ঘুরা-ফিরা: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ঘুরতে গেছিলাম, মাসখানেক আগে। ঘুরতে গেলে যা হয়, ছবি তোলা হইলো অনেক। আর ওইখানে ছবি আছিলোও অনেক। জাদুঘর বলতে মোটামুটি একটা ভিস্যুয়াল ডিসপ্লেই। ভিডিও-ও চলতেছে কয়েকটা জায়গায়। এখনকার সময়ে মেমোরি অ্যাকুমোলেট করি আমরা ভিজ্যুয়াল ওয়ে’তেই। ঘুরতে যে গেছিলাম, ছবি কই! হিস্ট্রি’তে যে ঘটছিলো তার ছবি কই! এইরকম।
গ্যালারি-১ টা বন্ধ আছিলো, মেরামত চলতেছিলো। গ্যালারি ২, ৩ আর ৪ দেখলাম। দেখতে দেখতেই কয়েকটা জিনিস মনে হইলো।
থিমপার্ক
জাদুঘরের ভিতরের অনেক জায়গার ইন্সটলেশন দেইখা থিমপার্কের কথা মনে হইছে।
এইটা মনে হইছে, ২৫শে মার্চের রাতের ডিসপ্লে’র জায়গাটাতে আইসা। ফ্যান্টাসি কিংডমে রেলগাড়িটা এইরকম টাইপের একটা টানেলের ভিতর দিয়া যায়। তখন মনে হইছে অডিয়েন্সের কথা; যে, কারা এইখানে ঘুরতে আসতে পারেন? স্কুলের বাচ্চারা আসলো স্টাডি ট্যু’রে, মফস্বলের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা, ফরেনার’রা তো আসতেই পারেন; এর বাইরে উইকএন্ডে যাঁরা ফ্যান্টাসি কিংন্ডমে যাইতে পারেন… সিঙ্গাপুরের ইউনির্ভাসাল স্টুডিও’তে না গেলেও। এইরকম যারা আছেন, উনাদের কাছে ব্যাপারটারে প্রেজেন্টবল কইরা তোলার একটা ঘটনা আছে। অডিও বাজতেছে, ভূতের গুহার মতন একটা জায়গা, চিপাচাপা দিয়া হরর মুভি’র মতন লাশের ছবি দেখা যাইতেছে। মানে, কি ঘটছে – সেইটা নানান রকমের কাহিনি থিকা তো আমরা জানি-ই, তারপরও কেমনে দেখানো হইতেছে – সেইটাই তো ঘটনা হিসাবে থাকে, থাকতেছে।
বা টিনের দেয়াল, মুক্তিযোদ্ধারা এইরকম বাড়িতে লুকায়া থাকতেন। তখনকার বাড়িগুলি এইরকমই ছিলো, একটা এনভায়রনমেন্ট ক্রিয়েট হইছে। বা ইন্ডিয়ার রিফিউজি ক্যাম্পে, সিমেন্টের পাইপের ভিতরে থাকতো মানুষজন। ছবি তো আছেই, একটা সিমেন্টের পাইপও রাখা হইছে। সিনেমাহলের সামনের নতুন ছবি’র কাট-আউটের সাথে দাঁড়ায়া যেমন ছবি তোলা যায়, এইখানেও একইরকম করা যাইতে পারে তো!
মানে, এইভাবে মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটা এন্টারটেইনিং হইতে পারতেছে কিছুটা। আর আল্টিমেটলি, একটা এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ড্রাষ্টির সাথেও ফাইট’টা দিতে হইতেছে তো উইকএন্ডের সাবজেক্ট হিসাবে ‘মুক্তিযুদ্ধ’রে। তো, ব্যাপারটা এইরকম না যে, মুক্তিযুদ্ধ মানে খুব সিরিয়াস একটা ভঙ্গিমা নিয়া থাকা লাগবে; কিন্তু সিরিয়াস-ই হোক বা এন্টারটেইনিং, যেই ভঙ্গিমাটা ইউজ করা হইতেছে, সেইটাই সাবজেক্ট হইয়া উঠতেছে। ভাষার ভিতর দিয়া আমরা বলতেছি আর ভাষাটাই রিয়ালিটি হয়া উঠতেছে। যেমন, যখন বলতেছেন কোনকিছু চাঁদের মতোন সুন্দর… চাঁদ ব্যাপারটাই সুন্দর হইতেছে আরো, থাকতেছে যা সেইটা চাঁদ-ই; সুন্দর বইলা আলাদা কিছু না। বিইং এন্টারটেইনিং বা সিরিয়াস, মুক্তিযুদ্ধ্ও সেইটাই মিন করতে থাকতেছে। প্রেজেন্টশনটাই ঘটনা। উপমাটাই রিকগনাইজ করার ভাষা।
বাংলা হইতেছে আসলে ইংলিশের অনুবাদ
জাদুঘরে ঢুকতে গিয়া পয়লা আসলে ভাষাটাই চোখে পড়ছে। উঠতে গিয়া দেখি একটা জায়গায় লেখা “Cloak Room তল্পিতল্পা জমাঘর”। ইংলিশে এই জিনিস আছে, বাংলায় এইটা নাই আসলে। যেমন ধরেন Terrace বইলাও কোন জিনিস নাই আমরা’র রিয়ালিটি’তে যারে ‘আড্ডাঘর’ বলা লাগে; বরং উঠান আছে, বাংলাঘর আছে, বাইরের ঘর আছে, খালি জায়গা আছে, বারান্দা আছে; ‘আড্ডাঘর’ তো কাভি নেহি! 🙁 আর ক্যান্টিন তো ক্যান্টিন-ই, নাশতাঘর কি জিনিস!
এইগুলি যে ‘বাংলা’ শব্দ না, তা না; কিন্তু বাংলায় অনুবাদ কইরা লেখা হইছে, বাংলাগুলি হইতেছে ইংলিশগুলির অনুবাদ। বাংলাদেশের সংবিধানও যদ্দুর শুনছি ইংলিশ থিকাই অনুবাদ করা হইছে বাংলায়।… এইভাবে আমাদের জিনিসপত্রগুলি বা কাজকামগুলি গায়েব হয়া যাইতেছে ভাষার ভিতরে; অন্য একটা কাজ, যেইটা অন্য ভাষার, সেইটারে বাংলায় অনুবাদ করার পরে, সেইটারে করা লাগতেছে বা চিনা লাগতেছে।
ঘটনাটা এইটা না যে, আমরা আমাদের ‘করা’গুলিরে বলতেছি খালি, বরং একটা ‘ইমাজিনড অডিয়েন্স’-এর কাছে বা একটা ‘ইমাজিনড মিনিং’রে বলতেছি আসলে। একটা স্পেইস এইভাবে আসলে বাংলা-ঘর বা বাইরের ঘর বা উঠান থিকা টেরেস হওয়ার পরে ‘আড্ডাঘর’ হইতে পারতেছে। এই ‘ইমাজিনড অডিয়েন্স বা মিনিং’-এর আইডেন্টিটিগুলি ফর্মুলেট হইতেছে ভাষার ভিতর দিয়াই।
————————————————————————-
সাউথ এশিয়ান আইডেন্টিটি নিয়া
কয়দিন আগে ইন্ডিয়ান একটা টিভি চ্যানেল (www.lifeok.com)-এর বিজ্ঞাপনে চ্যানেলরে ইনডোর্স করতেছিলেন শাহরুখ খান এইভাবে যে, সাউথ এশিয়ান ডায়াসপোরাদের মধ্যে সবচে জনপ্রিয় (বা হইতে পারে আদর্শ) একটা চ্যানেল। সম্ভবত ইন্ডিয়ান কালচারের কথাও বলতেছিলেন তিনি। (অবভিয়াসলি এইটা শাহরুখ খানের কথা না, এক ধরণের রিসার্চ ফাইন্ডিংসই হয়তো ইউজ করা হইছে, টেক্সটে।) ইউটিউবে খুঁজলাম ভিডিওটা, কিন্তু পাইলাম না। পাইলে আরো অথেনটিকভাবে বলা যাইতো; যে, সাউথ এশিয়ান বইলা একটা কম্যুনিটি এবং তাঁদের ‘ইন্ডিয়ান কালচার’ বইলা একটা ‘জিনিস’ আছে বা গ্রো করতেছে।
মাইগ্রেটেড পিপলদের সহজে চিনার লাইগা পশ্চিমাদের (ইউরোপ-আম্রিকা ইত্যাদির) মনে একটা ক্যাটাগরি থাকতে পারে ‘সাউথ-এশিয়ান’ আর এইভাবে পরিচিত হইতে চাওয়া জনগণ ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-বাংলাদেশ’র একটা ‘কমন কালচার’এ আগ্রহী হইতে পারেন। যে কোন আইডেন্টিটিই তৈরি হয় আসলে এই ‘আদার’-এর পারসপেক্টিভ থিকা।
এই যে ‘সাউথ এশিয়ান’ এই আইডেন্টিটি’টা আসলে বাংলাদেশে যারা থাকেন তাদের লাইগা দরকারি কোন জিনিস না খুবএকটা, পাকিস্তান বা ইন্ডিয়া’রও একইরকমের ঘটনা, আইডেন্টিটি’র জায়গা থিকা (পলিটিক্যাল জায়গাটাতে পরে আসাই ভালো)। কিন্তু যারা (মানে, এর বাইরেও দুনিয়া আছে তো) ধরেন খুবএকটা আলাদা করতে পারেন না, যাদের কাছে একইরকম লাগে প্রায় এই এলাকার মানুষজনদেরকে, তাদের কাছে বেশি দরকারি এইটা। বাংলাদেশিদের কাছেও চাকমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল’রা… যেমন ‘আদিবাসী’; একইরকমের প্রায় ব্যাপারটা। মানে, যারা ‘সাউথ এশিয়ান’ তাদের বাইরে যারা আছেন, তাদের কাছে সাউথ এশিয়ান’রা কি রকমের সাউথ এশিয়ান সেইটা প্রজেক্ট করার একটা ব্যাপার তো আছে… সেইটা কোর একটা জিনিস, আইডেন্টিটির।
ব্যাপারটা এইরকম না যে, আইডেন্টিটিগুলি আছেই; বরং বানানো-ই যায়। এই যে সাউথ এশিয়ান এইটা আসলে ব্রিটিশ কলোনি’র সময়কার ঘটনা তো বা মোগলরাও এইরকম কইরা ভাবতে পারছিলেন মনেহয়। তবে, এই ব্যাপারটা ইন্ডিয়ান হওয়ার চাইতে সাউথ এশিয়ান হওয়াটা বেটার মনেহয়।…
যদি ইন্ডিয়াননেস খাইয়া না ফেলে তাইলে এইটা স্ট্রং একটা আইডেন্টিটি হইয়া উঠার কথা, নিয়ার ফিউচারে।
মার্চ ১৬, ২০১৪
————————————————————————
মুক্তিযুদ্ধ’রে মুক্তিযুদ্ধ হিসাবে রিপ্রেজেন্টেড হওয়ার ভিতর দিয়া মুক্তিযুদ্ধ হইতে হইতেছে আবার। যেইভাবে হইতেছে, সেই ‘ভাব’টারে দেখার ভিতর দিয়া না-দেখার কিছু নাই। কিন্তু এই ‘ভাব’টা যদি ছবিগুলি’র মতো স্ট্যাটিক বা ভিডিওগুলির মতো একইরকমের রিপিটেটড হইতে থাকে তাইলে একটা সময়ে গিয়া রিলিভেন্স হারায়া ফেলতে পারবে হয়তো এই রিপ্রেজেশন্টশন। এন্টারটেইনমেন্ট হিসাবে পুরান মনে হইতে পারবে।
হ্যান্ডসাম কাপল
যেমন, এই ছবিটা এন্টারটেইনিং হইছে।
এই কাপলের নাম এর আগে কখনো শুনি নাই, কিন্তু ছবি দেইখা ভাল্লাগছে। এইরকম হ্যান্ডসাম কাপলেরাও মুক্তিযুদ্ধ সার্পোট করছে। আছে না! সুন্দর সুন্দর মানুষেরাই তো ভালো। আর এই ভালো মানুষেরা যা করছে, সেইটাও ভালো না খালি, সেইটাই ভালো।
এইটা বাজে না অবশ্যই, এমন না যে, উনাদের কোন কন্ট্রিবিউশন নাই, কিন্তু এইটা মুক্তিযুদ্ধরে একটা ‘অ্যাফ্লুয়েন্ট’ ফিলিংস দিতে পারে। এই ছবিটা। খুবই রোমান্টিকও। ভালো। সুন্দর।
সেক্যুলার
এই বাক্যটা খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে – “হিন্দু কাঠমিস্ত্রি নির্মিত চাঁদ-তারা খচিত ভবেরপাড়া খৃষ্টান মিশনের চেয়ার”। কি রকমের সেক্যুলার ব্যাপার দেখেন! 🙂 মানে, ব্যাপারটা যে সেক্যুলার সেইটা প্রমাণ করার লাইগা ধর্মরেই লাগতেছে। চেয়ারের গায়ে কোন ধর্ম লেখা নাই, ন্যারেশনে আছে। যিনি চেয়ার’টা বানাইছেন তিনি হিন্দু, নকশা যেইটা দিছেন সেইটা ইসলামি তরিকার – চাঁন-তারা (সো, ইসলামিক হওয়ার কারণে চেয়ারটা মুসলমান 🙂 ) আর আছিলো এক খৃষ্টান মিশনারি’তে। সব যেহেতু এক লগে হইছে এরা আলাদা আলাদা হইতে পারে নাই আর একলগে হওয়াই লাগছে আর হইছে গিয়া সেক্যুলার! কিন্তু এই ধর্মগুলা যদি না থাকতো সেক্যুলার কি হইতে পারতো?
অথবা এই ন্যারেশনটার বাইরে সেক্যুলারিজমটা কই আসলে?
বান্দরবনের ইপিআর
বান্দরবনের ইপিআর-এর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। এই ছবি দেইখা জানার আগ্রহ হইলো।
রাজাকার
এইটা বেশ ক্রিটিক্যাল একটা জিনিস মনে হইছে। মুক্তিযোদ্ধারা কেমনে কাজ করবেন এইরকম একটা ডকুমেন্টে বলা হইছে ‘সৎ ও বন্ধু রাজাকার বা পুলিশদের স্বপক্ষে আনতে হবে’। ‘ও’ বা ‘এবং’ না লিইখা ‘বা’ যে লেখা হইছে, সেইটা এক ব্যাপার, কিন্তু শক্রু যে সবসময় শক্রু না – এই আন্ডারস্ট্যান্ডিং যে মুক্তিযোদ্ধাদের ছিলো, এইটা কাজের জিনিসই হওয়ার কথা।
একটা পোস্টার
এখন তো একটা তরিকা আছে বলার যে, সবাই মুক্তিযোদ্ধা; কিন্তু এইরকম ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছিলো না ব্যাপারটা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরও প্রপাগান্ডা চালাইতে হইছে। এই পোস্টার’টা এর একটা প্রমাণ। হেল্প করতে বলা হইছে। বলা হইছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা ইয়াং। আর হেল্প চাওয়া হইছে মুরুব্বিদের কাছে। যারা হেল্প করছেন, তারা তো মুক্তিযোদ্ধা হইতেই পারছেন, যারা হেসিটেট করছেন, তারা হয়তো হইতে পারেন নাই। মুরুব্বি মানেই ঠিক দুইটা আইডেন্টিটি না – মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার; বরং একটা জেনারেশন হিসাবে দেখতে পারলেই মেবি বেটার।
তথ্য
‘ভারতীয় বাহিনীর আত্মদান’
শহীদ – ১৪২১, আহত – ৪০৫৬, নিখোঁজ – ৫৬ জন।
ব্যাকগ্রাউন্ডের কালার’টারে তো মোদি কালার বলে এখন, তাই না?
লাইব্রেরি
জাদুঘর ঘুইরা-টুইরা চা খাওয়ার আগে লাইব্রেরি’তে ঢুকলাম। বই-টই তেমন নাই। ‘মূলধারা ৭১’ বইটাই আবার কিনলাম, বাসায় নাই মনেহয় – এই ভাইবা। তখন আরো কিছু লোকজন ঢুকলো, বাচ্চা মানুষ – কিশোর-কিশোরী বয়সের; শব্দ কইরা হাঁটতেছিলো ওরা ফ্লোরে; হাসাহাসি করতেছিলো, কথা কইতেছিলো। লাইব্ররিয়ান ঝাড়ি দিলো ওদেরকে, বেশি কথা না বলার লাইগা। ওরাও চুপ মাইরা গেলো। লাইব্রেরিয়ানের ঝাড়িটার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের নিরবতা, সিরিয়াসনেস বা ভা-গাম্ভীর্য এমবেডেড ছিলো মনেহয়।
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024
- ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ - আগস্ট 9, 2024