Main menu

ফিকশন: একদিন তোর হইবো রে মরণ – ১

“In ancient Rome, when a victorious general paraded through the streets, legend has it that he was sometimes trailed by a servant whose job it was to repeat to him, “Memento mori”: Remember you will die.”

০.০১ বিপ্লবের রঙ লাল

 

আমস্টারডাম।

বাইরে টেম্পারেচার নয় ডিগ্রীরও নিচে।

স্মল আর কোজি একটা বার। গথিক স্ট্রাকচারের।

পুরা বারটাই খালি, মানুষজন নাই। কোণার ছোট্ট একটা টেবিলে কয়েকজন মানুষ বইসা আছে। এমন চুপচাপ আর স্টিল হয়া বইসা আছে যে মনেহয় এঁরাও কয়েকটা চেয়ার। কথা বলতেছে এমন আস্তে যে মনেহয় মেশিন দিয়া আওয়াজ বাইর হইতেছে। মানুষগুলি খুবই বেমানান এটমোস্ফিয়ারের সাথে। এইরকম এনভায়রমেন্টে ভূত থাকতে পারে কিন্তু তাই বইলা মেশিনের মতো মানুষজন![pullquote][AWD_comments][/pullquote]

টেবিলের মাঝখানে ল্যাম্পের মতো একটা আলো। একটা ম্যাপ রাখা সেইখানে। সবাই ঝুঁকে আছে সেইটার দিকে।

সুপারম্যান-ই কথা শুরু করলেন – লাইফ যেইরকম ফিকশনাল হয়া উঠতেছে ফ্যাণ্টাসির আর কোন দাম নাই এখন। যারে তারে নিয়া যখন তখন ফ্যাণ্টাসি করা যাইতেছে।

স্পাইডার ম্যান: বাল, এইটাতে আমাদের ওরিড হওয়ার কি আছে? হাত দিয়া সুতা ছাড়লেই তো আর স্পাইডারম্যান হইতে পারে না সবাই। সব জার্নালিস্টই কি সুপারম্যান নাকি? আপনি ক্যান ডরান?

বাটম্যান: আমার ধারণা, কানার হাটবাজার বইলা এইসবে ভয় পাইতেছেন আপনারা। কিন্তু অন্ধকারে আমি ব্যাটম্যান যে আছি সেইটা কেন ভুইলা যাইতে চান? আজিব। আমি মরি নাই, তারপরও আপনারা জোকাররেই ডরান!

টারজান: অর্গানিক ইস্যুটা হ্যান্ডেল করার জন্য আমার উপ্রেই ভরসা করতে পারেন।

বায়োনিক ওম্যান একটু লজ্জাই পাইলেন। কইলেন, দেখেন অর্গানিক জিনিসটাও একটা সায়েন্সই। আবিষ্কার করা লাগে নাই কি কারো না কারো?

সবার পন্ডিতি দেইখা একটু বিরক্তই হন মাইকেল কর্লিয়নি, কিন্তু সেইটার কোন ইম্প্রেশন গডফাদারের চেহারা বা কণ্ঠে নাই। তিনি সবাইরে শান্ত করার টোনে বলেন, লেটস মেইক দেম অ্যা অফার হুইচ দে ক্যান্ট রিফিউজ। তারপর ব্যাকগ্রাউন্ডটা উনি আরেকবার রিভিল করেন। বলেন যে, মিনিং ইম্পোজ করার কিছু নাই। কনটেক্সটটারে এমনভাবে ক্রিয়েট করা লাগবে যাতে মিনিংগুলি অটোম্যাটিক্যালি বাইর হয়া আসতে পারে। দেখবেন, প্রি-কলোনিয়ান অ্যাক্টিভিটিগুলারে অরা আরো বেশি কইরা সাবস্ক্রাইব করতে পারবে, আমাদেরকে এড়াইতে গিয়া। আমাদের খালি সেই চান্সটা দিতে হবে। সো, আপনেরা এলিয়েনদের লগেই ফাইট’টা করেন। উনারাই উনাদের রেভিউলেশন ঘটাইয়া ফেলতে পারবেন।

লেটস হ্যাভ অ্যা রেভিউলেশন! – গুনগুন কইরা সবাই-ই একই গান গাইয়া উঠলেন।

হলুদ বাতি নিইভা গিয়া লালবাতি জ্বইলা উঠলো তখন।

 

০.১ রূপার কান্না

লালবাতি জ্বালায়া দিনের বেলা একটা অ্যাম্বুলেন্সে যাইতেছে। ষ্ট্রেচারে হিমু’র শরীর। পাশে বইসা আছে রূপা আর মাসুদ রানা। আমি কি মারা যাইতেছি? আমি কেন মারা যাবো! মারা গেছেন ত হুমায়ূন আহমেদ! হিমু ভাবতে থাকে। তার ভাবনার চাইতেও দ্রুত চলে যাইতেছে অ্যাম্বুলেন্স।

রূপা চুপচাপ বইসা আছে। একটা হাতে শে ধইরা রাখছে হিমু’র হাত। অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া রাখছে শে। এই যে অন্যদিকে তাকাইয়া থাকা, তার চোখের দিকে তাকাইয়া তার মইরা-যাওয়াটা দেখতে না-চাওয়া, এইটাই ভালোবাসা; হিমু বুঝতে পারে। সে দেখতে পাইতেছে রূপার গালের শিরাগুলা কেমন লাল হয়া আছে; শে কি কানতেছে? এইটাই কি ভালোবাসার কান্না? এই ভালোবাসা আসলে নেয়া যায় না। আমাদের অস্তিত্ব নিতে পারে না। ইগনোর করার ভিতর থাকতেই থাকে। যদি মইরা যাই, এই কথা রূপারে ত আর বলা হবে না। কিন্তু হিমু জানে, সে মরবে না আজকে। অথবা যদি মইরা-ই যায়, তাইলে তার খুব খারাপ লাগবে। বাঁইচা থাকার জন্য না, রূপার ভালোবাসা সে তো আর দেখতে পাবে না। এইজন্য মইরা গেলেও তার খারাপ-লাগাগুলা দুনিয়াতে থাইকা যাবে। হয়তো রূপা বাঁইচা থাকবে, অন্য কারো চোখের দিকে তাকায়া সে খুঁজতে থাকবে হিমু’র ভালোবাসা। যে চোখে সে তাকায় নাই, সেই চোখ তখনো কেন বাঁইচা থাকতে পারবে না! এমনই অসহায় ভাবনা ভাবতেছিলো রূপা।

পাশে বইসা মাসুদ রানা কেমন কইরা জানি ঝিমাইতেছে। চিন্তা আসলে ওরে নিয়া। হাসপাতালে গেলে ডাক্তার’রা নিশ্চয় বুঝতে পারবে। অ্যামেচারদের চাইতে প্রফেশনালরা এইজন্য বেটার। অদের অভিজ্ঞতা এবং জানার কারণে ওরা নিশ্চিত থাকতে পারে অনেক, এইজন্য কুইক অ্যাকশন নিতে পারে। যেমন পারলো রানা। যেই সিচুয়েশনে তাঁরা পৌঁছাইছিলো সেইখান থিকা বাঁইচা আসার কোন কারণই ছিলো না। রানার মিলিটারি ট্রেনিং আর মিশনের অভিজ্ঞতা ছিল বইলাই বাঁইচা আসতে পারছে অরা। অথচ এমন একটা সময়ে তারা ছিল যেইখানে বাঁইচা থাকা বা মারা যাওয়া তেমন কিছুই মিন করে না।  সেই সময়ের কথা হিমু আর ভাবতেও পারতেছে না।

হঠাৎ কইরা রূপা মুখটা ঘুরায়, গলাটা সামনের দিকে নিয়া চিৎকার কইরা উঠে, “আপনি আরো জোরে যাচ্ছেন না কেন!” যদিও কোন সম্বোধন নাই, এইটা ড্রাইভাররেই বলা। ছোট প্রফেশনের লোকদেরকে রেসপেক্ট দেখাইয়া আপনি বলতে হয়, তাইলে ওরা আপনারেও রেসপেক্ট করবে। সমাজের সেলফ-রেসপেক্ট বাড়তে থাকবো। মোহনদাস করম চান্দ গান্ধী কি শিখাইছিলেন এইটা প্রথমে? হিমু কিছুই মনে করতে পারে না। সবকিছুই ঘোলাটে হয়া আসতে থাকে তার চোখে। আ্যাম্বুলেন্সটা মনে হয় অ্যাপোলো হসপিটালের দিকে যাইতেছে। বসুন্ধরার গেইটে ঢুকবার সময় রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামটা বাঁধছে। পোঁ পোঁ বাজতেছে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। আচ্ছা এখন কি সকাল? মানুষজন কি অফিসের দিকে যাইতেছে? নাকি সন্ধ্যা, সবাই ফিরতেছে ঘরে। মানে, ঘর তো আছে সবারই, ঘর না থাকাটাও ঘর; নাই বইলা চলতে থাকাটাই একটা ঘরের কল্পনার ভিতর দিয়া পারসিভ হয়। চলতে থাকার কারণে এই দুইটা টাইমেই রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম বেশি হয়। মানুষ যখন আসতে থাকে বা যাইতে থাকে। মানুষের আর কাম কি? শুধু যাওয়া-আসা। প্যাসেঞ্জার আমরা সকলেই। রবীন্দ্রনাথের গান কি বাজতেছে নাকি কোথাও?

রূপা খুব সুন্দর কইরা রবিগানগুলা গায়। আরো সুন্দর লাগে অর ভঙ্গিমার কারণে; কোন টেনশন নাই, যেন শে মাইয়া না কোন, খালি ‘নারী’; অথবা আরো সুপ্রিম কোন কিছু, যেমন – যে নারী সে একটা গান-গাওয়ার যন্ত্র খালি। যে শুনতেছে, এনজয় করতেছে তার ডিজায়ার ফুলফিল করার অবজেক্ট, ফুল বা পাখি-ই কোন। এই সময় রূপারে কি বলা যায় একটা গান গাওয়ার জন্য? কোন গানটা গাইবে সে? ‘তুমি ডাক দিয়াছ কোন সকালে, কেউ তা জানে না…’? নাকি ‘গোধূলি গগণে মেঘে ঢেকেছিল তারা…’? এখন কি সকাল নাকি সন্ধ্যা?

রূপারে জিজ্ঞাসা করতে চায় হিমু। হিমুর গলায় কোন আওয়াজ আসে না। সে খালি একটা দেইখা যাওয়ার মেশিন। কথা বলার কোন অধিকার তারে দেয়া হয় নাই। এইটা এমন একটা সময়, যখন আওয়াজ ছাড়া আবছা দৃশ্যের ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে সবকিছুই মুছে যাইতেছে। ঘরোয়া’র ভূনা খিচুরি’র দোকান, তার আগে হাজি’র বিরিয়ানি, তারপরে ইলেকট্রিকের দোকান, জুতার শো-রুম, ফখরুদ্দিন, পিএইচডি, ডক্টরেট ডিগ্রীওলাদের দোকান না, পিৎজা হাট ডেলিভারি, লেখা আছে পাশে, ইংলিশেই; এবড়ো-থেবড়ো বিল্ডিংগুলা পার হয়া অ্যাম্বুলেন্সটা এখনো যাইতেছে, যাইতেছে… তার যাওয়া স্লো হয়া আসতেছে, গ্রামীণফোনের অফিসের সামনে আইসা, নাকি হিমু’র চোখ-ই নিইভা আসতেছে…

রূপার কান্না এখনো দেখা যাচ্ছে। মাসুদ রানা ঝিমাইতেছে, নেতাইয়া পড়তেছে। হিমু’র নিজের কোন এগজিসটেন্স নাই আর। রূপার চোখের থেকে যেই পানির ফোঁটা তার গাল বাইয়া নেমে যাইতেছে ওই জায়গাটাতেই সে তার পুরা এগজিসটেন্স নিয়া পইড়া থাকে। খুবই ইনটেন্স; তারপরও নিজ তো আসলে নিজেরই বাইরের একটা জিনিস, অল্প কয়টা মুহূর্তের ভিতরই আটকা পইড়া থাকা একটা মোমেন্ট। তার শরীর সে আর ফিল করতে পারে না।

নিজেরে নিয়া সে আর ভাবতে পারে না। ভাবতে থাকে, মাসুদ রানা কই? মাসুদ রানা…

* * *

এইরকম একটা শেষের জায়গাতে আইসাই আসলে টের পাওয়া যায়, এর শুরুটা ছিলো আসলে, কোথাও না কোথাও।

 

১. ভারতনাট্যমের পরে 

কোথাও কোন কাজকাম নাই। খালি বইসা থাকা। ভারতনাট্যমের পরে অনেকগুলা অপারেশন গেলো; কিন্তু দেশের মাটিতে কাজকাম দিন দিন কমতেছে, নাই-ই কোন। মাসুদ রানা ঢাকায় বইসা আজাইরা টাইম পাস করতেছে, এই ২০১৪ সালে। অফিসে আসে আর খালি ডেস্কে বইসা ইলেকট্রিক সিগ্র্রেটের ধোঁয়া ছাড়ে। ফেড-আপ সে। সিঙ্গেল হ্যান্ডেডলি কোন কাজ করা যাইতেছে না। র’এর এজেন্টরাই শালা সবকিছু সামলায়। আইএমএফ-এর অ্যাডভাইজারের রুম যেইরকম বাংলাদেশের ব্যাংকের গর্ভনরের রুমের পাশে; সেইরকম ক্লোজ ওরা হোম মিনিস্ট্রি’র। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার মতো সেনসেটিভ বিষয়গুলাও ওরা হ্যান্ডেল করে; গাব্বার সিং-এর ইন্ডিয়াতে সাকসেসফুল ট্রান্সফারের পরে।

সিআইএ গোপনে এক ধরণের সম্পর্ক রাখতে চায় তার সাথে। এই ইলেকট্রিক সিগ্রেট’টা ওদেরই একজন দিলো কয়দিন আগে; রূপসী বাংলার বার-এ। বরিশালের জীবনানন্দ কলকাতা হয়া এখন ঢাকাতে। জেমস বন্ড কইলো, এই সিগ্রেট এখনো কোন লিগ্যাল এন্টিটি না এবং একইসাথে ইলিগ্যালও না। আম্রিকায় এইরকমের ব্যবসা প্রফিটেবল হয়। এইরকম ব্যবসার জিনিস তোমরা নেও না কেন? চাইলে এর সাথে অন্যান্য জিনিস, যেমন সেক্স-ডলের ব্যবসাও করতে পারো তোমরা, বাংলাদেশে! ফেসবুকের যে স্প্রেড এইখানে, ইট ইন্ডিক্টেস যে, লোনলিনেসের মার্কেট এইখানে বড়, অবদমনের ব্যবসা  তো আগে থিকাই আছে। মানে, কেমনে কল্পনা করতে হয় এই  জায়গাটাতে যদি একটু ঢুকতে পারো, এক্সপ্লোর করতে পারো, তাইলে আসল ব্যবসা’টা এইখানেই। মানুষ তো আসলে সেইটাই মানুষ যা হইতে চায়! জাস্ট অ্যা সাজেশন আর কি। আমরা কতকিছু দিতে চাই তোমরা’রে, তোমরা খালি ডরাও, তোমাদের সেলফ-কনফিডেন্স তো কম, এইজন্য ইনফিরিয়র হয়া থাকো, উদার হইতে পারো না। এইভাবেই যাওয়ার আগে জানতে চাইলো, পাকিস্তানের আইএসএস এর সাথে বাংলাদেশ মিলিটারি’র সম্পর্কটা এখন কে হ্যান্ডেল করে?

ওবামা’র আমল থিকা সিআইএ’র ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক আসলেই ডিফেন্সিভ মুডে চইলা গেছে। এইভাবে উপদেশ-ব্যবসার স্ট্রাটেজী দিয়া আর কদ্দিন? সবকিছুই আউটসোর্স কইরা ফেলছে। ওদের সাথে কথা বলার চাইতে হলিউডের ডিরেক্টরদের এজেন্টের সাথে কথা বলাটা বরং অনেক বেটার।

কিন্তু বাংলাদেশ সিক্রেট ইন্টেলিজেন্সের নিজের কোন কাম কি আর নাই? বিশেষ কইরা গণজাগরণ মঞ্চের ঘটনার পর সে আরো আর্জ ফিল করে। যা ঘটতেছে তার সবকিছুই ক্লিয়ারলি বুঝতে পারাটা দরকার। কি করতেছে সে ঢাকায় বইসা বইসা? এইরকম অধৈর্য্য শো করার পরে রাহাত খান বেশ কিছু মাইনর কাজ দিছেন তারে। সে জানে না এইগুলা কি মিন করে বা আসলেই এইগুলা কোন কাজ কিনা। এইরকম ছ্যাঁচড়া ড্রাগ ডিলার ধরতে যদি তারে যাইতে হয়, বালের র‌্যাব আছে কি করতে? এইরকম না-বুঝতে পারার ভিতর আরো হাঁসফাঁস লাগে রানার। বিকালবেলা বাইরে থিকা ফিরা কোনকিছু না বইলাই দুম কইরা বুড়া’র রুমে ঢুকে পড়ে।

বুড়া – রাহাত খান। চুপচাপ, গম্ভীর স্বভাবের মানুষ। কোন কথা বলতে গেলেই অস্বস্তি হয় রানার। এমনিতে তাঁর রুমে ঢোকার পারমিশন কারো নাই; যদি না তার ডাক পড়ে। আর রাহাত খানের ডাক পাওয়া মানেই কিছু একটা ঘটতে যাইতেছে।

রানা ঝোঁকের মাথায় আজকে ঢুকে পড়ছে। এত নিরবতা আর নিতে পারতেছিলো না সে। রানা’র দিকে পিছন ফিরা দাঁড়ায়া আছেন রাহাত খান। তাঁর সামনে স্বচ্ছ কাঁচের দেয়াল। রমনার বিশাল উদ্যান। স্বাধীনতার স্তম্ভটা দেখা যায়। রানার দিকে না ফিরাই অমিতাভ বচ্চনের মতো দরাজ গলায় উনি কইলেন, বসো!

বিশাল টেবিলের সামনে রাখা দুইটা চেয়ারের একটাতে বইসা পড়ে রানা। রাহাত খানের আধা-পাকা চুলের সামনে থিকা পাইপের ধোঁয়া বাইর হয়া আসে। শেখ মুজিব মারা গেছেন সেই কবে; বুড়া এখনো তাঁর রুমে দাঁড়াইয়া ৭ই মার্চের কথা মনে করেন।

কিভাবে আইএসএস’র প্ল্যানটারে তিনি নিজেই একা আটকাইয়া দিছিলেন যখন র’এর লোকজনও টের পাইতে পারে নাই। অরাও জানতো মুজিব ‘দাবিয়ে রাখতে পারবে না…’ না বইলা ‘দাবায়া রাখতে পারবা না…’ বলবেন। প্রফেসর শঙ্কু’রে লাগাইয়াও তারা এই তাদের কথিত (মানে, তাদের লিখিত) অশুদ্ধ বাংলারে প্রমিত করতে পারে নাই। এই প্রমিতনেস যে সাসটেইন করতে পারবে না সেই হিন্ট ওইখানে এক্সপোজড হয়া গেছিল। ঢাকা ইজ নট গোয়িং টু বি কলকাতা’স চাইল্ড। এইটা অবভিয়াস  হয়া গেছিলো যে, করাচির উর্দু থিকা কলকাতার বঙ্গতে হিজরত করবে না ল্যাঙ্গুয়েজ। ঢাকা নিজেই সেন্টার হয়া উঠবে, এইটা আর কেউ ভাবতেও পারে নাই।

কমিউনিস্টরা তারে ঘেরাও কইরা ফেলছিল, জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়ারা ত ছিল-ই। ড্রাফটটাই তারে পড়তে হবে; স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে। শেখ মুজিব তখনো কিছুই বলেন নাই। চুপচাপ সব শুনতেছিলেন। শেষমেশ কইলেন, কি লিখছিস, নিয়া আয় দেখি!তখন খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেলো ভাষণের মূল ড্রাফট’টাই হাওয়া। সবাই যখন হায় হায় করতেছে তখন শেখ মুজিব হুংকার ছাড়লেন, আমি কি মুখস্থ ভাষণ দিবো নাকি! সবাই জানে, মুজিব যদি মুখ খুলে তাইলে তারে আটকানোর কেউ নাই।

এর কোনকিছুই সম্ভব হইতো না, যদি সেই লিখিত বাংলারে, ভাষার ডিসটরটেড সেন্সটারে ইগনোর না-করা যাইতো। এখনো বাঙালি তার র’ফর্মে সাসসেইটন করার ট্রাই করতে পারতেছে। রাতে মুজিব রাহাত খান’রে একলা ডাকাইয়া বুকে জড়াইয়া ধরছিলেন। ‘এই বাঙলা আর বাঙালি’রে বাঁচাইয়া রাখতে হবে, রাহাত!’

সেই কথার দাম হয়তো মুজিবও বুঝেন নাই; আর রাহাত খান এখনো বোঝার ট্রাই করে যাইতেছেন। সেই অবিশ্বাস্য বিকালের কথাই রাহাত ভাবতেছেন আজকে, আবারো বিয়াল্লিশ বছর পরে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শেখ মুজিব তাই আর দেরি করেন নাই। রাহাত খান’রে ইন্টেলিজেন্স টিম করার দায়িত্ব দিছিলেন। ফ্রম দ্যা ভেরি বিগিনিং রাহাত খান ওয়াজ সিলেক্টিভ। শেখ-বংশের, মজহার-মাজহাবের এবং খান-পদবী’র কাউরে নেন নাই। মাসুদ রানা ইজ দ্য নিউ বেঙ্গলি আইডেন্টিটি, যার নাম-ই হইলো তার পদবী। এই নাম এখন গিয়া কপি করতে পারতেছে লোকজন। রানা আজকে যা, তা আসলে রাহাত খানেরই ইমাজিনেশন। রানারে উনি যেমন বুঝতে পারেন, রানাও টের পায় বুড়ার ভাবনা, কিন্তু বুঝতে পারে না, পুরাটা।

বুড়ার ভাবভঙ্গি আজকে সুবিধার মনে হইতেছে না। ধীরে ধীরে রানার দিকে ফিরলেন তিনি। নিজের চেয়ারে না বইসা, পাশের সোফাতে বসলেন। পাইপ থিকা একমুখ ধোঁয়া ছাড়ার পর ঠোঁট থেকে পাইপটা ডান হাতে নিলেন। ধোঁয়ার ভিতর থেকে রানার চোখে সরাসরি তাকাইলেন। রানা কুঁকড়াইয়া গেলো। যেন সমস্তকিছু বুড়া পইড়া ফেললো, তার চিন্তা-ভাবনা-কনফিউশন-রাগটাগ; যা সে বলতে চায় এবং না বলতে পারা, সবকিছু।

তারপর ধীরে ধীরে প্রতিটা শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণ কইরা কইলেন, ‘তুমি যা ভাবতে পারো, ঘটনা শুধু তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ইটস নট অনলি অ্যাবাউট আওয়ার স্টেট, ইটস অ্যাবাউট আওয়ার অউন এগজিসটেন্স! এইখানে কোন ভুল আমরা করতে পারি না।’

এইটুকু বলার পরে থামলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, ‘ওয়েট করো। সময় আসবে। শত্রুরে তার ভুলটা করতে দাও! যতক্ষণ পর্যন্ত শেয়াল বাঘের লেজের পাড়া না দিবে, বাঘ আক্রমণ করে না। লেট দেম ডু দ্য রং মুভ, ফার্স্ট!’

রানা ধৈর্য্য রাখতে পারে না; বলে, ‘ততক্ষণ পর্যন্ত সারভাইভ করাটাই ত মুশকিল। র’ই ত কন্ট্রোল করতেছে এখন ঢাকা শহর। আইএসএসরা’ও পায়ে পায়ে ঘুরে। মিলিটারি ত ব্যবসা নিয়া ব্যস্ত, তা না হইলে জাতিসংঘের শান্তি মিশনের টিকিট। আমার মনে হয়, আমরা দেরি করে ফেলতেছি। সিচুয়েশন ইজ টোটালি আউট অফ আওয়ার হ্যান্ড!’

ভাবলেশহীনভাবে বসে আছেন রাহাত খান। রানা’র অধৈর্য্য আবেগ তারে ছুঁইতে পারে না। যেন ত্যাদঁড় কোন ছোট বাচ্চারে বুঝানোর চেষ্টা করতেছেন, এইরকমভাবে ছোট্ট করে বলেন, ‘লেট আস ওয়েট অ্যান্ড সি।’

চুপ কইরা যান রাহাত খান। মানে, কথা এইখানেই শেষ। রানাও বুঝতে পারে।

কিছুক্ষণ পরে প্রসঙ্গ পাল্টায়া রানারে জিগান, “রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা’টা পড়ছো? তোমরা তো আবার পোস্ট-মর্ডান, এখন রবীন্দ্রনাথ পড়তে লজ্জা করে!” টিটকারি’টা ঠিকই দেন উনি। রাহাত খান জানেন, উনার রবীন্দ্রনাথ নিয়া অবসেশনটা রানা অ্যাপ্রিয়েশট করে না। কিন্তু উনি জানেন না যে, রানা খালি অ্যাপ্রিশয়েটই করে-না না, রীতিমতো ভালগার সব জিনিস ভাবে। রাহাত খানের রুমে একটা শেলফ ভর্তি রবীন্দ্র-সমগ্র, তাও বিশ্বভারতী’র। উঠতে-বসতে খালি রবীন্দ্রনাথ থিকা কোট করেন। রানা’র ধারণা, উনি টয়লেটে গিয়াও এসো এসো আমার কমোডে এসো, আমার কমোডে; বাহির হয়া আসো আমার যে আছো পেটের ভিতরে… এইরকম মনে করতে থাকেন! একটা মানুষ আরেকটা মানুষরে কেমনে এইরকম অবসেসড কইরা রাখতে পারে, খালি নোবেল প্রাইজ পাইছে বইলা! রানা’র উইয়ার্ড ইমাজিনেশন আর আগাইতে পারে না মেজর রাহাতের কথা’তে। “সময় নিয়া শেষের কবিতাটার শেষ কবিতাটা পইড়ো! এইটা উনার সেরা কবিতা, সেরা যদিও বলা যায় না কবিতা নিয়া, তারপরও… দেখো, এইটা কিন্তু নারী’র লেখা, পুরুষ না সে; বাংলা-কবিতা পড়ার লাইগা অমিত’রে কেন ব্যাঙ্গালোরে যাইতে হইছিলো আর একটা কবিতার লাইগা তার পটভূমি’টা কেন জরুরি, সেইটাও ভাইবো। কারণ কবিতা খালি শব্দগুলা না… শব্দগুলা হইলো ঘটনার রিফ্লেকশন…” ব্লা ব্লা ব্লা।

রানা’র মাথার ভিতর কিছুই ঢুকে না। সে হিমু’র কথা ভাবে। হিমুও শালা রবীন্দ্রনাথের মতো বাহুল্য নিয়া থাকে, ভঙ্গিমার ভিতর নিজেরে পাচার কইরা দিয়া মজা নিতে থাকে। প্রোলংগ করতে থাকে ঘটনারে। বাল ঘটনা কি নিজে নিজে ঘটে নাকি। ঘটনারে ঘটাইতে হয়!

হিমু কোন ঝামেলা না-বাঁধাইলেই হইছে। রানা ভাবে।

 

 

 

Series Navigation<< ফিকশন: একদিন তোর হইবো রে মরণ – ৬ফিকশন: একদিন তোর হইবো রে মরণ – ২ >>
The following two tabs change content below.
Avatar photo
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →