সাধকের গানে আপন ঘরে আপনারে চেনার আহ্বানে উপনিবেশ-বিরোধী চেতনা
[pullquote][AWD_comments][/pullquote] “সারা জীবন কলোনির ভিতর থাইকাও এইখানে কলোনাইজেশন বইলা কিছু একটা হিস্ট্রিক্যাল ওলটপালট ঘটাইয়া দিছে সেইটা লালন পইড়া বোঝার উপায় নাই প্রায়।” লালনকে নিয়ে তির্যক বুদ্ধিজীবী এস এম রেজাউল করিমের বাক্যটি লালনের গানে কলোনাইজেশন প্রসঙ্গে আক্ষরিক কিছু থাকা না থাকাকে চ্যালেঞ্জ করে না। লালনের ভাব থেকে কলোনাইজেশন সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত আসে কি না তা নিয়েই বরং চালেঞ্জটা আসরে আসে, একাধিক কারণে। এক, “লালন পইড়া বোঝার” বলার মাধ্যমে তিনি ইন্টারপ্রেটেশকেও তার চ্যালেঞ্জের আওতায় রেখেছেন। দুই, এ প্রসঙ্গে লালন কতটুকু কী দিয়েছেন তাও তিনি জুড়ে দিয়েছেন এই বলে,“এই লালন, জাতপাত-আশরাফ-আতরাফ লইয়া গান গাইয়া গাইয়া হিন্দু-মোসলমানরে মিশনারিতে পাঠাইছেন খ্রিস্টান বানাইতে, ওনার অসমতাবিরোধী গান খ্রিস্টান বানাবার চাইতে বেশি কিছু দিতে পারে নাই”। তিন,বি-উপনিবেশীকরণ প্রক্রিয়ায় লালনের স্মরণ নেয়ার প্রস্তাব এবং চর্চা আছে বাংলাদেশে। আবার, সেই প্রস্তাবের সঙ্গে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক দর্শনকে যারা যুথবদ্ধ করেন, তাদের প্রতি রেজাউল করিমের ক্রিটিক, তারা “রায়তি গ্রাম বানাইয়া জমি পত্তনী দিয়া কৃষকদের থেকে খাজনা লওয়া ফিউডাল লর্ড লালনরে ভাবেন নিম্নবর্গের বুদ্ধিজীবী” অথচ, “[…] সামাজিক মানুষের বেকুবি ইনভেন্ট কইরা করুণায় ভিজা হামবড়া লালনেরা গুরুর চরণের সুড়ঙ্গ দিয়া পরম নিখিলে যাইতে বিজি, শরীল তাগো সাধনার ময়দান।”
লালনের পর্যালোচনা বাংলাদেশে বেশ একপেশে- এ পর্যন্ত যা দেখেছি। সে বাবদে, রেজাউল করিমের অই ক্রিটিকে একটি বাহাসের আহ্বান আছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কোন লেখা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। লালন বিশেষজ্ঞদের মধ্য থেকে এর একটি যথার্থ উত্তর আশা করা যেতে পারে। আমি, লালন অনুরাগী হিসেবে, বি-উপনিবেশায়নের একজন সক্রিয় সমর্থক হিসেবে, নিম্নবর্গের রাজনীতিক দর্শনের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে, এবং রেজাউল করিমের একজন নিয়মিত পাঠক হিসেবে আসন্ন সেই বাহাসের অভিমুখটুকু তৈরি করার চেষ্টা করেছি আমার এই লেখায়। লালন পড়ে রেজাউল করিমের যে বোঝাপড়া তার সঙ্গে আমার বোঝাপড়ার কিছু তফাত তুলে ধরব এখানে।
আমার প্রস্তাব হচ্ছে, উপনিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আত্মকে, আপনাকে চেনার সাধক লালনকে দার্শনিক গুরু হিসেবে নেয়া ঠিক আছে। লালন বলছেন,আপনাকে চিনতে পারলে অন্যান্যকে জানা যাবে। এ কথার এক্সটেনশন বলে, অন্যান্য জানার ভেতর দিয়ে নিয়ে জানা হয়ে ওঠে না। এই কথাকে প্রামান্য রেখে, উপনিবেশের কথায় আসা যাক। উপনিবেশকে উপড়াতে হতে উপনিবেশকে জানতে হবে। এখন, উপনিবেশকে জানব কি করে? লালন মতে, এর উত্তর হল, আপনাকে জেনে। এ বাবদে আপনাকে জানার ভেতর দিয়েই বি-উপনিবেশীকরণ কার্যত শুরু হয়। এটা নিঃসন্দেহে পুনরাবৃত্তি হল, এই কথা অনেকেই বলেছেন, এবং রেজাউল করিমও তা জানেন। কিন্তু তাতে রেজাউলের বক্তব্যের ফয়সালা হয় না। কারণ রেজাউল করিমের প্রস্তাবটি এম্পেরিকাল ভুমিতে খাড়া;সেখানে ইন্টারপ্রেটশনের সঙ্গে এম্পেরিকাল এভিডেন্স উত্থাপন এবং এ দুয়ের তাত্ত্বিক সম্পর্ক নিরূপণের দাবী আছে। সেই বিষয়ে আমার বাকী কথা।
প্রথমে আমার তাত্ত্বিক ভিত্তিটা বলে নিতে চাই। রেজাউল করিম যেটাকে বলেছেন, “শরীল তাগো সাধনার ময়দান” সেই ময়দানের উপর দাড়িয়েই আমার কথা হবে। এই বিষয়ে তার বোঝাকে তিনি বিস্তার করেন নাই। ফলে আমার বোঝাপড়া উপস্থাপনে তুলনার বাঁধা থাকে না।আমার বোঝাপড়ায়, লালন সাধক তাতে সন্দেহ নাই, যদি সাধক বলে কিছু থাকে। সাধকের লক্ষ্য জ্ঞান চর্চা। আত্মজ্ঞান তার উদ্দেশ্য। বাহ্যবস্তু সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল হন ভেতরের রিপ্রেজেন্টশন পর্যালোচনা করে। কোন অনুষঙ্গ কখনই যেন ওই ভাবকে অতিক্রম না করে সে ব্যাপারে সাধক সতর্ক থাকেন। কেননা অনুষঙ্গ বহিরাঙ্গের ব্যাপার, আর জ্ঞান অন্তরঙ্গের। আর, সাধক অন্তরঙ্গের কারবারী; সাধক ইন্টারনালিস্ট। দেহভাণ্ডে যা আছে তা তার পাঠ্য (এখানে মন আর দেহের ভেদ আর নাই)। দেহভাণ্ডে যেসব রিপ্রেজেন্টেশন তৈরি হয়, সাধক সেগুলো পর্যালোচনা করেন। সেই পর্যালোচনার মর্মবস্তু প্রকাশে কালাম তৈরি করেন।
তিনি যেহেতু ব্রাত্য লোকায়ত সমাজে বাস করেন, ভাষা ব্যবহার করেন, তাই ব্রাত্যজনের জানা জিনিস উদ্ধৃত করেই তিনি তাঁর অন্তর্জ্ঞান প্রকাশ করেন। চাতকের কথা আনেন, গেড়ে গাঙে হাপুর হুপুর ডুব পারার কথা আনেন, তিলের খাজা খাওয়ার কথা আনেন, দিল্লী লাহোরের কথা ইত্যাদি আনেন।
কোম্পানীর শাসন (১৭৫৭-১৮৫৮ দ্বৈত শাসনসহ) আর ব্রিটিশ রাজ (১৮৫৮-১৯৪৭) মিলিয়ে যে সময় তা লালনের সময় (১৭৭৪-১৮৯০)।এখন, লালনের স্থানকালে উপনিবেশের ওলটপালট ব্রাত্যজনের উপমা উৎপ্রেক্ষায় এসেছে কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয়। আবার, এও বিবেচনার বিষয় যে, অন্যকোনো উপমায় রুপকে উৎপ্রেক্ষায় উপনিবেশের ওলটপালটের কথা এসেছে কিনা লালনের কালামে। সে বাবদে,উনিশ শতকের যে প্রেম কলোনীকারদের প্রতি, তার প্রতি কটাক্ষে লালনের এই গানটির কথা টানা যেতে পারে। দার্শনিক অনুপ্রেরণা, এম্পেরিকাল অনুষঙ্গ, আর এ দুয়ের তাত্ত্বিক যোগাযোগ এই গানে টানা কঠিন কিছু হবে না।
বিদেশীর সঙ্গে কেউ প্রেম করো না।
আগে ভাব জেনে প্রেম করো
যাতে ঘুচবে মনের বেদনা।।
ভাব দিলে বিদেশীর ভাবে
ভাবে ভাব কভু না মিশিবে।
পথের মাঝে গোল বাঁধিলে
কারো সাথে কেউ যাবে না।।
দেশের দেশী যদি সে হয়
মনে করে তারে পাওয়া যায়।
বিদেশী ঐ জংলা টিয়ে
কখনো পোষ মানে না।।
নলিনী আর সূর্যের প্রেম যেমন
সেই প্রেমের ভাব লও রসিক সুজন।
অধীন লালন বলে ঠকলে আগে
কাঁদলে শেষে সারবে না।।
[youtube id=”-l0KapGzfrg”]
এই গানের সঙ্গে উপরোক্ত বিবেচনাগুলো মিলেয়ে একটা বোঝাপড়ায় যাওয়া যেতে পারে, যে বাবদে লালনকে বি-উপনিবেশীকরণের আদর্শ হিসাবে নেয়া যথাযথ হয়। বিবেচনাগুলোর একটা ধারাবাহিকতা আছে। এখানে বিদেশী বলতে বিলাতী বোঝানোর আবশিক্যতা নাই লালনের, তবে বি-উপনিবেশীকরণের কারবারে বিদেশীকে বিলাতী উপনিবেশকারী বুঝে নিতে বাঁধা নাই।
পরিশেষে,রশীদ সরকারের কণ্ঠে শোনা একটি গানের কথা বলা দরকার মনে করি। গানে ভণিতা কবি জালাল উদ্দিনের। ভণিতার কারণে সন্দেহ করি ওটা জালাল উদ্দিনের খাঁ (১৮৯৪-১৯৭২)। ততদিনে ব্রাত্যজনের ডিসকৌর্সে উপনিবেশের ওলটপালট নিয়ে একটা বোঝাপড়া এসেছে। ফলে, বুঝে নেয়া যায়,সাধক তার গানে বিলাতকে উপনিবেশী শক্তি (অধিকারী) আকারে দেখিয়েছেন, কলকাতায়, দিল্লীতে উপনিবেশ (কাচারী) গড়ার ঘটনা নির্দেশ করেছেন এবং নিজের দেশকে না চেনার জন্য নিজেকে দায় দিচ্ছেন।
[…] বিজাতী এক অধিকারী
বিলাতে তার আসল বাড়ী
কলিকাতা হয় কাচারি
হুগলী নদীর পাড়ে
আরেক খানা আছে তোমার
দিল্লিরো শহরে
আরে ভোলা মন, মন রে
[…]
পরম আর্য এল দেশে
জীবাত্মা অনার্য বেটায়
পালাইছে পাহাড়ে
তাই মায়ার কাছে
আশ্রয় লইছে গৌর শঙ্করে
আরে ভোলা মন, মন, মন রে
তাই সোনার ভারত আপন মুরুত
কবি জালালুদ্দিন চিনল না রে
আপন ঘরে বইসা যে জন
চিনতে পারে আপনারে
ধন্য বলি তারে আমি
মানুষ বলি তারে
কিন্তু একই সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে, দেহের উপনিবেশিত হওয়া এবং তার স্বাধিকার অর্জনের কথা ইতিহাসের উপনিবেশের রূপকে এসেছে। গানের শরীরে সেই সাক্ষ্যও বিদ্যমান (লাইনগুলো নিচে দেওয়া গেল)।
মানব দেহের উত্তরে হয়
নেপাল ভুটান
পরশ্চিমেতে হয় বেলুচিস্তান
দক্ষিণে হয় লঙ্কাপুরী
মনিপুর পুবধারে
যেমন লাকসাম থেকে
লাইন খুলেছে বাহাত্তুর হাজারে
শোণিত স্বরূপা রানী
সেইসব রাস্তায় ঘুরে ফিরে
ধন্য বলি তারে আমি
মানুষ বলি তারে।
উপরোক্ত বিবেচনাগুলো এবং বোঝাপড়াগুলো বলে,সাধনার ময়দান দেহ মানেই এই নয় যে, সেই দেহের কোন দেশ নেই, রাজনীতি নেই, রাজনৈতিক দর্শন নেই, দার্শনিক অনুপ্ররণার জায়গা নেই। আছে।
————————–
রেজাউর করিম মনু’র ফেসবুক স্ট্যাটাস:
সর্বজন’র দেখেন গায়ে বিদ্যাসাগর আর ৫২’র ভুতের আছর না থাকলে ‘পাবলিক’-এর এমন অনুবাদ হইতে পারতো না। প্রাইভেট কার, পাবলিক বাস, পাবলিকের মাল, পাবলিকের রাস্তা/পয়সা, সরকার পাবলিকের কথা চিন্তা করে না–সারা দেশের বুলিতে পাবলিক কথাটা এইভাবে ছড়াইয়া থাকার পরেও এমন অনুবাদ করা হইলো! আরো ব্যাপার হইলো, বিদ্যাসাগরী বাংলা প্রায় বোঝে না দেশের ইংরাজি মিডিয়ামে পড়া পোলা-মাইয়া, এই বাংলা লইয়া অবাঙালিদের আরো বেশি সমস্যায় পড়তে হয়; পাবলিক শব্দটা একটা কমন শব্দও এই প্লুরাল আইডেন্টিটির লোকদের ভিতর।
এইটারে রিকগনাইজ করলেন না ওনারা, ওনারা সর্বজন বইলা একটা নদীয়া-লালনী শব্দ ডিসকভার করলেন! কোন এক আশ্চর্য কারণে এনারা রায়তি গ্রাম বানাইয়া জমি পত্তনী দিয়া কৃষকদের থেকে খাজনা লওয়া ফিউডাল লর্ড লালনরে ভাবেন নিম্নবর্গের বুদ্ধিজীবী; এইটারে পোস্ট-কলোনিয়ালিজমের গণবিরোধী আছর। অথচ এই লালন, জাতপাত-আশরাফ-আতরাফ লইয়া গান গাইয়া গাইয়া হিন্দু-মোসলমানরে মিশনারিতে পাঠাইছেন খ্রিস্টান বানাইতে, ওনার অসমতাবিরোধী গান খ্রিস্টান বানাবার চাইতে বেশি কিছু দিতে পারে নাই; সারা জীবন কলোনির ভিতর থাইকাও এইখানে কলোনাইজেশন বইলা কিছু একটা হিস্ট্রিক্যাল ওলটপালট ঘটাইয়া দিছে সেইটা লালন পইড়া বোঝার উপায় নাই প্রায়।
তো, এই সর্বজনঅলারা এমন অনুবাদ আরো অনেক করে; এরা লেবার কইবে না, কইবে শ্রমিক, পণ্য লিখবে, মাল কইলে শরম লাগবে এনাদের। অথচ দ্যাখেন, দেশের দোকানদাররা কয় মাল নাই, আনতে যায় বাজারে, পাড়ার ভ্যানে সবজি বেচা লোকেরা কাওরানবাজারে যায় মাল আনতে। ওদিকে দেখেন, লেবার শব্দটা কেমন মনোহর; বাংলায় লেবার যেইসব মিনিং দেয় সেগুলি ওনাদের শ্রমিক, কৃষক, কর্মী– অনেকগুলি শব্দ লাগে; তারচে বড় ঝামেলা হইলো, জোতদার আর বড় বড় সব ফার্মাররা নিজেদের কৃষক পরিচয় দিয়া সব দখল কইরা নেয়; লেবার শব্দটা দিয়া এগুলিরে আলাদা কইরা বাইরে রাখা যায়; এরা নিজেদের লেবার পরিচয় দিতে রাজিও হবে না; কৃষক বলবার ভিতর দিয়া এনারা আসলে ওইসব জোতদারদেরই স্বার্থ হাসিল করার সুয়োগ কইরা দেয়।
আবার দ্যাখেন, কৃষক বা শ্রমিক কইলে মাইয়া বা হিজড়া লেবাররা বাদ পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়, লেবার শব্দটা এগুলি সবই ইনক্লুড করতে পারে।
———————-
কয় বছর আগে মমতাজ আর রঠা’র গানে ইংরাজি-বাংলা কেমনে কেমনে আছে সেইটা বুঝতে চাইছিলাম; মমতাজের দুইটা গান:
‘‘পাংচার হইলে চাকা
চলবে না আর গাড়ী
হায়াতের তেল পাইবা না
খুঁজলে জগৎ ভরি…।’’
আবার,
‘‘হেডলাইট করছো ইউজ
কখন যে হইবে ফিউজ
রাখছনি তাহার নিউজ…।’’’
গানে মমতাজের এই শব্দগুলি আদৌ কি ইংরাজি থাকলো আর? ওদিকে রঠারে দেখেন ইংরাজি শব্দ নাই: “অন্তর মম বিকশিত কর, অন্তরতর হে…নির্মল কর…”–এইসব কি কি যেন, সংস্কৃতমুখর বিদ্যাসাগরী বাংলায় কেমন চার্চের গান গাইতে থাকলেন!
আহমেদ শামীম
Latest posts by আহমেদ শামীম (see all)
- সাধকের গানে আপন ঘরে আপনারে চেনার আহ্বানে উপনিবেশ-বিরোধী চেতনা - অক্টোবর 19, 2015