আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (লাস্ট পার্ট)
—————————————————————–
কথা বলতেছিলাম আমরা (আমি আর রক মনু) যে, বাঈজিরা কিভাবে নন-কলোনিয়ান ফেমিনিজমের সম্ভাবনা ছিলেন বা হইতে পারতেন। যার লাস্ট স্টেইজটা কিছুটা দেখা যায় বিনোদিনী দাসী’র টাইমে আইসা। কলোনিয়ান টাইম শুরু হওয়ার পরে বাঈজী শব্দটা বেশ্যা’র সিনোনেইমস হইতে পারছে। লখনৌ থিকা দিল্লী হয়া কলকাতা’তে হিজরত কইরা মরতে পারছে প্রি-কলোনিয়াল এই আর্ট কালচারগুলা। হিস্ট্রিতে ‘কলকাতা’ পিরিয়ড’টা সবচে মরবিড একটা টাইম হিসাবে আইডেন্টিফাইড হওয়ার কথা। যার একটা ইলিমেন্ট অবশ্যই সোসাইটিতে ইন্ডিপেন্ডেড উইমেনের জায়গাটারে আরো ন্যারো কইরা তোলা। ইউরোপের ভিক্টোরিয়ান এইজ রেপ্লিকেট হইছে কলকাতায়। শরীর বাজে জিনিস একটা। বাঈজীদের নাচা-গানাও মেইনলি শরীর বেচারই ধান্দা। এই যে ‘আল্টিমেট’রে বুইঝা ফেললাম আমরা, তখন অন্য সবকিছু হাওয়া হয়া গেলো। ওমরাওজান সিনেমাতে রেখা কবিতাই লিখতেছেন, তারপরও যতোটা না বাঈজী তার চাইতে বেশ্যাই। একটা সিঙ্গুলার সোসাইটিতে সিঙ্গুলার আইডেন্টিটি নিয়া থাকতে থাকাটাই ঘটনা। কেমনে আপনি টাকা রোজগার করেন সেইটাই হইতেছেন ‘আসল’ আপনি। এই থট প্রসেসে বিনোদিনীও সাবস্ক্রাইব করছেন আর বারবার মাফ চাইছেন যে, উনি তো ‘ভালো’ মেয়েমানুষ না।
মুশকিল হইলো, একটা ভালোর এগেনেস্টে একটা খারাপরেই আপহোল্ড করতে হইছে উনারে। উনার রিডার’রাও এই আক্ষেপে স্যাড হওয়ার বেশি কিছু করতে পারবেন বইলা মনেহয় না। কারণ কম বা বেশি আমরা এই চিন্তা-পদ্ধতিরই ভেড়া। ঘটনা এইটা না যে, বিনোদিনী দাসী কি পারছেন বা পারেন নাই, বরং উনার অ্যাক্টটারে উনি বা আমরা কিভাবে রিড করতেছি – সেইটাই ঘটনা। ট্রাজেডি এইটা না যে উনি কাছের মানুষদের দিয়া প্রতারিত হইছেন উনার প্রফেশনাল লাইফে, কিন্তু এখনো এই ট্রিকসটারে ‘বাস্তবতা’ বইলা মাইনা নিয়া উদাস হইতে রাজি থাকতে পারতেছি আমরা।
তো, বিনোদিনী দাসী’র এই টেক্সট উদাসীনতা আর বিষন্নতার বাইরে একটা অস্বস্তিরেও ইনসার্ট করতে পারে হয়তো। আমাদের উদ্দেশ্য এইটুক সিগনিফিকেন্সরেই ইনিশিয়ালি হাইলাইট করতে চাওয়া।
ই.হা.
——————————————————————
প্রথম খন্ডের শেষের দুটি কথা
এতদিনে আমার কর্ম্মতরু সম্পূর্ণরূপে ফলফুলে পূর্ণ হইয়া আমার অদৃষ্টাকাশে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করিয়া ছাইয়া উঠিল। এইবার সব ঠিক!
কারণ কি তাহার কৈফিয়ত দিতেছি। অনেক দিবস হইল গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের বিশেষ অনুরোধে আমার নাট্যজীবনী লিখিতে আরম্ভ করি; তিনি ইহার প্রতি ছত্র, প্রতি লাইন দেখিয়া শুনিয়া দেন; তিনি দেখিয়া ও বলিয়া দিতেন মাত্র, কিন্তু একছত্র কখন লিখিয়া দেন নাই। তাঁহার বিশ্বাস ছিল যে আমি সরলভাবে সাদা ভাষায় যাহা লিখি তাঁহার নিকট সেই সকল বড় ভালই বলিয়া মনে হয়।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
এইরূপে আমার জীবনী লিখিয়া “আমার কথা” নাম দিয়া ছাপাইবার সঙ্কল্প করি। তিনিও এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগী হন। কিন্তু তিনি মধ্যে মধ্যে রোগ যাতনা ভোগ করিবার জন্য ও নানা ঝঞ্ঝাটে কতদিন চলিয়া যায়। পরে তাঁহার পরিচিত বাবু অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ছাপাইবার জন্য কল্পনা করেন। কিন্তু আমার কতক অসুবিধা বশত: হ্যাঁ-না , এইরূপ নানা করণে তখন হয় নাই। তাহার পর আমি মরণাপন্ন রোগগ্রস্থ হইয়া চারি মাস শয্যাগত হইয়া পড়িয়া থাকি; আমার জীবনের কোন আশাই ছিল না; শত শত সহস্র অর্থ ব্যয় করিয়া, নানাবিধ চিকিৎসা শুশ্রূষা, দৈবকার্য্য করিয়া, প্রায় অনাহারে, অনিদ্রায় বহু অর্থ ব্যয়ে দেবতাস্বরূপ আমার আশ্রয়দাতা দয়াময় মহামহিমান্বিত মহাশয় আমায় মৃত্যুমুখ হইতে কাড়িয়া লইলেন। ডাক্তার, সন্ন্যাসী, ফকির, মোহস্ত, দৈবজ্ঞ, বন্ধু-বান্ধব সকলে একবাক্যে বলিয়াছিলেন যে, “মহাশয় শুধু আপনার ইচ্ছার জোরে (well force) ইনি জীবন পাইলেন।” সেই দয়াময় তাঁহার ধন-সম্পত্তি, তাঁহার মহজ্জীবন একদিকে; আর এই ক্ষুদ্র পাপীয়সীর কলঙ্কিত জীবন একদিকে করিয়া দারুণ ব্যাধির হস্ত হইতে আমায় রক্ষা করিলেন। আমি ব্যাধির যাতনায় বিগত নাড়ী হইয়া জ্ঞান হাড়াইলে, তিনি আমার মস্তকে হাত রাখিয়া স্নেহময় চক্ষুদুটী আমর চক্ষের উপর রাখিয়া, দৃঢ়ভাবে বলিতেন, “শুন, আমার দিকে চাহ; অমন করিতেছ কেন? তোমার কি বড় যাতনা হইতেছে? তুমি অবসন্ন হইও না! আমি জীবিত থাকিতে তোমায় কখন মরিতে দিব না। যদি তোমার আয়ু না থাকে তবে দেবতা সাক্ষী, ব্রাহ্মন সাক্ষী, তোমার এই মৃত্যুতুল্য দেহ সাক্ষী আমার অর্দ্ধেক পরমায়ু তোমায় দান করিতেছি, তুমি সুস্থ হও! আমি বাঁচিয়া থাকিতে তুমি কখনই মরিতে পাইবে না। ”
সেই সময় তাঁহার চক্ষু হইতে যেন অমৃতময় স্নেহপূর্ণ জ্যোতি: বাহির হইয়া আমার রোগক্লিষ্ট যাতনাময় দেহ অমৃতধারায় স্নাত করাইয়া শীতল করিয়া দিত। সমস্ত রোগ-যাতনা দূরে চলিয়া যাইত। তাঁহার স্নেহময় হস্ত আমার মস্তকের উপর যতক্ষণ থাকিত আমার রোগের সকল যাতনা দূরে যাইত।
এইরূপ প্রায় দুই-তিনবার হইয়াছিল; দুই-তিনবারই তাঁহারই হৃদয়ের দৃঢ়তায় মৃত্যু আমায় লইতে পারে নাই। এমন কি শুনিয়াছি অক্সিজেন গ্যাস দিয়া আমায় ১২/১৩ দিন রাখিয়াছিল। যাঁহারা সে সময় আমার ও তাঁহার বন্ধুবান্ধব ছিলেন, তাঁহারা এখনও সকলে বর্ত্তমান আছেন। সেই সময় মাননীয় বাবু অমৃতলাল বসু মহাশয়, উপেন্দ্রবাবু, কাশীবাবু প্রভৃতি প্রতিদিন উপস্থিত থাকিয়া আমায় যত্ন করিতেন; সকলেই এ কথা জানিত।
বুঝি এইরূপ সুস্থদেহে অসীম যাতনার বোঝা বাহিতে হইবে বলিয়া, অতি হৃদয়শূন্য ভাবে লোকের নিকট উপেক্ষিত হইতে হইবে বলিয়া, অবস্থার বিপাকে এইরূপ দুশ্চিন্তায় পড়িতে হইবে বলিয়া, অসহায় অবস্থায় এইরূপ অসীম যাতনার বোছা বুকে করিয়া সংসার সাগরে ভাসিতে হইবে বলিয়া, আমার দূরদৃষ্ট তাঁঁহার বাসনার সহিত যোগ দিয়াছিল! বোধহয় তাহাতেই সেই সময় আমার মৃত্যু হয় নাই। অথবা ঈশ্বর তাঁহার পরম ভক্তের বাক্যের ও কামনার সাফল্যের জন্যই আমায় মৃত্যুমুখ হইতে ফিরাইয়া দিলেন! কেননা আমার হৃদয়-দেবতা তিলেকে শতবার বলিতেন যে, “সংসারে কাজ করি সংসারের জন্য; শান্তি তো পাই না; তাই বলিতেছি যে তুমি আমার আগে কখন মরিতে পাইবে না।” আমি যখন তাঁহার চরণে ধরিয়া কাতরে বলিতাম, “এখন আর ও সকল কথা তুমি আমায় বলিও না। ত্রিসংসারে এ হতভাগিনীর তুমি বই আশ্রয় নাই। এ কলঙ্কিনীকে যখন সংসার হইতে তুলে আনিয়া চরণে আশ্রয় দিয়াছিলে তখন তাহার সকলই ছিল! মাতামহী, মাতা, জীবন জুড়ান কন্যা, বঙ্গভূমের সুখসৌভাগ্য, সূযশ, আশাতীত সম্পদ, বঙ্গ রঙ্গভূমের সমসাময়িক বন্ধুগণের অপরিসীম স্নেহ মমতা সকলই ছিল, তোমারই জন্য সকল ত্যাগ করিয়াছি; তুমি আমায় ত্যাগ করিয়া যাইও না। তুমি ফেলে গেল আমি কোথায় দাঁড়াইব।” তিনি হাসিয়া দৃঢ়তার সহিত বলিতেন যে, “সেজন্য ভেব না, তোমার অভাব ব্যতীত তোমার অন্য কোন অভাবই থাকিবে না। এমন বংশে জন্মগ্রহণ করি নাই যে এতদিন তোমায় এত আদরে এত যত্নে আশ্রয় দিয়া, তোমার এই রুগ্ন অসমর্থ অবস্থায় তোমার শেষ জীবনের দারুণ অবাবের মধ্যে ফেলিয়া চলিয়া যাইব। তাহার প্রমাণ দেখ যে আমার আত্মীয়দিগের সহিত একভাবে তোমায় আশ্রয় দিয়া আসিতেছি। এত জেনে শুনে যে তোমায় বঞ্চিত করবে – আমার অভিশাপে সে উৎচ্ছন্নে যাইবে।”
তাঁহার মত সহৃদয় দয়াময় যাহা বলিবার তাহা বলিয়া সান্ত্বনা দিতেন, কিন্তু কার্য্যকালে আমার অদৃষ্ট, তীক্ষ অসি হস্তে আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, আমার জীবনভরা সমস্ত আশাকে ছেদন করিতেছে! আজ তিন মাস হইল এই অসহায়া অভাগিনী কাহারও নিকট হইতে তিন দিনের সহানুভূতি পাইল না; অভাগিনীর ভাগ্য! দোষ কাহারও নয় – কপাল! প্রাক্তনের ফল!! পাপিনীর পাপের শাস্তি!!!
এই রোগ হইতে মুক্ত হইয়া আমি বৎসরাধিক উত্থানশক্তিহীন হইয়া জড়বৎ ছিলাম। পরে আমায় চিকিৎসকদিগের মতানুযায়ী বহুস্থানে, বহু জল-বায়ূ পরিবর্ত্তন করাইয়া, হৃদয়দেবতা আমার স্বাস্থ্য সম্পূর্ণরূপে দান করিয়া গিয়াছেন।
এইরূপ নানা অসুবিধায় এই পুস্তক তখন ছাপান হইল না। গিরিশবাবু দারুণ ব্যাধিতে স্বর্গে গমন করিলেন। তিনিও আমায় বলিয়াছিলেন যে, “বিনোদ! তুমি আমার নিজের হাতের প্রস্তুত, সজীব প্রতিমা! তোমার জীবন-চরিত্রের ভূমিকা আমি স্বহস্ত লিখিয়া তবে মরিব”; কিন্তু একটা কথা আছে যে, “মানুষ গড়ে, আর বিধাতা ভাঙ্গে”, (“Man proposes, but God disposes”) আমার ভাগ্যেই তাহা প্রত্যক্ষ প্রমাণ!
পরে ভাবিলাম যে যাহা হয় হইবে; বই হউক আর নাই হউক, আমার শেষ আকাঙক্ষা বড়ই ছিল যে আমি আমার অমৃতময় আশ্রয়-তরুর সুশীতল সুধামাখা শান্তি ছাওয়াটুকু এই বেদনাময় ব্যথিত বুকের উপর প্রলেপ দিয়া চির নিন্দ্রায় ঘুমাইয়া পড়িব; ঐ নিঃস্বার্থ স্নেহ ধারার আচরণে আমার কলঙ্কিত জীবনকে আবারিত রাখিয়া চলিয়া যাইব। ওমা! কথায় আছে কিনা! যে “আমি যাই বঙ্গে, আমার কপাল যায় সঙ্গে।” একটি লোক একবার তাহার অদৃষ্টের কথা গল্প করেছিল, এখন আমার তাহা মনে পড়িল। গল্পটী এই –
উপযুক্ত লেখাপড়া জানা একটী লোক স্বদেশে অনেক চেষ্টায় কোন চাকুরী না পাইয়া বড় কষ্ট পাইতেছিল। একদিন তাহার একটী বন্ধু বলিলেন যে, “বন্ধু! এখানে তো কোন সুবিধা করিতে পারিতেছ না, তবে ভাই একবার বিদেশে চেষ্টা দেখ না।” তিনি অনেক কষ্টে কিছু পাথেয় সংগ্রহ করিয়া রেঙ্গুন চলিয়া গেলেন। সেখানেও কয়েক দিন বিধিমতে চেষ্টা করিয়া কিছু উপায় করিতে না পারিয়া, একদিন দ্বিপ্রহর রৌদ্রে ঘুরিয়া এক মাঠের উপর বৃক্ষতলায় বসিয়া আছেন। এমন সময় তাঁহার মনে হইল যে রৌদ্রের উত্তপ্ত বাতাসের সহিত পশ্চাৎ দিকে কে যেন হা: হ: করিয়া হাসিতেছে। সচকিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে গা?” উত্তর পাইলেন, “তোমার অদৃষ্ট”। তিনি বলিলেন “বেশ বাপু! তুমিও জাহাজ ভাড়া করিয়া আমার সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছ? তবে চল, দেশে ফিরিরতেছি, সেইখানেই আমায় লইয়া দড়িতে জড়াইয়া লাট্ট্রু খেলিও”।
আমিও একদিন চমকিত হইয়া দেখি যে আমার অদৃষ্টের তাড়নায় , আমার আশ্রয় স্বরূপ সুধামাখা শান্তি-তরু মহাকালের প্রবল ঝড়ে কাল-সমুদ্রের অতল জলের মুখে পড়িয়া ডুবিয়া যাইল। আমার সম্পূর্ণ ঘোর ছাড়িতে না ছাড়িতে দেখি যে আমি এক মহাশ্মশানের তপ্ত চিতাভস্মের উপর পড়িয়া আছি। আবহকাল হইতে যে সকল হৃদয় অসীম যন্ত্রণার জ্বালায় জ্বলিয়া-পুড়িয়া চিতার ছাইয়ে পরিণত হইয়াছে, তাহারাই আমার চারিধার ঘেরিয়া আমার বুকের বেদনাটাকে সহানুভূতি জানাইতেছে। তাহারা বলিতেছে, “দেখ, কি করিবে বল? উপায় নাই! বিধাতা দয়া করে না, বা দয়া করিতে পারে না। দেখ, আমরাও জ্বলিয়াছি, পুড়িয়াছি, তবুও যায় নাই গো! সে সব জ্বালা যায় নাই! শ্মশানের চিতা ভস্মে পরিণত হয়েও সে স্মৃতির জ্বালা যায় নাই! কি করিবে? উপায় নাই!”
ঘবে যদি কোন দয়াময় দেবতা, মানুষ হইয়া বা বৃক্ষরূপ ধরিয়া সংসারে আসেন, তাঁহার কখন তোমার মত হতভাগিনীকে শান্তি-সুধা দানে সান্ত্বনা দিতে পারেন। তাঁরা দেবতা কিনা। পৃথিবীর লোকের কথার ধার ধারেন না। আর কুটিল লোকের কথায় তাঁহাদের কিছু আসে যায় না! সূর্য্যের আলোক যেমন দেবমন্দির ও আঁস্তাকুড় সমভাবেই আলোকিত করে – ফুলের সৌরভ যেমন পাত্রাপাত্র বিচার না করিয়া সমভাবে গন্ধ বিতরণ করে ইঁহারাও তেমনি সংসারে হিংসুক, নিন্দাপরায়ণ, পরশ্রীকাতর লোকদিগের নিন্দা বা সুখ্যাতির দিকে ফিরেও চাহেন না।
তাঁহারা দেবলোক হইতে অপরিসীম স্নেহপূর্ণ সুধামাখা আত্মানন্দময় হৃদয় লইয়া মর্ত্ত্যভূমে দু:খীর প্রতি দয়া করিবার জন্য, আত্মীয় স্বজনের প্রতি সহৃদয়তা দেখাইবার কারণ, বন্ধুর প্রতি সমভাবে সহানুভূতি করিবার ইচ্ছায়, সন্তানের প্রতি পরিপূর্ণ বাৎসল্য স্নেহ প্রদানে লালন-পালন করিতে, পত্নীর প্রতি সতত প্র্রিয়ভাষে প্রেমদানে তুষ্ট করিততে আজ্ঞাকারীর ন্যায় সকল অভাব পূর্ণ করিবার জন্য সতত প্রস্তুত! প্রেমময়ীর নিকটক অকাতরে প্রেমময় হৃদয়খানি বলি দিতে – ভালবাসার আকাঙিক্ষতাকে আপনাকে ভুলিয়া ভালবাসিতে – আশ্রিতকে সন্তুষ্টচিত্তে প্রতিপালন করিতে – পাত্রাপাত্র অভেদ জ্ঞানে আকাঙিক্ষতের অভাব পুর্ণ করিবার জন্য অযাচিতভাবে লুকাইয়া দান করিতে (কত সঙ্কুচিত হ’য়ে, যদি কেহ লজ্জা পায়) – ভগবানে অটল ভক্তি রাখিবার বাসনাকে হৃদয়ে স্থান দিতে – আত্বাসুখ ভুলিয়া দেবসেবা ব্রতে সুখী হইতে – প্রাণ ভরিয়া অক্লান্ত হৃদয়ে পরোপকার করিতে আাইসেন। ওগো তোমাকে আর কতই বা বলিব! তাঁহাদের তুলনা শুধু তাঁহারাই – যাহা লইয়া দেবলোকে দেবতা গঠিত হইয়া থাকে, তাঁহারা সেখানকার সেই সকলই লইয়া এই যন্ত্রনাময় মরজগতে অতি দু:খীকে দয়া করিতে আইসেন। সংসারের গতিকে ক্রুর হৃদয়ের বিষদৃষ্টিতে যখন সেই মানবরূপ বেতা বা তরুবয় অবসন্ন হইয়া পড়েন, তখনই চলিয়া যান। সে অভাগা ও অভাগিনীরা সেই পবিত্র ছাওয়ার কোলে আশ্রয় পাইয়া চিরদিনের মত ঘুমাইয়া পড়ে, সংসারের যাতনাময় কোলাহলে আর না জাগিয়া উঠে, তাহারাই হয় তো সেই দেবহৃদেয়র পবিত্রতার স্পর্শে শান্তিধামে যাইতে পারে; আবার যাহারা অদৃষ্টের দোষে সেই শান্তি সুধাময় তরুচ্ছায়া হইতে বঞ্চিত হয়; তাহারাই এই তোমার মত যাতনায় পোড়া শ্মশানের চিতাভস্মেও উপর পড়িয়া গড়াগড়ি যায়। তোমার মত দুর্ভাগিনীদের আর উপায় নাই গো! যাহারা অমূল্য রত্ন পাইয়াও হারাইয়া ফেলে, তাদের উপায় নাই। আর তোমাদের মত পাপিনীদের হৃদয় বড় কঠিন হয় ও হৃদয় শীঘ্র পুড়েও না, ভাঙ্গেও না, এত জ্বালায় লোহাও গলিয়া যায়। তোমার মত হতভাগিনী বুঝি আমাদের সধ্যেও নাই, ও রকম কঠিন পাষাণ হৃদয়ের কোন উপায় নাই; তা কি করিবে বল? এই সকল কথা বলিয়া সেই জ্বালা যন্ত্রণায় পোড়া হৃদয়ের চিতা ভস্ম হইতে হায়! ঘায়! করিয়া উঠিল। তাহাদের সেই ভস্ম হইতে হায়! হায়! শব্দ শুনিয়া আমার তখন খানিকটা চৈতন্য হইল। মনের মধ্যে একটা বৈদ্যুতিক আঘাতের মত আঘাত লাগিল, মনে পড়িল যে আমিও তো ঐরূপ একটী সুধাময় তরুর সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় পাইয়াছিলাম। তবে বুঝি সে তরুবরটি ঐ রকম দেবতাদেব জীবনীশক্তি দ্বারা পরিচালিত “দেবতরু”। ঐ চিতাভস্মগুলি যে সকল গুণের কথা বলিলেন, তাহা অপেক্ষাও শত সহস্র গুণে সেই দেবতার হৃদয় পরিপূর্ণ ছিল। দয়ার সাগর, সরলতার আধার, আনন্দের উচ্ছাসপূর্ণ ছবি, আত্মপরে সমভাবে প্রিয়বাদিতা, সতত হাস্যময়, প্রেমের সাগর, আপনাতে আপনি বিভোর, কনকোজ্জ্বল বরণ সুন্দরন, রূপে মনোহর, বিনয় নম্রতা বিভূষিত, সুধামাখা তরুবর! শুনিয়াছিলাম যে দেবতারাই সময়ে সময়ে দয়া করিতে বৃক্ষ বা মানবরূপ ধরিয়া সংসারে আসেন। সেইজন্য শ্রীরামচন্দ্র, গুহুক চন্ডালকে মিতে ব’লে স্নেহ করিয়াছিলেন। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দাসীপুত্র বিদুরের ঘরে ক্ষুদ্র খেয়েছিলেন। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবও যবন হরিদাসকে দয়া করিয়াছিলেন। দু:খী অনাথকে দয়া করিতে কি দোষ আছে? কাঙ্গালকে আশ্রয় দিলে কি পাপ হয় গা? লৌহের স্পর্শে কি পশে পাথর মলিন হয়? না কয়লার সংস্রব হীরকের উজ্জ্বলতা নষ্ট করে?
স্বর্গের চাঁদ যে পৃথিবীর কলঙ্কের বোঝা বুকে করিয়া সংসারকে সুশীতল আলোক বিতরণে সুখী করিতেছেন, পৃথিবীর লোক তাহারেই আলোক উৎফুল্ল হইয়া “ঐ কলঙ্কি চাঁদ ঐ কলঙ্কি চাঁদ” বলিয়া যতই উপহাস করিতেছে, তিনি ততই রজত ধারায় পৃথিবীতে কিরণ-সুধা ঢালিয়া দিতেছেন; আর স্বর্গেও উপর বসিয়া হাসিয়া হাসিয়া ভাসিয়া খেলা করিয়া বেড়াইতেছেন।
আমিও তো তবে ঐ দেবতারূপ তরুবরের আশ্রয় পাইয়াছিলাম! কৈ সেই আমার আশ্রয়স্বরূপ দেবতা? কৈ-কোথায়? আমার হৃদয়-মরুভ’মির শান্তি প্রসবণ কোথায়? হু হু করিয়া শ্মশানের চিতাভস্মমাখা বাতাস উত্তর করিল, “আ: পোড়া কপালি, এখনও বুঝি চৈতন্য হয় নাই? ঐ শুন চৈত্র মাসেন বাসন্তী পূজার নবমীর দিনে, মহাপুর্ণময় শ্রীরাম নবমীর শুভতিথির প্রভাতকালে ৭টার সময় সূর্য্যদেব অরুণ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া, ধারায় নামিলেন কেন, তাহা বুঝি দেখিতেছ না? পবিত্র ভাগীরথী আনন্দে উথলিয়া, হাসিয়া হাসিয়া, সাগর উদ্দেশ্যে কেন ছুটিতেছে, তাহাও বুঝি দেখিতেছ না? জীউ; গোপাল-মন্দির হইতে ঐ যে পূজারি মহাশয় জীউর মঙ্গল-আরতি সমাধা করিয়া প্রসাদি পঞ্চপ্রদ্বীপ লইয়া ঐ কাহাকে মঙ্গল-আরতি করিয়া ফিরিয়া যাইতেছেন, চারিদিকে এত হরিসঙ্কীর্ত্তন হরিনামধ্বনি, এত ব্রহ্মনামধ্বনি কেন? কিরণছটা অবলম্বন করিয়া সূর্য্যদেব আসিয়াছেন নাকি? প্রভাতী-পুষ্পের সৌরভ বহিয়া বায়ু ঘুরিয়া বেড়াইতেছে? দেবমন্দিরে এত শঙ্খ-ঘণ্টার ধ্বনি কেন? কিরণছটা অবলম্বন করিয়া সূর্য্যদেব কাহগার জন্য স্বর্গ হইতে রথ লইয়া আসিয়াছেন? তাহাও কি বুঝিতেছ না?”
চমকিত হইয়া দেখি, ওমা! আমারই আজ ৩১ বৎসরের সুখ-স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া যাইল! এই দীনহীনা দু:খী প্রাণী আজ ৩১ বৎসরের যে রাজ্যেশ্বরীর সুখ-স্বপোন বিভোর ছিল, মহাকালের ফুৎকারে ১২ ঘন্টার মধ্যে তাহা কালসাগরের অতল জলে ডুবিয়া গেল! অচৈতন্য হইয়া পড়িয়া মস্তকে প্রস্তুরের আঘাত পাইলাম, শত সহস্র জোনাকি-বৃক্ষ যেন চক্ষের উপর দিয়া ঝকঝকিয়া চলিয়া গেল!
আবার যখন চৈতন্য হইল, তখন মনে পড়িল যে আমি “আমার কথা” বলিয়া কতকগুলি মাথামুন্ডু কি লিখিয়াছিলাম। তাহার শেষেতে এই লিখিয়াছিলাম যে, “আমি মৃত্যুমুখ চাহিয়া বসিয়া আছি। মৃত্যুর জন্য তো লোকে আশা করিয়া থাকে, সেও তো জুড়াবার শেষের আশা!”
ওগো! আমার আর শেষও নাই, আরম্ভও নাই গো! ১৩১৮ সালের চৈত্র মাসের ১৪ই বুধবারের প্রাত:কালে সে আশাটুকু গেল!
মরিবার সময় যে শান্তিটুকু পাইবার আশা করিয়াছিলাম তাহাও গেল, আর তো একেবারে মৃত্যু হবে না গো, হবে না! এখন একটু একটু করিয়া মৃত্যুর যাতনাটিকে বুকে করিয়া চিতাভস্মের হায়-হায় ধ্বনি শুনিতেছি। আর দেবতারূপ তরুবরের আশ্রয় হইতে বঞ্চিত হইয়া এই মহাপাতকিনীর কর্ম্মফলরূপ সুবিশাল শাখা-প্রশাখা ফুল ও ফলে পূর্ণ তরুতলে বসিয়া আছি গো!
পৃথিবীর ভাগ্যবান লোকেরা গুন, শুনিয়া ঘৃণায় মুখ ফিরাইও । আর ও গো অনাথিনীর আশ্রয়তরু, স্বর্গেও দেবতা, তুমিও শুন গো শুন! দেবতাই হোক্, আর মানুষই হোক্, মুখে যাহা বলা যায় কার্য্যে করা বড়ই দুস্কর! ভালবাসায় ভাগ্য ফেরে না গো, ভাগ্য ফেরে না!! ঐ দেখ চিতাভস্মগুলি দূরে দূরে যাচ্ছে, আর হায়-হায় করিতেছে।
এই আমার পরিচয়। এখন আমি আমার ভাগ্য লইয়া শ্মশানের যাতনাময় চিতাভস্মের উপর পড়িয়া আছি। এখন যেমন অযাত্রার জিনিস দেখিলে কেহ রাম, রাম, কেহ শিব, শিব, কেহবা দুর্গা, দুর্গা বলেন, আবার কেহ মুখ ঘুরাইয়া লইয়া, হরি হরি বলিয়া পবিত্র হয়েন – যাঁহারা যে দেবতার আশ্রয়, তিনি তাঁহাকে স্বরণ করিয়া এই মহাপাতকীর পাপ কথাকে বিস্মৃত হউন। ভাগ্যহীনা, পতিতা কাঙ্গালিনীর এই নিবেদন।
ইতি – ১১ই বৈশাখ, ১৩১৯ সাল, বুধবার।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024