ফিশ লাভ ।। আন্তন চেখভ ।।
“আনিকা শাহ কইছেন, ‘কিন্তু এমনও তো হইতে পারে যে লিটেরারি জঁরাগুলার এভল্যুশনের মধ্যে ফ্যাবিউলিজম হয়ে সাররিয়ালিজম ছাড়ায়ে ম্যাজিক রিয়ালিজমের দিকে যাওয়ার মাঝের কোনো একটা সময়ের গল্প এইটা। নিশ্চিত না, অসম্ভবও না।’ আমি ভাবছি, এমন কি হইতে পারে না যে, হিস্ট্রিক্যলি পিছের একটা টাইমে বইসা বইসা ঘুঘু চেখভ বা গোগল (নাক) ফিউচারে পিপিং করছেন, আটলান্টিক পার হইয়া, তারপর নকল করছেন ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’, দুনিয়ার আর আর মানুষের (যেমন, রাজু আলাউদ্দিন বা রফিক-উম-মুনীর) তখনো ঐ পরের ম্যা.রি.র লগে চিন-পরিচয় হয় নাই বইলা ওনাদের ঘুগলামী ধরতেই পারি নাই আমরা…🙂!”
রক মনু
——————————-
“ফিশ লাভ” (প্রথম প্রকাশ ফ্র্যাগমেন্টস্ ম্যাগাজিনে, ১৩ জুন ১৮৯২) পড়ার আর অনুবাদ করার মধ্যে গ্যাপ এত বেশি হয়ে গেছে যে পড়ার সময় কী মনে হইছিল সেইটা মনে নাই।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
তবে এইটা মনে আছে যে পড়ার সাথে সাথেই অনুবাদ করার নিয়ত করছিলাম। খুব সম্ভব একটা এই কারণে যে গল্পটা ছোট, এবং আরেকটা এই কারণে যে গল্পের নায়ক একটা মাছ।
চেখভ আমার পড়া সবচেয়ে কমপ্যাশনেট লেখকদের মধ্যে একজন। তাঁর চরিত্ররা মানুষ হোক বা মাছ, এবং যেমনই মানুষ হোক বা যেমনই মাছ, আই হ্যাভ অলওয়েজ ফাউন্ড হিম টু হ্যান্ডল দেম উইদ আটমোস্ট কেয়ার। “ফিশলাভ”-এ হিউমার প্রমিনেন্ট, সারকাজম তস্য প্রমিনেন্ট। এতটা সারকাস্টিক চেখভকে হইতে দেখছি বলে মনে পড়ে না। তবে সারকাস্টিক হইতে হইতেও চেখভ কমপ্যাশনেট হইতে পারেন, সেইটা আরাম লাগে।
এমন হালকা ম্যাজিক রিয়ালিস্ট ধাঁচেরও চেখভকে হইতে দেখছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু হয়তো তিনি তখন হচ্ছিলেন। এবং হয়তো তিনি একা না। আমরা ধরে নেই যে ম্যাজিক রিয়ালিজমের উৎপত্তি ল্যাটিন আমেরিকায়। তার আগে সাররিয়ালিজম ছিল ইউরোপে, তারও আগে ফ্যাবিউলিজম ছিল নানান জায়গায়। এবং নিশ্চয়ই তাই-ই। কিন্তু এমনও তো হইতে পারে যে লিটেরারি জঁরাগুলার এভল্যুশনের মধ্যে ফ্যাবিউলিজম হয়ে সাররিয়ালিজম ছাড়ায়ে ম্যাজিক রিয়ালিজমের দিকে যাওয়ার মাঝের কোনো একটা সময়ের গল্প এইটা। নিশ্চিত না, অসম্ভবও না। হয়তো কোনো কিছুরই উৎপত্তিস্থল কেবলমাত্র সেই একটা জায়গা না।
দ্য মেটামরফসিস পড়ে মনে হইত যে মানুষ মূলত তেলাপোকা। “ফিশ লাভ” পড়ে মনে হইছিল মানুষ মাঝে মাঝে মাছও। কিন্তু পরে আবার মনে হইল যে মাছই আসলে মাছ। এবং মাছ মাছই। এবং দ্যাট্স্ ওকে। দ্যাট্স্ বেটার দ্যান ওকে। এত মনুষ্যকেন্দ্রিক হয়ে আর কতকাল।
আনিকা শাহ
শুনতে আজব লাগলেও, জেনারেল পান্তালিকিনের বাগানবাড়ির পাশের পুকুরের একলা কার্পটা বেড়াইতে-আসা সোনিয়া মামোচকিনার হুলুস্থুল প্রেমে পড়ে গেল। অবশ্য, এমনই আর কি আজব বিষয়টা? লেরমন্তভের শয়তান তামারার প্রেমে পড়ল i, রাজহাঁস লেডার প্রেমে পড়ল, আর আমলারাও তো মাঝেমাঝে তাদের বসের মেয়েদের প্রেমে পড়ে, পড়ে না? সোনিয়া মামোচকিনা প্রতিদিন সকালে তার ফুপুর সাথে গোসল করতে আসে। আর প্রেমে-পড়া কার্প পুকুরের ধারে সাঁতরায়ে সাঁতরায়ে তাকে দ্যাখে। পুকুরের পানি অবশ্য বহু আগেই বাদামি হয়ে গেছে, যেহেতু পাশেই ক্র্যান্ডেল আ্যান্ড সন্সের ঢালাইয়ের কারখানা। কিন্তু কার্পটা তাও সব দেখতে পায়। সে সাদা-সাদা মেঘ দ্যাখে, নীল আকাশে পাখি দ্যাখে, বেড়াইতে-আসা ভদ্রমহিলাদের জামাকাপড় খুলতে দ্যাখে আর পুকুরের পাশের ঝোপের চিপায় দাঁড়ায়ে তাদের দিকে উঁকি-মারা কমবয়সী ছেলেদের দ্যাখে। সে গোলগাল ফুপুকেও দ্যাখে। তিনি পানিতে নামার আগে অন্তত পাঁচ মিনিট একটা পাথরের উপর বসে থাকেন আর খুশিমনে নিজের গা চাপড়াইতে চাপড়াইতে বলেন: ‘ক্যামন করে আমি এমন হাতির মতো দেখতে হইলাম? কী বাজে লাগে আমারে দেখতে।’ হালকা-পাতলা কাপড়গুলা খুলে ফেলে সোনিয়া চিৎকার দিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেয়, সাঁতার কাটে, ঠাণ্ডায় কাঁপে। আর সেখানে থাকে কার্পটা, সাঁতরায়ে ওর কাছে যায়, লোভীর মতো চুমু দেয় ওর পায়ে, কাঁধে, ঘাড়ে…
গোসল শেষে ওরা ঘরে যেয়ে চা-বিস্কিট খায়, আর একলা কার্পটা পুকুরে গোল-গোল সাঁতার কাটে আর ভাবে: ‘সাড়া পাওয়ার তো কোনো চান্সই নাই। এত সুন্দর একটা মেয়ে, ও কি আর আমার প্রেমে পড়বে, একটা কার্পের? জীবনেও না, হাজারবার না! এইসব স্বপ্নের লোভ দ্যাখাইয়ো না নিজেরে, গাধা মাছ কোথাকার! কপালে তোমার একটা জিনিসই আছে – মরণ। অবশ্য মরবও ক্যামনে? পুকুরে রিভলভার নাই, ম্যাচের কাঠি নাই। কার্পের মরণ হয় পাইকের কামড়ে, কিন্তু পাইকও কই পাই। সারা পুকুরে একটাই পাইক ছিল সে-ও তো বোর হয়ে মারা গেছে। এমনই মরার কপাল আমার!’
মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাবতে তরুণ নৈরাশ্যবাদী আঠা-আঠা মাটির নিচে ঢুকে ডায়রি লিখে…
একদিন দুপুরে সোনিয়া আর ওর ফুপু মাছ ধরার জন্য পুকুর পাড়ে বসে। বঁড়শির ফাঁকে ফাঁকে কার্পটা সাঁতার কাটে, ভালোবাসার মানুষের থেকে চোখ সরাইতে পারে না। তখনই তার মাথায় আইডিয়ার বিদ্যুৎ চমকায়।
‘ওর হাতেই মরব আমি!’ সে ভাবে। খুশির চোটে ওর ডানা চকচক করে। ‘আহা কী সুখের মরণ হবে সেইটা!’
সোনিয়ার বড়শির কাছে গিয়ে সে বড়শির হুক কামড়ায়ে ধরে।
‘সোনিয়া, তোমার বঁড়শিতে মাছ লাগছে!’ ফুপু চ্যাঁচায়ে উঠে, ‘মাছ লাগছে দ্যাখো তোমার বঁড়শিতে, সোনা!’
‘আরে! তাই তো!’
সোনিয়া লাফ দিয়ে উঠে তাবৎ শক্তি লাগায়ে টান দেয়। চকচকা সোনালি কিছু একটা বাতাসে দেখা দিয়ে পানিতে পড়ে যায় আবার, পানিতে বৃত্ত তৈরি করে।
‘চলে গেল!’ দুইজনেই বলে উঠে।
ওরা হুকের দিকে তাকায়ে দ্যাখে মাছের ঠোঁট লেগে আছে।
‘এত জোরে তোমার টান দেয়া উচিত হয় নাই সোনা,’ ফুপু বলে। ‘বেচারা মাছটার এখন ঠোঁট ছাড়া থাকতে হবে…’
আমার গল্পের নায়ক হুক থেকে ছাড়া পেয়ে তাজ্জব হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বুঝতেই পারল না যে ঘটনাটা কী ঘটল। কিন্তু তারপর যখন বুঝতে পারল, তখন আর্তনাদ করল:
‘আবার আমাকে বাঁইচা থাকতে হবে! আবার! কপাল আমার তামশা করে আমার সাথে!’
তারপর সে যখন আবিষ্কার করল যে তার নিচের ঠোঁটটা নাই, কার্পটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, আর বিকট এক হাসি দিল… কার্পটা পাগল হয়ে গেল।
আমার আশংকা যে সিরিয়াস রিডার যারা, তাদের মনোযোগ যে আমি কার্পের মতো তুচ্ছ, ম্যাড়ম্যাড়া একটা প্রাণীর দিকে ঘুরায়ে রাখতে চাইতেছি, এইটা তাদের আজব লাগবে। অবশ্য, এমনই আর কি আজব বিষয়টা? লিটেরারি জার্নালগুলায় ভদ্রমহিলারা লেখেন না ছোটমাছ আর শামুক নিয়ে, যেইসব কেউ পড়তে চায় না? আমি জাস্ট তাদেরকে কপি করতেছি। আর হয়তো আমিও ভদ্রমহিলাই, জাস্ট পুরুষ-ছদ্মনামের পিছনে লুকায়ে আছি।
তো কার্পটা পাগল হয়ে গেল। এবং এই অভাগা প্রাণী এখনও বেঁচে আছে। কার্পরা সাধারণত ভাজি হইতে চায়, সাথে টক দই। কিন্তু আমার নায়ক যে কোনো ধরনের মৃত্যুর জন্যই রাজি আছে। সোনিয়া মামোচকিনা এক ওষুধের দোকানের মালিককে বিয়ে করে ফেলছে, আর ওর ফুপু গেছে তার বিবাহিত বোনের সাথে থাকতে লিপেট্স্কে। সেইটাতেও আজব কিছু নাই, বিবাহিত বোনের ছয়টা বাচ্চা, তারা সবাই তাদের খালাকে বড়ই ভালোবাসে।
কিন্তু কাহিনি আরও আছে। ক্র্যান্ডেল আ্যান্ড সন্স ঢালাই কারখানার ডিরেক্টর হইল একজন ইঞ্জিনিয়ার, নাম ক্রিসিন। তার বোনের ছেলের নাম ইভান। ইভান কবিতা লিখে আর সব জার্নাল-পত্রিকায় ছাপায়, সবাই জানে। একদিন দুপুরে, গরমের দিনে, কমবয়সী কবি পুকুরের পাশে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাইতে যাইতে ঠিক করল যে একটা ডুব দিবে। সে জামাকাপড় খুলে পানিতে নামল। পাগলা কার্প ওকে দেখে ভাবল সোনিয়া মামোচকিনা। সে সাঁতরায়ে ওর কাছে যেয়ে খুব নরম করে ওর পিঠে চুমু দিল। সেই চুমুর ফলাফল হইল মারাত্মক: কার্পের চুমুতে কবির মধ্যে নৈরাশ্যবাদ ছড়ায়ে পড়ল। সে পানি থেকে উঠল, কিছুই না টের পেয়ে, বাড়ির দিকে রওনা দিল বিকট হাসতে হাসতে। কয়েকদিন পর সে গেল পিটার্সবার্গে। সেইখানে সে বিভিন্ন সম্পাদকের অফিসে অফিসে ঘুরল, আর নৈরাশ্যবাদ ছড়ায়ে দিল ওইখানের সব কবিদের মধ্যেও। তারপর থেকেই আমাদের সব কবিরা দুঃখী আর মরা-মরা কবিতা লিখতে লাগলো।
Latest posts by আনিকা শাহ (see all)
- নাউ প্লেয়িং: প্রোটোজে - আগস্ট 18, 2016
- ফিশ লাভ ।। আন্তন চেখভ ।। - জুলাই 24, 2016
- নাউ প্লেয়িং: লানা ডেল রেই - জুলাই 11, 2016