Main menu

পোস্টস্ক্রিপ্ট: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য কবিতা নিয়া

তলস্তয়ের ‘how much land does a man need?’ গল্পের [ঐ যে এক লোককে কইলো, সূর্য ডোবার আগে যতটা জমি বেড় দিয়া ঘুইরা শুরুর পয়েন্টে ফিরতে পারবে, তত জমি তার হবে! লোকটা তখন হাঁটা শুরু করলো, হাঁটতে হাঁটতে এত দূরে চইলা গেল যে ফেরার অনেক আগে পথেই সন্ধ্যা হইয়া গেল, সারা দিন না খাইয়া দৌঁড়, সন্ধ্যা হইয়া যাইতেছে-টেনশন, খিদায় কাহিল দশায় পথেই মইরা গেল! আখেরে দেখা গেল, কবরের সাড়ে ৩ হাত জমিই মাত্র দরকার তার!] পোয়েটিক তরজমা হিসাবে ‘রাশি রাশি ভারা ভারা, ধান কাটা হলো সারা… ‘, মানে রঠা’র ‘সোনার তরী’ কেমন? কনটেক্সুয়ালাইজেশন ভালোই হইছে বলা যায়; মানে আমাদের তো অত জমি নাই লোকের তুলনায়, কবর ব্যাপারটাও তো রঠার চিতার মতো না, ওদিকে নাও লোকে বেশ চেনে–আওয়ামী লীগের নৌকার আগে থিকাই তো! তলস্তয়রে রঠা চিনতেন না আদৌ–এমন একটা বেনিফিট অব ডাউট দিয়া ‘…থিঙ্ক এলাইক’ ভাবতে আরাম পাইবেন অবশ্য অনেকেই।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

এনিওয়ে, ওইটা আমার ইস্যু না, আমার ইস্যু হইলো, নীতিকথার ছবক দেবার অমন পাতলা একটা পদ্যের ভালো কবিতা হইয়া পড়াটা। অনুপ্রাস আর অন্ত্যমিল কেমনে ওই পাতলা কাব্য লুকাইয়া ফেললো–সেইটাই বুঝতে চাইছি। কবিতাটা কইতাছে, ‘অনেক সোনার ধান কাইটা নাও ভইরা ফেললাম, এত্ত ভরলাম, এত্ত ভরলাম, এত্ত ভরলাম যে নিজে ওঠার জায়গা নাই আর!’

ক্যাপিটালিজমের আলগা ক্রিটিক–রোমান্টিক; কিছু ধান তো তখন ফালাইয়াই দেবে ক্যাপিটালিস্ট, তার তো নাই রঠার মতো রোমান্টিকতা। এই দিক থেকে তলস্তয় অত পাতলা না; কেননা, সেইখানে টাইমের ভিতরেই ফিরে আসতে পারবে ভাবা গেছিল, হিসাবটা একটু ভুল হইছিলো লোভের কারণে; রঠা’র কবিতায় ভুলটা মেক-আপের সুযোগ আছিলো; বোকা পাঠকের মনে বেদনা ঢালতে চাইছেন বলেই মে বি কবিতার কর্তারে আরেকটু চালাক হইতে দেন নাই রঠা! ভাবেন, সেই কর্তা যদি কিছু ধান ফালাইয়া দিয়া বাঁইচা যায় তাইলে কেমন ফানি হইয়া পড়ে পদ্যখান!

 

Untitled

দেখার আরেকটা নজর লইয়াও ভাবা যায়। দুনিয়ায় প্যারাডক্স আছে; এই কবিতার প্যারাডক্স হইলো, একটার জন্য আরেকটা ছাড়তে হবে–হয় ধান কিছু কম লইবেন, অথবা নিজেই পার হইতে পারবেন না। তলস্তয় যেই গপ্পোটা মারছেন সেইখানের প্যারাডক্স হইলো, অনেক অনেক জমি দখল করতে করতে ফেরার টাইম হারাইয়া ফেলছে লোকটা।

কিন্তু পোশ্নটা হইলো, কখন একটা প্যারাডক্সের মাঝে ট্রাজেডির সম্ভাবনা গজায়? রঠার মুরিদরা ঐ কবিতায় ট্রাজেডির রসে ফানা হইয়া যাইতেছেন, অথচ ঐখানে ট্রাজেডি জিনিসটাই নাই! কেন? কারণ, আপনে যেই ভুল কদমটা ফেললেন, সেইটা ফেরত লইতে পারতেছেন লগে লগেই! তলস্তয়ে সেই মওকা নাই। তাই তলস্তয়ে ট্রাজেডি আছে, রঠা প্যারাডক্সে নাই।

খেয়াল করলে দেখবেন, রঠা বড়ো হবার কালের কলিকাতার ইংরাজি পড়া নেটিভ এলিট সমাজে শেক্সপিয়র হইলেন ট্রাজেডির ওস্তাদ, আব্বাও। নেটিভ এলিট শেক্সপিয়র পড়ে, শেখে– ট্রাজেডির ছবক লয়, লেখার চেষ্টা করে। এই কবিতা হইলো কলিকাতার ট্রাজেডি-নাগরদের দরবারে রঠার কেরামতি দেখাবার ছল! কিন্তু ঐ নাগর আর কবি, দুই পক্ষই ট্রাজেডি ততো বোঝেন নাই মনে হয়! সেই কমতি কত কত বছর লুকাইয়া থাকতে পারলো মাত্রা আর অন্ত্যমিলের ভাজে ভাজে!

তবে অতো বোঝাবুঝি মাস্টার ইংরাজের জন্য ততো আরামেরও আছিল না; বুঝলে তো নেটিভ জিগাইয়া ফেলতে পারে, ‘ট্রাজেডি কেন পড়াইতে চাও আমাদের?’। কলোনিয়াল কলিকাতায় ট্রাজেডি তো আসলে মাস্টারদের কিছু ফায়দা হাসিল কইরা দেয়! ট্রাজেডির ভিলেনরা স্রেফ নায়কের ভুলের মাশুল আদায় কইরা দেয়, খেলাটা তো খোদার যেন পুরাই! ভিলেনের পাপ নাই ততো, ভিলেন তো নায়কের সাজা দেবার আসমানি লাঠিয়াল! তাই বাংলা বা দিল্লি বা লাহোর যে ইংরাজের দখলে সেইটা একটা ট্রাজেডিতে সাজা চলতে থাকা, ইংরাজের দোষ কই সেইখানে! নেটিভদের অতীত ভুলের আসমানি মাশুল আদায় চলতেছে মাত্র! ইংরাজরে তাই আপনে ভিলেন ভাবলেও ট্রাজেডি মোতাবেক বুঝবেন, ইংরাজ হইলো, আসমানি ফয়সালায় দরকারি পাটে অভিনয় করতে থাকা নট মাত্র!

এইসব বাদে, এই কবিতা যদি গদ্যে লেখা হয় তাইলে তো রিডার সহজেই ভিতরে তলস্তয় দেইখা ফেলতে পারে! রুশ বুলিতে এই কবিতা তরজমা কইরা তলস্তয়ের রিডারদের কাছে রঠারে পরিচয় করাইয়া দিলে মজাই হবে বটে!

তো, এই রঠা তো ধ্বনির মিলের ভিতরেই কবি হইতে পারলেন, ফলে বঙ্কিমের গদ্য কবিতা মনে লইলে রঠা’র বিপদ, বিহারিলালই নিরাপদ! এমনিতেও বঙ্কিমে বিপদ আছে রঠার; বঙ্কিমের হিন্দুধর্ম বাপ দেবেন্দ্র আর রঠা’র ব্রাহ্মধর্মরে খেদাইয়া দেবার ভয় আছে, পরে দিছেও! রঠা নিজেও বঙ্কিমের হিন্দু হইছেন, বিশ্বভারতীতে মহাত্মা গান্ধীর চান্দা লইয়া কংগ্রেসের কাছে নিজেরে বেইচা বা বঙ্গভঙ্গে বেদনা পাইয়া–উপনিষদ অত কাম করতে পারে নাই রঠা’র মনে! আর কবিতায় বেকুব রিডারেরে ধ্বনিমিলের পাতলা রোমান্স দিয়া বঙ্কিমেরে ভুলাইলেন, বাংলা কবিতার ইতিহাসে বঙ্কিম নাই হবার পরে গদ্য কবিতা লেখার ট্রাই করলেন রঠা; ততদিনে বঙ্কিমেরে কতক কম্যুনাল বলেও চিনতেছে গোপন কালচারাল ব্রাহ্ম রঠা’র রিডাররা, নোবেলের ভাপও তো আছিল! আমাদের ত্রিশের কবিরাও গদ্য কবিতা যেন নয়া আনলেন ইউরোপ থেকে, বঙ্কিম হইয়া ইউরোপে না যাইয়া ইনভেনশন দেখাইলেন একেক জন! আর কবিতায় বঙ্কিমের গদ্য কবিতার প্রস্তাব না লইয়া ৫০ বছর যাবত কত কত ধ্বনিমিলের আবর্জনা গিলাইলো রিডারেরে–কত কত কবি, মিলের ভিতর কত কত পাতলাভাব গোপন কইরা কবিও হইয়া পড়লেন, এখনো আখেরি মিলের স্ট্রাগল কইরা যাইতেছেন কবি কত কত কত…

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

রক মনু

কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →