জোশ পীযূষ, বিন্দু সিন্ধু, অনির্বচনীয়ের বাড়ি
সারওয়ার চৌধুরী’র এই গদ্যের বিষয় অনির্দিষ্টতা, এক দিক দিয়া। এমনিতে, উনার গদ্যের প্যার্টানও এইটা। সম্ভবত পোস্ট-মর্ডান অথবা মিস্টিসিজম অথবা জেন-ধর্ম আমাদেরকে ইনফ্লুয়েন্স কইরা থাকতে পারে যে, এইটাই ভালো (গ্রে’র প্রতি ভালোবাসা এবং বাইনারি’রে ঘৃণা করা)! এখন ভালো বা খারাপ ভাইবা ত কেউ লিখেন না, কিন্তু লেখা লেখকের ভাবনার ভিতরেও বন্দী থাকে না আর। এই যে কিছু না-বলা, এঁরা যে কিছু বলতে চায় না, সেইটা শেষ পর্যন্ত আর না-বলা না; বরং বলা যেহেতু যায় না, তার বিপরীতে এই অনুমানটাই স্পষ্ট হয়া উঠে যে, যা কিছু বলা হইছে, এর বাইরে আর কিছুই নাই, আর এই কারণেই তারা অনির্দিষ্টতা! এইটা সার্টেনলি, অনেককিছু যে বলাও সম্ভব, তার একস্ট্রিম-উল্টা একটা পয়েণ্ট অফ ভিউ। কিন্তু এইটা ত আছে। এই গদ্য যে পাবলিশ করা হইলো সেইটা এইভাবেও পড়া যাইতে পারে।
– ইমরুল হাসান
___________________________
অনির্বচনীয় ফোটে কেন? কোনো ফুল না, কিন্তু ফোটে। খুব সামান্যতে ফোটে, আবার বিশালকে ধরেও ফোটে। তথাকথিত সুখিদের ঘরেও ফোটে, দুখিদের ঘরেও ফোটে। কোথাও বেশি বেশি পুস্পিত এবং মন মাতানো ঘ্রাণে ভরা। কোথাও এই দেখি এই নাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাধ্যমে- ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই/চিরদিন কেন পাই না’। কোথাও সকালে আসে বিকালে যায়, রাতে আসে দিনে খবর নাই। নজরুল ইসলামের মাধ্যমে রুপকে এক ঝলক- ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর নমঃ নমঃ’। [youtube id=”m6UG1f7frS4″]দৃশ্যের ভেতরে বাইরে অনির্বচনীয়তার প্রভাব। প্রার্থনাও করে মানুষ- সে যেন আসে যথাসময়ে যথারীতি। ভাষার দ্বারা কিছুটা পাওয়া যায় কিন্তু ভাষা-শব্দ-বাক্যের অতীত তবু। ধরা যায় কিঞ্চিত আভাস কিন্তু ধরা যায় না। নৈরর্থের গহীন পেরিয়ে কোনো এক অধরা আলোকপুঞ্জের অন্তরে নিহিত থাকে কি এই সহস্র রূপ রসের অনির্বচনীয়? ভাষা সহস্র সম্ভাবনার কুদরতি সেখানে যেন অচল। বচনের দ্বারা ধরা যায় না বলেই অনির্বাচ্য বা অনির্বচনীয়। অথচ ভাষার উত্তাপেই পুস্পিত হয় যেটুকু তাতেই মহাবিস্ময় প্রকাশ পায়। ‘আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই গো’ [রবীন্দ্রনাথ] ভাষায় সুরে অনুভূতির স্রোতে সে কি অনুপম দোলা, শব্দ ও সুরে অমৃতধারা! ওখানে, ম্যাগনেটিজমের গহীনে, দিশাহীন অবস্থা! যেনো যুক্তি নয়, মুক্তির নাগাল পেয়ে আত্মহারা! ক্ষণকালের মুক্তি- ভাব নাই-য়ের এলাকায়। ‘হায় গো প্রাণ বন্ধুর পীরিতে আমায় পাগল করেছে’ [শাহ আবদুল করিম]। যেনো এক গাঢ়তর নৈশ স্তব্ধতার পর অনিন্দ্য সুবহে সাদিক। ভালোবাসার পাগলের ফর্সা পবিত্র প্রার্থিত প্রত্যুষ।
স্পর্শহীন ছোঁয়া
দেখতেই হবে, দেখতে দেখতে কিঞ্চিত বুঝে নেয়া যে, নক্ষত্র সংখ্যক এ্যালেথিয়া দিকে দিকে, ভাঁজে ভাঁজে, প্রতিটি কক্ষের ভিন্ন ভিন্ন অর্থের জগতমন্ডলে আমাদের জন্যেই যেনো বিনির্মিত অমৃতপুঞ্জ ক্রমাগত। বিস্তারিত মহাসামুদ্রিক বিশালতা। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ কিংবা বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল এই পরিপ্রেক্ষিতে তেমন উল্লেখযোগ্যই না। [pullquote][AWD_comments][/pullquote]প্রক্রিয়ানিষ্ঠ দার্শনিকের যুক্তিবৃত্তি অমৃতপুঞ্জের দিকে আগাতেই পারে না; থ দাঁড়িয়ে থাকে। আবার যুক্তিবৃত্তির অধ্যাদেশ মেনেও খন্ড খন্ড অমৃতের সাক্ষাত পায় মানুষ। কাব্যকলা অথবা চিত্রকলা কিংবা যেকোনো শিল্প ধারণ করে অমৃত বা অনির্বচনীয়ের উপলক্ষ। বিশেষ পাঠবস্তুও বিকিরণ করে অন্য রকম সঞ্চিত ভাষা। সে-ভাষার গহীনে যেনো চুপচাপ আনন্দমুখর অনিন্দ্য অমৃত। পুংলিঙ্গ অথবা স্ত্রীলিংগ আকারে উন্মোচিত হয়েও অমৃত লিঙ্গ পরিচয়হীন হ’তে পারে। কখনো অমৃত স্পর্শহীন ছোঁয়া দিয়ে জানান দেয়- ‘আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন'[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]। অমন বিলীন অবস্থাতে সৌন্দর্য্যবোধ এসে কপালে চুমু দিয়ে যায়। চুম্বনের ভেতর শত রঙ অমৃত। মা-য়ের চুমু, বাবা’র চুমু, ভাইয়ের চুমু, বোনের চুমু স্বামী-স্ত্রী’র চুমু, বন্ধুর চুমু, ধর্মগ্রন্থে চুমু ইত্যাদি আলাদা আলাদা অনির্বচনীয়ের স্বাদ নিয়ে আসে। ওই যে লোকটি বলে- ‘এতো আনন্দ পেয়েছি যে, ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না’। পারা যায় না ভাষার দ্বারা অনেক কিছু; আবার ভাষার বিস্ময়কর ক্ষমতার কারণেই ভাষার দ্বারা উদ্দীপিত মানুষটি স্বেচ্ছায় মৃত্যু কবুল কুন্ঠিত না। মানবসভ্যতার টার্নিং পয়েন্টগুলোতে কবি’র কবিতা, রাজনৈতিক নেতার ভাষণ, কন্ঠশিল্পীর সংগীত, ধর্মীয় নেতার প্রভাবশালী বক্তব্য ইত্যাদি বিশ্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে বিস্ময়কর উদ্দীপনা দিয়েছে।
দেখা যায়, পাঠবস্তুতে স্ফুট কাব্যকলার অমৃতকণা বিস্ময়কর মায়ায় বাঁধতে পারে, উদ্বুদ্ধ করতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় কাজী নজরুল ইসলাম’র গান কবিতা প্রেরণা দিয়েছে। গানের উত্সাহব্যঞ্জক পীযূষ পান করে চেতনা জেগেছে, জোশ এসেছে সুতীব্রভাবে; বেরিয়ে পড়েছে ঘর থেকে- ‘চল চল চল/উর্ধ গগনে বাজে মাদল…’। [youtube id=”s-JccfMn8ss”]
বিদ্যমান সেন্টিমেন্টে ধাক্কা
মার্টিন হাইডেগার দেখেছেন এক সত্য-বাস্তবতা। অসাধারণ শিল্প “grounds history”। এই হিস্টরি মানে আবার চোর বাটপার কর্তৃক লিখিত তথাকথিত ইতিহাস না। এই হিস্টরি মানুষের সভ্যতাতে অভিনব সংযোজন আনে, যা মানবজাতি সকল ভেদাভেদের উর্ধে উঠে সানন্দে গ্রহন করতে এগিয়ে আসে, স্বাগতম জানায়। আমরা দেখি, অভিনব সংযোজন যে-শিল্পের দ্বারা সে-শিল্পে ঝিলমিল করে বিস্ময়কর অমৃতপুঞ্জ। আর এইজন্যে অমন শিল্পের পরিচয় ontologically revolutionary । এর দ্বারা ইউনিভার্সাল ফোটে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ্যাক্সক্লুসিভ অনাকাঙ্খিত। ইউনিভার্সালের সামনে এ্যাক্সক্লুসিভের আলো ক্ষীণ- নিভূ নিভূ।
উল্লেখ করা যায়, মার্টিন হাইডেগারের শিল্পচিন্তা বুঝবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুয়ার হলো তাঁর কবিতা বিষয়ক চিন্তা। বিজ্ঞান ও দর্শন যতোকিছুকে ‘সত্য’ হিসাবে বুঝায়, তা ‘সত্য’ নয় – তা দেখিয়ে, ‘The end of philosophy’ ঘোষণা দিয়ে, তিনি নতুন কোনো এ্যাপিসটেমোলজি মানবজাতির জন্যে দিয়ে যান নি। কিন্তু তাঁর সকল জিজ্ঞাসা এসে যেনো থামে কবিতার কাছে। এই কবিতা মানে যেনতেন ধরণের কবিতা না। ওখানে কবিতা মানে- ‘the things show themselves’। ওখানে কবিতা রচয়িতা দ্রষ্টা না দৃষ্ট। [the one who no longer the observer, but the observed] যেনো সেই অনুরণন- ‘আমি কিছু নয় ওহে দয়াময়’। ওখানে কবিতা মানে ‘ডায়নামিক ডিসক্লোজার’ যে-ডিসক্লোজার বিদ্যমান সভ্যতার সেন্টিমেন্টে ধাক্কা লাগায়। যে-ডিসক্লোজারের দৌলতে ‘understanding of being’ ধরবার দিকে যাওয়া যায়। মানে এই কবিতা বিদ্যমান সভ্যতা সংস্কৃতিতে বিপ্লব আনে, প্রভাবিত করে। মানে, শিল্পের অমৃতের দ্বারা মতামত প্রতিষ্ঠার প্রণোদনা। সেখানে ইউনিভার্সাল হলেই কেল্লাহ ফতেহ। সকল ইউনিভার্সাল লক্ষ লক্ষ গুণের আধার। তবে ইউনিভার্সাল বুঝাবুঝির নতুন বিবেচনার যোগ আছে। যেনো ইউনিভার্সাল বরাবর নয় আবার ইউনিভার্সাল-ও। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বাংলাদেশকে সিগনিফাই করে এবং বিশ্ব মাঝারেও এ্ঢই ঢাকা শহর প্রয়োজনীয় পাঠ রাখতে থাকে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’-তে নিরংকুশভবে বাঙালি সংস্কৃতি স্ফুট এবং তার অমৃত সমগ্র মানবজাতিরও। এলিয়টের ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ তেমনি। এবং মানতে হয় ইমানুয়েল কান্টের অঙ্গুলি নির্দেশ- কিছু অমৃতকণার ঝলক সকলেই সানন্দে গ্রহণ করে।
ধরে ফেলা ইচ্ছাধীন না
এতো এতো অর্থবহ অমৃতপূঞ্জ যেনো নৈরর্থেরই শত রূপে শতবার প্রকাশ পাওয়া বস্তু আর অবস্তু সম্মেলন। অর্থবহ বহু অর্থে। মানবজাতির ক্রমাগত সব ধরণের উন্নয়নের ধারাতে অমৃতের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অমৃত আবছা দেখা দিলেই ভালোবাসা জাগে নানা রঙে। ভালোবাসা ক্রিয়াশীল থাকা মানে সৃষ্টিশীল থাকা। ঘৃণা রূপে প্রকাশ পাওয়া ভলোবাসা সৃজনের পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে অভূতপূর্ব অমৃতের সন্ধান দিয়ে ফেলে। সাধারণভাবে আমরা বুঝি, সুন্দর মজা আনে আমাদের মনে, আবার সুন্দর মানেই সব সময় সব অর্থে মজাদার না। ক্ষেত্র বিশেষে বাহ্যিক অসুন্দরও অসাধারণ অমৃতকণার আদর এনে দিতে পারে। হ্যাঁ, ইচ্ছা করলেই সারাক্ষণ যেনতেন প্রকারে অমৃতকণা পরিবেষ্টিত থাকা যায় না। যদি থাকা হয়, জীবন সিগনিফাই করতে পারে না কিছু। ‘যাবজ্জীবেত সুখম জীবেত/ ঋণং কৃত্বা ঘৃতম পীবেত'[চার্বাক]। বলা যায় অমন চমকপ্রদ কথা। বাস্তবতা হলো, ঋণ করে হলেও ঘি খাওয়া দূরে থাক, টাকা পকেটে নিয়ে কখনো খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়েও পাওয়া যায় না সাধের ঘৃত। কারণ, ইচ্ছা করলেই কোনো অমৃতকণা ধরে ফেলবার সুযোগ আসে না সকলের কাছে। কেউ বিত্তবান দুখি, আর কেউ বিত্তহীন কিন্তু সুখি।
ইনএ্যাফেবল এক্সটেসি দিয়া বান্ধা
আমি কথা কহি। ভাষার ভিতর দিয়া চিন্তা উন্নয়ন করতে করতে তোমার মন ছুঁই। তুমি ফুল পাখি নদী সাগর মেঘ বৃষ্টি ইত্যাকার অযুত রূপে। আমার প্রকাশভঙ্গি, উচ্চারণ, স্বরগ্রাম, একাগ্রতা, যুক্তি চর্চা, আবেগের বিকিরণ তোমাকে মুগ্ধ করে। তুমি বন্ধুদের কইলা- লোকটার কথার মইধ্যে আর্ট আছে, ম্যাগনেটিজম আছে, ধইরা রাখে। এই ঘটনাকে টলস্টয় বুঝায়া দেন- ইনফেকশাসনেস। ব্যস, এই সংক্রমণ, এই শিল্পাক্রান্ত হওনের দৌলতে তুমিও শিল্প সৃজনের প্রেরণা পাইতে পারো, সৃজনে মগ্ন হইতে পারো। আমার কথা বিষয়ক তোমার উপস্থাপন দ্বারা যদি তোমার পাঠক শ্রোতা আক্রান্ত হয়, তাইলে তোমার দ্বারাও অমৃতকণা ধরা ও ধারণ হইয়া গেল। আমাদের শিল্পচিন্তাসমূহ এইভাবে সংক্রমিত। সত্য বটে, তুমি ভাষার দ্বারা বা যে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করবা যতো পরে ততো আগে আমার কথন শিল্প তোমার মধ্যে সংক্রমিত। এবং যতোটা ধারণ করেছো তার কিঞ্চিত মাত্র ভাষাতে বা অন্য কোনো মাধ্যমে বিবৃত করবা। আমার কথনশিল্প তোমার দিকে বাস্তবতার কিছু জানালা খুইলা রাখছে। আমার কথনশিল্প তোমার দিকে অনুভূতি বিকিরণ করতেছে। আমার মধ্যে আমি নাই, তোমার মধ্যে তুমি নাই। আবার তুমিও এক অতুলনীয় শিল্প হে প্রিয় ক্যানারি পাখি! তুমি-শিল্প দ্বারা আমি আক্রান্ত হইছে আর হইতে থাকছে। আমি তোমাকে ‘আনস্পিকেবল হেপিনেস’ দিতে পারছে তোমার ভাবের ভিতরে ঢুইকা। আর আমিও বান্ধা পড়ছি তোমার ‘ইনএ্যাফেবল এক্সটেসি’-তে। তুমি ‘মায়াবন বিহারিনী হরিনী’। তোমার বিরহে আমাকে ‘ইনএ্যাক্সপ্রেসিবল এ্যাংগুইশ’-এ ডুবে যাওয়া অসম্ভব কিছু না।
ধরে তবু ধরে না
বুঝলেন! এই ধরাকে সরা জ্ঞান করণ কীভাবে? ভাষার ফুটানির তুচ্ছতা ধরতে পারাও ডায়নামিক ডিসক্লোজার। দুইদিকে ধরা। খুব কষ্টেও, খুব আনন্দেও। ভাষা তার অক্ষমতা প্রকাশ করে। কষ্ট ঘিরে ধরেছে প্রবলভাবে। এই কষ্ট ভাষার বয়ান যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে না। এই কারণে ইনএ্যাক্সপ্রেসিবল এ্যাংগুয়িশ। আবার দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পাওয়া গেছে, বহু শ্রমের দৌলতে মিলেছে কাংখিত সুযোগ, তাই ‘প্রাণবন্ধু আসিল ঘরে/ আমার আনন্দের সীমা নাই'[শাহ আবদুল করিম]। এই আনন্দাবস্থাতেও আনস্পিকেবল হেপিনেস। মানে, দুখরসের অমৃতকণা এবং সুখরসের অমৃতকণা ভাষা একেবারে সর্বাংশ ধরতে পারে না। কিছু ধরে মাত্র। যেটুকু ধরে, তাতেও শতদল ফোটে, তাতেও ফোটে অনির্বচনীয় সহস্র রঙে ও রূপে।
নিজ-এর কাছে যাওয়া যাক
‘নিজ’ মানে ইংরেজিতে যা self, সেই নিজ আসলে ইংরেজি বাক্যে বসা is এর মতো। আছে কিন্তু নাই। ভাষায় যোগাযোগ করতে আমি তুমি সে বলতে হয়। ভালো করে দেখলে ‘আমি’ এর ভেতরে ‘তুমি’ এবং ‘তুমি’ এর ভেতরে ‘আমি’ একেবারে মিলেমিশে একাকার।
আইনস্টাইন তাঁর potential for free will ব্যবহার করে ধাঁ ধাঁ নির্মাণ এবং জবাব খুঁজেছেন দশ বছর। যখন E=mc2 পেলেন, তিনি কি বিস্মিত হলেন এইজন্যে যে, এই অসাধারণ হিসাবের মর্ম এভাবে সামনে হাজির হবে তা তাঁর জানা ছিল না? পেয়েছেন by means of the power of sufficiently concentrated thought. এই পাওয়ার মানে, একই সাথে তিনি পেয়েছেন এবং শুধু তিনি কর্তৃক পাওয়া হয় নি, এই রকম একটা ব্যাপার দেখা যায়। বহু পদার্থবিদের নানামূখী বস্তুগত মর্ম চিন্তার সম্মিলন এই তত্ত্ব প্রাপ্তির পেছনে। এই কথা গ্যালিলিও এবং কোপার্নিকাস কর্তৃক আবিস্কারগুলোর ব্যাপারেও খাটে। ফলে Individual doer বা ব্যক্তি-আমি’র কর্ম পরিচ্ছন্নভাবে বের করা রীতিমত অসম্ভব। দেখা যায়, বস্তুর যে কোনো মর্মমূখী চিন্তা (Essential thought) ধারাবাহিক বিবর্তন পদ্ধতির আওতাভূক্ত এবং অংশ বিশেষ, আর এই চিন্তা পদ্ধতির কাঠামোটির শুরু কবে, কীভাবে, তা মানবজাতির জ্ঞানের বাইরে। ফলে ব্যক্তির চিন্তা (Individual’s thought) বলবার/বুঝবার সুযোগ থাকছে না।
এবং এভাবে দেখা যাক, কোরীয় মানুষটি কুকুরের মাংস ভূনা খেয়ে অমৃতকণা প্রাপ্তির স্বাদ টের পেল। আমাজন মহাবনের জো উপজাতির পরিবার কালো বানরটাকে আগুনে নিমজ্বলা সেদ্ধ করে সবাই মহানন্দে খেয়ে খুব খুশি হল। মজা পেয়েছে বিশেষ, এও অমৃতকণা। [এই উপজাতির মানুষেরা ‘সভ্যতা’ রিজেক্ট করে। বনে থাকে, বনে জন্মে, বনের খাবার খায়। তারা বুনো কিন্তু ‘সভ্য জগত’র মানুষের মতো তারাও ম্যাটাফিজিক্যাল বীঙ। ‘সভ্য মানুষ নানা ফ্যাশনের পোশাক পরে আনন্দিত হয়। বনের ওরা টোটালি পোশাকহীন জীবন যাপন করে আনন্দিত।] সভ্য দুনিয়ার মিলিয়ন মিলিয়ন ‘নিজ’ বিভক্তি ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত। সাংস্কৃতিক ভিন্নতা বহুবিধ। এক সংস্কৃতির ভিতরেও নানা গোষ্ঠীর নানা পছন্দ। একটি পরিবারের সদস্যদের মাঝেও পছন্দের ফারাক। পছন্দ মোতাবেক অমৃত বুঝে নেয়া। পছন্দ বিনির্মাণ হয় ব্যক্তি ও সমাজের রাজনীতি প্রবণতার আলোকেও। খেয়াল করলে দেখা যাবে, অমুকের পছন্দকে তমুক আপন করে নিয়েছে কোন-না-কোন কারণে। সেই পছন্দ তার মনোজগতে অমৃতের স্বপ্ন নির্মাণ করতে থাকে। পছন্দ বিনির্মাণের জ্ঞান সবটুকু প্রাপ্ত, রুচিবোধও অন্য থেকে আনা। তার মেমরীতে শৈশবকাল হতে পছন্দ জমা হতে থাকে। সেটা প্রাপ্ত বা আরোপিত। সে ‘নিজ’কে মানুষ জানে তা-ও তার প্রাপ্ত জ্ঞান। তার অমৃত ভাবনাও তার প্রাপ্ত জ্ঞান নির্ভর। আবার সহস্র ভিন্নতা সত্বেও মানবজাতির সদস্য হিসাবে সে-ও কিছু অভিন্ন অমৃত ভাবনার সম্পৃক্ত। তার অমৃত ভাবনা ভিন্নতাতে এবং বায়োলজিক্যাল অভিন্নতাতেও। স্বামীর সব পছন্দের সাথে যে-স্ত্রী তার সব পছন্দ মিলাতে পারে না, সেই স্বামী-স্ত্রী গাঢ়তর ভালোবাসার সাথে প্রজননের কাজ সারতে পারে। এগার ধরণের ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিপছন্দের পার্থক্য নিয়েও এই এগারজন এক সাথে ফুটবল খেলে জিতবার পর আনন্দে আত্মহারা হতে পারে। ‘নিজ’ এর পছন্দের ভিন্নতা বা অমৃতকণা ধরবার ভিন্নতা এমন যে-
একজন বললেন-
‘চ্যানেল এ্যাল্যুর’ আমাকে কেউ ফ্রি দিলেও নেব না। ওই ঘ্রাণ আমি পছন্দ করি না।
আরেকজন বললেন-
‘চ্যানেল এ্যাল্যুর’ই আমার একমাত্র পছন্দের পারফিউম।
জাপানী গবেষক টিম যখন আমাজন গহীনে গেল পোশাকহীন ট্রাইবদের জীবন নিয়ে গবেষণা করতে। তারা দেখল উপজাতিরা তীর ধনুক দিয়ে বুনো বানর শিকার করে আস্তো আগুনে পুড়ে সবাই মিলে বেশ মজা করে খাচ্ছে। জাপানী টিমের একজন বললেন-
আমাদের দ্বারা তাদের এই খাদ্য খাওয়া সম্ভব না। আমরা আমাদের খাবার সাথেই নিয়েছিলাম।
জ্যাঁ পল সার্ত্রে বলেছিলেন-
“We are our choices.” হুম, আমাদের পছন্দগুলোই আমাদের পরিচয়। আমাদের ভিন্ন ভিন্ন ভাব মানে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন পছন্দ।
Veronica Roth বলছিলেন-
“I fell in love with him. But I don’t just stay with him by default as if there’s no one else available to me. I stay with him because I choose to, every day that I wake up, every day that we fight or lie to each other or disappoint each other. I choose him over and over again, and he chooses me.”
তাহলে সুপারম্যান বা ইনসান-ই-কামেল এই দুইয়ের ‘নিজ’
সৃস্টির স্বরূপ বুঝাবুঝির বিদ্যা বা গূঢ় তত্ববিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিক ধারণা (ontological post-modernism) যার চিন্তা থেকে ফোটে ভাষার ভিতরে, তিনি ফ্রিদ্রিখ নীটশে। তাঁর সুপারম্যান (জর্মন ভাষায় Übermensch- উচ্চারণ- ইবামেনশ) কনসেপ্ট উত্তরাধুনিক অধ্যায়ের ঘোষণা আনে মুলত। বলা হয় মানুষ age of sage-এ প্রবেশ করেছে। নীটশে বিশ্বাস করতেন মানুষের will to power, যারা দ্বারা to reach the highest possible position in life পাওয়া সম্ভব। মার্টিন হাইডেগার, জ্যাক দেরিদা, জ্যাঁ পল সার্ত্রে, মিশেল ফুকো এবং কবি রিল্কে প্রমুখ প্রভাবিত হন ওই ‘উইল টু পাওয়ার’ ধারণা দ্বারা। প্রাচ্যের বড় দার্শনিক কবি ইকবালও অবহিত ছিলেন নীটশের সুপারম্যান সম্পর্কে। নীটশে দেখিয়েছেন, মানুষের হাইয়েস্ট এ্যাচিভমেন্ট হলো সুপারম্যান-এ উন্নীত হওয়া। বলা হয়, সূফি কবি রুমী এবং নীটশে, দুজনই ইকবালের চিন্তায় নতুন আইডিয়া বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন। পার্থক্য হলো, নীটশে’র সুপারম্যান-এ স্পিরিচুয়ালিটি নাই। ইকবালের ইনসান-ই-কামেল স্পিরিচুয়ালিটি সমৃদ্ধ। অবশ্য ইকবালের এই পারফেক্ট ম্যান হাসিলের জ্ঞান পাঠ কোরআন থেকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হলো, নীটশে’র বই ‘Thus Spoke Zarathustra’-তে ‘বি ফেইথফুল টু আর্থ’ এর উপর জোর দিয়েছেন। আর ইকবাল প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের উভয় মূল্যবোধের ইউনিফিকেশন ঘটিয়েছেন এই অর্থে যে, প্রাচ্যের স্পিরিচুয়ালিটি চর্চা বস্তু-শরীরকে সাথে নিয়েই। দ্বীন ও দুনিয়াকে ধারণ করেই সর্বোচ্চ(transcend) পর্যায়ে পৌঁছে ইনসান-ই-কামেল হ’তে পারা। এই পারফেক্ট ম্যান সহজেই তখন ধরিত্রীর বাস্তবতার ডাইমেনশন ছাড়িয়ে যেতে পারেন, conqueror of time space হতে পারেন। মানে ‘এ্যাবসলিউট রিয়েল’ এর দিদার প্রাপ্তি হওয়ার ফলেই তিনি ইনসান-ই-কামেল। ইকবালের ‘খুদি’র মর্ম এখানেই। ইকবাল দেখান রসুল মোহাম্মদ স: ইনসান-ই-কামেল এর মূর্ত প্রকাশ(এ্যমবডিমেন্ট অব পারফেকশন)। ইনসান-ই-কামেল এর কোনো পরাজয় নাই। এই ‘খাঁটি মানুষ’ সভ্যতাকে, ইতিহাসকে প্রভাবিত করতে পারেন। তার হাতের নাগালে না-চাইতে রকমারী অমৃতপুঞ্জ হাজির। তিনি মৃত্যুবরণ করলেও তার কাজ থেকে মানুষ অমৃত পায়। তিনি সারাক্ষণ নিশ্চিন্তপুরের বাসিন্দা। কোনো কারণেই উত্কন্ঠা নাই। তিনি দেখেন- Life and death are just passing phases.
তুমি হিরম্ময় রত্নপুর
হে অমৃতপুঞ্জের ক্ষুদ্রতম প্রতিনিধি সম্মানিত ধল প্রহর, বর্ণমালাদের ঘরে ঘরে কিঞ্চিতের কতো অংশ নিয়ে আসো! আমি তো কিছুই বুঝি না! আমার বুঝ পাওয়া সব পরিপ্রেক্ষিত আকাশের মেঘদল। বর্ণমালাদের দ্বারা আয়োজিত কৃৎকৌশলে কেবল আয়নার ভেতরে আয়না। প্রতিধ্বনি আকুল হয় প্রতিধ্বনির জন্যে। মিলনে বিরহে আলোতে অন্ধকারে তুমি হিরম্ময় রত্নপুর। চৌদিকে শুধু বিভা আর ব্যাকুলতা। এতো মিশে থাকা কারুকাজে সহস্র নিপুন চুম্বন দিয়ে যাও কেন! বর্ণমালার ভেতরে তুমি যদিও কিঞ্চিত তবু অশেষ ব্যঞ্জনার আধার। তোমাকে বিনম্র শ্রদ্ধা প্রিয় অমৃত, প্রিয় অনির্বচনীয়। তোমার untellable splendor নিয়ে আমি তো কিছু বলতেই পারছি না! ভাষা যেতে পারছে না ওখানে। ব্যাপারটাই আনটেলেবল! অথচ আমাকে বলতে বলছো! শুধু আনটেলেবল কি জিনিস তা শনাক্তকরণ শব্দ বাক্যের দ্বারা- এইটুক বলতে পারি। বাকীটা টেলেবেল করবার জন্যে তোমাকেই দুয়ার খুলতে হবে আমার কারণে। তুমি কি বুঝতে পেরেছো হে মারাত্মক untellable splendor ?
ও আচ্ছা, তুমি তাইলে নারী-পুরুষ-ঢেউ বিষয়ক, আবার না-ও। তুমি নারী বা পুরুষ সেটি মূখ্য অনেক ক্ষেত্রেই না।
আমি শুধু দেখাই ব্যাপারটা এরকম- অত্যাধুনিক একটা বহুতল ভবনের বড়ো সাইজের লিফটের ভেতরে যেই মুহুর্তে পুরুষটি উত্তর থে’কে দক্ষিণে কয়েক কদম হেঁটে গেল, আয়নায় নিজের অস্তিত্ব দেখলো; সেই মুহুর্তে লিফট দ্রুত গতিতে উর্ধগামী- বিশ সেকেন্ডে বারো তলা অতিক্রম- মানে, সে একই সাথে উত্তর দক্ষিণে হাঁটছে এবং অভিকর্ষের বিপরীত দিকে দ্রুত ধাবমানও; সেই মুহুর্তেও পৃথিবী প্রতি সেকেন্ড ত্রিশ কিলোমিটার বেগে তার কক্ষপথে সন্তরণশীল, মানে, সে একই সাথে সাগর মহাসাগর নদী নালা পর্বত পশু পাখি কীট পতঙ্গ এবং বালু কণাদের সাথে স্পেসে পরিভ্রমণে নিয়োজিত; এবং সেই মুহুর্তে তার হৃদপিন্ড যথারীতি পাম্প করতে থাকছে রক্ত সঞ্চালনের জন্যে; সেই মুহুর্তে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা প্রিয় মানুষটির চোখ-মুখ-চিবুকের আনটেলেবল কারিশমার সাথে কথা বলছে কল্পনায়।
এইসব ঘটনার বাস্তবতা পৃথক পৃথক আবার সে ওগুলোর সাথে সম্মিলিত-সংযু্ক্ত বা সমবিভ্যাহারে পরিভ্রমণরত। পর্যবেক্ষক দাবীদার সে এইসব দৃশ্য এক সাথে দেখতে পারবার যোগ্যতা রাখো না। অথচ তাকে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। তার সিদ্ধান্তে উন/কমতি থাকে। সিদ্ধান্ত ত্রুটিমুক্ত হয় না। ত্রুটিসহ সে, মানে মানুষ, ঘাটে ঘাটে জোশ পায়, অমৃতলোকের পীযুষধারা স্নান সেরে নিয়ে তার চোখেমুখে প্রস্ফুটিত হয় বৃষ্টিধোয়া প্রকৃতি। তাতে তুমি প্রকাশ পাও, তুমি হিরম্ময় রত্নপুর, তুমি অনির্বাচ্য, অনির্বচনীয়।
আবুধাবী, ইউএই
২০ জানুয়ারী, ২০১৪
সারওয়ার চৌধুরী
Latest posts by সারওয়ার চৌধুরী (see all)
- কবিতার শশীকলাদ্যুতি, জল আগুনের সিঁড়িতে মাসুদ খান - জানুয়ারি 22, 2015
- হারুকি মুরাকামি’র গল্প: ইয়েসটারডে - আগস্ট 13, 2014
- জোশ পীযূষ, বিন্দু সিন্ধু, অনির্বচনীয়ের বাড়ি - ফেব্রুয়ারি 7, 2014