রিফাত চৌধুরী’র এক ডজন কবিতা
ইউরোপের ইম্প্রেশনিস্টদের মধ্যে আপনি এই জিনিসটা পাইবেন, যে, কল্পনার ছবি’রে বাস্তবে আবিষ্কার করা না বরং বাস্তবের একটা ছবি’রে আঁকা, যেইটা আসলে কল্পনা থিকাই আসছে, আমাদের সামনে বাস্তব হিসাবে দেখা যাইতেছে; তার ভিতরকার কল্পনারে লোকেট করা। (অবশ্য কল্পনা চাকমারে না, কারণ উনি মনে হয় আবিষ্কার সম্ভাবনার ভিতরে নাই আর! বরং গুম-সম্ভাবনার প্রাথমিক প্রমাণ হিসাবে উনারে মনে করা যাইতে পারে আবার।) বাংলা কবিতায় এই জিনিসটা ব্যাপকভাবে করছেন রিফাত চৌধুরী। এত এক্সটেনসিভলি করছেন যে, মনে হইতে পারে কবিতা ব্যাপারটা খালি এর ভিতরেই আছে! [pullquote][AWD_comments][/pullquote]
এই পদ্ধতির ব্যবহার অনেকেই করছেন এবং যেহেতু বাংলা কবিতার হিস্ট্রিটা স্পষ্টভাবে কখনো আঁকা হয় নাই ইম্প্রেশনিস্টের মতো; দুয়েন্দে, সুরিয়াল এবং ম্যাজিক রিয়ালিজম টাইপের ঘটনার কারণে রিফাত চৌধুরী’র কবিতা এখনো প্রায়ই আবিষ্কৃত হওয়ার আনন্দ দিয়া থাকতে পারে! যদিও রিফাত চৌধুরী বেঁচে আছেন এবং লিখতেছেন।
উনার প্রথমদিকের বই মেঘের প্রতিভা (১৯৯০) এবং রিসেন্টলি লেখা নতুন কবি’র স্মরণে (২০১১) পান্ডুলিপি থিকা বারোটা কবিতা এইখানে রাখা হইলো। দুইটা টেক্সটই কবি রাদ আহমেদের কাছ থিকা পাওয়া। উনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
ইমরুল হাসান
________________________________
মেঘের প্রতিভা ।। বারান্দায় ।। অ্যাকোরিয়াম ।। তরমুজ ।। গ্রুপ ছবি ।। আশা ।। চাকরি চলে যাওয়ার পর ।। মারমেড ।। রাজার মাথায় গাধার কান ।। মানুষ চায়রে ।। নতুন কবি’র স্মরণে ।। এ জেনারেশন ।।
________________________________
মেঘের প্রতিভা (১৯৯০) বই থিকা
মেঘের প্রতিভা
ছেঁড়া জামা পরা এক কিশোর
ছেঁড়া জামা তার প্রতিভা
আলো-ছায়া ঘেরা আকাশের নিচে
বোরখা-পরা প্রার্থনারত মহিলা
বোরখা তার প্রতিভা
আয়না হাতে একটা বেশ্যা,
আয়না তার প্রতিভা।
বারান্দায়
চিন্তামগ্ন এক বালিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে,
হাত দুটো তার এক সঙ্গে ধরা রয়েছে,
সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের কলোনিবাড়ির বারান্দায়।
বাড়ির সামনের গাছগুলো আবেগভরে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
অ্যাকোরিয়াম
আমার বাড়ির আউট-হাউসে একটা দারুণ অ্যাকোয়রিয়াম আছে।
নির্জন দুপুরে বা বিষণ্ন বিকেলে অনেক সময় খুব মন খারাপ লাগে।
তখন ওখানে গিয়ে বসি।
সন্ধেবেলা আলো নিভিয়ে অ্যাকোয়রিয়ামের সবুজ আলোটি
জ্বেলে বসে থাকি আমি।
বিশাল অ্যাকোয়রিয়ামের জলে আপন মনে খেলে বেড়াচ্ছে নানা-
রঙের মাছগুলি।
ঘোর সবুজ জলের নিচে লাল রঙের মাছেরা ঘুরে বেড়ায়,
অ্যাকোয়রিয়ামের এক কোণায় ওটা কি ঘড়ি?
সময় কি বয়ে যায় গভীর জলের তলায়?
ঘোর সবুজ জলের মধ্যে শাদা অথবা বর্ণহীন মাছেরা জল ছিঁড়ে
সাঁতার কাটে,
পাশে বয়ে যায় খানকয় নৌকো।
তরমুজ
একটা মেয়ে একটা তরমুজ কাটছে।
তার হাতে ছুরি।
তরমুজ দু’টুকরা করে ছুরির ঠান্ডা ইস্পাতের ফলা চলে গেছে।
পাকা তরমুজের লাল বুক চিরে
তরমুজের ঘোর সবুজ রঙের উপর দিয়ে তরমুজের রস গড়িয়ে পড়ছে।
কাটা তরমুজ থেকে টপটপ করে রস গড়িয়ে পড়ছে।
তরমুজের রস থেকে একটু বেশী লাল, যেনো রক্ত।
গ্রুপ ছবি
সাত আটটা কাক দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের ছবি তোলা হচ্ছে।
কাকেরা সবাই কালো পোশাক পরে আছে।
আশা
রঙচটা ধুলোমাখা তোবড়ানো পুরোনো
পরপর দাঁড় করানো কয়েকটা রিকশা
এক নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
একটা রিকশার পিছনে বেগম খালেদা জিয়ার মুখ আঁকা।
স্প্রিং বের-হওয়া ফাটা চামড়ার সিটে
অলসভাবে বসে আছে রিকশাচালক।
রিকশার চাকা দুটো টাল খাওয়ানো।
নতুন কবি স্মরণে (২০১১) পাণ্ডুলিপি থিকা
চাকরি চলে যাওয়ার পর
সিএনজি থেকে নামলাম অফিসে। দু-তিনজন পরিচিত অফিসারদের সঙ্গে দেখা হতেই তারা পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। আমি হেসে কথা বলার চেষ্টাও করলাম। কিন্ত কেউ তেমন পাত্তাও দিলেন না, গেটে দায়োয়ানরা দাঁড়িয়েছিল, আমার সামনেই, যারা দারোয়ানদের সামনে দিয়ে ঢুকছিলেন, দারোয়ান তাদের প্রত্যেককে স্যালুট করল। কিন্ত আমাকে তা করল না। হয়তো করেছে, নয়তো করবে ভেবে আমি দারোয়ানদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিন্ত কোথায়! সকলে মুখ ফিরিয়ে সরে গেল। নিজের কাজে মন দিল।
লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সকলকে প্রায় ডিঙিয়ে প্রথমেই লিফটে উঠতে যাবো ভেবেছিলাম, কিন্ত লিফটম্যান বলে উঠলো ‘সরে যান, প্রথমে অফিসার লোককে চড়তে দেন?’
এবার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলআমার, কেন আমি কি অফিসার নই তবে? আমি তো ওদের থেকে সিনিয়র!
অগত্যা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলো। উঠে হাঁপিয়ে গেলাম আমি। নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আমার ঘরের দরজায় নেমপ্লেটটা তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আরেকজনের নাম। ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলাম। দরজায় একজন ষন্ডা-মার্কা লোক বসে আছেন। জোর করে ঢুকতে গেলাম, ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম আমি। কান্না পেয়ে গেল। কেঁদে ফেললাম আমি। কেঁদে উঠলাম, সত্যি সত্যি কেঁদে উঠলাম। আমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে লাগলাম কিন্ত এই কান্না যে অরণ্যেরোদন সে কথা আমি জানি না, জানতে চাই না। কেউ আমার চোখের পানির মূল্য দিতে আজ আর রাজি নয়।
মারমেড
শ্রাবন্তী দত্ত তিন্নি
তিলোত্তমাসু
মৎস্যকন্যা, ফিরে যাচ্ছি বিদায়ের বাসটা হর্ন মারছে বুকের ভিতর
আর সময় নেই তোমার সঙ্গে পাশাপাশি বেড়িয়ে আসি কুয়াশায় ঢাকা ঘুমন্ত পাহাড়
ক্যাফের ভিতর বসে প্লেটে কাঁটা চামচে বাজাই বসন্তের সুর।
নীলাম্বরী সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে কবিতা মনে পড়ে ক্রমন্বয় নির্জনতা
মৎস্যকন্যা, তোমার খোঁপায় গোজা জংলী ফুল তিব্বতের সাবানের বিজ্ঞাপনে সুন্দরীতমা হয়ে থাকো
সাবান তো নয় যেন এক টুকরো বাংলাদেশ পেলাম। ওকে বেশি করে দেখছিলাম।
তিনি যেন আরো স্মার্ট হয়েছে। সারাটা দেহ ও মনে বইছে জোয়ারের স্রোত।
এখনো তোমার খোঁপার মধ্যে জংলী ফুল হয়ে বেঁচে আছি
কালো খোঁপার ফুলগুলি অতলস্পর্শী অন্ধকার খাদ
সে এক নিষিদ্ধ অন্ধকার অথচ আলোয় চেয়ে দেখো
কত আশা বীজ থেকে অঙ্কুর ছিঁড়ছে স্বপ্নের কঙ্কাল নিয়ে খেলা করছে প্রেত।
সমুদ্রতরঙ্গ বুকে আছাড়ি পাছাড়ি করছে। শুভ্ রফেনপুঞ্জে নিজেকে আড়াল করা যায় না।
ঢেউ আমাকে উন্মোচিত করে দিচ্ছে। যার নিজস্বতা বহু থেকে বিচ্ছিন্ন একক গোপন সত্তা,
সুপ্ত ক্ষুধা শরীরের, সংসার নির্মাণের সে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে।
বর হওয়ার কল্পনা তাকে স্বচ্ছন্দ দুটি ডানা দিয়ে দেয়।
মেয়েদের বক্ষলগ্ন হওয়ার আশ্রয় তাপ আকুলতা রক্তকে চঞ্চল করে।
ক্যাফের ভিতর মুখোমুখি কিচেন রুমের অনুমেয় কবোষ্ণতায়
মনে পড়ে এই মুহূর্তে আজীবন দুঃখের নির্ণেয় পতাকা
মৎস্যকন্যা, এই বিদায়বেলা বাসটা বুকের ভিতর হর্ন মারতে মারতে ছেড়ে যাচ্ছে কক্সবাজার
এমন সময় জানালার ফাঁকে আমার নিঃসঙ্গ চেয়ে থাকা দেখে তুমি হাত নেড়ে স্বাগত জানাবে না?
ফেরার পথে বাসে আমি জানালার দিকে। বিকালের ফালি রোদ জায়গায় জায়গায়।
আমি বাসের জানালার বাইরে চোখ রাখি। সন্ধ্যা নামছে চট্টলায়।
দিন অবসানের আলো আকাশ গড়িয়ে ক্রমে নিঃশেষিত হচ্ছে।
শব্দ করে বাস ছুটছে। বাসের সতর্ক চাকা পিচের লাইন গড়িয়ে যাচ্ছে।
রাজার মাথায় গাধার কান
গাধার কান গজিয়ে গিয়েছিল রাজার। চুল কাটতে এসে নাপিত দেখে ফেলেছিল সেই কান। কিন্ত রাজা হুকুম দিয়েছিলেন, এই কানের কথা তুমি কাউকে বলবে না। যদি বলো গর্দান যাবে তোমার। রাজার মাথায় গাধার কান এইরকম একটা ঘটনার কথা কাউকে না বলে পারা যায় না। কিন্ত বললে তা ঠিক পাঁচকান হবে। তারপর সেই কথা রাজার কানে গেলে ওর মুন্ডু কাটা পড়বে নির্ঘাত। বেচারা নাপিত কথা চেপে রাখতে রাখতে শেষে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আশ্চর্য ঘটনাটার কথা কোনও একজনকে বলা দরকার, না হলে রোগ সারবে না। কিন্ত কাকে বলা যায়? নির্ভরযোগ্য তেমন লোক কোথায়?
হাঁটা থামাতেই হলো। খরগোশপুর গ্রামকে পিছনে রেখে কাঁচারাস্তা ক্রমশ সংকীর্ণ হতে হতে এখন এক ফালিতে এসে ঠেকেছে। সামনে এবার অুনচ্চ, অজানা সব গাছপালার সবুজ সুড়ঙ্গ। অবিরাম বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চকচক করছে লতাপাতা। তারই মধ্যে হাঁটু অবধি তবন (লুঙ্গি) তুলে চলেছে নাপিত। কাদামাটি ঠেলে আরও খানিক দূর গেলে কিছুটা ফাঁকাজায়গা। তারপর নদী। কিন্ত হলে কী হবে, তাতে বানের স্রোত। সোঁ সোঁ করে বইছে হাওয়া। নদীর ওপারে আরও গভীর জঙ্গল। তার ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া আকাশ দেখা যায়। নির্জন এলাকা থেকে আরও নির্জন এলাকায় ঢুকে পড়ছিল নাপিত। ভরা নদীর জলে সাঁতার দিয়ে বর্ষার মাঠ পেরিয়ে ছুটে আসা। গাছের ডালে-ডালে ফুলের সমারোহ।
শোনো গাছ, তুমি তো আর কাউকে ফাঁস করতে পারবে না। তোমাকে বলাই নিরাপদ। আমাদের রাজা সব সময় মস্ত একটা পাগড়ি পরে থাকেন কেন জানো? রাজার কান দুটো অবিকল গাধার কানের মতো। আমি ওর চুল কাটতে গিয়ে দেখে ফেলেছি। গোপন কথা গাছকে বলতে পেরে হালকা হলো নাপিত। ওর রোগও সারল। কিন্ত রাজার কপাল খারাপ। সেই গাছ কেটে বানানো হয়েছিল বাজনা। সেই বাজনাই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল রাজার কান গাধার মতো। ওয়ান থিং ইউ ক্যাননট ডাইজেস্ট, দ্যাট ইজ সিক্রেট। গোপন কেউ হজম করতে পারে না।
মানুষ চায়রে
মানুষ চায়রে কারে চায়রে মানুষ শুধু টাকা চায়রে টাকায় মানুষ চায় না।
মানুষ তো মরে শুধু মানুষ তো টাকা বানায় রে টাকায় মানুষ বানায় না।
টাকা থাকলে সব কিছু হয় না হলে কিছু নয়। আমার টাকা আয় তো রে।
এই ঝিলিমিলি রাত মিষ্টি ফাগুন চোখে চোখে রঙ মনের আগুন।
ফুলের হাসি পাপিয়ার সুর যদি পকেট ভর্তি থাকে সবি মধুর।
নতুন কবি স্মরণে
আবিদ আজাদ চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মুস্তফা আনোয়ার মারা গেল। পৃথিবী থেকে ভালোবাসার মানুষগুলি উবে গেল। পৃথিবীটা আমার কাছে বদ্ধ ডোবার মতো মনে হচ্ছিল। আর আমাকে এই বদ্ধ-ডোবায় ফেলে পালালে। তুমি ভীষণ স্বার্থপর। কাওয়ার্ড।
তোমার সঙ্গে জন্মের মতো আড়ি, তুমি চলে গেলে বড্ড তাড়াতাড়ি। সব খেলা ফেলে চলে যেতে হলো তোমাকে। গোরে মাতৃ-ক্রোড়ে।
তুমি আর কোথাও নেই! তুমি আর আমাকে দেখছ না! তুমি যত দূরে যাও তোমার জীবন হতে, তোমার ছায়া ততো লম্বা হয়ে ঘিরে থাকে আমাকে।
এই গ্রীনরোডের সংসারে আরও ক’দিন থেকে গেলে হতো। আর কয়েকদিন। আর একটু। আর ষাট মিনিট। উচ্ছ্বাস থেকে বিষণ্নতা এবেলা, ওবেলা, এই দশবেলায় বেলাবেলি তুমি সমস্ত উদ্বেগকে শুকনা পাতার মতো মাড়িয়ে চলে গেলে। এ যাওয়া মানে ফিরে আসা বারেবারে।
আর কয়েকটা দিন। মরা বিকেলের আলোয় তুমি চলে গেলে অনেক দূরে যেখানে লাইফে কোনো ডিস্টার্ব নেই…। তোমার প্রহর চলে গেছে। কোনো গভীর গুরুত্বপূর্ণ কবিতা এখন অর্থহীন। সকালে বারডেম থেকে বেরিয়ে আসে তোমার অ্যাম্বুলেন্স এরপর অ্যাম্বুলেন্স বাংলা একাডেমীর ভিতরে যায় যেখানে আমার কয়েকজন বন্ধু দাঁড়িয়েছিল রহস্য ঘেরা বিচিন্তা-বিচ্ছিন্ন মন তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়েল। শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নাও আজিমপুরের একটা সাধারণ কবরস্থানে চিরদিনের জন্যে। তুচ্ছ জীবন তুচ্ছ মরণ তুচ্ছ ক্ষুধা তুচ্ছ শীত। আমরা সবাই হারিয়ে যাবো, শীতের রাতে কেউ জানে না। শস্যক্ষেতে জন্ম কবরে মৃত্যু জন্ম মৃত্যুকে অনুভব করো তুমি সফল পরিক্রমায়। কবরে-ভবনে সর্বত্রই আসন। মারা যাবার পর আত্মা মাটির নিচ দিয়ে নানা চক্রে আকাশে মিশে অণু হয়। অণুটা ভাসছে, ভাসতে ভাসতে যেন শূন্যতার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনন্তকালের দিকে। পর জন্মটন্ম মিথ্যা, তুমি মারা গেলে, মাথা কুটলেও কি তোমার দেখা পাব আমি, তবে হ্যাঁ, স্বপ্নে আসো, কিন্ত কী বিষণ্ন তোমার মুখ খানি, কত লোক বেঁচে আছে, বসন্ত আসছে, বর্ষা, শীত আসছে, এ সব তোমার ভোগের হলো না, বেঁচে থাকতে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়, অনেক মানুষের সঙ্গে বেঁচে থাকা, অনেক গন্ধ, অনেক স্পর্শ নিয়ে বেঁচে থাকা, তোমার পাশে এসব কিছুই নেই, কোথায় যে চলে গেছো তুমি। একা হয়ে অন্ধকার মহাশূন্যে ঘুরছো হয়তো। মানুষ মরলে কি হয় তা আমি জানি না। কেউ বলে আকাশের তারা। কিন্ত সেও তো একা। আমার ভয় ভয় করতে লাগল। হ্যাঁ, তুমি খুব একা, একা হয়ে ঘুরছো। তুমি এই পৃথিবী থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলে। আমিও এই নিষ্ক্রমণ চাই।
ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো মৃত্যুকে বরণ করে ছাড়পত্র পেলে। তোমাকে কবর দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। মরে গিয়েও মনের গোপন কুঠুরিতে সযত্নে লুকিয়ে রাখা ক্ষতস্থানটা তুমি আবার খুঁচিয়ে দিয়ে গেলে। ওটা যে এত কাঁচা ছিল, এত রক্তপাত যে এখনও হতে পারে ওই ছোট্ট ক্ষতটা থেকে, তুমি মারা না গেলেহ য়তো কোনওদিনই বুঝতে পারতাম না আমি। ইচ্ছে করলে আমিও যেতে পারি। আমি চলে যেতে পারি। ক্রুয়েল এই পৃথিবী ছেড়ে। কত ব্লিজার্ড বয়ে গেছে জীবনে। আমি এমনিতেই খুব বেশি দিন পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখতে পাবো বলে আমার মনে হয় না।
সকালে ঘুম ভেঙে আমি দেখবো, আমি শুয়ে আছি নিজের ঘরে আর দুঃস্বপ্নের ঘামে বালিশ ভিজে গিয়েছে। তোমার সমস্ত ঐতিহ্য আমার মাথায় দুঃস্বপ্নের মতো চেপে বসে থাকে।
শরীরটা অচল হয়ে গিয়েছে, অথচ মনটা একইরকম আছে। ভিতরে অঝোরে পানি পড়ে, কিন্ত চোখ দিয়ে সে পানি বেরোয় না। এই সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, দিনরাত্রি, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, জন্ম, শৈশব, বার্ধক্য, মৃত্যু, মৃত্যুর মতোই এক চিরন্তন বিচ্ছেদ।
তুমি নতুন কবিতা রচনা করেছো। নতুন ভাষ্য দিয়েছো। তুমি নতুন টীকা রচনা করেছো। তুমি নিজেই তোমার ইতিহাস রচনা করেছো। আমি সেই কবিতা টীকা ভাষ্য ইতিহাস পাঠ করছি কবিতানুক্রমিক জীচন চর্চায়। তোমার মধ্যেই আমি খুঁজে পেয়েছি আমার আরাধ্য সব্যসাচীকে।
আসলে তুমি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলে। খানিকটা উঠে এসে এবং কিছুটা নেমে তুমি টিকে থাকতে চেয়েছিলে ভীষণ। তোমার চলে যেতে হবে সুনিশ্চিত, অথচ তুমি আরো কিছুটা নিতান্ত বাংলা সাহিত্য ভালবাসতে চেয়েছিলে।
মৃত্যুর পরপারে আর কোনোদিন যদি তোমার সঙ্গে দেখা হয় তাহলে বলবো তোমার সাহিত্যগ্রন্থ আমি বন্ধ করিনি আজও সেটা তেমনি খোলা আছে। তোমার অনুরণন বাংলাদেশের বুকে লেগে থাকবে অনন্তকাল। শরীরে নয় রঙ ছিল তোমার মনে। তুমি ছিলে এভারগ্রিন। বয়সের ভার তোমার মনকে স্পর্শ করতেপারেনি! স্কন্ধদয়ের সঙ্গে মিশেছিল তোমার বুদ্ধির অপরূপ চাতুর্য। তোমার বাক্নৈপুণ্য দিয়ে আমাদের আকৃষ্ট করবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তোমার।
জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে ফারাক শুধু এক চুলের। তোমার পরিকল্পনাকে-উত্তেজনাকে এক নিঃশ্বাসে, এক প্রশ্বাসে, এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিয়েছিল মৃত্যু তোমার বুকে এক গাদা ক্রোধ-অভিমান-নালিশ ও ব্যর্থতা নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছ। স্মৃতি হয়ে যেতে আর দেরি নেই। স্মরণ সময়ে নাও বেদনার ফুল স্মৃতিকাতর। আমার অন্ধকারের আলো তোমার স্মৃতি। নীলমাছির মতো উড়ন্ত কিছু স্মৃতি।
এ জেনারেশন
আমি আমার কবি বন্ধু ধান নেওয়াজকে টেনে বারান্দায় এনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললাম,
এ জেনারেশনের লোকগুলি সাদাসিধা ভেবেছিলাম। সাদাসিধা! ব্যাটারা এক নম্বরের চোর, পাক্কা ক্রিমিনাল। ডেঞ্জারাস! মিনমিনে স্বভাব, মিষ্টি-মিষ্টি কথার লোকগুলি মহা হারামি হয়।
গর্বিত, উদ্ধত, প্রলুব্ধ, নিষ্ঠুর, স্বার্থান্ধ। মনে রাখতে হবে এ জেনারেশন জন্মাবধি এক পরমুখাপেক্ষী।
এ জেনারেশনকে দেখছিলাম চতুর্দিকে। জঘন্য। অনাসৃষ্টি। চরিত্রহীন। এ জেনারেশন।
ওরা পুকুরের কচুরিপানার মতো, যত জল নেড়ে সরিয়ে দেওয়া হোক মুহূর্তে যে-কে সেই!
হাঁড়ির মধ্যে জীয়ান মাছ, পরস্পর অঙ্গস্পর্শে কন্ডুয়নে আর কিলবিল করে দিন কাটাতে চায়
এ জেনারেশনের সময় তো দিনের মুখে বাথরুমের আলোচনার মতোই অশ্রাব্য।
এ জেনারেশন অন্তর্মুখী। যাকে পছন্দ হয় শুধু তার সঙ্গে কথা বলে।
অল্প কথা বলে। কিন্ত প্রত্যেকটা মেপে মেপে পুকুরের জলে একটা করে ঢিল ফেলার মতো।
ওরা চলে অনেকটা আকস্মিকতার তোড়ে, হুজুগে; হঠকারী ঘটনার হাওয়ায়।
ওদের সঙ্গে মাঝে মাঝে খুব সাধারণ দু-চারটা কথা হয় আমার
বেশির ভাগ কথা মাটির দিকে চোখ রেখে নিচু গলায় বলি।
যার কোনো প্রয়োজন বা মানে নেই। যতটা পারি অ্যাভয়েড করে চলি।
আমি নীরব হয়ে গিয়েছিলাম ওদের কাছে। অন্তত ক্রমশ হতে চেষ্টা করেছিলাম।
যারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে অন্যর সম্বন্ধে খারাপ কথা বলে তাদের আমি ইমপর্টেন্স দিই না। চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে পরখ না করেই তার পিছনে দৌড়াই না।
আমি তাদের ওয়েল-উইশার নই।
আমার প্রশ্ন করার বাসনা নেই, অধিকার নেই।
প্রশ্ন কেন করব। তাছাড়া দুরূহ প্রশ্নে যাবার প্রয়োজন কী?
উল্টর পাওয়ার বেশি আর কী পাবো? সব রহস্য ভেদ করে কী লাভ হবে।
জীবনটাই যখন কড়া আলোর নিচে নগ্ন, থাকুক না একটু না-জানা কিছু।
কলাবাগানের ধানলেকের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধান নেওয়াজ ভাবছে বুঝি তার পিছনে ফেলে আসা দিনগুলির কথা।
হায় রে! এ জেনারেশন। বাঁধ ভাঙা বন্যায় অ্যান্টিহিরো করে দিতে চাও জগৎটাকেই।
রিফাত চৌধুরী
Latest posts by রিফাত চৌধুরী (see all)
- রিফাত চৌধুরী’র এক ডজন কবিতা - মে 9, 2014