‘আনবাড়ি’র অংশ
সমসাময়িক বাংলা গদ্য এবং গল্পের নজিরগুলা আমরা রাখতে চাই বাছবিচার-এ। বিদেশে/প্রবাসে যাঁরা থাকেন তাঁরা ম্যাক্সিমাম সময়ে দেশ বিষয়ে চিন্তিত থাকেন বইলা লিখতে বসলেই এই বিষয়ে উৎকণ্ঠিত হইতে থাকেন । বিদেশে গেলেই দেশ ও দেশের মানুষ নিয়া লিখতে হবে, এইরকম একটা চাপও সম্ভবত তৈরি হয় অথবা বিদেশ বইলা যে কিছু নাই সেইটা দেশ সম্পর্কে বেশি বেশি বইলা প্রমাণ করা লাগে। এর বাইরে, বিদেশে থাকা বাংলাভাষার লেখকেরা যে বিদেশ নিয়াও গল্প লিখতে পারেন এবং লিখেন, তার এক্সজাম্পল হিসাবে পড়া যাইতে পারে, এই উপন্যাসের অংশ।
_______________________________________
লুনার (লুনা রুশদী) আর আমার যৌথ খামার এই বই ‘আনবাড়ি’, নামখানা আমার দেয়া, সাধখানা দু’জনেরই অনেকদিনের। যদিও আমরা ভৌগোলিক প্রতিপাদস্থানে থাকি প্রায়, দূর থেকেও দু’হাতে দুইরকম বাজনা বাজানো সম্ভব নিশ্চয়ই। বইয়ের নামটা পরবাস অর্থে দেয়া, এই পরবাস নিজভূমেও হতে পারে, মিসফিটদের জন্যে সব দেশই কিনা প্রবাস। শুধু প্রবাসের গল্প বললে হয়তো ভুল বলা হবে তাই। ‘আনবাড়ি’ প্রকাশিত হবে আগামী বইমেলা ২০১৪তে, প্রকাশক শুদ্ধস্বর।
::সাগুফতা শারমীন তানিয়া
______________________________________
আমার দিন-২
হালকাচুলো আমাদের নিতে এসেছে। আম্মা শজারুর মতন ঝমঝম করতে করতে আর আমি পকেটে হাত পুরে ভোমরার মতো গুনগুন করতে করতে ওর পিছু পিছু চললাম। আম্মা আহ্লাদী গলায় বল্লো- “তুই কি গান করিস?” আমি বললাম- “বামি বান বরি না।” আম্মা রেগে গিয়ে গুম হয়ে রইলো। লেকের পাশে আমরা থামলাম। আম্মা আমাকে কোলে নিয়ে ঢেউয়ের উপর বয়ার মতন ডুবু-ভাসু করা গাঙচিল দেখালো- “দ্যাখ কি সুন্দর গাঙচিল।” আমি উপুড় হয়ে কালো কাদার উপর শুকনো রুপালি বালির দানা দেখতে দেখতে বলি- “ওটা হাঁস।” -“না রে ওটাকে বলে গাঙচিল।” -“না ওটা হাঁস।” -“আমি বলছি ওটা গাঙচিল।” -“হাঁস।” -“গাঙচিল। ওটার লেজ ছুঁচোলো।” -“ওটা হাঁস কারণ ওটা শাদা।” আম্মা কাঁদোকাঁদো হয়ে যায়- “তুই এত বাঁদর একটা ছেলে।” এই হয়েছে এদের, বয়ার মতন পাখিটা গাঙচিল না হলে আমাকে বাঁদর হতে হবে- আপনজনের হাতে এ কি হেনস্থা। আমি আম্মার গায়ে খোশামুদে গা ঘষে বলি- “হুমম, বেটা বাঁস।” আম্মা অসম্ভব রেগে যায় আর হালকাচুলো হাসতে হাসতে আমাকে কাঁধে তুলে নেয়। আমি তখনকার জন্যে হালকাচুলোকে সয়ে নিই। আমরা হলুদ হলুদ বাতি ঘাড়ের উপর জ্বলা রেস্তোরাঁতে খেতে বসি। আমি আলুভাজা মিইয়ে যাবার পর সেটা দিয়ে বুমেরাং বানাই, ঘোড়ার পেটে গোড়ালি দিয়ে লাথি দিয়ে বলি- “আরো জোরে।” হালকাচুলো উহঃ করে ওঠে। টেবিলে ধূম ছাড়তে ছাড়তে সেদ্ধ গেঁড়িগুগলি ইত্যাদি আসে, জোরদার গন্ধ কচি পেঁয়াজের আর রসুনের। আম্মা আর হালকাচুলো হাঁসেদের হিলহিলে খাদ্য হামলে পড়ে খেতে থাকে। আমি চোখ সরু করে দেখি- ওদের লেজ ছুঁচোলো কি না। আম্মা আমাকে সাধে- “খাও সোনা, এর নাম মাজল্স। দ্যাখো কি মজার একটা রবারের পুতুল শুয়ে আছে ঢাকনির ভিতরে।” পুতুলহীন ঢাকনিগুলি চাউনির পাঁজা হয়ে হাঁ করে চেয়ে আছে। আমি ঘাড় বেঁকিয়ে বলি- “আমি চাই না। এগুলি মাজল্স না। এগুলি প্লাম।” -“মাজল্স এগুলি। খেয়েই দ্যাখো।” আমি আরো জোরদার গলায় বলি- “এরা প্লাম, এরা কালো।” আম্মা আমার সাদাকালো জ্ঞানে অতিষ্ট হয়ে উঠবার আগে একঝলক মাজল্সগুলির দিকে তাকায়, তাদের প্লামরঙা কালচে বেগুনি ঢাকনার ভিতরে মুক্তার ফিকে রঙ চিকচিক করছে, হালকাচুলো আমার কবিত্বের তারিফ করে। আম্মা আমার কাব্যপ্রতিভার আভাস পেয়ে ঠান্ডা হয়ে আসে। এত শান্তি আমার ভাল লাগে না। আমি বলি- “বাড়ি বাব, ব্লাম বাব না।” হালকাচুলো হাসতে হাসতে বলে- “বপাল!”
আমার দিন-৩
আম্মা আর আমি গরমের দিনে পাশাপাশি গড়াই, যেন এটা কাদার বিছানা। পাশবালিশগুলি লম্বা দাঁড়ার শর। আর আমরা দুই হিপো। হিপো একের গায়ে হিপো দুই গড়াগড়ি খায়। সারা বেলা। হিপো একের গায়ে পরিজের গন্ধ। হিপো দুইয়ের গায়ে রাবারের ওয়েলিংটন আর চটকানো পাতার গন্ধ। আমাকে কোলে ঠেসে পুরে আম্মা বাগানে নেমে যায়- ভেজা কাপড়ের দড়িগুলির জট খুলতে খুলতে মেলতে থাকে। আমি ছোট্ট বাঁদরের মতন কোল থেকে ঝুলি। কাপড়গুলির গায়ে হলদে লেবু সাবানের গন্ধ। রোদ উঠলে আমাদের বাগানে পড়শীদের পেটমোটা বেড়াল খেলতে আসে। পর্চে দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে পেটমোটার মা ভাবতেই থাকে- কালো মায়ের পেটে শাদা বাচ্চা আর শাদা মায়ের পেটে কালো বাচ্চা কি করে জন্মায়। আমি ওকে নাম ধরে ডাকি- ‘পেটমোটা’, আম্মা বকলে ডাকি জনাব বলে। ঝনঝনে ঘাসে শুয়ে আমি আর আম্মা দুই হিপো আকাশে হিপো-আকারের মেঘ দেখি। হিপো শুকিয়ে জিরাফ হয়। তারপর আবার ডাইনোসর তারপর পালক ছেঁড়া রাজহাঁস। আবার একটা জিরানো বেড়াল। আম্মা বলে- “দ্যাখ এখন এটা পেটমোটা।” আমি বলি- “জনাব পেটমোটা।” আম্মা আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য আমার দাঁত মাজতে নিয়ে যায়। ফিরে এসে দেখি মেঘ এখন বীভার। বাতাস ছেড়েছে। লাটিমগাছগুলির পাতা উলটে উল্টোদিকের পাতার শাদা শেমিজ দেখা যাচ্ছে, লাটিম পাকবার সময় আসেনি এখনো। আমরা লেবুসাবান গুলে বুদ্বুদ বানাই। সোনালি। বেগুনি। সবুজ। ওদের দেখায় কাদাজলের চিড়িংমাছের ড্যাবড্যাবে চোখের মতন। কেউ যায় মগডালে। কেউ নামে ঘাসে। কেউ আমাকে অবাক করে দিয়ে বাসার দেয়াল ধরে বেঁকে ওপাশের দেয়ালে চলে যায়। কেউ আকাশের বীভার পর্যন্ত যাবে ভেবেই আবার নেমে আসে টালির ছাদে।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
তারপর আমরা বসে থাকি- পোস্টম্যান কখন আসবে। পোস্টম্যান ঝুলিতে করে অনেক উপহার আনে, চকচকে পোস্টকার্ড, বই আর খেলনা। অনেক সময় আমাদের বাসা পর্যন্ত আসতে আসতে ওর খেলনা ফুরিয়ে যায়, সেদিন আর আমি কিছু পাইনা। বেলা বাড়লে নানী আসে আমাদের বাড়িতে। চোখ সরু করে আমাকে দেখে, যেভাবে কিনবে কি কিনবে না ভাবতে ভাবতে নানী উলের বল হাতে তুলে নিয়ে আবার নামিয়ে রাখে সেভাবে নানী আমাকে তুলে নিয়ে ওজন পরখ করে নামিয়ে দেয়। ভুরু কুঁচকে বলে- “ওর তো ওজন বাড়ছে না। তুই কি খাওয়াস?” আম্মা বলার আগেই আমি ফিরিস্তি দিই, হিপো হিসেবে আমি কি কি খেয়েছি, পরে বাঁদর আর বীভার হিসেবে আরো কি কি। নানী তারিফের চোখ করে তাকায় আমার দিকে, তারপর আম্মার দিকে গোসাপের মতন করে তাকায়- মা হওয়া কত কঠিন এইসব নিয়ে কঠিন কঠিন সব কথা বলতে থাকে। মা হওয়া মোটেই কঠিন না। কাদায় হিপো আর তার বাচ্চাদের মতন গলাগলি করলেই তো হয়।
আম্মা জবাব দেয় না। নানী দস্তানা পরে বাগানে আলু তুলতে নামে। সারাদিন খেটে খুঁটে রেঁধে আর আমাকে এক-গলা খাইয়ে হিপো বানিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ নানী চলে যায়।
দু’দিন হলো পেটমোটা আর তার বাবা-মা পাশের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। খালি বাসাটার বেড়ায় শাদা গোলাপ ফু্টেছে অনেকগুলি। রাস্তার ল্যাম্প জ্বললে সেটা হলুদ গোলাপের গাছ হয়ে যায়। বাইরে নেলপলিশ রঙ মেঘ। বাইরে হলুদ গোলাপ। সন্ধ্যাবেলার ঝিঁঝি ডাকছে বাগানে। পেটমোটা ঝিঁঝিদের মোটেই সইতে পারতো না। আমার পাতের চিবোনো সসেজ ভালবাসতো। এখন যে কে তাকে সসেজ চিবিয়ে খেতে দিচ্ছে!
আম্মা কম্পিউটার খোলে। একটু পরেই সেখানে হালকাচুলো আসে। আমাকে ডাকতেই আমি এসে বসি সামনে। হালকাচুলো কাশতে থাকে। বিষম খেলে আম্মা আমাকে যেমন করে পিঠ থাবড়ে দেয়- আমিও তাই করি কম্পিউটারের ডালায়। সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আম্মা বিরক্ত হয় না, হোহো করে হাসতে থাকে। প্লাস্টিকের ছোট বালতি খুলে আমাকে দিয়ে বলে- “খা, এর নাম হাওয়াই মিঠাই।” আমি মুখ গোঁজ করে বলি- “না, এটা মেঘ।” -“তাহলে মেঘই খা।” -“না এটা খড়ের গোলা। আমি বীভার।” -“তাহলে খড়ের গোলাই খা।” -“না এটা চিবোনো ঝিঁঝি। আমি পেটমোটা।” আম্মা আমাকে সটান কোলে তুলে নেয় আর আমার দিকে রাস্তার ল্যাম্পের মতন তাকিয়ে বলে- “এটা হাওয়াই মিঠাই, খড়-কাপাশতুলা-প্যাপিরাস এইসব হাবিজাবি কিচ্ছু না আর তুমি আমার বাচ্চা, এখন এটাই খাচ্ছ।”
আমি হাঁড়িচাচার গলা বের করে কান্না শুরু করি।
আমার দিন-৪
মাঝে মাঝে আম্মা দেয়ালে টাঙানো ছবি হয়ে যায়। কথা নাই। নড়া নাই। হাসি আছে কিন্তু আসলে নাই। আমি আঙুল দিয়ে আম্মার পেটে গোল্লা আঁকি, বলি- একটা গোল্লা। আম্মার বুকেও গোল্লা আঁকি- বলি, দুই নম্বর গোল্লা, তিন নম্বর গোল্লা। আম্মা বিরক্ত হয়ে উঠে যায়, বেড়ালগুলিকে ঠাসতে থাকে যেন আরেকটু ঠাসলেই ওরা রুটি হয়ে যাবে। আমি আবার গিয়ে আম্মার কপালে আঙুল দিই, কত লাইন। বাঁকা বাঁকা লাইন। নাকে আঙুল দিয়ে আঁকি, এটা ত্রিভূজ। গালে আঙুল দিয়ে আঁকতে গিয়ে আমার আঙুল গর্তে চলে যায়- আমি বলি- হায় হায় এটা ভাঙা! আম্মা হেসে ফেলে, এটা ভাঙা না সোনা, এর নাম টোল। আমি টোলের উপর বিরক্ত হই, আবার গোল্লা গুনতে চেষ্টা করি, আম্মা আমার হাত সরিয়ে দেয়।
আম্মা রেডিও ছাড়ে, দৈত্যর দাঁত মাজার শব্দ হয়, দৈত্যর কুলকুচি করার শব্দ হয়, তবে দৈত্যগুলি দূরে। সকালের রেডিওতে অনেক দৈত্য থাকে। সকাল হলে আমি আর কাউকে শুয়ে থাকতে দিই না। আম্মার মাথার বালিশ সরিয়ে বলি- কুককুরুক কুক আমি লাল মোরগ। আমার সবসময় মোরগা হতে ভাল লাগে না। আমি আম্মার কানের কাছে এসে চেঁচিয়ে বলি- স্কোয়াআআআআআক! তখন আমি টিয়াপাখি। আম্মা টিয়াপাখিকে পোকা খুঁটতে দিয়ে উপুড় হয়ে যায়, তখন আম্মার পিঠে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে আমি বলি- আমি কুমিরের বাচ্চা, তুমি মা কুমির।
আম্মা যেসব দিনে ছবি হয়ে যায়, সেসব দিনে কুমির হতে চায় না। অজগরের মতন গা মোচড়াতে থাকে। আমরা দুই কাদাখোঁচা নদীর ধারে পিকনিক করতেও পারি না। আম্মা সেদিন পোকা খেতে চায় না। আমাকে গুঁতো দিয়ে একবাটি মাখনভাত আর ডিমপোচের সামনে ঠেলে দেয়। আমি একটু একটু করে চামচে তুলে ভাত খাই। ডিম খাবার সময় আমি হনুমানের মতো শব্দ করি। পাশবালিশের দড়িটা ধরে ঝুলি। আম্মা ছবি-ছবি মুখে তাকিয়ে দেখে। কোনো কথা নাই। আমি বেড়ালটাকে ভ্যানিশিং ক্রিম মাখানোর চেষ্টা করি। টিনের ট্রেনগুলিকে বালিশে কাত করে শুইয়ে রাখি। তোয়ালে দিয়ে লেজ বানিয়ে সারাদিন হাঁটাহাঁটি করি। আম্মা রাগেও না। কিছু বলেও না।
তারপর আবার আম্মা ছবি থেকে বের হয়ে আসে। মা-কুমির হয়। সারস হয়। পোকা খুঁটে খায় আর আমাকে আর অন্য ছানাদের (বেড়ালগুলি) ভাগ করে দেয় কেঁচোকেন্নো। আমার সাথে কম্বল দিয়ে খরগোশের গর্ত বানায়। স্নো ম্যান বানায়। স্নো ম্যানের নাকের গাজর আর চোখের কাঠকয়লা এগিয়ে দেয়। নিজের মাফলার জড়িয়ে দেয় স্নো ম্যানের গলায়। আমি খুশি হয়ে আমার দুই হাতের তেলোয় করে তেল নিয়ে আম্মার গায়ে আর কাপড়ে মেখে দিই। বলি- তোমাকে চকচকে বানাই। আম্মা তখন রাবার বেলুনের মতন চকচকে হয়ে যায়।
উপক্রমনিকা
‘রোজনামচা’
তোমার বাবার ভীষণ অপ্রিয় ছিল ব্রেড পুডিং, আমার ভাল লাগতো ঐ ডিমেল ঘোলের ভিতরে ডুবে রুটির পিঠে রুটি হয়ে ডুবে থাকা। ঝড় হলে ছোটবেলায় আমি বাসার মানুষ গুনতাম, সব্বাই বাসায় কি না, সবাইকে বাসায় দেখতে পেয়ে শান্তিভরা প্রাণে ঝড় দেখতে জানালায় যেতাম। বড় আবাসিক ছিলাম আমি। মশারির নীচের চৌকো পৃথিবীতে আমরা ভাইবোনেরা বাবামায়ের মাঝখানে হাইফেন হয়ে নয় ব্যাক-স্ল্যাশ হয়ে শুয়ে থাকতাম, আমার মনে হতো একটা খাটের ট্রাফে যত রকমের পারিবারিক সদস্যকে রাখা যায় তার সবগুলিকে রাখা, ব্যাকরণসম্মত করে। সেটা আমার প্রিয় ছিল। তোমার বাবার আর আমার প্রথম থাকবার জায়গাটা ছিল একটা টুলশেড, তার একধারে কিছু ভাঙা সাইকেল, আরেকধারে দেয়ালে ক্যাথরিন হেপবার্ন-গার্বো-বার্গম্যান ঠাসাঠাসি হয়ে থাকতো একটি পাঁজায়- ঐ ছিল আমাদের দুরন্ত শীতের বাতাসের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা। দ্যাখো কত্ত মানুষ আমাদের সেই ছোট্ট শেডে। তোমার জন্মের পরেও আমার তেমনি মনে হতো, আমরা তিনজন একগোছা শাক হয়ে নয় একতাড়া নোট হয়ে একটিমাত্র বিছানার থালায় গচ্ছিত থাকব। সেটা সম্ভব হয়নি। সে গল্প থাক।
একটা অনন্ত কাদার মাঠে একটা অনন্ত শুয়োরের মতন দাঁড়িয়ে আছি, যোনি অবমুক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকা অনায়াস কোনো প্রাণীর মতন, যেন বিশ্বের বাকি বরাহকূলকে আহ্বান করে। দৃষ্টিপথে শূণ্য দিগন্ত আর উলুর মাঠ। মুখে শুষ্ক খড়ের নির্বিশেষ স্বাদ। এখন আর চমকে উঠে মনেও পড়ে না এই বিবর্ণ জীবনই কি আমার জীবন? এখানে চমকানো নিষেধ। এখন আর আয়নায় গিয়ে সকাতরে সেই পুরাতন প্রশ্ন করা চলে না, আয়না আয়না তিনভূবনে কে বেশি রূপসী বলো আমায়? আয়না সবসময় বলবে, সে, সে, সে, তাহারা। এখানে প্রশ্নও নিষেধ। এই প্রশ্নহীন- আকারহীন-চমকহীন (অথচ বিদ্যুদ্গর্ভ) জীবনটাই আমি।
তবু তোমার জন্য বারে বারে খেলনা আনতে যাবার মতন করে (যার নাম বাবা), আমার জন্যে লেবেঞ্চুসরঙা কাঁচের ঘর আনবার জন্যে (যার নাম সংসার), আরেকটা ডুবে থাকা রুটির কাঁধে রুটি হয়ে ডুবে থাকার জন্যে (যার নাম সখা) কতবার বের হতে হয় বলো! আমি বড় ভয় পাই ঝড়ের ভিতরে একলা বাড়িতে দেয়াল পাহারা দিতে। বড় ভয় পাই রাতের কড়া-নাড়া। আমি বড় ভয় পাই জীবনের আপাতবিশুষ্ক দিনরাত্রিগুলির বৃথা অপচয়, আয়ূক্ষয়। যেন আমার কোচড় থেকে ঝরে যাচ্ছে অবিরাম ঝমঝমে মোহর। শুধু দিবারাত্রির মোহরসমেত আবার যাই দাসের বাজারে বিকিকিনি করতে।
তোমার তুলতুলে মুখ এক অতুল বিস্ময়চিহ্ন, এমন করে সুরকির দেয়ালেও প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা ফুটিয়ে তোলে অজস্র বিস্ময়বোধক চিহ্ন- তুমি অবাক হয়ে আমাকে দ্যাখো, আমার কাঁদোকাঁদো মুখে অদৃশ্য মোহর গুনতে বসা দ্যাখো। আমি জানি জীবনের যত মুহূর্ত আমি তোমাকে বুকে-পিঠে-কোলে নিইনি, সারা শরীর থেকে শাদা শাদা শেকড় বের করে তোমাকে শুষে নিইনি, সেইগুলিই আমার অফেরতযোগ্যভাবে হারিয়ে যাওয়া মোহর, আমার সুবর্ণমুদ্রা, আমার ক্যালাইডোস্কোপের ছবি। তারাই আমার আসল অপচয়।
আকাশময় ঘুড়ির ভিতরে কোনটা আমার? ছিন্ন সুতোর লাটাই কোলে বসে আছি।
২১/১২/২০১৩
লন্ডন ইস্ট, ইউ কে
সাগুফতা শারমীন তানিয়া
Latest posts by সাগুফতা শারমীন তানিয়া (see all)
- ‘আনবাড়ি’র অংশ - ডিসেম্বর 24, 2013