বিশৃঙ্খল দৃশ্য: পৌরুষ, পাবলিক স্মৃতি ও সেন্সরশিপ
র্যাবের সাথে ক্রসফায়ারে মারা-যাওয়া কোন লাশের ছবি কি ছাপা হইতে দেখছেন মিডিয়ায়, গত দুই-তিন বছরে? বা ধরেন, বিশ্বজিৎ-এর খুন কেন হন্টিং একটা ব্যাপার? কারণ আমাদের মিডিয়া-রিয়ালিটিতে ঘটনা হইলো ইমেজ-ডিপেনডেন্ট একটা বিষয়। ইমেজ নাই বইলাই ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটলেও সেইটা নাই-ই হয়া আছে এবং বিশ্বজিৎ-রে রিপিটেডলি মরতে হইছে। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে একটা অর্গানাইজড ক্যু’র পরে দেশের মিডিয়াগুলা নিজেদের উপ্রে যে সেন্সরশীপ ইম্পোজ করে সেইটার কনটিনিউশনই এখনো চালু আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এই কন্ট্রোলের ঘটনাটা ঘটছে মিডিয়ারে মিলিটারি অ্যাকশনের ভিতরে অ্যাকোমোডেট কইরা, আরো আগেই। আর বাংলাদেশের মিডিয়াগুলা ক্যু-এর পরের সময় থিকা সরকারি কন্ট্রোলের সাথে নিজেদেরকে কম্প্যাটিবেল কইরা তুলতে পারতেছে। এইটা যখন ইনিশিয়েটেড হইতেছে তখন রেহনুমা আহমেদ লিখছিলেন এই লেখাটা, ছাপাইতে দিছিলেন বিডিনিউজটুয়োন্টিফোরডটকম-এ; রিস্কি হবে মনে কইরা উনারা লেখাটা ছাপাইতে রাজি হইতে পারেন নাই। পরে দৃক ও যোগাযোগ পত্রিকা মিইলা লেখাটা ছাপায়। লেখকের অনুমতি নিয়া বাছবিচার-এ আপলোড করা হইলো।
– ই.হা.
১. লগনের কথা
এই লেখার বিষয় ভিশুয়াল রেপ্রিজেন্টেশন ও সেন্সরশিপ। এটা কোনো পূর্ণাঙ্গ লেখা না, চলমান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু খসড়া ভাবনাচিন্তা হাজির করছি মাত্র। মোটা দাগে সেন্সরশিপ বোঝা হয় নিষেধাজ্ঞা হিসেবে, নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে শাস্তি পেতে হবে, এ হিসেবে। এটা ছাপা যাবে না, ওটা নিয়ে কিছু বলা যাবে না ইত্যাদি, ইত্যাদি। সেন্সরশিপ আগে এবং পরে, উভয় দিক থেকে কাজ করে। আগে থেকে সতর্ক থাকা, আর পরে অর্থাৎ ঘটে গেলে, শাস্তি পাওয়া। কিন্তু বিষয়টা আরেকটু জটিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এই লেখার অন্য বিষয় ভিশুয়াল রেপ্রিজেন্টেশন। অর্থাৎ, আমার আলোচনার বিষয় রক্ত-মাংসের মানুষ না, রক্ত-মাংসের মানুষের রেপ্রিজেন্টেশন। খোলাসা করি : আপনার ছবি যেমন আপনারই ছবি, ‘আপনি’ আর ‘ছবি’, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। স্টিল ছবি হচ্ছে ব্রোমাইড কাগজে i ছাপা একটি বস্তু, আর আপনি হচ্ছেন রক্ত-মাংসের মানুষ। আর ঠিক একইভাবে, আমার আলোচনার বিষয় হচ্ছে ছবি – বেশ কটি ছবি, তার মধ্যে দুটো ছবি সমকালীন বাংলাদেশের, একটি প্রকাশিত হয়েছিল, পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়। অপরটি বহুলপ্রচারিত, কখনোই নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়নি। দুটোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকালীন ছবি – রক্ত-মাংসের মানুষ না।
‘আপনি’ আর ‘ছবি,’এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নেই তা বলছি না। যেমন ধরেন, “তুই না পিকনিকে যাস না? এ তো দেখি রাজেন্দ্রপুর।” “হ্যারে, জীবনে ওই একবারই গিয়েছিলাম।” অর্থাৎ, ছবি একটি বিশেষ মুহূর্তকে তুলে ধরে। এই বিশেষ মুহূর্ত নিয়মিত চর্চার কি-না, তা বলার ক্ষমতা ছবি রাখে না। মানুষই রাখে। ছবি রেপ্রিজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধিত্বশীল হতে পারে। যেমন ধরেন রাজকন্যা ডায়ানার প্রতি ব্রিটেনের মানুষের ভালোবাসা, তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের দিন বহু ছবিতেই তা প্রকাশ পায়। আবার একইসাথে ছবি বাস্তবকে সঠিকভাবে নাও তুলে ধরতে পারে, “এই ছবিটা যে ক্যামন, দ্যাখ ছোট চাচার নাকটা কেমন লম্বাটে দেখাচ্ছে।” আরো কথা আছে, “অ্যাঙ্গেলের কারণে মনে হচ্ছে গা ঘেঁষে বসা, আসলে প্রায় এক হাত দূরত্ব ছিল।” সংক্ষেপে বললে, ডকিউমেন্টারি ছবির ক্ষেত্রে বাস্তবের সাথে বাস্তবের রেপ্রিজেন্টেশনের সম্পর্ক অনায়াস কিছু না ii ।
আরেকটি বিষয় মাথায় রাখলে ভালো। হাল-আমলের ভিশুয়াল থিওরিস্টরা রেপ্রিজেন্টেশনকে ‘উৎপাদন প্রক্রিয়া’ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার ‘প্রোডাক্ট’, উভয়ভাবেই বিচার করেন iii। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ছবি তৈরিতে মানুষের শ্রম, অর্থ, চিন্তা, সময়, সামর্থ্য, দক্ষতা, স্বপ্ন, ছবির সাবজেক্টের প্রতি আলোকচিত্রীর অনুভূতি, আলোকচিত্রের প্রচলিত ধারা, প্রযুক্তিগত দিক ইত্যাদি, নানান বিষয় জড়িত। ভিশুয়াল থিওরিস্টরা বলেন, ছবি সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় প্রত্যয় বা কনসেপ্ট হিসেবে ‘উৎপাদন’ শব্দ আমদানি করা জরুরি। তার প্রয়োগ জরুরি। তা না-হলে স্রেফ বর্ণনায় আটকে থাকতে হবে, বিশ্লেষণের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লেখার প্রথম অংশে সমকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া-মিলিটারি সম্পর্কের কিছু বিশেষ মুহূর্ত তুলে ধরছি মোট ৫টি ছবির সাহায্যে। মিডিয়া-মিলিটারির সম্পর্ক আমি সেন্সরশিপের পরিসরে স্থাপন করছি। আহ-হা কী জ্বালা, সেন্সরশিপ তো প্রতিষ্ঠান, ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান, তাকে আবার পরিসর বলছেন কেন? হ্যাঁ, ঠিকই, আমিও তাই ভাবতাম। আমিও মনে করতাম সেন্সরশিপ এমন কিছু – ধরেন আইন, আইনের ধারা ইত্যাদি – যা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা (যেমন ফিল্ম সেন্সর বোর্ড) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলে বিশেষ কোনো কিছুর ওপর প্রয়োগ করে যেমন বই, সিনেমা, কার্টুন, সেটিকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে। কিন্তু ইদানীংকালে সেন্সরশিপকে আর এভাবে অর্থাৎ, নেতি-অর্থে, একটি সমস্যা iv হিসেবে দেখা হয় না। বিশ্লেষণের পদ্ধতি, তার ভাষা ও ভাবনা পাল্টে গেছে। ইদানীংকালে সেন্সরশিপ নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলেন, পুরানো দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা হচ্ছে ক্ষমতাকে ভাবা হয় একরৈখিক ভাবে, ধরে নেয়া হয় রাষ্ট্র একমাত্র ক্ষমতা চর্চাকারী প্রতিষ্ঠান। তারা বলেন, ক্ষমতাকে স্থবির কোনো কিছু হিসেবে না দেখে, এটাকে যদি একটা সম্পর্ক হিসেবে দেখি তাহলে বিশ্লেষণের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। v ফিল্ম সেন্সরশিপ নিয়ে একটা লেখায় মনিকা মেহতা বলেন, ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে ক্ষমতা চর্চিত হয় রাষ্ট্র, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এবং নাগরিক সম্প্রদায় দ্বারা, অপরের সাপেক্ষে। vi ক্ষমতা শুধু অবদমন করে না, বরং এটি নিয়ম-নীতি, অনুশীলন, আলাপচারিতার সীমা-পরিসীমা, বর্গ বা ক্যাটেগরি (ধর্ম কী? ধর্মীয় অনুভূতি কী?), সাবজেক্ট (ধার্মিক মানুষ বলতে কাকে বোঝায়? ধার্মিক মানুষ মাত্রেরই খারাপ লাগবে, নাকি খুব বেশি সেন্সিটিভ যারা, তাদের খারাপ লাগবে?) পুনরুৎপাদন করে। সংক্ষেপে বললে, ক্ষমতার খেলা সেন্সরশিপের ডিসকোর্স তৈরি করে। মনিকা মেহতা আলোচনা করছেন হিন্দি সিনেমার খলনায়ক নিয়ে, আর এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’ গানটি নিষিদ্ধ করার দাবি উত্থাপিত হয় হিন্দি সিনেমায় যৌনতা নিয়ন্ত্রণের আহ্বান হিসেবে। যৌনতা নিয়ন্ত্রণের আহ্বান একইসাথে যৌনতা উৎপাদনও করে।
কথা হচ্ছিল, মিডিয়া-মিলিটারির সম্পর্ক আমি সেন্সরশিপের পরিসরে স্থাপন করছি, এ নিয়ে। এখানে বলে রাখি, আমার এ লেখা সেন্সরশিপের ডিসকোর্স নিয়ে না। এটি একটি পলেমিকাল লেখা, তবে সেন্সরশিপ-এ্যাজ-ডিসকোর্সের চিন্তাভাবনা আমার নিজের ভাবনাচিন্তা কোন রাস্তা ধরে এগোবে, তার দিকনির্দেশনায় কাজে দিয়েছে। বিশেষভাবে কাজে দিয়েছে উত্তর-কাঠামোবাদের একটি তাত্ত্বিক সূত্র যথা, ডিসকোর্সে উপস্থিতি (প্রেজেন্স), অনুপস্থিতি (অ্যাবসেন্স), দুটোই খেলা করে।
লেখার প্রথম অংশে সমকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া-মিলিটারি সম্পর্কের কিছু বিশেষ মুহূর্ত আমি তুলে ধরছি মোট ৫টি ছবির সাহায্যে, তা বলছিলাম vii ছবি, আর ছবিগুলোকে ঘিরে যে আলোচনা, তা আরো বড় কাহিনীতে গাঁথা। বড় কাহিনীর একটি সূত্র সংক্ষেপে এ রকম: ১৯৯১-এ কুয়েতকে ইরাক-মুক্ত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (মিত্র বাহিনী সমেত) যে যুদ্ধের সূচনা করে, তা ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে মৌলিক অর্থে ভিন্ন ছিল। এক. মিডিয়ার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। দুই. তারই ফলশ্র“তিতে, মার্কিন সরকার এই যুদ্ধকে দৃশ্যগতভাবে রেপ্রিজেন্ট করতে পেরেছিল একটি নিপাট ও লাশবিহীন যুদ্ধ হিসেবে (জেনারেল নরমান শোওয়ারজকপফ-এর ভাষায়, “ইরাকি কতজন মারা গেছে এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই, আর বলে রাখলাম, আমার যদি এ ব্যাপারে কিছু বলার থাকে, আমি কিন্তু লাশ গোনার কায়কারবারে নামতে যাচ্ছি না” viii)। ১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরো কিছু যুদ্ধের সূচনা করে – আফগানিস্তান (২০০১), ইরাক (২০০৩) যা এখনো বর্তমান। তখনের এবং এখনের যুদ্ধ বিচার করলে, ধারাবাহিকতা অনুসন্ধান করলে বড় কাহিনীর অবয়ব টের পাওয়া যায়। যথা, বিশ্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা প্রকল্পে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়ার নতুন ভূমিকা দাঁড় করাতে হবে। নতুন ভূমিকায় মিডিয়া ও মিলিটারি বিচ্ছিন্ন থাকতে পারবে না। তাদের মিলে-মিশে কাজ করতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সেনাবাহিনীর সহগ ও অধস্তন শক্তি হিসেবে কাজ করতে হবে।
লেখার দ্বিতীয় অংশে সমকালীন বাংলাদেশের দুটো স্টিল ছবি আলোচনা করছি, আলোচনা প্রধানত ছবির জেন্ডার ডাইমেনশনকে ঘিরে। আমার আর্গুমেন্ট হচ্ছে, সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর, এ দেশে ম্যাসকুলিনিটি-র (পৌরুষ) ভিশুয়াল রেপ্রিজেন্টেশন নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়। প্রথম ছবির প্রকাশনা – যেটি সেন্সরড – ইমেজ জগতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। বিশৃঙ্খলা দূর করার লক্ষ্যে অন্য ইমেজের উৎপাদন – সেনাবাহিনীর কাছে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের ক্ষমা চাওয়া – জরুরি হয়ে পড়ে (তার অর্থ এই নয় যে এটি ইমেজ মাত্র, এটি কোনো বাস্তব ঘটনা নয়। এটি বাস্তব ঘটনারই ডকিউমেন্টারি ছবি)। এই যুক্তি ধরেই আমার বক্তব্য, প্রথম ও দ্বিতীয় ছবি সম্পর্কিত। শুধু তাই নয়, এ দুটি ধারাবাহিকভাবে, কজ-অ্যান্ড-ইফেক্ট ভাবে সম্পর্কিত। দ্বিতীয় ছবির উৎপাদন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে, এটি মিলিটারি ম্যাসকিউলিনিটিকে অগ্রাধিকারের স্থানে স্থাপন করে। কিন্তু, ছবি দুটোর সম্পর্ক যেহেতু কজ-এ্যান্ড-ইফেক্ট-এর, তাই প্রথম ছবির সেন্সরশিপ – পাবলিক স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার উদ্যোগ – অ-সম্পূর্ণ থেকে যায়।
২. লাশ ও আকাঙ্ক্ষা
একটি লাশবিহীন, নান্দনিক যুদ্ধ: সেন্সরশিপ জটিল, তা বলছিলাম। আর বলছিলাম, ১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধকে মার্কিন সরকার রেপ্রিজেন্ট করেছে একটি নিপাট ও লাশবিহীন যুদ্ধ হিসেবে।
এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর পক্ষে ছিল ৩,০০,০০০ সৈন্য। ইরাকের পক্ষেও ছিল ৩,০০,০০০ ইরাকি সৈন্য। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম ix -এর বহু ছবি এবং ভিডিও রিলিজ করেছে মার্কিন সরকার, কিন্তু কোনো স্টিল ছবি কিংবা কোনো ভিডিওতে, কোত্থাও লাশের কোনো ছবি নেই। মনে হবে এই যুদ্ধে কেউ মারা যায়নি। মনে হবে এ যুদ্ধ ছিল নিপাট, রক্তপাতবিহীন।
গ্রেনাডার ১৯৮৩-র সামরিক অভিযানে মিডিয়াকে ধারেকাছে যেতে দেয়া হয়নি। অভিযান-শেষে সেনাবাহিনী শুধু একটি প্রেস ব্রিফিং-এর আয়োজন করে। নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন মতে, “গ্রেনাডা যুদ্ধের পর থেকে, পেন্টাগন মনে করে বিজয় মানে সেন্সরশিপ।” x শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশিত শত্রু নিধনে খুশী হলেও, রণাঙ্গনের বাস্তব চিত্র দেখলে – লাশ, বিচ্ছিন্ন পা, এক টুকরো হাত, রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, ঘুরতে থাকা শকুনের দল, পঙ্গু সৈনিকের হতবিহ্বল চাহনি – ভোটাররা উদ্বেলিত হন না। কুয়েত আক্রমণের আগে, ১৯৯০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ তার কমান্ডারদের নির্দেশ দেন যাতে হতাহতের সংখ্যা (কী মার্কিন, কী ইরাকি সৈন্য) ন্যূনতম হয়। প্রেসিডেন্ট বুশের নির্দেশ যে পালন করা হয়েছিল তা এয়ার ফোর্স লেফটেনেন্ট জেনারেল চার্লস হোমার-এর কথা থেকে বোঝা যায় : “ক্লাস্টার মিউনিশিনের সাহায্যে আমরা আরো অনেক মারতে পারতাম, কিন্তু মারিনি।” xi বাস্তব হতাহতের সংখ্যা কমানো বাদে (লেঃ জেঃ হোমার মতে), সামরিক প্রেস ব্রিফিং আয়োজন করার মাধ্যমে, রণাঙ্গনে সাংবাদিক ও ফটো-সাংবাদিকদের না যেতে দেয়ার মাধ্যমে, মার্কিন টিভি চ্যানেলগুলোর নিউজ চাহিদা ‘গান ক্যামেরা’ ফুটেজ xii দিয়ে পূরণ করার মাধ্যমে, যুদ্ধকে বাস্তব করে তোলার চিহ্ন – হতাহতের সংখ্যা, আহত-নিহত সৈনিকের ছবি – কখনো কখনো অবাস্তব, কখনো কখনো অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা হয়। “আমি কিন্তু লাশ গোনার কায়কারবারে নামতে যাচ্ছি না”। অনুমান করা হয়, এই যুদ্ধে ৮০,০০০ থেকে ১,২০,০০০ ইরাকি সৈন্য মৃত্যুবরণ করেন xiii।
যুদ্ধের সময় সাংবাদিক, ফটো-সাংবাদিকরা কোথায় ছিলেন? যুদ্ধ কভার করার জন্য ১৫০ জন সাংবাদিকের একটি পুল গঠন করা হয়েছিল xiv কিন্তু এদের কেউ-ই লাশের কোনো ছবি তুলতে পারেননি xv। রণাঙ্গনের বাস্তবতা থেকে, হত্যাযজ্ঞ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। পুল সাংবাদিকদের একা চলাফেরা করতে দেয়া হয়নি। সেনা তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া তাদের কোথাও যেতে দেয়া হয়নি। সেনা তত্ত্বাবধায়কের তত্ত্বাবধান ছাড়া তারা কারো সাক্ষাৎকার নিতে পারেননি। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি স্টিল ছবি, ফিল্মের ক্ষুদ্রতম অংশের জন্য সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়েছিল xvi। পেন্টাগন সাংবাদিকদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, জাতীয় নিরাপত্তা বা সামরিক নিরাপত্তা, কিংবা সাংবাদিকদের নিরাপত্তার প্রশ্ন ছাড়া কোনো-কিছু সেন্সর করা হবে না। পেন্টাগনের জন্য বিব্রতকর, বা সমালোচনামূলক বলে সেন্সরের কাঁচি চালানো হবে না। কিন্তু বাস্তবে সেন্সরশিপ যেভাবে প্রয়োগ করা হয়, তা দেখে কোনো কোনো সাংবাদিকের মনে হয়েছিল, পেন্টাগনের গণযোগাযোগ অভিযানের স্বার্থ-রক্ষাই ছিল সেন্সরশিপ প্রয়োগের আসল কারণ xvii।
“লাশ গণনা করতে গেলে বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতির হিসেব-নিকেশ বিকৃত হয়ে যায়,” বলেন জাতীয় নিরাপত্তা প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক লরেন টমসন। “নান্দনিক এবং বাস্তবিক, উভয় দিক থেকেই লাশের কথা এড়িয়ে যেতে হয়।” xviii সেন্সরশিপের নানাবিধ জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি নিজের কাছে এই প্রশ্নটি রাখলাম: ১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধ – একটি নিপাট ও লাশবিহীন যুদ্ধ -কোন নন্দনতত্ত্ব-সংবলিত ছবির মাধ্যমে সবচাইতে ভালোভাবে উপস্থাপিত হতে পারে?
আমার মনে হয়েছে নিচের ছবিটি লাশের কথা ভুলিয়ে দিতে পারার সামর্থ্য রাখে (দেখুন ছবি ১)।
“ইরাকি কতজন মারা গেছে এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই…”
– ডেজার্ট স্টর্ম কমান্ডার জেনারেল নরমান শোওয়ারজকপফ
দখলদার বাহিনীর কাঙ্ক্ষিত ইমেজ : ২০০৩-এ ইরাক আগ্রাসন শুরু হয়। মিডিয়া ও মিলিটারির মধ্যে পার্টনারশিপ ঘোষিত হয়। তারই আলোকে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এমবেডেড জার্নালিজম নামে একটি প্রকল্প উন্মুক্ত করে xix। এমবেডেড বা প্রোথিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, সংবাদ প্রতিবেদক/আলোকচিত্রী সামরিক ইউনিটের সদস্য : তিনি সৈনিকদের সাথে থাকেন, তাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করেন, ঘুমান, তাদের সাথেই রণাঙ্গনে যান, সেখান থেকেই রিপোর্টিং করেন। নভেম্ব^র ২০০২-এ এমবেডেড জার্নালিস্টরা প্রাক-যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শুরু করেন। মার্চ ২০০৩-এ যখন যুদ্ধ শুরু হয়, ৭৭৫জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী পূর্ব-নির্দিষ্ট সামরিক ইউনিটের মধ্যে প্রোথিত হয়ে ইরাকে প্রবেশ করেন xx ।
উপসাগরীয় যুদ্ধে সরকার যেখানে পুল সাংবাদিকদের রণাঙ্গনের ধারেকাছে যেতে দেয়নি, সেখানে ইরাক যুদ্ধে দেখি খোদ পেন্টাগন-ই এর আয়োজন করছে। শুধু তাই না, সামরিক ইউনিটের ভিতরে বসবাসের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এই বড়সড় বদল আমরা কীভাবে বুঝব? কারো কারো মতে, প্রোথিত সাংবাদিকতা হচ্ছে সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীদের ‘সক্রিয়ভাবে যুদ্ধযন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত’ করার পেন্টাগন প্রকল্প xxi। আর যুদ্ধ-আয়োজকরা, তারা কী ব্যাখ্যা দেন? প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় বর্তমান ভাইস-প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী । যুদ্ধ-পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যুদ্ধে তথ্যর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণে এটা একান্তভাবে প্রেস-এর ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না, ‘ওদের ওপর আমি অতটা আস্থা বোধ করি না।’ তিনি আরো বলেন, “আমার দৃষ্টিতে প্রেস কোনো সম্পদ-টম্পদ নয়। প্রেস বরং একটি সমস্যা। [সরকারের] ওদের ম্যানেজ করতে হয়।” xxii
সামরিক ইউনিটের সদস্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে, সাংবাদিক আর ‘পর’ থাকেন না, তিনি সামরিক পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠেন। দু’পক্ষের মধ্যে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। জানমাল হেফাজতের জন্য, রণাঙ্গনের বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্য সাংবাদিক সৈনিকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন, একইভাবে সৈনিকের পক্ষ থেকেও প্রত্যাশা তৈরি হয় যে সাংবাদিকের পেশাজীবী দূরত্ব, তার সতর্কতা, নিরপেক্ষতা ইত্যাদি ধীরে-ধীরে ম্লান হয়ে পড়বে xxiii । তার পরিবর্তে, সাংবাদিকের মধ্যে গড়ে উঠবে একটি সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি। কারো-কারো মতে, প্রোথিত সাংবাদিকতা যুদ্ধ-রিপোর্টিং-এ কাক্সিক্ষত কিছু বদল ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ইরাক যুদ্ধের সংবাদ প্রতিবেদনে যুদ্ধ পরিস্থিতির তাড়া, তার তীব্রতা ফুটে উঠেছে। যুদ্ধের মানবিক দিকও ফুটে উঠেছে xxiv। আর এ কারণে, আগের তুলনায় বর্তমানের যুদ্ধ সাংবাদিকতা অনেক বেশি বাস্তবসম্মত xxv।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে আমি ইরাক যুদ্ধের ছবি দেখি আর নিজেকে প্রশ্ন করি : যুদ্ধ আয়োজকদের দৃষ্টিতে যুদ্ধের ‘কাক্সিক্ষত’ ছবিযে ছবি ফুটিয়ে তোলে যুদ্ধের মানবিক দিক, দখলদার সেনাবাহিনীর সাহসী দিক – কী হতে পারে?
আমার বাছাই করা ইমেজ নিচে দেখুন (ছবি ২, ছবি ৩) xxvi ।
কিন্তু পেন্টাগনের জন্য এটা অনেক বড় একটা ঝুঁকি না? প্রোথিত হওয়া সত্ত্বেও সাংবাদিককূলের কেউ যদি ‘ম্যানেজমেন্টের’ প্রত্যাশা পূরণ না করে? তারা যদি স্বাধীন সাংবাদিকতা অনুশীলন করতে চান? xxvii
ঝুঁকির সম্ভাবনা কমানো হয়েছে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে এই শর্তারোপের মাধ্যমে। চুক্তির শর্তমোতাবেক সাংবাদিক সেনাবাহিনীর কাছে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন : সাংবাদিকতার সম্পূর্ণ আউটপুটের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে থাকবে xxviii । অর্থাৎ, কী লেখা যাবে, কখন লেখা যাবে, কোন ছবি তোলা যাবে, কোনটি রিলিজ করা যাবে, এ ব্যাপারে সাংবাদিক সকল নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে রাজি হন। নিরাপত্তাজনিত কারণে যদি নিউজ ব্ল্যাকআউট-এর নির্দেশ দেয়া হয়, সেটিও মেনে নিতে রাজি হন xxix।
হতাহতের প্রিভেসি : ১৯৯১-এর নভেম্বরে, ডোভার বিমানবন্দরে ফিরতি মার্কিন সৈনিকদের কফিন নামানোর ছবির ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রথম বুশ সরকার। পেন্টাগনের ভাষ্যমতে, নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় মৃত সৈনিকদের পরিবারের প্রতি, তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের শোকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে। এই নীতি ইরাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, মার্চ ২০০৩-এ, আবারো ঘোষিত হয়, অতি কঠোরভাবে। অনেকেই জানেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : আহত-নিহত মার্কিন সৈনিকদের ছবি দেখলে, যুদ্ধের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের সমর্থন কমে যায় xxx । কিন্তু আরেকটি কাহিনী আছে, যা কম মানুষ জানেন : পানামার ১৯৮৯-এর আক্রমণের সার্থক সমাপ্তির পরে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ হোয়াইট হাউস থেকে সরাসরি-সম্প্রচারিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সাথে খুনসুটি করছিলেন। দুটো প্রধান নেটওয়ার্ক এ সময়ে টিভি স্ক্রীন দু’ভাগ করে অপর স্ক্রীনে আরেকটি অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে। ডোভার বিমানবন্দরে পানামা যুদ্ধে নিহত মার্কিন সৈনিকদের প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠান। বুশের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে বিমান থেকে কফিন নামানোর দৃশ্যের সম্প্রচার এর পর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়।
কফিনে ফিরতি সৈনিকদের ছবি তোলা বা সম্প্রচার নিষিদ্ধ, এর সাথে এ বছর আরেক-কিসিমের ছবির ওপর শর্ত আরোপ করা হয়। এমন শর্ত যা সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপণের-ই শামিল : আহত কোনো সৈনিকের ছবি ছাপতে হলে তার লিখিত অনুমতির প্রয়োজন। মুখমন্ডল না দেখা গেলেও লিখিত অনুমতির প্রয়োজন, যেহেতু সহযোদ্ধাদের দেখে বা আহত সৈনিকের ব্যাজ দেখে তাকে সনাক্ত করা সম্ভব। আবারো বলা হয়, প্রিভেসি রক্ষা করার লক্ষ্যেই এই শর্তারোপ xxxi ।
এটা ছাপা যাবে না… নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে শাস্তি পেতে হবে। ৪ নং ছবি এমনই একটি ছবি। ট্যামি সিলিকো-র তোলা। ছবি তোলার জন্য, সিয়েটেল টাইমস-এ প্রকাশিত হওয়ার জন্য কুয়েত বিমানবন্দরে কর্মরত মেট্যাগ এয়ারক্রাফট কর্মী সিলিকো-র চাকরি চলে যায়। পরের ছবিটি (ছবি ৫) কড়াভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার ঠিক-আগ মুহূর্তে তোলা। অর্থাৎ, সৈনিকের লিখিত অনুমতি ছাড়া এ রকম ছবি আগামীতে ছাপলে শাস্তি পেতে হবে। এটি সম্ভবত ইরাক যুদ্ধের শেষ আহত মার্কিন সৈনিকের ছবি। প্রোথিত আলোকচিত্রী মাইকেল ক্যাম্বার-এর তোলা। মজার ব্যাপার হলো, প্রিভেসির যুক্তি ক্যাম্বার মানেন না। তিনি বলেন, যুদ্ধ হচ্ছে পাবলিক ঘটনা। যুদ্ধের পরিণাম ঐতিহাসিক। আর তাই, যুদ্ধে কোনো-কিছু ঘটে যাওয়ার পরে, এটি প্রাইভেট, এ দাবি করা যায় না।
৩. বিশৃঙ্খল দৃশ্য
কথা হচ্ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকালীন দুটো ছবি নিয়ে। একটি প্রকাশিত হয়েছিল, পরবর্তীতে নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়। অপরটি বহুলপ্রচারিত, কখনো নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়নি। হয়নি, বাস এটা বললেই চলবে? আচ্ছা, সূক্ষ্মতার সাথে বলি, এখনো হয়নি। দ্বিতীয় ছবিটি, তার মানে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের ক্ষমা চাওয়ার ছবিটি কখনো নিষিদ্ধ হবে কি-না, হতে পারে কি-না, হলে কোন ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হতে পারে, প্রসঙ্গ হিসেবে এ বিষয়গুলো তোলা আদৌ বাস্তব কি-না, কাঙ্ক্ষিত কি-না – আমার পক্ষে কল্পনা করা কঠিন। উল্টো দিক থেকে প্রশ্ন তোলা – অর্থাৎ, যেটি বর্তমানে সেন্সরড তা কোনো দিন সেন্সর-মুক্ত হবে কি-না ইত্যাদি ইত্যাদি – আমার পক্ষে কল্পনা করা আরো কঠিন। কথাগুলো তুলছি কারণ কল্পনা করতে পারা, না-পারাও সেন্সরশিপের অংশ।
এ লেখার উপরের অংশের আলোচনা – ছবি ও সেন্সরশিপের বহুমাত্রিকতা – এ পর্যন্ত ভর করেছে ছবির ওপর (ছবি ১-৫)। দ্বিতীয় অংশের আলোচনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো ছবিকে ঘিরে, যার একটি সেন্সরড। যে ছবিটি সেন্সরড, স্পষ্টতই তা ছাপা যাচ্ছে না (দেখুন ছবি ৬)। সেটি কী নিয়ে, তা পাঠককে বোঝাব কেমনে? সেন্সরড ছবির বর্ণনা কোন ভাষায় করব? উপরন্তু, ছবি বর্ণনার ভাষা যাতে সেন্সরশিপের সীমারেখা লঙ্ঘন না করে, তা কীভাবে নিশ্চিত করব?
প্রশ্নগুলো পদ্ধতিগত। উত্তর পদ্ধতিগতভাবেই অনুসন্ধান করেছি। অনুসন্ধান করতে যেয়ে আরো নিশ্চিত হয়েছি যে ছবি দুটো ঘটনা-পরম্পরাভাবে লিংকড বা সম্পর্কিত। আর এ কারণে, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করে আবারো বলতে বাধ্য হচ্ছি, সেন্সরশিপ আসলেও খুব জটিল বিষয়।
সেন্সর-করা-ছবি বর্ণনার ভাষা : বলছিলাম, ছবি বর্ণনার ভাষা যাতে সেন্সরশিপের সীমারেখা লঙ্ঘন না করে, তা কীভাবে নিশ্চিত করব? অনুসন্ধান করে দেখলাম, ৩টি সূত্রের ভিত্তিতে ছবির অবয়ব রি-কনস্ট্রাক্ট করা যায়, ৩টাই সেন্সর-মুক্ত। শুধু তাই নয়, সূত্রমতে খুবই বিশ্বস্ত। অথেনটিক xxxii । একটি হচ্ছে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের ক্ষমা চাওয়া বক্তব্যটি, এটি আমি একটি প্রধান টেক্সট হিসেবে বিবেচনা করছি xxxiii । তার কারণ, ক্ষমা চাওয়া যাদের প্রতি উদ্দিষ্ট, তাদের কেউ এর সারকথা অস্বীকার করেছেন বলে জানা নেই। উদ্দিষ্টদের মৌন সম্মতি টেক্সট হিসেবে এর তাৎপর্য বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। মজার ব্যাপার হলো, এই টেক্সট একইসাথে পক্ষ-বিপক্ষের মানচিত্র খাড়া করেছে, যা একইসাথে ছবির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে আমাদের ধারণা দেয়। অন্য ২টো সূত্রের একটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, অপরটি সামরিক, তবে বেসরকারি xxxiv ।
এই তিনটি সূত্র থেকে ছবির বিষয়বস্তু কী, সে সম্বন্ধে কী ধারণা পাওয়া যায়? অধ্যাপক আনোয়ারের বক্তব্য থেকে জানতে পারি পক্ষে-বিপক্ষে কারা আছেন : সেনাবাহিনী/সামরিক বনাম সিভিলিয়ান/বেসামরিক xxxv । ‘সিভিলিয়ান’ বিভিন্ন শব্দ দ্বারা – ‘ছাত্ররা’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘শিক্ষক’, ‘শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক’, ‘ছাত্রদের অভিভাবক’ – প্রকাশিত হয়েছে, যা পরিপ্রেক্ষিত, অর্থাৎ ছবির স্থান-কাল-পাত্র সম্বন্ধে কিছু নির্দিষ্ট ধারণা দেয়। ছবিতে কিছু একটা ঘটছে, যা ঘটছে তা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্বরূপ, সেটাও অনুমান করা সম্ভব হয়। (অধ্যাপক আনোয়ারের বক্তব্যে ‘আঘাত’ শব্দ ৫ বার উচ্চারিত)। উপরের আলোচনার টুকরো অংশ, এবং ক্ষমা চাওয়ার যৌক্তিকতা বিচার করে অনুমান করি সিভিলিয়ান কেউ, সম্ভবত ছাত্র, কোনো সেনাসদস্যকে আক্রমণ করছেন। আক্রমণের ধরন কী তা অনুমান করা যায় বিএসএফ-এর একটি প্রতিবেদন-এর শিরোনাম দেখে, The “Flying Kicker” Identified xxxvi। “The” এবং “kicker” থেকে অনুমান করি ছাত্র পক্ষে একাধিক নন, একজনই ছিলেন। মনে হবে সেনাসদস্যও একজন, “একজন সেনাসদস্যের ওপর আঘাতটি পড়ে যায় গোটা সেনাবাহিনীর ওপর”। ‘এক’ শব্দটি এখানে রূপকও হতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয় তার সম্ভাবনা কম। যুক্তি দেখাতে বললে, আমার মানতে হবে এ পর্যায়ে পৌঁছে আমি কমনসেন্সের শরণাপন্ন হচ্ছি। আমি অনুমান করছি একজন নিরস্ত্র ছাত্র/সিভিলিয়ানের পক্ষে (ছাত্র/সিভিলিয়ান-এর হাতে অস্ত্র ছিল, তার উল্লেখ কোথাও পাইনি, আমার অনুমান, সশস্ত্র হলে অবশ্যই উল্লিখিত হতো xxxvii ), একাধিক সেনাসদস্যকে “flying kick” মেরে আক্রমণ (‘আঘাত’) করা বাস্তবিক-অর্থে অসম্ভব। আরেকটি বিষয় অনুমেয় : ছবিতে সেনাসদস্য ইউনিফরম পরিহিত অবস্থায় ছিলেন (“উত্তেজিত ছাত্ররা ইউনিফরম পরিহিত সেনাবাহিনীর ওপরও আঘাত করে,” “সেনাবাহিনীর ইউনিফরমের ওপর যদি কেউ আঘাত হানে…”)। এ ছিল ছবির বিষয় কী, তা রি-কনস্ট্রাকশনের কাজ।
এই ছবির প্রকাশ বিশৃঙ্খলা ঘটায় – এটি আমার আর্গুমেন্টের একাংশ। অধ্যাপক আনোয়ারের বক্তব্যে আমরা সেনাবাহিনীর ‘অপমান’বোধের কথা, তাদের ‘বিব্রতবোধ’-এর কথা, ‘মনে … আঘাত’ লেগেছে, সে কথার উল্লেখ পাই xxxviii । আমি সেটা নিয়ে বলছি না। আগেই বলেছি, আমার আলোচনার বিষয় রক্ত-মাংসের মানুষ না, বরং ছবি, বা রেপ্রিজেন্টেশন। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ-শাসনের দায়িত্ব গ্রহণের পর (জানুয়ারি ১১, ২০০৭), এ দেশের ভিশুয়াল রেপ্রিজেন্টেশনের জগতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বদল ঘটে। টিভি, প্রিন্ট মিডিয়া, উভয় ক্ষেত্রেই এ বদল ছিল লক্ষণীয়। ম্যাসকিউলিনিটির ধরন হিসেবে ‘সামরিক ম্যাসকিউলিনিটি’ একটি সুনির্দিষ্ট, বিশিষ্ট এবং কাঙ্ক্ষিতভাবে পুরুষ-হওয়াকে রেপ্রিজেন্ট করা শুরু করে। এই ভিশুয়াল ইমেজ-নির্মাণ নির্বাচিত সরকার আমলের (১৯৯০-২০০৭) ম্যাসকিউলিন রেপ্রিজেন্টেশান থেকে লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন, সে সময়কালে সামরিক পৌরুষ একইভাবে ইলেক্ট্রনিক কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায় দৃশ্যের সম্মুখভাগে (visually foregrounded) ছিল না। সামরিক পৌরুষ নির্মাণে ইউনিফরম কেন্দ্রীয়; এ ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে টিভি-তে xxxix প্রচারিত গানের সাথে সামরিক প্রশিক্ষণের দৃশ্য। ইউনিফরম হচ্ছে সামরিক পৌরুষ-এর প্রতীক, আর ইউনিফরম-এর অর্থ হচ্ছে শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, কষ্টসহিষ্ণু হওয়া। কঠোর ও কঠিন সামরিক প্রশিক্ষণের দৃশ্য অর্থ লাভ করে দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেমের অনভূতির পরিসরে। সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনী সহায়ক প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে নির্মিত এই টেলিভিশুয়াল ‘নিজ’ -অর্থাৎ সামরিক পৌরুষ সম্বন্ধে – যে জ্ঞান উৎপাদন করে (self-knowledge) তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘দুঃসাহস’।
ইউনিফরম প্রসঙ্গে ফিরে আসি। অধ্যাপক আনোয়ারের বক্তব্যে ‘ইউনিফরম’ আলাদাভাবে উল্লিখিত, “উত্তেজিত ছাত্ররা ইউনিফরম পরিহিত সেনাবাহিনীর ওপরও আঘাত করে। একজন সেনাসদস্যের ওপর আঘাতটি পড়ে যায় গোটা সেনাবাহিনীর ওপর…” xl । রেপ্রিজেন্টেটিভ-নেস অর্থে ‘ইউনিফরম’, ‘একজন সেনাসদস্য’ ও ‘গোটা সেনাবাহিনী’র এই সমীকরণ, এক কথায় বললে, অভূতপূর্ব। বক্তব্য-শেষে তিনি আবারো বলেন, “সেনাবাহিনীর ইউনিফরমের ওপর যদি কেউ আঘাত হানে…”। একইসাথে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অধ্যাপক আনোয়ার সেনাবাহিনীর সমগ্রতাকে ম্যাপ-আউট করেন সর্বোচ্চে অবস্থিত ‘সেনাপ্রধান’ ও সর্বনিম্নে-অবস্থিত ‘সাধারণ জওয়ান’, দুই প্রান্তের দুই পদ দ্বারা, দুই প্রান্তের মধ্যে অবস্থিত সেনাকূল দ্বারা। আমার বক্তব্য হচ্ছে, এই সমীকরণ ও ম্যাপিং-আউট যুক্তি-চর্চার (line of reasoning) বিশেষ ধারার মধ্যে অবস্থিত। উপরন্তু, আমার বক্তব্য হচ্ছে, এই সমীকরণ ও ম্যাপিং-আউট-এর পরিণাম ভয়াবহ। সেন্সরড ছবির সাহায্যে ব্যাখ্যা করি : সমীকরণের কারণে ছবি সবধহরহম-অর্থে অত্যধিক ভরপুর হয়ে ওঠে। ছবির ‘ছাত্র’ হয়ে ওঠেন সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের, সমগ্র সিভিলিয়ান সেক্টরের প্রতিনিধি, আর একজন (অভাগা) সেনাসদস্য হয়ে ওঠেন সমগ্র সেনাবাহিনীর, সমগ্র সেনাবাহিনীর মান-সম্মান, মর্যাদার প্রতিনিধি। সেনাবাহিনীর গায়ে একটি বিশেষ অর্থাৎ অ-সাহসী – আটকে যায়, তার মাধ্যমে রেপ্রিজেন্টেশনের জগতে সেনাবাহিনীর অপরাপর অর্থ, বীর, দুঃসাহসী ইত্যাদি (শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয়, জাতিসংঘের মিশনে দেশের বাইরেও) ম্লান হয়ে যায়। মুছে যায়। আমার ধারণা, অধ্যাপক আনোয়ারের এই বক্তব্য যাদের প্রতি উদ্দিষ্ট, তাদের line of reasoning একই।
আগেই বলেছি, বিশৃঙ্খলা দূর করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর কাছে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের ক্ষমা চাওয়ার ইমেজ জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু ইমেজ জগতে শৃঙ্খলা ফিরে আসলেও, ছবি দুটো ঘটনা-পরম্পরা দ্বারা লিংকড হওয়ার কারণে, কজ-অ্যান্ড-ইফেক্ট ভাবে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে, দ্বিতীয় ছবির উপস্থিতি, তার প্রেজেন্স, অনুপস্থিত অন্য-কে, একটি অ-সাহসী ইমেজকে মনে করিয়ে দেয়।
সেন্সরশিপ সত্ত্বেও।
[ প্রবন্ধটি লেখা হয়েছিল অনলাইন প্রকাশনা বিডিনিউজ২৪.কম-এর আর্টস পাতার জন্য, ২৫.১০.২০০৭-এ প্রকাশিত প্রথম সংখ্যার জন্য। দিনকাল ভালো নয়, সম্ভবত এ কারণে তারা প্রকাশনার সিদ্ধান্ত পাল্টান। ]
রেহনুমা আহমেদ
Latest posts by রেহনুমা আহমেদ (see all)
- বিশৃঙ্খল দৃশ্য: পৌরুষ, পাবলিক স্মৃতি ও সেন্সরশিপ - অক্টোবর 27, 2014