Main menu

গল্প: শা’নযর – শাহেদ আলী

বাংলা ছোটগল্প রাইটার হিসাবে শাহেদ আলী’র নাম যে খুবএকটা শুনবেন না আপনি, এর একটা কারণ হইলো যে উনি ‘ইসলামী সাহিত্য’ করছেন; বাংলা একাডেমিতে না কইরা, চাকরি করছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে। আর এইটা করতে গিয়া বাংলাভাষাতে ‘জোর কইরা’ অন্য ভাষার শব্দ ঢুকানোর ট্রাই করছেন। এই ঘটনাটা দুয়েকবার ‘ছোটলোকের ভাষা’ বইলা পিঠ-চাপড়ানি পাইলেও মোস্টলি ‘পাকিস্তানের দালালি’ বইলাই আইডেন্টিফাইড। তবে একটা সময়ে বা এখনো সংস্কৃত-অরিজিনের বাইরে যে ভাষা-রুচি সেইটারে, হোক সেইটা ‘ছোটলোকের ভাষা’ বা ‘ইসলামি সাহিত্য’ – একটা বাজে জিনিস বা ‘জোর-জবরদস্তি’ হিসাবে দেখার ব্যাপার তো আছেই।  

এক তো হইলো ‘ইসলামিক’, তার উপর আবার ‘ইরোটিক’! উনি খালি ইরোটিক হইয়াই থামেন নাই, উনার মাইয়ারা বেশিরভাগ সময়ই অ্যাক্টিভ রোল প্লে করতে থাকেন।  উনার ‘ঐ যে নীল আকাশ’ গল্পটাও ছাপাইছিলাম আমরা। উনার এই গল্প দুইটাতে ফিমেইল কারেক্টারগুলি অনেক স্ট্রং; মানে, উনারা মশকরা (হিউমার) করেন না খালি, এমনভাবে অ্যাক্ট করেন যে, উল্টা উনাদের মেইল পার্টনারদেরকে উনাদের চাইতে ইনফিরিয়র মনেহয়।

তারপরও উই রিকেমন্ড যে, শাহেদ আলী’র গল্প আপনারা পড়তে পারেন।

————————————————————————–

 

জোছনা ঝলোমলো রাত।

মিরাদ একটা জল-চৌকির উপর বসে আছে, বারান্দায়, খুঁটিতে হেলান দিয়ে সে নিজের মধ্যে ডুবে আছে।

বাড়ির পেছনে কড়ুই গাছের আগায় করুয়ার বাসা। সেই করুয়া ডেকেছে কিছুক্ষণ আগে। রাতের ঘুম-ভাঙানো, ধ্বনি-প্রতিধ্বনি জাগানো সেই ডাক শুনে সে আন্দাজ করতে পারলো, রাত কত হয়েছে। দু’ব্যাটারির একটা ট্রাঞ্জিস্টার মিরাদ কোলে কোলে রাখতো। মাসখানেক হলো ব্যাটারি পাওয়া যাচ্ছে না। সাথে সাথে উজ্জ্বল দুনিয়া মুছে গেছে তার জন্যে। সুর হয়ে, কথা হয়ে বাইরের দুনিয়া প্রবাহিত হতো তার চেতনায়। সেই দুনিয়া তার কাছ থেকে হঠাৎ দূরে সরে দাঁড়িয়েছে-কারণ ট্রাঞ্জিস্টার আর কথা বলে না, গান শোনায় না।

অথচ কী মশগুল হয়েই না সে দেশ-বিদেশের গান শুনতো, খবরের জন্যে কান খাড়া করে রাখতো। কেউ কাছে না থাকলেও সাড়া দুনিয়ার সাথে চলতো তার হৃদয়ের আলাপ। বিদেশী গানের ভাষা সে বোঝে না, কিন্তু কী এক রহস্যময় উপায়ে সেই সুরই চুপি চুপি নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়তো তার চেতনার ভাঁজে ভাঁজে – মিরাদ অবাক হয়ে যেতো!

স্তব্ধ হয়ে বসেছিলো! আশায় আশংকায় মিরাদ একেবারেই বিপর্যস্ত!

এরি মধ্যে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এলেন তার মাঃ হোনছোস্‌, জয়নাবের একটা ছাইলা অইছে!

ছেলে হয়েছে – জয়নাবের ছেলে হয়েছে! সুখের খবর না দুঃখের সংবাদ মিরাদ বুঝতে পারলো না। কেবল একটা অন্ধকার রহস্যের স্রোত যেন তার চেতনার উপকূলে ধাক্কা দিয়ে যায়!

যেদিন সে শুনতে পেলো জয়নাবের পেটে বাচ্চা এসেছে, প্রথমটা সে বুঝতেই পারেনি, এ কথার তাৎপর্য কী, মানে কী। তারপর, তাকে জয়নাব অনেক করে বুঝাবার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত জয়নাবের সাথে সাথে সে-ও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। জয়নাব তার কাছে কিছুই গোপন করেনি। মুহূর্তে মুহূর্তে মিরাদ তার শরীরী সত্বা দিয়ে অনুভব করেছে জয়নাবের দেহের রূপান্তর, মনের রঙ-বদল, আর তার সাথে মিরাদের চেতনায়ও জেগেছে রক্তিম উচ্ছ্বাস!

শেষের দিকে কিন্তু মিরাদ ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। অতো বড় একটা মানব-শিশুকে নারী কেমন করে পেটে ধরে, তারপর সেই অন্ধকার কুঠরী থেকে কেমন করে নিয়ে আসে আলোর জগতে-এ তার কাছে এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য! কী জানি, যদি সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে গিয়ে জয়নাবের পেত ফেটে যায় আর তার ফলে জয়নাব মরে যায়! মিরাদ তার দু’দু’টি বোনকে হারিয়েছে। এই রকম, ষোলো-সতেরোই তো হয়েছিল ওদেরও বয়স। জয়নাবের মতোই ওরাও তো বিভোর ছিল সন্তানের স্বপ্নে। কিন্তু সন্তান মাটিতে পরতে না-পরতেই মারা গেল একজন, আরেকজন একটি কন্যা জন্ম দেবার পর বেঁচেছিল মাত্র মাসখানেক।

আল্লাহ্‌র অশেষ মেহেরবাণী যে সন্তান জন্ম দিয়েও জয়নাব বেঁচে আছে।

-মা, মা গো, হঠাৎ একবার চিৎকার করে ওঠে মিরাদ।

-কী রে? কী অইছে? মিরাদের গলার স্বরে আতংকিত হন মা।

-আমারে ধৈরা একটু উডানে লৈয়া যাও মা।

-কেনরে? কই যাবি? মা’র গলায় উদ্বেগ সীমাহীন।

মিরাদের শিরা-উপশিরাগুলি রক্তের চাপে টন্‌টন্‌ করতে থাকে। উত্তেজনায় বুকের ভিতর ওর তোলপাড় শুরু হয়। অপূর্ব, অনিবার্য এক উল্লাসে মিরাদ এলোমেলো হয়ে পড়ে। জলচৌকি থেকে হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে যায়, আর হাত দু’টি প্রসারিত করে দেয় মা’র দিকে। সারা শরীর তার শিউরে শিউরে উঠছে, চোখের পাতা বারবার উঠছে আর নামছে। ঠোঁট দু’টি থেকে একটা করুণ, বিষন্ন অজাগতিক হাসি তার গালের উপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চোখে, মুখে, কপালে।

-মা, আমারে ধরো, প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে মিরাদ, আমারে উডানে লৈয়া যাও।

মা কিছুই বুঝতে পারেন না। এ মুহূর্তে মিরাদকে পোয়াতির ঘরে কিছুতেই নেওয়া যাবে না। মিরাদ ভয়ানক অস্থির হয়ে পড়েছে। বুকে আছড়ে পড়া ঢেউ সামলাতে সামলাতে তিনি মিরাদের পাশে এসে দাঁড়ান।

মা’র কাঁধের উপর হাত রেখে মিরাদ উঠানের দিকে পা বাড়ায়।

উঠানে নেমে সে তার হাত দু’টি তুলে নেয় মা’র কাঁধের উপর থেকে। তারপর ধীরে ধীরে সবুজ লুংগি গুটিয়ে সে পায়ের উপর বসে পড়ে আর বলে – আমারে এক বদনা পানি দে, মা।

আশ্বিনের ধোয়া-মোছা সাফ-সফা আসমানে মাথার উপর ভরা চাঁদ। রাত দুপুর গড়িয়ে গেছে, কারণ গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে করুয়া ডেকেছে কিছুক্ষণ আগে, তার অদ্ভুত গম্ভীর আওয়াজে আসমানে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তু’লে!

-একটু বার-চা’না বাপ, কারুণ্যে মা’র গলা আর্দ্র, তোর লাগ্যা পানি আনতাছি!

বাড়িতে এ ঘরে ও ঘরে ছুটাছুটি শুরু হয়। মিরাদের ছোট বোন সিতারা জয়নাবের বাচ্চাটাকে একটা তেনায় পেঁচিয়ে কোলে নিয়ে বসেছে।

ঘরের বারান্দায় পায়চারি করছেন সদরুদ্দিন। ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা-আন্দেশা তাঁরই সবচেয়ে বেশি। মিরাদের বোঝা বেড়ে চলেছে। বেটা ছেলে হয়েছে, এ পরিবারে এই পয়লা নাতি এসেছে, এ নিয়ে তাঁর খুশির এন্তেহা নেই। কিন্তু মিরাদের কথা ভেবে সেই আনন্দেরই স্ফীত বুক কাঁটার ঘায় জখমী, রক্তাক্ত হয়ে উঠছে।

মন সম্পূর্ণ ঢেলে দিয়ে মিরাদ ওজু করে। তারপর দাঁড়িয়ে দু’হাতে শাহাদাতের আংগুল কানে ঢোকায় এবং গলা ছেড়ে আযান শুরু করে; জোছনায় সয়লাব দুপুর রাতের পৃথিবী সুরে সুরে ভেসে যায়।

শিশুকাল থেকে মুয়ায্‌জিনের আযান শুনতে শুনতে সে যে কখন নিজেও আযানের সুর আয়ত্ত করে ফেলেছে মিরাদ তা জানতো না। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেন শোণিত বিন্দু থেকে, আজ যখন মিরাদ নিজের সন্তান হবার পর সেই আল্লাহ্‌র মহিমা গাইবার জন্যে আযান শুরু করলো, তাঁর আবেগে কাঁপা, বিস্ময় আর পূলক-সেঁচা দরাজ-গলার আওয়াজ যে ‘শুনলো সে’ই অভিভূত হয়ে পড়লো।

নিশ্চল খুঁটির মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সদরুদ্দিন কান পেতে রাখেন। আযান যে অতো মধুর হতে পারে, চেতনার পরতে পরতে পৌঁছে মানুষকে গভীর আর্তিতে অমন ব্যাকুল-বিহ্বল করে তুলতে পারে, তিনি স্বপ্নেও কখনো কল্পনা করেননি। আহা, মিরাদ যদি রোজ গাঁ’র মসজিদের পাঞ্জেগানা নামাযের আযান দিতো, সদরুদ্দিন মনে মনে ভাবেন, নতুন প্রাণ পেয়ে বিরান মসজিদ জিন্দা হয়ে উঠতো!

আযান শেষ করে মিরাদ আবার তার মাকে ডাকে। সায়রা বানু আসার আগেই আগিয়ে আসেন সদরুদ্দিন-কীরে, কী চাস? বাপ।

-বাজান?

-হ।

একটু চুপ করে থেকে মিরাদ বলে-আমারে এট্‌টু বারিন্দায় নিয়া যাও না বাজান।

হাত ধরে ধরে সদরুদ্দিন মিরাদকে মিরাদের ঘরে নিয়ে যান। তিনি টের পান, চোখের পানিতে মিরাদের বুকের জামা ভিজে গেছে।

আবার জলচৌকিতে বসে, পেছনের খুটিতে ঠেস্‌ দিয়ে মিরাদ চুপ করে থাকে। তার বুকের ভেতরের তোলপাড় ততোক্ষণে অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে।

কিছু কইবি? সায়রা বানু তার পাশেই দাঁড়িয়ে জিগ্‌গেস করেন। মিরাদ জবাব দেয় না। তার মনে উচ্ছ্বসিত জোয়ারের মতো ঔৎসুক্যঃ সে বুঝতে চায়, জানতে চায় – সন্তান কী জিনিস? দেখতে কেমন হয়েছে? কার মতো হয়েছে? আর জয়নাব, জয়নাব কেমন আছে? সে কি সন্তান পেয়ে খুশী হয়েছে?

কিন্তু মুখ ফুটে কোন কথাই সে বলতে পারলো না। অদ্ভুত এক দ্বিধা আর সংকোচ এসে তার মুখ চেপে ধরে, তাকে বোবা বানিয়ে দেয়। এক করুণ বিষাদে তার মুখখানা যেন দুঃখের বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠে।

সোয়ামীর সাথে বনি-বনা না হওয়ায় সেই যে বছর খানেক আগে সিতারা বাপের বাড়ি এসেছিল তখন থেকেই সে এখানে রয়েছে। অতোক্ষণ জয়নাবের ঘরেই ছিলো সিতারা। রাত ফুরিয়ে এসেছে, তাহাজ্জদের সময় আসন্ন। জয়নাবের ঘর থেকে বার হয়ে এসে সে মিরাদের পাশে বসে, হোন্‌ছো ভাইয়া!

– কী? মিরাদ জানতে চায়, নিশ্চয়ই কোন জরুরী খবর নিয়ে এসেছে সিতারা।

– ভাবী তুমারে ডাকতাছে, মিরাদের মুখের উপর চোখ দু’টি রেখে সিতারা বলে, মাথার কাপড় তার ঢলে পড়ে কাঁধের উপর, চোখ-মুখে রাত জাগার ক্লান্তি।

– আমারে? মিরাদের গলার আতংক নিশুতি রাতের জলোচ্ছ্বাসের আলামত এনে দেয়-কেন? তর ভাবী কেমন আছে? একসংগে কথাকটি উচ্চারণ করে মিরাদ আবার চুপ করে যায়। জিগ্‌গেস করতে সাহস পায় না, দেখতে কেমন হয়েছে সন্তানটি। যদি তারই মতো হয়ে জন্মে থাকে!

– ভাবীর ঘুম আইছে কিছুক্ষণ আগে, হাই তুলতে তুলতে সিতারা বলে, বাচ্চারে দেখ্যা কেমুন যে একটা হাসি ফুট্যা উঠলো হের মুখে!

– খুশি অয় নাই? কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে দ্বিধার সাথে মিরাদ জিগ্‌গেস করে।

– খুশি অইবো না! সিতারা বিস্ময় চাপা দিতে পারে না, অমন চান্দের মতন পোলা পাইছে!

চান্দের মতন পোলা, চান্দের মতন পোলা পাইছে মিরাদ-শব্দ ক’টি সে মনে মনে বারবার আওড়ায়। একটি ছবি আনাবার চেষ্টা করে ধারনায়। কিন্তু জীবনে কোন ছবিই তো তার মনে এলো না। রঙ আর ছবির দুনিয়ায় ঢুকবার অধিকারই সে পায়নি। ও জগত থেকে মিরাদ নির্বাসিত! দুনিয়ার রঙের ভোজে তার আমন্ত্রন নেই!

তবু তার মনে হয়, ছেলেটি সুন্দর হয়েছে দেখতে। সুন্দর..সুন্দর মানে কী? জীবনে রোজই এও শব্দটি সে শুনছে। সুন্দর কী, বুঝবার চেষ্টা করে মিরাদ; কিন্তু কই, আজো তো সে কিছুই বুঝলো না। তাকেও তো লোকে সুন্দর বলে। তাহলে এর অর্থ কী! নিজের নাক মুখ শরীর হাতড়িয়ে মুরাদ বুঝতে চেয়েছে, কী এ শব্দটির মানে। একটা ধারণাও যে তার না হয়েছিল তা নয়। তারপর, একদিন যখন শুনলো, তার স্ত্রী জয়নাব কেবল সুন্দরী নয়, অনুপমা, তখুনি তার ধারণার মধ্যে বাঁধলো এক দারুণ সংঘাত। জয়নাবের সারা শরীর জরীপ করে সৌন্দর্যের যে চড়াই-উৎড়াই সে ভাংলো তাতেই তার মনে হলো, সৌন্দর্য একটি কথার কথা, এর কোন নির্দিষ্ট মানে নেই, অবয়ব নেই। সেই থেকে যখন কেউ সুন্দরের কথা বলে মিরাদের ভাবনায় একেবারে তালগোল পাকিয়ে যায়। বুঝবার চেষ্টা করেও এর কোন অবয়ব সে খুঁজে পায় না।

মাঝে মাঝে মিরাদের মনে হয়, সৌন্দর্য তাহলে একটা স্বাদ, একটা সুগন্ধ, একটা অনুভুতি!

চাঁদের মতো মুখ! কিন্তু মিরাদের আসমানে তো চাঁদ উঠেনি-কখনো চাঁদ অস্তও যায়নি! এ আসমানে সূর্য ওঠে না, সুর্য ডোবে না। তাহলে মিরাদ চাঁদের মতন পুত্র পেয়েছে, কী এর অর্থ? হঠাৎ তার মনে হলো, তার পুত্র তার পুত্রেরই মতো, এ কথা ভাবতে অসুবিধা কী? সে আর কারো মতোই নয়, এই অর্থেই সে সুন্দর।

মিরাদের চোখের পাতা ঘন ঘন ওঠা নামা করতে থাকে।

বাসর রাত। সারাদিন ঝড়-তোফানের পর, এখন যে ঘরের বাইরে পৃথিবী জোছনায় ঝলমল করছে, মিরাদ সে খবর রাখে না। এই ঝড়-তোফানের মধ্যেও শোরগোল, হৈ-হল্লা কম হয়নি, আর যাই হোক, বিয়েবাড়ি তো। ঝড়-তোফান মাথায় করেও এসেছিল মিরাদের খেশ-কুটুম আর ইয়ার দোস্তরা।

বলা যায়, ইয়ার-দোস্তরাই জোর করে মিরাদের শাদি দিয়েছে। এখন সবাই সরে পড়েছে; বাসর ঘরে, কেবল দুল্‌হা আর দুল্‌হিন।

কাচারি ঘরে এখনো হ্যাজাক বাতি জ্বলছে আর বাসর ঘরে ধুঁয়া ছেড়ে ছেড়ে লাল আলো দিচ্ছে একটা হারিকেন।

কিন্তু মিরাদ তার কিছুই জানে না।

কেবল ওর বুকের ভেতরটাই ধুক ধুক করছে, আর তাঁরই শব্দ সে শুনছে, আর শুনছে আরেকটি বুকের শব্দ, যেন আঁধার রাতে সব শব্দ হারিয়ে যাওয়ার পর, সময়ের বুকের উপর দিয়ে টিক্‌টিক্‌ করে আগিয়ে চলেছে একটি টেবল ঘড়ির কাটা।

মিরাদের পাশেই রয়েছে জয়নাব, মাছিমপুরের করম আলী ফকিরের মেয়ে। ফকিরের ছেলে তিনটি কিন্তু মেয়ে মাত্র একটিই। সাদ্যি মতো শাড়ি-ব্লাউজ আর জেওর-পাতিতে মেয়েকে সাজিয়ে দিয়েছেন করম আলী। খেশ-কুটুম সবাই ঘোর আপত্তি তুলেছিল, মেয়েটির মা নেই বলেই কি তাকে সমুদ্দুরে নিক্ষেপ করতে হবে? এভাবে জেনেশুনে তার একমাত্র মেয়ের সর্বনাশের ইচ্ছা কী করে করছেন করম আলী?

কিন্তু করম আলী কারো মানা শুনতে রাজি নন। ছেলেটিকে দেখে অবধি তার মায়ায় তিনি আটকা পড়ে আছেন। আশ্চর্য এক স্নেহ-মমতায় মনটা তার ভরে উঠেছিল। করম আলী নিজে একজন শিল্পী, একজন গায়ক। জেনে শুনেই তিনি জয়নাবকে তার হাতে তুলে দিয়েছেন।

কিংবা উল্টা করে বলা যায়, মিরাদকেই তিনি তুলে দিয়েছেন জয়নাবের হাতে।

নতুন বউরা লাজ-শরমের প্রতিমা হয়ে ওঠে বাসর ঘরে। ওরা থাকে সলজ্জ প্রতীক্ষায়, উন্মোচিত হবার জন্যে। ঘোমটা তুলে নেকাব উঠিয়ে সৌন্দর্যের ভাণ্ডার উদ্‌ঘাটনের দায়িত্বটা দুল্‌হাকেই নিতে হয়।

কিন্তু নতুন বউ জয়নাবের মাথায় ঘোমটা নেই, মুখে নেকাব নেই। ঘন নিবিড় দৃষ্টি মেলে ও বারবার মিরাদকে দেখে। কত সুন্দর তার বর! গায়ের রংটা যেন পাকনা রাতা ধানের মতন! কপালটা কত চওড়া! ধারালো বড়শীর মতো বাঁকানো নাকের নিচে চিকন ঠোঁট দু’টি মৃদু কাঁপ্‌ছে। মাথা ভরা কোঁকড়ানো ঘন বাবরির ঢঙে ছাটা, মাঝখান দিয়ে সিথি।

তন্ময় হয়ে দেখে জয়নাব। কিন্তু মিরাদ ওকে দেখছে না। কেমন তার চোখ মুখ, তার গায়ের রঙ, হাসতে গিয়ে কেমন হয় তার ঠোঁটের ভংগি, কেমন করে গালে টোল পড়ে নদীর আবর্তের মতো, মিরাদ কিছুই জানে না।

কেবল জয়নাবই মিরাদকে দেখছে। মিরাদ কি চোখ বুঁজে আছে? নাকি সে ধ্যানে ডুবে আছে, অন্য কিছু ভাবছে? তা নয়। জন্মের পর সে কখনো দেখেনি পৃথিবীর আলো, এর রঙের সমারোহ। আলো আঁধার শাদা-কালো কিছুই সে বোঝে না, জানে না।

জয়নাব পলকহীন চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে। পরম যত্নে সাজানো একটা মূর্তি যেন মিরাদ। হাসির ছটা খেলা করছে ওর ঠোঁটে, পানির উপর জোছনার খেলার মতো। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে ঠোঁট দু’টি।

এক সময়ে, মিরাদের চোখ থেকে টস্‌টস্‌ করে আঁসু ঝড়ে পড়ে। তার মসৃণ গালের উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বড় বড় ফোটাগুলি পড়ে তার বুকের উপর।

জয়নাব শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মোছে। কিছুতেই নিজেকে ও সামলাতে পারছে না। কান্নার দরিয়া উথাল-পাথাল করছে তার বুকের ভেতর। বারবার চোখ মোছে আঁচল দিয়ে, আর সেই আঁচল দিয়েই মুছে দেবার চেষ্টা করে মিরাদের চোখ, মিরাদের গাল, মিরাদের বুক।

এই স্পর্শ বিদ্যুতের একটা কম্পন, একটা তরংগের মতো মিরাদের গোটা চেতনায় ছড়িয়ে পড়ে তাকে ব্যাকুল করে তোলে। তার বুকে ঘুমন্ত সমুদ্দুর উদ্বেল হয়ে ওঠে। আন্দাজের উপর সে জয়নাবের ডান হাতপাখা চেপে ধরে, আর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে, দেখো, আমারে দুষ দিওনা!  – আমি বিয়া করতে চাই নাই, ওরা জোর কইরা বিয়া দিছে।

এবার জয়নাব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। সুরমার কাজল-টানা চোখ দু’টি ওর আসুর ধারায় ঝাপ্‌সা হয়ে ওঠে; তারপর সকল সংকোচ কাটিয়ে উঠে সে বলে – কেন, আমি কী দুষ করছি তুমার কাছে?

– তুমি কী দুষ করবা? ডান হাতে বন্দী জয়নাবের হাতের উপর বাঁ হাতটা বুলাতে বুলাতে মিরাদ বলে দুষ তুমার কপালের!

– আমার কপালের দুষ! জয়নাবের ঠোঁটে একটা করুণার হাসি স্ফুরিত হয়, দুষ না-আমার কপাল গুণেই তুমারে আমি পাইছি!

জয়নাব কি ঠাট্টা করছে? মিরাদের কাছে কেমন যেন শ্লেষের মতোই মনে হয় কথাগুলি-না, এ তুমার মনের কথা না!

মিরাদ চুপ করে থাকে। দোস্ত-ইয়ারদের কাছে শুনেছে-পয়লা দু’চার দিন নাকি মুখ ফুটে কোন কথাই বলতে চায়না নতুন বউরা। চুপ করে নিরীক্ষণ করে সব কিছু, আর যা-কিছু দেবার, স্বামীকে ওরা দেয় দেহ দিয়ে, শরীর দিয়ে!

কিন্তু কী আশ্চর্য, জয়নাবের মধ্যে কোন সংকোচ নেই, লাজ-শরমের বালাই নেই। বরং জয়নাবই কথা বলে চলেছে, আর মিরাদ যেন বাধ্য হয়ে কেবল তার কথার জবাব দিচ্ছে।

আগের মতোই, জয়নাবের হাতের উপর হাত বুলাতে বুলাতে মিরাদ বলে দেখো, কোনটা মনের কথা আর কোনটা মুখের কথা, আমি টের পাই!

-তা-ইলে, আমি আর কুনু কথা কমু না তুমার লগে, টেনে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে জয়নাব অভিমানে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।

আবার অনেকটা জোর করেই জয়নাবের বাঁ হাতটা মিরাদ নিজের কোলে টেনে নেয়, আর স্নিগ্ধ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে বলে-রাগ কইরো না; জন্ম থাক্যাই আমার চোখ দু’টা নাই। এ অভাগারে লইয়া জিন্দেগী তুমি কেমনে কাটাইবা, কও?

কিছুক্ষণের জন্যে জয়নাব নীরবতার অথৈ সাগরে ডূব দেয়, তারপর হঠাৎ ছাড়া-পাওয়া নির্ঝরের মতো কলকলিয়ে ওঠে-কে কয় তুমার চউখ নাই? আমিই তুমার চউখ!

এক আশ্চর্য রহস্যময় উক্তি! মিরাদ তারই অতলে কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে যায়! তারপর, আবার চেতনার সমতলে ভেসে উঠে বুঝবার চেষ্টা করে এর তাৎপর্য।

-আমার চউখ দিয়া দেখবা তুমি, জয়নাব আরো স্বচ্ছ, আরো বোধগম্য হবার চেষ্টা করে।

অলৌকিক এক আলোতে ধীরে ধীরে মিরাদের মুখখানা উদ্ভাসিত হয়, তার সংগে তার নিষ্প্রভ অন্ধকার চোখ দু’টি থেকে নামে আঁসুর ঢল। রোদের আলোয় ঝলোমলো পৃথিবীকে এক পশ্‌লা বৃষ্টি যেন ধুয়ে দিয়ে যায়। একবার সে বলে – হাচাই দেখুম?

-হে, হাচাই দেখবা, জয়নাব তার সুগন্ধি তেলে সুবাসিত মাথাটা মিরাদের বুকের উপর রাখে, আমি তুমার চউখ অইয়া তুমারে পথ দেখামু, পথ দেখাইয়া তুমারে লইয়া চলুম।

এক অনাস্বাদিত সুরভির ঢেউ তুলে, প্রগাঢ় সুখের এক হিল্লোল মিরাদের গোটা চেতনার উপর দিয়ে বয়ে চলে।

তার মনে পড়লো, তার হামেশ-খনের সাথী মুবারক বলেছিলঃ ছেলে কও, মাইয়া কও, কেউই, পুরা মানুষ না। আদম থাক্যাই হাওয়া। দুইজনে মিল্যা তয় না একজন মানুষ। আর এর লাগ্যাই বিয়া-শাদি। দোস্ত, বিয়া না অইলে পুরা অয়না মানুষ-জীবনের রাস্তায় একলা চলন যায় না।

অতো দিনে মুবারকের কথাগুলির অর্থ মিরাদের কাছে ধীরে ধীরে শরীরী হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

মুবারক নিজেও একজন গায়ক-মিরাদের দোস্ত ভক্ত দু-ই। মিরাদের একতারাটি ও রাখে নিজের বুকের উপর, তারপর মিরাদের হাত ধরে এক জা’গা থেকে আরেক জা’গায় নিয়ে যায়। মুবারক কেবল অন্ধের লাঠি নয়, অন্ধের আঁখিও বটে।

এখন থেকে জয়নাব হয়ে উঠবে তার চোখ, আর চোখ হয়ে তাকে পথ দেখাবে সারা জীবন।

মিরাদ টের পায় তার বুকের জামা যেন ভিজে উঠছে।

জয়নাব কি তাহলে নিঃশব্দে কান্নায় বিগলিত? তার চোখের নীরব আঁসুধারা মিরাদের হৃদয়ের উপর দিয়ে যেন গড়িয়ে চলেছে। দু’হাত দিয়ে জয়নাবের সুবাসিত মাথাটা চেপে ধরে মিরাদ, আর জয়নাবের মুখের উপর নিজের মুখটা তুলে ধরে বলে-তুমি কান্‌তাছো?

জয়নাব আর কথা কয়না; আঁসুতে ঝাপ্‌সা চোখ দু’টি তার কিছুক্ষণ থির হয়ে থাকে মিরাদের মুখের উপর। আগের মতোই, তার চোখের পানি ছিন্ন তস্‌বি দানার মতো গড়াতে থাকে তার গালের উপর দিয়ে।

আর সেই উষ্ণ আঁসুর স্পর্শে, মিরাদের হৃদয় যেন বরফ-গলা দুঃখের নদী হয়ে কুলু কুলু বইতে থাকে-এই অভাগা অন্ধের লগে তুমার বাপে তুমারে বিয়া দিসে, এই দুঃখে তুমি কান্‌তাছো!

জয়নাব স্প্রিংএর মতো ত্বরিত তার ডান হাত তুলে মিরাদের মুখ চেপে ধরে – ছিঃ অমন কথা কইও না।

-তবে তুমি কান্‌তাছো কেন?

-মানুষ কি খালি দুখ্‌খেই কান্দে?

-তবে?

-সুখেও কান্দে মানুষ।

-তুমি মিছা কইতাছো।

-না গো-না, আমি হাচা কথাই কইছি, বলতে বলতে জয়নাব এবার দু’বাহু মেলে মিরাদকে জড়িয়ে ধরে।

আবার নিঃশব্দের গহনে মিরাদ হারিয়ে যায়। কী এক অপূর্ব উল্লাসে তার দেহের প্রতিটি অণুপরমাণু থেকে গানের একেকটা রাগিনী যেন পাখা মেলতে শুরু করেছে।

দৃষ্টি-হীন করেই স্রষ্টা তাকে সংসারে পাঠিয়েছেন। নারী যে কী বস্তু তা-ও মিরাদ জানে না। বন্ধুরা নানাভাবে তার কাছে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে নারীর রূপ। কিন্তু মিরাদের কাছে নারীর কোন রূপই আজো পষ্ট নয়। রুপের জগতের কপাট তার জন্য বন্ধ। রুপের এই মহোৎসবে, চোখের এই ভোজে তার দাওয়াত নেই।

মিরাদ ডান হাত দিয়ে জয়নাবের পিঠে থাবা মারতে মারতে বলে-

আমার কী মনে লইতাছে জানো?

-কী? জয়নাব ঔৎসুক্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

-তুমি যেন একটা বাদ্যযন্ত্র, থাবা দিলেই সুর উঠবো।

একটু চুপ করে থেকে আশ্চর্য যাদুকরী এক ভংগিতে জয়নাব বলে ওঠে – বাজাও না তোমার ইচ্ছা মতো – জয়নাব নিজেই যেন বংশীধ্বনি হয়ে ওঠে।

আগের মতোই জয়নাবের পিঠে থাবা মারতে মারতে মিরাদ বলে – দেখো, তুমি মিশ্যা আছো আমার বুকের লগে, তবু তুমার লগে দেখে অইলো না। জীবন থাকতে কুনুদিনই দেখা অইবো না, আহা, মিরাদ কথা শেষ করতে পারে না, তার অন্ধকার চোখ দু’টি থেকে তরল পারার মতো ফোঁটা ফোঁটা পানি গাল বেয়ে গড়াতে থাকে।

জয়ানব মেঘের জটলা-পাকানো আকাশের মতো কান্নায় ভেঙে পড়তে চায়। তবু নিজকে সামলে নিয়ে বলে – কেন দেখা অইবো না? মিরাদের মুখে একটা ক্লিষ্ট করুণ হাসি ফুটে ওঠে, সে কোন কথা বলে না।

– মাইনষে কি কেবল চউখ দিয়াই দেখে?

– তয়?

– মাইন্‌ষে হাত দিয়া দেখে, গতর দিয়া দেখে, মন দিয়াও দেখে – সহজ জয়নাব আচমকা কেমন যেন রহস্যময় হয়ে ওঠে।

– হাচাই? নৈরাশ্যের অপার অতল দরিয়ায় ভাসা ডিঙির পালে হঠাৎ যেন আশার অনুকূল হাওয়া লাগে।

– আমি তুমারে স-ব দেখামু-বহু দূর থেকে ভেসে আসা এ ব্যাকুল সুরের আমেজ জাগে জয়নাবের গলার আওয়াজে।

মিরাদ তর্ক করতে রাজী নয়। সে একেবারে নীরব হয়ে যায়, আর সেই নীরবতায় ঘুমিয়ে-পড়া প্রহরীর পাশ কাটিয়ে, অলৌকিক এক অনুভুতি তার হৃদয়ে ঢুকে তার সমস্ত অস্তিত্বকেই রাঙিয়ে তোলে। ফুলের পাপড়ি-মেলার মতো প্রচ্ছন্ন এক হাসি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে তার মুখখানা আলোয় উদ্ভাসিত করে। মিরাদ কথা বলে না, আগের মতোই হাত দিয়ে জয়নাবের পিঠের উপর তাল ঠুক্‌তে থাকে।

– কী কথা কইছো না যে? মিরাদের মুখের উপর চোখ মেলে ধরে জয়নাব জিগ্‌গেস করে।

– কী কমু, কও? মিরাদ জয়নাবের পিঠের উপর তাল ঠোকা থামিয়ে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, যার চউখ নাই তারে তুমি দেখাইবা কেমনে, কও?

– একিন অয় না বুঝি? জয়নাব আবার তার সুবাসিত মাথাটি মিরাদের বুকের উপর রাখে।

– কেমনে বিশ্বাস করুম আমি? হঠাৎ মিরাদের বুক ছলছল করে ওঠে। জয়নাব একটু চুপ করে থাকে; তারপর বলে-কেন? কেবল চউখ দিয়া দেখলেই বুঝি বিশ্বাস অয়? ধরতে পারলে, ছুইতে পারলে বুঝি বিশ্বাস অয় না? একটু থেমে বিস্ময়কর এক প্রশ্নে সে একেবারে লা-জওয়াব করে দেয় মিরাদ কে – আচ্ছা, দেখা বড় না, পাওয়া বড়?

বহুক্ষণ মিরাদ কোন কথাই খুঁজে পায় না। বেশি কথার মানুষ সে কোনোদিন নয়। তার বুকের তলে, ভাবের সাত সমুদ্দুরে বয়ে চলে কত স্রোত! মাঝে মাঝে সেই সমুদ্দুরের সংগীত তার বুকে ভাষা পায় গানের আকারে, যেন কান্না-ভরা আকাশের বিলাপ। অন্যথায়, মিরাদ কথা খুব কমই বলে। আসলেই ও একজন শ্রোতা, সারা চেতনা দিয়েই শোনে, অনুভব করে। শ্রবণ আর পরশের দুই স্রোত বয়ে জগৎ এসে নামে তার হৃদয়ে, শ্রাবণের ঢলের মতো।

মিরাদ করম আলীর মেয়ে জয়নাবের মতো কলকলিয়ে উঠতে জানে না। করম আলীর বাড়িতে থেকেই সে গান শিখেছে। বিয়ের আগেও জয়নাবের কথা সে বহুবার শুনেছে। আজ সেই জয়নাব তার বুকে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে আশ্বাসের কথা শুনাচ্ছে। জয়নাব নিজেই যেন একটা আশ্বাস, অন্ধকার সমুদ্দুরে আশার একটা বাতিঘর!

আচমকা স্নিগ্ধ প্রশান্তির এক হিল্লোল মিরাদের হৃদয় মনের উপর পরশ বুলিয়ে যায়। আবার সে ডান হাত দিয়ে জয়নাবের পিঠের উপর তাল ঠুকতে শুরু করে।

– তুমি দেখ্‌তেছো আমারে? – মিরাদের মুখের কাছে মুখ তুলে প্রশ্ন করে জয়নাব।

সে কি হ্যাঁ বলবে জবাবে? – মিরাদ নিজেই নিজকে মনে মনে জিগ্‌গেস করে। তারপর ছোট্ট জবাব দেয়-না-তো!

– তাইলে, দেখো ভালা কইরা!

– কেমনে দেখুম? দ্বিধা মেশানো গলায় আগের মতোই মিরাদ প্রশ্ন করে।

এই যে দেখো, বলতে বলতে জয়নাব নিজকে প্রায় অনাবৃত করে মিরাদের হাতের নিচে ছড়িয়ে দেয়। প্রথমে সে মিরাদের ডান হাতখানা রাখে নিজের মাথার উপর, আর বলে-কিছু দেখতাছো?

– হ্যাঁ।

– কী।

– একটা মাথা, মাথা ভরা চুল, আর নাকে তার খোশবু পাইতাছি।

জয়নাব মিরাদের হাতটা নিজের কপালের উপর দিয়ে গড়িয়ে এনে তার চোখ আর নাকের উপর রাখে-কী দেখতাছো অখন? – প্রশ্ন করে জয়নাব।

– তুমার ভুরু তুমার ডাগর ডাগর দুইটা চউখ, চউখের পশমগুলি লম্বা লম্বা-ঘন ঘন তুমি চউখের পাতা মেলতাছো আর বুজতাছো। আর তুমার নাকখানা উঁচা, চিক্‌কন, ঠোঁট দুইটা পাতলা, ভিজা ভিজা – একটু থেমে মিরাদ জিগ্‌গেস করে – কেমন, ঠিক কইছি না?

– বিলকুল ঠিক কইছো, জয়নাব একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, তাইলে বুঝতে পারছো, চউখ না থাকলেও দেখান যায়!

– তাইলে আরো দেখো, জয়নাব মিরাদের ডান হাতটা তার বুকের উপর, পিঠের উপর দিয়ে টেনে টেনে তার পায়ের পাতা পর্যন্ত নিয়ে যায়। এভাবে, তার সর্বাংগের উপর দিয়ে সে কয়েকবারই টেনে নিয়ে যায় মিরাদের হাত, কখনো উজান ঠেলে, কখনো ভাটি পথে, তারপর বলে, কেমন দেখলা তুমি আমারে?

দু’বাহু মেলে জয়নাবকে নিজের বুকের উপর টেনে নিয়ে সে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। কী জবাব দেবে সে? সৌন্দর্যের চড়াই উৎরাই ভেঙে সুখের শিখরে সে পৌছছে, সেখানে তো কেবলি নির্বাক বিস্ময়, সেখানে তো কেবলই নিশব্দ উপলব্ধি।

– কী কথা কও না যে! জয়নাব আবার ঝলমলিয়ে ওঠে।

– কইবার কী আছে, কও? আঁধার চোখ দু’টির পাতা ঘন ঘন নাচাতে নাচাতে মিরাদ বলে-কোথায় কুলাইবো না! মুহূর্তের জন্যে মিরাদ নিশ্চুপ হয়ে যায়, তারপর জয়নাবের পিঠে আবার ডান হাত দিয়ে তাল ঠুক্‌তে ঠুক্‌তে বলে-আর কথা না। আমারে এট্‌টু বুঝতে দেও।

আর এভাবেই ফুরিয়ে আসে মিরাদের পয়লা বাসর রাত-মোরগ বাঁক দিতাছে, বাহুর বাঁধন শিথিল করে দিয়ে, জয়নাবকে সোজা করে বসিয়ে দেয় মিরাদ।

– আযান দিবো এখুনি, জয়নাব নিচু গলায় বলে, পূব আসমান পশর অইয়া গেছে।

মিরাদের মুখে কৃষ্ণ পক্ষের শেষ চাঁদের মতো একটা করুণ হাসি ফুটে উঠলো।

হারিকেনের ক্ষীণ আলোতে সে হাসি দেখেই জয়নাব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে – হাসি তো নয়, যেন বৃষ্টির আগে রোদের রঙলাগা ঘন মেঘ। জয়নাব জানে না, মিরাদের রাতও নেই, দিনও নেই।

 

ওস্তাদ করম আলী পয়লা সে দিন মিরাদকে দেখেন, তিনি চমকে উঠেছিলেন।

কলমাকান্দা বেড়াতে এসেছিলেন। পায়ে-পাঁটা একটি পথ বাসাউড়ার সুমুখ দিয়ে এসে মিলেছে সড়কের সাথে। হাতে লাঠি আর কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে বাসাউড়ার একটা বাড়ির সামনে দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন। হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে উঠেনঃ বারান্দায় জল-চৌকির উপর দু’হাত দিয়ে তাল ঠুক্‌তেঠুক্‌তে কী যেন গাইছে এক কিশোর; গলার রগ তার ফুলে ফুলে উঠছে –

যেন নবীন কবুতর জীবনে এই পয়লা গাইবার চেষ্টা করছে!

মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন করম আলী। জহুরী এক দুর্লভ রত্নের সাক্ষাৎ পেয়েছেন।

বাড়িটি তার চেনা। পুরোনো বনেদী এক পরিবারের বাড়ি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন-এ বাড়িরই সদরুদ্দিনের কনিষ্ট পুত্র ঐ কিশোর। তার চেহারা-সুরত প্রথম দৃষ্টিতেই চমক লাগিয়ে দেয়, এমনি সুন্দর সে। কিন্তু পৃথিবীতে সে এসেছে এক নিদারুণ দুঃখ নিয়ে, জন্ম থেকেই সে দৃষ্টিহীন।

সেই থেকে করম আলীর মন জুড়ে রইলো মিরাদ।

শিল্পী হিসাবে করম আলীর অনেক নাম-ডাক; বলতে গেলে ভাটি মুলুকে তিনি গানের রাজা। তিনি নিজে গান তৈরি করেন, সুর দেন, আবার নিজেই গেয়ে ফেরেন। পল্লী গানের আসরে এ অঞ্চলে তাঁর জুড়ি নেই। তাঁরও দীলের আরজু – তিনি মিরাদকে গান শেখাবেন – গানের রাজ্যে তিনি ওকে তার উত্তরাধিকারী বানাবেন, তার গানের সব কিছু তিনি দিয়ে যাবেন ওকে।

করম আলী প্রস্তাব দেন সদরুদ্দিনের কাছে- ছেলেডারে আমার লগে দিয়া দেন। এক বচ্ছর আমার বাড়িতে রাখুম। অতোদিন না-ও লাগতে পারে। গান শিখাইয়া পরে আপনার ধন আপনারে ফিরাইয়া দিমু।

সদরুদ্দিন কিছুতেই রাজী হতে চাননি। গান যে তার খুব অপছন্দ টা নয়। জারী আর মুর্শীদি গান শোনার জন্যে আজো সারারাত তিনি জাগ্‌তে পারেন। তবু তার ছেলে গায়ক হবে, তার অন্তর কিছুতেই সায় দিতে চাইলো না। বরং, তাকে কুরআনের হাফিজ বানাবারই তাঁর খায়েশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হয়ে যান। গায়কের ইজ্জত আছে, এ তিনি দেখেছেন। এই গান তাঁর পরিবারে ইজ্জতের কারণও তো হতে পারে। ময়মনসিংহে একবার তিনি আব্বাসুদ্দীনকে দেখেছেন, তাঁর গান শুনেছেন। কত তাঁর খ্যাতি। তাঁদেরই এলাকার একটা উপজাতীয় ছেলে কত নাম করেছে গাইয়ে হিসাবে – এখন ঢাকা থাকে।

করম আলী যেন হাতে আসমান পেলেন। মিরাদকে তিনি নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। এক বছর থাকতে হয়নি – ন’মাসের মধ্যেই ওস্তাদ করম আলীর ভাণ্ডার উজাড়, তিনি গানের যা কিছু জানেন সবই মিরাদ আয়ত্ত করে ফেলে। বলা যায়, ওস্তাদ তাঁর হৃদয়কে মিরাদের বুকের ভেতর ঢেলে দিলেন উপুড় করে।

তখন থেকেই কিশোর মিরাদের জন্যে নানা জায়গা থেকে দাওয়াত আসতে লাগ্‌লো। ফুলের খোশবুর মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খোশ্‌নাম।

মিরাদ তাজ্জব হলো যখন একদিন প্রস্তাব এলোঃ ওরা ওকে নিয়ে যেতে চায় এক গানের আসরে, তার জন্যে কিছু মজুরিও ওরা দেবে। গলা বেচে তাহলে কামাই করা যায়!

কিন্তু এ কেমন করে সম্ভব? গান, গলার সুর, আল্লাহ্‌র দেওয়া নিয়ামত! এর বদলে সে মানুষের কাছ থেকে মজুরি নেবে কি করে? শেষ পর্যন্ত এর একটা সমাধান তার নিজের মনেই উদয় হলো। সে কখনো টাকা কড়ি চাইবে না, কারো সাথে কখনো দর কষাকষি করবে না। তবে, কেউ যদি ইচ্ছা করে কিছু দেয়, নিতে দোষ কি? এতো আলো হওয়ার মতোই আল্লাহ্‌র রহমত!

তখন থেকেই, তার গান শুনে কেউ তাকে কিছু দিলে, সে টা আনন্দের সাথে গ্রহণ করে। অনেকে তাকে জোর-জবরদস্তি করে টাকা পয়সা গছায় – তবু তাকে যেতে হবে হরেক জায়গায়, গানের আসরে – অংশ নিতে হবে প্রতিযোগিতায়।

অদ্ভুত মিরাদের লেহান, আর তার স্মৃতি-শক্তি – সেতো অপূর্ব! এজন্য সদরুদ্দিনের মুর্শিদ তাকে বলেছিলেন-ছেলেটি যখন পার্থিব আলো থেকে বঞ্চিত হয়েই জন্মেছে, ওর বুকের ভেতরে ঢেলে দাও আল্লাহ্‌র নূর, ওকে কুরআনের হাফিজ বানাও।

কিন্তু তার সে আশা পুরা হলো না। এ জন্যে সদরুদ্দিনের মনে খেদ্‌ রয়েই গেছে। কিন্তু যখন তিনি ছেলের তারিফ শোনেন, তার চারদিকে ছড়িয়ে পড়া খ্যাতির কথা মনে করেন তখন তার মনে হয়, আল্লাহ্‌ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন। মিরাদ যে অন্য কিছু না হয়ে গায়ক হয়েছে, এ হয়তো আল্লাহ্‌রই ইচ্ছা, হয়তো গান দিয়েই তার কাছ থেকে খিদ্‌মত নেবেন আল্লাহ্‌।

এ কারণে সদরুদ্দিন আর আফ্‌সোস করেন না। ছেলে তাঁর একটা-কিছুতে ডুবে থাকুক, তার জীবনের দুঃখ ভুলে থাকুক, বাপ হয়ে এর বেশি আর কীই বাঁ তিনি চাইতে পারতেন? মিরাদ সুরের জগতে মজে আছে, এতেই তাঁর সান্ত্বনা।

তার বাপ না হয়েও করম আলী তার গলায় দিয়েছেন সুর, আর এমনি করে তাকে মুক্ত করেছেন মাটির বাঁধন থেকে। মিরাদ এখন আকাশের মুক্ত বিহংগ।

আর তার চেয়েও বড় কথা, করম আলী তাঁর একমাত্র কন্যা জয়নাবকে মিরাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, জীবনভর তাকে পথ দেখাবার জন্যে। দশ-দাঁড় ইস্কুলে ছেলেদের সাথে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ক্ষান্ত দিয়েছিলো জয়নাব। মা-মরা, নিজের হাতে গড়া সেই জয়নাবকে তিনি উপহার দিয়েছেন তার প্রিয় সাগ্‌রেদ্‌কে।

করম আলীর আত্ম-বিশ্বাস বিপুল।

 

বাপ হওয়া, এ যেন এক রহস্যময়, অলৌকিক ব্যাপার। বিশ্বাস করতে কেমন যান দ্বিধা হয় মিরাদের। শরীর উঠতে চায়না, সংকোচের চাইতে ভয় আর আশংকা তার বেশি।

– চলো না ভাইয়া, প্রায় মিনতি করে সিতারা, ভাবী বার্‌ চাইতাছে তুমার দায়।

– তুই যা তর ভাবীর কাছে, নৈশঃব্দের অতল থেকে একবার কথার বুদ্‌বুদ্‌ ওঠে, ভোমরার পাখার মতো চোখের পাতা ওর ঘনঘন নাচতে থাকে-চেষ্টা করেও মিরাদ উচ্ছ্বাস চাপা দিতে পারছে না – হেরে গিয়া ক’ আরাম করতে। আমি আসুম্‌নে পরে।

– না, তুমি আমার লগে লও, সিতারা পীড়াপীড়ি করে, নইলে ভাবী মনে করবো, তুমি খুশি অও নাই।

– ধ্যেৎ অমন কথা কইস্‌ না, ধমক দেয় মিরাদ, তর ভাবী আমারে চিনে। সিতারা হাল ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়ে।

যখনি নির্জন হয়, পানির বুদ্‌বুদের মতো, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের মতো, জীবন-মৃত্যুর রহস্যের কথা কখনো ভাবনার আকারে অবচেতন থেকে উঠে আসে তার চৈতন্যের সমতলে, কখনো হয়ে ওঠে শ্রুতি-গোচর। ভাবের গানেই মিরাদ মশগুল হয়ে থাকে, মুখে মুখে নিজেই রচনা করে কত গান। নামায-রোজাকে তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়নি কখনো।

কিন্তু আজ সে এক অদ্ভুত কাজ করে বসলো; অপূর্ব মিষ্টি লেহানে আযান দিয়ে সে ফজরের নামাযে দাঁড়িয়ে গেল।

এ যেন মিরাদের নতুন জীবনের অভিষেক।

সুপারী গাছের ফাঁকে ফাঁকে সকালের রোদ এসে পড়েছে উঠানে। ভোর হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। মা এসে হাত ধরে মিরাদকে নিয়ে যান জয়নাবের ঘরে।

তুষের আগুনে কিছু সর্ষে পুড়িয়ে, তারই ধুঁয়া লাগিয়ে, সর্ষে-পোড়া গন্ধের মধ্য দিয়ে মিরাদ জয়নাবের ঘরে ঢোকে।

সিতারা একটি জল-চৌকি আগিয়ে দিয়ে বলে-এইখানে বও।

মিরাদ ধীরে ধীরে জল চৌকিটির উপর বসে পড়ে। একটা নতুন কাঁথায় পেঁচিয়ে নবজাত শিশুকে মিরাদের কোলে দিলেন না।

কিছুক্ষণের জন্যে, মিরাদ গহন সাগরের তলদেশের মৌণতায় হারিয়ে যায়। তার হাত কাঁপতে শুরু করে, বুকের ভেতরে তার সামুদ্রিক উচ্ছ্বাস শুরু হয়। চোখের পাতা তার ঘন ঘন ওঠানামা করতে থাকে।

– জানোস্‌? কী লম্বা চুল অইছে তর পুতের মাথায়! নিস্পলক চোখে মিরাদের মুখের উপর চোখ রেখে মা বলেন।

মিরাদ আলতো করে হাতটা শিশুর মাথায় রাখে-সত্যি, আশ্চর্য রকমের লম্বা আর ঘন চুল নিয়ে জন্মেছে তার পুত্র। সে নিজেও নাকি এরকম ঘন চুল নিয়েই জন্মেছিলো।

– আর কপালডা দেখ্‌ছোস্‌, কত বড়ো?

মিরাদ এবার ডান হাত দিয়ে আন্দাজে শিশুর কপাল স্পর্শ করে। সত্যি বলেছেন মা, ভারি চওড়া আর মসৃণ তার পুত্রের কপাল, হাত দিয়েই মিরাদ বুঝতে পারে। চওড়া কপাল নিয়ে জন্মালে নাকি ছেলেরা ভাগ্যবান হয়। মিরাদের বুকের ভেতরে ফুস্‌ফুস্‌ যেন আনন্দে স্ফীত হয়ে উঠতে চায়।

– নাক-মুখ অক্কবারে তোরই পাইছে, মা’র গলায় গভীর তৃপ্তির আমেজ, আর রঙ পাইছে কাঁচা সোনার মতন!

আলতো করে শিশুর নাকে-মুখে মিরাদ হাত বুলায়, তারপর আবার নিজের নাক-মুখের উপর হাত বুলিয়ে মা’র কথা বুঝতে চেষ্টা করে। হয়তো ঠিকই বলেছেন মা।

কিন্তু কাঁচা সোনার মতন রঙ, সে আবার কী? কাঁচা সোনা, পাকা সোনা কিছুই বোঝে না মিরাদ। তার কাছে তো কালাও নেই, ধলাও নেই। রঙ তাহলে অমন জিনিস, যা স্পর্শ করা যায় না, উঁচু-নিচু ঠাণ্ডা-গরম, সুগন্ধ-দুর্গন্ধ, কিছুই নয়-যা কেবল চোখই বুঝে, আর কেউ বোঝে না!

মিরাদ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছু জিগ্‌গেস করতে সাহস পায় না।

জয়নাবের ঠোঁট দু’টিতে স্নিগ্ধ হাসি খেলা করে-ক্লান্ত চোখ দু’টি তার ঔৎসুক্যে টলোমলো করছে আর ঠোঁট দু’টি তার কাপছে আঙুলের পরশ লাগা বীণার তারের মতো! বারবার জয়নাব তার একাগ্র নজর রাখছে মিরাদের মুখের উপর, লক্ষ্য করছে-মিরাদের মুখের, ঠোঁট-মুখ চোখের সূক্ষ্মতম রূপান্তর।

মা বাচ্চাটাকে ওর কোল থেকে নিয়ে আবার জয়নাবের পাশে শুইয়ে দেন।

আগের মতোই মিরাদ চুপচাপ, নিস্তব্ধ। সে কি দেখলো শিশুটিকে? দেখতে পাবে কোনদিন? কোলে নেবে, বুকে নেবে, চুমু খাবে-কিন্তু ওকে কখনো দেখতে পাবে না। ওর পুত্রের সাথে জীবনে কখনো ওর সাক্ষাৎ হবে না…এক চাপা ব্যাকুল কান্নায় মিরাদের বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যেতে চায়-বিক্ষুব্ধ সমুদ্দুর যেন ফুলে ফেপে উঠ্‌ছে। তার চোখের পাতা ঘন ঘন মেলতে ও বুঁজতে থাকে আর সাথে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে তার গাল বেয়ে।

জয়নাব আতংকিত হয়-তুমি সুখী অও নাই? মৃদু-স্বরে সে প্রশ্ন করে।

– আরে, তুমি জাগ্যা আছো? তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছ্‌তে মুছ্‌তে মিরাদ বলে, আমি ভাবছিলাম, তুমি ঘুমাইয়া আছো! একটু থেমে বলে-আমার কী ভয়ই না অইছিলো!

– কী ভয়? ঠোঁটে স্মিত হাসির আভাস এনে জয়নাব জিগ্‌গেস করে।

– কি জানি, তুমি যদি না বাঁচো-যদি পেট ফাট্যা মইরা যাও!

মিরাদের মুখের দিকে চেয়ে জয়নাব হেসে ওঠে। সে হাসি ক্ষীণ হলেও তার ধ্বনি মিরাদের কানে প্রবেশ করে দূরাগত সংগীতের মতো। জয়নাব বসে, শিশুর মাথার পাশে ডান হাতটা রেখে বলে-যা-ই হোক, বাঁইচা তো আছি। তুমি নি খুশি অইছো?

মিরাদ কোন জবাব দেয় না।

– তুমি কথা কইতাছো না যে? জয়নাবের গলার আওয়াজে হতাশার আভাস জাগে।

– কী কমু কও? এর কি কোন জবাব আছে? এক প্রগাঢ় উপলব্ধির চাপে মিরাদের কণ্ঠস্বর ভারাক্রান্ত, অমন করতে নাই, অমন সওয়ালের জবাব দেওন যায় না!

– কেন? জিগ্‌গাসায় জয়নাব উদগ্রীব হয়।

– যে কথা তুমি নিজে জানো, হে কথা আবার জানতে চাও কেন? তাতে কী সুখ?-কী লাভ? একটা অস্পষ্ট হাসি মিরাদের মুখে খেলা করতে থাকে।

এরপর জয়নাব আর কিছু বলতে সাহস পায় না। সে বেজায় হুশিয়ার হয়ে ওঠে। মিরাদকে আর কষ্ট দেবে না। দু’টি হৃদয়ের মধ্যে যে অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়েছে তারই উপর দিয়ে চলে ওদের একের দিকে অপরের হৃদয়ের সফর, দু’য়ের মধ্যে আলাপ। ভুল বোঝাবুঝির কারণ ঘটলেও অন্তর তার ফয়সালা করতে দেরি করে না।

– তুমি গোস্বা অইছো? অনেকক্ষণ পর মিরাদই আবার প্রশ্ন করে।

– কেন রাগ করুম?

– তুমার কথার জবাব দিই নাই বুইলা!

জয়নাব এবার এক অদ্ভুত মিষ্টি হাসিতে খানিকটা উচ্চকিত হয় – কে কয় তুমি জবাব দেও নাই? -একটু থেমে বলে, ভালা কথা জানা থাকলেও বারবার শুনতে ভালা লাগে, তাই না জিগাইছিলাম। নাইলে, আমি কি তুমার মনের কথা জানি না?

মিরাদের সমগ্র-মন আর অনুভুতি এক অপূর্ব তৃপ্তিতে সিঞ্চিত হয়ে ওঠে। চোখ দু’টি নাচাতে নাচাতে সে বলে-আগে সাইরা ওঠো। আল্লায় বাঁচাইয়া রাখলে কথা কইবার অনেক সময় পাইবা। অখন তুমি আরাম করো। একটু চুপ করে থেকে মিরাদ চিৎকার করে ওঠে-সিতারা-ও সিতারা-কই গেলি তুই?

বারান্দা থেকে ছুট্‌তে ছুট্‌তে সিতারা ঘরে এসে ঢোকে-কেন্‌গো ভাইয়া, কী অইছে?

– আমারে এট্টু ধর, আমার ঘরে লৈয়া যা। মিরাদ হাত বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়-তর ভাবীরে বেশি কথা কইতে বারণ করিস্‌। হের অখন ঘুমানি দরকার।

সিতারা শাড়ির আঁচলটা মাথায় তুলে দিয়ে মিরাদের হাতের নিচে তার কাঁধ পেতে দেয়। সিতারার কাঁধের উপর হাত রেখে, মিরাদ ধীরে ধীরে পা ফেলে তার নিজের কামরায় গিয়ে ঢোকে, তারপর গা এলিয়ে দেয় খাটের উপর। সারারাত একটুও ঘুম হয়নি। প্রবল উত্তেজনার সাথে মিশেছিলো খানিকটা আশংকা, কিছুটা অস্বস্তিকর অনিশ্চয়তা। ধীরে ধীরে কিছুটা স্বস্তি নেমে এলো। চোখ দুটি তার ঘন ঘন নাচতে লাগলো। যেন আঁধারের আবরণ তুলে আলোর মুখ দেখার ব্যাকুল প্রয়াস – যেন নববধূর সাথে এই পয়লা শা-‘নযর হচ্ছে – এই পয়লা দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে তার!

 

 

The following two tabs change content below.

বাছবিচার

এডিটর, বাছবিচার।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →