আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (৬)
শেষ সীমা
পত্র
মহাশয়!
আপনাকে আর কত বিরক্ত করিব! এ ভাগ্যহীনার কলঙ্কিত জীবনের পাপকথা দ্বারা আপনাকে আর কত জ্বালাতন করিব! কিন্তু আপনার দয়া ও অনুগ্রহ স্মরণ করিয়া এ পাপ জীবনের ঘটনা মহাশয়কে নিবেদন করিতে সাহস করি। সেই কারণে নিবেদন এই যে, যদি এতদিন দয়া করিয়া ধৈর্য্যদ্বারা আমার যন্ত্রণাময় কথা শুনিয়াছেন, তবে শেষটাও শুনুন![pullquote][AWD_comments][/pullquote]
মানুষ যদি আপনার ভবিষ্যৎ জানিতে পারিত, তাহা হইতে গর্ব্ব অহঙ্কার সকল পাপই পৃথিবী হইতে চলিয়া যাইত! কি ছিলাম, কি হইয়াছি! তখন যদি বুঝিতাম যে সর্ব্বশক্তিমান পরমেশ্বর দিতেও পারেন এবং নিতেও পারেন, তাহা হইওে কি মান-অভিমানের খেলা লইয়া বৃথা দিন কাটাইতাম! এখন দিন গেছে, কথাই আছে, আর আছে, স্মৃতির জ্বালা! পাপের অনুতাপ! কিন্তু ঈশ্বর দয়াময় তাহাও নিশ্চয়! জীব যতই অধঃপতিত হউক না কেন, তাঁর দয়াতে বঞ্চিত নহে। তিনিই দেন, তিনিই লন, ইহাতে আক্ষেপ নাই। সেই অসীম করুণাময় এই নিরাশ্রয়া পতিতা ভাগ্যহীনাকে একটি সুশীতল আশ্রয়স্থল দিয়াছেন। যেখানে বসিয়া এই দুর্ব্বিসহ বেদনাপূর্ণ বুক লইয়া একটু শান্তিতে ঘুমাইতে পাই! ইহা তাঁহারি করুণা! এখন শেষ কথাগুলি শুনুন!
আমি যে সময় থিয়েটারে কার্য্য করিতাম, সেই সময়ের দু’একটি কথা বলি। আমি এত বালিকা বয়সে অভিনয় কার্য্যে ব্রতী হইয়া ছিলাম যে, আমি যখন “সরোজিনী”-তে “সরোজিনী”-র অংশ অভিনয় করিতাম, তখন এখনকার “ষ্টার”-এর সুযোগ্য ম্যানেজার মহাশয় ঐ নাটকে বিজয়সিংহের অংশ অভিনয় করিতেন। তিনি এখনও বলেন, ‘সে সময় তোমার সহিত আমার বিজয়সিংহের ভূমিকা লইয়া প্রেমাভিনয় বড় লজ্জা হইত! কিন্তু অভিনয় এত উৎকৃষ্ট হইত যে একদিন অভিনয়কালীন “ভৈরাবচার্য্য” যখন “সরোজিনী”-কে বলি দিতে যায় সেই সময় দর্শকবৃন্দ এত উত্তেজিত হইয়া পড়িয়া ছিল যে ফুটলাইট ডিঙ্গাইয়া ষ্টেজে উঠিতে উদ্যত। তাহাতে মহা গোলযোগ হইয়া ক্ষণেক অভিনয় কার্য্য বন্ধ রাখিতে হইয়াছিল। ইহা তোমার মনে আছে কি?”
“বিষবৃক্ষ”-তে আমি “কুন্দ”-র অংশ অভিনয় করিতাম। আমাদের মতন চঞ্চলস্বভাবা স্ত্রীলোকদের মধ্যে সেই ভীরুস্বভাবা শান্ত, শিষ্ট, এতটুকু হৃদয়মধ্যে অসীম ভালবাসা লুকাইয়া আত্মীয় স্বজন বর্জ্জিত হইয়া পরগৃহ প্রতিপালিতা হইয়া তাহার উপর দুর্ম্মতি বশতঃই হউক, আর অদৃষ্ট দোষেই হউক , সেই প্রেমপূর্ণ হৃদয়খানি চুপে চুপে ভয়ে ভয়ে তাহা অপেক্ষা সহস্রগুণ, রূপে, গুণে, সহায় সম্পদে, ধনে মানে উচ্চ সেই আশ্রয়দাতাকে দান করিয়া, অতিশয় সহিষ্ণুতার সহিত সেই বেদনা ভরা বৃক্ষখানিকে, বুকের মধ্যে লুকাইয়া সেই আশ্রয়দাতাকে আত্মসমর্পণ করিয়া সশঙ্কিত মৃগশিশুর ন্যায় দিন কাটান! উপায় নাই, অবলম্বন নাই, আপনার বলিবার কেহ নাই, আত্মনির্ভরতাও নাই, এই ভাবে অভিনয় করিতে যে কত ধৈর্য্য প্রয়োজন, তাহা সমভাবি অভিনেত্রী ব্যতীত অভিনয় করিতে পারিবেন না! এই সময় মাননীয় গিরিশবাবু মহাশয় আমার সহিত “নগেন্দ্রনাথ”-এর অংশ অভিনয় করিতেন।
“বিষবৃক্ষ”-এর “কুন্দ”র অভিনয়ের পরই “সধবার একাদশী”র “কাঞ্চন’’! কি স্বভাব সম্বন্ধে, কি কার্য্য সম্বন্ধে, কত প্রভেদ! অভিনয়কালে আপনাকে যে কত ভাগে বিভক্ত করিতে হইত তাহা বলিতে পারি না। একটী কার্য্যপূর্ণ ভাব সম্পূর্ণ করিয়া অমনি আর একটী ভাবকে সংগ্রহ করিতে হইবে। আমার এটী স্বভাবসিদ্ধ ছিল। অভিনয় ব্যতীত আমি সদাসর্ব্বক্ষণে এক এক রকম ভাবে মগ্ন থাকিতাম।
“মৃণালিনী”তে “মনোরমা”র চরিত্র সামঞ্জ্যস্য রক্ষা করিয়া চলা যে কতদূর কঠিন, তাহা যাঁহারা না মৃণালিনীর অভিনয় দর্শন করিয়াছেন, তাঁহারা বুঝিবেন না! একসঙ্গে বালিকা, প্রেমময়ী যুবতী, পরামর্শদাত্রী, অবশেষে পরম পবিত্র চিত্ত স্বামী সহমরণ অভিলাষিণী দৃঢ়চেতা সতী রমণী! যে কেহ “মনোরমা”র অংশ অভিনয় করিবে, তাহাকেই একসঙ্গে এতগুলি ভাব দর্শককে প্রদর্শন করিতে হইবে! গাম্ভীর্য্যরে সহিত “পশুপতি”-র সঙ্গে কথা কহিতে কহিতে হঠাৎ বালিকামূর্ত্তি ধরিয়া “পুকুরে হাঁস দেখিগে,” বলিয়া চলিয়া যাওয়া যে কত অভ্যাস ও চিন্তাসাধ্য তাহা ধারণ করাই কঠিন। গাম্ভীর্য্য ভাব পরিত্যাগ করিয়া তৎক্ষণাৎ অবিকল বালিকাভাব ধারণ যদি স্বাভাবিক না হয় তাহা হইলে দর্শকের নিকট অতি হাস্যজনক হইয়া উঠে; “ন্যাকাম” বলিয়া অভিনেত্রী উপহাস্যম্পদ হন! সেই কারণে বঙ্কিমবাবু মহাশয় নিজে বলিয়াছেন যে, “আমি মনোরমার চিত্র পুস্তকেই লিখিয়াছিলাম, কখন যে প্রত্যক্ষ দেখিব এমন আশা করি নাই; আজ বিনোদের অভিনয় দেখিয়া সে ভ্রম ঘুচিল!”
আমার অভিনয় সম্বন্ধে কাগজে-কলমে যে বিস্তর সমালোচনা হইত, তাহা বলা বাহুল্য! সমালোচনায় অবশ্যই নিন্দা প্রশংসা উভয়ই ছিল, কিন্তু তাহাতে নিন্দা বা প্রশংসার কথা কি পরিমাণে ছিল তাহা যাঁহারা আমার অভিনয় দর্শন করিয়াছেন তাঁহারাই জানেন। আমি সমালোচনা বড় দেখিতাম না! তাহার কারণ এই যে, প্রশংসার কথা শুনিয়া আমার দুর্ব্বলচিত্তে অহংকার আসে তবে তো আমি একেবারে নষ্ট হইয়া যাইব। যাহা হউক দয়াময় ঈশ্বর ঐ স্থানটীতে আমায় রক্ষা করিয়াছেন। আমার এমন যেমন নিজেকে হীন ও জগতের ঘৃণিতা বলিয়া ধারণা আছে, তখনও তাহাই ছিল। আমি সুধীগণের দয়ার ভিখারী ছিলাম! তখনকার আমার অভিনয় সম্বন্ধে পরম পূজনীয় স্বর্গীয় শম্ভুনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁহার “রিজ এ- রায়ৎ” পত্রিকায় যাহা লিখিয়াছিলেন তাহার এক সপ্তাহের একখানির এইটুকু লেখা আমি তুলিয়া দিতেছি:
`But last not least shall we say of Binodini? She is not only the Moon of Star Company, but absolutely at the head of her profession in India. She must be a women of considerable culture to be able to show such unaffected sympathy with so many and various characters and such capacity of reproducing them.she is certainly a lady of much refinement of feeling as she shows herself to be one of inimitable grace. On Wednesday she played two very distinct and widely divergent roles, and did perfect justice to both. Her Mrs. BilasiniKarforma, the girl graduate, exhibited so to say an iron grip of the queer phenomenon, the Girl of the period as she appears in Bengal society. Her Chaitanya showed a wonderful mastery of the suitable forces dominating one of the greatest of religious characters who was taken to be the Lord himself and is to this day worshipped as such by millions. For a young Miss to enter into such a being so as to give it perfect expression, is a miracle. All we can say is that genius like faith can remove mountains.”
ইহার ভাবার্থ এই যে-
ষ্টার থিয়োরের অভিনেত্রীবর্গের মধ্যে শ্রীমতী বিনোদিনী চন্দ্রমা স্বরূপা। বলিতে কি তিনি ভারতবর্ষের সমস্ত অভিনেত্রীবৃন্দের শীর্ষস্থানীয়া। বিশেষ শিক্ষিতা ও অভিজ্ঞা বলিয়া তিনি বহুবিধ চরিত্রের স্বাভাবিক সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া তৎচরিত্র প্রদর্শন করিতে সমর্থ হইয়াছেন। এবং তিনি বিশিষ্টরূপ মার্জ্জিতারুচি বলিয়া, কোন অভিনেত্রীই এ পর্য্যন্ত তাঁহার মনোহারিত্ব অনুকরণ করিতে পারেন নাই। বিগত বুধবার (৭ই অক্টোবর ইং ১৮৮৫) তিনি দুইটি বিভিন্ন ও পরস্পর সম্পূর্ণরূপ বিসদৃশ চরিত্রের অভিনয় করিয়া, উভয় চরিত্রের সম্যক সম্মান রক্ষা করিয়াছেন। শিক্ষিত রমণী গ্রাজুয়েড্ বিলাসিনী কারফরমার চরিত্র অভিনয়ে তিনি আধুনিক বঙ্গ সমাজের শিক্ষিতা মহিলার আদর্শরূপা, অদ্ভুত দৃশ্যের কঠোর ভাব প্রদর্শন করিয়া কৃতকার্য্য হইয়াছেন।
আর যে চৈতন্যদেবকে ভগবান জানিয়া লক্ষ লক্ষ লোক পূজা করিয়া কৃতার্থ হয়েন, তাঁহার চরিত্রাভিনয়ে ইনি যে প্রকৃতির বহুবিধ সক্ষম শক্তির উপর প্রাধান্য রাখিয়া থাকেন তাহা বিশেষরূপে বুঝিতে পারা যায়। কুমারী বিনোদিনীর পক্ষে এরূপ মহাপুরুষের চরিত্রাভিনয়ে সেই চরিত্রের সম্যক বিকাশ প্রদর্শন, একপ্রকার অনৈসর্গিক ব্যাপারই বলিতে হইবে, তবে ঐশী প্রতিভা ও বিশ্বাস পর্ব্বতসদৃশ বাধাও অতিক্রম করিয়া থাকে!
আবার কত লোক নিন্দাও করিত, যে নিন্দা অভিনয় সম্বন্ধে নহে। বলিত যে এই এইরূপ লোকদ্বারা এরূপ উচ্চ অঙ্গের চরিত্র অভিনয় করাই দোষ। যাহার যাহা মনে ভাব বলিত! আমাদের সময়ে যেমন প্রশংসা ছিল তেমনি কোনরূপ ত্রুটী হইলে নিন্দার জোরও ততধিক ছিল। অতি সামান্য ক্রুটী হইলে অজস্র কটু কথা দ্বারা গালাগালি দিতেন।
আবার থিয়েটারে কার্য্যকালীন, সময়ে সময়ে কত দৈববিপাকে পড়িতে হইয়াছিল। একবার প্রমীলার চিতা-আহোরণ সময়ে পরিহিত মাথার কাপড় ও চুল একেবারে জ্বলিয়া উঠে। একবার বৃটেনিয়া সাজিয়া শূণ্যে তারের উপর হইতে নীচে একেবারে পড়িয়া যাই। এইরূপ দৈববিপদে যে কতবার পড়িয়াছি কত আর বলিব! অভিনয়কালীন যেমন আমার পার্টের দিকে মন থাকিত, তেমনি পোষাক-পরিচ্ছদের সম্বন্ধেও যত্ন ছিল। ভূমিকা উপযোগী সাজিবার ও সাজাইবার আমার সুখ্যাতি ছিল। যখন নলদয়মন্তীর নূতন অভিনয় হয়, সেই সময় ‘নল’-কে রং ও ড্র্রেস করিয়া দিবার জন্য কোন সাহেবের দোকান হইতে এক সাহেব আসিয়াছিল। যেহেতু অমৃতলাল মিত্র মহাশয় কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন, রং ও পরচুলা অনেক টাকার আসিল। আমাকেও অনেক বল্লেন যে, “তুমিও রং করিয়া লও।” আমি তখন বলিলাম যে, আগে নল মহাশয়ের রং হউক দেখি। পরে “নল”-এর রং করা দেখিয়া আমার মনঃপুত হইল না, বরং হাসি পাইল। যেন তেলচিটা তেলচিটা মনে হইতে লাগিল। আমি তখন বলিলাম যে, “না মহাশয় আমার ড্রেস ও রং আমি আপনি করিতেছি দেখুন!” যখন আমি পোষাক ও রং সম্পূর্ণ করিলাম, সকালে দেখিয়া বলিলেন যে এই রং বেশ হইয়াছে। সেই অবধি অমৃতবাবু যতবার “নল” সাজিতেন ততবারই আমি রং করিয়া দিতাম। অন্য কেহ রং করিয়া দিলে তাঁর পছন্দ হইত না। ইহার দরুণ অন্য এক্ট্রেসরা সময়ে সময়ে অসন্তুষ্ট হইত। আমার একদিন তাড়াতাড়ি থাকাতে বনবিহারিণী (ভুনী) নাম্নী একজন অভিনেত্রী বলিয়াছিল যে, “আসুন অমৃতবাবু, আমি রং করিয়া দিই।” অমৃতবাবু তাহার উত্তরে বলেন যে “রং ও পোষাক সম্বন্ধে বিনোদের পছন্দ সকলের হইতে উত্তম!” আমি সকল সময়েই নিজ নিজের পোষাক ও নং করিতাম, ড্রেসারেরা শুধু সংগ্রহ করিয়া দিতেন। আমি এমন সুরুচিসম্পন্নরূপে ড্রেস করিতে পারিতাম যে আমার পোষাকের কেহই প্রায় নিন্দা করিত না। আমার মাথার চুলগুলি যখন যেভাবে প্রয়োজন হইত সেই ভাবেই বিন্যস্ত করিতে পারিতাম। আমার চুলের কার্লিংগুলি এত সুন্দর হইত যে গিরিশবাবু মহাশয় আদও করিয়া বলিতেন যে, “একজন ইটালিয়ান কবি বলিতেন তাঁহার পুস্তকের একটী সুন্দর বালিকার মুখের এক স্থানের একটী তিলের জন্য তাঁহার জীবন দিতে পারিতেন; তোমার চুলের কার্লিংগুলি দেখিলে ইহার কত দাম ঠিক করিতেন বলিতে পারি না।” হইতে পারে গিরিশবাবু আমায় স্নেহ করিতেন বলিয়া খুব বেশী বলিতেন, কিন্তু আমার ড্রেসের কেহ কখন নিন্দা করেন নাই। এক্ষণকার “ষ্টার থিয়েটার”-এর সুযোগ্য ম্যানেজার শ্রীযুক্ত অমৃতলাল বসু মহাশয়ও আমার ড্রেস করিবার অতিশয় সুখ্যাতি করিতেন। থিয়েটারের অভিনেত্রীদের নিজ নিজ পোষাকের উপর বিশেষ মনোযোগ রাখা প্রয়োজন। যেহেতু একজন লোককে বাল্য, কৈশোর,যৌবন, বার্র্দ্ধক্য সকল দশা অনুযায়ী পরিবর্ত্তিত হইয়া দর্শকসমীপে উপস্থিত হইতে হয়। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, শান্তি, গম্ভীর নানারূপ মনের অবস্থা দেখাইতে হইবে, তখন একই জনকে মুখের ভাব ও অঙ্গভঙ্গীর ভাবও নানারূপ দেখাইতে হইবে। সেইজন্য পোষাকেরও পরিবর্ত্তন চাই! কেননা – “আগে দর্শন ধারী, পিছাড়ি গুণ বিচারী।”
যে সময় আমি থিয়েটারের কার্য্যে জীবিকা অতিবাহিত করিয়াছিলাম, পূর্ব্বে বলিয়াছি তো যে সুকার্য্যে কিছু করি আর না করি বুদ্ধির বিপাকে প্রবৃত্তির অনেক মন্দ কর্ম্ম করিয়া থাকিত। “ষ্টার থিয়েটার” প্রতিষ্ঠা করিবার কালীন এতে ঘাত-প্রতিঘাত সহিতে হইয়াছিল যে ইহার জের থিয়েটার হইতে অবসর লওয়ার পরও শেষ হয় নাই। কোন এক রাত্রির ঘটনা বর্ণনা করিতেছি। আমার গুর্ম্মুখ বাবুর আশ্রয় লইবার সময় আমার পূর্ব্ব আশ্রয় দাতা সম্ভ্রান্ত যুবকের সহিত অতিশয় দাঙ্গা-হাঙ্গামার উপক্রম হওয়ায় আমাকে লুকাইয়া থাকিতে হয়। পরে সর্ব্বকার্য্যে সমাধা করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে প্রকাশ হইলে একদিন পূর্ব্বোক্ত সম্ভ্রান্ত যুবক আমার সহিত দেখা করিয়া বলিলেন যে, “বিনোদ, তুমি আমায় প্রতারণা করিয়া তোমার স্বার্থসিদ্ধি করিয়া লইলে; কিন্তু এ তোমার ভুল। তুমি কতদিন লুকাইয়া থাকিবে? আমি যতদিন বাঁচিব ততদিন তোমার শত্রুতা করিব। তোমার কথার কখনই ব্যতিক্রম হইবে না। তুমি ঠিক জানিও আমার কথা মিথ্যা হইবে না। মৃত্যুর পরও তোমায় দেখা দিব জানিও।” আমি তখন একথা বিশ্বাস করি নাই, বোধ হয় আমার মুখে একটু অবিশ্বাসের হাসিও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ১২৯৬ সালের ৩রা অগ্রহায়ণ যখন তাঁহার মৃত্যু হয়, তখন আমি ইহার সত্যতা অনুভব করিতে সক্ষম হই। তখন আমি থিয়েটার হইতে অবসর লইয়া ঘরে বসিয়াছিলাম। উক্ত রবিবারে সবেমাত্র আমার ঘরে সন্ধ্যার আলো দিয়া গিয়াছে। আমি সেদিন আলস্য ভাবে বিছানায় সন্ধ্যার সময়ই শয়ন করিয়াছিলাম। আমার বেশ মনে আছে যে, আমি নিদ্রিত ছিলাম না। তবে মনটা কেমন অবসন্ন ছিল, সেইজন্য সন্ধ্যার সময়ই শুইয়াছিলাম, কোন কারণ না থাকিলেও যেন দেহ মন অবসন্ন হইয়া আসিতে ছিল। আমি অর্দ্ধ নিমীলিত দৃষ্টিতে আমার ঘরের প্রবেশদ্বারের দিকে চাহিয়াছিলাম, এমন সময় স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম যে সেই বাবুটি মলিন ভাবে আমার ঘরের সম্মুখের দ্বার দিয়া অতি ধীরে ধীরে ঘরের ভিতর আসিয়া আমার মাথার দিকে খাটের ধারে হাত দিয়া দাঁড়াইলেন! এবং আমায় সম্বোধন করিয়া অতি ধীর ও শান্ত ভাবে বলিলেন যে, “মেনি, আমি আসিয়াছি!” তিনি প্রায়ই আমায় “মেনি” বলিয়া ডাকিতেন। আমার বেশ মনে আছে যে যখন তিনি ঘরের মধ্যে আসেন তখন আমার দৃষ্টি বরাবর তাঁর দিকেই ছিল। তিনি খাটের নিকট দাঁড়াইবামাত্র আমি চমকিত ও বিস্মিত হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম, “একি! তুমি আবার কেন আসিয়াছ?” তিনি যেন কাতর নয়নে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আমি যাইতেছি তাই তোমাকে বলিতে আসিয়াছি।’’ তাঁহার কথা কহিবার সময় কোনরূপ চঞ্চলতা বা অঙ্গ চালনা কিছুই ছিল না; যেন মাটীর তৈয়ারী পুতুলের মতন মুখ হইতে কথা বাহির হইতেছিল! আমার একবার মাত্র মনে হইল যে তিনি একটু সরিয়া আমার দিকে হাত তুললেন। একটু ভয়ও হইল, আমি ভয়ে কিছু পশ্চাৎ সরিয়া গিয়া বলিলাম, “সেকি। তুমি কোথায় যাইতেছ? আর কত দুর্ব্বল হইয়াছ কেন?” তিনি যেন আরও বিষন্ন ও স্থির হইয়া বলিলেণ, “ভয় পাইও না আমি তোমায় কিছু বলিব না; আমি বলিয়াছিলাম যে আমি যাইবার সময় তোমায় বলিয়া যাইব, তাই বলিতে আসিয়াছি, আমি যাইতেছি!” এই কথা বলিয়া তিনি ধীরে ধীরে প্রস্তর মূর্ত্তির ন্যায় সেই দরজা দিয়াই চলিয়া যাইলেন!
ভয়ে ও বিস্ময়ে আমি চমকিত হইয়া তৎক্ষণাৎ বিছানা হইতে উঠিয়া বাহিরে আসিলাম, কিন্তু আর কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না। তখন উপর হইতে উচ্চঃস্বরে আমার মাতাঠাকুরানীকে ডাকিয়া বলিলাম, “মা উপরে কে আসিয়াছিল?” মা বলিলেন, “কে উপরে যাইবে? আমি তো এই সিঁড়ির নীচেই বসিয়া রহিয়াছি।” আমি বলিলাম, “হ্যাঁ, মা অমুক বাবু যে আসিয়াছিলেন!” আমার মা হাসিয়া বলিলেণ, “দরজায় মিশির বসিয়া আছে, আমি সদর পর্য্যন্ত দেখিতে পাইতেছি; কে আসিবে? তুই স্বপ্ন দেখ্লি নাকি? (মিশির আমাদের দারওয়ান) কোন ব্যক্তি বাহির হইতে আসিলে অগ্রে সে খবর দেয়।” তখন আর কিছু না বলিয়া ভাবিতে ভাবিতে ঘরে চুপ করিয়া শুইয়া মনে করিতে লাগিলাম, যে কি হইল? সত্য কি স্বপ্ন দেখিলাম নাকি? তাহার পর দিবস সন্ধ্যায় আমি বাটীর ভিতর বারান্দায় বসিয়া আছি, আর আমার মাতা কি কার্য্যবশতঃ সদর দরজায় গিয়াছিলেন। এমন সময় রাস্তার মধ্য হইতে এক ব্যক্তি একখানা ঠিকাগাড়ীর ভিতর হইতে বলিয়া উঠিলেন, ওগো গিন্নি! শুনিয়াছ, গত কল্য সন্ধ্যার সময় বাবুর মৃত্যুর হইয়াছে। সেই লোকটা মৃত ব্যক্তির একজন কর্ম্মচারী! তাহার কথা রাস্তা হইতে আমি স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম।
আমার অন্তর কাঁপিয়া উঠিল। ভাবিলাম সত্যই কি তাঁহার মৃত্যুর পর তিনি সত্যপালন করিয়া গেলেন। পূর্ব্ব দিনের স্মৃতি আসিয়া ভয়ে ও বিস্ময়ে আমার শরীর যেন বরফের মত শীতল অনুভব হইতে লাগিল।
এই ক্ষুদ্র ঘটনা লিখিবার উদ্দেশ্য অন্য কিছুই নহে, মৃত্যুর পর মানুষ যে স্ব-রূপে কোন জীবিত ব্যক্তির নয়নগোচর হইতে পারে, ইহা আমার ধারণার অতীত ছিল। কিন্তু অন্য কেহ কখন যদি এমন অবস্থা প্রত্যক্ষ করিয়া থাকেন, তাঁহাদের মনের বিশ্বাসকে আরও একটু বলবান করিবার জন্য ইহা লিখিলাম।
আর একটী ঐরূপ ঘটনা ঘটে, তাহা আমার একজন আত্মীয় প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। যদিও সেই ঘটনার সঙ্গে নিন্মলিখিত ঘটনার কোন সম্বন্ধ নাই, তথাপি সাদৃশ্য বোধে লিখিলাম।
আমার কনিষ্ঠা কন্যার যখন মৃত্যু হয়, সেইদিন ঠিক সেই সময়ে আমার সেই কন্যা অথবা তাহার ছলনাময়ী মূর্ত্তি সেই আত্মীয়টীর প্রত্যক্ষীভূত হয়। আমিও যেমন আলস্য-জড়িত-দেহে শুইয়াছিলাম মাত্র, তিনিও সেইরূপ সুষুপ্তি হইতে অন্তরে ছিলেন। আমার কন্যা-মূর্ত্তিকে দেখিয়া বলেন, “একি! কালো! তুই এখানে?” তিনি তখন কলিকাতার বাহিরে বাহিরে বাস করিতেছিলেন। মূর্ত্তি উত্তর করিল, “হ্যাঁ!” আত্মীয় তাহাতে বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “সে কি! এত অসুস্থ শরীরে তুই এলি কি করে মা?” ছায়াময়ী উত্তর করিল, “এলুম!” দুটি-তিনটি কথা কহিয়া তিনি যেমন উঠিয়া বসিলেন, আর দেখিতে পাইলেন না! নিমেষে অদৃশ্য হইল! মানব-জীবনের শ্রেষ্ঠ পরিণাম মৃত্যু! কিন্তু তাহার শেষ গতি কি তাহার মীমাংসা কে করিবে? বহু দার্শনিকের বহু প্রকার সিদ্ধান্ত! কাজেই লেখনী এখানে মূক! তবে মৃত মনুষ্য যে কথা কহিতে পারে ইহাও আশ্চর্য্য! ঘইতে পারে আমার ভ্রম এবং অনেকেও তাহা বলিতে পারেন। যদি কেহ কখন মৃত আত্বার সাক্ষাৎ পাইয়া থাকেন, তবে তিনিই আমার কথা সত্য বলিয়া মানিতে পারেন! কিন্তু আত্বা যদি অবিনাশী হয় এবং ইচ্ছাশক্তিতে যদি দেহের গঠন হয় তবে এইগুলি বোধ হয় অবিশ্বাস্য নয়।
আমার এই ক্ষুদ্র কথার ভিতর ষ্টার থিয়েটার সম্বন্ধে লিখিবার অন্য উদ্দেশ্য নাই; তবে, যে ষ্টার থিয়েটার স্বদেশে, বিদেশে, সুযশে, সুনামে পরিপূর্ণ ছিল – আমি এক্ষণে সে ষ্টার থিয়েটার হইতে বহু দূরে; হয় তো আমার স্মৃতি পর্য্যন্ত এক্ষণে তাহার নিকট হইতে বিলুপ্ত হইয়াছে। কেননা সে বহু দিনের কথা! চিরদিন কখন সমান যায় না! আজ জগৎ জোড়া যশের বোঝা লইয়া সংসার ক্ষেত্রে যে “ষ্টার থিয়েটার”-এর নাম উন্নত বক্ষে অবস্থান করিতেছে, সেও একদিন এই ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র স্ত্রীলোককে বিশেষ আত্মীয়া বলিয়া মনে করিত! এক্ষণে শত আরাধনায় যাহাদের একবারমাত্র দেখা পাওয়া যায় না, কিন্তু এমন দিন গিয়াছে যে এই অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি আত্মত্যাগ না করিলে হয় তো কোন আঁধারের কোণে কাহাকে পড়িয়া থাকিতে হইত! তাই বলি চিরদিন কখন সমান যায় না! লোকে দিন পায়, আবার সেদিনও চলিয়া যাইতে পারে! লোকে দিন পায়, আবার সেদিনও চলিয়া যাইতে পারে! হৃদয় শোকে-তাপে বিজড়িত হইলে, যাতনায় অস্থির হইলে, যাহাদের আপনার মনে করা যায় বা যাহারা এক সময় অতিশয় আত্মীয়তা জানাইয়াছিল, তাহাদের নিকট সহানুভূতি পাইতে আশা করে, তাই আপনা হইতে পূর্ব্ব স্মৃতি মনে আসে! সেজন্য পূর্ব্ব স্মৃতি মনে আসে! সেজন্য পূর্ব্ব কথা তুলিলাম। ইহার মধ্যে অতিরঞ্জিত কিছুই নাই। আর আমার মত ক্ষুদ্রপ্রাণ স্ত্রীলোকের এক্ষণকার সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের প্রতি কোন অতিরঞ্জিত কথা বলিবার সাহস কেন হইবে, আর আমি গর্ব্ব করিয়াও কোন কথা বলি নাই! সে স্বার্থ আমি নিজে ইচ্ছা করিয়া ত্যাগ করিয়াছিলাম, তাহার জন্য অপরের বাধ্য নহে। শুদ্ধ বুদ্ধিহীনা স্ত্রী স্বভাবের দুর্ব্বলতা বশতঃ একথা উঠিল, নচেৎ এ ক্ষুদ্র কথা উল্লেখযোগ্যও নহে এবং ইহা বহুদিনের কথা বলিয়া হয় তো কোন একটা গোলও হইতে পারে, ইহার জন্য এখন যাহারা আমার সহিত মৌখিক সদ্ভাব রাখিয়াছেন তাহারা না বিরূপ হয়েন। বহুদিনের ঘটনা মনে করিয়া লিখিতে গেলে হয় তো তাহার দু’একটি গোলও হইতে পারে।
এই ভাবে কার্য্যক্ষেত্রে জীবনের প্রথম উদ্ভাসিত অবস্থায় দিন কাটিয়া গিয়াছিল। বাহ্যিক অবস্থা তো বড়ই ঘৃণিত। পতিত। কিন্তু যাঁহারা এই ক্ষুদ্র লেখা দেখে ঘৃণা বা উপহাস করিবেন, তাঁহারা যেন এ পুস্তক পাঠ না করেন। কেন না রমণী জীবনে যাহা প্রধান ক্ষত স্থান তাহাতে লবণ দিয়া নাই বিরক্ত করিলেন। যাঁহারা দুঃখিনী হতভাগিনী বলিয়া একটুকানি দয়া করিয়া সহানুভূতি দেখাইবেন তাঁহারা যেন এ হৃদয়ের মর্ম্ম ব্যাথা বুঝেন। এই ভাগ্যহীনা হতভাগিনীর হৃদয় যে কত দীর্ঘশ্বাসে গঠিত, কত মর্ম্মভেদী যাতনার বোঝা হাসিমুখে চাপা, কত নিরাশা হা-হুতাশ, দিবানিশি আকুলভাবে হৃদয় মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে – কত আকাঙক্ষার অতৃপ্ত বাসনা, যাতনার জ্বলন্ত জ্বালা লইয়া ছুটাছুটি করিতেছে – তাহা কি কেহ কখন দেখিয়াছেন? অবস্থার গতিকে নিরাশ্রয় হইয়া স্থানাভাবে আশ্রয়াভাবে বরাঙ্গনা হয় বটে; কিন্তু তাহারাও প্রথমে রমণী-হৃদয় লইয়া সংসারে আসে। যে রমণী স্নেহময়ী জননী, তাহারাও সেই রমণীর জাতি! যে রমণী জ্বলন্ত অনলে পতি সনে পুড়িয়া মরে, আমরাও সেই একই নারী-জাতি। তবে গোড়া হইতে পাষাণে পড়িয়া আছাড়্ পিছাড়্ খাইতে খাইতে একেবারে চুম্বক ঘর্ষিত লৌহ যেরূপ চুম্বক হয়, আমরাও সেইরূপ পাষাণে ঘর্ষিত হইয়া পাষাণ হইয়া যাই! আরও একটী কথা বলি, সকলেই সমান নহে; যে জীবন অজ্ঞানতা অন্ধকারে আচ্ছন্ন করিয়া আছে, তাহা এক রমন নির্জীব ভাবে জড় পদার্থের মত চলিয়া যায়। কিন্তু যে জীবন দূরে দূরে উচ্ছল আলোক সৃষ্টি করিতেছে অথচ পতিত হইয়া আত্মীয়, সমাজ, স্বজন-বন্ধন হইতে বঞ্চিত তাহাদের জীবন যে কতদূর কষ্টকর, যন্ত্রণাদায়ক তাহা ভুক্তভোগী ব্যতীত কেহই অনুভব করিতে পারিবে না। বরাঙ্গনা জীবন কলঙ্কিত ঘৃণিত বটে। কিন্তু সে কলঙ্কিত ঘৃণিত কোথা হইতে হয়? জননী জঠর হইতে তো একেবারে ঘৃণিতা হয় নাই? জন্ম মৃত্যু যদি ঈশ্বরাধীন হয়, তবে তাহাদের জন্মের জন্য তো তাহারা দোষী হইতে পারে না? ভাবিতে হয় এ জীবন প্রথম ঘৃণিত করিল কে? হইতে পারে কেহ কেহ স্বেচ্ছায় অন্ধকারে ডুবিয়া নরকের পথ পরিষ্কার করে। কিন্তু আবার অনেকেই পুরুষের ছলনায় ভুলিয়া তাহাদের বিশ্বাস করিয়া চির কলঙ্কের বোঝা মাথায় লইয়া অনন্ত নরক যাতনা সহ্য করে। সে সকল পুরুষ কাহারা? যাঁহারা সমাজ মধ্যে পূজিত আদৃত তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ নন্ কি? যাঁহারা লোকালয়ে ঘৃণা দেখাইয়া লোক চক্ষুর অগোচরে পরম প্রণয়ীর ন্যায় আত্মত্যাগের চরম সীমায় আপনাকে লইয়া গিয়া ছলনা করিয়া বিশ্বাসবতী অবলা রমণীর সর্ব্বনাশ সাধন করিয়া থাকেন, হৃদয়ের ভালবাসা দেখাইয়া আত্ব-সমর্পণকারী রমণী হৃদয়ে বিষের বাতি জ্বালাইয়া অসহায় অবস্থায় দূরে ফেলিয়া অন্তর্হিত হন, তাঁহারা কিছুই দোষী নহেন! যে সকল হতভাগিনীর সুধাবোধে বিষপান করিয়া চিরজীবন জর্জ্জরিত হইয়া হৃদয়-জ্বালায় জ্বলিয়া মরে, তাহাদের কি? যে ভাগ্যহীনা রমণীরা এইরূপে প্রতারিতা হইয়া আপনাদের জীবনকে চির শশ্মানময় করিয়াছে, তাহারাই জানে যে বারাঙ্গনা জীবন কত যন্ত্রণাদায়ক! যাতনার তীব্রতা তাহারাই মর্ম্মে মর্ম্মে অনুভব করিতেছে। আবার এই বিপন্নাদের পদে পদে দলিত করিবার জন্য অবলা-প্রতারকেরাই সমাজপতি হইয়া নীতি পরিচালক হন! যেমন ভাগ্যহীনাদের সর্ব্বনাশ করিয়াছেন, তাহারা যদি তাহাদের সুকুমারমতি বালক-বালিকাদের সৎপথে রাখিবার জন্য কোন বিদ্যালয়ে বা কোন কার্য্য শিক্ষার জন্য প্রেরণ করে, তখন ঐ সমাজপতিরাই শত চেষ্টা দ্বারা তাহাদের সেই স্থান হইতে দূর করিতে যত্নবান হন। তাঁহাদের নীতিজ্ঞতার প্রভাবে অভাগা বালক-বালিকারাও জীবিকা নির্ব্বাহের জন্য পাপ পথের পথিক হইতে বাধ্য হইয়া বিষ-দৃষ্টির দ্বারা জগতের দিকে চাহিয়া থাকে। সুকুমারমতি বালিকাদের পবিত্র সরলতা হৃদয় যাইতে যাইতে না যাইতে, তাহাদের হৃদয়ে মধুরতা সমাপ্ত না হইতে, তাহাদের কচি হৃদয়খানি অবিশ্বাস অনাদরের জ্বালায় জ্বলিয়া উঠে। এমন পুরুষ-প্রবর অনেকেই আছেন, যে নিজের নিজের প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হইয়া, আত্মদমনে অক্ষম হইয়া, একজন অবলার চিরজীবনের শাস্তি নষ্ট করিয়া – সমানে ঘৃণিত, স্বজনে বঞ্চিত, লোকালয়ে লাঞ্ছিত, মর্ম্মে মর্ম্মে পীড়িত করিয়া পৌরুষ জ্ঞান করেন। হায়! ভাগ্যহীনা রমণী, কি ভুল করিয়াই আত্ববিনাশ কর! পঙ্কে যে পদ্ম ফুটে তাহা দেবতা মস্তক পাতিয়া লন; কেননা তিনি ঈশ্বর! আর মানুষেরা সুকুমারমতি বালিকাগণকে লতা হইতে বিচ্যুত করিয়া পদে দলিত করেন, কেননা ইহারা মানুষ! যাক। সে ভুল সারাজীবনকে বিষময় করে, তাহা যে কি ভয়ানক ভুল, তাহা এই ভাগ্যহীনারাই বুঝে! শত দোষ করিলে ক্ষতি নাই; কিন্তু “নারীর নিস্তার নাই টলিলে চরণ।”
এক্ষণে নানাকারণ বশতঃ থিয়েটার হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া সুখ-দুঃখময় জীবন নির্জ্জনে অতিবাহিত করিতেছিলাম। এই নানা কারণের প্রধান কারণ যে আমায় অনেক রূপে প্রলোভিত করিয়া কার্য্য উদ্ধার করিয়া লইয়া আমার সহিত যে সকল ছলনা করিয়াছিলেন, তাহা আমার হৃদয়ে বড় লাগিয়াছিল। থিয়েটার বড় ভালবাসিতাম তাই কার্য্য করিতাম। কিন্তু ছলনার আঘাত ভুলিতে পারি নাই। তাই অবসর বুঝিয়া অবসর লইলাম। এই দুঃখময় জীবনের একটী সুখের অবলম্বন পাইয়াছিলাম। একটী নির্ম্মল স্বর্গচ্যুত কুসুমকলিকা শাপভ্রষ্টা হইয়া এ কলঙ্কিত জীবনকে শান্তিদান করিতেছিল। কিন্তু এই দুঃখিনীর কর্ম্মফলে তাহা সহিল না! আমার শান্তির চরমসীমায় উপস্থিত করিবার জন্য সেই অনাঘ্রাতে স্বর্গীয় পারিজাতটী আমায় চিরদুঃখিনী করিয়া এই নৈরাশ্যময় জীবনকে জ্বালার জ্বলন্ত পাবকে ফেলিয়া স্বর্গে চলিয়া গিয়াছে। সে আমার বড় আশা ও আদরের ধন ছিল। তাহার সরল পবিত্র চক্ষু দুটীতে স্বর্গের সৌন্দর্য্য উথলিয়া পড়িত। সেই স্নেহময় নির্ভর পরায়ণা হৃদয়টীতে দেবীর পবিত্রতা, ফুলের অসীম সৌন্দর্য্যরাশি, জাহ্নবীর পবিত্র কুল কুল ধ্বনি, বিকশিত পদ্মের ন্যায়, মধুময় হৃদয়ের পবিত্রতা রশি সদাই উথলিয়া আমার জীবনকে আনন্দময় করিয়া রাখিত। তাহার সেই আকাঙক্ষা-রহিত নিম্মর্লতা কত উচ্চে আমাকে আকর্ষণ করিত। এ দেবতার দয়ার দান, অভাগিনীর ভাগ্য দোষে দেবতার দান সহিল না। আমার সকল আশা নির্ম্মূল করিয়া আমার অন্ধকার হৃদয়ে বিষময় বাতি জ্বালিয়া দিয়া সে আমার চলিয়া গিয়াছে! এখন আমি একা পৃথিবীতে, আমার আর কেহই নাই, শুধুই আমি একা! এখন আমার জীবন শূন্য মধুময়! আমার আত্বীয় নাই, স্বজন নাই, ধর্ম্ম নাই, কর্ম্ম নাই, কার্য্য নাই, কারণ নাই! এই শেষ জীবনে ভগ্নহৃদয়ে জ্বালাময়ী প্রাণ লইয়া অসীম যন্ত্রণার ভার বহিয়া আমি মৃত্যু পথপানে চাহিয়া বসিয়া আছি।
আশা, উদ্যম, ভরসা, উৎসাহ, প্রাণময়ী সুখময়ী কল্পনা, সকলই আমায় ত্যাগ করিয়া গিয়াছে! অহরহঃ শুধু যন্ত্রণার তীব্র দংশন! এই আমি – অসীম সংসার প্রান্তরে একটী সুশীতল বটবৃক্ষের একটু ছাওয়ায় বসিয়া কতক্ষণে চির শান্তিময় মৃত্যু আসিয়া দয়া করিবে তাহারই অপেক্ষা করিতেছি। সেই সুবিশাল সুশীতল তরুই আমার এই জীবন্মৃত অবস্থার আশ্রয় স্থান! আমার অন্তর ব্যাথা অনের নিকট হাস্যাম্পদ হইলেও আমি ইহা লিখিলাম। কেননা লোকের নিকট হাস্যাস্পদ হইবার আর আমার ভয় নাই। লোকেই সে ভয় দূর করিয়াছে। তাহাদের নিন্দা বা সুখ্যাতি আমার নিকট সকলই সমান! গুণী, জ্ঞানী, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা লিখেন, লোকশিক্ষার জন্য, পরোপকারের জন্য, আমি লিখিলাম, আমার নিজের সান্তনার জন্য, হয়তো প্রতারণা বিমুগ্ধ নরক পথে পদবিক্ষেপোদ্যতা কোন অভাগিনীর জন্য। কেননা আমার আত্মীয় নাই, আমি ঘৃণিতা, সমাজবর্জ্জিতা, বারবণিতা; আমার মনের কথা বলিবার বা শুনিবার কেহ নাই! তাই কালি-কলমে লিখিয়া আপনাকে জানাইলাম। আমার কলুষিত কলঙ্কিত হৃদয়ের ন্যায় এই নির্ম্মল সাদা কাগজেরও কলঙ্কিত করিলাম। কি করিব! কলঙ্গিনীর কলঙ্ক ব্যতীত আর কি আছে?
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024