Main menu

আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (৪)

।। ।। ।।

 

বেঙ্গল থিয়েটারে

কৈশোরে পদার্পণ করিয়া বেঙ্গল থিয়েটারের অধ্যক্ষ পূজনীয় শরৎচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের অধীনে কার্য্যে নিযুক্ত হই। ঠিক মনে পড়ে না, কি কারণ বশতঃ আমি “গ্রেট ন্যাশনাল” থিয়েটার ত্যাগ করি। এই বেঙ্গল থিয়েটারই আমার কার্য্যরে উন্নতির মূল; এই স্থানে শরৎচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের কর্তৃত্বাধীন অতি অল্প দিনের মধ্যে প্রধান প্রধান ভূমিকা অভিনয় করিতে আরম্ভ করি। মাননীয় শরৎবাবু আমায় কন্যার ন্যায় স্নেহ করিতেন, তাঁহার অসীম স্নেহ ও গুণের কথা আমি এক মুখে বলিতে পারি না। প্রসিদ্ধা গায়িকা বর্ণবিহারীনি (ভুনি), শুকুমারী দত্ত (গোলাপী) ও এলোকেশী সেই সময় “বেঙ্গল”-এ অভিনেত্রী ছিলেন। তখন মাইকেল মধুসুদন দত্তের “মেঘনাধ বধ” কাব্য নাটকাকারে পরিবর্তিত হইয়া অভিনয়ার্থে প্রস্তুত হইতে ছিল। আমি উক্ত “মেঘনাথবধ” কাব্য সাতটি পার্ট এক সঙ্গে অভিনয় করিয়া ছিলাম। প্রথম চিত্রাঙ্গদা, ২য় প্রমিলা, ৩য় বারুনী, ৪র্থ রতি, ৫ম মায়া ৬ষ্ঠ মহামায়া, ৭ম সীতা।১ বঙ্কিম বাবুর “মৃনালীনি” তে মনোরমা অভিনয়ই করিতাম এবং “দূর্গেশনন্দিনী”তে আয়েষা ও তিলোত্তমা এই দুইটী ভূমিকা প্রয়োজন হইলে দুইটীই এক রাত্রি একসঙ্গে অভিনয় করিয়াছি। কারাগারের ভিতর ব্যতিত আয়েষা ও তিলোত্তমার দেখা নাই! কারাগারে তিলোত্তমার কথা ও ছিল না অন্য একজন তিলোত্তমার কাপড় পরিয়া কারাগারে গিয়া “কে-ও-  বীরেন্দ্র সিংহের কন্যা?” জগৎ সিংহের মুখে এই মাত্র কথা শুনিয়া মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িত। আর সেই সময়েই আয়েষার ভূমিকার শ্রেষ্ঠ অংশ ওসমানের সহিত অভিনয়! [pullquote][AWD_comments][/pullquote] এই অতি সঙ্কুচিতা ভীরু-স্বভাবা রাজকন্যা তিলোত্তমা, তখন ই আবার উন্নত-হৃদয়া-গর্ব্বিণী অপরিসিম হৃদয়-বলশালীনি প্রেম পরিপূর্ণা নবাব পুত্রী আয়েষা! এই রূপ দুই ভাগে নিজেকে বিভক্ত করিতে কত যে উদ্দ্যম প্রয়োজন তাহা বরিবার নহে। ইহা যে প্রত্যহ গঠিত তাহা নহে, কার্য্য কালিন আকস্মিক অভাবে এই রূপে কয়েকবার অভিনয় করিতে হইয়াছিল। একদিন অভিনয় রাত্রিতে আয়েষা সাজিবার জন্য গৃহ হইতে সুন্দর পোষাক – পরিচ্ছদ পরিয়া অভিনয় স্থানে উপস্থিত হইয়া শুনিলাম, যিনি ‘আসমানি’-র ভ’মিকা অভিনয় করিবেন তিনি উপস্থিত নাই। রঙ্গালয় জনপূর্ণ! কর্ত্তৃপক্ষগণের ভিতর চুপি চুপি কথা হইতেছে – “কে বিনোদনকে ‘আসমানি’ -র পার্ট অভিনয় করিতে বলিবে? উপস্থিত বিনোদ ব্যতিত অন্য কেহই পারিবে না!” আমি বাটী হইতে একেবারে আয়েষার পোশাকে সজ্জিত হইয়া আসিয়াছি বলিয়া ভরসা করিয়া কেহই বলিতেছেন না। এমন সময় বাবু অমৃতলাল বসু আসিয়া অতি আদর করিয়া বলিলেন, “বিনোদ! লক্ষী ভগ্নিটী আমার! আসমানী যে সাজিবে তাহার অসুখ করিয়াছে, তোমায় আজ চালাইয়া দিতে হইবে, নতুবা বড়ই মুশকিল দেখিতেছি।” যদিও মুখে অনেকবার “না – পারিব না” বলিয়া ছিলাম বটে, আর বাস্তবিক সেই নবাব পুত্রীর সাজ ছাড়িয়া তখন দাসীর পোশাক পড়িতে হইবে, আবার “আয়েষা”  সাজিতে অনেক খুঁত হইবে বলিয়া মনে মনে বড় রাগ ও হইয়াছিল, কিন্তু বিশেষ প্রয়োজন বুঝিয়া তাঁহাদের কথা মত কার্য্য করিতে বাধ্য হইলাম। বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনয় করিবার সময় “ইংলিস ম্যান”, “ষ্টেটসম্যান” ইত্যাদি কাগজে আমায় কেহ “সাইনোরা” কেহ কেহ বা “ফ্লাওয়ার অফ দি নেটিভ ষ্টেজ” বলিয়া উল্লেখ করিতেন। এখনও আমার পূর্ব্ব বন্ধুদের সহিত সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা বলেন যে, “সাইনোরা” ভাল আছ তো!

পূর্ব্বেই বলিয়াছি এই থিয়েটারে বঙ্কিম বাবুর “মৃণালীনি” অভিনীত হইত। তাহার অভিনয় যেরূপ হইয়াছিল তাহা বর্ণনাতীত। তখনকার বা এখনকার কোন রঙ্গালয়ে এ পুস্তকের এরূপ অভিনয় বোধ হয় কোথাও হয় নাই। এই মৃণালীনিতে হরি বৈষ্ণব – হেমচন্দ্র, কিরণ বাঁডুয্যে -পশুপতি, গোলাপ (সুকুমারী দত্ত)- গিরিজায়া, ভূনি – মৃণালীনি এবং আমি – মনোরমা!

আর গোটা কয়েক কথা বলিয়া বেঙ্গল থিয়েটার সম্বন্ধে কথা শেষ করিব। একবার আমরা সদলবলে চুয়াডাঙ্গা যাই, আমাদের জন্য একখানি গাড়ী রিজার্ভ করা হইয়াছিল। সকলে একত্রে যাইতেছি! মাস – স্মরণ নাই, মাঝখানে কোন্ ষ্টেশনে তাও মনে নাই, তবে সে যে একটী বড় ষ্টেশন সন্দেহ নাই। সেই স্থানে নামিয়া “উমিচাঁদ”  বলিয়া ছোটবাবু মহাশয়ের একজন আত্মীয় (আমরা মাননীয় শরৎচন্দ্র ঘোষ মহাশয়কে ছোটবাবু বলিযা ডাকিতাম) ও আর দুই-চারিজন একটার আমাদের কোম্পানীর জন্য খাবার আনিতে গেলেন। জল খাবার, পাতা ইত্যাদি লইয়া সকলে ফিরিয়া আসিলেন, উমিচাঁদ বাবুর আসিতে দেরী হইতে লাগিল। এমন সময় গাড়ী ছাড়ে ছাড়ে, ছোট বাবু মহাশয় গাড়ী হইতে মুখ বাড়াইয়া “ওহে উমিচাঁদ শীঘ্রই এস – শীঘ্রই এস –  গাড়ী যে ছাড়িল” বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন। এমন সময় গাড়ীও একটু একটু চলিতে লাগিল, ইত্যবসরে দৌড়িয়া উমিচাঁদ বাবু গাড়িতে উঠিলেন, গাড়িও জোরে চলিল। এমন সময় উমিচাঁদ বাবু অবসন্ন হইয়া শুইয়া পড়িলেন। ছোট বাবু মহাশয় ও অন্যান্য সকলে “সর্দিগরমি হইয়াছে, জল দাও জল দাও” করিতে লাগিলেন, চারুচন্দ্র বাবু ব্যস্ত হইয়া বাতাস করিতে লাগিলেন। কিন্তু এমন দুর্দৈব যে সমস্ত গাড়ীখানার ভিতর একটী লোকের কাছে, এমন কি এক গন্ডুস জল ছিল না, যে সেই আসন্ন – মৃত্যু মুখে পতিত লোকটীর তৃষ্ণার জন্য তাহা দেয়। “ভূনি” তখন সবে মাত্র বেঙ্গল থিয়েটারে কার্য্য নিযুক্ত হইয়াছে। তাহার কোলে ছোট মেয়ে;  সে সময় অন্য কোথাও উপায় না দেখিয়া আপনার স্তন্য দুগ্ধ একটি ঝিনুকে করিয়া লইয়া উমিচাঁদের মুখে দিল। কিন্তু তাঁহার প্রাণ তৎক্ষণাত বাহির হইয়া গেল। বোধহয় ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে এই দূর্ঘটনা ঘটিল। গাড়ী শুদ্ধ লোক একেবারে ভয়ে ভাবনায় মুহ্যমান হইয়া পড়িল। ছোটবাবু মহাশয় উমিচাঁদের বুকে মুখ রাখিয়া বালকের ন্যায় কাঁদিয়া উঠিলেন। আমি একে বালিকা, তাহাতে ওরকম মৃত্যু কখন দেখি নাই, ভয়ে মাতার কোলের উপর শুইয়া পড়িলাম। উমিচাঁদ বাবুর মৃত্যু কালীন সেই মুখভঙ্গী আমার মনোক্ষেত্রে পুনঃ পুনঃ অভিনীত হইতে লাগিল। আমার অবস্থা দেখিয়া চারুবাবু মহাশয় ছোটবাবুকে বলিলেন, ‘শরৎ থাম, যাহা হইবার হইয়াছে; এখন যদি রেলের লোক এ ঘটনা জানিতে পারে, গাড়ী কাটিয়া দিবে, এত লোকজন লইয়া রাস্তার মাঝে আর এক বিপদ হইবে।” ছোটবাবু কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “ আমি উমির মা’কে গিয়া কি বলিব? সে আসিবার কালীন উমিচাঁদ সম্বন্ধে কত কথা যে আমাকে বলিয়া দিয়াছিল।” (উমিচাঁদ বাবু মাতার একমাত্র পুত্র ছিলেন)। যাক্ এই রকম ভয়ানক বিপদ ঘাড়ে করিয়া আমরা সন্ধ্যার সময় চুয়াডাঙ্গায় নামিলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা, সেখানের ষ্টেশন মাষ্টারকে বলা হইল যে এই আগের ষ্টেশনে এই ঘটনা ঘটিয়াছে। তার পর আমরা বাসায় গিয়া যে যেখানে পাইলাম, অবসন্ন হইয়া সে রাত্রে শুইয়া পড়িলাম। ছোটবাবু ও দুই চারিজন অভিনেতা শব দাহ করিতে যাইলেন। সেখানে তিন দিন থাকিয়া অভিনয় কার্য্য সারিয়া সকলে অতি বিষন্ন ভাবে কলিকাতায় ফিরিলাম। এই শোকপূর্ণ ঘটনাটী কোন যোগ্য লেখকের দ্বারা বর্ণিত হইলে সে ভীষণ ছবি কতক পরিমাণে পরিস্ফুট হইত।

আর এক বার একটী ঘোর বিপদে পড়ি। সে ও বেঙ্গল থিয়েটারের সহিত সাহেবগঞ্জ না কোথায় একটী জঙ্গলা দেশে যাইতে। নির্দিষ্ট স্থানে যাইতে কতকটা জঙ্গলের মধ্য দিয়া হাতী ও গোরুর গাড়ীতে যাইতে হয়। ৪ টী হাতী ও কয়েক খানি গোরুর গাড়ী আমাদের জন্য প্রেরিত হয়। যাহারা গোরুর গাড়ীতে যাইবে, তাহারা তিনটার সময় চলিয়া গেল। আমি ছেলে মানুষির ঝোঁকে বলিলাম যে, “আমি হাতীর উপর যাইব।” ছোটবাবু মহাশয় কত বারণ করিলেন। কিন্তু আমি হাতী কখন দেখি নাই! চড়া তো দূরের কথা ! ভারি আমোদ হইল, আমি গোলাপকে বলিলাম, ‘দিদি আমি তোমার সঙ্গে হাতীতে যাইবো।” গোপাল বলিল, “আচ্ছা,  – যাস্ !” সে আমায় তার সঙ্গে রাখিল। মা বকিতে বকিতে আগে চলিয়া গেলেন। আমরা সন্ধ্যা হয় এমন সময় হাতীতে উঠিলাম। আমি, গোলাপ ও আর দুইজন পুরুষ মানুষ একটাতে, আর চারিজন করিয়া অপর তিনটাতে। কিছুদূর গিয়া দেখি, এমন রা¯তা তো কখন দেখি নাই। মোটে এক হাত চওড়া রাস্তা! আর দুই ধারে বুক পর্যন্ত বন! ধান গাছ কি অন্য গাছ বলিতে পারি না – আর জল! ক্রমে যতই রাত্রি হইতে লাগিল ততই বৃষ্টি চাপিয়া আসিল, আর সঙ্গে সঙ্গে ঝড় ও আরম্ভ হইল। হাতী তো ফর্ ফর্ করিতে লাগিল। শেষে সকলকে বেত বনের মধ্য লইয়া ফেলিল। তার উপর শিলা বৃষ্টি! হাতীর উপর ছাউনী নাই, সেই জল, ঝড়, মেঘ গর্জন, তার উপর শিলা বর্ষণ, আমি কেঁদেই অস্থির! গোলাপ ও কাঁদিতে লাগিল। শেষে হাতি আর এগোয় না। শুঁড় মাথার উপর তুলিয়া আগের পা বাড়িয়া ঠায় দাঁড়াইয়া রহিল। আবার তখন মাহুত বলিল, যে “বাঘ বেরিয়েছে তাই হাতী যাইতেছে না।” মাহুত চারিজন হই হই করিয়া চেঁচাইতে লাগিল। আমি তো আড়ষ্ঠ, আমার হাতী চড়ার আমোদ মাতায় উঠিয়াছে। ভয়ে কেঁদে কাঁপিতে লাগিলাম; পাছে হাতীর উপর হইতে পড়িয়া যাই বলিয়া একজন পুরুষ মানুষ আমায় ধরিয়া রহিল। তাহার পর কত কষ্টে প্রায় আধমরা হইয়া আমরা কোন রকমে বাসায় পৌঁছিলাম। জলে শীতে আমরা এমনই অসাড় হইয়া গিয়াছিলাম, যে হাতি হইতে নামিবারও ক্ষমতা ছিল না! ছোটবাবু নিজে ধরিয়া নামাইয়া নিয়া আগুন করিয়া আমার সমস্ত গা সেঁকিতে লাগিলেন। মা তো বকিতে বকিতে কান্না জুড়িলেন। মার বুলিই ছিল “হতচ্ছাড়া মেয়ে কোন কথা শোনে না।” সেই দিনই আমাদের অভিনয়ের কথা ছিল, কিন্তু দুর্যোগের জন্য ও আমাদের শারিরীক অবস্থার জন্য সেইদিন বন্ধ রহিল।

আর এক বার নৌকাতে বিপদে পড়িয়াছিলাম –  আর এক বার পাহাড়ে বেড়াইতে গিয়া ঝড়ের মাঝে পড়িয়া পথ হাড়াইয়া পাহাড়িদের কুটীরে আশ্রয় লইয়া জীবন রক্ষা করি! সেই পাহাড়ীই আবার রাস্তা দেখাইয়া দিয়া বাসায় রাখিয়া যায়।

একবার কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীতে ঘোড়ায় চড়িয়া অভিনয় করিতে পড়িয়া গিয়া বড়ই আঘাত লাগিয়াছিল। “প্রমিলা” র পার্ট ঘোটকের উপর বসিয়া অভিনয় করিতে হইত। সেখানে মাটির প্লাটফর্ম প্রস্তুত হইয়াছিল, যেমন আমি ষ্টেজ হইতে বাহিরে আসিব, ওমনি মাটির ধাপ ভাঙ্গিয়া ঘোড়া হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া গেল। আমিও  ঘোড়ার উপর হইতে প্রায় দুই হস্ত দূরে পতিত হইয়া অতিশয় আঘাত পাইলাম। উঠিয়া দাঁড়াইবার শক্তি রহিল না। তখন আমার অভিনয়ের অনেক বাকী আছে  –  কি হইবে! চারু বাবু আমায় ঔষধ সেবন করাইয়া বেশ করিয়া আমার হাঁটু হইতে পেট পর্যন্ত ব্যান্ডেজ বাঁধিয়া দিলেন। ছোট বাবু মহাশয় কত স্নেহ করিয়া বলিলেন যে “ লক্ষীটী! আজিকার কার্য্যটি কষ্ট করিয়া উদ্ধার করিয়া দাও।” তাঁহার সেই স্নেহময় সাত্বনাপূর্ণ বাক্যে আমার বেদনা অর্দ্ধেক দূর হইল।  কোনরূপে কার্য্য সম্পন্ন করিয়া পরদিন কলিকাতায় ফিরিলাম। ইহার পর আমি একমাস শয্যাশায়ী ছিলাম। যাহা হউক, বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনয় কালে আমি এক রূপ সন্তোষে কাটাইয়াছিলাম। কেননা তখন বেশি উচ্চ আশা হয় নাই। যাহা পাইতাম তাহাতেই সুখী হইতাম। যেটুকু উন্নতি করিতে পারিতাম, সেইটুকুও যথেষ্ঠ মনে করিতাম। বেশি আশাও ছিল না, অতৃপ্তি ও ছিল না। সকলে বড় ভালবাসিত। হেসে খেলে নেচে কুঁদে দিন কাটাতাম।

এই সময় মাননীয় কেদার নাথ চৌধুরী ও শ্রীযুক্ত বাবু গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয় প্রায় বেঙ্গল থিয়েটারে যাইতেন।  কেদার বাবু আমার “কপালকুন্ডলা” র অভিনয় দেখিয়া বলিয়াছিলেন যে, “ এই মেয়েটি যেন প্রকৃত ‘কপালকুন্ডলা’ ইহার অভিনয়ে বর্ন সরলতা উৎকৃষ্ট রূপে প্রদর্শিত হইয়াছে। ”

পরে শুনিয়াছিলাম এই সময়ে গিরিশবাবু মহাশয় ছোট বাবুকে বলিলেন যে, “আমরা একটি থিয়েটার করিব মনে করিতেছি। আপনি যদ্যপি বিনোদকে আমাদের থিয়েটারে দেন তবে বড়ই ভাল হয়।” ছোটবাবু মহাশয় অতি উচ্চ-হৃদয়-সম্পন্ন মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন, তিনি বলিলেন, “বিনোদকে আমি বড়ই স্নেহ করি; উহাকে ছাড়িতে হইলে আমার বড়ই ক্ষতি হইবে। তাথাপি আপনার অনুরোধ আমি এড়াইতে পারি না, বিনোদকে আপনি লউন।”

তারপর ছোটবাবু মহাশয় একদিন আমায় বলিলেন যে, “কিরে বিনোদ এখান হইতে যাইলে তোর মন কেমন করিবে না?” আমি চুপ করিয়া রহিলাম। এ বিষয় লইয়া সেদিন শ্রীযুক্ত অমৃতলাল বসু মহাশয়ও বলিলেন যে, “ওসব কথা আমারও বেশ মনে আছে। তোমাকে বেঙ্গল থিয়েটার হইতে আনিবার পরও শরৎ বাবু মহাশয় আমাদের বলিয়া মাইকেল মধুসুদন দত্তের বেনিফিট নাইটের “দূর্গেশনন্দিনী’র আয়েষার” ভূমিকায় অভিনয় করিবার জন্য লইয়া যান; আরও কয়েকবার লইয়া গিয়াছিলেন।” যাহা হউক, সেই সময় হইতে আমি মাননীয় গিরিশবাবু  মহাশয়ের সহিত কার্য্য করিতে আরম্ভ করি। তাঁহার শিক্ষায় আমার যৌবনের প্রথম হইতে জীবনের সার ভাগ অতিবাহিত হইয়াছে।

 

ন্যাশন্যাল থিয়েটারে যৌবনারম্ভে

আমি বেঙ্গল থিয়েটার ত্যগ করিয়া “কেদারনাথ চৌধুরী মহাশয়ের ন্যাশনাল থিয়েটারে কার্য্য করিবার জন্য নিযুক্ত হই। মাস কয়েক “মেঘনাদ বধ, “মৃণালিনী” ইত্যাদি পুরাতন নাটকে এবং “আগমনী”, “দোললীলা”  প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গীতিনাট্যে ও অনেক প্রহসন ও প্যাণ্টোমাইমে প্রধান প্রধান  ভ’মিকা গ্রহন করি। সকলগুলিই প্রায় গিরিশবাবুর রচিত। ইহার পর গিরিশবাবুর ও আমার থিয়েটারের সহিত সংস্রব শিথিল হইয়া আসে। ঐ সময় ন্যাশনাল থিয়েটারের দুর্দ্দশা! অল্পদিনের  মধ্যেই থিয়েটার নীলামে বিক্রয় হওয়ায় প্রতাপবচাঁদ জহুরী নামক জনৈক মাড়োয়ারী অধিকারী হইলেন। প্রতাপচাঁদ বাবুর অধীনে থিয়েটারের নাম ন্যাশনাল থিয়েটারই রহিল। গিরিশবাবু পুনর্ব্বার ম্যানেজার হইলেন। এই থিয়েটারের প্রথম অভিনয়, কবিবর সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার বিরচিত “হামীর”! ইহার নায়িকার ভ’মিকা আমার ছিল, কিন্তু তখন ন্যাশনালের দূর্নাম রটিয়াছে;  অতি ধূমধামের সহিত সাজ-সরঞ্জাম প্রস্তুত হইয়া অভিনয় হইলেও অধিক দর্শক আকর্ষিত হইল না।  ভাল ভাল নাটক যাহা ছিল, সব পুরাতন হইয়া গিয়াছে, নূতন ভাল নাটক ও পাওয়া যায় না। “মায়াতরু” নামে একখানি ক্ষুদ্র গীতিনাট্য গিরিশবাবু রচনা করিলেন। “পলাশীর  যুদ্ধের” সহিত  একত্রিত হইয়া এই গীতিনাট্য প্রথম অভিনীত হয়। দুই-তিন রাত্রি অভিনয়ের পরেই এই ক্ষুদ্র নাটিকার যশে দর্শক আকর্ষিত হইয়া বাড়ী ভরিয়া যাইতে লাগিল। এই গীতিনাট্যে আমার “ফুলহাসির”  ভূমিকা দেখিয়া “রিজ এন্ড রায়ৎ”-র সম্পাদক শম্ভূচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় লেখেন, “বিনোদিনী  is simply  charming’ –  ক্রমে গিরিশবাবুর “মোহিনী প্রতিমা”, “আনন্দ রহো” দর্শক আকর্ষণ করিতে লাগিল। তারপর “রাবণ বধের”  পর হইতে থিয়েটারে লোকের স্থান সঙ্কুলান হইত না। উপরের আসন সকল প্রতিবারই পূর্ণ হইয়া যাইত, যে সকল ধনবান ও পন্ডিত ব্যক্তিরা ঘৃণা করিয়া থিয়েটারে আসিতেন না তাহাদের দ্বারাই দুই-একদিন পূর্ব্বে টিকিট ক্রীত হইয়া অধীকৃত হইত। দিন দিন থিয়েটারের অদ্ভুত উন্নতি দেখিয়া  একদিন স্বত্বাধিকারী প্রতাপচাঁদ বলেন, “বিনোদ তিল সমান করন্তি।”  তিল সমাত অর্থে যাদু! ক্রমে “সীতার বনবাস” প্রভৃতি নাটক চলিল। থিয়েটারের যশ চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে অধীনার খ্যাতিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।

গিরিশবাবুর সহিত থিয়েটার আরম্ভ করিয়া বিডন ষ্ট্রীটের “ষ্টার থিয়েটার’ শেষ হওয়া পর্য্যন্ত আমি তাঁহার সঙ্গে বারবার কার্য্য করিয়া আসিতেছি। কার্য্য ক্ষেত্রে আমি তাহার শিক্ষক ছিলেন এবং আমি তাঁহার প্রথমা ও প্রাধান্যা শিষ্যা ছিলাম। তাঁর নাটকের প্রধান প্রধান স্ত্রী চরিত্র আমিই অভিনয় করিতাম। তিনিও  অতি যত্নে  আমায় শিক্ষা দিয়া তাঁহার কার্য্যোপযোগী করিয়া লইতেন।

যে সময় কেদারবাবু থিয়েটার করেন,  সেই সময় সুপ্রসিদ্ধ অভিনেতা অমৃতলাল মিত্র মহাশয় আসিয়া অভিনয় কার্য্যে যোগ দেন। গিরিশবাবুর মুখে শুনিয়াছিলাম যে,  অমৃত মিত্র আগে যাত্রার দলে এক্ট করিতেন। তাঁহার গলার সুন্দর স্বর শুনিয়া তিনি প্রথমে থিয়েটারে লইয়া আসেন। উপরে উল্লেখ করিয়াছি, ইতিপূর্ব্বে “মেঘনাদ বধ”, “বিষবৃক্ষ”, “সধবার একাদশী”, “মৃণালিনী”, “পলাশীর যুদ্ধ” ও নানা রকম বড় অথরের বই নাটকাকারে অভিনতি হইয়াছিল। “মেঘনাদ বধ” এ অমৃতলাল রাবণ সাজেন এবং আমি এখানেও সাতটি অংশ অভিনয় করিতাম। গিরিশবাবু মেঘনাদ ও রাম, “মৃণালীনি” তে গিরিশবাবু পশুপতি, আমি মনোরমা, “দুর্গেশনন্দিনীতে” তে গিরিশবাবু জগত সিংহ, আমি আয়েষা, “বিষবৃক্ষে” গিরিশবাবু নগেন্দ্রনাথ, আমি কুন্দনন্দিনী, “পলাশীর যুদ্ধে” গিরিশবাবু ক্লাইভ, আমি ব্রিটেনিয়া, অমৃত মিত্র জগৎ শেঠ ও কাদম্বিনী রাণী ভবানী। কত পুস্তকের নাম করিব। সকল পুস্তকেই আমার, গিরিশবাবুর, অমৃত মিত্রের, অমৃত বসু মহাশয়ের এই মকল বড় বড় পার্ট থাকিত।  গিরিশবাবু আমাকে পার্ট অভিনয়ের জন্য অতি যত্নের সহিত শিক্ষা দিতেন। তাঁহার শিক্ষা দিবার প্রণালী বড় সুন্দর ছিল। তিনি প্রথম পার্টগুলির ভাব বুঝাইয়া দিতেন। তাহার পর পার্ট মুখস্থ করিতে বলিতেন। তাহার পর অবসর মত আমাদের বাটীয়া বসিয়া, অমৃত মিত্র, অমৃতবাবু (ভুনীবাবু) আরো অন্যান্য লোকে মিলিয়া নানাবিধ বিলাতী অভিনেত্রীদের, বড় বড় বিলাতী কবি সেক্সপীয়ার, মিল্টন, বায়রন, পোপ প্রভৃতির লেখা গল্পচ্ছলে শুনাইয়া দিতেন। আবার কখন তাঁদের পুস্তক লইয়া পড়িয়া পড়িয়া বুঝাইতেন। নানাবিধ হাব-ভাবের কথা এক এক করিয়া শিখাইয়া দিতেন। তাহার এই রূপ যত্নে  জ্ঞান ও বুদ্ধিও দ্বারা অভিনয় কার্য্য শিখিতে লাগিলাম। ইহার আগে যাহা শিখিয়াছিলাম তাহা পড়া পাখীর চতুরতার ন্যায়, আমার নিজের বড় একটা অভিজ্ঞতা হয় নাই। কোন বিষয়ে তর্ক বা যুক্তি দ্বারা কিছু বলিতে বা বুঝিতে পারিতাম না। এই সময় হইতে নিজের অভিনয়-নির্ব্বাচিত ভূমিকা বুঝিয়া লইতে পারিতাম। বিলাতী বড় বড় এক্টার-এক্ট্রেস আসিলে তাহাদের অভিনয় দেখিতে যাইবার জন্য ব্যগ্র হইতাম। আর থিয়েটারের অধ্যক্ষেরাও আমাকে যত্নের সহিত লইয়া গিয়া ইংরাজি থিয়েটার দেখাইয়া আনিতেন। বাটী আসিলে গিরিশব্বু জিজ্ঞাসা করিতেন, “কি রকম দেখে এলে বল দেখি?” আমার মনে যেমন বোধ ঘনু,  তাঁহার কাছে বলিতাম। তিনি আবার যদি ভুল হইত তাহা সংশোধন করিয়া বুঝাইয়া দিতেন।

কেদারবাবু প্রায় বৎসরখানেক থিয়েটার করেন; ইহার পর কৃষ্ণধন ও হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়া দুই ভাই কয়েকমাস থিয়েটারের কর্তৃত্ত্ব করেন। তাহার পর কাশীপুরের প্রাণনাথ চৌধুরীর বাটীর শ্রীযুক্ত শিবেন্দ্রনাথ চৌধুরী বলিয়া এক ব্যক্তি ছয় মাস কি আট মাস এই থিয়েটারের প্রোপাইটার হন। এই সকল থিয়েটারেই গিরিশবাবু মহাশয় ম্যানেজার ও মোশন মাষ্টার ছিলেন। কিন্তু সকল প্রোপাইটারই স্ব স্ব প্রধান, গিরিশবাবু  আপিসের কার্য্য করিয়া থিয়েটারে অধিক সময় দিতে পারিতেন না। ইহাতে এত বিশৃঙ্খলা হইত যে ব্যবসা বুদ্ধিহীন আমোদপ্রিয় প্রোপাইটারেরা শেষে থলি ঝাড়া হইয়া শূন্য হস্তে ইন্সল্ভেন্টের আসামী হইয়া থিয়েটার হইতে বিদায় গ্রহন করিতেন। তত্রাচ আমার বেশ মনে পড়ে যে সে সময় প্রতি রাত্রেই খুব বেশী লোক হইত ও এমন সুন্দর রূপ অভিনয় হইত যে লোকে অভিনয় দর্শনে মোহিত হইয়া একবাক্যে বলিত যে আমরা অভিনয় দর্শন করিতেছি কি প্রত্যক্ষ করিতেছি, তাহা বোধ করিতে পারিতেছি না। এত বিক্রয় সত্ত্বেও যে কেন সব ধনী সন্তানেরা সর্ব্বশান্ত হইতেন, তাহা আমি বলিতে পারি না। লোকে বলিত যে এই জায়গাটা হানা জায়গা। এই স্থানের ভূমিখন্ড কাহারও অনুকূল নহে।

গিরিশবাবু মহাশয়ের শিক্ষা ও সতত নানারূপ সৎ উপদেশ গুণে আমি যখন ষ্টেজে অভিনয়ের জন্য দাঁড়াইতাম, তখন আমার মনে হইত না যে আমি অন্য কেহ! আমি যে চরিত্র লইয়াছি আমি যেন নিজেই সেই চরিত্র। কার্য্য শেষ হইয়া যাইলে আমার চমক ভাঙ্গিত। আমার এইরূপ কার্য্যে উৎসাহ ও যত্ন দেখিয়া রঙ্গালয়ে কর্ত্তৃপক্ষীয়েরা আমায় বড়ই ভালবাসিতেন ও অতিশয় স্নেহ মমতা করিতেন। কেহবা কন্যার ন্যায় কেহবা ভগ্নীর ন্যায়, কেহবা সখীর ন্যায় ব্যবহার করিতেন। আমিও তাঁহাদের যত্নে ও আদরে তাঁহাদের উপর প্রবল স্নেহের অত্যাচার করিতাম। যেমন মা-বাপের  কাছে আদরের পুত্র-কন্যারা বিনা কারণে আদর আবদারের হাঙ্গামা করিয়া তŧাহাদের উৎকণ্ঠিত করে, ভ্রাতা ও ভগ্নীদের নিকট যেমন কোলের ছোট ছোট ভাই ভগ্নীগুলি মিছামিছি ঝগড়া আবদার করে, আমারও সেইরকম স্বভাব হইয়া গিয়াছিল।

এই সময়ে নানা রকমের উচ্চচরিত্র অভিনয় দ্বারা আমার মন যেমন উচ্চদিকে উঠিতে লাগিল, আবার  নানারূপ প্রলোভনের আকাঙ্খাতে আকৃষ্ট হইয়া সময়ে সময়ে আত্মহারা হইবার উপক্রম হইত।

আমি ক্ষুদ্র দীন দরিদ্রের কন্যা, আমার বল বুদ্ধি অতি ক্ষুদ্র। এদিকে আমার উচ্চবাসনা আমার আত্মবলিদানের জন্য বাধা দেয়, অন্যদিকে অসংখ্য প্রলোভনের জীবন্ত চাকচিক্য মূর্ত্তি আমায় আহ্বান করে। এইরূপ অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে আমার ন্যায় ক্ষুদ্র-হৃদয়-বল কতক্ষণ থাকে? তবুও সাধ্যমত আত্মদমন করিতাম। বুদ্ধির দোষে ও আদৃষ্টের ফেরে আত্মরক্ষা না করিলেও তখন অভিনয় কার্য্যে অমনোযোগী হই নাই। অমনোযোগী হইবার ক্ষমতাও ছিল না। অভিনয়ই আমার জীবনের সার সম্পদ ছিল। পার্ট অভ্যাস, পার্ট অনুযায়ী চিত্রকে মনোমধ্যে অঙ্কিত করিয়া বৃহৎ দর্পনের সম্মুখে সেই সকল প্রকৃতির আকৃতি মনোমধ্যে স্থাপিত করিয়া তন্ময়ভাবে সেই মনাঙ্কিত ছবিগুলিকে আপনার মধ্যে মিলাইয়া মিশাইয়া দেখা, এমন কি সেইভাবে চলা,  ফেরা, শয়ন, উপবেশন যেন আমার স্বভাবে জড়াইয়া গিয়াছিল।

আমার অন্য কথা বা অন্য গল্প ভাল লাগিত না। গিরিশবাবু মহাশয় যে সকল বিলাতের বড় বড় অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের গল্প করিতেন, যে সকল বই পড়িয়া শুনাইতেন, আমার তাহাই ভাল লাগিত। মিসেস সিডনিস যখন থিয়েটারের কার্য্য ত্যাগ করিয়া, দশবৎসর বিবাহিতা অবস্থায় অতিবাহিত করিবার পর পুণরায় যখন রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হন,  তখন তাঁহার অভিনয়ে কোন সমালোচক কোন স্থানে কিরূপ দোষ ধরিয়াছিল,  কোন অংশে তাঁহার উৎকর্ষ বা ত্রুটী ইত্যাদি পুস্তক হইতে পড়িয়া বুঝাইয়া দিতেন। কোন এক্ট্রেস বিলাতে বনের মধ্যে পাখীর আওয়াজের সহিত নিজের স্বর সাধিত, তাহাও বলিতেন। এলেন্টারি কিরূপ সাজ-সজ্জা করিত, ব্যা-ম্যান কেমন হ্যামলেট সাজিত, ওফেলিয়া কেমন ফুলের পোষাক পরিত, বঙ্কিমবাবু “দুর্গেশনন্দিনী” কোন পুস্তকের ছায়াবলম্বনে লিখিত, “রজনী” কোন ইংরাজী পুস্তকের ভাব সংগ্রহে রচিত, এই রকম কত বলিত গিরিশবাবু মহাশয়ের ও অন্যান্য স্নেহশীল বন্ধুগণের যত্নে ইংরাজী, গ্রীক,ফ্রেঞ্চ, জার্ম্মানি প্রভৃতি বড় বড় অথরের কত গল্প যে আমি শুনিয়াছি, তাহা বলিতে পারি না। শুধু শুনিতাম না, তাহা হইতে ভাব সংগ্রহ করিয়া সতত সেই সকল চিন্তা করিতাম। এই কারণে আমার স্বভাব এমন হইয়া গিয়াছিল যে যদি কখন কোন উদ্যান ভ্রমণ করিতে যাইতাম, সেখানকার ঘর বাড়ী আমার ভাল লাগিত না, আমি কোথায় বন-পুষ্প শোভিত নির্জ্জন স্থান তাহাই খুঁজিতাম। আমার মনে হইত যে আমি বুঝি এই বনের মধ্যে থাকিতাম, আমি ইহাদের চিরপালিত! প্রত্যেক লতাপাতায় সৌন্দর্য্যরে মাখামাখি দেখিয়া আমার হৃদয় লুটাইয়া পড়িত। আমার প্রাণ যেন আনন্দে নাচিয়া উঠিত! কখন কোন নদীতীরে যাইলে আমার হৃদয় যেন তরঙ্গে তরঙ্গে ভরিয়া যাইত, আমার মনে হইত আমি বুঝি এই নদীর তরঙ্গে তরঙ্গেই চিরদিন খেলা করিয়া বেড়াইতাম। এখন আমার হৃদয় ছাড়িয়া এই তরঙ্গগুলি আপনা আপনি লুটোপুটি করিয়া বেড়াইতেছে। কুচবিহারের নদীর বালিগুলি অভ্র মিশান, অতি সুন্দর, আমি প্রায় বাসা হইতে দূরে, নদীর ধারে একলাটী যাইয়া সেই বালির উপর শুইয়া নদীর তরঙ্গ দেখিতাম। আমার মনে হইত উহারা বুঝি আমার সহিত কথা কহিতেছে।

নানাবিধ ভাব সংগ্রহের জন্য সদা সর্ব্বক্ষণ মনকে লিপ্ত রাখায় আমি কল্পনার মধ্যেই বাস করিতাম, কল্পনার ভিতর আত্বা বিসর্জ্জন করিতে পারিতাম। সেইজন্য বোধহয় আমি যখন যে পার্ট অভিনয় করিতাম, তাহার চরিত্রগত ভাবের অভাব হইত না। যাহা অভিনয় করিতাম, তাহা যে অপরের মনোমুগ্ধ করিবার জন্য বা বেতনভোগী অভিনেত্রী বলিয়া কার্য্য করিতেছি ইহা আমার কখন মনেই হইত না। আমি নিজেকে নিজে ভুলিয়া যাইতাম। চরিত্রগত সুখ-দু:খ্য নিজেই অনুভব করিতাম, ইহা যে অভিনয় করিতেছি তাহা একেবারে বিস্মৃত হইয়া যাইতাম। সেই কারণে সকলেই আমায় স্নেহের চক্ষে দেকিতেন।

একদিন বঙ্কিমবাবু তŧাহার “মৃণালিনী” অভিনয় দেখিতে আসিয়াছিলেন, সেই সময় আমি “মৃণালিনী”-তে “মনোরমা”-র অংশ অভিনয় করিতেছিলাম। মনোরামার অংশ অভিনয় দর্শন করিয়া বঙ্কিমবাবু বলিয়াছিলেন যে, “আমি মনোরমার চরিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম,  কখন যে ইহা প্রত্যক্ষ দেখিব তাহা মনে ছিল না, আজ মনোরামাকে দেখিয়া আমার মনে হইল যে আমার মনোরমাকে সামনে দেখিতেছি।” কয়েকমাস হইল এখনকার ষ্টার থিয়েটারের ম্যানেজার অমৃতলাল বসু মহাশয় এই কথা বলিয়াছিলেন যে,  “বিনোদ, তুমি কি সেই বিনোদ,  – যাহাকে দেখিয়া বঙ্কিমবাবুও বলিয়াছিলেন যে আমার মনোরমাকে প্রত্যক্ষ দেখিতেছি?” যেহেতু এক্ষণে রোগে, শোকে প্রায়ই শয্যাগত।

আমি অতি শৈশবকাল হইতে অভিনয় কার্য্যে ব্রতী হইয়া, বুদ্ধিবৃত্তির প্রথম বিকাশ হইতেই, গিরিশবাবু মহাশয়ের শিক্ষাগুণে আমার কেমন উচ্ছ্বাসময়ী করিয়া তুলিয়াছিল, কেহ কিছুমাত্র কঠিন ব্যবহার করিলেই বড়ই দুঃখ হইত। আমি সততই আদর ও সোহাগ চাহিতাম। আমার থিয়েটারের বন্ধু-বান্ধবেরাও আমায় অত্যধিক আদর করিতেন। যাহা হউক এই সময় হইতে আমি আত্মনির্ভর করিবার ভরসা হৃদয়ে সঞ্চয় করিয়াছিলাম।

এই সময়ের আর একটা ঘটনা বলিঃ  প্রতাপবাবুর থিয়েটারে আসিবার ঠিক আগেই হউক আর প্রথম সময়েই হউক, আমাদের অবস্থা গতিকে আমাকে একটি সম্ভ্রান্ত যুবকের আশ্রয়ে থাকিতে হইত। তিনি অতিশয় সজ্জন ছিলেন; তাঁহার স্বভাব অতিশয় সুন্দর ছিল এবং আমাকে অন্তরের সহিত স্নেহ করিতেন। তাঁহার অকৃত্রিম স্নেহগুণে আমায় তাঁহার কতক অধীন হইতে হইয়াছিল। প্রথম তাঁর ইচ্ছা ছিল, যে আমি থিয়েটারে কার্য্য না করি, কিন্তু যখন ইহাতে কোন মতে রাজী হইলাম না, তখন তিনি বলিলেন, তবে তুমি অবৈতনিকভাবে (এ্যামেচার) হইয়া কার্য্য কর, আমার গাড়ী ঘোড়া তোমার থিয়েটারে লইয়া যাইবে ও লইয়া আসিবে। আমি মহা বিপদে পড়িলাম, চিরকাল মাহিনা লইয়া কার্য্য করিয়াছি। আমার মায়ের ধারণা যে থিয়েটারের পয়সা হইতে আমাদের দারিদ্র্যদশা ঘুচিয়াছে, অতএব ইহাই আমাদের লক্ষী। আর এমন অবস্থা হইয়াছিল যে, সখের মত কাজ করা হইয়া উঠিত না। হাড়-ভাঙ্গা মেহনত  করিতে হইত, সেইজন্য সখেও বড় ইচ্ছা ছিল না। আমি একথা গিরিশবাবু মহাশয়কে বলিলাম, তিনি বলিলেন যে, তাঁহাতে আর কি হইবে, তুমি “অমুককে” বলিও যে আমি মাহিনা লই না। তোমার মাহিনার টাকাটা আমি তোমার মা’র হাতে দিয়া আসিব।” যদিও প্রতারণা আমাদের চির সহচরী, এই পতিত জবিনের প্রতারণা আমাদের ব্যবসা বলিয়াই প্রতিপন্ন, তবুও আমি বড় দুঃখিত হইলাম। আর আমি ঘৃণিতা বারনারী হইলেও অনেক উচ্চ শিক্ষা পাইয়াছিলাম, প্রতারণা বা মিথ্যা ব্যবহারকে অন্তরের সহিত ঘৃণা করিতাম। অবিশ্বাস আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র হইলেও আমি সকলকেই বিশ্বাস করিতাম ও ভাল ব্যবহার পাইতাম। লুকোচুরি ভাঁড়াভাঁড়ি আমার ভাল লাগিত না। কি করিব দায়ে পড়িয়া আমায় গিরিশবাবু মহাশয়ের কথায় সম্মত হইতে হইল। উক্ত ব্যক্তির সহিত গিরিশবাবুর সৌহৃদ্য ছিল, তিনি এত সজ্জন ছিলেন যে পাছে উহারা কিছু মনে সন্দেহ করেন বলিয়া কাজের আগে আমায় থিয়েটারে পৌছাইয়া  দিতেন। সে যাহা হউক প্রতাপ জহুরীর থিয়েটার বেশ সুশৃঙ্খলায় চলিতেছিল; তিনিও অতিশয় মিষ্টভাষী ও সুদক্ষ ব্যক্তি ছিলেন। এই স্থানে যে যে ব্যক্তি কার্য্য করিয়াছেন,  কেবন প্রতাপবাবুই ঋণগ্রস্থ হন নাই। লাভ হইয়াছিল কিনা জানি না। অবশ্য তাহা বলিতেন না, তবে যে লোকসান হইত না, তাহা জানা যাইত। কেন না প্রতি রাত্রে অজচ্ছল বিক্রয় হইত, আর চারিদিকে সুনিয়ম ছিল। তাঁর বন্দোবস্তও নিয়মমত ছিল। সকল রকমে তিনি যে একজন ব্যবসায়ী  লোক তাহা সকলেই জানিত ও জানেন। এক্ষণে আমার উক্ত থিয়েটার ছাড়িবার কারণ ও “ষ্টার থিয়েটার” সৃষ্টির সূচনার কতা বলিয়া এ অধ্যায় শেষ করি। গিরিশবাবুর নূতন নূতন বই ও নূতন নূতন প্যাণ্টোমাইমে আমাদের বড়ই বেশী রকম খাটিতে হইত। প্রতিদিন অতিশয় মেহনতে আমার শরীরও অসুস্থ হইতে লাগিল, আমি একমাসের জন্য ছুটী চাহিলাম, আমি সেই ছুটীতে শরীর সুস্থ করিবার জন্য কাশীধামে চলিয়া যাইলাম। কিন্তু সেখানে আমার অসুখ বাড়িল। সেই কারণ আমার ফিরিয়া আসিতে প্রায় এক মাস হইল। এখানে আসিয়া পুনরায় থিয়েটারে যোগ দিলাম, কিন্তু শুনিলাম যে প্রতাপবাবু আমার ছুটীর মাহিনা দিতে চাহেন না। গিরিশবাবু বলিলেন যে, “ছুটীর মাহিনা না দিলে বিনোদ কাজ করিবে না, তখন বড় মুশকিল হইবে।” যদিও স্পষ্ট শুনি নাই, তবুও এই রকম শুনিয়া আমার সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল, বড় রাগ হইল। আমার একটুতে যেন মনের ভিতর আগুন লাগিয়া যাইত, আমি চোখে কিছু দেখিতে পাইতাম না। সেই দিনই প্রতাপবাবু ভিতরে আসিলে আমি আমার মাহিনা চাহিলাম। তিনি  হাসিয়া বলিলেন, “মাহিনা কেয়া? তোম তো কাম নেহি কিয়া!” আর কোথা আছে, “বটে মাহিনা দিবেন না” বলিয়া চলিয়া আসিলাম। আর গেলাম না!

তারপর গিরিশবাবু, অমৃত মিত্র আমাদের বাটীতে আসিলেন। আমি তখন গিরিশবাবুকে বলিলাম যে, “মহাশয়, আমার বেশী মাহিনা চাহি,  আর যে টাকা বাকী পড়িয়াছে তাহা চুক্তি করিয়া চাহি, নচেৎ কাজ করিব না। “তখন অমৃত মিত্র বলিলেন, “দেখ বিনোদ এখন গোল করিও না, একজন মাড়ওয়ারীর সন্তান একটি নতুন থিয়েটার করিতে চাহে., যতটাকা খরচ হয় সে করিবে। এখন কিছুদিন চুপ করিয়া থাক, দেখি কতদূর কি হয়!”

এইখান হইতে “ষ্টার থিয়েটার” হইবার সূত্রপাত আরম্ভ হইল। আমিও গিরিশবাবুর কথা অনুযায়ী আর প্রতাপবাবুকে কিছু বলিলাম না। তবে ভিতরে ভিতরে সংবাদ লইতে লাগিলাম কে লোক নতুন থিয়েটার করিতে চাহে?

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

বিনোদিনী দাসী

বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
Avatar photo

Latest posts by বিনোদিনী দাসী (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →