আবুল হাসানের কয়েকটা জনপ্রিয় কবিতা
বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে খ্রিষ্টীয় গত শতকের সেভেনটিইসে যাঁরা কবিতা লিখছেন, অ্যাজ অ্যা টেনডেন্সি তাদের কবিতা সমাজ-রাজনীতির নিচে চাপা পইড়া গেছে বইলা অভিযোগ আছে। অবশ্য সমাজ-রাজনীতি ত প্রায় সবসময়ই আছে কবিতার ভিত্রে, কিন্তু সমাজ-রাজনীতি যেইভাবে চেইঞ্জ হইছে, কবিতাগুলা যেহেতু লেখা হয়া গেছে চেইঞ্জ আর হইতে পারে নাই – এইরকমের একটা ঘটনা ঘটছে। ব্যাড লাক অবশ্যই!
তবে উনাদের মধ্যে মইরা গিয়া অনেকটাই বাঁইচা আছেন কবি আবুল হাসান। উনি লাকি; কম-বয়স উনার কবিতারে অনেকদিক দিয়াই সেভ কইরা গেছে; পঁচিশ বছর বয়সে এইরকম কবিতাই ত লেখার কথা! আনফরচুনেটলি নির্মলেন্দু গুণ’রে ঊনসত্তর বছর বয়সে এখনো একইরকমের কাজ কইরা যাইতে হইতেছে। মানে, মরার আগ পর্যন্ত উনারা পঁচিশেই থাকবেন, অথবা সত্যিকার অর্থে পঁচিশ বছর বয়সেই উনাদের ক্রিয়েটিভ মৃত্যু সম্ভব হইছে।
মিড এইটিইসে আবৃত্তিচর্চার পেশায় কাঁচামাল হিসাবে অন্যান্য কবিদের পাশাপাশি আবুল হাসানের কবিতার ব্যবহারও সম্ভব হয়; যেই কারণে সাহিত্যসমাজের বাইরে কলেজ-ভার্সিটি’তে পড়া শিক্ষিত সমাজে উনার একটা পরিচিতি তৈরি হয়, কিছু কবিতা সেই পারসপেক্টিভে জনপ্রিয় হয়।
এমনিতে উনার কবিতা ইনটেন্স, গভীর আবেগের মামলা; ইথিক্যালি প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের কালচারাল মেনিফেস্টো এবং এসথেটিক্যালি ছিল বা আছে এক ধরণের আউটস্পোকেননেস-এর চর্চা হিসাবে, যেইটা রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং তসলিমা নাসরীন হইয়া আর্লি এইটিইস পর্যন্ত কনটিনিউ হইছে। এরপরে বাংলাকবিতা যে কম-কথা-বলা এবং জীবনের-গূঢ়-রহস্য-আবিষ্কারে নামলো সেইটা এই টেনডেন্সির অ্যাবাউট টার্ন হিসাবেও দেখা যাইতে পারে। উনার ইনটেন্সিটির চর্চা এখনো এক ধরণের পুনরাবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনার মধ্যেই আছে।
এইরকম জায়গায় দাঁড়াইয়া, বাংলা-কবিতার একটা প্রবণতা হিসাবে আবুল হাসানের কবিতা আবার পড়ার রিকোয়েস্ট ত করা যাইতেই পারে।
ই. হা.
______________________________________________
আবুল হাসান ।। চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ ।। জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন ।। উচ্চারণগুলি শোকের ।। অসভ্য দর্শন ।। মিসট্রেসঃ ফ্রি স্কুল স্ট্রীট ।। উদিত দুঃখের দেশ ।। নিঃসঙ্গতা ।। গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর ।। যুগলসন্ধি ।। বিচ্ছেদ ।। ঝিনুক নীরবে সহো ।। এপিটাফ ।। তোমার মৃত্যুর জন্য ।। জ্যোস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন ।। অপরিচিতি ।।
______________________________________________
আবুল হাসান
সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
মায়াবী করুণ
এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ম তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর?
আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে,
যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারা এঘরে ওঘরে যায়
সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী
তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে –
এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর,
একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা,
তুই যার অনিচ্ছুক দাস!
হয়তো যুদ্ধের নাম, জ্যোৎস্নায় দুরন্ত চাঁদে ছুঁয়ে যাওয়া,
নীল দীর্ঘশ্বাস কোনো মানুষের!
সত্যিই কি মানুষের?
তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত চিল, কোনোদিন
ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙ্গুল?
ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?
চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ
আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে সরকারী লোক, পুলিশ বিভাগে চাকরী কোরেও
পুলিশী মেজাজ কেন ছিলনা ওনার বলুন চলায় ও বলায়?
চেয়ার থেকে ঘরোয়া ধূলো, হারিকেনের চিমনীগুলো মুছে ফেলার মতোন তিনি
আস্তে কেন চাকর বাকর এই আমাদের প্রভু নফর সম্পর্কটা সরিয়ে দিতেন?
থানার যত পেশাধারী, পুলিশ সেপাই অধীনস্থ কনেস্টবল
সবার তিনি একবয়সী এমনভাবে তাস দাবাতেন সারা বিকাল।
মায়ের সঙ্গে ব্যবহারটা ছিল যেমন ব্যর্থ প্রেমিক
কৃপা ভিক্ষা নিতে এসেছে নারীর কাছে!
আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে দেশে যখন তাঁর ভাইয়েরা জমিজমার হিশেব কষছে লাভ অলাভের
ব্যক্তিগত স্বার্থ সবার আদায় কোরে নিচ্ছে সবাই
বাবা তখন উপার্জিত সবুজ ছিপের সুতো পেঁচিয় মাকে বোলছেন এ্যাই দ্যাখোতো
জলের রং-এর সাথে এবার সুতোটা খাপ খাবে না?
কোথায় কাদের ঐতিহাসিক পুকুর বাড়ি, পুরনো সিঁড়ি
অনেক মাইল হেঁটে যেতেন মাছ ধরতে!
আমি যখন মায়ের মুখে লজ্জাব্রীড়া, ঘুমের ক্রীড়া
ইত্যাদি মিশেছিলুম, বাবা তখন কাব্যি কোরতে কম করেননি মাকে নিয়ে
শুনেছি শাদা চামেলী নাকি চাপা এনে পরিয়ে দিতেন রাত্রিবেলায় মায়ের খোপায়!
মা বোলতেন বাবাকে তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা?
ঘুষ খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,
কতরকম ফন্দি আটছে কত রকম সুখে থাকছে,
তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?
বাবা তখন হাতের বোনা চাঁদর গায়ে বেরিয়ে কোথায়
কবি গানের আসরে যেতেন মাঝরাত্তিরে
লোকের ভীড়ে সামান্য লোক, শিশিরগুলি চোখে মাখতেন!
এখন তিনি পরাজিত, কেউ দ্যাখেনা একলা মানুষ
চিলেকোঠার মতোন তিনি আকাশ দ্যাখেন, বাতাস দ্যাখেন
জীর্ণ ব্যর্থ চিবুক বিষণ্ন লাল রক্তে ভাবুক রোদন আসে,
হঠাৎ বাবা কিসের ত্রাসে দুচোখ ভাসান তিনিই জানেন!
একটি ছেলে ঘুরে বেড়ায় কবির মতো কুখ্যাত সব পাড়ায় পাড়ায়
আর ছেলেরা সবাই যে যার স্বার্থ নিয়ে সরে দাঁড়ায়
বাবা একলা শিরঃদাঁড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন, কী যে ভাবেন,
প্রায়ই তিনি রাত্রি জাগেন, বসে থাকেন চেয়ার নিয়ে
চামেলী হাতে ব্যর্থ মানুষ, নিম্নমানের মানুষ!
জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন
মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ কোরে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন?
আধিপত্যে এত লোভ? পত্রিকা তো কেবলি আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর…
মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলোনা!
পৃথিবীতে তবু আমার মতোন কেউ রাত জেগে
নুলো ভিখিরীর গান, দারিদ্রের এত অভিমান দেখলোনা!
আমাদের জীবনের অর্ধেক সময় তো আমরা
সঙ্গমে আর সন্তান উৎপাদনে শেষ কোরে দিলাম,
সুধীবৃন্দ, তবু জীবনে কয়বার বলুন তো
আমরা আমাদের কাছে বোলতে পেরেছি,
ভালো আছি, খুব ভালো আছি?
উচ্চারণগুলি শোকের
লক্ষী বউটিকে
আমি আজ আর কোথাও দেখিনা,
হাঁটি হাঁটি শিশুটিকে
কোথাও দেখিনা;
কতগুলি রাজহাঁস দেখি,
নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি,
কতগুলি মুখস্ত মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখিনা
শিশুটিকে কোথাও দেখিনা!
তবে কি বউটি রাজহাঁস?
তবে কি শিশুটি আজ
সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?
অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো,
অনেক রক্ত গেলো,
শিমুল তুলোর মতো
সোনারূপো ছড়ালো বাতাস।
ছোটো ভাইটিকে আমি
কোথাও দেখিনা,
নরোম নোলক পরা বোনটিকে
আজ আর কোথাও দেখিনা!
কেবল পতাকা দেখি,
কেবল উৎসব দেখি,
স্বাধীনতা দেখি,
তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?
অসভ্য দর্শন
(নির্মলেন্দু গুণকে)
দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরোম কুঠার তাও রাজনীতি,
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!
বোন তার বেণী খুলছে যৌবনের অসহায় রোদে মুখ নত কোরে
বুকের ভ্রমর হাতে রাখছে লুকিয়ে – তাও রাজনীতি
তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি পুনরায়
মারামারি যুদ্ধ আর অত্যাচার, হত্যার আগ্রাসী খুন মানুষের
ছড়ানো বীর্যের ব্যথা, বিষণ্ন মিথুন
মহিলার রক্তের ভিতরে ভ্রুণ, সমস্যার ছদ্মবেশে আবার আগুন
উর্বর হচ্ছে, রাজনীতি, তাও রাজনীতি!
আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি
জীবনের অস্তিত্বে ক্ষুধায় মরছি রাজনীতি, তাও রাজনীতি আর
বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁ, খাঁ, খল,
তীব্র এক বেদেনীর সাপ খেলা দেখছি আমি; রাজনীতির তাও কি
রাজনীতি?
মিসট্রেসঃ ফ্রি স্কুল স্ট্রীট
প্লাষ্টিক ক্লিপের মতো সহস্র কোকিল যেই বনভূমি গেঁথে নেয়
সবুজ খোঁপায় ভোরবেলা – ময়ূরের পেখমের মতো খোলা রোদে বসে
ব্লাউসের বোতাম লাগিয়ে মিসট্রেস আসে ইশকুলে আর
কয় ঝাঁক বালকের নির্দোষ নিখিল ভরা ক্লাসরুমে এসেও সে শোনে
বনখোঁপা বাঁধা কোকিলের কাজল কূজন তার চুলে, চমৎকার
চিরোল গ্রীবায়, শেষে গৌর লাজুক শিয়রে শিহরিত শুধু
পেতে গিয়ে এক হারানো প্রেমের ঘ্রাণ, বয়ে নেয় সে তখন
কী যে এক আর্দ্র পরাজয় তার আত্মব্যস্ত অতীতের অথই সীমায়!
দেরি কোরে এসে ইশকুলে ক্লান্ত কর্ণেও ভরে নিতে হয় তাকে মাঝে মাঝে
হেড মিসট্রেসের শ্লীলতাবিহীন সাধুভাষা – আর তাই দেখে করুণাতে
আর্দ্র হও কখনো কি তুমি হে স্ট্রীট? বুঝে নিতে পারো তার
বিখ্যাত বেদনা? নারী, নারীই কেবল যদি বোঝে কোনো নারীর হৃদয় – তবে
তুমি ভূখন্ডের মানে এই ঢাকা শহরের এক সবুজ তনয়া, নারী
তুমি কি বোঝোনা তার তিরিশ বছর কাল কুমারী থাকার অভিশাপ?
বোঝো না কি
তিরিশ বছর কত কাঁদায় যৌবন ঐ কোকিলের পাষণ্ড রোদন!
মিসট্রেস, কালো মিসট্রেস, করুণকোমল ঐ রোদনরূপসী মিসট্রেস!
যেনো কোনো রেফ্রিজেরেটারে তার তুমুল হৃদয় রেখে আসে ইশকুলে,
ক্লান্ত! এখন অধীরা, যেনো কতদিন সে তার নিজের মুখ মোছেনা
আনন্দ অভিধায়!
অভিমানী, সর্বস্ব খোয়োনো ঐ মেয়ে –
মানসিক শ্রমে জব্দ জীবনধারিণী!
ওকে দয়া করো
হে ভোর,
হে স্ট্রীট,
শিশুক্লাস,
আর্ট খাতা,
বনের বিজন
সাঁঝবেলা!
বিষণ্ন ও কুমারীকে দয়া করো!
দয়া করো!
দয়া করো!
উদিত দুঃখের দেশ
উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো!
মানুষের লোকালয়ে ললিতলোভনকান্তি কবিদের মতো
তুমি বেঁচে থাকো
তুমি ফের ঘুরে ঘুরে ডাকো সুসময়!
রমণীর বুকের স্তনে আজ শিশুদের দুধ নেই প্রেমিক পুরুষ তাই
দুধ আনতে গেছে দূর বনে!
শিমুল ফুলের কাছে শিশির আনতে গেছে সমস্ত সকাল!
সূর্যের ভিতরে আজ সকালের আলো নেই সব্যসাচীরা তাই
চলে গেছে, এখন আকাল
কাঠুরের মতো শুধু কাঠ কাটে ফল পাড়ে আর শুধু খায়!
উদিত দুঃখের দেশ তাই বলে হে কবিতা, দুধভাত তুমি ফিরে এসো,
সূর্য হোক শিশিরের ভোর, মাতৃস্তন হোক শিশুর শহর!
পিতৃপুরুষের কাছে আমাদের ঋণ আমরা শোধ করে যেতে চাই!
এইভাবে নতজানু হতে চাই ফলভারানত বৃক্ষে শস্যের শোভার দিনভর
তোমার ভিতর ফের বালকের মতো ঢের অতীতের হাওয়া
খেয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চাই!
হে কবিতা তুমি কি দ্যাখোনি আমাদের ঘরে ঘরে তাঁতকল?
সাইকেলে পথিক?
সবুজ দিঘীর ঘন শিহরণ? হলুদ শটির বন? রমণীর রোদে
দেয়া শাড়ি? তুমি কি দ্যাখোনি আমাদের
আত্মহুতি দানের যোগ্য কাল! তুমি কি পাওনি টের
আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া চোখের কোণায় তুমি কি বোঝোনি আমাদের
হারানোর, সব হারানোর দুঃখ – শোক? তুমি কি শোননি ভালোবাসা
আজও দুঃখ পেয়ে বলে, ভালো আছো হে দূরাশা, হে নীল আশা?
নিঃসঙ্গতা
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত শোভা, অত স্বাধীনতা!
চেয়েছিল আরো কিছু কম,
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!
অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভীড়, অত সমাগম!
চেয়েছিল আরো কিছু কম!
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!
গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর
গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান ছিলাম।
জ্যোৎস্নায় ফেরা জাগুয়ার চাঁদ দাঁতে ফালা ফালা করেছে আমারও প্রেমিক হৃদয়!
আমিও আমার প্রেমহীনতায় গণিকালয়ের গণিকার কাছে ক্লান্তি সঁপেছি
বাঘিনীর মুখে চুমো খেয়ে আমি বলেছি আমাকে উদ্ধার দাও।
সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে পান করেছি মৃত্যু
হে কবি কিশোর
আমারও অনেক স্বপ্ন শহীদ হয়েছে জীবন কাঁটার আঘাত সয়েছি আমিও।
হৃদয়ে লুকানো লোহার আয়না ঘুরিয়ে সেখানে নিজেকে দেখেছি
পাণ্ডুর খুবই নিঃস্ব একাকী!
আমার পায়ের সমান পৃথিবী কোথাও পাইনি অভিমানে আমি
অভিমানে তাই
চক্ষু উপড়ে চড় ইয়ের মতো মানুষের পাশে ঝরিয়েছি শাদা শুভ্র পালক!
হে কবি কিশোর নিহত ভাবুক, তোমার দুঃখ আমি কি বুঝি না?
আমি কি জানি না ফুটপাতে কারা করুণ শহর কাঁধে তুলে নেয়?
তোমার তৃষ্ণা তামার পাত্রে কোন কবিতার ঝিলকি রটায় আমি কি জানি না
তোমার গলায় কোন গান আজ প্রিয় আরাধ্য কোন করতলও হাতে লুকায়
আমি কি জানি না মাঝরাতে কারা মৃতের শহর কাঁধে তুলে নেয়?
আমারও ভ্রমণ পিপাসা আমাকে নারীর নাভিতে ঘুরিয়ে মেরেছে
আমিও প্রেমিক ক্রুবাদুর গান স্মৃতি সমুদ্রে একা শাম্পান হয়েছি আবার
সুন্দর জেনে সহোদরাকেও সঘন চুমোর আলুথালু করে খুঁজেছি শিল্প।
আমি তবু এর কিছুই তোমাকে দেবো না ভাবুক তুমি সেরে ওঠো
তুমি সেরে ওঠো তোমার পথেই আমাদের পথে কখনো এসো না,
আমাদের পথ
ভীষণ ব্যর্থ আমাদের পথ।
যুগলসন্ধি
ছেলেটি খোঁড়েনি মাটিতে মধুর জল!
মেয়েটি কখনো পরে নাই নাকছাবি।
ছেলেটি তবুও গায় জীবনের গান,
মেয়েটিকে দেখি একাকী আত্মহারা!
ছেলেটির চোখে দুর্ভিক্ষের দাহ,
মেয়েটির মুখে কত মায়া মৌনতা;
কত যুগ যায়, কত শতাব্দী যায়!
কত যুগ ধরে কত না সে বলীদান!
ছেলেটি খোঁড়েনি মাটিতে মধুর জল,
মেয়েটি দেখেনি কখনো বকুল ফুল।
ছেলেটি তবুও প্রকৃতি-প্রতিনিধি;
মেয়েটি আবেগে উষ্ণ বকুল তলা!
ছেলেটি যখোন যেতে চায় দক্ষিণে,
মেয়েটি তখনো ঝর্ণার গান গায়;
মেয়েটির মুখে সূর্যাস্তের মায়া!
ছেলেটি দিনের ধাবমান রোদ্দুরে!
কত কাল ধরে কত না গোধূলি তলে,
ছেলেটি মেয়েটি এর ওর দিকে চায়!
কত বিচ্ছেদ কত না সে বলীদান!
কত যে আকাল শুভকাল পানে ধায়!
ছেলেটির গায়ে বেঁধে কত বল্লম;
মেয়েটির মনে কত মেয়ে মরে যায়!
ছেলেটি যদিও আঘাতে আহত তবু,
মেয়েটি আবার মেয়ে হয়ে হেসে উঠে।
কত বিদ্রোহ, কত না সে, বলীদান;
পার হয়া ওরা কত না মহামারী!
ছেলেটির বুকে মেয়েটির বরাভয়;
মেয়েটির চোখে ছেলেটির ভালোবাসা!
একজন ফের উদ্যানে আনে ফুল,
একজন মাঠে ফলায় পরিশ্রম;
কতনা রাত্রি কতনা দিনের ডেরা,
কতনা অশ্রু, কতনা আলিঙ্গন!
ছেলেটি আবার খোঁড়ে মাটি খোঁড়ে জল!
মেয়েটি আবার নাকে নাকছাবি,
ছেলেটির চোখে মেয়েটির বরাভয়;
মেয়েটিকে দেখি একাকী আত্মহারা!!
বিচ্ছেদ
আগুনে লাফিয়ে পড়ো, বিষ খাও, মরো
না হলে নিজের কাছে ভুলে যাও
এত কষ্ট সহ্য করো না।
সে তোমার কতদূর? কী এমন? কে?
নিজের কষ্টকে আর কষ্ট দিও না,
আগুনে লাফিয়ে পড়ো, বিষ খাও, মরো,
না হলে নিজের কাছে নত হও, নষ্ট হয়ো না!
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও!
এপিটাফ
যতদূরে থাকো ফের দেখা হবে। কেননা মানুষ
যদিও বিরহকামী, কিন্তু তার মিলনই মৌলিক।
মিলে যায় – পৃথিবী আকাশ আলো একদিন মেলে!
এ সেতু সম্বন্ধ মিল, রীতিনীতি সবকিছুতেই আজ
সুসংঘবদ্ধ, সুতরাং হে বিরহ যেখানেই যাও
মিলন সংযোগ সেতু আজ আর অসম্ভব নয়!
মূলতঃ বিচ্ছেদ চোখের বহির্বস্তু, বাহ্যিক আগুন!
কিন্তু মনে যেহেতু মঞ্জুষা আছে – মৈত্রীমমতায়
পৃথিবীর এপার ওপার তাই, তোমার সমস্তদূর এক লহমায়
মনের কোণায় এসে অলৌকিক মিলে মিশে যায়!
এখন হৃদয় আর বিরহের বিন্দুমাত্র বিকাশে অলীক
বলেনা হবেনা দেখা, – আর নয়, – কোনোদিন নয়!
এখন আকাশ, আলো, – একে অপরের নিজ দায়ে
কাছাকাছি হতে জানে – সূর্য, চাঁদ, – এপিঠ ওপিঠ
একে অপরের সাথে রাত্রি ও দিনের ব্যবধানে
পরস্পর জ্যোৎস্না, যৌবন, রোদ, ভালোবাসা চলাচল করে!
আমাদেরও বলা হবে, যেমন সূর্যে হয়, ঐ চাঁদে হয়!
দিন ও রাত্রির ব্যবধানে যেমন ওদের হয়, পরস্পর
দূরে ও অদূরে উষ্ণ সংরাগের সন্ধিতে তন্ময়
জন্মে ও মৃত্যুতে ফের একদিন আমাদেরও হবে!
যখোন পৃথিবী আর দেশে দেশে দুরন্ত দুঃখের
দারুণ সত্তায় জেগে মরেনা অসহ্য মাথা কুটে!
তখোন আকাশ আলো হয়তো বা মিলে যায়, মেলেঃ
তখোন পৃথিবী হয়তো বার বার ফিরে পায় তারে!
তখোন তোমারে পাবো, দেখা হবে, ফের দেখা হবে!
তোমার মৃত্যুর জন্য
তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে
আমার হাতঘড়ি
নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে!
ট্যুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে
সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী
এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে
শিশিরের নত নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলছি কালো এ্যাশট্রেতে,
রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবে না আজ রানী?
তোমার কথার মতো নরম সবুজ
কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে
তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ
তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁর
একটি নীল প্রজাপতি পর্দার বুনট থেকে উড়ে এসে
ঢুকে গেছে আমার মাথায়।
টুং টাং পেয়ালা পিরিচ বাজছে চারপাশে মিহি ঝর্ণার আঙ্গুলের,
শহরে আজকাল শুনি দুর্ঘটনার কথা
আত্মহত্যা গেছে বেড়ে,
সবাই আমরা আজ সভ্যতার সচ্ছল শিকার।
হতে পারে তুমি একটি নির্জন স্ট্রীটে
এক গাছের তলায় পড়ে আছো মৃত
তোমার মুখের ‘পরে লাল পিঁপড়ে শুষে নিচ্ছে
তোমার সৌন্দর্য্য আর
এসে গেছে রিপোর্টার ক্যামেরা ঝুলিয়ে
হয়তো বা কাল দেখা যাবে পত্রিকায়
মৃত্যুর খবরে শিরোনামা
অসনাক্ত লাশ একটি পাওয়া গেছে কোনো এক স্ট্রীটে
ছবি থাকবে দক্ষ ক্যামেরার, ভাঙ্গাচোরা;
কেবল একটি চোখ, নিরীহ একটি চোখ, আহত একটি চোখ,
ভালোবাসা-ভরা একটি চোখ দেখে বুঝতে পারবো;
তুমি কাল পথিমধ্যে মারা গেছো,
তোমার মৃত্যুর জন্য আমি কি তখন নিজেকেই দায়ী করবো
নাকি সভ্যতাকে?
জ্যোস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন
প্রতিটি নতুন কথা বলাটাই হলো আমাদের প্রেম,
প্রতিটি নতুন শব্দই হলো শিল্পকলার সীমাঃ
হে অসীমা তুমি কথা বলছো না কেন?
ওষ্ঠে কাঁপন ধরানোই হলো
নিবিড় নিহিত আবেগের চুম্বন!
এসো তবে ঠোঁটে কাঁপন ধরাই
দু’জনের ঠোঁটে দূরের কুজন, হাও্য়া শনশন চুম্বন গড়ে তুলি!
একাকী থেকেও এখন আমরা এসো দু’জনের মুগ্ধতা আনি মুখে
কালে কাঁপাই ভ্রূ যুগল অনুভূতি!
বাতাসে বহাই চক্ষুর সম্মতি!
এসো সতী মেয়ে আবার আমরা শুয়ে পড়ি, সেতু বাঁধি
দুই শরীরের মিলনে ঐক্যতান,
সংরাগে দেই সুন্দর করতালিঃ
আমাদের দুটি হৃদয়ে আজকে প্রথম ধরেছে কলি,
এসো উদ্যানে পুষ্পে পবনে অঙ্গার হয়ে জ্বলি।
সূর্যে তারায় শত শনশন সবুজ ডেরায় আমি তুমি ঝঙ্কার
কান পেতে তুমি তাই শোনো মৃত্তিকা,
এসো সুন্দর এসো হে শহরতলী,
আমাকে বানাও ঘন সবুজের শিখা,
তুমি তো বনস্থলী,
তোমাকে কে চেনে আর
আমি ছাড়া আর কে চেনে তোমার কেন এ অহঙ্কার,
কেন নিশ্চুপ, কথা বলছো না হৃদয়ে পূর্ণিমার
জ্যোৎস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন!
অপরিচিতি
যেখানেই যাই আমি, সেখানেই রাত!
স্টেডিয়ামের খোলা আকাশের নীচে রেস্তোরাঁয়
অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর
ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর
সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত
আমার কেবলই রাত হয়ে যায়!
_____________________
আবুল হাসান, চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ, জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন, উচ্চারণগুলি শোকের, অসভ্য দর্শন, মিসট্রেসঃ ফ্রি স্কুল স্ট্রীট – এই কবিতাগুলা ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কবিতার বই থিকা নেয়া হইছে।
উদিত দুঃখের দেশ, নিঃসঙ্গতা এবং গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর নেয়া হইছে ‘যে তুমি হরণ করো’ বই থিকা।
যুগলসন্ধি, বিচ্ছেদ, ঝিনুক নীরবে সহো এবং এপিটাফ নেয়া হইছে ‘পৃথক পালঙ্ক’ বই থিকা।
তোমার মৃত্যুর জন্য, জ্যোস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন এবং অপরিচিতি ছাপা হইছিল ‘রচনা সমগ্র’-তে অগ্রন্থিত কবিতা হিসাবে।
* কবিতাগুলার মালিকানা বিষয়ে কারো সাথে যোগাযোগ করা যায় নাই। কেউ কোন আপত্তি জানাইলে , অনুমতি নেয়ার চেষ্টা করা হবে।
আবুল হাসান
Latest posts by আবুল হাসান (see all)
- আবুল হাসানের কয়েকটা জনপ্রিয় কবিতা - জানুয়ারি 18, 2014