Main menu

কাছিমগালা

ইংরেজী ১৯৮৯ সনে লেখা বাংলা এই ছোটগল্পটা কোয়ার্টার সেঞ্চুরী পার করতে না করতেই মিথে পরিণত হইতে পারছে। বাংলা সাহিত্যে এইরকমের মিথ অনেকগুলা আছে– গল্প/কবিতার বইটা খুবই ‘ভালো’, কিন্তু বইয়ের দোকানে গেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলা সাহিত্যের ক্রিয়েটিভ প্রকাশকদের এই সাফল্যের কারণে অবশ্য অনেক দুষ্পাপ্য লেখারেও ‘ভালো’ বলাটা এখনো সম্ভব হইতেছে। এইভাবে দেখতে গেলে, কাছিমগালা গল্পটার বাইলিঙ্গুয়াল প্রকাশ ঘটাইয়া মিথটারে একটা চ্যালেঞ্জের দিকেই টার্ন করানো গেলো। কিন্তু যে কোন মিথেরই মৃত্যু নাই, খালি অর্থবদল সম্ভব। এইভাবে শেষ পর্যন্ত আরেকরকমের মিথের সম্ভাবনার দিকেই যাওয়া যাবে হয়তো। কাছিমগালার মিথ উন্মোচনে এবং পুনঃনির্মাণে আপনাকে স্বাগতম!

___________________________________________________________

একদিন শুনি আমার অতিচেনা কাছিম নাকি তিনশ বছর বাঁচে। একথা জানার পর থেকে আমি স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছি। খাওয়া-দাওয়ায় রুচি নেই, সারাদিন শুধু ভাবি – কি যে ভাবি তা নিজেই জানি না, শুধু জানি, আমাকে ভাবতে হবে, আরো, আরো বেশী করে।

আমার বউ সবসময়ই বলে আমি নাকি ঘরকুনো। কথাটা শুনে একাই খানিকটা হাসি। আমার হাসি খুব অমায়িক ছোটবেলা থেকেই। নিজের কাছে হাস্যময়েরা বউয়ের খুব ভক্ত হয়। কিন্তু বউ আমার অতশত জানে না। রাতে পাশে শুয়ে আমাকেই নাকি স্বপ্ন দ্যাখে। কখনো অনেক রাতে হঠাৎ হঠাৎ গুঙিয়ে কেঁদে উঠে। আমাকে কারা যেনো কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলছে। দ্যাখে, কুচি কুচি করে কেটে চুন মিশিয়ে বস্তাবন্দী করে পানিতে ফেলে দিচ্ছে। আবার দ্যাখে লঞ্চ ডুবিতে মারা পড়ছি আমি, পরের দিন ফুলে উঠেছে আলিঙ্গনাবদ্ধ আমার দেহ। স্বপ্ন দেখে ধরফর করে উঠে জিজ্ঞেস করে, ‘লঞ্চে কার সাথে মারা যাচ্ছিলে গো?’ সারাক্ষণ আমি যেনো ওর ভিতরটা উঁকি মেরে দেখছি এমন ভাবে ও। আমি শুধু আমার বউকে দেখি, দুচোখ মেলে দেখি, ওর ঘরেপরা ব্লাউজের হাতাহীন বাহুমূল কখনো ক্লান্ত বা ম্লান হয় না। শুধু প্রশ্নই করে, উত্তর খোঁজে না।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

নানারকম লোকের সঙ্গে মিশেছি আমি। একদিন এক অন্ধ আমার পিঠে হাত রেখে বলেছিল, ‘বড় ভুল সময়ে এলিরে পাগল।’ জানি এসব মন ভোলানো কথা, কিন্তু কে-ই বা বলে এরকম। লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার রক্তিম চক্ষু কোটরে রস গড়াচ্ছে, তবু কেমন কোমল ও আর্দ্র লাগছে। হয়তো এক সময় ডাকাতি করতো, গ্রামের লোকেরা চোখ তুলে ফেলেছে বিরক্ত হয়ে।

‘আমার পীর কে জানস? পাতরাইলের লোকগুলা।’

‘এতো লোক পীর?’

‘এতো কই রে, লোক তো একটাই।’

‘…!’

‘সব লোক কি আর লোক? দেখ আমার কোমড়ে কতগুলা চোউখ।’

‘আমাকে একটা দিতে পারেন?’

আমার সবই আসলে খেলা। নানা ধরনের অবাস্তব কথা তাকে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু অন্ধ লোকটার প্রতিটা দমই বেশ হিসাব করা। সে বলে, ‘খুব খারাপ আর গান্দা এই সময়টা, দেইখা শুইনা চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সবাই পীর হইবার চায়, সাবধান গো সাবধান।’

আমি দেখেছি, ভাবে টাবে না এমন লোক মাঝে মাঝে আশ্চর্য সব কথা বলে ফেলে। জাফলংএ পিয়াইন নদী পাড় হবার সময় নৌকা টলমল করে উঠলে মাঝি ছেলেটি বলেছিল, ‘মানুষতো আর পাত্থর না। নৌকা একটু দুলবোই।’

আমার বউ এসব ছুটকো কথার খুব ভক্ত। তার একটা ব্যক্তিগত সংগ্রহ আছে এইসব অনামা লোকজনের উক্তির। সে সবাইকে বলে রেখেছে, নতুন কিছু শুনলেই যাতে তাকে লিখে দেয়। আমাকে প্রতিমাসে পাঁচটি বাক্য খুঁজে বের করতে হয়। অনেকটা বউয়ের জন্যই বিচিত্র লোকদের শরীরে শরীর, ঘামে ঘাম লাগিয়ে মিশতে হয় আমার।

আরো কতগুলো দায়িত্ব অবশ্য আছে। ‘অ’ এর প্রকৃত উচ্চারণ শিখতে হবে আমাকে। আজ না হয় কাল একদিন তো একটা ছেলে বা মেয়ে হতে পারে, তখন ওকে স্বরবর্ণ শেখাতে হবে তো আমাকেই। পিতা হিসাবে এই প্রাথমিক দায়িত্বটুকু আমি তার মায়ের উপর ছেড়ে দিতে চাই না। ঘরে থাকা মা জীবনের অনেক গাঢ় বিচিত্র উচ্চারণই জানেনা। ও যখন বড় হবে, ওকে যাতে কোন অচেনা পৃবিীতে অনুপ্রবেশ করতে না হয় সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি দরকার।

‘অ’ একটি বিচিত্র বহুবর্ণিল ধ্বনি। শুধু ধ্বনি নয়, এর সাথে জড়ানো রয়েছে বহু প্রজন্মের অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতা। গভীর রাতে যে কাকটি ‘অওঅ-’ স্বরে নিজের কাকবিস্ময় প্রকাশ করে, সেই কাকই দিনের প্রথম ভাগের কর্কষতাকে নির্ভর করে অন্য একটি ‘অ’ দিয়ে প্রয়োজন মেটায়। আমি ভাবতে চাই এইভাবে যুবকের আর্তনাদের মধ্যে ‘আ’, বালকের প্রতিবাদের মধ্যে ‘ই’ বিভিন্ন স্বরূপে প্রকাশিত।

আমি খুঁজতে চাই তারাদের স্বরবর্ণ কি? ভ্রমণচলিষ্ণু নক্ষত্র জগৎ মানুষের স্বরে কখন কথা বলে? আমার ছেলেকে শেখানোর জন্য বর্ণ পরিচয়ের বহুমাত্রিক একটা পুস্তকের সন্ধান করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমি আর বৌ মিলে হাজারো প্রশ্ন করি। প্রশ্নগুলোর কোন অর্থ খুঁজি না তবু প্রশ্নগুলোই গতি। অন্ধকার পছন্দ করি তা বলে মনের ভেতরটা যাদের অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে, ড্যাম্পমারা, তাদের জন্য আমার কোন সহানুভূতি নাই। ছোট্ট একটা দুকামরার ঘর যতোটা সম্ভব আলোময় করে রাখা যায় বৌ আর আমি মিলে তা রচনা করেছি। একটা রুমে দুজন রাতে সঙ্গম, ঘুম ইত্যাদি শারীরিক প্রয়োজনগুলো মেটাবার জন্য ব্যবহার করি, আরেকটা রুমে দুজনের সখের জিনিশগুলো রাখা। কোন অতিথি এলে দরোজা খুলে বলি, ‘ভাই আমি তো একটা কাজে ব্যস্ত, বসতে বলতে পারছি না।’ পারতপক্ষে কাউকে ঘরে এনে বসাই না। নিতান্তই কেউ যদি আসতে চায়, বউয়ের সাথে বুদ্ধি করে রান্নাঘরে নিয়ে সবাই। ওখানে দুটা মোড়া রাখা আছে, মলিন ও পুরানো বেতের, বসলে পাছায় বাঁশের কাঠির খোঁচা খেতে হয়। দুএক মিনিট কথা বলে জিজ্ঞেস করি, ‘একটু চা’র কথা বলবো’ – বলে চুলার দিকে তাকাই, তাকাই সেলফের কৌটাগুলির দিকে। অতিথি বুঝতে পেরে কাজের কথা বলে চিরদিনের মতো বিদায় নেয়।

দুনম্বর রুমটার কথা পরে বলা যাবে – এক নম্বরটার কথাই বলি। শুধু রাতে ব্যবহার করি বলে এ রুমটার চারিদিকে অনেক ধরণের বাতি লাগানো। বৌ ষড়ঋতুর ব্যাপারে একজন ওস্তাদ লোক। ছোটবেলায় নাকি রাজ্যের বৃদ্ধাদের সঙ্গে ওর ভাব ছিলো, তারাই ওকে ঋতু বিষয়ক নানা জ্ঞানে সমৃদ্ধ করেছে। জীবনের প্রথম যে ঋতুর বিষয়ে জেনেছে, তা নিয়ে অবশ্য কথা বলতে চায় না। আজকাল সহজেই বলে দিতে পারে চলতি মাসের প্রথম পনের দিন কত ওয়াটের কি রকম বাল্ব জ্বলবে দেয়ালের কোন কোণা থেকে। নানরকম সেড লাগানো আছে, বৌ নিজেই কুড়িয়ে পাওয়া জিনিশ থেকে ওগুলো বানিয়েছে নিজস্ব সজ্ঞা বলে। আমি এর কিছুই বুঝি না। তবে আমার ঝোঁক পুরানো আমলের তেলের বাতিতে। বিবাহবার্ষিকীর রাতে জ্বালানোর জন্য প্রাচীন একটা পেট্রোম্যাক্স জোগাড় করেছি। এই সব জিনিশের ঝামেলা হলো, কার্যক্ষম করে তোলার জন্য অনেক সময়ই এর দুএকটা অংশ সারিয়ে নিতে হয় নিজের হাতে। যদিও আমার টুলবক্স আছে, আছে ঝালাই করার ইলেকট্রিক তাতাল, ফাইল, হ্যান্ড ড্রিল, হ্যাকস, বাটাল, হাতুড়ী, র্যাঁদা, স্ক্রু ড্রাইভার, মাল্টিমিটার – তবে ইলেক্ট্রনিকসের তেমন সখ নাই। যেমন আমার বৌয়ের নাই বাগান করার সখ। আমি খুব খুশী এতে। শিল্পবিপ্লবের পর মানুষের সবকিছুইতো খুব বড়ো হয়ে গেছে, না হয় খুব ছোট হয়েছে; বাগান করাটা কোনটার মধ্যেই পড়ে না। বাগান করা আমার কাছে মনে হয় এক ধরণের বিলাস।

ঋতু বিশেষজ্ঞ আমার বৌ শোবার ঘরটা এমনভাবে পরিকল্পনা করেছে যে ১২’ ী ১৪’ আকারের কক্ষে ঢুকলে আদিঅন্তহীন মাত্রাত্তোর একটা অনুভুতি আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। ঘরের অর্ধেকে প্রকৃত মেঝে থেকে দেড় ফুট উঁচু একটি ফলস মেঝে, যাতে কার্পেট পাতা আর মেঝেটা যে কোন দিকে সরানো যায়। বৌ প্রতিমাসের এক অনির্ধারিত তারিখে মেঝের স্থান পরিবর্তন করে। কার্পেটের ওপর এক ইঞ্চি ফোমের চাদর। আবার সেটার উপর পাটি বিছানো যায়, মাদুরও ফেলা যায়। সে যাই হোক, ওর বয়সের সমান সংখ্যক পঁচিশটা ছোট, বড়, গোল, চ্যাপ্টা, তিনকোণা নানা রঙের বালিশ বিছানায় ছড়ানো থাকে। আমি কখনো বৌকে বালিশে ঢেকে তার ওপর ঘুমানোর চেষ্টা করি। কখনো বা ওর সাথে বালিশের বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে তুমুল বালিশবৃষ্টিতে মুষলধারে বালিশবর্ষণ করি। কখনো ভোররাতে দেখি বালিশগুলোকে ও কোলে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। খুকিটির মতো নয় যেনো বা মহাভারতের সময়কার নারীদের শতপুত্রের আকাঙ্খার ভিতরে হাবুডুবু খাচ্ছে ও। চোখে মুখে শস্য-শ্যামলা কৃষিভূমির ঘুমঘুম মেঘ।

ঘরের দরোজা দুটি সাজানোর কল্যাণে কখনো হয়ে ওঠে বউয়ের ঠোঁট। মন চায় ওখানে সারাদিন যাওয়া আসা করি, চুমু খাই, ভিজিয়ে তুলি যা নেই সেই সব অনস্তিত্বের ভাবনাগুলি। বস্তুতঃ আমার কাছে ঘরের অর্থই হলো কতগুলো নির্বস্তুক ভাবকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে কাল্পনিক একটা ভাবনাকে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যবহারিক জীবনে স্থাপন করার কৃৎকৌশল।

শোবার ঘরটাতে একটা কাঁচের ফাঁপা কিউব রয়েছে। এটার একদিকের কাঁচ সরানো যায়। স্বচ্ছতার দিক থেকে অপরিসীম আমাদের ঘরে হঠাৎ আনা সুন্দর এই ঘনকটার ভিতরে খুব উল্লেখযোগ্য কিছু স্থাপনের চিন্তা আমরা করেছি। এরকম আধারের ভিতর অনেকে মাছ পোষে কিন্তু একুয়ারিয়াম আমরা চাই না, আমরা আরো মৌলিক ও একক কিছু করতে চাই। খুব গভীর আন্তরিক কিছু একটা এই দামী কাঁচঘেরাটোপে রাখতে চাই।

বউ আমার মতোই ৯টা-৫টা অফিস করে। কিন্তু ওর জন্য কোন নাম আজ অব্দি ঠিক করতে পারিনি। একই মানুষের বিভিন্ন নামে আমি বিশ্বাসী। ‘নাম’ – এই বিস্ময়কর বিষয়টা যতো বেশী ধ্বনিনির্ভর শ্রবণপ্রিয় হবে ততই আমার সায়। নতুন নাম দিতে ভালবাসি। কিন্তু ওর জন্য ঠিক করা কোন নামেই আমি সন্তুষ্ট নই। বউয়ের যে সব বিষয় জানি তাতে সহজেই ওকে ডাকতে পারি আ-তিয়া। কিন্তু নামটার মধ্যে ‘ত’ ধ্বনি বিশেষ অভিঘাত হানলেও বহু ব্যবহারে তা ম্লান। আর ব্যবহার করা জিনিশে আমার শিহরণ নাই।

ছেলের নাম রাখবো নিহি। মেয়ের নাম নৃপা। বা মেয়ের নাম পিঁপিঁ, ছেলের নাম কিশ। এসব ভাবতে ভাবতে শিশুদের মতো জলরংয়ে নানারকম কম্পোজিশন করতে করতে পারিবারিক রংয়ের ভিতর ঢুকে যেতে থাকি।

প্রথমে ভেবেছিলাম তিআর ছোট্ট একটা ব্রোঞ্জমূর্তি করে কাঁচের ঘনকটার মধ্যে স্থাপন করি। ধাতুগলানো ফার্নেসের ব্যবস্থা থাকলে ব্রোঞ্জ গালিয়ে নিজেই মোল্ডিং এ নেমে পড়তাম। কিন্তু ঘরে ছিলো মোমবাতি। ব্যবহার করা খালি ইকোনো কলম মোমের আলাতে গলিয়ে, বাঁকিয়ে কলমের আকারের বিকৃতি ঘটিয়ে নানা রংয়ের সরল রেখা নির্ভর ফর্ম তৈরী করলাম। কোন কোনটা হয়ে দাঁড়ালো সংগমরত ত্রিভঙ্গ নটরাজ, কোনটা উর্দ্ধমুখী পাকানো সাপ। যেন স্পেসকে ধরার জন্য ত্রিমাত্রিক ফাঁদ বানালাম। যদিও, তিআ হলো না। কিন্তু তিআ নয়, আজকাল আমার ভিতর ঐ বহু তলের কাঁচের বাক্সটাই অনবরত ঘুরতে থাকে। যেখানে যাই, যে অবস্থায় থাকি কানের ভিতর কুমন্ত্রণা দিতে থাকে ঐ সীমাহীন অর্থশূন্য বাক্স। সে যেন কেবল বলে, ‘ভরো, ভরো, ভরো’।

বাজারের থলি হাতে একদিন অফিসে চলে যাই। ‘তুমি শুধু একটু রাজী হও’ বলে তিআকে প্রস্তাব দেই আমাদের দুনম্বর ঘরটাকে সকলের জন্য খুলে দিতে। কিন্তু তিআ রাজী হয় না কিছুতেই। অথচ কি একঘেঁয়ে লাগছে আমার ঐ ঘরের পঁচিশটা জিনিস নিয়ে কেবল ভাবতে। ২৫-৭=১৮; ১৮/২=৯; ৯-৩=৬। আমার নিজস্ব একান্ত আপন বলতে ঐ ঘরে মাত্র ৬টা জিনিস রয়েছে। বাকিগুলির মধ্যে ৭টা সাধারণ, দুজনের, তিআর নিজস্ব ৬টা, প্রত্যেকের বাকী তিনটা এক নম্বর ঘরের সাথে সংশ্লিষ্ট। ৬টা জিনিস, অথচ আমার আকাঙ্খা ৭মটাতে। আর ওখানে নতুন কোন কিছু যোগ করার যায়গাও নাই।

একদিন ময়মনসিংহ থেকে চিঠি পাই, সেই লোকটার খোঁজ পাওয়া গেছে।

তিআ কে ছেড়ে গত দেড় বছর কোন রাত আমি বাইরে কাটাইনি। দেড় বছরের প্রতিটা রাতই আমাদের এক নম্বর ঘরের ফলস মেঝে দাপাদাপি করেছে; ঐ রাতগুলোতে জেনেছি মেয়েদের যৌনআত্মা অসম্ভব ধরনের বিলাসী। মেয়েদের শরীর কখনো কখনো সহজ বটে কিন্তু তিআ খুব জটিল মেয়ে। জটিলতা দিয়ে ওকে জয় করতে হয়। তিআ কখনোই ক্লান্ত হয় না। ওর শরীর সৃজনী প্রতিভাদীপ্ত, বীরব্যঞ্জক আর ওর শরীরের ভেতরের অংশটুকুর বাগ্মীতা অসাধারণ। আমি আমার শরীরটাকে উদ্যম দিয়ে যদি স্পীডবোট করে তুলি ওর জলাভূমিতে ও খুশীতে পঁচিশটা তিআ হয়ে ওঠে, বেলে মাটির মতো গুড়ো হয়ে ঝরে পড়ে আমার হাতে। আমাকে আরব্য রজনীর শাহরিয়ার করে ওর হঠাৎ ঘুম থেকে ওঠা স্তনযুগলের গল্প নিবেদন করে। যে গল্পের মুখে কাপ ভর্তি উষ্ণ এক্সপ্রেসো কফি। ও খুশি হয়ে উন্মাদিনী হয়ে ওঠে, যেন গলাটিপে সন্তানকে মেরে ফেলছে এক ডাইনি। ও ওর তলপেটকে বলে সেতু, যার টোল আদায়কারী খুব কড়া – অবশ্যই তাকে সামুদ্রিক চুমু দিতে হবে, তবেই তার তলদেশের রসিক কড়ির মুদ্রিত ভাঁজ খোলার অনুমতি সে দেবে।

যে লোকটার কথা লিখেছে ময়মনসিহ থেকে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে এক বিকেল শেষ না হওয়া সন্ধ্যায়। ছিপছিপে একটা নৌকায় তোলা চুলায় ভাত টগবগ করছিলো। নদীর উপর কুয়াশার মশারী টাঙ্গানোর আয়োজন চলছে। নৌকাটা খুব সাধারণ আর এতোই অনুজ্জ্বল দেখে যে কারো মন খারাপ হয়ে যাবে।

আমি তখন ছাত্র। পুরানো ব্রহ্মপুত্রের বাঁধানো পাড় ধরে সন্ধ্যায় দল বেঁধে হেটে কিছুটা রাতে কৃষ্ণপক্ষের কালো আকাশের পটভূমিতে নক্ষত্রগুচ্ছ থেকে ভেবে ভেবে নিজের দেহনক্ষত্র বের করি। এই জায়গাটায় পোষা ব্রহ্মপুত্রের চেহারা বিপ্রদাসের মতো। ঠিক বুঝিয়ে বলা যায় না। নদীর ঐ পাড়ে অনেক রাত পর্যন্ত দেখা যায় পানির ওপর দিয়ে অনবরত কতগুলি আলোর বল নাচানাচি করছে। এদের সংখ্যাও খুব চঞ্চল। কখনোই দুবার গুনলে একরকম হয় না। বাঁধানো ঘাটে উত্তর মুখো হয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকি। সামনে ডানে বামে উজ্জ্বল বিচিত্র বর্ণের উল্কা খসে পড়ে আকাশ থেকে দৌড়ে ডান থেকে বামে যেতে গিয়ে হঠাৎ নিজেকে হারিয়ে ফেলে। আর কী তীব্র মনোহর উল্কার পুড়ে মরা। কাছাকাছি উল্কাপাতের পরেই নানারকম ঘটনা ঘটতে দেখেছি – পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। জিব দিয়ে স্বাদ নিয়ে দেখেছি সৈন্ধব লবনের মতো লাগছে বাতাস। মৃত নদীর পাড় থেকে আকাশ খুব জবরদস্ত মনে হয়।

নদীর ঘাটে একদিন সিগারেট ধরাতে গিয়ে লোকটার সাথে পরিচয় হয়। চুলায় টগবগ করে ভাত ফুটছে, নৌকার ছৈবিহীন অংশটাতে ছড়ানো রয়েছে টেটা, বর্শা, জাল, দড়ি আর সার সার চিৎকারে রাখা কি জিনিস প্রথমে ভাবতেও পারিনি কি হতে পারে এগুলো, কিন্তু জেনে বিস্ময়ে চমৎকার হতবাক! প্রথমেই মনে হলো ঈসপের সেই দুর্দান্ত বিখ্যাত উপকথাটি: কচ্ছপ ও খরগোসের দৌড়। কে জিতেছিলো আসলে? তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কেন ঘামাইনি? গল্পটার মজা কি তাহলে সমাপ্তিতে নয়? এর মূল মজাটা কি লুকিয়ে আছে মানুষের একান্ত কিছু আদিপ্রেরণার উন্মোচনে? যার জন্য মানুষ ধীরকে দ্রুত, বিজয়ীকে ব্যর্থ, সহজ কে অসহজ, স্বাভাবিক কে আকস্মিক হিসাবে ভাবতে চায়? আজ এই নৌকায় চিৎ করে ফেলে রাখা কাছিমগুলো দেখে তাই মনে হলো।

পেটের তলাটার রং ঘনহলুদ থেকে সবজেহলুদ। একটা জ্যান্ত  কাঁসার থালা বলেও ভাবা যায় উল্টে রাখলে। আমি বিহবল হয়ে দেখতে থাকি। কাছিম দেখেই আমার কি যেন সব মনে হতে চাইছে। মাথার ভিতরটা গুমগুম করে উঠলো, মনে হচ্ছে ভাবনা কেন্দ্র থেকে খুব দূরে কি যেন একটা অনুভাবনা চিঁ চিঁ করে কেন্দ্র মাকে ডাকছে। ইচ্ছা করছে মগজটাকে খুলে উল্টে দেই, কি মনে হতে চাইছে তা জানাটা খুবই দরকারী যেনো।

লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে একটু সহজ হই, কিন্তু ভেতরের ব্যগ্রতা রয়েই যায়। সে কোন কথা বলছে না – তাকিয়ে আছে – তবে কিছু বলতে চায় মনে হলো। মনে হলো সে ভাবছে কিভাবে বলবে। চুলার আগুনে তার চেহারাটা স্পন্দময় আর নিবিড়।

‘একটু আগুন হবে?’

কিছুক্ষণের জন্য নিরবতা নেমে আসে। চুলায় একটা বাঁশের টুকরা চড় চড় করে পুড়ছে। কাছেই চিৎকরা খোল থেকে একটা কচ্ছপের মাথা বেরিয়ে এলো আমার গলা শুনে। প্রৌঢ় লোকটা জিজ্ঞেস করলো, ‘সিগারেট ধরাইব্যান?’ পাটখড়ি দিয়ে চুলার আগুন আমার মুখের কাছে তুলে ধরলো।

‘কি রান্ধেন?’

‘চাউল ফোটাচ্ছি’, বলে অর্ধষ্ফুট হাই তুললো। ছৈয়ের ভিতর একটা তরুণ কি যেনো করছে।

‘চাচামিয়া বাড়ী কই?’

লোকটা আমাকে অসম্ভব আকর্ষণ করছে। যে করেই হোক তাকে ধরবো।

কাছিম হলো আজব জীব। পানির খাসী। পূর্ণবয়স্ক নুনুর মতো তার চাঁচাছোলা উদাম গলাটি যে কোন সময় বুকের ভিতর লুকিয়ে ফেলতে পারে, তাই কাছিম একটা রহস্যময় প্রাণী। মুসলমানরা জবাই করার কৌশল আয়ত্বে আনতে পারেনি বলে এর মাংস আস্বাদনে বঞ্চিত। কিন্তু মহাশুন্যচারীর চমৎকার নিরাপদ পোষাকের মতো আর কারই বা এমন দেহবর্ম রয়েছে? দেখতে লাজুক মনে হলেও যৌনজীবনে কাছিম নিশ্চয়ই খুব গোছালো। চরের বালির উত্তাপে যেভাবে সে ডিম ফোটায়, ভাবলে অনুপ্রানিত হতে হয়। প্রার্থনায় উবু হওয়া মানুষের মতো কচ্ছপের আদিগন্ত অবনতভাব পানি, আকাশ ও ভূমি রেখার মধ্যে একটা অপার্থিব কামনা জাগিয়ে তোলে।

প্রৌঢ় কচ্ছপ শিকারী দীর্ঘ কাহিনীর একেবারে গোড়াতে বললো তার আদি বাড়ী ছিলো কানসাট। চাপাইনবাবগঞ্জে পদ্মার ছাড় মরাপাগলার পাড়ে। তাও অনেকদিন আগের কথা। ‘দুটা দানার লাইগা নিজের দ্যাশ ছাইড়া এরঘে কান্তনগর আসাছ্যি।’

দিনাজপুরের মরাকাঞ্চনের পাড়ে কান্তনগর। নৌকা ভাসিয়ে কাছিম ধরতে ধরতে দেশ বিদেশ আসা যাওয়া হরহামেশাই চলে। পায়ের নিচে মাটি শক্ত নয় বলে। সারা শীতকাল কাছিম ধরবে মরাব্রহ্মপুত্রের এ এলাকায়, পানি শুকিয়ে যখন হাহাকার ফিরবে বাতাসে, তখন আবার ফেরা।

ভাব জমিয়ে ফেলি শিকারীর সাথে। আমার জানতে হবে কাছিম পানিতে কি করে? কাছিম ডিম পারে কিভাবে? আর ঘুমায় কোথায়?

‘আপনারা বুঝিন পানিক খুব ছস্তা মনে করেন, না?’

অনেকক্ষণ হয় রাত ঘোর হয়ে এসেছে। ওদের নৈশাহার সমাপ্ত। চাদর মুড়ি দিয়ে মাঘের আকাশের নিচে বসেছি নৌকার পাটাতনে। হারিকেনের কালিঝুলি মাখা আলোতে আমার আশেপাশে চিৎকরা কাছিমগুলার চোখ জ্বলছে নিবছে। আকাশের অনেক উপর দিয়ে জীন চলে যাবার মতো গম্ভীর সোঁ সোঁ শব্দ করে একদল দেশবদলী পাখি উড়ে গেল। লোকটা অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো। কথা হচ্ছিল পানির দেবতা, চরের পীর, কাছিমের বন্ধু এইসব নিয়ে। প্রৌঢ়ই আমাকে এসব বিষয়ের উপস্থিতি সম্পর্কে  সচেতন করায়।

হঠাৎ ফিসফিস করে বলে, ‘ইগলাকে কি কুন কালে দেখছ্যেন?’

‘কি?’

‘বুঝলেননাখো, রাইতের বেলা যারগে নাম নিতে হয় না, অরঘে কথাই কোহছি।’

আমার চোখমুখ একটু শুকিয়ে গেল কি? কাছাকাছি কোন গাছে কোড়া টুবটব করে উঠলো?

‘গেলোবার রেলব্রীজের নিচে ফকফকা চান্নিরাতে দেখনু ছয়খান দাড়িঅলা লোক হাডুডু খেলছে। একবারে মালকোছা মাইরা দুদিকে দুদল ভাগ হইয়া খেলছে। খেলার মধ্যে মনে করেন যে জইমা আছে। ঘুম আসছিল নাকো, তাই কোঁচটা লিয়ে বাহির হয়েই এইগলা দেখুন। দেখ্যা মনে করেন যে থ। অমন রাইতে দ্যাড়হাত উচা একেকটা লোক। সভারই ফের নাভী পর্যন্ত সাদা দাড়হি। ফের হাডুডু খেলছে। খেলছে তো খেলছে – কাহুরি পা ফের মাটি ছুঁচে নাখো-’

আমি চাদরের ভিতরে থেকে শীতকালের থাবা পেলাম যেনো। প্রৌঢ় আবার গলা নামিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো:

‘মনে হছ্যে, অরঘে কেহ কেহ হারঘে আনজরে পানজরেই ঘুরছে। এ্যাকটু গা ঘিষা বইসেন।’

বুঝলাম আমার মুখটা আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। ভাঙ্গাস্বরে জিজ্ঞেস করি, ‘এখন কি করতে হবে?’

‘চুপ কর‌্যা বসেন তো হামি দেখছি। অরা হাইলে হাইলে আইসা করে কি জানেন, আমার লাওয়ের সব কাছিমগালাকে পান্তে ছাইড়া দ্যায়। দ্যাখছ্যান, মোনে হছ্যে কাছিমগালা কিছু এ্যাকটা ট্যার পায়াছ্যে।’

আসলে সবগুলো কাছিম গলা বার করে কি যেন দেখছে। ষ্টেডিয়ামে ফুটবল খেলার সময় একদিকে যেমন সবাই তাকায়, যেমন বল এক পোষ্ট থেকে অন্য পোষ্টের দিকে যায় আর তাকিয়ে থাকা মাথাগুলো ঘাড়ের উপর ঘোরে, অনেকটা সেরকম।

‘এখন অরাকে লিয়ে যদি কাহিনী কহি, তাহলে সব ভুল্যা যাবো। অরঘে গুন গাহিলে সব ভুইল্যা যায়।’

‘চার পাঁচ বছর আগে একটা ঘটনা ঘটে ছিল। কাছিম ধরছি মনে করেন যে তো আইজকা থাকে নয়, মেলা দিন, কিন্তু এমন ঘটনা আর ঘটতে দেখিনিকো। ঐ রকমই এক রাতে কোচ লিয়্যা গাঙের পারে ঘুরছি আর পানি লিঝিয়ে লিঝিয়ে দেছি। হামারতো ভয়ডর কোনো কালে ছিল নাকো। এদিকে রাইত বাড়ছে তো বাড়ছেই কিন্তু শিকার আর পাছি নাখো। একবার ভাবনু রাতটা বুঝি কুফা। এমনি সময়ে হঠাৎ গাঙের বুকে দেখনু ভুরভুরি। আস্তে আস্তে ভুরভুরিটা বাড়ছে। চাইপ্যা ধরনু কোচটাকে। ভুরভুরি ওঠা যায়গাটা মনে হছে যেনু খেইপ্যে গেছে। উথাল পাথাল করতে লাগলো আর তল থাইক্যা কেমন আশ্চর্য আলো বারহাইতে লাগলো। হঠাৎ কইরা বিহান বেলার মতোন হয়া গেল। আলো বাড়ছে, পানির খ্যাপামুও বাড়ছে। জায়গাটা লাল টুকটুকা মরিচের মতো হইয়া গ্যালো। তারপরে উ ভাস্যা উঠলো। এদিকে হামি তো রেডি, কোঁচ তুলছি মারবো কহ্যা। দেখনু একটা সাপ আসমান থাইকা নাইমা আইলো। অর গায়ের চারদিকেও লাল আলো। মনে হছে বাবলা কাঠের আগুন জ্বলছে। আর চোখ দুটা কি কহবো, কোঁচ হামার হাতেই থাইক্যা গেল – মারতে পারনু নাখো। দেখনু শালা হিহি কইর‌্যা হাসছে। হামি হাত নামিয়ে লওয়াতে অর আলো ঝকঝকা রূপার মতন হয়া গেল। হামি তো বেকুব। ফের তুলনু কোঁচ। এবার মারবুই। যেই কোঁচ তুলা, ছাপের হাসি বন্ধ হয়্যা গ্যালো আর সাধা আলো অমনি লাল হয়া গ্যালো। হামাকে বুঝিন ঘোরই পাইল। হাইলে হাইলে ফের কোঁচটা নামিয়ে লিনু। মারতে পারনু নাকো। বারবার একই ঘটনা ঘটতে লাগলো। হামি কোঁচ তুলি, উ লাল হয়া যায় – নামিয়ে লি উ হাসে। আমি সহ্য করতে পারনু নাখো। চরের এক মাথা থাকে আরেক মাথা পালিয়ে বেড়াতে লাগনু। পালিয়ে বেড়ালে হব কি, যেখানে যায়া থামি ওখানেই দেখি ভুরভুরি। ফের সেই আলো, কাছিম, ছাপ, বুক জালান্যা হাসি। হামি কি পাগল হয়া যাছি। মনে হছে হাঁর সব শক্তি উ কাইরা লিয়েছে। হামি স্বপনের ঘোরে ভাসতে লাগনু।

কাছিমটা হাইলে হাইলে উইঠ্যা আইলো গাঙের পারে। আর অমনি ছাপটাও কুনঠে থাক্যা আইসা হাজির। কাছিমটাকে সনঝা বেলার সুজ্জের মতো মনে হছিলো। উর চোখ দুটা জানি মধুর ফোটা। পাগলা রাজকইন্যার পা। হামি দেখছি আর দেখছি, মনে হইছে কুনঠে থেকে গাঙের ভরা ঢেউ হাঁর বুকের মইধ্যে আইসা পড়ছে। দেখনু দুঝনা লাচতে শুরু করেছে। সে কি লাচন। অরঘে লাচের সাথে সাথে আলোগুলাও বদল্যে যেতে লাগলো। কখনো রুহি মাছের রক্ত, কখনো বনটিয়া, কখনো বা বাবলার ফুল। কত যে রং অরা করছে, হামি জীভর‌্যা দেখছি।

ছাপটা হামার দিকে তাকায়া হাছতে লাগলো। হাছতে হাছতে হঠাৎ কইরা কাছিমটা সহ উ দুইটা আলোর বল হয়া গেল আর হারায়া গেল মাঝ নদীতে।’

কাছিম শিকারী আর বললো না কিছু। গল্প শেষ হলো তখন রাত তিনটা। ছোটনৌকায় আমার ঘুমানোর জায়গা হবেনা আর তাছাড়া ঘুমও নেই চোখে। নৌকা থেকে লাফিয়ে নামতে যাবো, পেছন থেকে সে বলে, ‘লাফ ঝাঁপ তো শয়তানের কাজ-’ খুব কড়া চোখে আমাকে নিরীক্ষণ করছে টের পেলাম – কুয়াশায় যতদূর দেখা যায়।

নদীর পাড় যেনো খাড়া ক্লীফ। উপরে উঠে দেখি নৌকার হারিকেনের আলো টিমটিম করে কাছিম শিকারীর চোখের মনি হয়ে আমাকে দেখছে। পেছনে ঝাপসা, অস্পষ্ট রাতের নদী রয়ে গেল, কুয়াশায় খাড়িগুলি অদৃশ্য, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ মাছ বা কোন অতিলৌকিক জীবের ভারী চলাফেরার শব্দ হতে লাগলো, যেতে যেতে আবারো ফিরে তাকালাম, নৌকার হারিকেনের আলোর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হওয়া অস্তিত্ব তখন নিবিড় অন্ধকারে মিশে গেছে, কিন্তু আমার মনে হলো ঐ অন্ধকারের মধ্যে কালো গর্তের মতো বৃদ্ধটির চোখ আমার চলে যাওয়া দেখছে।

এরপর থেকে আমার নেশা হয়ে গেল রাতের ব্রহ্মপুত্রের পাড় ধরে ঘুরে বেড়ানো। প্রথমে সঙ্গীরা থাকতো, ওদের এডভেঞ্চার থাকতো, কিন্তু ওরা ক্লান্ত হয়ে যেতে লাগলো। একা একা চলে যেতে লাগলাম নতুন গজিয়ে ওঠা চরে। একহাঁটু পানি, কোথাও চরের মধ্যে খাড়ি মতোন, নক্ষত্রালোকিত রাতে খাড়ির পকেটের পানি মুখর হয়ে ওঠে আমার দেখা পেয়ে। রাতজাগা পাখিরা দল বেঁধে নেমে আসে, তার এক দুটা পথ ভুল করে, সেই পাখিগুলির কি ডাক, মৃত্যুকে এনে যেনো বালিয়াড়ির নিচে গুঁজে রেখে দিচ্ছে। মৃত্যুর  অপমানে হু হু করে ওঠে চারদিক। বুনোঝাউয়ের বনে গোঙানি ওঠে। পানির ভিতরে মাছের বা অন্য কিছুর ঝুপঝাপ শব্দ। ভিজে বালির ঠান্ডা নিঃশ্বাসের উপর ভয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকি। কিন্তু আমার কৌতুহল মেটেনা। চোখ পিটপিট করে দেখি একটা সারস মতো শীতের পরিযায়ী পাখি পাশ দিয়ে হেঁটে গেল গ্রীবাকে এক দুই, এক দুই করতে করতে। গড়াতে গড়াতে ওর পিছু নেই, দুর থেকে শোনা যায় আরো দুটি পাখির মৃদু আলাপ।

একটা হুট্টিরি পাখিকে চিৎ হয়ে পা দুটো আকাশের দিকে তুলে দিতে দেখলাম। মেয়ে হুট্টিরি ডিম পাড়ার সময় ভাবে, সে যে বিশাল ডিম পাড়বে তাতে পৃথিবী ভেঙে যেতে পারে, তাই আকাশের দিকে ডিম পাড়ছে ভেবে চিৎ হয়। আমি আগ্রহ নিয়ে হুট্টিরি পাখিটার দিকে তাকাই। তীব্র স্বরে পাখিটা ডেকে চলে ট্টি, ট্টি, হুট্টিটি, হুট্টিটি। যে দিগন্তরেখা ছিলো অসীমে তা যেন নিঃশ্বাসের নৈকট্যে এলো। এতো মধুর আলো, মনে হচ্ছে এর শেষ নেই; সবচেয়ে উজ্জ্বল, ধীমান জায়গা থেকে নেমে এসেছে এই নিসর্গ বিষ্ফোরণ আর সেই সাথে বালির ওপর, পানির ভিতর ঝাউয়ের পাতায় – যেখানে যা কিছু আছে সবই আলো ছড়াচ্ছে, সবাই জেগে উঠছে।

কোন রাতে লোকালয় ধরে বহুদূর চলে যাই। আধো অন্ধকারে খড়বাঁশের বাড়িগুলো ঝোপঝাড়ের মতো মনে হয়। সেইসব পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে আরো দূরে যাই। আবার নদীর রেখা, আবার পাখির ডাক – আবার আকাশ। পাড়ে বসে থাকি, উঁচু পাড় থেকে খেলার মাঠের মতো চরগুলোর দিকে তাকাই। একরাতে ঐ রকম এক জায়গায় তিনটা লোক মিলে চতুর্থ একজনকে হত্যা করতে দেখলাম। ওরা টেরই পায়নি আমি রয়েছি। আক্রান্ত ব্যক্তির মুখবাঁধা আর্তচিৎকারে পাখিরা পর্যন্ত পালিয়ে চলে গেলো। বাতাস স্তব্ধ হতাশ্বাসে গোঙালো। তবু আমি বসে থাকলাম। ওরা সদ্যমৃত লোকটার শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ব্যাগে ভরে নিয়ে গেল। ভেবেছিলাম ওরা চলে গেলে লোকটাকে চেনার চেষ্টা করবো, কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না।

কিন্তু রাতের পর রাত চলে গেল, শিকারীর সেই দৃশ্যের মতো আমার কিছু দেখা হলো না।

আমাকে ময়মনসিংহ যেতে হবে, আবারো কচ্ছপ শিকারীর সাথে দেখা করতে। ওখানে রয়েছে এক ইহলৌকিক অমরতা। এই দীর্ঘজীবী (তিনশ বছর?) যদি দয়া করে তাহলেই আমাদের শোবার/সঙ্গমের ঘরের কাঁচের কিউব নিয়ে যে সমস্যায় পড়েছি তার সুরাহা হবে। বউয়ের সাথে কথা বলেছি; তিআকে কচ্ছপের আইডিয়া জানাতে হতাশায় ও কালো হয়ে গেল। শুধু ঘন ঘন মাথা নাড়াতে লাগলো আর বললো, ‘তাকি করে হয়, আমি তো ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম…’ তিআ ওর বড় বড় চোখগুলো ভাবনায় আচ্ছন্ন করে আমাকে ভোলাতে চায়, কিন্তু আমি জানি তিআ এখনো কিছু ভেবে উঠতে পারেনি। হয়তো সময় পেলে একদিন খুঁজে বের করতে পারতো, কিন্তু এখনো পারেনিও। আমি বললাম, ‘একটা সোনালী রঙের বাচ্চা কচ্ছপ… কেমন হয় বলতো … শুনি?’ তিআ প্রবল বেগে মাথা নাড়ায় আর বলে, ‘না…আ…’  ওর এই নঞর্থক ভাবনাটা আর্তনাদের মতো ঠেকে… আমি বলি ‘দেখো তিআ… আমরা আর কদিন… কিন্তু ও কতোকাল যে থাকবে… এই শহরের কেউ তার শেষ দেখতে পারবে না… তারপরও থাকবে, বুঝে দেখ, অদ্ভুতভাবে থাকবে, নিজেদেরকেও শিকারী ভাবা যাবে, কচ্ছপ শিকারী… আর যদি ওসব ঘটেই…’

যদিও নদী নেই – তারপরও তিআ মুর্ছা যেতে চায়। আমি কিছুতেই তিআকে রাজি করাতে পারি না। কিন্তু আমি কচ্ছপ শিকারীর কাছে যাবোই।

 

রচনা: ১৯৮৯

লেখকের নোট:: বাংলা ভাষায় স্ত্রী-বাচক সর্বনাম নাইতাই আমি ‘সে’ কে পাল্টে করেছি ‘শে’।

 

English Version

The following two tabs change content below.
Avatar photo

কাজল শাহনেওয়াজ

কবি ও গল্পকার। জন্ম ১ জুন, ১৯৬১;বিক্রমপুর; থাকেন ঢাকায়, ধানমন্ডিতে। প্রকাশিত কবিতার বই – ছাঁট কাগজের মলাট (১৯৮৪), জলমগ্ন পাঠশালা (১৯৮৯), রহস্য খোলার রেঞ্চ (১৯৯২), সঙ্গীত পরিবারে সতীর আত্মহত্যা (১৯৯৮), আমার শ্বাসমূল (২০০৭), কাঠকয়লায় আঁকা তোমাকে আমার (২০০৯), তালগাছ হাতির বাচ্চা (২০১১)। গল্পের বই – কাছিমগালা (১৯৯৩), গতকাল লাল (২০০৭), কাছিমগালা ও গতকাল লাল (২০১১)। সম্পাদনা করেছেন – বিকল্প কবিতা (যৌথভাবে রিফাত চৌধুরী’র সাথে, ১৯৮৯), ফৃ (লিটল ম্যাগাজিন, ১৯৯৫ – ১৯৯৮), ফৃ গ্রন্থিকা সিরিজ (১৯৯৮ – ৯৯, ২০০৭, ২০১১)।
Avatar photo

Latest posts by কাজল শাহনেওয়াজ (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →