প্রিয় প্রিয়ভাষিণী
ওই সময়টায় আমি খুব আর্ট একজবিশন দেখে বেড়াইতাম। দেখতামই শুধু, কোন আর্ট-ওয়ার্ক কেনার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবতাম না। তবু একদিন, সৈয়দ ইকবালের আঁকা গৌতম বুদ্ধের একটা পেইন্টিং খুব মনে ধরে যাওয়ায় দাম জিজ্ঞেস করে বসছিলাম। ওই পেইন্টিং-টার দাম ছিলো ৪০,০০০ টাকা। তো তাতে একটা ধারণা পাইছিলাম আর কি, কেমন আকাশচুম্বী দাম (নাকি মূল্য বলতে হয়?) হয় ওইসব ফাইন আর্টের।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
সেই সময় একদিন, কার কাছে যেন শুনলাম, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর কোন একটা কাজ নিজের সংগ্রহে নিতে কোটি টাকা দাম দিতে চাইছেন আবুল খায়ের লিটু। কিন্তু প্রিয়ভাষিণী আগেই সেই ভাস্কর্যটা তাঁর এক বান্ধবীকে উপহার দিয়ে দেয়াতে লিটুর প্রস্তাবে তিনি নাকি রাজি হন নাই। তো যেই ভাস্কর্যের জন্য কোটি টাকার অফার ফিরাইয়া দিলেন তিনি, তার দাম এমনিতে কত হইতে পারে আসলে, তা জানার কিউরিওসিটি থেকেই সেই একজিবিশনে গিয়ে আমি মূল্যতালিকাটা দেখতে চাইছিলাম।
এবং তারপর অবাক হয়ে দেখছিলাম সেখানে ১,৫০০-২,০০০ টাকার কিছু কাজও আছে! সবথেকে দামী কাজটা সম্ভবত ছিলো ২৫,০০০ টাকার। যদিও ততদিনে অধিকাংশ আইটেমই ছিলো “সোল্ড”, বেশ কিছু “সস্তা” কাজ তখনো “আনসোল্ড” ছিলো। সেগুলার মাঝে আমার সবথেকে ভালো লাগছিলো একটা বকপাখি, ৬,০০০ টাকা দাম ছিলো ওইটার; বাট ইট ওয়াজ স্টিল আ লিটল আউট অফ মাই রিচ!
তো ওরকম মওকা পেয়ে ঠিক করলাম, কিনেই ফেলা যাক একটা আর্ট-ওয়ার্ক। আমার বাজেটের মধ্যে অবশ্য তখন অবশিষ্ট ছিলো শুধু কিছু “মিশ্র গাছ”। ভাবলাম মিশ্র-গাছই সই! কিন্তু সব মিশ্র-গাছই দেখতে ছিলো প্রায় কাছাকাছি, কোনটা রেখে যে কোনটা নেই- কিছুতেই যখন সিদ্ধান্তে আসতে পারতেছিলাম না, আমার পাশে এসে একজন বলছিলেন, “তুমি ওই বকপাখিটাই নিয়ে যাও, বাকি টাকাটা পরে কখনো দিও।“ 😀
প্রিয়ভাষিণী আমাকে সেই সুযোগটা দেয়াতে আমার সবথেকে বড় প্রাপ্তিটা কী হইছিলো জানেন? পরে আরো কয়েকবার সেই উছিলায় তাঁর সাথে দেখা করতে যাওয়া গেছিলো।
প্রিয়ভাষিণীর ধানমন্ডি তিন নাম্বার সড়কের ওই বাসাটায় না একবার ঢুকলে আমার আর বের হইতে ইচ্ছা করতো না। ইন ফ্যাক্ট সবাইকেই বলতে শুনতাম তেমন কথা। সবাই বলতো সেই বাসার ছিমছাম গাছ-গাছালিতে ঘেরা পরিবেশের কথা। কিন্তু আমি তো জানতাম, ওইসব গাছ-গাছালি, ছায়া-টায়া যে আসলে আমার অতটা প্রিয় কিছু না। আমি টের পাইতাম, ওই বাসায় আমার ওরকম শান্তি-শান্তি লাগে আসলে ওই প্রিয়ভাষিনীর কারণেই। সাজসজ্জা দিয়ে কি আর অমন মমতা মাখা ঘর সাজানো যায়।
পরে আরো কয়েকবার গেসি আমি সেই বাসায়। আমাদের এক প্রিয় শিক্ষকের বিয়েতে পুরা ক্লাস মিলে আমরা স্যারকে প্রিয়ভাষিণীর একটা ভাস্কর্য গিফট করছিলাম, সেই উছিলায় বেশ কয়েকদিন যাওয়া হইসিলো। আমার আসলে যাইতে ইচ্ছা করতো খুব, কিন্তু কোন কারণ ছাড়া একজনের বাসায় গিয়ে হাজির হবার কথা ভাবতে বেশ লজ্জা লাগতো সেই বয়সে।
সম্ভবত সেইটাই শেষবার ছিলো, চলে আসার সময় আমি বলছিলাম, “পরের বার অনেক টাকা জমাইয়া নিয়া আসবো আপনার বাসায়, আপনার থেকে একটা পুরা ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কিনে নিয়ে যাবো।“
তাঁর স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসিটা দিয়ে তিনি বলসিলেন, ওইসব টাকাটুকা জমানোর অপেক্ষায় না থাকি যেন, মন চাইলেই যেন চলে আসি।
মন চাইছে, বিনা ছুতায় কারো বাসায় গিয়ে হাজির হবার সাহসও পরে হইছে, কিন্তু আমার আর যাওয়া হয় নাই তাঁর কাছে। আজকে আমার মনে হইতেছে, যতবার মন চাইছে, ততবারই কেন যে চলে যাই নাই আমি!
তাঁকে কখনো বলি নাই, এবং সম্ভবত কখনো বলতে পারতামও না, কিন্তু মনে হইতেছে, কোন এক উপায়ে আমার তাঁকে জানানো দরকার ছিলো যে আমি তাঁকে কতটা অসম্ভব ভালোবাসতাম।
সেই ভালোবাসাটা যখন তিনি আমার থেকে আদায় করে নিছিলেন, আমি বেশ একটু অপ্রস্তুতই হইছিলাম। কেননা, আমি তখনো ভাবতাম, বন্ধুবান্ধব বা পরিবার-পরিজনের বাইরে ওরকম “অপরিচিত” কাউকে আমার পছন্দ হবে, ভালো লাগবে, তাঁদের কেউ কেউ আমার থেকে সমীহ আদায় করে নিতে পারবেন (আবার কারো কারো থেকে সেই সমীহ আমাকে পরে ফিরাইয়া নিতে হবে), কিন্তু তেমন বাইরের কেউ আমার কাছে কখনো ভালোবাসা দাবি করতে পারবেন না।
ইন ফ্যাক্ট, তার পরেও কখনো তেমনটা ঘটে নাই তো, “অপরিচিত” কাউকেই তো কখনো ঠিক ভালোবাসতে পেরে উঠি নাই আমি আর।
প্রিয় প্রিয়ভাষিণী, আপনার মতোন ওরকম কাউকে আর পাই নাই যে আমি কখনো। ওরকম- পুরাটা শরীর জুড়ে, পুরাটা অস্তিত্ব জুড়ে যেন শুধু অগাধ মমতা আর মমতা- এমন দ্বিতীয় কোন মানুষের দেখা আমি আজও পাই নাই।
প্রিয় প্রিয়ভাষিণী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, আমার অনেক অনেক ভালোবাসা জানবেন!
রেদওয়ান বাশার
Latest posts by রেদওয়ান বাশার (see all)
- গনতন্ত্র কেন দরকার? - আগস্ট 10, 2024
- মাইকেল সরকিন ও মার্সেল - মার্চ 28, 2020
- প্রিয় প্রিয়ভাষিণী - মার্চ 6, 2018