কিছু কালচারাল উইপন মিউজিয়ামে রাখতে চাই আমি
বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি-পপুলার ডিসকোর্সে সিনেমার ইন্টারভেনশন বুঝতে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ভালো এক্সাম্পল। জাতীয় গান, পাকিস্তানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, পড়ালেখার বাইরে স্টুডেন্টদের রাজনৈতিক দায়িত্ব মনে করাইয়া দেওয়া, গণলিপ্সু রাজনীতি প্রমোট করা, সুইসাইড ফ্রিডম ফাইটার হইতে ফুসলানো–কয়েকভাবেই এই মুভি ইন্টারভেন করতে পারছিলো মুক্তির সময়কালের পাকিস্তানে বা একটু পরের বাংলাদেশের ফ্রিডম ফাইটে। পরে এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও; সামরিক জিয়ার শাসনের টাইমে এই মুভি বিশেষ কোন ভূমিকা রাখতে পারে নাই–সেই পিরিয়ডে পলিটিক্যাল মুভমেন্ট বিশেষ নাই; ফারাক্কার দিকে ভাসানির লং ড্রাইভ আখেরে বিএনপি’র রাজনীতিরেই সার্ভ করে। ওদিকে, জামাত/মুসলিম লীগ/বামদের টাইট রাখতে আওয়ামী লীগরে সংগঠিত হইতে দেন জিয়া, পরে হাসিনারে আনেন, সো সামরিক জিয়ার প্রতি আওয়ামী লীগ মে বি উল্টা গ্রেটফুল আছিল রিভাইভালের জন্য, মুভমেন্ট কেমনে করবে!
তো, ‘জীবন থেকে নেয়া’ পাওয়াফুল মুভি আছিল, মে বি এখনো। যদি খোঁজেন, কেমনে পাওয়ারফুল এইটা, কী কী পাই আমরা?
লৌহমানব আইউব খানরে মাইয়া বানাইয়া এই মুভি আইউববিরোধীদের মনোবল বাড়ায়; আইউবরে মাইয়া ভাবা গেলে জেতার কনফিডেন্স পাওয়া যায়; সমাজে মাইয়াদের দুর্বলতা তো এক জানা ব্যাপার। শত্রুরে লইয়া ফান-মেকিং ভয় কমায়; কোন পোলার ভিতর মাইয়া দেখানো গেলে ফান-মেকিং হয় এই সমাজে, এইটা একই লগে আবার মাইয়াবিরোধী হেট-ক্যাম্পেইনও। বাংলাদেশের গড় মাইয়াদের চাইতে খাটো রওশন জামিলের মাপে আইউব-ইয়াহিয়ারে ভাবা গেলে সুবিধা হয়, তায় মাইয়া; আর আমগো নেতা ছয়ফুট পোলা, আমরা তো জিতবোই!
আইউবের পইড়া যাওয়া তাইলে মাইয়ার বিপক্ষে পোলার জয়, এবং তাইতো হবার কথা। পোলারা হারে না, হারি নাই আমরাও–আমরা পোলা। পরে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস মাইয়া আইউবের পড়ায় বাংলা পোলাগো বাইরে আর কাউরে জায়গা দেয় নাই, তাতে বাংলার পোলাহুডের আরো পাওয়ারফুল ইমেজ কনফার্ম হইলো। এই ইতিহাসে যদি পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর আইউববিরোধী মুভমেন্ট ঠিকঠাক লেখা হয় তাইলে প্রোবলেম; ১৯৬৭ সালে পয়দা হওয়া ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি ৭০ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগরে খেদাইয়া দিলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে–জন্মের ৩ বছরের মাথায় ভুট্টোর পার্টির এই বিজয় তখন পূব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিজয়ের চাইতে এ্যশটোনিশিং লাগবে; আমাদের জাতীয় পোলাহুডের জন্য দরকার হইলো, কেবল আমাদের গণ-অভ্যুত্থান দিয়াই মাইয়া আইউবরে ফালানো, ভুট্টোরে ভাগ দিমু না।
পোলাহুডের এই সেলিব্রেশন, জহির রায়হানের এই মুভি এখন কি তাইলে নিবো আমরা? জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি এনশিওর করা একটা কন্সটিটিউশন আছে আমাদের, মাইয়াবিরোধী হেট-ক্যাম্পেইন থামানো দরকার আমাদের; এমন এক টাইমে এই মুভি লইয়া কি করবো আমরা? এখন এক মাইয়ার শাসনে আছি আমরা, এই সরকার পয়দা হইতে নির্বাচন লাগে নাই, ১৫০’র বেশি সরকারি এমপি নির্বাচন বাদেই হইতে পারছেন; ডেমোক্রেসি সাসপেন্ডেড রাখা এমন এক সরকারে বিরুদ্ধে এই মুভি কোন কামে লাগছে? একজন মাইয়ারে মাইয়া বলে গালি দিয়া এখন কতটা ফান পয়দা করতে পারছি আমরা?
ওদিকে, সমাজে বউদের পাওয়ার খুবই ভুলভাবে হাজির করে এই মুভি; স্ত্রৈণ স্বামী বলে কিছু একটা প্রায় সংস্কৃত বাংলায় আছে, এই মুভির স্বামী তেমনও নয়, মুভির এক্সটেন্ডেড ফেমিলির কিছুরই মালিক নন ভিলেন বউ-রওশন জামিল, বাট তার একক অথরিটি হাজির করে মুভি; বিপরীতে, সমাজে দেখি, মাইয়ারা প্রোপার্টির মালিক হইলেও এনটাইটেলমেন্ট নাই, স্বামীর ১৪ গোষ্ঠীর সেবাসহ স্বামীর সংসারে ১৬ ঘণ্টা কাম করলেও মজুরি নাই, মাঝে ১ ঘণ্টা টিভি দেখতে বসলে স্বামী-ননদ-শ্বাশুরি থেকে বুদ্ধিজীবী–সবাই মশকরা শুরু করে, বাপের বাড়ির প্রোপার্টি ভোগ করতে গেলে খারাপ মাইয়া হইতে হয়।
‘জীবন থেকে নেয়া’-নামের ভিতর রিয়েল সমাজ-জীবন হাজির করার ক্লেইম থাকার পরেও আখেরে মুভির কাছে রিয়েলিটির অনুগত থাকার দাবি করা যায় না, বাট আমাদের চেনা দরকার–কোন মুভি পলিটিক্যালি কোন পক্ষ নিতাছে; এই মুভি মাইয়ার দুশমন, ঐ ফেমিলিতেই আরেক মাইয়া বউ হইয়া আসার পরে কেমনে সে ঐ ভিলেন বউরে সাইজ করে–এই আইওয়াশ ঐ দুশমনী লুকাইতে পারে নাই।
তবু, মাইয়াদের দুশমনরে আদর করার লোকের অভাব নাই দেশে; বাট তাগো পছন্দ না হবার মতো ব্যাপারও আছে এই মুভিতে। পরের বাংলাদেশের জাতীয় গান বাদেও রঠা’র শ্লোগানের ইউজ আছে–“…নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।” দেখা যাইতাছে, জান দিয়া দিতে ডাকাডাকি করছেন জহির রায়হান, রঠা’র শ্লোগান দিয়া। বাংলাদেশের ফ্রিডম ফাইটে এই শ্লোগান নিশ্চই ফাইটারদের মাঝে জান দেবার লোভ তৈরি করছিলো, সুইসাইডের ডিজায়্যারঅলা ফাইটার যুদ্ধে বেশ উপকারী বটে।
বাট, ইতিহাসের এই বেলায় আসার পরে আমরা দেখতাছি, কবি-আর্টিস্টদের করা সুইসাইডের অমন জয়গান করতে থাকা এতদিনে হাছাই সফল বলার টাইম হইছে; যুদ্ধতত্ত্বের বিকাশের ইতিহাস খেয়াল করলে দেখবো, শিকারী এবং শিকারের দূরত্ব বাড়াবার ট্রাই করা হয়; যেমন, ছুরি থেকে তীর-ধনুক দিয়া দূরে থাইকা মারা যায়, রাইফেল দিয়া আরো দূরে, মিসাইল দিয়া আরো দূর; আরো একটা ব্যাপার হইলো এফিসিয়েন্সি-সফলতার হার এবং একবারে কত মারা যাইতাছে; এই ব্যাপারে ভাবা যায়, কামানের গোলা থেকে এটম বোমা; কেমিক্যাল উইপন ভবিষ্যতের শত্রুও ঠেকাইয়া দেয়–ফার্টিলিটির ড্যামেজ ঘটায়, খাদ্য নষ্ট করে এবং বিকলাঙ্গ বাচ্চার জনম ঘটে। বাট সবগুলির বেলাতেই শিকারীর সেফটি এনশিওর করা হইতাছে–এই ব্যাপারে লেটেস্ট আইলো ড্রোন।
সুইসাইড যুদ্ধ আসলে ঐ যুদ্ধতত্ত্বের গলদ দেখাইয়া দেওয়া; কেননা, ঐ তত্ত্বে অনুমান করা হইতাছে শত্রুও একই থিওরি মানে, বাট, সুইসাইড যুদ্ধ নিজে সেফ থাকাটারে অদরকারি করে তোলে; কেউই মরতে চায় না–ভাবনাটারে ভূয়া বানাইয়া ফেলে, ঐ যুদ্ধতত্ত্বের জন্য বেকুব হবার মতো ঘটনা এইটা; এতদিন ছিল দুইটা দলের যুদ্ধ, বিভিন্ন উইপন দিয়া, এখন এইটা দুইটা যুদ্ধতত্ত্বেরো যুদ্ধ।
নতুন এই যুদ্ধতত্ত্বের এসথেটিকস্ পয়দা-প্রচার করতেছিলেন রঠা এবং জহির সাহেব, আরো বহু কবি-আর্টিস্ট; ১৯৯০ দশকের বহু হলিউড মুভি এই তত্ত্বের এক্সিকিউশনও দেখাইয়া দিছে; মনে পড়তাছে ‘Seven’ বা ‘in the line of fire’-এর কথা; গাড়িবোমা তো সেই কবে থেকে শত শত অ্যাকশন থ্রিলারের কমন ফিচার। ২০০২ সালের ‘Collateral Damage’ ব্যাপারটারে আরো আগাইয়া নেয়–নিজের বাচ্চা মাইয়া ইউজ করে বোমা হামলায়; এইটা অবশ্য এখনো বিশেষ পাই নাই আমরা, কনসিভ করতে আরো টাইম লাগবে মে বি। যাইহোক, এতো এতো ফুসলানি আর ট্রেনিং-এর ফল দুনিয়া এখন, এতোদিনে পাইতাছে। মরতে আগ্রহী ফাইটার বেশ পাইতাছি আমরা এখন; বোমা লইয়া বাজারে, মসজিদে, জমায়েতে যাইতাছে ফাইটাররা, ফুটাইয়া দিচ্ছে বোমা, নিজে মরার আনন্দের লগে পাইতাছে শত্রু মারার প্লেজার। সুইসাইড ফাইটাররা অবশ্য শত্রু যুদ্ধতত্ত্ব হতে পুরা যুদা না; বাচ্চা/মাইয়া/বেসামরিক মানুষ মারার ভাবনা শেয়ার করে দুইটাই; কতিপয় বেকুব কইতে পারেন, এগুলি সুইসাইড যুদ্ধতত্ত্বের যুদ্ধ-ভাবনা; এটম বোমা মারার ব্যাপারটা বাদেও বুঝতে পারবেন যে এইটা আগের যুদ্ধতত্ত্বের মাল; বাচ্চা/মাইয়া/বেসামরিক মানুষ মারার ভাবনা না থাকলে কেমিক্যাল উইপন বানানো যায় না, হারাম হয় পুরাই; এমনকি, কেবল মানুষ মারাই ইনটেনশন না কেমিক্যাল উইপনের, অপরাপর প্রাণ আর পরিবেশ সবাইরেই মারার উইপন এইটা। এগুলি কেমনে কেমনে যেন তালাল আসাদ কইছেন কদ্দূর, আদমবোমা ইত্যাদি ড. সলিমুল্লাহ খানের তরজমা আর তাফসিরে পড়তেও পারেন আসাদ।
যাহোক, আমাদের সবাইকেই কোন না কোন যুদ্ধতত্ত্ব মারতে চাইতাছে বলে দেখা যাচ্ছে; আসলে যুদ্ধের ময়দানেই আছি আমরা। কী করা উচিত আমাদের? রঠা আর জহির সাহেব দিয়া আমরা কি সুইসাইড ফাইটার বানাবার ট্রেনিং চালু রাখবো, সেলিব্রেট করবো ‘জীবন থেকে নেয়া’?
বাংলাদেশ পয়দা হওয়ায় ইউজ করা বিভিন্ন উইপন সামরিক যাদুঘরে রাখা আছে; আমরা সেগুলি আর ইউজ করি না; এই মুভিও ভালো একটা কালচারাল উইপন হিসাবে কামে দিছিলো; যেমন হইতে পারে সামরিক উইপনের বেলায় তেমনটা পারে কালচারাল উইপনের বেলাতেও–দুইটাই নষ্ট হইতে পারে কালে; কালচারাল উইপনরে যেন বাড়তি স্নেহ না করি আমরা। এই মুভি নষ্ট একটা উইপন এখন; যেমন নষ্ট আরেকটা কালচারাল উইপন হইলো ‘জয় বাংলা’। জয় বাংলার সেই জোশ এখন মান্দি-চাকমা-বিহারির জীবন-বুলি-প্রোপার্টি মারার অতিরিক্ত ভালো কিছু সার্ভ করতে পারে না। ম্রো’দের একটা সভায়, সাঁওতালের একটা কালচারাল জমায়েতে, বিজুতে যাইয়া ‘জয় বাংলা’ বলার চাইতে হামলাকারী আর আগলি কথা খুব বেশি খুঁজে পাবো না আমরা। কখনো আবার ফানিও হইয়া উঠতে পারে ব্যাপারটা; পশ্চিমবঙ্গের লগে ক্রিকেট বা কুতকুত খেলতে যাইয়া বাংলাদেশের প্লেয়াররা ‘জয় বাংলা’ বইলা ঝাপাইয়া পড়লে ব্যাপারটারে ফানি ছাড়া কিছু ভাবা মুশকিল হবে অডিয়েন্সের।
সো এইগুলি এখনো ইউজ করতে গেলে বিপুল নাগরিকের গায়ে যাইয়া লাগবে, এই হেট ক্যাম্পেইন আর সুইসাইড ফাইটার বানাবার কালচারাল উইপনরে ভালো মুভি হিসাবে পরিচয় করাইয়া দিয়া আমরা যেন মুভি-মেকার আর অডিয়েন্সরে ঘেন্না আর হত্যাচর্চা করতে না ফুসলাই।
রক মনু
Latest posts by রক মনু (see all)
- হিস্ট্রিওগেরাফি এন্ড পলিটিকেল লয়ালটি - অক্টোবর 18, 2024
- খলিফা হইয়া ওঠা - সেপ্টেম্বর 2, 2024
- আমাদের নিয়ত এবং বাংলাদেশের ফিউচার - আগস্ট 25, 2024