ভালো লাগার গ্রামার
মেঘনাথ বধ-এর রেফারেন্সেই মনে হইলো, ‘মূল’ সাহিত্য বইলা একটা জিনিস আছে যেইখানে কালা’রা হিরো না কখনোই। যেমন, আদর কইরা কিছু কবিতারে যে ‘অ্যান্টি-কবিতা’ বলা যায় ওইটা ‘কবিতা’ (তখন মূল বা আসল বা অরিজিনাল বলা লাগে না) বইলা একটা কিছু’রে বাঁচায়া রাখার চাতুরি-ই মেইনলি। বা ধরেন কমন একটা ভাষা যেইটা সোসাইটিতে এগজিস্ট করে সেইটারে ‘মুখের ভাষা’ বইলা ট্যাগ করার যে দরকার পড়ে সেইখানেই টের পাওয়া যায় যে, ‘লেখার ভাষা’ ডিফরেন্ট কিছু। 🙂
ধরেন অনেকে বলছেনও যে, এইসব ‘মুখের ভাষা’ ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে ইউজ কইরেন, কিন্তু ‘প্রবন্ধ’ (আজিব এক শব্দ) লেখা যাবে না! বা নাটকের ডায়ালগ ‘আঞ্চলিক ভাষায়’ হইতে পারে, কিন্তু ন্যারেটিভ ‘লেখার ভাষা’ হওয়া লাগবে।… এইসব আজাইরা কথা আছে। মানে, ব্যাপারটা কখনোই বাতিল করার না, বরং কি কি ভাবে আপনি মাইনা নিতে রাজি হইতেছেন, সেই জায়গাগুলিরে খোলাসা করতে পারাটা দরকারি। [pullquote][AWD_comments][/pullquote]
রেয়ার জিনিসই সুন্দর আমাদের কাছে, দূরের জিনিসই ভালো! যেই জিনিস কম মানুষ বুঝে সেইটা বেটার আর্ট! কমন মানে হইতেছে কমদামি। এই এসথেটিক্যাল পজিশনটারে যদ্দিন আমরা সাবস্ক্রাইব কইরা যাবো আর্ট-কালচার একটা ‘ক্লাস সুপিরিয়রিটি’র বাইরে খুব বেশি কোন স্পেইসরে ওপেন করতে পারার কথা না।
ই. হা.
————————————
বাংলাদেশে বনেদি ফেমিলির ফিচারগুলা কেমন? বনেদি ফেমিলির চেহারা-সুরত কেমন হয়, আমাদের পোলামাইয়ার কেমন চেহারা-সুরত চাই আমরা?
গড়ে দেশের মানুষ ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। গায়ের রঙ গড়ে শ্যামলা। নাক গড়ে আধা-বোঁচা। চুলে কোকড়া ভাব আছে একটু। কিন্তু নিজেদের খোয়াবে আমাদের যেমন পোলামাইয়া দেখি তারা ৬ ফুটের মতো লম্বা, গায়ের রঙ দুধে-আলতা (আমার হিসাবে সেন্ট্রাল এশিয়া, মানে উজবেকিস্তান-তুর্কমেনিস্তানের গড় গায়ের রঙ।), খাড়া নাক, সোজা সিল্কি চুল। কাপড়ের নিচে না গেলাম আর। আমাদের খোয়াব পুরা করতে বহু কসরত করি আমরা; র্ফসা-লম্বা বিয়া করতে চাই। ‘জাতের মাইয়া নাকি কালাও ভালো’–এমন মোলায়েম রেসিস্ট ভাবনা আলগাভাবে আছে একটা; তবে, এর ভিতরেই তো পাইতেছি, জাতের মাইয়া ফর্সা হইলে আরো ভালো। রঙ ফর্সা করার ক্রিম তাই বেশ চলে দেশে।
আমাদের বনেদির লগে টাকাপয়সার সম্পর্ক কম! র্ফসা-লম্বা-খাড়া নাকেই আমাদের বনেদিয়ানার আসল ঠিকানা। এইগুলা কই পাই আমরা? দেশের মোসলমানেরা নিজেদের কনভার্টেড মোসলমান ভাবতে আরাম পায় না; তাইলে বিংলাদেশের একজন বনেদি মোসলমান ফর্সা-লম্বা-খাড়া নাক কই পাইবেন? কনভার্টেড মোসলমান ভাবতে আরাম পাইলে না হয় ভাবতো যে, সে ব্রাহ্মণ/বামুন-ক্ষত্রিয়ের পোলা-মাইয়া! তাতে আরাম যেহেতু নাই, তাই দেশের সব বনেদি মোসলমান দাবি করা ফেমিলিই নিজেদের গোড়া দেখায় ইরান-তুরানে। আমাদের টপ পলিটিক্যাল লিডারদের মাঝেও তালাশ করতে পারেন ব্যাপারটা। জিয়া ছাড়া দেশে কালা লিডার পাইতেছেন কয়জন? ইরান-তুরান দাবি করা লিডার কত পার্সেন্ট? আমাদের দেশে নায়ক-নায়িকা হইতে কেমন চেহারা-সুরত লাগে? রাজ্জাক-ফারুক-আলমগীর-সাবানা-শবনম-ববিতা-মান্না-শাকিব খানরা পর্দায় যেমনে হাজির হয় তাতে ফর্সা-লম্বা-খাড়া নাক পাইতেছেন কিনা! কালা দুয়েকজন পাইবেন ভিলেন হিসাবে, সাদেক বাচ্চু থিকা কাবিলা।
বাংলাদেশ হবার জন্য ১৯৬০-৭০ আমরা একটা কালচারাল মুভমেন্ট করছিলাম। সেই মুভমেন্টে আমাদের কালচারাল খাম্বাগুলা কেমন আছিল? সোজা কথায়, আমরা কোলকাতার এসথেটিক্স হাতাইছি, সেইটাইরেই বাড়াইছি। কোলকাতার এসথেটিক্স কেমন? বামুনদের দখলে। বঙ্কিম-বিদ্যাসাগর-রঠা-শরৎ, মধুসূদণ ছাড়া মোটামুটি সবাই বামুন; এমনকি মার্ক্সের তরিকার পলিটিক্যাল পার্টি সিপিএমও কালা অনার্য নেতা দিতে পারে নাই প্রায়! কালচারে অবামুন সত্যজিৎ আছিলেন, তিনি অন্তত ফর্সা, মধুসূদনের মতো কালা না! কালা মধুসূদণ জমিদারের পোলা হইয়াও নিজেরে ততো বনেদি হিসাবে দাবি করতে পারে নাই, কালা বইলা! হিন্দু থাইকা তো ফর্সা মাইয়া বিয়া করতেই মুশকিলে পড়তেন। হিন্দু থাকার সময়ে ফর্সা গৌরের লগে দোস্তি করছেন, পরে খুস্টান হইয়া আসল প্রতিশোধটা নিছেন ফর্সা হিন্দু এলিটদের উপর। ফর্সা হিন্দু এলিটরা যেই হোয়াইটদের পা ধোয়া পানি খাইতেন, খৃস্টান হইয়া মধুসূদন সেই হোয়াইট এক মাইয়ার লগে পরকীয়া করছেন, আরো দুই হোয়াইট মাইয়ারে বিয়া করছেন! খেয়াল কইরা দেখেন, কালা মেঘনাদ মধুসূদনের নায়ক, ধলা-আর্য রাম-লক্ষ্মণ হইলেন ভিলেন। মধুসূদনের গায়ের রঙ লইয়া আলাপ একটু পাইবেন প্রমথনাথ বিশী’র ‘মাইকেল মধুসূদন (১৯৫৭)’ বইতে।
এই কোলকাতারে নকল কইরা আমরা বাংলা ভাষা থিকা নিজেদের আইডিয়াল চেহারা-সুরত বানাইছি। তাতে আমরা আম বাংলা ডিনাই কইরা সংস্কৃতের খাদেম হইছি, নিজেদের সুরত বানাইছি র্ফসা-লম্বা-খাড়া নাক। আসলে আগে থিকাই তাই আছিলাম, ১৯৬০-৭০ আমাদের মওকা আছিল ঐ রেসিস্ট-এলিটিস্ট ভাবনা-এসথেটিক্স ফালাইয়া দেবার, আমজনতার বাংলা লইয়া নিজেদের কালচারাল ফর্মেশন ঘটাইতে পারতাম আমরা, নিজেদের কালচারাল চেহারা-সুরতে আমজনতার কাছে যাইতে পারতাম আমরা। যাই নাই। আমরা ফর্সা-লম্বা লিডার-নায়ক-নায়িকাই বানাইতে থাকলাম।
এখন আপনে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ছবিতে চাইয়া দেখেন, আপনের খোয়াবের বনেদি চেহারা-সুরত পাইতেছেন? কয়দিন আগে এক আরব কইছেন, পাকিস্তানীরা সহি মোসলমানই না! কিন্তু আমাদের কাছে তো খোয়াবের ষোলআনাই, সাক্ষাত ইরান-তুরান!
আমরা যে জাতীয়তাবাদ বানাইছি তাতে তো এই দেশের গড় মানুষ নাই, ভাষা নাই, চেহারা-সুরত নাই। এই জাতীয়তাবাদে এই জাতির চেহারা-সুরত এই দেশে গজায় নাই। এই জাতির আইডিয়াল চেহারা-সুরত ১০০ পার্সেন্ট পাকিস্তান ক্রিকেট দলের লগে মিলতেছে। আজকে পাকিস্তানের বাংলাদেশি সাপোর্টারদের যারা গালি দিতেছেন তাদেরও খোয়াবের চেহারা-সুরত তেমনি। এনাদের জাতীয়তাবাদী আম্মা-আব্বারাই ঐটা বানাইছে! ইমরান খানের রঙ আর নাকের লোভ হবার জন্য বিএনপি বা রাজাকার বা জামাত হওয়া লাগে না, বরং ঐ লোভের গোড়া সহি আওয়ামী-কোলকাতাই এসথেটিক্সেই। সো সব গালি জাগা মতোই পড়তেছে।
এসথেটিক্স মনের একদম তলার ব্যাপার, খুন-রেপ-মাইর এসথেটিক্সকে হারাইতে পারে না। স্বামী-ভাতার-পতির ব্যাপারে আমাদের কালচার যেই এসথেটিক্স বানাইছে সেইটা দিয়াও বুঝতে পারেন। নিত্য মাইর-রেপের পরেও সেই ভাতারকে ভালবাসতে থাকে বউ, বাধ্য হইয়া থাকে তেমন কইতে পারবেন না কেবল! ঢাবির মাস্টার রুমানা মঞ্জুরের কথা ভাবতে পারেন, ভাতারের মাইরে যার চোখ গেছিল; পোলা-মাইয়ার যে বাপ লাগেই–এইটাও এসথেটিক্স!
এই রেসিস্ট-এলিটিস্ট এসথেটিক্স ফালাইয়া দিয়া দেশের আমজনতার এসথেটিক্স বানাইতে না পারলে পাকিস্তানের সাপোর্ট আরো বাড়বে, ভারত ফ্যাক্টর নিশ্চই তাতে বাড়তি ঘিও ঢালতে থাকবে।
২০০০ সালের আশেপাশে কতগুলা দেশি স্যাটেলাইট চ্যানেল হওয়ায় আমরা হাসান মাসুদ বা ফজলুর রহমান বাবু বা মোশারফ করিমের মতো কালা-শ্যামলা নায়ক পাইছিলাম, ধীরে নায়িকাও হয়তো পাইতাম! আমজনতার বাংলাও পাইছিলাম। কিন্তু এখন ফর্সা-লম্বা সুরতের নায়ক-নায়িকার তুর্কি সিরিয়ালের কোলকাতাই বাংলায় ডাবিং হইতেছে দেদার, যৌথ প্রযোজনার নামে সেই ফর্সা-লম্বারাই আবার পুরা দখলে নিতেছে দেশের এসথেটিক্স ভুবন! তাতে নিশ্চই আফ্রিদিদের আরো ভালো লাগতে থাকবে আমাদের। ভালো লাগার গ্রামার বোঝেন।
#রক_মনু, ২০ জুন ২০১৭
রক মনু
Latest posts by রক মনু (see all)
- ‘শোনার বাংলা’র এছথেটিক দলা - নভেম্বর 8, 2024
- হিস্ট্রিওগেরাফি এন্ড পলিটিকেল লয়ালটি - অক্টোবর 18, 2024
- খলিফা হইয়া ওঠা - সেপ্টেম্বর 2, 2024