প্রলয়ঙ্করী ষষ্ঠী।। জগদীশ গুপ্ত
গ্যাংগস অফ ওয়াসিপুররে আমরা গডফাদার-এর ইন্ডিয়ান আর্টিকুলেশন বইলা ভাবতে পারলেও প্রলয়ঙ্করী ষষ্ঠী’রে ট্রয়ের ঘটনার বেঙ্গলি অ্যাডাপশন বইলা যে প্রায় ভাবতেই পারি না এর কারণ মে বি খালি একটা টাইম গ্যাপ না, বরং আমরা যেইভাবে আর্ট-কালচারের এক্সচেইঞ্জরে ভাবতে পারি সেইখানে এই সিমিলারিটিগুলি একটা ফ্রেমের মধ্যে দিয়াই অপারেট করে যে, যিনি বিশ্বকবি তিনি আইরিশ সং থিকা নিতে পারবেন কিন্তু যিনি লোকাল ছোটগল্প রাইটার তিনি মহাভারত, রামায়ণ জানতে পারেন কিন্তু গ্রীক লিটারেচার তক যাইতে পারবেন না বা গেলেও উনার ইনফিরিয়রিটি (যেইটা উনার থাকুক বা না-থাকুক, আমাদের এক্সপেক্টশন যে থাকতেই হবে) থিকাই লিখতে পারাটা দরকার যে, ‘বিদেশী গল্পের অনুকরণে’; যেমনে ফোক লিটারেচারে ‘লেখক’ বইলা ইন্ডিভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি’রে আমরা (আরবান মিডল ক্লাশ এবং বাংলা-সাহিত্যের রিডার) বাতিল কইরা দিতে পারি। মানে, এইসবকিছু আছে এইখানে, এই গল্পের রিডিংটাতে।
ট্রয়ের কাহিনিতে হেলেন তো ডেফিনেটলি ‘ভালোবাসেন’ প্যারিসরে, তার লগে পালাইয়া আসেন। আর এইখানে যে হেলেন, তার কোন নাম-ই নাই (বা একটা নাম দিয়াই তারে মানুষের মর্যাদা দিতে পারার ঘটনাটা নাই), তিনি জসিমের বউ। প্যারিস সদু খাঁ হইতেছেন ব্যবসায়ী, বোন ডাইকা তারে বাড়িতে নিয়া আসেন অ্যান্ড তারপরের ঘটনা খুবই গোপন, অলমোস্ট ইনভিজিবল টাইপের ব্যাপার (মায়া-টায়া যেমনে রিভিল করা যায়, এইরকম), কিছু অনুমান করা যায় খালি। এইটা ভাবতে পারাটা খুবই পসিবল যে, জসিমের বউ সদু খাঁ’র প্রেমে পইড়াই জামাইয়ের বাড়িতে ফিরতে চান না (মানে, প্রেমে ত বিশ্বাস রাখতে হবে আপনারে); আর প্রেমে না পড়লেও উনি যদি ফিরতেই চাইতেন জসিমের বাড়িতে, তাইলে ঘটনাটা কি রকম হইতে পারতো সেইটাও ইমাজিন করাটা তো ইম্পসিবল না। মানে, জসিমের বউ-এর কোন নাম না থাকলেও, উনি হেলেন না হইলেও শেষে যে ডিসিশান নিতে পারেন; খুবই অবাক করার মতো ব্যাপার একটা!
আবার, রিলিজিয়াস পারসপেক্টিভে দেখতে গেলে, ‘বাটপার’ মুসলমানের কাছ থিকা নিজের ‘নিরীহ’ বউরে উদ্ধার করার লাইগা ‘গরিব’ মুসলমানের ‘সৎ’ হিন্দু যোদ্ধাদের হেল্প নিয়া ‘ধর্ম’ উদ্ধারে নামার ঘটনা হিসাবে এইটা পড়তে সমস্যাই হওয়ার কথা; কারণ হিন্দু-লেখকের অসাম্প্রদায়িক মুসলমান ক্রিয়েট করার কোন এজেন্ডা এইখানে নাই। সোসাইটিতে (মানে গল্পটাতে) মানুষজন আছে মোস্টলি কোনরকম হিন্দু-মুসলমান কনশাসনেস ছাড়াই; কি রকমের অসভ্য , বর্বর এঁরা।
– ই.হা.।
মাইয়াটা মে বি বুইঝা ফেলছিলেন ইগো আর পীরিতের তফাত, বা অসতী বউ ভাবনার চাপে কতটা মরতে পারে পীরিত; মানে, ছিনাইয়া লওয়া বউরে ফেরত আনতে পারার পরে সেই বউরে আর কতটা দরকার! যতটা ধুইলে এই অসতী বউ’র মাই আর ভোদায় লাইগা থাকা সদু খাঁর জিভের রস, আঙুলের দাগ উইঠা যাবে ততটা ধোয়া কি পসিবল, ততটা মোক্ষম পানি আছে জগতে! সো, ডরাইতে কি পারে না সে? সো, জসিমে পীরিত মনে লইয়াও তো জসিমে না ফিরতেই পারে সে! বা ধনী সদু’র বাড়ির লাইফস্টাইল অদরকারি কইরা তুলছিলো নাকি জসিম বা সদু’র পীরিত! হায়, এমন সাইকো এনালিসিস তো আমরা পাইতেই পারতাম এখনকার ঢাকাই আর কোলকাতাই স্টোরি রাইটারদের তলে ঘাপটি মাইরা থাকা মনগুলির কোন একটা যদি জগদীশে ইনজেক্ট করা যাইতো! বা শেষের কবিতার রাইটারের পাতলা সাইকি-লোটা আর দরিয়ার পানির কম্প্যারিজন করা নোবেল মন! হায়, মরা জগদীশের ভেইন কি আর ইনজেক্টেবল…!
– রক মনু।
_________________________
চোখ দুটা তার গোল আর লাল; আড়ে দীঘে সে প্রকাণ্ড;কিন্তু আকার আর চেহারার চেয়ে ভয়ঙ্কর তার কথা।
সদু খাঁ কথা কয় খুব আস্তে আস্তে, চাপা গলায় ; তার কথায় আর চেহারায় এমনি গরমিল যে তাহার কথা শুনিলেই ধাঁ করিয়া মনে হয়, – আগুন ধোঁয়াইতেছে।
বাস্তবিক কথাগুলো তার ধোঁয়ার মতই-যেন হালকা ; কিন্তু ভিতর হইতে কখন যে আগুনের জিব বাহির হইয়া আসিবে তাহারই দিশা না পাইয়া লোকে তাহার সামনে একেবারে কুঁচকিয়া যায়। যে কয়জন পেয়ারের মানুষ তার আছে, সদুর লোক বলিয়া তাহাদের দাপটও কম নয়, অথচ তাহারাই আবার তার সামনে শীতের ব্যাঙের মতো গুটাইয়া থাকে। …
[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
সদু খাঁ আগে গাঁওয়াল করিত-
মানে, কোমরের ঘুনসী, তামার তাবিজ, সুতোর গুলি, সুচ, টিনের আয়না, চিরুনি, কাঠের কৌটা, খেলনা-এইসব মনিহারী জিনিস মাথায় করিয়া গাঁয়ে গাঁয়ে ফেরি করিয়া বেড়াইত।…
তারপর সে শুরু করিল ফড়ের কাজ-
পাট, তিসি, সর্ষে, রাই, ধান, ধনে, গম, তিল, কলাই-এইসব যখনকার যা ফসল, গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরিয়া দশ বিশ সের সংগ্রহ করিয়া আড়তে আনিয়া দিত। …
তারপর হইলসে ব্যাপারী-
মানে মহাজনের নৌকা পাট কি ধান বোঝাই হইয়া যায় মোকামে, সদু খাঁ সেই নৌকার আর মালের ভার লইয়া কর্তা হইয়া নৌকায় যাওয়া-আসা করে। …
অতঃপর হাজার-মণে এক পালোয়ারী নৌকা কিনিয়া সে নিজেই মহাজন হইয়া গদিতে বসিল। …
পয়মন্ত লোক, দেখিতে দেখিতে পড়তা ফিরিয়া গেল। অনর্গল পয়সা হাতে আসিতে লাগিল।
কিন্তু লোকটার বজ্জাতি গেল না।
… সে হাটে যায়, বাজারের সেরা মাছটার চোয়াল ধরিয়া তুলিয়া অনর্থক জিজ্ঞাসা করে,-কত?
জেলে বলে,-আড়াই টাকা।
সদু বলে, আড়াই টাকা? বেশ সস্তা তো! বলিয়া চাকরের হাতে মাছটা দেয়।
-বিদেশী যদি কেহ সেখানে থাকে, সে ভাবে, বুঝি সত্যই সস্তা সদুর কাছে ; কিন্তু যে চেনে সদুকে সে মনে মনে হাসে; জেলে কাঁপিয়া ওঠে। …
সদু যাবার বেলা আটগন্ডা পয়সা জেলের চুপড়ির ভিতর ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যায়। যথা-লাভ মনে করিয়া জেলে তা-ই ট্যাঁকে রাখে।
সুদখোর নিধিরাম দত্তর ঘরে সেদিন আগুন লাগিয়ে গেল।
এমন প্রায়ই হয়।
গ্রামের ছোটখাটোর মধ্যে এ-ও একটা ব্যবসা।
দেশলাইয়ের কাঠিটা জ্বালিয়া চালের উপর ফেলিয়া দিলে, আগুন লাগুক আর না লাগুক,-তার দাম এক টাকা।
খড়ের ভিতর জ্বলন্ত টিকে গুঁজিয়া দিলে-তিন টাকা।
ঘরের চার কোণেই আগুন দিলে-পাঁচ টাকা।
ঘরের ভিতরকার মানুষ বাহির হইতে না পারে এমনি করিয়া বাহির হইতে দরজা বন্ধছন্দ করিয়া আগুন দিলে-দশ টাকা।
সদু খাঁ ছিল এইসবের সর্দার।
কিন্তু ইতিমধ্যেই মস্ত ব্যবসাত বলিয়া চারিদিকে নাম পড়িয়া গেছে।
নৌকা হইয়াছে তিনখানা। ওদিকে ঢাকা, ওদিকে রাজমহল, ওদিকে কলকাতা পর্যন্ত তার মাল খরিদ-বিক্রি হয়।
দোতালা দালানও উঠিয়াছে, বিশটা কুঠুরি তার। বৈঠকখানা, ফরাস, তাকিয়া, গড়গড়া, ফুরসী, অম্বুরি তামাক, পিতলের বদনা-সবই হইয়াছে। দাসী, বাঁদী, খানসামা,-তাও দশ বিশটার কম নয়। বিবিও জুটিয়াছে-গোঁটা পাঁচেক-সোয়া গন্ডা।
বিবিদের মহাল সব আলাদা আলাদা। এক এক বিবির খাসে দুই দুই বাঁদী।
দাসী বাঁদী বিবি-সকলের গর্ভেই ছেলেমেয়ে জন্মগ্রহণ করিতেছে। … তিন-চার বছরেই সদু খাঁর অত বড় বাড়ি নোংরামিতে আর গোলমালে জংলা পায়রার আড্ডাকেও ডিঙ্গাইয়া গেছে।
নৌকার খেপে খেপে সদু টাকা ঘরে আনে চার পাঁচ হাজার; কিন্তু একটি অভ্যাস সে কোনদিন ছাড়ে নাই।একখানা না একখানা নৌকায় সে প্রতিবারে যায়ই; একবার এখানা, একবার ওখানা, এইরকম করিয়া তিনখানাতেই সে পালাপালি করিয়া বেড়ায়; সঙ্গে থাকে গোটা দুই দাসী, বাঁদী, আর তার কয়েল চৈতন্য। চৈতন্যের মতো অমনধারা ভয়ঙ্কর পাকা লোক সহজে চোখে পড়ে না; ফি দাঁড়ির ঝুলে দেড় সের পর্যন্ত সে চুরি করতে পারে, এমনি তার সাফাই হাত!-
কালিগঞ্জের বাজারের ঘাটে সদু খাঁর নৌকা গেরাপি করা আছে। পাটের গাঁট নামিয়া ঘাটেই কমানে ওজন হইয়া মহাজনের গুদামে উঠিয়া যাইতেছে।
বাজারের ঘাটের খানিকটা উত্তরেই স্নানের ঘাট। …
নৌকার ছইয়ের উপর বসিয়া ছাতি মাথায় দিয়া মালের নামা-ওঠা দেখিতে দেখিতে সেই স্নানের ঘাটের দিকে হঠাৎ চাহিয়া সদুর মনে হইল- বাঃ, বেশ বৌটি তো!
বিশ-বাইশ বছরের একটি বৌ জল লইতে আসিয়া ঘোমটা একটু তুলিয়া সদুরই পাটের গাঁট ওজন করা দেখিতেছিল। …
রাঁধাবাড়ার জন্য সঙ্গে যে বাঁদী দুটি আসিয়াছিল তাহাদের একটাকে ডাকিয়া বৌটার পিছন ধরাইয়া দিল।
বাঁদী বউ-এর বাড়ি চিনিয়া আসিয়া গোপনে সদুকেও সেই বাড়িটা দেখাইয়া দিল।
সদু তার পরদিন হাঁটিতে হাঁটিতে ঠিক তার পাশের বাড়িটাতে গিয়া উঠিল। বাহিরের উঠানে দাঁড়াইতে না দাঁড়াইতেই বাড়ির লোকে সমাদর করিয়া তাহাকে ডাকিয়া লইয়া জলচৌকির উপরে বসাইল। বড় একজন কারবারি সম্ভ্রান্ত লোক বলিয়া তাহারা সদুর মুখ চিনিত ; তাই খাতির করিয়া পান দিল, তামাক দিল। কিন্তু তামাক খাওয়া সদুর ভালো করিয়া হইলই না- হুঁকা টানিতে টানিতে সহসা দুটি গণ্ড বাহিয়া তার চক্ষের জল অবিরলধারে গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। … বাড়ির লোক অবাক হইয়া গেল।
জিজ্ঞাসা করিল,-আপনি কাঁদছেন কেন?
সদু বলিল,-কাঁদছি ভাই বড় কষ্টে। যাকে আর কোনোদিন দেখব বলে মনে আশা ছিল না, আল্লার দোয়ায় তাকেই আমি দেখেছি।
উপস্থিত সকলেই হাঁ করিয়া রহিল।
সদু বলিতে লাগিল,-তাকেই আমি দেখছি, ভাই। সে আমার বোন। নদীর ঘাট থেকে জল নিয়ে গেল একটা বৌ … হঠাৎ তাকে দেখেই আমার বুক ছাঁৎ করে উঠল, এ কাকে দেখলাম ; ঠিক আমার সেই মরা বোনটি, যেন বেহেশত থেকে ফিরে এসেছে; তেমনি রুপ, তেমনি গরন, পা ফেলাটা পর্যন্ত ঠিক তারই মতন, একেবারে সে-ই।
বলিয়া সদু হুঁকা ফেলিয়া আরো কাঁদিতে লাগিল।
একজন বলিল,-ও বাড়ির জসিমের বৌ, সেই খুব সুন্দর।
সে-দিন ঐ পর্যন্ত-
সদু কাঁদিয়া কাটিয়া চলিয়া আসিল।
কিন্তু কথাটা জসিমদের কানে উঠিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তাহারা সদুর নৌকায় যাইয়া দেখা করিল ; বলিল,-যাবেন একবার মেহেরবানি করে গরিবের বাড়ি, বসে আসবেন।
তার পরদিন সদু দুই হাঁড়ি খাজা বাতাসা আর দুই হাঁড়ি জিলিপি লইয়া জসিমদের বাড়ি আসিয়া হাজির।
আদর আপ্যায়ন দস্তুরমতোই হইল,-বোনের বাড়ি ভাই আসিলে যেমন হওয়া দরকার।
বোনের ছেলেটিকে কোলে লইয়া সদু আর ছাড়িতে চায় না, এমনি স্নেহ! বোনের ছেলেবেলাকার গল্প, বড় হওয়ার গল্প, আর সুখ্যাতি যা করিল তা-ও ঢের। …
আরো হাঁড়ি চার পাঁচ খাজা বাতাসা জিলিপি ভাগ্নের নামে পাড়ার লোককে খাওয়াইয়া সদু নৌকা লইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল।
দিন পনর পরেই সদুর লোক আসিল জসিমের বাড়ি প্রায় শ-খানেক টাকার কাপড়-চোপড় লইয়া-
বোনের কাপড়, রুমাল; ভাগনের কাপড়, জামা, জুতো, রাঙা ছাতি; জসিমদের তিন ভাইয়ের কাপড়, জামা, জুতো, গামছা, ছাতি; আরো মিঠাই হরেক রকমের। সঙ্গে চিঠি আসিল-বোনের জন্য প্রাণ চব্বিশ ঘণ্টাই হু-হু করে।
জসিমের বাড়িতে রীতিমতো চেঁচামেচি লাগিয়া গেল;-এ আহ্লাদ রাখি কোথায়! এতগুলো-এইসব একেবারে আমাদের । …
লোকে বলিতে লাগিল-যাক, এতদিনে জসিমের দুঃখ ঘুচল শালাকে পেয়ে। আর কোমরজলে দাঁড়িয়ে পাট পোঁচাতে হবে না-
কিন্তু এত পাওয়ার পাল্টা দেওয়া তো কিছু চাই-ই, তবেই মুখরক্ষা হয়,-কিন্তু জসিমদের অবস্থা, ভাত জোটে তো নুন জোটে না মতো,- কষ্টেসৃষ্টে সের পাঁচেক বাতাসা ছাড়া আর কিছুই পাঠানো হইল না।
তবে ইহাতে জসিমদের আক্ষেপ করিবার কিছুই রহিল না। সের পাঁচেক বাতাসা পাইয়াই সদু এমন আরজ পাঠাইল, যেন সে সোনার খনির মুখ খোলা পাইয়াছে।
এমনি করিয়া লেনদেনের প্রণয় চলিতে চলিতে হঠাৎ একদিন সদুর বাড়ি একটা বিবাহ কেমন করিয়া যেন আসন্ন হইয়া উঠিল।
জসিমের বাড়িতে সদুর পিয়াদা চিঠি লইয়া আসিল; আর আট বেহারার এক পালকি, জন দুই পাইক, এক দাসী আসিল বোনকে লইতে।
চিঠিতে লেখা ছিল,-
জসিম ভাই, আমার ছোট ভাইয়ের শাদি, অমুক তারিখে ; বোনকে অবশ্য পাঠাবে। শাদির আর আট দিন আছে-তোমরা তার দু’একদিন আগেই রওনা হয়ে আসবে, তাতে অমত বা অন্যথা করবে না। …
জসিমের বৌ পালকি চড়িয়া আগে পাছে পাইক পেয়াদা আসাসোঁটা লইয়া হুম্ হুম্ করিয়া সদুর বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল। জসিমের ছোট ভাই কাসেম, পনর ষোলো বছরের ছেলে,-সেও সঙ্গে আসিল।–পালকি সটান অন্দরের দরজায় আসিয়া নামিল ; দাসীর সঙ্গে জসিমের বৌ ভিতরে চলিয়া গেল।
বিয়ে যেদিন হইবার কথা তার তিন দিন আগে সদু কাসেমকে ডাকিয়া বলিল,-বিয়ে এ তারিখে হল না হে ; লোক সঙ্গে দিচ্ছি, তুমি এখনকার মতো বাড়ি যাও ; জসিম ভাইকে বোলো, বিয়ের আগেই তারা ঠিক খবর পাবে।
কাসেম বলিল,-বৌ?
-বৌ কিছুদিন থাকবে এখানে। তার ব্যবস্থা পরে করব।
কাসেম চলিয়া গেল।
কিছুদিন যাইতেই জসিমেরা বৌ-এর জন্য একটু ব্যস্ত হইয়াই উঠিল। তার উপর, পরের বাড়ি যাইয়া এতদিন থাকা, হাজার দহরম মহরম কুটুম্বিতাই থাক, ভাল দেখায় না।
কাজ কামাই করিয়াই অবশেষে জসিম একদিন সদুর বাড়ি আসিল।-
জসিম সদুর বৈঠকখানার দাওয়ায় বসিয়া আছে, মনে মনে ভাবিতেছে, বাপরে কত বড় বাড়ি! এমন সময় বাড়ির মালিক আসিতেই সে উঠিয়া দাঁড়াইল। আপ্যায়িত হইয়া জসিম একটু হাসিলও ; কিন্তু ভুরু তুলিয়া সদু বলিল,-কী চাও? … যেন জসিমকে চেনেই না এমনি সদুর আলগা ভাব।
জসিম ভাবিল, বড়লোকেরা বুঝি এইরকমই ঠাট্টা করিয়া থাকে ; তাই আরো খানিকটা হাসিয়া বলিল,-ভাই, আমাকে চিনতে পারলেন না?
-না হে না, কে তুমি? তোমার বাড়ি কোথায়?
সদুর রাগ দেখিয়া জসিমের মনে হইল, এটা বড়লোকের ঠাট্টা না-ও হইতে পারে। সে অবাক হইয়া গেল। একটু থামিয়া গুছাইয়া লইয়া বলিল, … আপনার নামই তো সদু খাঁ?
হ্যা, আমারই নাম সদু খাঁ।
-তবে চিনতে পারলেন না কেন বুঝতে পারছিনে। আমার নাম জসিম কারিগর, বাড়ি কালিগঞ্জ।
সদু বলিল,-কালিগঞ্জ চিনি বটে, কয়েকবার যাওয়া-আসা করেছি ; কিন্তু তোমাকে তো চিনিনে। সে কথা মরুকগে-এখন কী দরকারে এসেছ এখানে?
জসিম বলিল, আমার স্ত্রী-
-পালিয়েছে বুঝি?
শুনিয়া জসিম যেন আর থই পায় না ; সদুর মুখের দিকে খানিকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া থাকিয়া ভয়ে ভয়ে বলিল,-আপনি তাকে নিয়ে এসেছেন-
সদু যেন আচমকা বাঘ ডাকিয়া উঠিল,-জেন্দার-
‘হুজুর’ বলিয়া সাড়া দিয়া ঝাঁকড়া চুল ঘুরাইয়া খিৎমৎগার জেন্দার আসিয়া দাঁড়াইল। তাহাকে দেখিয়াই জসিমের কোমরজলে দাঁড়াইয়া পাট পোঁচাইবার পরেও হাতে পায় যেটুকু বল ছিল তাহাও অবশ হইয়া গেল। জেন্দারের ভ্রমরের মতো মিসমিসে কাল তেলমাখানো দেহখানার দিকে চাহিয়া জসিমের জিবটা একটুনড়িয়া গলার মধ্যে হিক্কার মতো একটা শব্দ হইল-আল্লা হক।
সদু জসিমের দিকে আঙ্গুল তুলিয়া বলিল,-এই বেটা পাগল। বলছে, আমি ওর বৌকে নিয়ে এসেছি। বাঁদীর বাচ্চার কান দুটো কেটে রেখে নদী পার করে দিয়ে আয়।
-‘যো হুকুম’ বলিয়া জেন্দার আগাইয়া আসিতেই জসিম ফুপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল ; হাত দুটি জোড় করিয়া বলিল,-দোহাই হুজুরের, মা বাপ, রক্ষে করুন।
সদু বলিল,-যা তবে, আর পাগলামি করিসনে।
কেমন করিয়া খোঁজ পাইল কে জানে-
জসিম আসিয়া আছাড় খাইয়া পড়িল ঠিক মানুষটির সামনে। …
অর্জুন নমশূদ্র। সত্তর বছরের বুড়ো।
ঘটনা সব শুনিয়া অর্জুন বলিল,-তুমি থানায় যাও ; আমরা কী করতে পারি?
কিন্তু জসিম সে কথা কিছুতেই মানিল না ; বারবার সে একই কথা বলিতে লাগিল,-তোমরা একবার চল সদুর কাছে, তোমরা বললেই সে আমার বৌকে ছেড়ে দেবে।
… বেচারা তখনো জানে না যে, সদু তার বৌকে নিকা করিয়া তাহারই ঘরে থাকে। জসিম কাঁদিয়া কাটিয়া অর্জুনের পা ধরিতেই যায়।
অর্জুন বলিল,-চল যাই, দেখে আসি, কিন্তু ব্যাপার অল্পে মিটবে না। তুমি তাকে চেন না।
জসিমের সঙ্গে অর্জুনকে দেখিয়াই সদু হাসিয়া বলিল,-কী বাবা রাম, হনুমান নিয়ে এসেছ?
এই হইল তার প্রথম কথা।
… তারপর দুই পক্ষের অনেক কথাই হইল, চটাচটির মতোই-
সদু এ-কথা বলিল না যে জসিমের বৌ তার বাড়িতে নাই ; আছে যে তাও বলিল না সে-কথাটি এড়াইয়া নবাগতদের সে এই কথাই কেবলই ধমকাইতে লাগিল,-
মুসলমানে মুসলমানে আমাদের যা-ই হোক, তোরা তার মধ্যে কোথাকার কে?…
জসিম তো ভয়ে কথাই বলিল না।
তারপর শেষ কথা সদুই বলিল, জাত তুলিয়াই বলিল,-তোদের আক্কেল হয় জুতো খেলে ; অনেকদিন বুঝি তা মাথায় পড়ে না?
অর্জুনের মুখের দিকে চাহিয়াই তাহার বড় ভাইপো যুধিষ্ঠির তাহাকে টানিয়া বাহিরে আনিল ; আনিবার সময় চেঁচাইয়া বলিয়া আসিল,-এ মামলা মিটবে লাঠির ঘায়ে। খবর দিও কবে চাও।
সদুও চেঁচাইয়া বলিল,-আচ্ছা।
দুপক্ষই জানিল, একটা মারামারি হইবেই।
যুধিষ্ঠিররা দলে প্রায় পঁচিশ জন। সবাই অর্জুনের সাগরেদ।
খবর পাঠাইলে আরো কিছু লোক পাওয়া যায়। কিন্তু অর্জুন তাহা হইতে দিল না! বলিল,-তারা দুশোর বেশি তো নয়। …
বাহিরের মধ্যে দলে রহিল কেবল জসিমরা তিন ভাই। তারাও কেবল দেখিয়ে। লাঠি তাহাদের ধরিতে দেওয়া হয় নাই।
মারামারির জায়গা ঠিক হইল, নমশূদ্রপাড়ার নিচেকার গোচারণের ঐ মাঠটা। সেটা কিন্তু সদুরই প্রস্তাব।–বোধহয় তার ইচ্ছা ছিল, ইহাদের মারিতে মারিতে ঠেলিয়া বাড়িতে তুলিয়া দিয়া সেই ঝোঁকেই ঘরবাড়ি পর্যন্ত সাপাট করিয়া দিবে।
যুধিষ্ঠির একবার আপত্তি করিল; কিন্তু অর্জুন বলিল,-না, ঐখানেই হবে।
দিন ধার্য হইল। …
ধার্যদিনে উহারা আসিল। গুনতিতে দু’শো হইবেই, তার বেশি ছাড়া কম নয়।
ইহারা মাত্র বাইশ জন। বাইশটি ঋজু সুগঠিত বৃষের মতো সুদৃঢ় দেহের প্রত্যেকটি অংশে দুর্জয় সংযত শক্তি ; আপাদমস্তকে কোথাও জড়তা নাই।–সকলেরই গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরণে রক্তাম্বর, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, হাতে একখানা করিয়া চার হাত লম্বা লাঠি।
সবাইকে একত্র করিয়া অর্জুন বলিল,-তোরা খুব আস্তে আস্তে এগিয়ে যা, আমি আসছি! … বলিয়াই সে ঘরে ঢুকিল।
সেখানে মাটিতে চাপিয়া বসিয়া মিনিট পাঁচেক চোখ বুজিয়া থাকিয়া, তারপর ‘মা মা’ বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে যখন সে চোখ খুলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তখন তার সে পূর্বের চেহারা একেবারে বদলাইয়া গেছে।–এখন সে যেন শিবের সংহার-মূর্তি।
এইবার সে বাহিরে আসিল। সচরাচর যেন চলিতে পারে না, এমনি সে জবুথবু ; কিন্তু এ- সময়ে যেন রক্তের গন্ধে সে ছুটিয়া চলে। তার হাঁকে বাঘেরও পিলে চমকায়, এমনি গলার বেগ!-তার লৌহকঠিন পেশিবর্তুলগুলির তরঙ্গের শৃঙ্গে শৃঙ্গে তটে তটে-তাদের সঞ্চরনে আকুঞ্চনে সম্প্রসারণে যেন রুদ্রের তেজ নাচিতে থাকে!…
‘মা মা’ বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে ছুটিয়া আসিয়া অর্জুন বলিল-সঙ্গে আয়।–বলিয়াই হাঁক ছাড়িয়া মাঠে যাইয়া পড়িল। …
তারপর যে কী হইল তাহা ভাল করিয়া বলিতে পারিব না।–
… এক একটা ঝড় এমনি আসে-খালি একটা শোঁ শোঁ শব্দ ; অন্ধকারে হঠাৎ চোখ বুজিয়া যায় ; চোখ খুলিয়াই দেখি, হাত-পা ছেঁড়া গোটাকতক মানুষ পড়িয়া আছে, চোখের সামনে আর সব ফাঁকা … সেইরকমই একটা কাণ্ড ঘটিয়া গেল চক্ষের নিমেষে।
মারামারি যখন থামিল, তখন সেই বাইশ জনেরই মনে হইল, কতকাল পড়ে তারা যেন মাটিতে ফিরিয়াছে।
অর্জুনরা কজন ছাড়া মাঠে তখন আর কেউ নাই। জসিমরা তিন ভাই দূরে দাঁড়াইয়া থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।
* * *
জসিম তার বৌকে ফিরিয়া পায় নাই।
বৌ নিজেই আসিতে চায় নাই।
জগদীশ গুপ্ত
Latest posts by জগদীশ গুপ্ত (see all)
- ফিকশন: কলঙ্কিত তীর্থ – জগদীশ গুপ্ত - অক্টোবর 25, 2020
- প্রলয়ঙ্করী ষষ্ঠী।। জগদীশ গুপ্ত - জানুয়ারি 27, 2016
- জগদীশ গুপ্তের তিনটা গদ্য - ফেব্রুয়ারি 24, 2014