Main menu

আনোয়ার পাশার পিরিতের চাবুকে বাংলার জখম

মাদ্রাসার মাস্টার আনোয়ার পাশার নভেল ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ পড়ছেন? এইটা মুক্তিযুদ্ধ লইয়া পয়লা নভেল, যুদ্ধের টাইমেই লেখা, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে উনি খুন হন পাকিস্তানপন্থিদের হাতে, এ কারণে বাংলাদেশ এই মাদ্রাসার মাস্টারকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসাবে মনে রাখে। বাংলাদেশে ১৪ ডিসেম্বর যাগো কারণে মনে আসে তাগো মাঝে আনোয়ার পাশা একজন।

তো, অনলাইনে পড়তেছিলাম রাইফেল, রোটি, আওরাত। না, এইটার ভিত্রে বাংলা একাডেমীতে বই বেচার যে বড় বাজার বসে সেইটার লগে দুশমনি নাই কোন :)! পুরাটা পড়তেও চাইতেছি না, দুই-চার পাতা পইড়া স্রেফ দুইটা কথা পাড়ার পায়তারা করতেছি আর কি![pullquote][AWD_comments][/pullquote]

এই নভেলের নায়ক মনে হইতেছে সুদীপ্ত শাহিন, ইনি ইংরাজির মাস্টার ঢাকা ভার্সিটিতে। কোলকাতা থিকা পাকিস্তানে মাইগ্রেট করছিল, এই নাম লইয়া ভেজালে পড়ে পাকিস্তানে–মোসলমান কিনা সন্দেহ করে, তাই নাম পাল্টাইয়া ফেলেন এই মাস্টার সাব।

আগে এক লেখায় কইতেছিলাম, আইউব খান পাকিস্তানে রঠার গান গাইতে মানা করায় রঠার গান দিয়া ছায়ানট বা উদীচী সারা পূব পাকিস্তানে মুভমেন্ট শুরু করে, বাংলাদেশের কালচার্ড মিডল ক্লাসের মন রঠার গানের দখলে যাবার গোড়ায় আছেন আইউব খান, ছায়ানট হইলো ঐ খান সাহেবের আনওয়ান্টেড চাইল্ড। আমার এই কথারে কিছু ভ্যালিডিটি দিতেছে আমাদের এই মাদ্রাসামাস্টার, নায়কের নাম ‘সুদীপ্ত’ রাইখা। এই নাম একটা অর্থ দেবার লোভে রাখা হইতেছে, কিন্তু বাঙালিরা এইটার অর্থ জানে না, অশিক্ষিত তো দূর, শিক্ষিতরাও জানে না!

সুদীপ্ত শাহিন কলেজে মাস্টারির চাকরিতে ইন্টারভিউ দিতে গেলে বোর্ডের লোকেরা ঐটার অর্থ না জানাটা জানায়, জিগায়–”সুদীপ্ত কথাডার মানেডা কি?”।সুদীপ্ত তখন অর্থটা জানায়, “উত্তমরূপে দীপ্যমান যাহা”। পাশা সাহেব নায়কের এমন নাম কেন রাখলেন? এমন নাম যা গড় বাঙালি বোঝে না, একবার শুইনা কইতেও পারবে না! এইটা আসলে রেজিস্ট্যান্স, পাকিস্তানপন্থিদের ভাবনার রিঅ্যাকশন! কোন ভাবনা? বোর্ডের জবাবে সেইটা পাইবেন– “এ তো তবে বাংলা নাম হইলো সাব। আপনে তবে হিন্দু হইতে চান?”।

শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা

শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা

 

বোর্ডের লোকের মুখে বাংলার একটা ভুল ডেফিনিশন বসাইছেন আনোয়ার পাশা! এইটা বাংলা না, সংস্কৃত; বাঙালি সমাজের বোঝাবুঝির মাঝে সংস্কৃত শব্দ থাকলে সেইটা বাংলাই, কিন্তু এইটা নাই। বোর্ডের লোকেরা বাঙালি, শিক্ষিত, তারাও এইটা বোঝে না দেখা গেল! তারপর বাংলা আর হিন্দুর যোগাযোগটাও ভুল; আরবীতে কথা কওয়া ইহুদী যেমন থাকতে পারে, বাংলা কওয়া ইহুদীও তেমন থাকতে পারে–বুলির লগে ধর্মের অমন নেসেসারি রিলেশন নাই। তাইলে দুইটা ভুল ভাবনারে পাকিস্তানপন্থিদের ভাবনা হিসাবে অনুমান কইরা, ধইরা নিয়া তার রিঅ্যাকশন হিসাবে নায়কের নাম রাখছেন ‘সুদীপ্ত’! চারপাশে দেখেন, প্রায় ৫০ বছর আগে পাকিস্তান মরলেও আজকের বাংলাদেশেও সেই রিঅ্যাকশন দেখাইয়া কতজন নিজের/পোলার নাম সুদীপ্ত রাখতেছেন! আনোয়ার পাশা থিকা আরো কতো কতো লেখক চেষ্টা করলেন, কিন্তু সুদীপ্ত শব্দটা আরো কম লোকে বোঝে এখন! ইংরাজি মিডিয়াম হিসাবে লইলে সাফ সাফ বুঝবেন :)।

একটামাত্র শব্দ লইয়া এমন কেন প্যাচাইতেছি, তাই ভাবছেন? না, একটা শব্দ না। এইটা একটা প্যাটার্ন। বাংলা গ্রামারের বেকুবগুলা ‘সুযোগ’ বা ‘সুখবর’ ধরনের দুই চারটা শব্দ দেইখা ‘সু’ দিয়া পুরা মাখাইয়া ফেলছে বাংলা, কতগুলা সংস্কৃত শব্দের লগে ‘সু’ জোড়া লাগাইয়া দেয় খালি, তাতেই যেন সুন্দর বাংলা হইতেছে! এমন আরো আছে। যেমন ‘বি’ দিয়া কইবে ‘বিনম্র’, ‘বিশুষ্ক’ ‘বিশিষ্ট’। কিন্তু দেখেন, এগুলা বাংলার লগে মেলে না আসলে, ভালো বাড়ি বুঝাইতে সুবাড়ি কইছেন? ভালো চাউলরে কইলেন সুচাউল? আপনের বিশেষ ছাগলটারে বিছাগল কন নাকি?

এক ভাষার/বুলির শব্দ আরেক ভাষা/বুলিতে অনেকভাবেই আইতে পারে। ধরেন, ‘ইন্টারেস্টিং’ বা ‘কুলিং’ ‘শ্যুটিং’ বা ‘বোরিং’ বা ‘ডেটিং’– এমন অনেক ইংরাজি গোড়ার শব্দ এখন বাংলায় পাইবেন, তাই বইলা কি আপনে ‘ing/ইং’  যোগ করতে থাকবেন বাংলায়? দৌড়িং কইবেন? গোছলিং? খাইং? লিখিং? চাবাইং? পিরিতিং? ব্যাপারটা বুঝলে আপনে সিধা বুঝবেন যে, সুফল কইতে পারেন বাংলায়, তাতে ভালো ফ্রুট/ফল বোঝেই না লোকে, এই ফল আরেক কিসিমের, আবার চাকরিতে আপনে  সুমজুরি পান, সুমজুরি শব্দটার চল নাই, লোকে কয় না, লেখে না, ঐ ‘সু’অলা বাঙালিরা হয়তো বুঝবে, তাও একটু ভাবার পরে!

কিন্তু রাইফেল, রোটি, আওরাতের দুই/তিন পাতায় আরো কিছু ভাবার ব্যাপার আছে। ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকা বাঙালিদের আলাপ দেখেন। আগের দুয়েকটা কথার লগে আরো দেখাই:

১. “ঠিক কইছ হাওলাদার বাই।”

২. “মনে তো লয় যে, দরখাস্তে আপনে মিছা কথা বানাইছেন।”

এই কথাগুলাই তখনকার পূব পাকিস্তানের আমজনতার বাংলা, আমি এইটার নাম কই ‘কমন বাংলা’, জেনারেল বাংলাও কইতে পারেন। এইটাই লোকে এখনো কয়, এই বাংলাতেই ভাবে, অশিক্ষিত-শিক্ষিতের আলাপগুলাও এই বাংলায় চলে এখনো। আনোয়ার পাশা ‘সুদীপ্ত’ হইয়া আমজনতার এই বাংলারে ফালাইয়া দিয়া লোকে কয় না বা বোঝে না তেমন একটা বানানো বাংলায় লেখেন; যেই বাংলাটা কলোনিয়াল কোলকাতার ল্যাবরেটরিতে কম্যুনাল এবং জমিদারি এলিটের হাতে পয়দা হইছে, শূদ্র এবং মোসলমান–বাঙালির এই ৯৫{855ff4e32ca5c8db0719e8f837cd158afce0d103a8821dfb7d995472b79aa6d7} মেম্বারের ঢঙ এবং শব্দ বা ভোকাবুলারি ফালাইয়া দিয়া, ঘেন্না কইরা, ভালগার নাম দিয়া, রেসিজমে মাতাল হইয়া আর্যের সংস্কৃতের বনেদি বাছুর হবার লোভে!

 

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

রক মনু

কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →