বিনোদিনী দাসী’র কয়েকটি কবিতা
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ – ১৯৪১) থিয়েটারের অভিনেত্রী হিসাবেই পরিচিত। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। উনার আত্মজীবনী ‘আমার কথা’ (১৯২০) এখনো রিলিভেন্ট একটা টেক্সট, অনেকগুলি কারণেই। কিন্তু উনার দুইটা কবিতার বই – বাসনাi এবং কনক ও নলিনীii ছাপা হইলেও ‘বঙ্গের মহিলা কবি’তেiii শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ৩৩ জন বিশিষ্ট এবং ১৭ জন নন-বিশিষ্ট কবিদের মধ্যে উনার নাম নিতে পারেন নাই। সোসাইটিতে, কবিতা যে ক্লাস সুপরিয়রিটির একটা ব্যাপার এই ঘটনা থিকা এইটা স্পষ্ট হওয়ার কথা।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
বিনোদিনী দাসী’র কোন সোশ্যাল ক্লাশ ছিলো না। সমাজ’রে উনি ঘৃণা করতেন এই কথাও জানা যায়।iv উনি এমন একটা টাইমে জন্মাইছিলেন যখন পেশা হিসাবে বাঈজী আর এগজিস্ট করে না এবং বেশ্যা হওয়াটাও পুরাপুরি ডিফাইনড হয় নাই; বরং এর মাঝখান থিকা থিয়েটার করা বাজে মেয়েমানুষ হিসাবেই উনি পরিচিত হইতে পারছিলেন। যেই কারণে জগদীশ গুপ্তের উপন্যাসে ‘বেশ্যাবিবাহ’ রবীন্দ্রনাথ মানতে পারেন নাইv একই কারণে বিনোদিনী দাসী যে কবিতা লিখেন এইটাই বিশ্বাসযোগ্য কোন ঘটনা হইতে পারে নাই। স্টিল নাউ ঘটনাটা এইরকমই।
নিজের খায়েশ মোতাবেক চলা বা করা–ইন্ডিপেন্ডেন্স যারে কয় আর কি–বিনোদিনী’র কাছে সেইটা বিশেষ কিছু পাইয়া ফেলা না; কেননা, বিনোদিনীর ক্লাসে খায়েশ একটা হরদম ঘটনা, খায়েশ পূরণও। ফলে স্বর্ণকুমারী বা কামিনী রায়ের কাছে যেগুলি সাকসেস বিনোদিনীর সেইটা ইনহেরিটেন্স! সো, এই বিনোদিনী স্বর্ণকুমারী-কামিনীর ক্লাসে এন্ট্রি চাইলেন ঠিকই, নিউ ক্লাসের দরজার বাইরে বহু কিছুই রাইখা যাইতে রাজি হইলেও সাকসেসের ডেফিনিশনটা ফালাইয়া যাইতে রাজি হন নাই। মালিক হইতে চাইলেন বিনোদিনী, স্বর্ণকুমারীরা তখনো নিজের নড়াচড়ার জন্য একটু স্পেস–কেবল নিজের মালিক হবার লড়াইটাই পুরা করতে পারেন নাই, আগে থেকেই নিজের মালিক বিনোদিনী তখন প্রোপার্টির মালিক হইতে চাইছেন, নিজের প্রোপার্টি দিয়া আর্টের ব্যবসা কইরা খাইতে চাইতাছেন।
পোলাদের কানগুলি তাগো কথাও একটু শুনুক, কেননা দুইটা কথা তাগোও আছে–স্বর্ণকুমারীরা কবিতায় যখন অতটুকু স্রেফ চাইতাছেন, ভিক্টোরিয়ান এথিকস্ মাইনা পাপের শরীল লুকাইয়া স্রেফ মনের কথা কইতাছেন বিনোদিনী তখন শরীলে ঢেউ তুইলা পোলাগো লগে নেগোসিয়েট করতাছেন, ওয়াদা না রাখা পোলাগো অভিযোগ আর গালি দিয়া মেসমার কইরা দিতাছেন।
বিনোদিনী তাই স্বর্ণকুমারীদের ক্লাসের কবি হইতে চাইলেও এমন কিছু করতে পারতাছেন যা স্বর্ণকুমারীদের পারতে আরো ১০০ বছর লাগবে; ইভেন ১০০ বছর পরেও রোকেয়াদের দেখানো রাস্তায় বড়জোর তসলিমাদের পাইবো আমরা, কেননা বিনোদিনী আমদানি করা চিন্তায় পয়দা হন নাই, এইখানকার ইতিহাসে পয়দা হইছেন–আমদানি করা চিন্তার লগে ডায়ালেক্টিক্সের ভিতর দিয়া। বিনোদিনী একটা প্যারালাল, বিনোদিনী মরণ সেই প্যারালালেরও মরণ। তবু, আজকের আমরাদের ডি-কম্পোজ যদি করতে চাই, রি-ক্রিয়েট যদি করতে চাই, তুমুল ডি-কন্সট্রাকশনের ভিতর দিয়া যাইতে যদি রাজি হইতে পারি কখনো–বিনোদিনীরে আমাদের কামে লাগবে।
—————————————————————–
কি কথাটি তার ।। আবার চাঁদ ।। একটি গোলাপ ।। সোহাগ ।। শিখাও আমায় ।। কেন যে এমন হল।। কোথা গেলি ।। অবসাদ।।
—————————————————————–
কি কথাটি তার।
কি যেন প্রাণের কথা বলে গেল কে?
যেন কোন দূর দেশে, কি যেন প্রাণের আশে
কিসের তরে কোথায় যেন গিয়েছিল সে
কি যেন প্রাণের কথা বলে গেল কে?
যেন সে চাঁদের কোলে তারার সনে
খেলতো দিবা নিশি।
যেন সে ফুলের সনে হেলে দুলে
নাচতো সুখে ভাসি।
যেন সে মধুর আলো গায়ে মেখে
চলতো বাতাস ভরে
যেন সে শূন্যে মিশে
যেতো ভেসে দেশে দেশান্তরে।
যেন সে প্রাণের ভিতর ধরত কত
সোহাগের ফুল
আপন মনে থাকতো সদা
ঘুমে ঢুলু ঢুলু।
জানতো যেন আকাশেতে
বাড়ী ঘর তার
আর কি কোথায় আছে কিনা
জানতো নাকো আর।।
যেন সে ভেসে ভেসে দেশে দেশে
ধরতো ফুলের হাসি।
কত সাধ করে আপন গলায়
পরতো প্রেমের ফাঁসি।।
যেন সে চাঁদের চুমোয় বিভোর হয়ে
হতো আপন হারা
মলয়ানিলে কোলে করে
ভাবতো পাগল পারা।।
যেন সে ঘুমের ঘোরে চমকে উঠে
চাইতো চারি ধার।
দেখতো কাছে সদা আছে
মুখখানি কার।।
এখন যেন সেখান হতে যাচ্ছে চলে সে।
কি যেন প্রাণের কথা বলে গেল কে।।
আবার চাঁদ
শশি রে সুন্দর সাজ কে দিয়েছে তোরে।
ভাল বাস ভাল বাসি আনন্দ সাগরে ভাসি
বুক ভরা মুখ ভরা ঐ হাসি হেরে;
জুড়াতে প্রাণের জ্বালা কে শিখাল তোরে।।
চাঁদ রে শুধাই তোরে বল একবার।
এমন মধুর প্রাণ, সুধা ভরা কাণে কাণ
অঙ্কিত করেছ কেন কলঙ্ক রেখায়
এতরূপে হৃদি কালী ঢাকা নাহি যায়।।
বল শশি! কি বেদনা প্রাণেতে তোমার
কেন ও হৃদয় মাঝে, কলঙ্কের রেখা সাজে
কি আঘাতে ভেঙ্গেছে ও নির্ম্মল হৃদয়।
(আহা) না জানি হৃদয় তব কত ব্যথা সয়।
আমারে বলিতে শশি! দোষ নাহি কিছু
সমব্যথী হলে পরে, বেদনা জানায় তারে
ব্যথিত হৃদয় তার হয় যে সাত্বনা
শশি রে মনের দুঃখ আমায় বল না!
একটি কালীর দাগে এত তব যাতনা
দেখ এ হৃদয় মাঝে, কত শত দাগ সাজে
দেখ কত শিখিয়াছি সহিতে বেদনা।
শশি রে মনের দুঃখ আমায় বল না।।
একটি গোলাপ
কার তরে ফুটেছ লো গোলাপ সুন্দরী
কে তোরে আদর করে
কে রাখে হৃদয় পরে
কার জন্যে ছড়াতেছ রূপের মাধুরী।।
বল কার আদরেতে তুমি আদরিণী
কে তোমায় ভালবাসে
কার সুখ-সাধ আশে
পরেছ সুন্দর সাজ ওলো সোহাগিনী।।
কিবা কথা বল্ তোর সমীরণ সনে
দুলে দুলে ঢলে ঢলে
হেসে হেসে গলে গলে
আদরে সোহাগ ভরে আনন্দিত মনে।।
জাননা কি চিরকাল থাকে না আদর
আজি প্রফুল্লিত মনে
মিশায়ে সোহাগ সনে
যার কথা কহিতেছ আনন্দ অন্তর।।
দুই দিন পরে তুমি দেখিও আবার
তোমার সে প্রাণধন
আনন্দে বিভোর মন
অন্য ফুলে করে পান মধু অনিবার।।
এখন আদরে তোরে হৃদয় ধরেছে
কালি নাহি রবে ঘোর
ভাঙ্গিবে স্বপন তোর
দেখিবি অন্যের প্রেমে সোহাগে মজেছে।।
সোহাগ
আসে সন্ধ্যা দেখি সব নাচে ফুলচয়
হাসে কলি, গায় পাখী
সোনার বরণ মাখি
হেলে দুলে তরতরে বহিছে মলয়।।
পরশে মলয়ানিল কালিকা সকল
কেহ চমকি চাহিল
(মৃদু) হাসি কেহবা হাসিল
অনিল পরশে কেহ হইল বিকল।।
মৃদু মৃদু ধীরে ধীরে বহিল পবন
ফুটিল গোলাপকলি
রূপের ঘোমটা খুলি
আদরেতে সমীরণ চুমিল বদন।।
সোহাগে গোলাপ কয় যাও নাথ যাও
এখন কহিছ মত
প্রেমকথা নানা মত
মল্লিকা পাশেতে গেলে ফিরে নাহি চাও।।
জানি হে পুরুষজাতি নিঠুর-নিদয়
থাকে যবে যার কাছে
যেন সে তাহার আছে
অদর্শনে কোন কথা প্রাণে নাহি রয়।
যাও যাও প্রাণনাথ আদর এ নয়।।
শিখাও আমায়
আজিকে শশাঙ্ক বড় সেজেছ সুন্দর।
কালিমা হৃদয়ে,
পরাণ গলায়,
আনন্দেতে মত্ত হয়ে হয়েছ বিভোর।।
কাহার হৃদয় শশী করিতে রঞ্জন
লয়ে ফুল হাসি
খেলা কর শশী
মেঘেতে ঢালিয়ে কায় কোথায় গমন?
লইয়া কলঙ্ক রেখা হাসিছ কেমন
কলঙ্কিনী নাম
ঘোষে ধরাধাম
দেখ এ হৃদয়শূণ্য তম-আবরণে
যুগান্তের জ্বালা শশী সহিছ কেমনে।।
দেখ হে সুধাংশু নিতি হইলে নির্জ্জন
বসি তরুতলে
নয়নসলিলে
ধুইয়া করিতে চাই কলঙ্ক বর্জ্জন।
ততই হৃদয় মাঝে দহে হুতাশন।।
একটি বচন তুমি রাখ আজি মোর।
হৃদয়ে কলঙ্ক
লইয়ে শশাঙ্ক
কেমন হইয়া থাক সুখেতে বিভোর।
আমারে শিখাও শশী দাসী হব তোর।।
কেন যে এমন হল
বিষাদিত প্রাণ মন কিসের কারণ,
কেন এত ভাঙ্গা ভাব হৃদয়-মাঝারে,
কেন ছলে ঘুরে এসে দেয় আবরণ।
মরমে মরমে পিষে প্রাণের সুসারে।।
যেন কোন দেশান্তরে হারায়েছি প্রাণ,
শূন্য দেহ বহি সদা ঘুরিয়া বেড়াই,
চারিদিকে দেখি সব জনশূন্য স্থান,
সংসারে বাসনা মম কিছু যেন নাই।।
চিত্রিত সংসারে যেন শূন্যভারে দোলে,
চিত্র করা ফল ফুল যেন শব্দহীন,
আঁকা তরু আঁকা পাখী আঁধারের কোলে
সকলই শূন্যে ভরা চেতনাবিহীন।।
পূর্ণ শশী কাঁদে শুয়ে যামিনীর গায়,
ভেঙ্গে ভেঙ্গে বয়ে যায় মলয়পবন,
দিনমানে প্রেম খেলা পাখি ভুলে যায়।
তমসায় ডোবে সব আশার স্বপন।।
কি চাই কি নাহি পাই কিসের কারণ,
সদাই কাতর প্রাণ মন উচাটন,
ছায়া আবরণে যেন কাটাই জীবন,
চির আধাঁরের কোলে করিয়া শয়ন।।
কোথা গেলি
আয়রে প্রাণের পাখি
হৃদয় মাঝারে তোরে লুকায়ে রাখি
গহন কানন মাঝে
কোথা তুই হারাইয়া যাবি
হৃদয় বিহঙ্গ তুই মোর
পথ কোথা পাবি।।
চিরদিন বাঁধা ছিলি
হৃদয় পিঞ্জরে;
আজিকে কেন রে পাখি
গেলি তুই উড়ে।
বড় যে যতন কোরে
রেখছিনু হৃদপিঞ্জরে
বলনা তুই কেমন কোরে
পলাইয়া গেলি।
মনের মতন সাধের পিঞ্জর
আবার কোথায় পেলি।।
বাঁধা ছিলি প্রেমশিকলে
কেমনে তা ফেল্লি খুলে
ক’ইতিস কত প্রেম কথা
সব কি তুই গেলি ভুলে
অজানা অচেনা দেশে
কেমনে বেড়াবি।।
মনের মতন সাধের শিকল
আবার কোথায় পাবি।।
হৃদয় পিঞ্জরে তুই
থাকতিস সদা সুখে
বল দেখিরে প্রাণের পাখি
উড়লি কোন দুঃখে।
সাধ করে দিয়েছিলি ধরা
সাধ করে উড়লি
সাধ করে গড়নু খাঁচা
শূন্য করে গেলি।।
অবসাদ
বিষাদে ফুলের মালা গাঁথিছে কিরণবালা
ঘুমায়ে ঘুমায়ে বহে মলয় পবন।
বসিয়া অবশ কায় যামিনী জাগিয়ে যায়
ঢুলু ঢুলু করে সব তারার নয়ন।।
শরৎ-চাঁদের হাসি মেঘের কোলেতে আসি
আপনা আপনি সব যেতেছে নিবিয়া।
কমলদলের পরে খেলে নাকো মধুকরে
তরঙ্গে তরঙ্গে তারা যেতেছে ভাঙ্গিয়া।।
কোকিলেতে গান গায় প্রাণ যেন ভেঙ্গে যায়,
হাসিব ভাসিব বলে কাঁদিয়া আকুল।
নিকুঞ্জে ফুলের রাশি হাসিয়া অবশ হাসি
ঝরে ঝরে পড়ে গেল সব ফোটা ফুল।।
যার যে মাধুরী ছিল সব তারা নিয়ে গেল
ফেলে রেখ গেল শুধু অশ্রুমাখা হাসি।
অবশেষে যেবা ছিল হাসিটি কুড়ায়ে নিল
বিনিময়ে দিয়ে গেল বিষাদের রাশি।।
হাসি কান্না ক’রে শেষ তারা গেছে কোন দেশ
আমারে রাখিয়ে গেছে না দেখিতে পেয়ে।
পাব না তাদের দেখা আমি শুধু আছি একা
কুটীর-দুয়ারে বসে অশ্রুপানে চেয়ে।।
বিনোদিনী দাসী
Latest posts by বিনোদিনী দাসী (see all)
- আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (৫) - জানুয়ারি 21, 2017
- আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (৪) - সেপ্টেম্বর 11, 2016
- আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (৩) - জুলাই 21, 2016