রত্যেকেই নিরাকার, আজতক এই পদবীধারক একজনও পাই নাই যিনি সাকার ‘র’ নিয়া হাঁটাচলা করিছেন। সকলেই রহমানরূপে আবহমান, একজন আছেন ভুবনধন্য উর্দু-ইংলিশ সংলাপকেন্দ্রী একারযুক্ত রেহমান, সর্বসত্তার উপর প্রভূত রহম বর্ষিত হউক। তবে, এইসব ফাইন্ডিংস বাঙালিজীবনে কোনো কাজে লাগবে না, তা ঠিক, তবে এরচেয়েও অনর্থক ভোঁতা আবিষ্কার দিয়া এই দেশে ঢেঁড়শের চেয়েও অধিক হারে পিয়েচডিপিৎলাঘুঘুদের ফলন স্বজাতি নিরখিয়া আসিছে জন্মাবধি, ভরসা সেইখানেই, এই নিবন্ধকও তো পেতে পারে সেই ইংরেজি ওয়ার্ডবুকে শেখা ডানকি শব্দের আদ্যাক্ষর। আশায় বসতি।
কিন্তু হুমায়ূন বিষয়ক এন্তার কথিকা রচনা ও সম্প্রচার শুরু হয়েছে তাঁর প্রস্থানপরবর্তীকালে এবং কথিকাগুলো সমস্তই স্মৃতিচারণিক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই স্মৃতিভিত্তিক হুমায়ূনালোচনা আরও অনেকদিন অব্যাহত রইবে। সেক্ষেত্রে অসুবিধে দেখি না তেমন, বরং ধানভানার আঙিনায় শিবগীত পরিবেশনের এই দেশে সাহিত্যসমালোচনার নামে বেফায়দা হানাহানিহিংসার আর অসার স্তবকীর্তনের বাইরে এই স্মৃতিনির্ভর আলাপন অনেক শোভন ও উপভোগ্য। কথাগুলো বক্ষ্যমাণ রচনার দীনদশা ঢাকবার কোনো সাফাই নয় আদপে। যেহেতু নিবন্ধকারের কৈশোর-ফ্যাসিনেশন এই নামটি, এবং যেহেতু প্রচারমাধ্যম ও প্রোডিউসর-স্পন্সর পাওয়া আজ আর অন্তরায় নয় তেমন দূরীকরণদুরূহ, অতএব এ-লেখা। তা ঠিক ট্রিবিউট নয় লেখাটা, দাবি করা নিশ্চয় অহেতু হবে না, আ কাইন্ড অফ সেলিব্রেশন বলা যাইতে পারে। এইটা সিঙ্গল-এপিসোড না সিক্যুয়াল, টু-বি-কন্টিন্যুড না দ্য এন্ড, রাইট নাও ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না।
আমাদের হুমায়ূন
মানে আমাদের ভাইবোন-কাজিন কলকাকলিত যৌথ উনোনের একান্নবর্তী পারিবারিক হুমায়ূন, আমাদের পাড়াতো বন্ধুদোস্ত ও সহপাঠীদের হুমায়ূন, আমাদের আউটবই পড়াপড়ি ও বিটিভিনাটক দেখাদেখির দিনগুলোর হুমায়ূন। এইধারা আরও কিছু খুচরো কথা ও স্মৃতির বিক্ষেপ নিয়ে গড়ে-ওঠা আমাদের হুমায়ূন, পরিকল্পিত কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন এপিসোডের এই ধারাবাহিক, অথবা আমার হুমায়ূন। খুবই ব্যক্তিগত জগতের হুমায়ূন। ওই যেমন রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-নজরুল নিয়ে লেখা হয়ে থাকে আমার রবীন্দ্রনাথ…আমার জীবনানন্দ…ইত্যাদি, ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের রবীন্দ্রনজরুলজীবন-পড়ুয়া পাঠক-লেখক লিখে থাকেন এইধারা রচনা। আজকাল আমার শঙ্খ, আমার শক্তি, আমার সুনীলও লেখা হচ্ছে—এই সিরিজপ্রবাহক জয় গোস্বামীর চটিপুস্তিকাগুলো পড়েছি। কিন্তু অবিকল ওইরকম তো লিখতে পারব না, পারলে তো খুব কাজের কাজ হতো, গাড়ি কিছুটা ধাক্কাঠেলায় ধুঁকিয়ে ধুঁকিয়ে এলোমেলো গতিতে চলবে। এবং অনিয়মিত। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসই নিয়মিত নয় আমার ও আমাদের জীবিকাযাপনের জান্তব প্রতিক্রিয়া আর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায়, বলে কিনা লেখায় নিয়মানুবর্তিতা! গরিবের আবার রেস্পিরেটোরি সিস্টেম আর ব্লাড সার্কুলেশন!
হুমায়ূনসাহিত্য নিয়া লেখার একটা চালু ও সবচেয়ে এস্টাব্লিশড দস্তুর হলো, প্রথমে ঝেড়ে গালিগালাজ করে নেয়া। না-হলে লেখা হালে তো পানি পাবেই না, পাঠক লেখাটা-যে হুমায়ূনরচনা নিয়া তা বুঝতেই পারবে না। স্বাভাবিক। যে-দেশে ও যে-ক্ষেত্রে যেমন। তবে এই জায়গায় একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা হলো, সময় ও সমাজটা এখন যতটা-না আমার ও আমাদের, তারচেয়ে বেশি আমার ও আমাদের সন্তানদের। আমি যেমন হুমায়ূন পড়ে বেড়ে উঠেছি, তেমনি আমার মেয়ে এখন হুমায়ূন পড়ে এমনকি ক্লাস-এক্সাম ভুলে! আমার মেয়ে মানে, আমার সহকর্মীর মেয়ে, আমাদের ছেলেমেয়েরা। যেমন, ধরা যাক, নুদরাত নাওফা ফিমা। হাইস্কুল পড়ুয়া। নাওয়াখাওয়া আর নানাদেশি আইডল দেখা ভুলে যায় নতুন হুমায়ূন পেলে। কিংবা আমাদের ছেলেদের মধ্যে যেমন প্রতীক বৈদ্য, উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া, পাঁড় হুমায়ূনপাঠক। ফলে, মুশকিলটা এখানেই যে, লেখা জাতে তোলার অনায়াস কৌশল হলো বুঝে-না-বুঝে গিমিক তথা আন্দু বকাবাদ্যি—কিন্তু এসব করে এই নতুনদিনের সন্তানদের সময় ও সমাজে শান্তিতে গৃহবাস হবে না আশঙ্কা করি, তাই ব্রাভো রচয়িতা হওয়ার রাস্তাটা ছেড়ে সহজ মানুষের সহুজে স্মৃতিচারণের লাইন নিলাম। আবার এও ভাবলাম যে, এছাড়া আমার তো কোনো উপায়ও নাই। নিজের গড়নকালটাকে, ছেলেবেলাটাকে, নিজের টুটাফাটা লেখাপড়ার শুরুসময়টাকে তো অস্বীকার করতে পারি না ভায়া! আর-যা-ই-হোক, কৈশোর-তারুণ্যের সেই দিনগুলোর সঙ্গে তো বেইমানি করতে পারি না। তা যদি করি, তো মহাপাতকী ক্রিয়াকাণ্ড হবে সেটা। যা-হোক, প্রচারতেল্লাই পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এক আনিসুল হক মশাইকে দেখেছি অকপট স্বীকারোক্তি দিতে যে তিনি বেড়ে উঠেছেন হুমায়ূনকাহিনির চিনচিনে ব্যথা ও কথার ঘোরলাগা হাওয়ায়। ব্যাপারটা তাহলে এই আমার ক্ষেত্রেই কেবল নয়! সেইটাই। চরৈবেতি।
প্রয়াত প্রথিতযশা
আমাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি কোম্পানি গত প্রায় একবছর ধরে একটা ভালো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এইটা আমি ভেবেছিলাম হুজুগ হবে, দেড়-দুইদিন তদুর্ধ্বে চল্লিশার পর বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু না, আমার আশঙ্কা ও এন্টিসিপেশন ভুল প্রমাণ করতেই হয়তো ঘটনাটা আজও অদ্য রজনী অব্দি ঘটেছে। একবছর পূর্তিও হয়েছে এই ঘটনার। পরিবর্তিত যুগ ও লোকলস্করের বিটিভির কাছ থেকে এইটা আশাতীত বললে বেশি বলা হয় না। তা, ঘটনাটা বলি। বিটিভি নিয়মিত প্রতিহপ্তায় হুমায়ূন আহমেদের নাটক পুনঃপ্রচার করে চলেছে। টুয়াইস ইন আ উইক, সোম ও বৃহস্পতি। তুঙ্গ সংস্কৃতি। বিটিভি তার এই সদিচ্ছা আর শুভকর্ম অব্যাহত রাখলে এগজিস্টিং ভিশ্যুয়াল চ্যানেলগুলো না-হোক অন্তত ওয়েইটিং টু গেট ডিক্লারেশন গরিবদেশের শত শত বিনোদনব্যবসাস্বাপ্নিকগণ ব্যাকফুটে খেলবেন বলে রে-অফ-হোপ ঝিলকি মারে। যেটা বলছিলাম, হুমায়ূন আহমেদের একক তথা সাপ্তাহিক খণ্ডনাটকগুলো এবং পাক্ষিক ধারাবাহিকগুলো, স্বর্ণসময়ের সেই টিভিপ্লেগুলো, তখনও হুমায়ূন পরিচালক হননি কিংবা হননি বিনোদনসওদাগর, বিটিভি রিপ্লে করছে দুইযুগের ওপার হতে এবং আমাদের অস্বস্তিপীড়নকর সপ্তাহগুলো সম্প্রতি স্মৃতিহীরকখচিত খাসা কাটানো যাচ্ছে। যে-ব্যাপারটা খেয়াল করলাম, মজার ব্যাপার এবং ভাবনারও, প্রতিবার নাটক শুরুর অগ্রে টিভিঘোষক এসে ফর্ম্যাল ঘোষণা দেন নাটক শুরু হবার এবং বলেন যে, এবার আমাদের অনুষ্ঠানমালায় আপনাদের জন্য রয়েছে প্রথিতযশা সাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ কিংবা ‘কোথাও কেউ নেই’ ইত্যাদি। ইন্টারেস্টিং। প্রতিবারই এই পরিচয় দিয়ে চলেছে টেলিভিশনখোকা একবছর ধরে। ব্যাপারটা হলো, ‘প্রয়াত প্রথিতযশা’। তাদের কাছে হুমায়ূন হপ্তায় দুইবার মারা যাচ্ছেন। অথচ হুমায়ূন তো আমাদের কাছে বেঁচে উঠেছেন অতীতের যে-কোনো সময়ের তুলনায় বেশিভাবে। একটা ফিচেল হাসির রেখা দেখা যায় দর্শকদের কারো কারো ওষ্ঠে—আরে, বিটিভি মরহুম না-বলে প্রয়াত বলছে যে! এখন, রবীন্দ্রনাথপূর্ণিমা বা নজরুলতিথিতে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করে তারা, বিটিভিওয়ালারা, তাতে তো বলে না তারা প্রয়াত প্রথিতযশা! ভাগ্যিস বলে না। তাহলে তো পচে যেত এদ্দিনে কান আমাদের। রোজ সকাল-সন্ধ্যা এই দুজনের নাম তো বিটিভি নিয়ে থাকে বছর জুড়ে। প্রয়াত প্রথিতযশা রবীন্দ্রনাথ…প্রয়াত প্রথিতযশা কাজী নজরুল ইসলাম…জীবনানন্দ দাশ…মরহুম মশহুর শামসুর রাহমান…ভাবা যায়! এখন, দেখা যাচ্ছে, বিটিভির কাছে রবিন-জীবন-নজরুল জীবিত, হুমায়ূন মৃত। অথবা কি উল্টোটা! ভাবছিলাম, কয়দিন পার হলে একটা প্রতিষ্ঠানের নিকট কোনো-একজন লেখক জীবিত বলে গণ্যগ্রাহ্য হন! মরে যাবার পর কয়বছর গেলে পরে একজন লেখককে প্রয়াত বলা থেকে বিরত হবে বিটিভি! কিংবা স্বাভাবিক ও জীবিত ভাবতে অভ্যস্ত হবে কবে থেকে, যেমন হুমায়ূন আহমেদকে, এই বিটিভির বিকটসংস্কৃতি ব্যক্তিকর্তৃপক্ষ! তবে একবছর পর্যন্ত শোকযাপন ও মৃতসৎকার যে বিটিভির দস্তুর, তা তো প্রমাণিত হইল। দুইবছর পর যদি, দেখা যাক, বিটিভিবাকশো হুমায়ূন আহমেদকে লেখক হিশেবে জীবিত মনে করে একটু সম্মান দেখায়, কিংবা তিন, অথবা একযুগ পরে, লেট’স সি, আমরা অপেক্ষায় থাকি বরং। কবে যে এইসব—শুধু হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে নয়, অন্যত্র, সর্বত্র—অহৈতুকী বিশেষণ ব্যবহারের বাহুল্য খসবে আমাদের খাসলত থেকে! লেখায় এবং শিল্পসংস্কৃতির অন্য সর্বত্র এই জিনিশের প্রকট প্রেজেন্সে এক্কেরে পর্যুদস্ত অবস্থা দেখি। বিটিভি নিশ্চয় আমাদের জাতীয় আমল-খাসলতের একটা আয়না, তা খানিকটা ম্যানিপ্যুলেটেড হলেও।
বাচালতাভারাক্রান্ত হুমায়ূনের টেলিপ্লেগুলো
হুমায়ূন আহমেদের টেলিপ্লেগুলো লক্ষ করে দেখলে—ফ্রম বিগিনিং টু এন্ড—একটা ব্যাপার ঠাহর হয় তাঁর পুরো রচনাজীবন সম্পর্কে। এইটা আমার হয়েছে, এইটা কাজেই প্রামাণ্য কিছু না, এখানে একটু টুকে রাখতে চাইছি। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ-সাক্ষীসাবুদ জড়ো করে বেশ একটা ভালো ও দশাসই নিবন্ধাকৃতি জিনিশ বানিয়ে ওঠা যেত না তা নয়। যেত, দরকার মনে করছি না। আমি ডিপে যেতে পারি না, আপে থাকি, আমার বলবার কথা আমি বিঘৎখানিক জমিতেই নিতে পারব সেরে। ব্যাপারটা হলো, হুমায়ূনরচনায় বাচালতা আর বাগবাহুল্যের অনুপ্রবেশ। কথাটা আমার মাথায় এসেছে একদম সম্প্রতি, ঠিক দানাও বাঁধে নাই ভাবনা ঠিকমতো, পাছে ভুলে যাই তাই লিইখা ফালাই। ইদানীং যখন হুমায়ূন আহমেদের টিভিড্রামাগুলো মহাফেজখানা থেকে বের করে পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে টেলিভিশনে, বিটিভির জন্মলগ্ন থেকে এ-পর্যন্ত গৃহীত কররেখায়-গণনীয় সাধু সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগগুলোর মধ্যে এইটি শীর্ষস্থানীয় সন্দেহ নেই, এর ফলে একটা সুযোগ পাচ্ছি ছেলেবেলায়-দেখা আমার প্রিয় টিভিফিকশনগুলো পুনরীক্ষণের এবং সেইসঙ্গে বাংলাদেশের টিভিনাট্যের হিস্ট্রিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো রিক্যাপ করে দেখার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যেই কথাটা বলার জন্য এই প্রসঙ্গের অবতারণ, সুযোগ পাচ্ছি বিশেষ একভাবে তুলনামূলক অবলোকনের। হুমায়ূনের সামগ্রিক রচনাজীবন যদি দ্বিভাগ কল্পনা করি, তবে সেই অবলোকনপূর্বক তুলনা তাঁর প্রথম রচনাজীবনের সঙ্গে দ্বিতীয় রচনাজীবনের। এবং সমগ্র দেখাকর্ম, এই নিবন্ধানুচ্ছেদে, তাঁর টেলিপ্লেভিত্তিক। ফলে এইটি খুবই খণ্ডিত একটা দেখা, খোঁড়া বীক্ষণ, আগেই স্বীকার করে নিই। কিন্তু হলেও, অবলোকন টেলিপ্লেভিত্তিক হলেও, কথাগুলো হুমায়ূনের বইভিত্তিক সাহিত্য সম্পর্কেও মোর-অর-লেস বলা যাবে ধারণা করি।
বাচাল চরিত্রের উপস্থিতি হুমায়ূনসাহিত্যের গোড়া থেকেই লক্ষ করা যাবে, সেইটা লাগামের আওতায় ছিল, একটা কমিক রিলিফ হিসেবে দেখা যাইত প্রায়শ। অনেকসময় এই ফটফটে স্রেফ-চাপানোতোরে-স্বভাব কথাবাজ ক্যারেক্টারগুলোর মুখ দিয়ে তীক্ষ্ণ প্রবচনপ্রতিম কথাও বলিয়ে নিতে পারতেন রচয়িতা। শার্প কথাবার্তা সারাক্ষণ বলে গেলে সেই কথা-বলিয়ের শার্পনেসের ঠেলায় ভিরমি খায় লোকে। এবং অনিবার্য কারণবশত লোকে একসময় সেই শার্পনার মেশিনটা হাতের নাগালের দূরে রেখে চলা শুরু করে। হুমায়ূননাট্যের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে ঘটেনি বলে মনে হলেও, গরিষ্ঠাংশে সেইটা সত্য হলেও, ঘটেছে কিন্তু! মুখ ফিরিয়েছেও প্রচুর তাঁর একদা পাঁড় দর্শক, লক্ষ করেছি, বিরক্ত হয়েছে একটা বেশ বড় অংশ তাদের। খোঁড়া হলেও একটা এভিডেন্স দিচ্ছি, দেখুন তো মনঃপূত হয় কি না আপনার। গত একদশকে ডিভিডিবাহিত হুমায়ূন ওয়ার্ল্ডট্যুর করে বেড়িয়েছেন, বিশেষত এই স্যাটেলাইটবেষ্টিত প্ল্যানেটে, এইটা বলা তো যায়ই। ইন দি পাস্ট ডিকেড যারা ফ্রিকোয়েন্ট বাসজার্নি করেছেন ইন্টারডিভিশন, তারা জানেন, হুমায়ূননাট্যকীর্তি মনিটরে প্লে করার পর বাসকন্ডাক্টর লক্ষ করে ডিভিডিখানা পাল্টে প্লে করার রিকোয়েস্টসম্বলিত সম্মানিত যাত্রীসাধারণের বিরক্তিগুঞ্জন। উল্টোটা তো হুমায়ূনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকই ছিল, সজোরে কেতুকুতু দিয়া হাসানোকেও লোকে এপ্রিশিয়েট করে গেছে তাঁর ক্ষেত্রে, এডমায়ার করেছে তবু তাঁরে, এইটা কাজেই আলোচনার কিছু নয়। দিবালোকের মতো সোজাসাপ্টা চাক্ষুষ-চক্ষুগোচর ছিল হুমায়ূনজনপ্রিয়তা, তারা পাঠক-দর্শক নয় কেবল, নন-পাঠক নন-দর্শক লোকজনও হুমায়ূনকে অজ্ঞাত কারণে নিজের ধরনে গ্রহণ করে নেন। উদাহরণ চয়ন করা যাইতে পারে। একটা আপিশের ক্যান্টিনে পাচক-পরিচারক পদে ব্যাপৃত জনাদশেক লোক টিভি দেখছিলেন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার টোল-পড়া হাস্য ও তার টাটকা ইলিশ-ঝিলকিয়া লাস্য, বিজ্ঞাপনবিপদকালে চ্যানেল সার্ফ করে যেয়ে আটকে গেলেন হুমায়ূনে। তা, তাঁর নাটক-সিনেমা না, সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন হুমায়ূন নিজে। সেখানে তিনি তাঁর আপাত-অনাকর্ষণীয় নেত্রকোণাঞ্চলিক ককনি বাংলায় নিজের লেখালেখির পূর্বাপর বলে যাচ্ছিলেন। মহাফেজখানা থেকে রিপ্লে দেখানো হচ্ছিল। উপস্থিত দর্শকদের কেউ হুমায়ূনবইয়ের সনে সেভাবে ওরিয়েন্টেড না তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু তারা তাঁর টিভিপ্লেগুলো যথাসাধ্যসম্ভব অদেখা যাইতে দেন না। বা অন্য কোনো কারণে যেভাবেই হোক হুমায়ূনের প্রতি তাদের আগ্রহ এতটাই যে, এমনকি প্রিয়াঙ্কাও সরে যান তাদের প্রায়োরিটিলিস্ট থেকে, এইটা যা-হোক সিগ্নিফিক্যান্ট মনে হয়েছে আমার কাছে। একজন লেখকের প্রতি নির্বিশেষ সর্বশ্রেণিমানুষের এমন ঔৎসুক্য সমাজে লেখালেখিবিকাশের সম্ভাবনা খানিকটা হলেও প্রচার করে বৈকি। কিংবা আরেকটা উদাহরণ তোলা যাইতে পারে টেবিলে। যেমন হুমায়ূনপ্রণীত কাগুজে বইয়ের পাঠক না-হয়েও শুধু তাঁর শেষদিককার ডিভিডিধৃত টিভিপ্লেগুলোর সাবস্ক্রাইবার ছিলেন এমনকি বঙ্গজ পণ্ডিত প্রতিনিধিদেরও কেউ কেউ। অন্তত একজন এমন স্বীকারোক্তি দিবালোকে এক্সপ্রেস করেছেন যে, হুমায়ূননির্মিত অনাবিল হাসিবিকিরক টিভিনাট্য উপভোগ করা তাঁর ফেব্রিট প্যাস্টাইম। তিনি গোলাম মুরশিদ, অবিতর্কিত পণ্ডিত ব্যক্তি এবং এখানে তা বলাও হচ্ছে সদর্থেই, হুমায়ূন-প্রস্থানোত্তর স্মৃতিচারণ ও শ্রদ্ধাতর্পণমূলক একটি লেখায় স্বীকারোক্তিটি জ্ঞাপন করছেন ডক্টর মুরশিদ। বলতে চাইছি যে, এক-ধরনের অদ্ভুতুড়ে স্ট্যাটাস-ক্যু, ওভাররেইটিং-আন্ডাররেইটিং, উত্তোলন-অবতলন, পদায়ন-পদদলন, সমালোচকদের আন্দাজিপনা আর বিবিধ ধান্দাবাজির বাইরে যেয়েও হুমায়ূনপঠনের আনন্দ-বিনোদন উপজীব্য করে একপ্রকার রিডার্স-রেসপন্স তথা ডাইজেস্ট গড়ে উঠতে পারে। কেবল সমালোচকের শাদন্তকিড়িমিড়ি, আলোচকের ওঠবস আর সাহিত্যিক ও সাহিত্যপাঠকৃতি ওঠানো-বসানো দিয়া দুনিয়া আবিল কিংবা ঋদ্ধ করে রাখার কোনো মানে নাই।
কিন্তু হুমায়ূনের টিভিফিকশনগুলোতে ক্যাচরম্যাচর কথার ক্যারিক্যাচার কবে থেকে অনুপ্রবেশ করল, ব্যাপারটা সংক্ষেপে খেয়াল করা যাক। আদিতে ছিল না এমন, এইটা ক্লিয়ার। নৈরব্যের নিক্কণ শোনা যাইত তাঁর আখ্যানভাগের ভেতরে-বাইরে একসময়, স্পেস পাওয়া যাইত প্রচুর না-হলেও অনেকানেক, অল্পবিস্তর পরিসর বজায় রইত চিন্তার ও অনুভবের ও অনুভূতি জারণের, সর্বোপরি বিমোক্ষণ তথা ক্যাথার্সিস ঘটত—সমস্তই ছিল তো কথাবাহিত। পরকালে, শেষের দশকে, কথা পর্যবসিত হয় বিলকুল কোলাহলে। কেবল ডামাডোল, কথাচাপে সঙ্কুচিত কল্পনাস্থান, হুমায়ূনকে তদ্দিনে পেয়ে বসেছে এলোপাথাড়ি কথার নেশায়। ভাগ্যিস, খুব বেশি দীঘল নয় এই চ্যাপ্টার, হুমায়ূনে অপচয়ী কথাকারবার শুরু হয়েছে একেবারে শেষদিকে এসে। একসময় যা ছিল হিউমার, যে-সংলাপ ছিল শক্তিশেল, কালক্রমে সেই শেল অতিপ্রয়োগে হয়ে দাঁড়াল কর্ণ ও মর্মপীড়নকর অত্যাচার। তৎসত্ত্বেও তাঁর নাটক ব্যবসাবাদ্য তুমুলভাবে একচেটিয়া বাজিয়ে গেছে, এর একটা কারণ হতে পারে যে মানুষ ন্যাচারালি মর্ষকামী। কিংবা আরও কারণ রয়েছে হয়তো। হুমায়ূনের টিভিপ্লেরিট ক্যারিয়ারের প্রথমভাগের সঙ্গে দ্বিতীয়ভাগ মিলিয়ে একটা মূল্যাঙ্কন মুসাবিদা করতে পারলে এইটা ভালো বোঝা যাবে। এইটাও মনে রাখতে হবে, প্রথমভাগের হুমায়ূন শুধু স্ক্রিপ্ট লিখে দিতেন, দৃশ্যরূপায়িত হতো অন্য কোনো নাট্যপ্রয়োগকর্তার হাতে। এই তথ্য এ-প্রাসঙ্গিক আলাপের একটা সম্ভাব্য ক্ল্যু হতে পারে। এছাড়া আরেকটা ব্যাপার, যেইটা খুব গুরুত্মপূর্ণ মনে হয়, নব্বইয়ের দশকের একেবারে শেষপাদে এসে বাচালতা বা প্রগলভতা ভর করছে হুমায়ূননাট্যে। সেইসময়ের চারপাশে চোখ রেখে এক্ষণে এমন অনুমিতি টানা যাবে যে, ডেমোক্রেসির একদশক ধরে হ্যাঁচড়াটানা আশাভঙ্গে বীতশ্রদ্ধ হয়েই হোক বা অন্য যে-কোনো কারণে, এপিস্টেমোলজিক্যাল ডোমেইনে তো বটেই, ইভেন সমাজে এবং সবিশেষ নগর-পরিসরে তখন শুরু হচ্ছে ফাঁপা কথার কারবার, যা কিনা পরবর্তী দশকের রাজনীতি-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিল্পকলা-বিদ্যায়তন সর্বত্র জাঁকিয়ে বসবে। ঠিক ওই সময়েই হুমায়ূনের দৃশ্যায়ন-মাধ্যমের কুশ ও লব সবাই মিলে শুরু করে অবাধে অসার ফটরফটর, মুখে যেন মশামাছিও বসে না বাছাদের! আরও লক্ষণীয়, ওই সময়েই, নব্বইনিঃশেষিত প্রথম দশকে টেরিস্ট্রিয়াল ও অন্যান্য টেলিভিশনচ্যানেল জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো শুরু করতে যাচ্ছেন তৎকালে-তরুণ প্রতিভালোকিত প্রযুক্তিদক্ষ টিভিনাট্যনির্মাতাগণ, যাদের হাতে এই বিনোদনগরিব জাতির দর্শক অপূর্বকল্পিত-অভাবিত প্রোডাকশনে আশাকরোজ্জ্বল নির্মিতিঋতু উপহার পেলেও সেই সময়সীমা ছিল অত্যন্ত স্বল্পমেয়াদী। অচিরে এই ভাই-ব্রো নটগোষ্ঠীর হাত থেকে বেরোতে থাকে একাদিক্রমে রঙ্গনাট্য, রগড়, পেটে-খিল-ধরানো সব রঙচঙে কেচ্ছাকাণ্ড। শুরুতে সকলের হাতে একটা আইডি সিগ্নেচারটিউন থাকলেও ক্রমে এরা একঘাটে-জলপানরত মহিষে পরিণত হন। অভিনয়ে মহানায়ক হয়ে ওঠেন মোশাররফ করিম এই সময়েই, বাকি সবাই নির্ব্যতিক্রম মহানায়কের অনুকার। নাফ নদী থেকে পিয়াইন নদী, নির্জন সুন্দরবন থেকে জনমোচ্ছব কাঁটাবন, সর্বত্র একই ভাষা একই ভঙ্গিতে কথা ও অভিব্যক্তি। শত শত জলঝর্ণার ধ্বনিচিত্র অভিন্ন, বৈচিত্র্যরহিত, শত ফুলের বাগানসম্ভবা জায়গাটা পারিজাতভরা। সাম্যবাদ কায়েম হইল অবশেষে, লেকিন ইয়া মাবুদ, ভুল জায়গায়! এই সিলসিলায় একটা আস্ত দশক অতিক্রান্ত হলো, অনেক পেছন থেকে ইন্ডিয়ান বাংলা বাণিজ্যের সিনেমা আবারও গল্পেশিল্পেশৈলীতে ও নির্মাণসৌকর্যে পেল্লাইপোষ্টাই হতে শুরু করল। বড় বেদনার মতো বেজে ওঠে একসময় ফের-একবার-ভরসা-জাগানো তরুণাস্থির ক্ষয়ঘণ্টা। আমরা দেখতে পাই এই সিনেমাস্বাপ্নিক প্রিপেয়ার্ড তারুণ্য থুবড়ে পড়ে সিনেমা বানাতে যেয়ে। এখানে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, দাপুটে এই তারুণ্য হয়তো হুমায়ূননাট্যের আয়ূধগুলো তথা তাঁর উইট-পান-হিউমার প্রভৃতিকে বেঁকিয়ে বিকৃত করে দিতে প্রভাব রেখেছে। কে জানে, ব্যাপারটা ভাইস-ভার্সাও হতে পারে।
সিনেমাকার ও স্যংরাইটার হুমায়ূন
নয় থেকে দশটা সিনেমা বানিয়েছেন হুমায়ূন, স্বহস্তে, কেমন ছিলেন তিনি সিনেমাকার হিশেবে? সেই হিসাবনিকাশের লোকলস্কর আলাদা। তা, তাঁকে কি বিশেষ বিবেচনায় পাশ দেয়া যায়? এর উত্তরে একজন বললেন, মহাকালে বিশেষ বিবেচনা বলে কিছু নাই। বিলক্ষণ। তবে দেখতে তো মন্দ লাগে নাই, স্বীকারোক্তি সরল, তিনটে অন্তত এই নিবন্ধকারের নয়নে বেশ লেগেছে। সেগুলো ক্রমশ যথা ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ এবং প্রস্থানের অব্যবহিত পূর্বে রিলিজ-পাওয়া ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। আপনি যদি সিনেমাজাগতিক নতুন-পুরানা নানান তরঙ্গের ম্যুভিচিত্রগুলো সম্পর্কে একাধটু ওয়াকেফহাল ও থোড়াথুড়ি রসাস্বাদনকারী হয়ে থাকেন, তবুও বলবেন কি সিনেমাত্রয় একেবারে মন্দ হয় নাই? ফিল্মি দুনিয়ায়, যেমন কবিতায়, ভালো-মন্দ বিচারসালিশের বাইরে যেয়েও রসাস্বাদন করা যায় এবং সেই আস্বাদনোত্তর অভিজ্ঞতা আলবৎ প্রকাশও করা যায়। এই কথাটায় আস্থা রাখতে পারলে মানুষ হিশেবে আমাদের অপরাধ ও অর্জনসমূহ অনেক উন্নয়নশীল ও উদযাপনযোগ্য হয়ে উঠতে পারে। এই প্রসঙ্গ, তথা হুমায়ূনের চলচ্চিত্রিক বোধ ও বাসনার খবরাখবর তালাশ, আপাতত স্থগিত রাখা যাক। এরচেয়ে বরং কয়েকটা আশপাশকথা ব্যক্ত করা যাইতে পারে। যেমন একটা কনফেশন তো জরুর যে, এই নিবন্ধকারের বয়সী বিভাগীয়-মফস্বল শহুরে বাসিন্দাদের যৌবন ফিকে হয়ে যেত বান্ধবী-সমভিব্যহারে প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে একটাও বই না-দেখে। সেই সুযোগটি নিয়ে আসে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, সেই প্রথম এবং সেইই শেষ, ছারপোকাদষ্ট সিটের সিনেমাহল থেকে বেরিয়েই আমাদের বান্ধবীরা আলতারাঙা রাতুল পায়ে সুরমা-কুশিয়ারা লোহিতবর্ণিল বানিয়ে একে একে বিদায় নিতে থাকে আমাদের জীবন থেকে, এবং আমরাও মতি মিয়ার মতো বৈঠা ফেলে দেই ঝপাৎ করে মাঝগাঙে, সেই দিন আর আসে নাই ফিরে। এইটা ঠিক যে, সহপাঠী ব্যাটাবন্ধুদের নিয়ে এর আগে ও পরে আমরা ময়ূরী ও মুনমুনের বই নির্মদ্য উইকেন্ডে প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে দেখলেও মেয়েবন্ধুদের নিয়ে ওই ছিল প্রথম ও শেষ অভিযান। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রায়ন হিশেবে নাসিরুদ্দীন ইউসুফের ‘গেরিলা’ ও তারেক মাসুদের ‘নরসুন্দর’ ম্যুভিনিচয়ের পূর্ব পর্যন্ত ‘আগুনের পরশমণি’ তো অদ্বিতীয় ছিল নানা কারণেই, ‘ওরা এগারোজন’ মনে রেখেও বলা যায়, এখনও এবং সম্ভবত অনেকদিন-আরও উল্লেখযোগ্যতা থাকবে এই সিনেমাটার। ঠিক চলচ্চিত্রিক চোখ দিয়ে দেখতে গেলে এর অনেক অসঙ্গতি-বিসঙ্গতি ধরা যাবে না তা নয়, বিস্তর ধরা যাবে, সে-তো হুমায়ূনের যে-কোনো চলচ্চিত্রকাজে এবং নাট্যাদি নির্মাণে ঢের অসঙ্গতি ছিল, ফিল্ম হিশেবে এদের ফ্রেম খুবই নিশ্চরিত্র, সর্বোপরি সিনেমাগুলোর অকহতব্য মন্তাজদারিদ্র্য, সবই ঠিক আছে। টেকনিক্যালিও খুব সাউন্ড তো নয় তাঁর সিনেমা একটাও। তবে আকালের দিনে, মঙ্গাকালে, জাউভাত ইতিহাসে চিরস্মর্তব্য, তা আপনি দিনফেরা দারুণ বসন্তসময়ে ফেস্টিভ্যালে যেয়ে স্বর্ণভল্লুক লভুন আর পলান্ন ভক্ষণ করুন-না-কেন। সব মিলিয়ে হুমায়ূন ছিলেন গল্পবলার দিকে মনোযোগী, সিনেমায় অন্তত, ঢিসুমঢিসুম মারদাঙ্গা আর চাক্কুমচুক্কুম নাচাগানা কাটপিসের ভুবনে এইটুকুই ছিল আমাদের জন্য মরুদ্যান, ওয়েসিস, মায়াবী সিমুম, ভুলি ক্যাঙ্কা করে! এবং চলচ্চিত্রে হুমায়ূনের এইরকম খুঁটিনাটি কিছু কন্ট্রিবিউশনের ভিড়ে যে-ব্যাপারটি নির্দ্বিধায় কুর্নিশযোগ্য, সেটি হলো চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে হুমায়ূনের কিছু অনবদ্য গীতপঙক্তি রচনা। খানবিশেক গান তিনি লিখেছেন মোটমাট, ফিরিয়ে এনেছেন একঝলক বাংলা ছায়াছবির নস্ট্যালজিক সোনালি দিনের স্মৃতি। তুরীয় ফুর্তির কয়েকটা গানপদ যেমন বেঁধেছেন তিনি, বিষাদেরও তেমনি। দুইটা গান তো বলতে গেলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মর্তবায় নিয়ে গেছেন, লিরিক্যাল ইন্টেন্সিটির দিকটি বিবেচনায়, এদের একটির মুখ এমন : “বরষার প্রথম দিনে / ঘন কালো মেঘ দেখে / আনন্দে যদি কাঁদে তোমার হৃদয় / তখন তাহার সাথে করো পরিচয়…” ইত্যাদি। কিংবা আরেকটা গান ওই বৃষ্টিদিনেরই বিষণ্নতামাখা, হাহাকারব্যাপ্ত বর্ষাঋতু মন্দ্রিত সঙ্গীতযোজনা ও আবহ, মুখড়ার বাণী গিয়াছি ভুলিয়া। গানটার শুরু সম্ভবত ঠাকুরপদ ছুঁয়ে : “বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর নদেয় এল বান / বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান…” [youtube id=”jVsp49S5QgM”]এবং এরপরে গানের দেহখানা। বা, কেমন করে ভুলি, সেই “ও আমার উড়াল পঙ্খি রে / যা যা তুই উড়াল দিয়া যা…” গানটা! বাংলা গানে হুমায়ূনের অবদান, যদি জিগান, দুইটা লাইন গুঞ্জরিয়া উঠিলেই কাফি : “সবুজবরন লাউডগায় দুধশাদা ফুল ধরে / ভুল-করা কন্যার লাগি মন আনচান করে”—না, ভুল-করা কন্যার লাগি মন হয়তো উচাটন হয় না আমাদের এ-বয়সে আর, একসময় হতো কি না তা-ও মনে পড়ে না, মাগার সব্জিবর্ণা লাউডুগিতে দুগ্ধধবল ফুল আমরা একদিন ফুটতে দেখেছি অনেক, আজ আর নেই তারা কেউ খবরে, নিখিলেশও তো কবরে, ইত্যবসরে আমাদেরও চোখ সর্ষেফুল দেখতে দেখতে সেই চিলতে-লম্বাটে উঠোনের দূর কোণে কেবলই শান্তিস্নিগ্ধা লাউফুলগুলো খুঁজে ফেরে। নেইরাজার দেশে এসে পৌঁছেছি এদ্দিনে, নেই সেথা ক্ষণপরিত্রাণ। কথাটা জাজমেন্টাল শোনালেও বলতেই হচ্ছে, কেননা নাচার এছাড়া, সমগ্র বাংলাসাহিত্যে এই পিকচারটা, লাউডুগিটা আর তার ফুলটা, আগে হেরিয়াছি বলে মনে তো পড়ে না। তা, বিপুলা এ বাংলাসাহিত্যের আমরা কতটুকুই-বা জানি, বিশেষত বঙ্গপ্রভাষণাব্যাদিত ধরাধামে এই জমানায়, ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেলুম। অদৃশ্য একটি ইমোটিকন ধর্তব্য ঠিক এইখানে, সমবেত হাসাহাসির, ভেংচানো মুখাবয়বের। আনন্দম্!
জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)
- লিটলম্যাগ/ছোটকাগজ নিয়া দুইটা লেখা - জুলাই 6, 2015
- মুখরা জগৎকুমারীর সনে এক প্রেমিকের ঝগড়াঝাটি - সেপ্টেম্বর 5, 2014
- অন হুমায়ূন নন্যাকাডেমিক - নভেম্বর 22, 2013