Main menu

বাংলা সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ প্রসঙ্গে

গতকাল ফ্রেন্ডলিস্টের সকলের এবং জানা-অজানা পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখেছিলামঃ “বাংলা সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ কে? অন্যভাবে প্রশ্ন করলেঃ কোন ব্যক্তির জন্ম না হলে বর্তমানে যেই জিনিসগুলোকে আমরা বাংলা সংস্কৃতি বলে থাকি তা টিকেই থাকতোনা?” এই প্রশ্নের জবাবে অনেকেই অনেক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন। সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আর ২৪ ঘন্টা ধৈর্য ধরে যারা এই লেখা পড়ছেন তাদের কাছে একইসাথে ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করছি। প্রশ্নটা করার সময় অবশ্যই একজন ব্যক্তির নাম আমার মাথায় ছিল। সেই ব্যক্তির নাম সকলকে জানানোর আগে সংক্ষেপে একটু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হিসেবে যদি এই ব্যক্তির নাম শুনে যদি হতাশ হয়ে থাকেন তার জন্যে অগ্রীম ক্ষমাও চেয়ে নিলাম। আপাতত ওনার একটা ছবি দেখেন এবং আগ্রহবোধ করলে নিচের লেখা পড়তে পারেন।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

স্বাভাবিকভাবেই আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই ‘বাংলা সংস্কৃতি’ কী সেটা নিয়ে একটা বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। যেহেতু এই ধরণের বিতর্কে নিষ্পত্তির কোনও ধরণের উপায় নেই সেহেতু তাতে যাওয়ার বদলে আমরা এই বিতর্কের মীমাংসার বিশেষজ্ঞ তথা বাংলার সংস্কৃতিবানদের হাতে ছেড়ে দেব। আমাদের চিন্তা এবং পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সীমিত করার অংশ হিসেবে আমরা আরও ধরে নেব যে বাংলার সংস্কৃতিবানরা আনুষ্ঠানিকভাবে যা করেন তাতেই বাংলা সংস্কৃতির একটি গ্রহণযোগ্য চিত্র প্রতিফলিত হয়। 

প্রথমেই বাংলা সংস্কৃতি বলতে যা বোঝানো হয় তা বোঝার জন্যে সনাতনভাবে যাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বলা হয় তার শরণাপন্ন হই। না, আজকালকার জগাখিচুড়ি মার্কা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয় (যাতে কিনা মানুষের এগজিবিশনিজম চরিতার্থ করার জন্যে ফ্যাশন শোও থাকে), একেবারে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আয়োজিত অনুষ্ঠানের কথা হচ্ছে। সেই অনুষ্ঠানের দৃশ্য মাথায় রেখে এইবার আমরা তা তুলনা করবো বিভিন্ন ‘অপসাংস্কৃতিক’ অনুষ্ঠান (যেমন কনসার্ট)-এর সাথে। নিশ্চয়ই এই দুইয়ের মধ্যে কোথাও না কোথাও এমন কিছু একটা আছে যার কারণে কোনও অনুষ্ঠান সাংস্কৃতিক হয়ে যাচ্ছে (অথবা কোনও একটা কিছু অনুপস্থিতিতে কোনও অনুষ্ঠান অপসাংস্কৃতিক হয়ে যাচ্ছে)। প্রথমেই অনেকেই পোষাকের কথা বলবেন, যেমন পুরুষের পাঞ্জাবী এবং মেয়েদের শাড়ী। এইখানে ঝামেলা হচ্ছে যে তাহলে আজকালকার ধুমধাড়াক্কা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানকেও তাহলে বাংলা সংস্কৃতির মধ্যে ফেলে দিতে হবে। আরেক ঝামেলা হচ্ছে এই পোশাকগুলো আবার চরম সংস্কৃতিবিমুখ মানুষও পড়ে। পোশাকের ব্যাপারটা খারিজ করে দিলে স্বাভাবিকভাবে কবিগুরুর কথা বলবেন। তাদের বক্তব্যে কিঞ্চিৎ সত্যতা থাকলেও শিকার করে নিতে হবে এখনও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রবীন্দ্রনাৎসিদের একাধিপত্য স্থাপিত হয়নি। যদ্দিন হচ্ছেনা তদ্দিন তাদেরকে কষ্ট করে হলেও নজরুল থেকে শুরু করে গণসঙ্গীত হয়ে পল্লীগীতি পর্যন্ত যাবতীয় অনার্য সঙ্গীত সহ্য করে যেতেই হবে।

মার্বেল প্লেটে আঁকা হারমোনিয়াম। ছবি, গুগুল সার্চ থিকা নেয়া।

মার্বেল প্লেটে আঁকা হারমোনিয়াম। ছবি, গুগুল সার্চ থিকা নেয়া।

এইরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুইটিকে খারিজ করার প্রেক্ষিতে পাঠকদের অনেকেই নিশ্চয় যারপরনাই ত্যক্ত-বিরক্ত হচ্ছেন। হ্যাঁ আমিও বলি, “না! অনেক হয়েছে।” তাহলে বাংলা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই বস্তুটি কী? উড়োজাহাজের যেমন ব্ল্যাক বক্স ঠিক তেমনি বাংলা সংস্কৃতিও একটি বাক্সতে বন্দী। বাংলা সংস্কৃতির প্রাণভোমরা যেই বাক্সতে আটকানো আছে সেই বাক্সের নাম হারমোনিয়াম। এপার-ওপার দুই বাংলা মিলিয়ে নিজেকে সংস্কৃতিবান প্রমাণ করতে গেলেই যেকোনও বঙ্গসন্তানকে এই বাক্সের শরণাপন্ন হতেই হবে। আর হারমোনিয়াম না থাকলে যে যাই করুক না কেন তা সাংস্কৃতিক হিসেবে পরিগণিত হবেনা। ইউরোপিয়ান এই আবিস্কার আজকালকার দিনে সারা দুনিয়ায় পরিত্যক্ত হলেও পৃথিবীর এই বিচিত্র অঞ্চলের মানুষ তাদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র বাদ দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই একে তাদের সংস্কৃতির আধারে পরিণত করেছে। যে ফরাসী ধর্মযাজকেরা যখন এই বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এখানে এসেছিলেন তারাও এর ভবিষ্যৎ সাফল্য সম্পর্কে ধারণা করতে পারেননি।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এই হারমোনিয়াম বাংলা সংস্কৃতির বিস্তারে কী ভূমিকা রেখেছে। এই প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে কিছুটা বামপন্থী রেটরিকের দরকার হবে। আজ যাকে আমরা বাংলা সংস্কৃতি বলে থাকি এর উদ্ভব ঘটেছিল এই অঞ্চলের সামন্তপ্রভুদের বৈঠকখানায় (বা তার সমতুল্য কোনও স্থানে)। এই সংস্কৃতি কারখানার যন্ত্রাণুসঙ্গের কলেবরের কথা বিবেচনায় আনলে এই সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানো স্বাভাবিকভাবেই কঠিন ছিল। যাই বলেন না কেন সবারতো আর জ্যোতিদা’র পিয়ানো ছিলনা সেসময়। হালফ্যাশনের যন্ত্র হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর যখন এর চাহিদা বাড়লো তখন দ্বারকানাথ ঘোষ নামের জনৈক সঙ্গীতজ্ঞ/বাদ্যযন্ত্রীর কল্যাণে ফরাসী দেশের এই পাম্প অরগ্যান (এই কথাটার আক্ষরিক অনুবাদ করে গতকাল থেকে হেসেই যাচ্ছি) পদচালিত পাম্পের বদলে হস্তচালিত পাম্পে বিবর্তিত হয়ে ফরাস পেতে বসার উপযোগী হয়ে ওঠে। যার ফলে সেইসময়ের সামর্থ্যবান থেকে শুরু করে প্রায় শিক্ষিত নিম্নবিত্ত সকলেরই ‘সাংস্কৃতিক’ হওয়ার আশাপূরণ করা সহজ হয়ে গেল। আজকালকার কম্পিউটার টার্মিনোলজি ব্যবহার করলে হারমোনিয়াম যন্ত্রটি বাংলা সংস্কৃতিকে ‘পোর্টেবল’ করে দিল। আর কালের বিবর্তনে এই বাদ্যযন্ত্র শ্রেণীরেখা ভেদ করার সাথে সাথে এই সংস্কৃতির প্রতীকে পরিণত হলো। এই হারমোনিয়াম আঁকড়ে ধরে বাঙ্গালী তার সংস্কৃতির কী ক্ষতি করেছে তা ভিন্ন সময়ে আলাপ করার ইচ্ছে আছে।

তবে সবকিছু বিবেচনা করে এই হারমোনিয়াম যন্ত্রের ফরাসী আবিস্কর্তা আলেক্সান্দর দেবাঁকেই বাংলা সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ আখ্যা দিতে আমার মনে কোনও দ্বিধা নেই। ভদ্রলোকের শ্রীমুখ আপনারা আগেই দেখেছেন। ধৈর্য ধরে লেখা পড়বার জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ।

 

মে ১০, ২০১৫।

The following two tabs change content below.

নায়েল রহমান

প্রাক্তন শিক্ষক, পর্যবেক্ষক, বিশ্লেষক এবং ব্যবসায়ী।

Latest posts by নায়েল রহমান (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →