Main menu

নিকোলাই গোগলের গল্প – নাক।

লিটারালি, ল্যাটিন আম্রিকার লিটারেচারের ম্যাজিক রিয়ালিজমরেই আসল রিয়ালিজম বইলা ভাবতে পারি আমরা। মানে, একটা ট্রু রিয়ালিটি আছে যেইটা ম্যাজিক ছাড়া রিভিল করা যাইতেছে না। ইমাজিনেশন আসলে ইমাজিনেশন না, একটা ট্রু রিয়ালিটির রিফ্লেকশন; আর এই ট্রান্সফর্মেশনের জায়গাটাতে ম্যাজিকও পয়দা হয়। ওয়াও! রিয়েল ত একটা ম্যাজিক্যাল ব্যাপারই তখন।

গোগল যখন নাক লেখেন তখন এই রিয়েল হওয়ার কোন টেনশন উনার আছিলো না। কাফকারে যেমন ধইরা নিতে হইছে যে, গ্রেগর সামসা মানুষ আছিলো – এইটা নিয়া কোন কনফিউশনই নাই; কনফিউশন হইলো অন্য কোনকিছু হইতে থাকাটা নিয়া। যার ফলে, কাফকারে ম্যাজিক রিয়ালিজমের বাপ (মেইল ইগো-রই যন্ত্রণা) মনে হইলেও, গোগলরে আর কাফকার বাপ মনে হইতে পারে না। কারণ গোগলের রিয়ালিটি নিয়া তেমন কোন ঝামেলা নাই; এইটা থাকলে আছে, না-থাকলে নাই।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

কাফকা যখন রিয়ালিটিটারে (হোয়াটএভার ইট ইজ) ডিসটরট কইরা ফেলেন তখন ম্যাজিক পয়দা হয় আর সেই ম্যাজিকের রাস্তা দিয়া হাঁটতে হাঁটতে নতুন নতুন রিয়ালিটির কলাগাছ লাগাইতে থাকেন মার্কেজরা। যেই চেয়ারে বইসা টাইপরাইটারে লিখতে হয় উনাদের, সেই চেয়াররে আর চেয়ার কওয়া যায় না, কইতে হয় পঙ্খীরাজ নাইলে ছোট্ট-গাধা, তা নাইলে চেয়ার জিনিসটার থাকাটাই পসিবল না। আমরার রিয়ালিটি যেহেতু একটা লজিক্যাল ফেনোমেনা, ম্যাজিক রিয়ালিজমের লাইগা এইরকম ডিসটরশনগুলা খালি জরুরি না, এই ডিসটরশনগুলাই রিয়ালিটি ইটসেলফ।  

তবে লিটারেচারে, চেয়াররে যে চেয়ার বলা যাইতো একটা সময় বা মেবি এখনো যে বলা-ই যায় (অলটুগেদার ডিফরেন্ট কোন চেয়ারই, ১৮৩৫ সালের না), গোগলের নাক’টা এইটার একটা রিমাইন্ডার হিসাবে পড়া যাইতে পারে। যা কিছু আছে সেইটা যদি না থাকতে পারে, যা কিছু নাই সেইটাও থাকার কোন কথা না, সবসময়েই।

সো, লেটস হ্যাভ অ্যা রিয়ালিটি চেক উইথ গোগল উইথআউট ম্যাজিক রিয়ালিজম।
——————————————


মার্চ মাসের ২৫ তারিখে সেন্ট পিটার্সবুর্গে একটা অসাধারণ রকমের অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ভজনেসেনস্কি এভিনিউয়ের অধিবাসী নাপিত ইভান ইয়াকভলেভিচ (পদবিটা তার হারিয়ে গেছে, এমনকি নেই তার দোকানের সাইনবোর্ডেও, যেখানে আকা আছে একগাল সাবানের ফেনা মাখা এক ভদ্র লোকের ছবি আর লেখা আছে ‘রক্ত মোক্ষণও করা হয়’), বেশ ভোরে ঘুম ভাঙতেই নাপিত ইভান ইয়াকভলেভিচ গরম রুটির গন্ধ পেল। খাটের উপর দেহটা সামান্য উঁচু করে তুলতেই সে দেখতে পেল যে কফির দারুন ভক্ত, পরম শ্রদ্ধেয়া মহিলা, তার সহধর্মিণীটি চুল্লী থেকে সদ্য-সেঁকা রুটি টেনে বার করছে।

‘প্রাসকোভিয়া ওসিপভনা, আজ আর আমি কফি খাবো না; ইভান ইয়াকভলেভিচ বলল,’তার বদলে পিঁয়াজ দিয়ে খানিকটা গরম রুটি খাবার ইচ্ছে হচ্ছে।’

(আসলে ইভান ইয়াকভলেভিচ মনে মনে কফি এবং রুটি দুটোই চাইছিল, কিন্তু সে জানত যে একবারে দুটি বস্তু চাওয়া হবে সম্পূর্ণ নিরর্থক, যেহেতু প্রাসকোভিয়া ওসিপভনা এ ধরনের আবদার মোটেও বরদাস্ত করতে পারত না।) ‘আহাম্মকটা রুটি খাকগে; আমারই ভালো, বাড়তি এক ভাগ কফি জুটবে, মনে মনে এই ভেবে তার স্ত্রী টেবিলের ওপর একটা রুটি ছুঁড়ে দিল।

ইভান ইয়াকভলেভিচ ভদ্রতার খাতিরে জামার ওপর কোট চাপাল, টেবিলের পাশে বসে পরে খানিকটা নুন ঢালল, দুটো পিঁয়াজ ছাড়াল, ছুড়ি হাতে নিল এবং গম্ভীর মুখভঙ্গি করে রুটি কাটতে প্রবৃত্ত হল। রুটিটা দুই আধখানা করে কাটার পরে মাঝখানটায় তার চোখ পড়ল, সে অবাক হয়ে গেল সাদা একটা কিছু দেখতে পেয়ে। ইভান ইয়াকভলেভিচ সন্তর্পণে সেটাকে ছুরি দিয়ে খোঁচালো, আঙ্গুল দিয়ে টিপে দেখল। ‘আঁটসাট গোছের দেখছি’। সে মনে মনে বলল, ‘কী হতে পারে এটা’?

সে আঙ্গুল পুরে  দিয়ে টেনে বার করল – নাক। ইভান ইয়াকভলেভিচ থ হয়ে গেল; চোখ রগড়াতে লাগল, জিনিসটা হাতড়ে দেখতে লাগল: নাক – নাক যে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই! শুধু ত-ই নয়, মনে হচ্ছিল যে কোন চেনা লোকের। ইভান ইয়াকভ্লেভিচের চোখে-মুখে ফুটে উঠল আতঙ্কের ভাব। কিন্তু যে ক্রোধ তার স্ত্রীরত্নটির ওপর এসে ভর করল সেটার তুলনায় এই আতঙ্ক নেহাৎই তুচ্ছ।

‘ওরে কসাই, কোথায় তুই কাটলি এই নাকটা, শুনি?’ রাগে চেঁচিয়ে বলল সে। ‘ঠগ! মাতাল! আমি নিজে তোর নামে পুলিশে রিপোর্ট করব! কী ডাকাত! আগে আমি তিন তিনজন লোকের কাছে শুনেছি, দাড়ি কামানোর সময় তুই লোকের নাক নিয়ে এমন টানাটানি করিস যে নাক কোন রকমের জায়গায় টিকে থাকে।’

কিন্তু ইভান ইয়াকভলেভিচের তখন জীবন্মৃত অবস্থা। সে চিনতে পারল যে এই নাকটা সরকারী কালেক্টর কভালিওভের ছাড়া আর কারও নয়। লোকটা প্রতি বুধবার ও রবিবার তার কাছে কামাতে আসে।

‘দাঁড়াও, প্রাসকোভিয়া ওসিপভনা! আমি ওটাকে একটা নেকড়ায় জড়িয়ে কোনায় রেখে দেই; ওখানে না হয় খানিকক্ষণ পড়ে থাক, পরে বাইরে নিয়ে যাবো।’

‘কোন কথা শুনতে চাই না! ভেবেছিস কাটা-নাক ঘরে পড়ে থাকবে, এটা আমি বরদাস্ত করব?… চালাকি! জানিস তো কেবল চামড়ার বেল্টের ওপর ক্ষুর ঘষতে, শিগগিরই নিজের কাজটা করার মতও অবস্থা তোর থাকবে না রে হতভাগা, পাজি, বদমাশ! তোর হয়ে পুলিশের কাছে আমি সাফাই গাইতে যাবো ভেবেছিস?… ওরে আমার বুদ্ধির ঢেঁকি, হতচ্ছাড়া নোংড়া কোথাকার! নিয়ে যা এখান থেকে বলছি। এক্ষুনি! যেখানে খুশি নিয়ে যা! ত্রিসীমানায় যেন ওটাকে দেখতে না পাই!

ইভান ইয়াকভলেভিচ দাড়িয়ে রইল মড়ার মত কাঠ হয়ে। সে ভেবে ভেবে কোন কূলকিনারা খুঁজে পেল না।

‘কে জানে বাবা কী করে একটা হল,’ সে হাত দিয়ে কানের পেছনটা চুলকে শেষ কালে বলল। ‘গতকাল মাতাল অবস্থায় ফিরেছিলাম না কি তাও ত ঠিক বলতে পারছি না। এদিকে সমস্ত দেখেশুনে মনে হচ্ছে ঘটনাটা অবাস্তব, কেন না রুটি হল গিয়ে সেঁকা জিনিস, আর নাক একেবারেই অন্য বস্তু। মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না !…..

ইভান ইয়াকভলেভিচ চুপ করে গেল। পুলিশ তার কাছ থেকে নাক খুজে পেলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করবে – এই চিন্তায় তার সংজ্ঞা লোপ পাবার মত অবস্থা হল। ততক্ষণে তার যেন  মনে হতে লাগল যে সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে রুপোর জরিতে সুন্দর কাজ করা লাল টকটকে কলার, তলোয়ার…. সঙ্গে সঙ্গে তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। অবশেষে সে তার ট্রাউজার্স্ ও বুটজোড়া বার করল, ঐ সমস্ত জঞ্জাল নিজের গায়ে আঁটল, তার পর প্রাসকোভিয়া ওসিপভনার কঠোর  নির্দেশের সঙ্গে তাল রেখে নাকটাকে নেকড়ায় জড়িয়ে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।

তার ইচ্ছে ছিল কোথাও ওটাকে পাচার করে দেয়: হয় তোড়নের নিচে বেদীর আড়ালে, নয়ত কোন রকমে আচমকা হাত থেকে ফেলে দিয়ে পাশের কোন গলিতে সটকে পড়া।  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোন না কোন পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে লাগল। তারা তৎক্ষণাৎ শুরু করে দিল জিজ্ঞাসাবাদ: ‘কোথায় চললে?’  কিংবা  ‘এত সকালে  কাকে খেউরি করতে চললে? – ফলে ইভান ইয়াকভ্লেভিচ কিছুতেই ফাঁক পাচ্ছিল না। আরেক বার সে ওটাকে হাত থেকে একেবারে ফেলেই দিয়েছিল, কিন্তু গুমটিতে  প্রহরারত কনস্টেবল দূর থেকেই তার হাতিয়ার টাঙ্গিটা দিয়ে নির্দেশ করে বলল: ‘এই যে কী একটা জিনিস  যেন তোমার হাত থেকে পড়ে গেছে!’  ইভান ইয়াকভলেভিচের পক্ষে তখন নাকটা তুলে নিয়ে  পকেটে  লুকিয়ে ফেলা ছাড়া গত্যন্তর রইল না। সে হতাশ হয়ে পড়ল। পরন্তু দোকানপাট খুলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় লোকজনের যাতায়াত অবিরাম বেড়ে চলল।

সে ঠিক করল ইসাকিয়েভস্কি ব্রীজের দিকে যাবে: সেখান থেকে কি আর কোনমতে ওটকে নেভা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যাবে না?… হ্যাঁ, আমারই খানিকটা অপরাধ বটে যে বহু দিক থেকে শ্রদ্ধাভাজন ইভান ইয়াকভলেভিচ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোন কথাই আমি বলি নি।

যে কোন নিষ্ঠাবান রুশী কর্মকুশলীর মতো ইভান ইয়াকভলেভিচ ছিল পাঁড় মাতাল। যদিও সে প্রতিদিন অন্য লোকের চিবুকের ওপর ক্ষৌরিকর্ম করত, তার নিজের চিবুকে কিন্তু কস্মিনকালে ক্ষুর পড়ত না। ইভান ইয়াকভলেভিচের  টেইল-কোট (ইভান ইয়াকভলেভিচ কদাচ  ফ্রক-কোট পরত না) ছিল চকরাবকরা; অর্থাৎ সেটা কালো ছিলো বটে, কিন্তু  আগাগোড়া  খয়েরি-হলুদ ও ছাইরঙা ছোপ ধরা; কলারটা চিকচিক করত, আর তিনটি বোতামের জায়গায় ঝুলতো কেবলই সূতো।   ইভান ইয়াকভলেভিচ ছিল ভয়ঙ্কর মানববিদ্বেষী – সরকারী কালেক্টর  কভালিওভ যখন দাড়ি কামানোর সময় অভ্যাসবশে তাকে বলত: ‘ইভান ইয়াকভলেভিচ তোমার  হাতে সবসময় একটা দুর্গন্ধ!’ – জবাবে ইভান ইয়াকভলেভিচ প্রশ্ন করত: ‘দূর্গন্ধ কেন হতে যাবে?’ ‘জানি না ভায়া তবে দুর্গন্ধ পাওয়া যায়,’ সরকারী কালেক্টর বলত,  আর এই প্রতিফলস্বরূপ ইভান ইয়াকভলেভিচ এক টিপ নস্যি টেনে নিয়ে  তার গালে, নাকের নিচে, কানের পেছনে, চিবুকের নীচে – এক কথায় নিজের খেয়াল খুশি মত যেখানে সেখানে সাবান ঘষে দিত।

এহেন  শ্রদ্ধাভাজন নাগরিকটি দেখতে দেখতে ইসাকিয়েভস্কি  ব্রীজে এসে পৌছুলো। সে প্রথমে এদিক-ওদিক  তাকিয়ে দেখে নিল; তার পর রেলিং-এর  ওপর ঝুকে পড়ল,  যেন ব্রীজের নিচে অনেক মাছ ছোটাছুটি করতে কিন্ দেখার উদ্দেশ্যে। অবশেষে চুপি চুপি নেকড়ায় জড়ানো  নাকটা ফেলে দিল। তার মনে হল যেন কয়েক মণ ওজনের ভার হঠাৎ বুক থেকে  নেমে গেল;  ইভান ইয়াকভলেভিচ ইষৎ হাসলও। সরকারী কর্মচারীদের চিবুকে খেউরি করতে না গিয়ে সে এক গ্লাস পাঞ্চের অর্ডার দেওয়ার উদ্দেশ্যে  রওনা দিল ‘খানা আর চা’ সাইনবোর্ড লেখা একটা প্রতিষ্ঠানের দিকে, এমন সময় ব্রীজের অন্য প্রান্তে সে দেখতে পেল গালপাট্রা জুলপিধারী,  তেকোনা টুপি মাথায়,  তলোয়ারধারী সম্ভ্রান্ত  চেহারার পুলিশ ইন্সপেক্টরকে। ভয়ে ইভান ইয়াকভলেভিচের প্রাণ উড়ে গেল; ইতিমধ্যে পুলিশ ইন্সপেক্টর তার দিকে আঙ্গুল নেড়ে ইশারা করে বলল:

‘এদিকে এসো দেখি ভালোমানুষের পো!’

ইভান ইয়াকভলেভিচের দস্তুর জানা ছিল, তাই অনেক দূর থেকেই মাথার টুপি খুলে চটপট তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল:

‘সালাম হুজুর!’

‘না না ভায়া, ও সব হুজুর-টুজুর নয়, বল দেখি ব্রীজের ওপর দাড়িয়ে দাড়িয়ে কী করছিলে ওখানে?’

‘ভগবানর দিব্যি কর্তা খেউরি করতে যাচ্ছিলাম, কেবল দেখলাম নদী কিভাবে তরতর করে বয়ে চলেছে।’

‘মিছে কথা, মিছে কথা! ও সব বলে পার পাবে না। ঠিক  মতো জবাব দাও বলছি!,

‘আমি, কর্তা,  কোন রকম উচ্চবাচ্য না করে সপ্তাহে দুবার এমনকি তিনবারও আপনার খেউরি  করতে রাজি,’ ইভান ইয়াকভলেভিচ জবাব দিল।

‘না বন্ধু ওতে চলবে না! তিনজন নাপিত আমার খেউরি করে, আর এ কাজটাকে তারা পরম সম্মানের  বলেও মনে করে।  এবারে বলে ফেল দেখি বাপু ওথানে কি করছিলে?’

ইভান ইয়াকভলেভিচ ফেকাসে হয়ে গেল।… কিন্তু এখানে ঘটনা সম্পূর্ণ কুয়াশায় ঢাকা পরে যায়, তাই অতপর যে কি ঘটল তার বিন্দুবিসর্গ আমাদের জানা নেই।

নিকোলাই গোগল

নিকোলাই গোগল


খুব ভোড়ে সরকারী কালেক্টর কভালিওভের ঘুম ভেঙে গেল। অত:পর সে ঠোট নেড়ে আওয়াজ করল,  ‘ব্ র র…’ – যেটা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সে  বরাবরই করে থাকে,  যদিও নিজেই বলতে পারে না কারন টা কী।  কভালিওভ আড়িমুড়ি ভেঙ্গে টেবিলের ওপর থেকে ছোট আয়নাটা তাকে দিতে বলল।  গতকাল সন্ধ্যায় তার নাকের ওপর যে ফুসকুড়িটা উঠেছিল সেটা একবার দেখার ইচ্ছা হল ; কিন্তু সে বেজায় হকচকিয়ে গেল যখন  দেখতে পেল যেখানে নাক থাকার কথা সে জায়গাটা পুরোপুরি চেটাল। ঘাবড়ে গিয়ে কভালিওভ জল আনতে বলল,  সে তোয়ালে দিয়ে চোখ রগড়ালো  কিন্তু ঠিকই, নাক নেই! সে ঘুমোচ্ছে কিনা জানার উদ্দেশ্যে হাতড়ে দেখতে লাগল। না, ঘুমোচ্ছে বলে তো , মনে হয় না।  সরকারী কালেক্টর কভালিওভ খাট থেকে নেমে লাফিয়ে গা ঝাড়া দিল: নাক নেই!… সে তৎক্ষণাৎ পরনের পোশাক তলব করল, সোজা ছুটলো পুলিশের কমিশনারের উদ্দেশে।

কিন্তু এই অবশরে কভালিওভ সম্পর্কে কিছু কথা বলা অবশ্যক, যাতে পাঠক বুঝতে পারেন এই সরকারী কালেক্টরটি কোন্ গোত্রের লোক  ছিল।  যে সমস্ত সরকারী কালেক্টর  তাঁদের  বিদ্যার সার্টিফিকেট  ও ডিগ্রীর জোরে  এই খেতাবের  অধিকারী হন, ককেশাসে যাঁরা কালেক্টর পদ লাভ করেন তাঁদের সঙ্গে এঁদের  কোন মতেই তুলনা চলে না। এ’রা  সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা দুই জাতের।  বিদ্বান সরকারী কালেক্টররা…কিন্তু রাশিয়া এমনই আজব একটা দেশ যে কোন একজন সরকারী  কালেক্টর সম্পর্কে কিছু বলে দেখুন না, অমনি রিগা থেকে কামচাত্কা পর্যন্ত সব সরকারী কালেক্টর সেটাকে  নিজের গায়ে নেবেন। যে-কোন খেতাব এবং পদ সম্পর্কেও  এই একই কথা প্রযোজ্য। কভালিওভ ছিল ককেশীয় সরকারী কালেক্টর।  সে মাত্র দু বছর হল এই খেতাব পেয়েছে, তাই মুহূর্তের জন্যও সেটাকে ভুলতে পারে না;  আর নিজের কৌলীন্য ও গুরুত্ব  আরও বাড়িয়ে দেখানোর উদ্দেশ্যে  নিজেকে কখনও সরকারী কালেক্টর বলত না, সব সময় উল্লেখ করত মেজর বলে।  রাস্তায় জামা কাপড়ের ফিরিওয়ালী কোন মেয়েছেলের সঙ্গে দেকা হলে সচরাচর বলত: ‘বুঝলে গো আমার বাড়ীতে চলে এসো;  সাদোভায়া স্ট্রীটে আমার ফ্ল্যাট; কেবল জিজ্ঞেস করলেই হল মেজর কভালিওভ কোথায় থাকে; যে কেউ দেখিয়ে দিবে।’ আর সুশ্রী চেহারার কোন মেয়ের সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যেত তাহলে তাকে পরন্তু গোপন নির্দেশ দিত এই বলে: ‘লক্ষীটি আমার, জিজ্ঞাস করবে মেজর কভালিওভের ফ্ল্যাটটা কোথায়।’ অতএব আমরাও এখন থেকে এই সরকারী কালেক্টরটিকে মেজর বলেই উল্লেখ করব।

মেজর কভালিওভের অভ্যাস ছিল প্রতিদিন নেভস্কি এভিনিউতে পায়চারী করা। তার জামার কলার সব সময় বড় বেশি পরিচ্ছন্ন আর কড়া মাড় দেওয়া। তার জুলফিজোড়া ছিল এমন এক জাতের, যা এখন ও দেখতে পাওয়া যায় জেলা আর সদরের  আমিনদের মধ্যে, স্থপতি, রেজিমেন্টের ডাক্তার, এমনকি বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত পুলিশ কর্মচরীদের মধ্যে – মোট কথা, যে সমস্ত পুরুষমানুষের গাল ভরাট ও আরক্তিম এবং যারা বেশ ভালো বস্টন খেলে তাদের  সকলের মধ্যে: এ ধরনের জুলফি গালের ঠিক মাঝখান দিয়ে এসে সোজা চলে যায় নাক অবধি ।  মেজর কভালিওভ দামী লাল পাথরের অসংখ্য সীল বুকে ঝুলাতো, কতকগুলির ওপর থাকতো নানা প্রতীকচিহ্ন   আবার কতকগুলির ওপর বুধবার, বৃহষ্পতিবার, সোমবার – এইসব খোদাই করে লেখা থাকত। মেজর কভালিওভ সেন্ট পিটার্সবুর্গে এসেছে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, সঠিক ভাবে বলতে গেলে, তার খেতাবের  উপযোগী চাকুরীর সন্ধানে: এ ব্যাপারে সফল হলে তার পদ হবে ছোট লাট পর্যায়ের,  আর তা না হলে সে কোন একটা  বিশিষ্ট ডিপার্টমেন্টে প্রশাসনিক পদ নেবে। বিয়ের ব্যাপারেও মেজর কভালিওভের  আপত্তি নেই, কিন্তু একটি মাত্র শর্তে –  পাত্রীর পুঁজির পরিমাণ হতে হবে দু লাখ। সুতরাং মেজর যখন তার মোটামুটি চলনসই ও মাঝারি গোছের নাকের বদলে যাচ্ছেতাই রকমের লেপাপোঁছা, সমান জায়গা দেখতে পেল তখন তার যে কি মনের অবস্থা হতে পারে তা পাঠকদের  সহজেই অনুমেয়।

এমন দূর্ভাগ্য যে রাস্তায়  একটাও  ঘোড়ার গাড়ির দেখা মিলল না, ওপরের ঢিলে আচকানটা গায়ে জড়িয়ে, যেন নাক দিয়ে রক্ত পরচে এমন ভঙ্গিতে রুমালে মুখ ঢেকে তাকে পা’য়ে হেটে চলতে হল। ‘হয়ত এটা আমার মনেরই ভুল: নাকটা বেমালুম উধাও হয়ে গেল এ হতেই পারে না’ – ভাবতে ভাবতে সে ইচ্ছে করেই, আয়নায় একবার দেখার উদ্দেশ্যে এক মিঠাইয়ের দোকানে এসে উপস্থিত হল। সৌভাগ্যবশত দোকানে কেউ ছিল না;  ছোকড়া চাকরগুলি ঘড়দোর ছাফ করছিলো, চেয়ার সাজিয়ে রাখছিল;  কেউ কেউ ঘুমচোখে বারকোশে গরম গরম পেস্ট্রি বার করে আনছিল; চেয়ার-টেবিলের ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছিল গতকালের কফি-ঢালা খবরের কাগজ। ‘যাক,  ভগবানের কৃপায় কেউ নেই,’ সে বলল, ‘এই ফাঁকে তাকিয়ে দেখা যেতে পারে।’  সে ভয়ে ভয়ে আয়নার দিকে এগিয়ে গেল, তাকিয়ে দেখল। ‘ধুত্তোর, এ কি যাচ্ছেতাই কান্ড!’ তাকানোর পরে সে বলল। ‘নাকটার জায়গায় অন্তত কিছু একটাও যদি থাকত, তা নয়, কিছুই নেই!….’

বিরক্ত হয়ে ঠোঁট কামড়ে সে মিঠাইয়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এলো,  ঠিক করল আজ আর অভ্যাস মত কারও দিকে তাকাবে না, কারও উদ্দেশ্যে অমাইক হাসি হাসবে না। হঠাৎ একটা বাড়ীর দরজার সামনে সে পাথরের মূর্তির মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল; তার চোখের উপর ঘটে গেল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা: প্রবেশপথের সামনে এসে থামল একটা জুড়িগাড়ি; গাড়ির দরজা খুলে যেতে ঘাড় কুঁজো করে লাফ দিয়ে নামলেন  ইউনিফর্ম পরা এক ভদ্রলোক, ছুটে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে  উঠতে লাগলেন ওপরে। কভালিওভ কী দারুণ আতঙ্কিত ও বিস্মিতই না  হয়ে গেল যখন ঐ লোকটিকে চিনতে পারলো তার নিজের নাক বলে!  এই অসাধারণ দৃশ্য দেখে তার মনে হল যেন  চোখের সামনে সমস্ত কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে; তার মনে হচ্ছিল এই বুঝি পড়ে  যাবে। কিন্তু ঠিক করল কপালে যা-ই থাক না কেন, অপেক্ষা করে থাকবে যতক্ষণ না নাক গাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করে।  তার সর্বাঙ্গ তখন জ্বরো রুগীর মতো থরথর করে কাঁপছে। দুমিনিট বাদে নাক বাস্তবিকই বেরিয়ে এলেন। তাঁর ইউনিফর্মে সোনালী জরীর কাজ, বিশাল খাড়া কলার আাঁটা; পরনে ছিল হরিণের নরম চামড়ার প্যান্ট; পাশে ঝুলছিলো তলোয়ার। পালকগোঁজা টুপি দেখে  সিদ্ধান্ত করা যায় যে পদমর্যাদার দিক থেকে তিনি একজন সরকারী পরামর্শদাতা। সব দেখেশুনে মনে হাচ্ছিল তিনি স্বাক্ষাৎকারের জন্য কোথাও চলেছেন। এ পাশে ও পাশে দৃষ্টি  নিক্ষেপ  করে কোচম্যানের উদ্দেশ্যে তিনি হাঁক দিলেন: ‘গাড়ি লাগাও!’ বলেই তিনি চেপে বসলেন, গাড়িও ছুটল।

বেচারি  কভালিওভের তখন মাথা খারাপ হওয়ার জো। সে এই অদ্ভুত ঘটনর কথা ভাবতেই পারছিল না। এই গত কালও যে-নাক তার মুখে সাঁটা ছিল, যার গাড়িতে  বা পায়ে হেঁটে কোন ভাবেই চলার ক্ষমতা নেই, সেটা কি করে সত্যি-সত্যিই ইউনিফর্ম ধারণ করতে পারে!  সে ছুটল জুড়িগাড়ীর  পিছু পিছু। গাড়ীটা সৌভাগ্যবশত তখনও বেশি দূরে যেতে পারে নি এবং যেতে যেতে থেমে দাঁড়িয়েছে কাজান ক্যাথেড্রালের সামনে।

সে ক্যাথেড্রালের ভেতরে দ্রুত পা চালাল, ভিখিরি বুড়িদের সারির মাঝখান দিয়ে ঠেলেঠুলে পথ করে নিয়ে সে গীর্জার ভিতরে প্রবেশ করল। নাক খসে পড়া এই ভিখিরি-বুড়িদের কাপড়ে  জড়ানো মুখের ওপর চোখের দুটো ফোকর দেখে এককালে তার বড়ই হাসি পেত।  গীর্জার ভিতরে প্রার্থনাকারীদের সংখ্যা বেশি ছিল না; তারা সকলে কেবল দরজায় ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল।  কভালিওভের অবস্থা তখন এমনই বেসামাল যে প্রার্থনা করার কোন সাধ্য তার ছিল না, সে আনাচে-কানাচে সর্বত্র দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে বেড়াতে লাগল সেই ভদ্রলোকটিকে।  অবশেষে সে তাঁকে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।  নাকের মুখটা পুরোপুরি ঢাকা পরে গেছে  বিশাল খাড়া কলারের আড়ালে, তিনি পরম ভক্তি গদগদ ভঙ্গিতে প্রার্থনা করছিলেন।

‘কী করে ওঁর সামনে যাওয়া যায়?’ কভালিওভ ভাবল। ‘ইউনিফর্ম’ টুপি – সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে যে উনি একজন সরকারী পরামর্শদাতা। কী জানি ছাই, জানি না কি ভাবে কি করা উচিত!’

সে তাঁর কাছাকাছি এসে খাশতে শুরু করল, কিন্তু মুহুর্তের জন্যও নাকের ভক্তি-গদগদ অবস্থায় কোন বিকার ঘটল না, তিনি মাথা নুইয়ে প্রণাম করে চললেন।

‘স্যার…’ ভেতরে ভেতরে জোর করে সাহস সঞ্চয় করে  বলল কভালিওভ, ‘শুনছেন স্যার…’

‘কী চাই আপনার?’ ঘাড় ফিরিয়ে বললেন নাক।

‘আমার তাজ্জব লাগছে স্যার… আমার মনে হয়… আপনার নিজের  জায়গা থাকা উচিত। আর হঠাৎ কিনা আমি আপনার সাক্ষাৎ পেলাম, কোথায় – না, গির্জায়। আপনাকে মানতেই হবে…’

‘ মাফ করবেন, আপনার কথার মাথামুন্ডু আমি কিছুই বুছতে পারতেছি না।… স্পষ্ট করে বলুন।’

‘কী করে এ’কে বুঝিয়ে বলি?’ কভালিওভ মনে মনে ভাবল, শেষকালে আবার সাহস সঞ্চয় করে বলতে শুরু করল:

‘অবশ্য আমি, হ্যাঁ আমি… আসলে একজন মেজর। আপনি নিশ্চই অস্বীকার করতে পারবেন না যে নাক ছাড়া চলাফেরা করা আমার শোভা পায় না। ভসক্রেনেস্কি ব্রীজের যারা ছড়ানো কমলালেবু-টেবু বিক্রি করে  ঐ রকম কোন ফিরিওয়ালী মেয়ের পক্ষে নাক ছাড়া বসে থাকা চলে; কিন্তুু যেহেতু আমার সম্ভাবনা আছে…  তাছাড়া বহু বাড়ির মহিলাদের  সঙ্গে – সরকারী পরামর্শদাতা চেখ্তারিওভের স্ত্রী ইত্যাদি আরও অনেকের সঙ্গে চেনা পরিচিতি থাকায়… আপনি নিজেই বিচার করে দেখুন… আমি আর কি বলব স্যার, জানি না…’  (বলার সঙ্গে সঙ্গে মেজর কভালিওভ অসহায়ের ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকাল)। ‘মাফ করবেন… ব্যাপারটাকে যদি কর্তব্য ও সম্মানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়… তাহলে আপনি নিজেই বুঝতে পারেন…,

‘কিছুই বুঝতে পারছি না,’ নাক জবাব দিলেন। ‘একটু বোঝার মতো করে বলুন।’

‘স্যার…’ কণ্ঠস্বরে  আত্মমর্যদার ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল কভালিওভ, ‘জানি না, আপনার কথাগুলোর অর্থ  কী হতে পারে… এখানে সমস্ত ব্যাপারটা, মনে হয় জলের মতো পরিষ্কার… নাকি আপনি চান… আরে আপনি যে আমারই নাক।’

নাক মেজরের দিকে তাকালেন, সামান্য ভ্রুকুটি করলেন।

‘আপনি ভুল করছেন মশাই। আমি আমার নিজের গুণেই আমি। তাছাড়া, আমাদর মধ্যে কোন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকারও সঙ্গত কারণ নেই।  আপনার ইউনিফর্মের বোতাম দেখে মনে হচ্ছে আপনি অন্য কোন দপ্তরে   কাজ করেন।’

এই বলে নাম মুখ ফিরিয়ে আমার প্রার্থনায় মন দিলেন।

কভালিওভ এখন সব গুলিয়ে ফেলল, বুঝে উঠতে পারছিল না কী করা যায়, সে কিছুই ভাবতে পারছিল না। এমন সময় কোন ভদ্রমহিলার পোশাকের মধুর খসখস আওয়াজ কানে এল; এগিয়ে এলেন এক বর্ষীয়সী ভদ্রমহিলা  – সর্বাঙ্গে লেসের সজ্জা  আর তার সঙ্গে চমৎকার মানিয়েছে, মাথায় ঈষৎ হলদেটে রঙের টুপি, ফুরফুরে পেস্ট্রির মত হালকা। ডজন  খানের কলার আাঁটা পোশাক পরনে, বিশাল জুলফিধারী  এক দীর্ঘকায় ভৃত্য তাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, নস্যিদানি খুলল।

কভালিওভ খানিকটা এগিয়ে এলো, সে তার জামার কেম্ব্রিক কাপড়ের কলারটা টেনে বার করল, সোনার  চেন-এ তার যে-সমস্ত সীল ঝুলছিল সেগুলি ঠিকঠাক করে  নিল এবং এপাশে-ওপাশে হাসি ছড়াতে ছড়াতে মনোযোগ দিল তন্বী মেয়েটার দিকে। মেযেটি তখন বসন্তের ফুলের মত সামনের দিকে সামান্য হেলে পরে তার স্বচ্ছপ্রায় আঙ্গুলি সমেত  সাদা ধবধবে হাতাটা উচিয়ে কপালে ঠেকাচ্ছিল। কভালিওভ যখন টুপির আড়ালে তার গোলগাল, উজ্জ্বল ধবধবে চিবুক আর প্রথম বসন্তের গোলাপের রঙ ছোপানো গালের একাংশ  দেখতে পেল তখন তার হাসি আরও প্রশস্ত আকার ধারণ  করল। কিন্তু হঠাৎ সে এক লাফে পিছিয়ে গেল, যেন ছে’কা লেগেছে।  তার মনে পরে গেল যে নাকের জায়গাটায় তার একেবারেই কিছু নেই, তার চোখে জ¦ল এসে গেল। সে ঘুরে  দাড়ালো ইউনিফর্মধারী ভদ্রমহিলাকে সোজাসুজি এই কথা বলার জন্যে যে তিনি আসলে সরকারী পরামর্শদাতার ভেক নিয়েছিলেন,  আসলে তিনি একটা ঠগ, ইতর,  তিনি তারই পৈতৃক নাক বৈ আর কিছু নন।…  কিন্তু নাক তখন আর সেখানে ছিলেন না; এই অবসরে  তিনি সরে পরেছেন, সম্ভবত আরও কারো সাথে সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে।

ফলে কভালিওভ হতাশ হয়ে পড়ল। সে পিছু হটে গিয়ে বাইওে চলে এলো, থামের সারি দেওয়া তোরণের নীচে থমকে দাড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে নিরীক্ষণ করতে লাগল কোথাও নাকের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। তার বেশ ভালোমতো মনে আছে যে নাকের টুপিতে ছিল পালক গোঁজা আর ইউনিফর্মপায় ছিল সোনালি জরির কাজ। কিন্তু ওভারকোটটা সে খেয়াল করে দেখে নি, তার জুড়িগাড়ীর বা ঘোড়াগুলির রঙও নয়, এমন কি তাঁর পেছনে কোন ভৃত্য বা চাপরাশি ছিল কিনা তাও নয়। তাছাড়া এত বেশি সংখ্যক জুড়িগাড়ি পেছনে সামনে ছুটে চলছিল এবং এত দ্রুত গতিতে, যে আলাদা করে চেনাও কঠিন;   আর সেগুলোর মধ্য থেকে আলাদা করে চিনতে পারলেই বা কি? – থামানোর কোন সাধ্যও তার হত না।  দিনটা ছিল চমৎকার, রোদ ঝলমলে ।  নেভ্স্কি  লোকে লোকারণ্য; পলিৎসেইস্কিন  ব্রিজ থেকে  শুরু করে  অনিচকভ ব্রীজ পর্যন্ত ফ’টপাত জুড়ে ছড়িয়ে আছে মহিলাদের স্রোত – যেন পুরোদস্তুর ফুলের প্রবাহ। ঐ ত চলেছে তার পরিচিত এক কাছারির উপদেষ্টা, যাকে সে লেফটেন্যান্ট কর্নেল বলে ডাকে,  বিশেষত বাইরের লোকজনের সাক্ষাতে। ঐ ত ইয়ারিগিন, সিনেটের হেডক্লার্ক, তার ঘনিষ্ট বন্ধু,  যে বস্টন খেলার সময় আটে খেললেই বাজী হেরে যায়। ঐ যে ককেশাসে কালেক্টরের খেতাব পাওয়া  আরও এক মেজর – হাত নেড়ে কাছে আসতে বলছে…

‘জাহান্নামে যাক!’  কভালিওভ বলল। ‘এই  কোচম্যান,  আমাকে সোজা নিয়ে চল পুলিশ কমিশনারের কাছে!’
কভালিওভ একটা ছেকরা গাড়িতে চেপে বসে  কেবল কোচম্যানের উদ্দেশ্যে হাঁক  পাড়ল: ‘জলদি হাকাও!’

‘পুলিশ কমিশনার  আছেন কি?’  বার-বারান্দায় পদার্পন করে  সে চে’চিয়ে বলল।

‘উ;হু নেই,’  দারোয়ান জবাব দিল ‘ এই মাত্র বেরিয়ে গেলেন।’

‘বোঝ কান্ড!’

‘হু,’ দারোয়ান যোগ করল, ‘এই ত কিছুক্ষণ আগে বেড়িয়ে গেলেন। আর মিনিটখানেক আগে যদি আসতেন তাহলে  বাড়িতে পেয়ে যেতেন।’

কবালিওভ মুখে রুমাল রুমাল চাপা দিয়েই গাড়িতে  উঠে পড়ল, হতাশ কণ্ঠে চে’চিয়ে বলল:
‘চালাও!’

‘কোথায়?’ কোচম্যান জিজ্ঞেস করল।

‘সিধে হাঁকাও!’

‘সিধে?  তা কী করে হবে? ওখানে ত রাস্তা মোড় নিয়েছে: ডাইনে না বাঁয়ে?’

এই প্রশ্নে কভালিওভ থতমত খেয়ে গেল, সে আবার বাধ্য হয়ে ভাবতে বসল। তার যে রকম অবস্থা তাতে সবচেয়ে ভাল হয় পৌর পুলিশ দপ্তরে গিয়ে যোগাযোগ  করা, কারন এমন নয় যে পুলিশের সাথে এর কোন সরাসরি সম্পর্ক আছে, কারনটা হল এই যে পুলিশ দপ্তরের হুকুম অন্যান্য দপ্তরের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি জারী হওয়ার সম্ভাবনা। নাক যেখানে চাকরি করে বলে জাহির করছে সেখানকার কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে কৈফিয়ত দাবী করাটা  অবিবেচকের কাজ হবে, কেন না নাকের নিজের জবাব থেকেই স্পষ্ট বোঝা গেছে যে এই লোকটির ন্যায়নীতির কোন বালাই নেই, আর এক্ষেত্রে সে ডাহা মিথ্যা কথা বলে যেতে পারে,  যেমন বলেছিল আগে,  যখন সে সাফ জানিয়ে দেয় যে কস্মিনকালেও সে মেজর কভালিওভ কে দেখে নি । সুতরাং কভালিওভ পৌর পুলিশ দপ্তরে যাবার প্রায় হুকুম দিয়ে বসেছিল,  এমন সময় আবার তার মাথায় এই চিন্তা খেলে গেল যে প্রথম সাক্ষাতেই যে ঠগ ও জোচ্চরটা তার সঙ্গে এমন নির্লজ্জ ব্যবহার করল,  সে আবার দিব্বি সময়ের সুযোগ নিয়ে কোন উপায়ে শহর থেকে সটকেও পড়তে পারে –  আর তাহলে সমস্ত অনুসন্ধানই ব্যর্থ হতে পারে কিংবা, ভগবান না করুন, পুরো একমাস ধরেও চলতে পারে।  শেষকালে সে যেন আকাশ থেকে প্রত্যাদেশ পেল।  স্থির করল সরাসরি খবরের কাগজের অফিসে যাবে এবং সময় থাকতে যাবতীয়  লক্ষণাদির বিশদ বিবরণ দিয়ে  একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করবে,  যাতে যে কেউ  ওটা দেকামাত্র উদ্ধার করে তার কাছে  এনে হাজির করতে পাওে কিংবা অন্তত হদিশ দিলেও দিতে পারে।  সুতরাং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পর সে কোচম্যানকে খবরের কাগজের  অফিসের দিকে গাড়ী চালানোর হুকুম দিল এবং সারা রাস্তা ধরে কোচম্যানের পিঠে কিল ঘুষি বর্ষন করতে করতে  বলে চলল: ‘জলদি চালা ইতর! জলদি, জলদি ঠগ কোথাকার!’ ‘ওঃ বাবু!’ কোচম্যান এই বলতে বলতে মাথা ঝাঁকাতে লাগল,  রাশ আলাদা করে দিল তার ঘোড়ার,  যেটার গায়ে ছিল লোমশ বলেনিজ কুকুরের মতো লম্বা লম্বা ঝাঁকড়া পশম।  ছেকড়া গাড়ি শেষকালে থামল,  কভালিওভ হাঁপাতে হাঁপাতে, ছুটতে ছুটতে এসে প্রবেশ করল  একটা ছোট আকারের রিসেপ্শন রুমে,  যেখানে পুরনো টেইল-কোট পরনে, চশমা-নাকে এক পক্ককেশ কেরানী দাঁতে  পালকের কলম ধরে পেবিলের  পাশে বসে তার সামনে এনে রাখা এক গাদা তামার পয়সা গুনছিল।

‘এখানে কে বিজ্ঞাপন নেন?’ কভালিওভ চেঁচিয়ে বলল। ‘এই যে, নমস্কার!’

‘নমষ্কার,’ পক্ককেশ কেরানিটি এক মিনিটের জন্য চোখ তুলে কথাটা বলেই আবার সামনে রাখা পয়সার স্তুপের ওপর চোখ নামাল।

‘আমি কাগজে ছাপাতে চাই…’

‘যদি কিছু মনে না করেন… দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন’, ডান হাতে কাগজের ওপর সংখ্যা লিখতে লিখতে এবং বাঁ হাতের আঙ্গুল দিয়ে পাশে রাকা অ্যাবাকাসের ঘুঁটির সারিতে দুটো ঘুঁটি সরিয়ে দিতে দিতে বলল।

লেস লাগানো পোষাক পরনে এক ভৃত্যগোছের লোক, যার চেহারা দেখে মনে হয় কোন  অভিজাত বাড়িতে কাজ করে,  দাঁড়িয়ে ছিল টেবিলের পাশে;   লোকটার হাতে ধরা ছিল একটা চিরকুট।  সে তার মিশুকে স্বভাবের  পরিচয় দেওয়া শিষ্টাচারসম্মত বিবেচনা করে বলল:

‘বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না স্যার,  কুকুরটার দাম একটা আধুলিও হবে না, মানে আমি হলে ত ঐটার জন্যে আটটা তামার পঁয়সাও দিতাম না;  কিন্তু রানী-মা ভালবাসেন, কি দারুণই না ভালোবাসেন! – আর তাই, যে ওটার সন্ধান দিতে পারবে তাকে একশ রুবল পুরষ্কার!  আর যদি ভদ্রতার খাতিরে বলতে হয়,  যেমন এই এখন আপনার আমার মধ্যে কথা হচ্ছে,  তাহলে বলব মানুষের রুচির কোন সীমা-পরিসীমা নেই: শিকারীর কথাই ধরুন না কেন, কোন শিকার খোঁজার বা শিকারের পেছনে তাড়া করার মতো কুকুরের জন্য পাঁচশ, হাজার দিতেও কার্পণ্য করবে না  – কুকুর ভাল জাতের বলেই হল।’

কেরানি মহোদয় গম্ভীর ভঙ্গীতে এই কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল,  সেই সঙ্গে আনা চিরকুটটিতে কটা অক্ষর আছে তা-ও গুনে চলছিল। তার আশেপাশে চিরকুট নিয়ে দাড়িয়ে ছিল বহু সংখ্যক বৃদ্ধা, দোকানকর্মী ও চৌকিদার শ্রেণীর লোকজন।  কোনটাতে প্রকৃতিস্থ স্বভাবচরিত্রের এক কোচম্যান সেবাদান-প্রার্থী; কোনটাতে ছিল ১৮১৪  সালে প্যারিস থেকে আনীত স্বল্পকাল  ব্যবহৃত এক গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন; কোনটাতে ধোবীর কাজে অভ্যস্ত, তবে অন্যান্য কাজের ও উপযোগী উনিশ বছর বয়ষ্কা ভ’মিদাষ-কন্যা সেবা-প্রার্থিনী; এছাড়াও বিজ্ঞাপনের মাঝে ছিল একটা স্প্রিং-ছাড়া  মজবুত ছেকরা  গাড়ি,  ছাইরঙা চক্করওয়ালা সতেরো বছর বয়ষ্ক তরুণ তেজী ঘোড়া, লন্ডন থেকে প্রাপ্ত শালগম ও মুলোর নতুন বীজ;  দুটো আস্তাবল, সেই সঙ্গে চমৎকার বার্চ অথবা ফারগাছের বাগান করার উপযোগী প্রশস্ত জমি সমেত  যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন বাগানবাড়ি;  একটা বিজ্ঞাপন আবার ছিল পুরনো জুতার সোল ক্রয়েচ্ছুদের প্রতি আহ্বান – প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে তিনটার মধ্যে নিলাম ঘড়ে উপস্থিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাদের। গোটা দল যে-ঘড়ে এসে জড় হয়ে ছিল সেটা ছিল ছোট, ঘরের বাতাস ছিল দারুণ ভারী; কিন্তু সরকারী কালেক্টর কভালিওভের পক্ষে কোন গন্ধ টের পাবার উপায় ছিল না, যেহেতু সে মুখে রুমাল চাপা দিয়েছে, তা ছাড়া খোদ তার নাকটাই, ভগবান জানেন, কোন্ জায়গায় অবস্থান করছিল।

‘মশাই শুনছেন? আমার আর্জিটা… বড় দরকারী,’ অধৈর্য হয়ে শেষকালে সে বলে ফেলল।

‘এক্ষুনি, এক্ষুনি! দুরুবল তেতাল্লিশ কোপেক! এক মিনিট! এক রুবল চৌষট্রি কোপেক!’ বুড়ি আর দাড়োয়ান শ্রেণীর লোকদের মুখের ওপর চিরকুট গুলো ছুঁড়ে দিতে দিতে পক্ককেশ কেরনি মহোদয় বলে যাচ্ছিলেন। ‘আপনার কী চাই?’ অবশেষে কভালিওভের উদ্দেশ্যে সে বলল।

‘আমার আর্জিটা হল এই যে…’ কভালিওভ বলল, ‘এমন একটা কান্ড ঘটে গেছে যাকে প্রতারণা না জুয়াচুরি কী বলব, এখনও  আমি কোন মতে বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার কাছে আমার অনুরোধ, কেবল এই কথাগুলি ছাপিয়ে দিন যে দুর্বৃত্তটিকে যে-ব্যক্তি ধরে আমার কাছে এনে হাজির করতে পারবে তাকে উপযুক্ত পুরষ্কার দেওয়া হবে।’

‘আপনার নাম, পদবী জানতে পারি কি?’

‘না, নাম-টামে কি দরকার?  ও সব আমি প্রকাশ করতে পারব না। সরকারী পরামর্শদাতা চেখতারিওভের স্ত্র্রী, স্টাফ অফিসারের স্ত্রী পালাগেইয়া গ্রিগরিয়েভনা পদেতোচিনা… এরকম বহু লোকজন আমার চেনা পরিচিত। ভগবান না করুন, হঠাৎ যদি জানাজানি হয়ে যায়! আপনি  প্রুফে লিখুন না কেন সরকারী কালেক্টর, কিংবা আরও ভালো হয় যদি লেখেন জনৈক মেজর পদাধিকরী।’

‘আর যে পালিয়েছে সে কি আপনার গোলাম-টোলাম কেউ?’

‘আরে না গোলাম আর কোথায়? তা হলে ত তেমন বড় প্রতারেণা বলা যেত না! আমার কাছ থেকে পালিয়েছে… নাসিকা…’

‘হুম্! বড় অদ্ভুত নাম! তা এই নাসিকা বাবাজীটা কি আপনার প্রচুর পরিমাণ টাকা মেরেছে?’

‘নাসিকা হল গিয়ে… আপনি যা ভাবছেন তা নয়!  নাক, আমার একেবারে নিজস্ব নাক যাকে বলে, সেটা খোয়া গেছে, কোথায় জানি না। শয়তানের কারসাজি!’

‘কিন্তু কী ভাবে খোয়া গেল? কোথায় যেন একটা গোলমাল ঠেকছে, ভালোমতো বুঝতে পারছি না।’

‘না, কী ভাবে, সেটা আমি আপনাকে বলতে পারছি না; তবে বড় কথা এই যে সে এখন শহরের এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নিজেকে সরকারী পরামর্শদাতা বলে জাহির করছে। তাই আপনার কাছে আমার অনুরোধ, এই মর্মে বিজ্ঞাপন ছাপান যে ওটাকে ধরতে পারলে যেন বিন্দুমাত্র দেরি না করে,  অনতিবিলম্বে আমার কাছে এনে হাজির করা হয।  আপনিই বিচার করে দেখুন না, সত্যিই তো শরীরের এমন একটা জায়গা দৃষ্টিগোচর অংশ ছাড়া  আমার চলবে কী করে? এটা ত আমার পায়ের কড়ে আঙ্গুল নয় যে বুট জুতোর  ভেতর গলিয়ে দিলে – ব্যস, আঙ্গুল না থাকলেও কারও জানার উপায় নেই।  আমি বৃহস্পতিবার-বৃহস্পতিবার  সরকারী পরামর্শদাতা  চেখতারিওভের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাই, স্টাফ অফিসারের স্ত্রী পালাগেইয়া গ্রিগরিয়েভনা পদেতচিনার কাছেও যাই – তাঁর আবার বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে আছে  – দু’জনের সঙ্গেই আমার দারুণ দহরম-মহরম তাই বলি কি আপনি নিজেই বিচার করে দেখুন,  এখন আমি কী করে… কী করে  এখন আমি  তাদের কাছে যাই?’

কেরানি  যে ভাবে শক্ত করে ঠোঁট কামড়াল তাতে বোঝা গেল যে সে ভাবনায় পড়ে গেছে।

‘না এ ধরনের বিজ্ঞাপন পত্রিকায় ছাপানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়,’ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর অবশেষে সে বলল।

‘কেন ? কী কারণে?’

‘পারব না, বললাম তো। পত্রিকার সুনাম নষ্ট হতে পারে। সকলেই  যদি লিখতে শুরু করে যে তাদের নাক খোয়া গেছে তা হলে… অমনিতেই লোকে বলে যে পত্রিকায় অনেক  আজেবাজে জিনিস, মিথ্যে গুজব ছাপানো হয়।,

‘কিন্তু এটা আজেবাজে হল কী করে শুনি? আমার ত মনে হয় সে কেম কিছুই  এর মধ্যে নেই।’

‘নেই, সেটা আপনার মনে হচ্ছে।  অথচ এই ধরুন না কেন গত  সপ্তাহের ঘটনাটা। আপনি যেমন এসেছেন ঠিক সেই ভাবেই একজন সরকারী কর্মচারী এলো একটা চিরকুট নিয়ে, হিসাব করে দাড়াল দুই রুবল তিয়ত্তর কোপেক, আর গোটা বিজ্ঞাপনের বক্তব্যটা হল এই যে কালো লোমওয়ালা এক পুডল্ কুকুর হারিয়েছে। মনে হতে পারে এতে আর কী আছে? কিন্তু ব্যপারটা গড়াল মানহানির মামলায়: আসলে এই পুডল ছিল এক ক্যাশিয়ার – কোন্ প্রতিষ্ঠানের তা মনে করতে পারছি না।’

‘কিন্তু আমি ত আর কোন পুডল সম্পর্কে বিজ্ঞাপন দিতে যাচ্ছি না, বিজ্ঞাপন দিচ্ছি আমার নিজের নাক সম্পর্কে:  অর্থাৎ, বলতে গেলে খোদ নিজের সম্পর্কে।’

‘না এ ধরনের বিজ্ঞাপন আমি কোন মতেই ছাপতে পারি না।’

‘খোয়া যদি গিয়ে থাকে সে হল  ডাক্তারের কাজ। শুনেছি এমন লোকও আছে যারা যে-কোন  রকম নাক বসাতে পারে।  কিন্তু সে যাক গে, আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি বেশ রগুড়ে লোক, লোকজনের সঙ্গে হাসিঠাট্রা করতে ভালোবাসেন।’

‘ভগবানের পবিত্র নামের দিব্যি!  ব্যাপারটা যখন এতদূরে এসে ঠেকেছে, তাহলে দেখাতেই হচ্ছে।’

‘ঝামেলায় কাজ কী!’ কেরানি নস্যি টানতে টানতে বলে চলল, ‘অবশ্য তেমন ঝামেলা যদি মনে না করেন, তাহলে একবার দেখতে পেলে মন্দ হত না।’

সরকারী কালেক্টর কভালিওভ মুখের ওপর থেকে রুমাল সরিয়ে  নিল।

‘আসলে কিন্তু সত্যিই দারুণ অদ্ভুত!’ কেরানি বলল, ‘জায়গাটা একেবারেই লেপাপোঁছা, যেন সবে সেঁকা একটা চাপাটি। হ্যাঁ এমনই সমান যে বিশ্বাস করা যায় না!’

‘তাহলে, এখনও কি আপনি তর্ক করবেন? আপনি  নিজেই দেখতে পাচ্ছেন যে না ছাপালে  চলবে না। আমি  আপনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ থাকব; এই উপলক্ষে  আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ায়  আমি বড়ই আনন্দিত – নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান জ্ঞান করছি…’

এ থেকে  বুঝতে বাকী  থাকে  না  যে মেজর  এবারে  খানিকটা খোসামোদের  আশ্রয়  গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
‘ছাপানোটা অবশ্যই তেমন কঠিন ব্যাপার নয়,’ কেরানি বলল, ‘ তবে এতে আপনার কোন ত লাভ আমি  দেখতে  পাচ্ছি  না।  যদি নেহাৎই  এ ব্যাপারে কিছু করতে চান তাহলে বরং যার কলমের জোর আছে এমন কাউকে গিয়ে বিষয়টাকে অসাধারণ প্রকৃতির ঘটনা বলে লেখান, প্রবন্ধটা ‘উত্তরের মধুকর’ কাগজে  ছাপতে দিন, (এই  বলে সে আরও এক টিপ নস্যি নিল)‘ ‘যুবসম্প্রদায়ের উপকারের জন্য’ (বলতে বলতে সে নাক মুছল)‘কিংবা অমনিতেই সকলের কৌতুহল চরিতার্থ করার জন্য।’

সরকারী কালেক্টর সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়ল। সে চোখ নামাল খবরের কাগজের  পাতার উপরে, যেখানে ছিল থিয়েটারের বিজ্ঞপ্তি – সেখানে এক আকর্ষণীয় অভিনেত্রীর  নাম চোখে পড়ল তার মুখে প্রায় হাসি-হাসি ভাব ফুটে উঠল,  তার হতও চলে গেল পকেটে,  পাঁচ রুব্লের নোট কাছে আছে কিনা দেখার উদ্দেশ্যে,  যেহেতু কভালিওভের স্টাফ অফিসারদের বসা উচিত গদিওয়ালা সীটে  –  কিন্তু নাকের কথাটা মনে পড়তেই  সব বরবাদ হয়ে গেল।

কেরানিটি নিজেও যেন কভালিওভের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়ল। কভালিওভের দুঃখ অন্তত কিঞ্চিৎ  পরিমানেও লাঘবের বাসনায় সে গুটি কয়েক কথায় তার সমবেদনা জানানো সৌজন্যমূলক বলে গন্য করল:

‘সত্যি কথা বলতে গেলে কি, আপনার জীবনে যে এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল তার জন্য আমার বড় দুঃখ হচ্ছে। এক টিপ নস্যি নেওয়া কি আপনার পক্ষে ভালো হবে না? এতে মাথার যন্ত্রণা আর মনমরা ভাবটা ছেড়ে যায়; এমনকি অর্শের পক্ষেও এটা ভালো।’

বলতে গেলে কেরানিটি কভালিওভের সামনে নস্যিদানি ধরে টুপি পরিহিতা কোন এক মহিলার প্রতিকৃতি আাঁকা ঢাকনাটা বেশ কায়দা করে ঘুরিয়ে নীচে সরিয়ে দিল।

এহেন হঠকারিতায় কভালিওভের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।

‘আমি ভেবে পাই না, এ নিয়ে আপনি রসিকতা  করেন কী বলে,’ সে রেগে গিয়ে বলল, ‘আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না যে নস্যি যেখান দিয়ে  টানব সেই জিনিসটাই আমার নেই? জাহান্নামে  যাক আপনার  নস্যি!  এই অবস্থায় ওটার  দিকে তাকানোরও প্রবৃত্তি নেই আমার – আপনার ঐ জঘন্য বেরেজিনইস্ক মার্কা ত দূরের কথা, যদি খোদ রাপে i  এনে দিতেন তা হলেও নয়।’

এই বলে সে দারুণ বিরক্ত হয়ে খবরের কাগজের অফিস থেকে বেরিয়ে রওনা দিল পুলিশ সুপারিন্ডেন্টের উদ্দেশ্যে। লোকটি  ছিল চিনির  পরম ভক্ত। তার বাড়িতে পুরো সামনের ঘরটা, যেটা আবার খাবার ঘরও বটে, চিনির ডেলায় সাজানো  – সেগুলি বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে  উপঢৌকন দিয়েছে ব্যবসায়ীরা ।  বাড়ির রাঁধুনি  এই সময়ে সুপারিন্ডেন্টের পা থেকে  তার আনুষ্ঠানিক জ্যাক-বুট জোড়া খুলছিল;  তলোয়ার এবং আর সব সামরিক উপকরণ ইতিমধ্যেই শান্ত ভাবে ঘরের এ কোনায় ও কোনায়   ছুলছিল, আর ভয়ঙ্কর তেকোনা টুপিটা নিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে তার তিন বছরের ছেলে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট এখন যুদ্ধবিপর্যস্ত, সামরিক জীবনের পর শান্তিসুখ উপভোগের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

কভালিওভ যখন তার কাছে এসে উপস্থিত হল তখন রেস হাতপা টান টান করে ছড়িয়ে দিয়ে কঁকিয়ে উঠে বলল:  ‘আঃ ঘন্টা দুয়েক আরামসে ঘুম দেওয়া  যাবে!’ তাই আগে থেকেই অনুমান করা যেতে পারে  যে কালেক্টরের আগমন ছিল সম্পূর্ণ অসময়োচিত ; জানি না, আমার ত মনে হয় ঐ সময় সে যদি অন্তত কয়েক পাউন্ড চা কিংবা  খানিকটা বানাত কাপড়ও আনত তাহলেও তেমন একটা সাদর অভ্যর্থনা পেত না। সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিল যাবতীয় শিল্প ও বাণিজ্যেও পরম  উৎসাহদাতা, তবে সে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করত ব্যঙ্ক নোট। ‘জিনিসের মতো জিনিস বটে,’ সে সচরাচর বলত, ‘এর চেয়ে ভালো জিনিস আর কিছুই নেই: খাওয়ানোর দরকার নেই,  জায়গা অল্প লাগে,পকেটে সব সময় জায়গা হয়ে যায়,  পড়ে গেলেও ভাঙে না।’

সুপারিন্টেন্ডেন্ট শুষ্ক কণ্ঠে কভালিওভকে অভ্যর্থনা জানালো, বলল যে মর্ধাহ্নভোজের পর তদন্ত চালানোর সময় নয়, স্বয়ং প্রকৃতির নির্দেশ এই যে পেট পুরে খাওয়াদাওয়ার পর  বিশ্রাম করা উচিত (এ থেকে কালেক্টর বুঝতে পারল যে প্রাচীন জ্ঞানীদের বাণী পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টের অজানা নয়),তাছাড়া কোন ভালো লোকের নাক কেউ ছিনিয়ে নেয় না, আর দুনিয়ায় মেজর অনেক রকমের আছে, এমনও আছে যাদের পরনে একটা ভদ্রস্থ জামা পর্যন্ত নেই, যারা অস্থানে-কুস্থানেও যাতায়াত করে।

অর্থাৎ রেখে ঢেকে নয়, সরাসরি মুখের ওপর! এখানে উল্লেখ করা দরকার যে কভালিওভ ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর লোক। তার নিজের সম্পর্কে যা কিছু বলা হোক না কেন সে ক্ষমা করতে পারে, কিন্তু তার পদ বা খেতাব নিয়ে লোকে কিছু বলবে এটা সে কোনমতেই বরদাস্ত করতে পারে না।  তার এমনও মনে হল যে নাট্যাভিনয়ে মেজরের নীচের শ্রেণীর সৈন্যদের নিয়ে যা খুশি দেখানো হোক না কেন কোন আপত্তি  নেই, কিন্তু স্টাফ অফিসারদের ওপর আক্রমন করা চলে না।  পুলিশ- সুপারিন্টেন্ডেন্টের অভ্যর্থনায় সে এমন হতভম্ব হয়ে গেলক যে মাথা ঝাঁকিয়ে মর্যাদাব্যঞ্জক স্বরে, দুই হাত সামান্য ছড়িয়ে বলল: ‘ আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনার পক্ষ থেক এ ধরনের অপমানজনক মন্তব্যের পর আমার আর কিছ্ইু বলার নেই।, সঙ্গে সঙ্গে  সে বেড়িয়ে গেল।

বাড়িতে যখন সে ফিরে এলো তখন নিজের পায়ে প্রায় কোন সাড়াই পাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে অন্ধকার ঘনিয়ে এসছে।  এই সমস্ত অনর্থক খোঁজাখুঁজির পর নিজের ফ্ল্যাটটাকে তার কাছে মনে হতে লালগ ভয়ানক কুৎসিত আর বিষন্ন ধরনের।  সামনের ধরটাতে  প্রবেশ করতে সে দেখতে পেল যে চাকর ইভান ছোপ ধরা চামড়ার  কোচে চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে ছাদের কড়িকাঠ লক্ষ করে থুতু ফেলছে, বেশ সাফল্যের  সঙ্গে বারবার একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য ভেদ করছে। লোকটার ঔদাসীন্যে কালেক্টর  ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, সে টুপি  দিরেয় তার কপালে এক ঘা কষিয়ে দিয়ে বলল:  ‘শুয়োর কোথাকার, সব সময় আজেবাজে কাজ।’

ইভান তৎক্ষণাৎ তার জায়গা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে সাঁ করে ছুটে এলো প্রভুর গা থেকে আচকানটা খোলার জন্য।
নিজের ঘরে প্রবেশ করে ক্লান্ত ও বিষন্ন মেজর গদি আাঁটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিল, অবশেষে পর পর কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল:
‘হা ভগবান ! হা ভগবান! কেন এই দুর্ভাগ্য? যদি হাত কিংবা পা যেত, সেও  ছিল এর চাইতে ভাল; কান যদি যেত সেটা খারাপই হত, কিন্তু তাও সহ্য করা যেত; কিন্তু নাক ছাড়া মানুষ  –  কে জানে বাপু তাকে কী বলা যায়?  – পশু নয়, পাখি নয়, মানুষ ও নয়। স্রেফ তুলে নিয়ে জানালা দিয়ে ছু’ড়ে ফেলে দেওয়ার বস্তু! আর তাও যদি কাটা যেত যুদ্ধে কিংবা ডুয়েলে, কিংবা আমার নিজের কো দোষে; কিন্তু দেখ, খোয়া গেল  বিনা কারণে, বেফায়দা, ঝুটমুটে!… না, না এ হতে পারে না,’ খানিকটা ভেবে নিয়ে সে যোগ করল। ‘নাক খোয়া যাওয়া, এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার, কোন মতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সম্ভবত আমি স্বপ্ন  দেখছি, নয়ত নেহাৎই আমার মনের ভ্রান্তি; এমনও ত হতে পারে যে জলের বদলে আমি ভুলক্রমে খেয়ে ফেলেছি ভোদকা, যে ভোদকা আমি দাড়ি কামানোর পর চিবুকে ঘষি। বোকা ইভানটা  ওটা উঠিয়ে রাখে নি, সম্ভবত আমি খেয়ে ফেলেছি।’

সে যে মাতাল নয় এ বিষয়ে সত্যি  সত্যি  নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেজর নিজের গায়ে এত জোড়ে চিমটি কাটল যে যন্ত্রনায় নিজেই চেঁচিয়ে উঠল। এই যন্ত্রণার ফলে তার সম্পূর্ণ প্রত্যয় হল যে সে সক্রিয় এবং জাগ্রত অবস্থায় আছে।  সে ধীরে ধীরে  আয়নার দিকে এগিয়ে গেল এবং প্রথমে  এই আশায় চোখ কোঁচকাল যে নাকটা হয়ত যথাস্থানে দেখা গেলেও যেতে পারে;  কিন্তু পর মুহুর্তেই এক লাফে পিছিয়ে গিয়ে বলল:
‘ওঃ কী বিদঘুটে দৃশ্য!’

ব্যাপারটা  সত্যি সত্যিই দুর্বোধ্য। বোতাম, রুপোর চামচ, ঘড়ি কিংবা ঐ ধরনের কিছু জিনিস খোয়া গেলে না হয় একটা মানে হয়, কিন্তু গেল ত গেল – এ কী খোয়া গেল ?  তাও আবার কিনা নিজের ফ্ল্যাটে!… মেজর কভালিওভ সমস্ত পরিস্থিতি সবে মনে মনে বিবেচনা করে এটাই সত্যের  অনেকটা কাছাকাছি বলে  অনুমান করল যে এর জন্য সম্ভবত স্টাফ অফিসার পদ্তোচিনার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ দায়ী নয় – ভদ্রমহিলার ইচ্ছে ছিল সে যেন তার মেয়েকে বিয়ে করে। মেয়েটির সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি   করতে তার নিজের ও মন্দ লাগত না কিন্তু চূড়ান্ত কোন কথা দেওয়ার ব্যাপারটা সে পরিহার করে  এসেছে। স্টাফ অফিসারের পত্নী যখন কন্যাকে তার সঙ্গে বিয়ে দেবার ইচ্ছে তাকে স্পষ্টাস্পষ্টি  জানালেন তখন সে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিল; সবিনয়ে জানাল যে তার বয়স এখনও কম, তার আরও পাঁচ বছর চাকরী করা দরকার যাতে বয়স পুরোপুরি বেয়াল্লিশ হয়। আর সেই কারণে স্টাফ অফিসারের পত্নী সম্ভবত প্রতিহিংসাবশত তার সর্বনাশ করার মতলব এঁটেছেন, হয়ত সে কোন ডাইনী-টাইনীর সাহায্য নিয়েছেন, কেননা নাকটা যে কাটা গেছে এটা কোন মতেই অনুমান করা  যায়  না: তার ঘরে কেউ আসে নি, নাপিত ইভান ইয়াকভলেভিচ তার দাড়ি কামিয়েছে বটে, কিন্তু সে ত বুধবারে, এমনকি পুরো বিষ্যুদবারটাও তার  নাক অক্ষত ছিল – এটা তার মনে আছে এবং বেশ ভালোই জানা আছে; তাছাড়া সে রকম হলে ত ব্যাথাই টের পেত, আর  নিঃসন্দেহে কোন ক্ষত এত তাড়াতাড়ি শুকাতে পারে না এবং চাপাটির মত  অমন লেপাপোঁছাও হতে পারে না। সে মনে মনে মতলব আটতে লাগল: স্টাফ অফিসারের স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক  ভাবে মামলা ঠুকবে,  নাকি নিজেই তার বাসায় গিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে। দরজার সমস্ত ফাঁক ফোকর দিয়ে আলোর ঝলক এসে ঘরে প্রবেশ করল –  বোঝা গেল যে সামনের ঘরে ইভান ইতিমধ্যেই মোমবাতি জ্বেলেছে। ফলে মেজরের ভাবনায় ছেদ পড়ল। অচিরেই মোমবাতি আগ বাড়িয়ে ধরে সারা ঘর উজ্জল আলোয় আরোকিত করে আবির্ভাব ঘটল স্বয়ং ইভানের।  কভালিওভের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল রুমাল তুলে নিয়ে সেই জায়গাটা চাপা দেওয়া যেখানে গতকালও বিরাজ করছিল তার নাক, যাতে কর্তার এই অদ্ভুত দেখে ডাহা বোকা লোকটার মুখ হাঁ না হয়ে যায়।

ইভান তার নিজের খুপরিতে ফিরে চলে যেতে না যেতে সামনের ঘরে শোনা গেল অপরিচিত কন্ঠস্বর, কে যেন জিজ্ঞেস করল:
‘সরকারী কালেক্টর কভালিওভ এখানে থাকেন কি?’

‘ভেতরে আসুন, মেজর কভালিওভ এখানে,’ ঝট্ করে লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলতে খুলতে কভালিওভ বলল।

প্রবেশ করল এক পুলিশ কর্মচারী। চেহারাটা সুন্দর, দু’পাশের জুলপিজোড়া না একেবাওে ফেকাসে,  না গাড় রঙের, গাল বেশ ভরাট – এ হল সেই পুলিশ কর্মচারীটি,  কাহিনীর শুরুতে যাকে আমরা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম ইসাকিয়েভস্কি ব্রিজের প্রান্তে।

‘যদি কিছু মনে না করেন, আপনিই কি নাক হারিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।’

‘ওটা এখন পাওয়া গেছে।’

‘বলেন কী?’ মেজর কভালিওভ চেঁচিয়ে উঠল।  আনন্দে তার বাক্যস্ফূর্তি হল না। সে চোখ বিস্ফরিত করে তাকাল তার সম্মুখে দন্ডায়মান দারোগার দিকে – দারোগা সাহেবের ফোলাফোলা ঠোঁট আর গালের ওপর মোমবাতির কাঁপা কাঁপা উজ্জ্বল আলো নাচছিল। ‘কী ভাবে পেলেন?’

‘অদ্ভুত ঘটনাক্রমে: ওটাকে প্রায় পথেই পাকড়াও করা হল। একটা গাড়িতে চেপে বসে রিগায় চলে যাবার তাল করছিল। পাশপোর্টটা ছিল অনেক  আগের লেখা, এক সরকারী কর্মচারীর নামে। আর অদ্ভুত ব্যাপার হল এই  যে গোড়ায় আমি নিজেও ওকে কোন ভদ্রলোক বলে ভেবেছিলাম।  কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমার সঙ্গে চশমা ছিল, তাতেই না আমি তৎক্ষণাৎ দেখতে পেলাম যে ওটা হল নাক। আমার আবার দৃষ্টিটা ক্ষীণ কিনা, আপনি যদি আমার সামনাসামনি দাঁড়ান তাহলে আমি কেবল দেখতে পাব যে আপনার মুখ আছে, কিন্তু না নাক, না  দাড়ি কিছুই ঠাহর করতে পারব না।   আমার  শাশুড়ী   ঠাকুরন, মানে আমার  স্ত্রীর  মাও কিছুই দেখতে পান না।’

কভালিওভ উত্তেজনায় আত্মহারা  হয়ে পড়ল।

‘ওটা কোথায়? কোথায় আছে? আমি এক্ষুণি যাব।’

‘অধীর হবেন না। ওটা আপনার দরকার জেনেই আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আর অদ্ভুত ব্যাপার হল এই যে একাজে  নাটের গুরু হল ভজনেসেনস্কায়া স্ট্রীটের এক ঠক নাপিত, যে এখন হাজত বাস করছে। আমি বহুদিন যাবৎ মাতলামি ও চুরির জন্য তাকে সন্দেহ করছিলাম,  এই দু’দিন আগেও একটা দোকান থেকে সে এক ডজন বোতামের একটা পাতা সরিয়েছে। আপনার নাক যেমন ছিল অবিকল তেমনি আছে।’

এই বলে পুলিশ ইন্সপেক্টর পকেটে হাত গলিয়ে বার করল কাড়জে মোড়া নাক।

‘হ্যাঁ এটাই!’  কভালিওভ চে’চিয়ে বলল। ‘আরে এটাই ত। আসুন, আজ আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাবেন।’

‘খেতে পারলে পরম কৃতার্থ বোধ করতাম,কিন্তু কিছুতেই পারছি নে: আমাকে আমার এখান থেকে যেতে হবে সংশোধনাগারে।… সমস্ত জিনিসের দাম অগ্নিমূল্য হয়ে উঠেছে।… আমার বাড়িতে আমাদের সঙ্গে বাস করেন শাশুড়ী  ঠাকুরুন, মানে আমার স্ত্রীর মা, এছাড়া আছে ছেলেপুলে; বিশেষত বড়টা রীতিমত সম্ভাবনাপূর্ণ: বড় বুদ্ধিমান ছেলে, কিন্তু পড়াশোনা চালানোর কোন রকম সঙ্গতি নেই।’

ইঙ্গিতটা আাঁচ করতে পেরে কভালিওভ টেবিল থেকে একটা দশ রুবলের নোট তুলে নিয়ে ইন্সপেক্টরের হাতে গুঁজে দিল। ইন্সপেকক্টর নীচু হয়ে অভিবাদন জানিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলে, চাষাভুষো শ্রেণীর একটা বোকা লোক গাড়ি নিয়ে সোজা বুলভারে  উঠে পড়ায় তাকে সে উত্তম মধ্যম দিচ্ছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টর চলে যাবার পর কালেক্টরটি কয়েক মিনিট কেমন যেন একটা অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ডুবে রইল। অপ্রত্যাশিত আনন্দে সে  এমনই অভিভূত হয়ে পড়েছিল, যে দেখা এবং উপলব্ধি করার ক্ষমতা ফিরে পেতে  তার বেশ কয়েক মিনিট লেগে গেল। সে সন্তর্পণে দুই হাতে অঞ্জলি পেতে উদ্ধার প্রাপ্ত নাকটা রেখে  সেটাকে মনোযোগ গিয়ে আরও একবার দেখল।

‘হ্যাঁ  ঠিকই, এটাই বটে!’ মেজর কভালিওভ বলল। ‘হ্যাঁ  এই ত বাঁ দিকে সেই ফুসকুড়িটা, যেটা গতকাল উঠেছিল।’

মেজর আনন্দে প্রায় হেসেই ফেলল।

কিন্তু পৃথিবীতে কোন কিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয়, আর এই কারণেই আনন্দও পরবর্তী মুহুর্তে  প্রথম মুহুর্তের মত  গভীর থাকে না; তার ও পরের মুহুর্তে হয়ে আসে আরও ক্ষীণ এবং অবশেষে মনের সাধারণ  অবস্থার সঙ্গে অলক্ষিতে মিলেমিশে এককার হয়ে যায়   –  জলের বুকে ঢিল পড়লে যে বৃত্তাকার লহরীর সৃষ্টি হয় তা যেমন  শেষ পর্যন্ত মসৃণ জলপৃষ্ঠে মিশে যায় ঠিক তেমনি। কভালিওভ ভাবতে শুরু করল, আর তখনই তার চৈতন্য সহল যে   ব্যাপারটা এখনও মিটে যায় নি: নাক খুঁজে পাওয়া গেছে বটে, কিন্তু তাকে যে সাটতে হবে, যথাস্থানে লাগাতে হবে!

‘কিন্তু যদি আটকানো  না যায় তাহলে?’

নিজেই নিজেকে  এ প্রশ্ন করার পর মেজর ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

একটা দুর্বোধ্য আতঙ্ক এসে তার ওপর ভর করল। সে ছুটে চলে গেল টেবিলের দিকে,নাকটা যাতে কোন মতেই  বাঁকা বসানো না হয়  তার জন্য সে আয়না টেনে বার করল।  তার হাত কাঁপছিল। সে সাবধানে, হুঁশিয়ার হয়ে নাকটাকে আগেকার জায়গায় বসাল। ওঃ কী সাংঘাতিক! নাক এঁটে থাকছে না! সে ওটাকে মুখের সামনে নিয়ে এলো, মুখের সামান্য ভাপ দিয়ে একটু গরম করে নিয়ে আবার  দুই গালের মাঝখানকার সমতল  জায়গায় এনে ধরল; কিন্তু নাক কিছুতেই জায়গায় থাকছে না।

‘এই! এই! লেগে থাক আহাম্মক কোথাকার!’ সে তাকে বলল। কিন্তু নাক তখন কাঠের টুকরোর মতো, টেবিলের ওপর পড়ে এমন বিদঘুটে একটা আওয়াজ করল যেন একটা ছিপি। খিঁচুনির ফলে মেজরের মুখ বেঁকে গেল। ‘তা হলে কি ওটা জোড়া লাগবেই না?’ সে ভয় পেয়ে বলল। কিন্তু কতবারই না সে তাকে যথাস্থানে রাখতে গেল, সব চেষ্টা বৃথা।

ঐ বাড়িরই দোতলায় সবচেয়ে ভালো ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন এক ডাক্তার। ইভান কে ডেকে মেজর তাঁকে আনতে পাঠাল। এই ডাক্তারটি বিশিষ্ট চেহারার পুরুষ, তাঁর ছিল চমৎকার কালো কুচকুচে জুলফি, তাজা স্বাস্থ্যবতী ঘরনী। তিনি   সকালে টাটকা আপেল খান, রোজ সমালে  প্রায় প’য়তাল্লিশ মিনিট ধরে র্গাগল্ করেন এবং পাঁচটি বিভিন্ন ধরনের ব্রাশ দিয়ে দাত মেজে মুখের ভেতরটা অসাধারণ পরিষ্কার রাখেন। ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হলেন। কতদিন যাবৎ  দূর্ঘটনাটা ঘটেছে জিজ্ঞেস করার পর ডাক্তার চিবুক ধরে মেজর কভালিওভের মাথা ওপরে তুললেন এবং আগে যেখানে নাক ছিল ঠিক সেই জায়গাটায় বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে  এমন টুসকি মারলেন যে মেজর মাথাটা ঝাটকা মেরে  পেছনে হেলাতে বাধ্য হল,  আর তার ফলে মাথার পেছন দিকটা দেয়ালে ঢুকে গেল। চিকিৎসক বললেন যে ওটা কিছু নয়, তিনি তাকে দেয়াল থেকে খানিকটা সরে আসতে পরামর্শ দিলেন, তাকে মাথাটা প্রথমে ডান দিকে হেলাতে আজ্ঞা করলেন এবং যেখানে আগে নাক ছিল সেই জায়গা হাত দিয়ে স্পর্শ করে বললেন: হুম্! অতঃপর  তাকে আজ্ঞা করলেন বাঁ দিকে মাথা হেলাতে এবং বললেন হুম্!’ আর পরিশেষে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে  আবার এমন একটা টুসকি মারলেন যে দাঁত দেখতে গেলে ঘোড়া যেমন করে, সেই ভাবে মেজর কভালিওভ মাথা ঝাটকা দিল। এহেন পরক্ষার পর চিকিৎসক মাথা নাড়িয়ে বললেন:

‘না, সম্ভব নয়। আপনি বরং এই অবস্থায় ই থাকুন, কেননা কিছু করতে  গেলে আরও খারাপ হতে পারে। ওটাকে লাগানো যে যায় না এমন নয়; আমি হয়ত এক্ষুণি লাগিয়েও দিতাম;  কিন্তু আমি আপনাকে সত্যি করে বলছি, এতে আপনার খারাপই হবে।’

‘চমৎকার কথা! নাক ছাড়া আমার চলবে কী করে শুনি?’ কভালিওভ বলল। ‘এখন যেমন আছে  এর চেয়ে খারাপ ত আর কিছু হতে পারে না! এটা যে ছাই কী, তা একমাত্র শয়তানই জানে!  এরকম যাচ্ছেতাই  অবস্থায়  অবস্থায়  কোথায় আমি মুখ দেখাব? আমার ভাল ভাল চেনাপরিচিত লোকজন আছে; এই ত আজই দুটো বাড়ির সান্ধ্য আসরে আমার যাওয়া দরকার। অনেকের সঙ্গে  আমার আলাপ:  সরকারী পরামর্শদাতা চেখ্তারিওভের স্ত্রী, স্টাফ  অফিসারের স্ত্রী পদ্তোচিনা… যদিও  তাঁর বর্তমান আচরণের পর পুলিশের মাধ্যমে কিছু করা ছাড়া তাঁর সঙ্গে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই।  আপনার কাছে মিনতি করছি,’ কভালিওভ কাতর কণ্ঠে বলল, ‘কোন উপায় কি নেই? কোন রকমে আটকে দিল, ভাল হোক খারাপ হোক, লেগে থাকলেই হল; তেমন বিপদ দেখলে হাত দিয়ে সামান্য ঠেলে ধরে  রাখতেও আমি পারি। তাছাড়া আমি নাচিও না, সুতরাং অসাবধানবশত বেচাল গয়ে গিয়ে যে ক্ষতি করব এমন সম্ভাবনা নেই। আপনার ভিজিটের জন্য কৃতজ্ঞতার ব্যাপারে যদি বলেন তা হলে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আমার সাধ্যে যতটা কুলোয়…’

‘বিশ্বাস করুন,’ ডাক্তারের কণ্ঠস্বর উঁচু পর্দায় উঠল না, নীচেও নামল না,সম্মোহন শক্তিসম্পন্ন সুমধুর কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আমি ব্যক্তিগত লাভের জন্য কখনও চিকিৎসা করি না। এটা আমার নিয়ম এবং শাস্ত্রকলার বিরোধী।  ভিজিটের জন্য ফি আমি অবশ্যই নেই, কিন্তু তার একমাত্র কারণ এই যে না নিলে লোকে মনে দুঃখ্য পাবে। আপনার নাক আমি অবশ্যই লাগিয়ে দিতে পারতাম; কিন্তু হলফ করে  বলছি, আপনি যদি নেহাৎই আমার কথা বিশ্বাস না করেন,এর ফল অনেক বেশি খারাপ হবে। বরং প্রকৃতির নিজের কার্যকলাপের ওপর ছেড়ে দেন। ঘন ঘন ঠান্ডা জলে মুখ ধোন, আমি আপনাকে আশ্বাস দিতে পারি নাক থাকলে  আপনি যেমন সুস্থ থাকতেন, না থাকলেও ততটা থাকবেন। আর নাকটা, আমার পরামর্শ যদি শোনেন, স্পিরিট দিয়ে  একটা বয়ামের ভিতর রেখে দিন, কিংবা আরও ভালো হয় যদি তার সঙ্গে যোগ করেন  বড় চামচের দু চামচ  ঝাল ভদকা ও ঈষদুষ্ণ ভিনিগার – তা হলে ঐটার বদলে আপনি ভাল দাম পেতে পারেন।  এমন কি আমি নিজেই নিতে পারি – যদি আপনার দাম তেমন চড়া  না হয়।’

‘না, না! কোন দামেই বিক্রি করব না!’ মেজর কভালিওভ মরিয়া কণ্ঠে চে’চিয়ে বলল,‘ ওটা নষ্ট হয়ে যাক তাও সই!’

‘মাফ করবেন!, জবাবে ডাক্তার বললেন, ‘আমি আপনার উপকারে  আসতে চেয়েছিলাম।… তা কী আর করা যাবে। আমার চেষ্টার  কোন ত্রুটি ছিল না, এটা তো অন্তত আপনি দেখেছেন।’

এই বলে ডাক্তার গুরুগম্ভীর চালে ঘড় থেকে বেড়িয়ে গেলেন। কভালিওভ তাঁর মুখের দিকে পর্যন্ত তাকাল না, কেবল  গভীর নিরাসক্ত দৃষ্টিতে  দেখতে পেল ডাক্তারের কালো টেইল- কোটের হাতার ফাঁক থেকে উকি মারছে শার্টের তুষারধবল ও পরিচ্ছন্ন  হাতার অগ্রভাগ।

পর দিনই সে ঠিক করল অভিযোগ দায়ের করার আগে স্টাফ অফিসারের পত্নীকে একটা চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করবে তার হক জিনিস তিনি তাকে বিনা যুদ্ধে ফিরিয়ে দিতে রাজি আছেন কিনা। চিঠিটার বয়ান ছিল এই:

‘প্রিয় মহাশয়া
আলেক্সান্দ্রা গ্রিগরিয়েভনা,

আপনার অদ্ভুত আচরণের কারণ আমার বোধগম্য নহে। আপনি এই বিষয়ে নিশ্চিত থাকিতে পারেন যে এবংবিধ আচরণের  ফলে আপনার লাভের কোন সম্ভাবনা  নাই এবং কোন মতেই আপনি আপনার কন্যার পাণিগ্রহণে আমাকে বাধ্য করিতে পারিবেন না। বিশ্বাস করুন,  আমার নাসিকা সংক্রান্ত ঘটনা আমি সম্পূর্ণে অবগত আছি এবং ইহাও নিশ্চিত জানি যে উক্ত কর্মে  মূলত সংশ্লিষ্ট রহিয়াছেন আপনি – আপনি ব্যতীত অপর কেহ নহে। উহার আকস্মিক স্থানচ্যুতি, পলায়ন ও ছদ্মবেশ ধারণ – কখন ও সরকারী কর্মচারীর বেশ ধারন,অবশেষে নিজ  মূর্তি ধারণ আপনার, কিংবা আপনার তুল্য যাঁহারা  মহৎ কর্মে লিপ্ত রহিয়াছেন, তাঁহাদিগের মন্ত্রের প্রভাব ব্যতিরেকে অন্য কিছু নহে। আমার পক্ষ হইতে আমি এই মর্মে আপনাকে পূর্বাহ্নে অবগত করা প্রয়োজন বলে বিবেচনা করি যে আমার উল্লিখিত নাসিকা যদি অদ্যই যথাস্থানে প্রত্যাবর্তিত না হয় তাহা হইলে আমি  আইনের রক্ষণাবেক্ষণ ও পৃষ্ঠপোষকতার আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হইব।

এতদসত্ত্বেও, আপনাকে পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিয়া কৃতার্থ বোধ করিতেছি।

ভবদীয় সেবক
প্লাতন কভালিওভ।’

‘প্রিয় মহাশয়
প্লাতন কুজমিচ,

‘আপনার পত্র প্রাপ্ত হইয়া সাতিশয় আশ্চর্য বোধ করিলাম। আমি অকপটে স্বীকার করিতেছি যে এবংবিধ অন্যায় ভর্ৎসনা  কোন মতেই প্রত্যাশা করি নাই –  আপনার নিকট হইতে ত অবশ্যই নহে। আপনার অবগতির জন্য জ্ঞাপন করিতেছি যে-সরকারী কর্মচারীর উল্লেখ আপনি করিয়াছেন তাহাকে আমি কদাচ স্বগৃহে অভ্যর্থনা জানাই নাই – ছদ্মবেশে নহে, স্বমূর্তিতেও নহে। সত্য বটে, ফিলিপ ইভানভিচ পতানচিকভ আমার গৃহে  আসিতেন। আর যদিচ তিনি যথার্থই আমার কন্যার পাণিপ্রার্থনা করিয়াছিলেন এবং যদিচ তিনি সুপাত্র, আচরণে  সংযত  ও পরম বিদ্মান, তথাপি আমি তাহাকে কদাচ কোন রূপে আশা-ভরসা প্রদান করি নাই।  আপনি নাসিকার প্রসঙ্গও উল্লেখ করিয়াছেন । এতদ্বারা আপনি যদি এমত  বলিতে  চাহেন যে আমি আপনার প্রতি উন্নাসিকতা প্রকাশ করিতেছি অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক ভাবে আপনাকে প্রত্যাক্ষান করিতেছি,  তাহা হইলে আমি এই ভাবিয়া বিস্মিত না হইয়া  পারি না যে আপনি নিজেই  এই সম্পর্কে বলিতেছেন,  যখন আমি – আপনার অবিদিত নই  –  সম্পূর্ণ ইহার বিপরীত মত পোষণ করি; অপিচ এক্ষণে যদি আইনমতে আপনি আমার কন্যার  পাণিপ্রার্থনা করেন তাহা হইলে  আমি এই মুহুর্তে আপনার  তুষ্টি বিধানে  প্রস্তুত, যেহেতু ইহা চিরকালই আমার একান্ত কাম্য ছিল এবং উক্ত ভরসায় আমি সর্বদা আপনার সেবায় প্রস্তুত আছি।

– আলেক্সান্দ্রা পদতোচিনা।

‘না,’ কভালিওভ চিঠি পড়ার পর বলল। ‘ঠিকই ভদ্রমহিলার কোন দাষ নেই। তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না! যে-লাক কোন অপরাধে দোষী তার পক্ষে এমন চিঠি  লেখা সম্ভব নয়!’ সরকারী কালেক্টরের  এটা জানা ছিল,   কেননা ককেশাস অঞ্চলে থাকার সময় কয়েক বার তাকে  তদন্তে যেতে হয়। ‘কী ভাবে, কোন্ ফেরে  এমন ঘটনা ঘটল ? কী জানি ছাই!’ শেষকালে  সে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল।

ইতিমধ্যে এই অসাধারণ ঘটনা সম্পর্কে  শহরময় গুজব রাষ্ট্র হয়ে গেছে এবং সচরাচর যা হয়ে থাকে – বেশ খানিকটা রং ফলিয়ে।  সেই সময় অসাধারণত্বের প্রতি সকলের বিশেষ  প্রবণতা ছিল: এর মাত্র কিছুদিন আগে জনসাধারণ সম্মোহন শক্তির প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে ছিল। পরন্তু কনিউশেন্নায়া স্ট্রীটের  নাচিয়ে চেয়ারের ধটনা তখনও পুরনো হয়ে যায় নি, তাই শিগগিরই  লোকে যখন বলতে শুরু করল যে সরকারী কালেক্টর কভালিওভের নাক কাঁটায় কাঁটায় তিনটের সময় নেভ্স্কি এভিনিউতে নিয়মিত ঘুরে বেড়ায় তাকে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না। প্রতি দিন য়ুঙ্কারের দোকানে আছে – অমনি য়ুঙ্কারের  দোকানের সামনে এমন ভিড় জমে গেল যে পুলিশের হস্তক্ষেপ  দরকার হয়ে পড়ল।  থিয়েটারের প্রবেশপথের সামনে নানা ধরনের শুকনা মিঠাইয়ের জনৈক বিক্রেতা – ভদ্র চেহারার জুলফীধারী ফটকাবাজ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে মজবুত গোছের, চমৎকার কয়েকটা কাঠের বেঞ্চি বানিয়ে কৌতুহলী লোকজনকে  সেগুলির ওপর দাড়ানোর আমন্ত্রণ জানালো – এক এক জন দর্শকের কাছে থেকে আসি কোপেক করে নিতে লাগল।  কোন এক মান্যগন্য কর্ণেল এর জন্য বিশেষ করে  বাড়ি থেকে আগে আগে বের হলেন এবং অতি কষ্টে ভিড়ের মধ্যে পথ করে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন; কিন্তু তিনি দারুণ বিরক্ত  হয়ে গেলেন যখন দোকানের শো কেস্-এ নাকের বদলে দেখতে পেলেন  সাধারণ পশমী গেঞ্জি এবং একটা ছাপানো ছবি, যাতে দেখা যাচ্ছে দেখা যাচ্ছে একটা মেয়ে তার পায়ের স্টকিং ঠিক করছে, আর গাছের আড়াল থেকে খোলা ওয়েস্ট কোট পরনে, ছাগল দাড়িওয়ালা এক ফুলবাবু তার দিকে তাকিয়ে আছে – আজ দশ বছরেরও বেশি কাল হল ঐ একই জায়গায় ঝুলছে ছবিটা। সরে এসে তিনি আক্ষেপ করে বললেন:

‘এরকম অর্থহীন, অবিশ্বাস্য গুজব ছড়িয়ে লোকজনকে বিভ্রান্ত করার কোন মানে হয়?’

তারপর আরও একটি গুজব রটল এই মর্মে যে নেভস্কি এভিনিউতে  নয়, তাভ্রিচেস্কি বাগানে ঘুড়ে বেড়ায় মেজর কভালিওভের নাক – বহু দিন হল নাকি সে ওখানে;  আর খোজরেভ মির্জা  যখন ওখানে বাস করতেন তখন নাকি  তিনি প্রকৃতির এই অদ্ভুত লীলাখেলা দেখে দারুণ অবাক হয়ে যান। সার্জিক্যাল একাডেমির  কিছু  ছাত্র সেখানে রওনা দেয়। সম্ভ্রান্ত বংশের  কোন এক শ্রদ্ধেয়া  মহিলা বিশেষ পত্রযোগে বাগানের ওয়ার্ডেনকে তাঁর ছেলেমেয়েদের এই দুর্লভ দৃশ্য দর্শনের সুযোগ দানের এবং সম্ভব হলে কিশোর-কিশোরীদের  পক্ষে শিক্ষাপ্রদ ও উপদেশাত্বক ভাষ্য দানের অনুরোধ জানান।

শৌখিন সমাজের যত লোকজন, যারা বড় বড়  সান্ধ্য আসরে নিয়মিত যাতায়াত করত, মহিলাদের হাসাতে ভালোবাসতো , তারা এই ঘটনায় পরম পুলকিত হল,  কেন না তাদের রশদ ইতিমধ্যে একেবারেই ফুরিয়ে এসেছিল। মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক  শ্রদ্ধাভাজন ও সংযত লোকজন রীতিমতো অসন্তুষ্ট  হলেন। এক ভদ্রলোক বিরক্তির সঙ্গে বললেন, কী করে  বর্তমান এই আলোকপ্রাপ্ত  যুগে এমন উদ্ভট কল্পনা ছড়াতে পারে এটা তাঁর পক্ষে বোধগম্য নয়, আর সরকারই বা কেন এদিকে মনোযোগ  দিচ্ছেন না তা ভেবে  তিনি বিস্মিত। ভদ্রলোকটি  স্পষ্টতই  সেই জাতের ভদ্রমন্ডলীর একজন যাঁরা সমস্ত ব্যাপারে, এমন কি  তাঁদের  স্ত্রীদের সঙ্গে প্রাত্যহিক ঝগড়াঝাপির ক্ষেত্রেও, সরকারকে জড়িত করতে কুণ্ঠিত হন না। অতঃপর… কিন্তু এখানে সমগ্র ঘটনা  আবার ঢাকা পড়ে যায় কুয়াসায়,এবং অতঃপর কী যে ঘটল তা সম্পূর্ণে অজ্ঞাত।

 

[youtube id=”YVZleGmQ4Os”]

 


দুনিয়ায় আজেবাজে অনেক কান্ডকারখানা ঘটে। কখনও কখনও  কোন কার্যকারণ সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না:  সরকারী পরামর্শদাতার পদে অধিষ্ঠিত হয়ে যে নাক এখানে ওখানে ভ্রমণ করছিল এবং শহরে  এত বড়  সোরগোল তুলেছিল, সেই নাকই একদিন হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই আবার ফিরে  এলো যথাস্থানে, অর্থাৎ মেজর কভালিওভের  দুই গালের ঠিক মাঝখানটায়। ঘটনাটি ঘটল এপ্রিল মাসের সাত তারিখে। ঘুম ভাঙার পর দৈবক্রমে আয়নায় দৃষ্টি পড়তে  সে দেখতে পেল – নাক!  হাত দিয়ে চেপে ধরল – নাকই বটে! ‘হে’ ‘হে’ !’  কভালিওভ বলল এবং আনন্দে সে খালি পায়ে গোটা ঘড় জুড়ে  প্রায় এক পাক কসাক ত্রোপাক নাচ নেচেই ফেলেছিল, কিন্তু ইভানের আগমনে  ব্যাঘাত ঘটল। মেজর তৎক্ষণাৎ হাতমুখ ধোয়ার সরঞ্জাম দিতে বলল, হাতমুখ  ধোয়ার পর সে আরও একবার আয়নার দিকে তাকাল: নাক! তোয়ালে  দিয়ে মুখ মুছে সে আবার তাকাল আয়নার দিকে: যথার্থই নাক!

“ইভান দ্যাখ দেখি, আমার নাকের ওপর যেন একটা ফুসকুড়ি উঠেছে,’ কথাটা বলেই সে মনে মনে ভাবতে লাগল :

‘সর্বনাশ, ইভান যদি বলে বসে: ‘না কর্তা,  ফুসকুড়ি কোথায়, নাকই ত নেই দেখছি!’’
কিন্তু ইভান বলল:

‘কিছু নেই, কোন ফুসকুড়ি-টুসকুড়ি নেই  – নাক পরিষ্কার!’

‘ভালো কথা, জাহান্নামে যাক!’  মনে মনে এই কথা বলে মেজর  তুড়ি মারল। এই সময়  দরজায় উঁকি মারল নাপিত ইভান ইয়াকভেলভিচ,  কিন্তু এত ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে,  যেন একটা বিড়াল মাংসের খন্ড চুরি করার অপরাধে এই মাত্র উত্তম মধ্যম খেয়েছে।

‘আগে বল্  দেখি হাত পরিষ্কার আছে ত?’ দূর থেকেই  কভালিওভ ওর উদ্দেশ্যে তর্জন করে বলল।

‘আছে।’

‘মিথ্যে কথা।’

‘ভগবানের দিব্যি, পরিষ্কার আছে কর্তা।’

‘থাকলেই ভালো, দেখিস কিন্তু!’

কভালিওভ বসল। ইভান ইয়াকভেলভিচ একটা তোয়ালে দিয়ে তাকে জড়াল, চোখের  পলকে  ব্রাশের সাহায্যে তার পুরো দাড়ি  এবং গালের একটা অংশ এমন ফেটানো ক্রীমের পুঞ্জে পরিণত করে ফেলল, যা পরিবেশিত হয়ে থাকে ব্যাবসায়ীদের  বাড়ির জন্মদিনের পার্টিতে।

‘বোঝ কান্ড!’ নাকটার দিকে তাকিয়ে ইভান ইয়াকভেলভিচ মনে মনে বলল, তারপর মাথা অন্য দিকে কাত করে একপাশ থেকে সেটাকে দেখল। ‘দেখ দেখি! ভাবাই যায় না!’ মনে মনে বলতে বলতে সে অনেকক্ষণ ধরে  নাক দেখতে লাগল। অবশেষে নাকের ডগা ধরার উদ্দেশ্যে  সে এত সন্তর্পণে ও আলতো করে দুটো আঙ্গুল সামান্য  ওঠাল যে তা কল্পনাই করা যায় না। এটাই ছিল ইভান ইয়াকলেলভিচের  অভ্যস্ত রীতি।

‘দেখিস, দখিস, সাবধান!’ কভালিওভ চে’চিয়ে বলল।

এই কথায় ইভান ইয়াকভেলভিচ থমতম খেয়ে,  স্তম্ভিত হয়ে হাত নামিয়ে ফেলল, জীবনে আর কখনও এমন স্তম্ভিত সে হয় নি। শেষ পর্যন্ত সে সন্তর্পণে ক্ষুর দিয়ে মেজরের চিবুকে সুড়সুড়ি দিতে লাগল; ঘ্রাণেন্দ্রিয় না ধরে  দাড়ি কামাতে যদিও তার পক্ষে রীতিমতো  অসুবিধাজনক ও কঠিন ঠেকছিল তথাপি সে কোন রকমে তার খসখস বুড়ো আঙ্গুল মেজরের  গালে ও নীচের মাড়িতে ঠেকিয়ে  সমস্ত বাধা বিঘ্ন কাটিয়ে উঠে শেষ পর্যন্ত  দাড়ি কামানো  সারল।

সব হয়ে যেতে  কভালিওভ তঃক্ষণাৎ তাড়াহুড়ো করে  জামাকাপড় পড়ে নিল,  একটা ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে সোজা চলল মিঠাইয়ের দোকানে। প্রবেশ করতে করতে সে দূর থেকে হাঁক দিয়ে বলল: ‘বয়, এক কাপ চকলেট!’ আর নিজে সেই মুহুর্তে  এগিয়ে গেল আয়নার দিকে:  নাক আছে বটে! সে খুশি হয়ে পেছনে ফিরল, চোখ সামান্য কু’চকে বিদ্রুপের  দৃষ্টিতে তাকাল দু’জন  সামরিক অফিসারের দিকে, যাদের এক জনের নাক ওয়েস্ট কোটের বোতামের চেয়ে কোন অংশে বড় ছিল না। এর পর সে রওনা দিল কোন এক ডিপার্টমেন্টের অফিসে যেখানে  সে চেষ্টা-চরিত্র করছিল ছোট লাটের পদ লাভের – আর নেহাৎই না জুটলে যাতে কোন প্রশাসনিক পদ পাওয়া যায়, তার জন্য। রিসেপশন-রুমের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সে আয়নার দিকে দৃষ্টিপাত করল: নাক যথাস্থানে আছে! অতঃপর সে গেল আরেকজন কালেক্টর বা মেজরের কাছে –  খুব রসিক লোক, তার নানা ধরনের খোঁচামারা  মন্তব্যের  জবাবে কভালিওভ প্রায়ই বলত : ‘হু’  তোমাকে আর চিনি নে? হুল ফোটাতে ওস্তাদ!’ পথে সে ভাবল: ‘মেজরও যদি আমাকে দেখে হাসিতে ফেটে না পড়ে তা হলে এ  বিষয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকবে না যে যা যা থাকার ঠিক আছে, যথাস্থানে আছে।’ কিন্তু কালেক্টরটির প্রতিক্রিয়া দেখা দিল না। ‘ভালো, ভালো, মরুক গে ছাই!’ কভালিওভ মনে মনে ভাবল। পথে স্টাফ অফিসারের পদতোচিনের  স্ত্রী আর কন্যার সাথে তার দেখা হয়ে গেল, সে তাদের  উদ্দেশ্যে নীচু হয়ে অভিবাদন জানাল, তার দেখা পেয়ে তারা উল্লসিত হয়ে চেঁচাল: তার মানে, কিছুই ঘটে নি, কোন ক্ষয়ক্ষতি তার হয় নি। সে সুদীর্ঘ সময় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলল এবং ইচ্ছে করেই নস্যিদানি বার করে তাদের সামনে বেস দীর্ঘ সময় নিয়ে নাকের  দুটো প্রবেশ পথেই নস্যি ঠাসতে ঠাসতে মনে মনে বলল ‘তোমাদের, এই মেয়ে জাতটার এমনই হওয়া উচিত! মুরগীর জাত কোথাকার!  যাই বল না কেন, তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি না। হ্যাঁ নেহাৎ যদি par amour ii হত  তাহলে না হয় কথা ছিল!’ এর পর থেকে মেজর কভালিওভ নেভস্কি এভিনিউতে, থিয়েটারে সর্বত্র পরম নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আর নাকও পরম নিশ্চিন্তে বসে রইল তার মুখের ওপর, এমন কি কোনকালে যে স্থানচ্যুত হয়েছিল তেমন লক্ষণ পর্যন্ত দেখা গেল না। আর এর পর কভালিওভকে  সর্বক্ষণ দেখা যেত খোশ মেজাজে, তার মুখে হাসি লেগে থাকত। সে সোৎসাহে সমস্ত সুন্দরী মহিলার পিছু নিত, এমন কি একবার সে শহরের বাজার পাড়ায় এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে পদক ঝোলানের একটা ফিতেও কেনে, যদিও কারণটা ছিল অজ্ঞাত, কেন না সে নিজে কোন পদকের অধিকারী ছিল না।

এমনই ঘটনা ঘটেছিল আমাদের এই সুবিশাল দেশের উত্তরের মহানগরীতে! কেবল এখনই সমস্ত ব্যাপারটা মনে মনে চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই যে তার মধ্যে অনেক কিছু অবিশ্বাস্য আছে! দস্তুরমতো অদ্ভুত, অতিপ্রাকৃত উপায়ে নাকের স্থানচ্যুতি এবং সরকারী পরামর্শদাতার বেশে বিভিন্ন স্থানে নাকের আবির্ভাবের কথা যদি ছেড়েও  দিই, এ জিনিসটা কভালিওভ কেন বুঝতে পারল না যে সংবাদপত্রের মাধ্যমে নাক সম্পর্কে ঘোষনা করা সঙ্গত নয়?  আমি এখানে  এই অর্থে বলছি  না যে বিজ্ঞাপনের পেছনে  অর্থ ব্যায় আমার কাছে বাহুল্য মনে হয়েছে:  এটা নেহাৎই বাজে কথা, আমি আদৌ অর্থগৃধাু শ্রেণীর লোক নই। কিন্তু ব্যাপারটা অশোভন, অসঙ্গত, ভালো নয়! তা ছাড়া আরও একটা কথা –  নাক কী করে সদ্য সে’কা রুটির ভেতরে এলো,  আর খোদ ইভান ইয়াকভেলকভিচের  বা কী হল?.. না, এটা  আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না, একেবারেই না! কিন্তু আরও অদ্ভুত,  সবচেয়ে দুর্বোধ্য ব্যাপার হল এই যে লেখকরা কী করে এমন বিষয়বস্তু গ্রহণ করেন! স্বীকার করতে বাধা নেইা,  এটা  সম্পূর্ণ জ্ঞানবুদ্ধির অতীত, এটা আসলে … না, না, আমি মোটে বুঝে উঠতে পারছি না। প্রথমত, এতে স্বদেশের বিন্দুমাত্র উপকার নেই; আর দ্বিতীয়ত… হ্যাঁ, দ্বিতীয়তও কোন উপকার দেখি না। সোজা কথা, আমি জানি না এটা কী।…

সে যাই হোক না কেন, এসব সত্ত্বেও, যদিও  এটা ওটা এবং আরও কিছু অবশ্যই ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে, এমন কি হয়ত বা… আর সত্যিই ত, সামঞ্জস্যহীন কান্ডকারখানা কোথায়ই বা না ঘটে?.. কিন্তু এসব সত্ত্বেও, একটু ভেবেচিন্তে দেখলে, এই সমস্তটার মধ্যে কিছু একটা আছে, অবশ্যই  আছে। যে যাই বলুন না কেন, এ ধরনেরে ঘটনা পৃথিবীতে ঘটে –  ক্বচিৎ, তবে ঘটে।

___________________

*নিকোলাই গোগল (১৮০৯ – ১৮৫২) এই গল্পটা লেখেন ১৮৩৫-৩৬ সালে। রুশ ভাষা থিকা বাংলায় অনুবাদ করছেন অরুণ সোম। রাদুগা প্রকাশন থিকা ছাপা হইছিল ১৯৮৬ সালে।

 

The following two tabs change content below.

বাছবিচার

এডিটর, বাছবিচার।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →