আল মাহমুদের ইন্টারভিউ: এটা কবিদেরই গদ্য লেখার যুগ (১৯৯২)
কবি উৎপলকুমার বসু ‘কথায় কথায়’ নামে একটা ইন্টারভিউর বই এডিটর হিসাবে ছাপাইছিলেন, ২০০১ সালে, কলকাতার সৃষ্টি প্রকাশন থিকা। মেইনলি ১৯৫৫ থিকা ১৯৬৫, এই সময়টাতে যারা বাংলাভাষায় ক্রিয়েটিভিটিতে বা আর্টের নানান ফর্মে বিখ্যাত হইছিলেন, তাদের ইন্টারভিউ উনি রাখতে চাইছেন। ২৪টা ইন্টারভিউর মধ্যে ২টা ছিলো বাংলাদেশি আর্টিস্টের, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর আল মাহমুদের।
এই ইন্টারভিউটা ওই বই থিকা নেয়া হইছে।
…………………………………………………………………
সাক্ষাৎকার নিছেন : সালাহউদ্দীন আইয়ুব
উপমা : আল মাহমুদ সংখ্যা (১৯৯২, ঢাকা)
…………………………………………………………………
আইয়ুব : আমরা শুনেছি আজ থেকে বহুদিন পূর্বে শহীদ কাদরী একবার কবি আল মাহমুদকে খারিজ করে গল্পকার আল মাহমুদকে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ আসন দিয়েছিলেন। মনে পড়ে সেসব কথা? বলুন তো ভালো করে।
মাহমুদ : আপনারা বোধ হয় অনেক কিছুই শুনেটুনে এসেছেন। একদা শহীদ কাদরী বলে আমার এক কবি বন্ধু ছিলেন। আমরা প্রায় এক-দশক ব্যাপী পরস্পরের প্রতি হৃদ্যতা অনুভব করতাম। কবিদের বন্ধুত্বের পরমায়ু একদশক স্থায়ী হওয়া মানে হলো প্রায় একশতাব্দী স্থায়ী হওয়ার পরিতৃপ্তি উপভোগ করা। পঞ্চাশে শুরু করে ষাটের শেষপ্রান্তে এসে অযাচিতভাবে আমাদের উভয়েরই খ্যাতি-প্রতিপত্তি এত বেড়ে যায়, আমরা পরস্পরের একটু আধটু সমালোচনা ও খোঁচাখুঁচি শুরু করি। সত্তর দশকে আমার একটি ছোট গল্পের বই বেরোয়, নাম ‘পানকৌড়ির রক্ত’। সাধারণত এদেশের পাঠকদের কাছে মননশীল গল্পের কদর তখনও ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এ সময় একজন কবির লেখা গল্প প্রায় সব ধরনের পাঠকেরই সম্ভবত দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমার কবিবন্ধু এ সুযোগ কি করে হাতছাড়া করেন? তিনি বিচিত্রায় লেখলেন, আল মাহমুদের কবিতার চেয়ে তার গল্পই আমার কাছে বেশি প্রতিভাদীপ্ত মনে হচ্ছে। আমি মুহূর্তের মধ্যে আমার বন্ধুর প্রকৃত সদিচ্ছাটা আন্দাজ করে বিচিত্রাতেই জবাব দিই, একটিমাত্র গল্পের বই লিখে আমি যদি শহীদ কাদরী মতো বিশ্বসাহিত্যের একজন সমঝদারের কাছে এদেশের সেরা কথাশিল্পীর মর্যাদা পাই- তবে তো কানাকড়ি মূল্যে আমার কবি খেতাব আমি বিকিয়ে দিতে রাজি। এতে আমার বন্ধুবর খুব জব্দ হন।
আইয়ুব : কিভাবে শুরু করলেন গল্প লেখা? কোন প্রণোদনায়?
মাহমুদ : আমি তখন স্কুলের ছাত্র। সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। বেধড়ক কবিতা লিখে খাতা শেষ করে দিচ্ছি। সব কবিতাই কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী ভাবধারায় প্রভাবিত। এসময় সেকালের কম্যুনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত একটি পাঠাগারে পড়াশুনোর সুযোগ পাই। সেখান থেকে ম্যাকসিম র্গোকির অনূদিত কিছু গল্প পড়ে গদ্য লেখার ঝোঁক সৃষ্টির ফলে হঠাৎ একটি দু’টি গল্প লিখে ফেলি। সৌভাগ্যক্রমে এর একটি রচনা তৎকালীন সত্যযুগ পত্রিকায় গৌরকিশার ঘোষ মহাশয় ফলাও করে ছেপে দিলে আমি বুঝতে পারি কবিতার মতো আমার গদ্যশক্তিও প্রবল। এখানে বলে রাখা ভালো, অন্যের দ্বারা খানিকটা প্রভাবিত হলেও আমার কবিতা কিন্তু এর আগেই কলকাতার কয়েকটি পরিচিত পত্রিকায় প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় দারিদ্র্য ও নিরাশ্রয় অবস্থায় পড়ে গিয়ে আমি ১৯৫৪ খৃষ্টাব্দে ঢাকায় পাড়ি জমাই এবং পঞ্চাশ দশকের কবিদের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা থেকে আমাকে উদ্ধার করে একটি ঘটনা। এ সময় হঠাৎ বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকায় আমার তিনটি কবিতা প্রকাশ করেন এবং আমাকে দু’লাইনের একটি চিঠি লিখে জানান, ‘তোমার কবিতা ছাপা যাবে মনে হচ্ছে।’ ভাবুন, তিরিশের কাব্য আন্দোলনের প্রধান কর্ণধার আমাকে চিঠি লিখে তাঁর মনোনয়ন জানাচ্ছেন। আর আধুনিক বাংলাভাষার সবচেয়ে দুর্ভেদ্য পত্রিকায় চেষ্টাতেই চিচিং ফাঁকের মতো রহস্যের দুয়ার খুলে গেল। এরপর গল্পটল্প অতিশয় তুচ্ছ মনে হল। আবার এ সময়টায় আমার বেশ কিছু ছোটো গল্প ঢাকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ‘অগত্যা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ফজলে লোহানী তখন ‘পূর্ববাংলা’ নামক একটি সাপ্তাহিকে এসে জুটেছিলেন। তিনিই মূলত সম্পাদনা করতেন ‘পূর্ববাংলা’। সাপ্তাহিকটিতেও আমার ‘ধূসর রংয়ের খরগোশ’ ও ‘সূর্য ওঠার আগে’ এই শিরোনামে দু’টি গল্প এবং সাপ্তাহিক কাফেলায় ‘জীবন’ নামে একটি গল্প ছাপা হলে তখনকার কথাশিল্পী নামক পাহারাদাররা ‘কে এই হারামজাদা’ ধরনের মন্তব্যে আমাকে সম্মানিত করতে থাকেন। বিরূপ মন্তব্যে আমারও স্ফীত হওয়ার কারণ ঘটে। আমি বুঝতে পারি আমার খাপে জোড়া কিরিচ আছে। কিন্তু পঞ্চাশ দশকের পাল্লায় পড়ে আমি আমার আসল অস্ত্রটিতেই জং ধরে গেছে ভেবে এতদিন ইস্তেমাল করিনি। এখন ভয়ে ভয়ে খাপ থেকে টেনে বের করতে গিয়ে বুঝছি একটু আঁটসাঁট লাগছে বটে তবে নিজের চোখের ঝিলিকটাও লাগছে। এখন বলতে চাই, এটা কবিদেরই গদ্য লেখার যুগ। আর যুগের প্রণোদনা ছাড়া কে আর গদ্য লেখার পরিশ্রম স্বীকার করে।
আইয়ুব : যাকে আমরা ছোটো অর্থে ‘নিরীক্ষা’ বলি- তা আপনি করেননি কখনো, গল্পেও নয় কবিতায়ও নয়; তবু আপনার লেখা সজীব, সপ্রাণ, নিজস্ব; গল্পের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি আপনি ‘পানকৌড়ির রক্ত’ কিংবা ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’ পর্যায়ে- ভাষাগত মৌলিক প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন; তাছাড়া কোথায় যেন আপনি বলেছেনও ‘কবিরা ভাষার শিক্ষক’- গল্প লিখতে গেলেন কি এই শিক্ষকতার অভিপ্রায়ে- এমনকি দিন দিন আপনার কথা সাহিত্যিক অভিলাষ বেড়েই চলেছে লক্ষ্য করছি।
মাহমুদ : এই শব্দটি, অর্থাৎ আপনারা যাকে গালভরা নাম দিয়েছেন নিরীক্ষা, আমি এসবের বিশ্বাস করি না। সাহিত্যে অসার্থকতার নামই হলো নিরীক্ষাধর্মী রচনা। সাহিত্যে নিরীক্ষা জিনিসটা কি তা আজ পর্যন্ত আমাকে স্পষ্টভাবে কেউ বুঝিয়ে পারেনি। কবিতা বা কথা-সাহিত্যে কারো যদি নতুন কোনো উদ্ভাবনা থাকে, আর সেটা যদি হয় পাঠকের কাছে চিন্তনীয় বিষয় এবং পাঠকের অন্তরের সায় পাবার মতো রসযুক্ত, তদুপরি লেখকের রচনার মৌলিকত্ব যদি মুহূর্তের মধ্যেই অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত হওয়ার মতো উপাদানে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ থাকে তবে সেই লেখাটিকে আমরা সার্থক গল্প কবিতা বলে চিহ্নিত করি। আমি কবিতা, গল্প উভয় ক্ষেত্রেই চেষ্টা করেছি নিজস্ব উদ্ভাবনশক্তির পরিচয় দিতে। হ্যাঁ আমি একবার বলেছিলাম বটে কবিরাই ভাষার শিক্ষক। তবে একথায় এটা বোঝাতে চাইনি যে কবিরা ভাষাটাকে উত্তমরূপে জানেন বলে কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও পণ্ডিতি ফলাতে গিয়ে ভাষাটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন। আমি বলতে চেয়েছি কবিরা ভাষার স্বভাবটা অন্যান্য মানুষের চেয়ে অধিক উপলব্ধি করেন। না, গল্প লিখতে গিয়ে আমি মাস্টারি ফলাবার পক্ষপাতী নই। আমার কথাসাহিত্যিক হওয়ার অভিলাষ বাড়ছে কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। বরং বলুন আমি গল্প-উপন্যাসও লিখতে চাইছি। আমি তো আগেই বলেছি, এটা কবিদেরই গদ্য লেখার যুগ।
আইয়ুব : একদিন আপনার মনে হয়েছিলো এরকম : ‘আমাদের সাম্প্রতিক সাহিত্যের যে অংশটি গদ্যের দ্বারা বাহিত হচ্ছে বিশেষ করে গল্প ও উপন্যাস, তা সন্দেহ নেই যে হঠাৎ ঝলমলিয়ে ওঠা হাসির মতো।’ (চারিত্র : মে ১৯৮০) আজকের সাহিত্যচর্চার দিকে তাকিয়ে আপনার কি মনে হচ্ছে?
মাহমুদ : আমি মনে করি আমাদের সাম্প্রতিক কবিতার চেয়ে আমাদের সমকালীন গল্প উপন্যাস আঙ্গিক ও উপস্থাপনা কৌশলের বিচারে আধুনিক। দেশ কাল, স্থানিক বৈশিষ্ট্য, পরিবেশ বর্ণনা এবং সামাজিক খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণে দ্বিধাহীন। জড়তা যেটুকু দেখছি সেটা কেবল ভাষার ক্ষেত্রে। এ দোষ তো সাম্প্রতিক কবিতারও আছে। তবুও স্বীকার করতেই হবে আমাদের গল্প লেখকগণ তৃতীয় বিশ্বের সমসাময়িক লেখকদের থেকে পিছিয়ে নেই। লাতিন আমেরিকায় যেমন হিসপানি ভাষার আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তির একটা জন্মগত সুবিধা আছে তা আমাদের নেই। না থাকা স্বত্বেও ঢাকার নতুন গদ্যভাষায় যা রচিত হচ্ছে তা ফ্যালনা নয়। বরং এক অর্থে কলকাতার রক্ষণশীল, চর্চায় নিপুণ গদ্য কর্মের চেয়ে আমাদের কথাসাহিত্য তার আনাড়ি বাকপটুতা নিয়েই অনেক সতেজ এবং সার্থক। কারণ তারা অভাবনীয় বিষয় ও ভাষা ব্যবহারে ক্রমাগত দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে চাইছে। এ ধরনের রচনাকে আপনি কি করে আধুনিক সাহিত্য না বলে পারেন!
আইয়ুব : আপনি আরো বলেছিলেন গদ্য ভাষার সহজতা সৃষ্টি হলেও তাতে জীবনবোধ সঞ্চারিত হয়নি। কারণ এর জন্য গল্প ও উপন্যাস রচয়িতাদের জীবনের বহু তরঙ্গভঙ্গে আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে হয়। এসব কথার পর প্রায় একযুগ কেটে গেছে। আমাদের কথাশিল্পীরা জীবনশিল্পী হয়ে উঠেছেন তো?
মাহমুদ : আমি সহজতার কথা বলেছিলাম এই ভেবে যে আগে আমাদের লেখকগণ কলকাত্তাইয়া পদ্য ঢংটাকেই বাংলা গদ্যের পরাকাষ্ঠা ধরে নিয়ে গল্প উপন্যাস লিখতেন। এ ঢং বা স্টাইলে যে ভালো লেখা হয়নি এমনও নয়। কিন্তু কবিতা ও নাটকে যখন বাংলাদেশের কথা স্টাইলটা নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়তে লাগল তখন এর সংক্রাম স্বাভাবিক ভাবেই গল্প উপন্যাস লেখকদের মধ্যেও সহজেই সঞ্চারিত হলো। যেমন ধরুন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘দোজখের ওম’ গল্পটি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, সেলিনা হোসেনের সৃজনশীল রচনার গদ্যভাষার সাথে শওকত ওসমানের গদ্যভাষার যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে সেটাই আমি আপনাকে ধরিয়ে দিতে চাইছি। ধরিয়ে দিতে চাইছি শাহেদ আলীর ‘জিবরাইলের ডানা’র সাথে শওকত ওসমানের পিঁজরাপোলের গল্পগুলোর উপস্থাপন কৌশলের পার্থক্য। মনে রাখতে হবে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ইউরোপীয় সাজসজ্জার নীচে পূর্ববঙ্গীয় কিষাণ আত্মাটি বেশ সতেজভাবেই ধুকপুক করত। আর অভিজ্ঞতার ইঙ্গিতটা দিয়েছিলাম আমাদের লেখকদের জীবনযাপন, ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের উত্থানপতনে তাদের নিরাপত্তাহীনতা ও জীবিকার অনিশ্চিয়তার কথা ভেবে। আমি মনে করি আঙ্গিকগত দুর্বলতার দিকটা অত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার না করলে আমাদের কথাশিল্পীরা নিঃসন্দেহে জীবন শিল্পীর অন্তরদৃষ্টি আয়ত্ত করেছেন। এদের সকলেরই রাজনৈতিক আদর্শ আছে। আছে সামাজিক কমিটমেন্ট। যে কমিটমেন্ট বা আদর্শের সাথে আমার গুরুতর মতপার্থক্যের কথা আজকাল সকলেরই প্রায় জানা হয়ে গেছে। তবুও রচনারীতি ও সাহিত্যিক আন্তরিকতায় যে রচনা উত্তীর্ণ হয় সেটা স্বীকার করে নিতে আমার বাঁধে না।
আইয়ুব : আপনার আরো একটি মন্তব্য আছে; তা হলো জীবনের গভীরতর অর্থকে আবিষ্কার করতে লেখকের কোনো না কোনো আদর্শের কাছে বশীভূত হতে হয়। কিন্তু বেশি রকম বশীভূত হওয়ার শৈল্পিক পরিণাম ‘পানকৌড়ির রক্তে’র সঙ্গে ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’-এর পার্থক্য থেকেই কি আমরা বুঝতে পারি না? আমরাএ-ও কি বলতে পারি না যে নিজের ধরনে আপনি গভীরতর জীবনার্থের দিকে গিয়েছেন বটে। কিন্তু ‘জলবেশ্যা’র মতো স্মরণীয় সৃষ্টি আর দেখা দিচ্ছে না। ‘উপমহাদেশ’ কিংবা ‘ডাহুকী’ লিখছেন বটে ‘বুনো বৃষ্টির প্ররোচনা’র মতো অদ্ভুত কিছু আর পাই না তো? একদিন টলস্টয়ের মতো বলে বসবেন না তো আমার পূর্বেকার সকল লেখা খারাপ- আদর্শ আক্রান্ত কিছু রচনা উৎকৃষ্ট?
মাহমুদ : আপনার এই কথাগুলোর ভেতর অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে। আপনারা জানেন কিনা জানি না, সৃজনশীল লেখকদের সব প্রশ্নের জবাব দিতে নেই। কারণ সৃজনকর্মের তন্ময়তায় লেখক বা কবিগণ এমন অনেক দুর্লভ মুহূর্তের আবেগ উত্তেজনা উদ্দীপনা এবং উদ্ভাবনার সম্মুখীন হন যা রচনাটি সমাপ্ত হওয়ার পর মুহূর্তেই আর থাকে না। প্রশ্নকারীরা যেমন সেখানে পৌঁছুতে পারেন না। তেমনি সৃজনশীল লেখক বা কবিটিও তার ধনুকের ছিলার মতো টান হয়ে থাকা মানুষটি আর থাকেন না। তিনি তখন জুড়িয়ে জল হয়ে থাকেন। যাহোক আমি মনে করি লেখকের কোনো একটি মহৎ আদর্শ থাকা উচিত। অন্তত আধ্যাত্মিক ধ্যানমগ্ন সমদৃষ্টি কিংবা কোনো বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পিত নিরপেক্ষতা। অবিশ্বাসী হলেই যে কেউ কবি বা লেখক হতে পারেন না এমন নয়। তবে আমার মতো আবেগপ্রবণ অস্রুসজল লোকদের একটা কিছু অদৃশ্য হাতল না হলে চলে না। সকলের ধাত তো আবার একরকম হয় না। আপনি আমার দু’টি গল্পের শৈল্পিক পরিণামের দৃষ্টান্ত তুলেছেন। হ্যাঁ আমি মানি ‘পানকৌড়িররক্ত’ এর সাথে ‘সৌরভেরকাছেপরাজিত’ গল্পটি একই লেখকের লেখা বলে মানতে একটু খটকা লাগারই কথা। তবে আপনাকে এ জিনিসটাও ভেবে দেখতে হবে যে পানকৌড়িররক্তে প্রকৃতি, প্রেম এবং নিসর্গের বর্ণাঢ্য বিন্যাসের মধ্যে আমি নিষ্ঠুরতারও একটা নিয়মের কথা বলতে দ্বিধা করিনি। সর্বোপরি একটি পাখির হত্যাকাণ্ডের রক্তে গল্পটিকে ভাসিয়ে দিয়ে শেষ করতে হয়েছে। এখানে কেবল কবিত্বের আদর্শকেই আমি সাধ্যমত কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ‘সৌরভের কাছে’ গল্পটি স্থাপন করেছি দৈনন্দিন কিংবা নিকট-অতীতের একটি সাংবাদিক বিশ্লেষণের উপর। এখানেও সন্ত্রাসীরা বা হত্যাকারীদের বয়েসটা বিবেচনায় রাখতে হবে। যেন জনৈক যাত্রীকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে তার পুত্রতুল্য বালকের পিতার শিশ্নটি নিয়ে খেলছে। ডাকাতেরা বলছে তাদের সমাজবাদী আদর্শ আছে। কিন্তু একটা আতরের শিশির লোভ ওরা ছাড়তে পারে না। অর্থাৎ মানবিক মূল্যবোধগুলো তখন পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়নি।
এখন আপনার কাছে যদি মনে হয় ‘পানকৌড়ির রক্ত’ আমার খুব সার্থক রচনা, তাহলে আপনাকে আমি হলপ করে বলতে পারি ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’ গল্পটি পড়েও আমার অনেক পাঠক আছেন যারা আমাকে প্রশংসা করে থাকেন। আমি লেখক হিসেবে এর মাঝামাঝি অবস্থান করতে চাই। আর জলবেশ্যার কথা আপনি ঠিকই বলেছেন। ঐ ধরনের অভিজ্ঞতা আসলেই আমার ঝুলিতে খুব বেশি নেই। নিজের যৌবনের রচনায় বাড়তি বাহুল্য অস্বীকার করার মতো প্রজ্ঞায় পৌঁছুতে পারলে অস্বীকারটা খুব দোষনীয় নয়। আমি এখনও তেমন অবস্থায় পৌঁছিনি।
আইয়ুব : মাহমুদুল হক আপনার প্রিয় লেখকদের একজন। মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ আমাদেরও প্রিয় উপন্যাস; কিন্তু একারণে নয় যে, তা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস- এজন্যে যে তাতে ফ্রয়েডীয় লিবিডো-তাত্ত্বিক অন্বেষাকে খোকা ও নীলা ভাবীর নানা আচরণের মধ্য দিয়ে শিল্পিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এটাকে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস বলা যাবে কিনা; প্রশ্নটা একারণে যে, ‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস’ হিসেবেই একে উল্লেখ করা হয়।
মাহমুদ : মাহমুদুল হক আমার প্রিয় লেখক। তবে ‘জীবন আমার বোন’ আমার প্রিয় উপন্যাস নয়। এটি একটি মানবিক সম্পর্কসূত্রের বিশ্লেষণাত্মক রচনা যা একটি গল্পেই তার মতো কুশলী কথাশিল্পীর লেখা সম্ভব ছিল। এটা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস কিনা তা আমার মাথায় আসেনি।
আইয়ুব : পঞ্চাশের গল্পকারদের বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি? একেবারেই আড়ালে পড়ে যাওয়া ‘দূর-দুরান্ত’ ‘বিশাল ক্রোধ’ ‘মুণ্ডহীন মহারাজ’ প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? সৈয়দ শামসুল হক? এমন কি জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত- তাঁর আগের লেখা কেমন লাগত। সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ ‘উড়িয়ে নিয়ে যা কালমেঘ’-এর কথা না হয় থাক। আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্পও তো আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন- তাঁর গল্পের কোন দিকটা আপনাকে আকৃষ্ট করে?
মাহমুদ : অসাধারণ লেখক তারা। আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়িদ আতীহকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর পঞ্চাশ দশকের এই পাঁচজনই কবি ও কথাশিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হলে আমি মফস্বল থেকে এদের মধ্যে একটা নব্য গূঢ়ার্থব্যঞ্জক গদ্যভাষার স্বাদ পেয়ে অভিভূত হয়ে যাই। পরবর্তীকালে শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জ্যোতিপ্রকাশরা এসে গভীর অভিনিবেশ সহকারে সৃজনশীল গদ্যভাষায় গল্প-উপন্যাস রচনা শুরু করেন। এঁদের মৌলিকতা ও কৃতিত্বেই বাংলাদেশের কথাশিল্পের যুগসন্ধি অতিক্রান্ত হয়েছে। শেষের দিকে এসেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ গল্পের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও একদেশদর্শিতাকে অস্বীকার করে। আমাদের সৃজনশীল কথাশিল্পীদের মোটামুটি এই হলো তালিকা।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের যে রচনার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে সেটা একটি কবিতা। তিনি প্রথম যেভাবে তার সমসাময়িকদের দ্বারা উত্থাপিত হয়েছিলেন তাতে আমার ধারণা হয়েছিল তিনি কবি। পরে তাঁর প্রতিভাদীপ্ত গল্পগুলোর সাথে পরিচয় ঘটে। এখন তাঁর চিত্রকলা বিষয়ক ও আমার স্পর্শযোগ্য সব রচনারই আমি মুগ্ধ পাঠক। নিজেকে এভাবে ছড়িয়ে না ফেললে আমি তাকে একজন আধুনিক কথাশিল্পী হিসেবে চিন্তা করতে আরাম পেতাম। সৈয়দ শামসুল হক আমার কাছে অতিশয় অন্তরদৃষ্টিসম্পন্ন গল্পকার। আর জ্যোতিপ্রকাশের সম্বন্ধে আমার ধারণা আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর জটিলতা শেষ পর্যন্ত লেখককে দুস্প্রবেশ্য দূরত্বে ঠেলে দ্যায়। তাছাড়া অনধিগম্যতা যেখানে আধুনিক দার্শনিকগণও পরিহার্য ভাবছেন সেখানে একজন দ্রষ্টা লেখক কেন তা গায়ে পড়ে কাঁধে তুলে নেবেন? সমকালীন বিশ্বের আধুনিক গল্পকারগণ যেমন জার্মান ভাষার পিটার বিকসেল কিংবা আর্জেন্টিনীয় বোর্হেস এবং ল্যাটিন আমেরিকার সাম্প্রতিক লেখকগণ যেখানে কল্পকথা কিংবা জাদু বাস্তবতার সহজ বিস্ময়বিমুগ্ধতাকে কথাসাহিত্যের উপজীব্য করে তুলেছেন, সেখানে দার্শনিক জটিলতাকে আগ বাড়িয়ে সাহিত্যে ঢোকানোর প্রয়াস সমর্থনযোগ্য বলে আমি মনে করি না। অবশ্য আমার মনে করাতে কী-ই বা এসে যায়? তবে একথা আমি সত্য বলে এতদিন মেনে এসেছি, সাহিত্যে দার্শনিকতাকে একবার ঢুকতে দিলে সে লেখকের প্রজনন ক্ষমতাকে (সাহিত্যিক অর্থে) খোজা বানিয়ে রাখে। অপরিতৃপ্ত, স্বল্পপ্রজ কথাশিল্পীর যুগ এটা নয়। কথাশিল্পীকে অন্তত গোটা বিশেক বই লিখে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি একজন লেখক। না, আলবেয়ার কাম্যুর কথা এখানে তুলবেন না। মনে রাখতে হবে আপতিক দুর্ঘটনার কাহিনী রচনায় তিনি আনন্দ পেতেন বেশি। আর ঐ মহান কথাশিল্পীরও অকাল মৃত্যু হয়েছিল দুর্ঘটনায়।
আইয়ুব : গল্প নিয়ে তো অনেক অনেক কথা বলেছেন- কারো মতে এ্যানালাইসিস অফ এ সিটিয়ুশন কারো ধারায় ইউনিট অফ ইমপ্রেশন- কারো মনে একটা ইনফরমিং আইডিয়া-র বিকাশ; আপনার কি মনে হয়? আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ যে মহানন্দে বললেন- এবং আমাদের অধ্যাপকেরা অবিরাম উদ্ধৃত করে গেলেন- ‘নিতান্ত সহজ সরল ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা-ছোটো ছোটো দুঃখকথার অতৃপ্তিমূলক পরিণামের রূপায়নই ‘ছোটোগল্প’; আজকের দিনে এই ধারণার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু? তিনি আরো বলেছেন ‘তত্ত্ব’ থাকবে না গল্পে; কিন্তু ‘তত্ত্ব’ কি আমাদের জীবনের অংশ হয়ে যায়নি?
মাহমুদ : ছোটো গল্পের এসব সংজ্ঞায় সত্য ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে আছে হয়তো। সাহিত্যের ছাত্রদের এতে খানিকটা উপকার হয়। তাহলে আমিই বা একটা সংজ্ঞা দেব না কেন? আমি ছোটোগল্পকে মনে করি পচে যাওয়া মানবজাতির জীবন রসায়নের বুদ্বুদ। রবীন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন একজন অতিশয় বড় মানুষ। সম্ভবত এই বড়ত্বের জন্য শাদা দাড়িঅলা আলখেল্লা-পরা বিশাল লোকটার সংকোচের সীমা ছিল না। সবকিছুকেই সহজ সরল আর ছোটো দেখতে তার ভাল লাগত। তার কথাকে উল্টে দিলেই একালের গল্পের সংজ্ঞা বেরিয়ে আসে।যেমন ছোটো প্রাণের বদলে বিশাল প্রাণের ছোটো কাহিনী। ছোটো ব্যথার বদলে বিপুল ব্যথার কিঞ্চিত বিবরণ। আর অফুরন্ত দুঃখকথার অতৃপ্ত বর্ণনা ইত্যাদি। ছোটোগল্পের কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকতেই হবে এটা সঠিক বলে ভাবি না। বরং অপ্রাসঙ্গিক আকস্মিকতার বর্ণনাই ছোটোগল্প। তবে ‘তত্ত্ব’ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন তা একেবারে মোক্ষম। না, কোনো তত্ত্বই মানবজীবনের অংশ হয়ে টিকে থাকেনি।
আইয়ুব : মুক্তিযুদ্ধের মতো ইতিহাসের একটা নির্ণায়ক ঘটনা, আমাদের কথাসাহিত্যে কতটা যথাযথভাবে রূপায়িত হয়েছে?
মাহমুদ : হয়নি। আমাদের দেশের প্রধান লেখক ও কবিগণ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেননি। আমাদের বামপন্থী প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী এবং কবি সাহিত্যিকগণ সেকালে আওয়ামী লীগ এবং এর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে মূর্খ বলে গালি দিতেন। তারা ছ’ দফার বিরোধী ছিলেন। ২৫শে মার্চের রাতে পাকবাহিনীর গোলাগুলির আওয়াজে ভীত হয়ে পরদিন ভোরবেলায় স্ব স্ব গ্রামে স্বপরিবারে পালিয়ে যান। লুকিয়ে ন’মাস কাটিয়ে আবার ঢাকায় সাবেক জীবনে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামক তত্ত্ব, ‘বন্দীশিবির থেকে’ জাতীয় কাব্যগ্রন্থ উপহার দেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংকলন করেন একজন অমুক্তিযোদ্ধা কবি। যে সৈনিক ব্যক্তি ন’মাস জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ঢাকায় ফিরে এসে তিনি যেহেতু ভারতীয় বাহিনীর বেপরোয়া লুটপাটে বাধাদান করতে উদ্যত হয়েছিলেন, কিংবা নিজেকে একজন মুসলিম হিসেবে উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-অলারা তার নাম দেন রাজাকার। তবুও দেশবাসী তাদের হৃদয়ে তাঁর নাম সোনার হরফে লিখে রেখেছে। তিনি মেজর জলিল। আমি আগেই বলেছি এদেশের প্রধান লেখকগণের প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। হাতে গোনা যে দু’-একজন কবি মুক্তিযুদ্ধে সামিল হতে ঢাকা ছেড়ে শেষপর্যন্ত কলকাতায় গিয়ে পৌঁছেন এবং যুদ্ধের প্রোপাগান্ডায় সাধ্যমত অবদান রাখেন তাদের একজন আমি নিজে। স্বধর্ম এবং স্বদেশের সার্বভৌমত্বে আস্থা উঠে যায়নি বলে আমাকে আখ্যায়িত করা হয় মৌলবাদী বলে। এ পরিবেশে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কালজয়ী রচনা কার হাত থেকে বেরুবে বলে আশা করেন? মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রধান শত্রু ছিল পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনী। আমরা আমাদের প্রধান পোশাক বা পরিধানের নাম রেখেছি পাঞ্জাবী। এখন আসুন লম্বা পাঞ্জাবী পড়ে রবীন্দ্রসংগীত গাই। এই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
আইয়ুব : জীবনানন্দের গল্প আপনার কেমন লাগে? উপন্যাস? তাঁর কথাসাহিত্যকে কি কেবলমাত্র তাঁর কাব্যভাবনার পরিপূরক বলা যাবে? জীবনানন্দের মধ্যে কবি ও কথাশিল্পীর এক স্বাভাবিক সহাবস্থান, অরুণ মিত্রের মতো, আমরাও লক্ষ্য করি। এতদিন পর জীবনানন্দকে সব্যসাচী লেখক বলেই তো মনে হয়। জীবনানন্দের কথকতায় আড়ম্বর, জাঁকজমক, ঘটনার জুলুস ইত্যাদি নেই- জীবনের পীড়া তিনি যেন জীবনযাপনের অভ্যন্তরে নির্ণয় করতে চেয়েছেন; মর্ষকামও পাব- যেমন ‘মাল্যবান’। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন : ‘তাঁর গদ্যের প্রায় সর্বত্রই জীবনানন্দ দেখাল সেই মানুষের ছবি, প্রকৃতির থেকে ছিন্ন হয়ে যে মানুষ যন্ত্রসভ্যতার এক যক্ষপুরীতে এসে দাঁড়িয়েছে, যে মানুষ তার পরিবেশ থেকে কেবলই বিযুক্ত দেখে নিজেকে। যে-যোগ তার হতে পারতো, আর যে বিয়োগের মধ্যে সে আছে, জীবনানন্দের নায়কেরা কেবলই তার ভিন্ন দুই রণন জাগিয়ে তোলে তাদের ভাবনার ব্যবহৃত প্রতিমায়।’ সে যাই হোক এই মহাকবির গদ্যলেখা বিষয়ে আপনি কি বলেন?
মাহমুদ : এই যে আপনি এক রকম অযাচিতভাবেই জীবনানন্দকে মহাকবি বলে সম্বোধন করলেন এটা কি কেবল তার কবিতার জন্যই? তাহলে কোন সাহসে? নিশ্চয়ই তার গদ্যপদ্য মিলিয়ে যে একটা ধূসর প্রাণপ্রকৃতি মথিত মানবরহস্যের সৃষ্টি হয়েছে সে কথা মনে রেখেই। আমি তার গদ্যপদ্যের ভেদরেখটি কোথায় তা এখনও ধরতে চেষ্টা করছি। জীবনানন্দের এই বিপুল গদ্যরচনার খবর আমার প্রায় অজানাই ছিল। প্রথম যিনি আমাকে এ ব্যাপারে সন্ধান দেন তিনি তাঁরই কন্যা মঞ্জুশ্রী দাশ। তাঁর কন্যা বলেই আমার ধারণা হয়েছিল তিনি একটু বাড়িয়ে বলছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের অল্পকাল পরে মঞ্জুর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলে আমি এই মহাকবি সম্বন্ধে অনেক কথা জানতে পারি। আমি ও কবিকন্যা কলকাতা শহরে অনেক সকাল সন্ধ্যা একাকী ঘুরে বেড়াবার সুযোগে তাঁর রচনারহস্য নিয়ে কথা চালাচালি করি। আমি চাই কেবল কবিতা সম্বন্ধে জানতে। কিন্তু মঞ্জু আমাকে সজাগ করতে চান তাঁর গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত উপন্যাস ও গল্পগুলো সম্বন্ধে। মঞ্জুর কেন যেন আমার সাথে পরিচয়ের পূর্বেই, কেবল আমার কয়েকটি কবিতা পাঠের সুরঙ্গ ধরেই এই আস্থা দৃঢ় হয় যে আমি এ্যাকাডেমিক সমালোচনায় জর্জরিত তার মহৎপ্রাণ পিতার প্রতি সুবিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক শক্তি। পরবর্তীকালে আমি যখন ‘গণকন্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদনা করছি হঠাৎ মঞ্জু ঢাকায় আমার অফিসে এসে আমাকে জানান যে তিনি আমাকে ‘জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করতে ঢাকায় এসেছেন। এবারও তিনি আমাকে তাঁর পিতার গল্প উপন্যাসগুলো পড়ার ইঙ্গিত দিয়ে যান। এবং চিঠিতে আমার সাথে যোগাযোগ রেখে চলেন। এর দীর্ঘকাল পর জীবনানন্দের গ্রন্থাকারে প্রকাশিত রচনার একটি প্যাকেট অন্য এক কবি মহিলা আমার প্রতি অনুগ্রহ করে নিজ খরচায় পাঠিয়ে দিলে আমি একেবারে নির্বাক হয়ে যাই এবং আমার পূর্ব অভেলার পাপমোচনের জন্য সাধ্যমত প্রায়শ্চিত্যে নিয়োজিত হই। এখন আমি গদ্যের আধারে লুকানো এক মহাকাব্যের সম্মুখীন। কয়েকদিন আগেও আমি মহাকবি জীবনানন্দের রচিত জলপাইহাটি ইত্যাদি রচনার পরিবেশ সন্ধানের আশায় তাঁর এককালের বাসগৃহটি পরিদর্শনের জন্য বরিশাল গিয়েছিলাম। তাঁর পদ্যের আধেয় বা উপাদানসমূহ উপলব্ধির জন্য আমার খানিকটা নিরবিচ্ছিন্ন অবকাশ দরকার। যাঁর গদ্য রচনার পরিধি দেখে আমি আমার জন্য সাহস-সঞ্চয়ে প্রয়াসী তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার বিষয়ে মন্তব্য করতে একটু সময়ের দরকার বৈকি। যখন আপনার মতো আমিও স্বীকার করে নিচ্ছি তিনি এক মহাকবি।
আইয়ুব : ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ যাকে ‘ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা’ বা ‘যাদু বাস্তবতা’ বলা হচ্ছে- লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে যার ব্যাপক প্রভাবশালী প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে, সে সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
মাহমুদ : এটা হল চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও রেজি দেব্রের আরণ্যক মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী কমিটেড রিয়ালিজমের সর্বশেষ স্বাভাবিক পরিণতি। এখন এরা ভূত-প্রেতে বিশ্বাসী। আরব্যরজনীর লেখকেরা জিন এবং দৈত্যদানোয় মানুষকে বিশ্বাসী করে তোলার চেষ্টায় দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন। ইসলামী ন্যায়নিষ্ঠ খেলাফত অর্থাৎ ধর্মীয় কল্যাণরাষ্ট্রের পতনের পর যখন রাজতন্ত্র চেপে বসল তখন মানুষ উমাইয়া এবং আব্বাসীয় ডাইনেস্টির হাত থেকে মুক্তির প্রত্যক্ষ কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই দেখে দৈত্যাকার জিনদের ডেকে এনেছিল। বাগদাদের হতদরিদ্র দর্জি, গরিব দোকানদার, উটের রাখাল, তামাকাঁসার কারিগর, কামার-কুমার-দিন মজুরেরা মুক্তির স্বপ্ন দেখত এইভাবে যে একটা বিশালকায় জিন এসে একদিন এদের অবস্থা পরিবর্তন করে দেবে। জেলের জালে মুখবন্ধ কলসি উঠে আসে। মুখ খুলতেই ধোঁয়া। তারপর এক বিশাল জিন বলছে, বলুন হজুর কি করতে হবে? আপনার গোলাম আমি, রাতকে দিন করে দিতে পারি। হতভাগ্য জেলে বা জেলেনী কিন্তু কিছু টাকাকড়ি, সুখাদ্য, বড়জোর এক বা একাধিক দালানকোঠার বেশি কিছু চাইতে পারে না। বলতে পারে না হারুন আল রশীদ অত্যাচারী বাদশা। তার বাদশাহী চুরমার করে দিয়ে সমদৃষ্টি ও সমবণ্টনের ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র বানিয়ে দাও। এখনকার ল্যাটিন আমেরিকার যাদু বাস্তবতাও একই জিনিসের সমকালীন দুঃস্বপ্ন মাত্র। সোভিয়েট রাশিয়ার কম্যুনিস্টদের মানবতাবিরোধী রাষ্ট্রযন্ত্রের পতন এবং চিনের সমাজতান্ত্রিক অচল অর্থব্যবস্থার উচ্ছেদকান্ডের পর সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির আধিপত্যকে কিংবা বাজার অর্থনীতির নামে সুদভিত্তিক শোষণ ব্যবস্থার উচ্ছেদ অসম্ভব ভেবে মার্কসবাদী সৃজনশীল লেখকদের কল্পরাজ্যে উড়াল দেয়ার নাম হল জাদু বাস্তবতা। মধ্যেযুগের আরব্যরজনীতে যেমন ছিল যৌনতার ছড়াছড়ি। তেমনি এখনকার ম্যাজিক রিয়ালিটির প্রাণ ভোমরা হল যৌনতার অবাধ বর্ণনা। বেমিল যেটুকু আছে তা হল দেশ, কাল এবং পোশাক-আশাকের। বাজার অর্থনীতি বা সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি উচ্চারণের ক্ষমতা নেই ঐ সব ভূতপ্রেতে বিশ্বাসী খ্রীষ্টবিরোধী মার্কসবাদী প্রগতিশীল কাব্যকার এবং গল্পবাজদের। একেই বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
উমাইয়া এবং আব্বাসীয় রাজতন্ত্রের স্বর্গরাজ্যের শোষণ-বঞ্চনার রাজধানী বাগদাদ ধ্বংসের জন্য জিনদের বদলে নেমে এসেছিল আল্লাহর গজব রূপে আখ্যায়িত মধ্য এশিয়ার বন্য রাখালের স্রোত নিয়ে হালাকু খান। মনে হচ্ছে বাজার অর্থনীতি অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির শোষণকে মিটিয়ে দিতে একদিন না একদিন শুরু হবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পারমাণবিক বিনাশযজ্ঞের পরও পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে। মানুষ থাকলে নতুন আধ্যাত্মিক বিশ্ববিধানই তারা গ্রহন করবে। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির রয়ে-সয়ে শোষণের প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বিশ্বব্যবস্থা নয়। নয় তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের নব্য গণতান্ত্রিক ফর্মুলাও। বরং নতুন এক আধ্যাত্মিক বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে আধুনিক সৃজনশীল লেখকগণ এগিয়ে আসছেন।
আইয়ুব : নতুন গদ্য কি লিখছেন এখন? নতুন কোনো বই? কোনো পরিকল্পনা?
মাহমুদ : আমি একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখে যাচ্ছি। জানুয়ারীতে ‘কবি কোলাহল’ নামক একটি ক্ষুদ্র উপন্যাস বেরুবে। ফেব্রুয়ারী ’৯৩এ ‘উপমহাদেশ’ বের করছে শিল্পতরু। তিরান্নবুই সনের মার্চে নতুন কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সম্ভবত শেষ করতে পারব। বইটির নাম রাখতে চাই ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’। আর পরিকল্পনা, আমার মাথায় আছে একটা কাব্যনাট্য, টুকরো কবিতার একটি সচিত্র পাণ্ডুলিপি- যার চিত্রকল্পগুলো সাধ্যমত এঁকে দিতে সুলতান ভাই (এস এম সুলতান) অনুগ্রহ করে রাজি হয়েছেন। তারপর ভ্রমণ তো আছেই। সারা বছর দেশের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবার বাসনা রাখি।
আইয়ুব : এতক্ষণ গল্পকার আল মাহমুদকে প্রশ্ন করেছিলাম, এবার কবি হিসেবে আপনার কাছে একটা জিজ্ঞাসা আছে। সম্প্রতি ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় লেখকদেরকে সমকালীন কবিতার দুর্গতি-দুর্দশা বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। তারই অনুসরণে আপনাকেও যদি প্রশ্ন কড়ি আমাদের সাম্প্রতিক কাব্যচর্চার দুর্গতির কারণটা কি?
মাহমুদ :এ প্রশ্নের জবাব দেয়া আমার জন্যে একটু বিব্রতকর। কারণ আমি নিজেই কবিতা লেখার প্রয়াসী। শুধু কবিতা লেখার জন্যই আজকাল পাশ্চাত্যের কবিগণ একটা মূল্যবান মানবজীবন ব্যয় করে ফেলতে রাজি নন। আমিও নই। আমি মনে করি এসময়টা কবিদের আধুনিক জীবনের সৌন্দর্য ধারণার সর্ববিষয়ে হস্তক্ষেপ করে কিংবা নাক গলিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের যুগ। কথাটা খোলাসা করে বললে এভাবেও বলা যায়, এ সময়টা কবিদের মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার সর্বপ্রকার বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত কলাকৌশল সম্বন্ধে পূর্ণভাবে অবহিত হয়ে কবিতা লেখার যুগ। আর সেই অর্থে একই সাথে এটা কবিদেরই গদ্য লেখারও যুগ।
আমাদের দেশে আধুনিক কবিতা দুর্দশাগ্রস্থ হয়েছে এটা বলা বোধহয় ঠিক নয়। বাংলাদেশের সমকালীন কাব্যচর্চাকে দুর্দশাগ্রস্থ না বলে বলা উচিত দুর্গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। এর জন্য প্রধানত দায়ী পঞ্চাশ দশকের দু’-একজন ফুরিয়ে যাওয়া কবির খ্যাতির লড়াই। কবিরা কখনো কাউকে কবিদের রাজা বলে মেনে নেয় না। কিন্তু বাংলাদেশে কয়েকজন প্রতিভাহীন ব্যক্তি কবি খেতাব লাভের আশায় তথাকথিত প্রগতিপন্থী রাজনৈতিক শক্তিমত্তার সহায়তায় জনৈক ফুরিয়ে-যাওয়া কবিকে ‘রাজা’ মনোনীত করে আমাদের আধুনিক কাব্যচর্চার গতিকে শিথিল এবং সম্পূর্ণ পশ্চাতমুখী করে দিয়েছেন। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের আধুনিক কবিতা পশ্চিমবঙ্গের তথা কলকাতার সমসাময়িক তরুণ কবিদের অচিন্তনীয় বিষয় ছিল এবং দেশের মাটির সৌরভমিশ্রিত এক নতুন ধারার কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করে কবিতা হয়ে উঠেছিল ঢাকাকেন্দ্রিক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে তরতাজা কেন্দ্রভূমি। সেই কেন্দ্রভূমির প্রাণ ছিল রোমান্টিক শিহরন এবং তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। দুঃখের বিষয়, রোমান্টিকতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের আখড়ায় বেশ কিছুকাল যাবৎ একজন ‘কবিদের রাজা’ প্রবেশ করে কবিদের দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছেন। সমকালীন কবিতার দুর্গতির কারণ ঐ ‘কবিদের রাজা’ ব্যক্তিটি। যতদিন পর্যন্ত তরুণ কবিত্বশক্তি মহারাজটির অন্তঃসারশুন্যতা উপলব্ধি করে আধুনিক সাহিত্যের আন্তর্জাতিক চরিত্র অনুধাবন না করবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের আধুনিক কবিতা হবে সাব-স্ট্যান্ডার্ড সাহিত্য। দেশ ও আনন্দবাজারীয় আবহাওয়ার অনুকরণ মাত্র।
আমি আগেই বলেছি, কবিদের কোনো রাজা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশের তথাকথিত প্রগতিপন্থীদের সাহিত্যক্ষেত্রে একজন ‘বড় কবির’ খুবই প্রয়োজন ছিল। তিনি যে ‘বড় কবি’ এতে আমারও ইতিমধ্যে সন্দেহ ঘুচেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে তিনি আধুনিক কবি কিনা এ ব্যাপারে আমি দ্বিধান্বিত। এই দ্বিধাই আমার নিজের অবারিত কাব্যচর্চায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এই সন্দেহ বা দ্বিধাই আমার কাল হয়েছে।
আমি এমনিতে কম লিখি। দিনরাত কবিতা নিয়ে পড়ে থাকা আমার হয় না। আমি সিনেমা-ভিডিও ফিল্ম দেখতে পছন্দ করি, দর্শন ও সৌন্দর্যতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করি, আধ্যাত্মিক সাহিত্য ও প্রাচীন কাব্যের আমি মুগ্ধ পাঠক, তদুপরি আলসেমীতে আমি অভ্যস্ত। এ জন্য আমার লেখালেখিটাও অনিয়মিত। কবিতার ব্যাপারে তো আরও কৃপণ। এর পরেও বছরে পাঁচ ছ’টি কবিতা আমি ছাপতে দিতাম। টিভিতে এবং রেডিওতে পড়তে আমাকে মাঝেমধ্যে আহ্বান করা হয়। ব্যস, এইটুকুতেই আমি তৃপ্ত থাকতাম। সম্প্রতি কবিতার রাজনৈতিক ‘রাজা মহাশয়’ আমি যেসব পত্রিকায় লিখতাম সেসব পত্রপত্রিকার সম্পাদক ও মালিকপক্ষকে হুমকি দিয়েছেন তারা যদি আমার কবিতা ছাপেন তবে ‘তিনি’ এবং ‘তারা’ ঐ পত্রিকায় লিখবেন না। ঐ প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহন করবেন না। ফলে ইত্তেফাক পত্রিকার মালিকপক্ষ তাদের ম্যাগাজিন সম্পাদককে আমার রচনা প্রকাশ না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। টেলিভিশন আমাকে তাদের কোনো অনুষ্ঠানেই ডাকতে ভরসা পাচ্ছে না। মৌলিক সাহিত্যের ওপর কোনো ‘রাজার শাসন’ কায়েম হলে এতে আমার মতো কবির তেমন ক্ষতি হয় না বটে। কিন্তু তরুণতম কবিরা অগ্রজের উদ্ভাবন কৌশল সম্বন্ধে অজ্ঞই থেকে যায়। তারা নতুনত্বের রাস্তায় যেতে পারে না। কবিতা দুর্গতিপ্রাপ্ত হয়। আমাদের সাহিত্যের সেই রাজনৈতিক ‘রাজা’ ব্যক্তিটি বাংলাদেশের কাব্য-আন্দোলনকে সম্পূর্ণভাবে দ্বিধাবিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। দ্বিধাবিভক্ত কাব্য-আন্দোলন তরুণ কবি যশপ্রার্থীদেরদিশেহারা করতে বাধ্য। হয়েছেও তাই। তরুণতম কবিরা বুঝতে পারছেন না এদেশে কারা প্রকৃত কবিপ্রতিভা? রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দিকে ধাবমান কবিরা? না ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী রোমান্টিক ধারার কবিরা। ফলে আশির দশকে আধুনিক বাংলা কবিতার যে স্ট্যান্ডার্ড ঢাকায় এক ধরনের আঙ্গিক নির্মাণে সক্ষম হয়েছিল, ‘রাজা’ ব্যক্তিটির কলকাতা প্রীতি ও আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সাথে যোগসাজশের ফলে এখন ঢাকার তরুণতম কবিদের দিশেহারা দ্বিধাবিভক্তির সুযোগে তা আর স্থায়িত্ব লাভে সক্ষম হয়নি। এখনও রাজা ব্যক্তিটির ধারণা আধুনিক বাংলা কবিতার যা কিছু নতুন উদ্ভাবনা তা কলকাতার কবিরাই করছেন। দেশ পত্রিকায় যেসব পশ্চিমবঙ্গীয় তরুণ কবিরা লিখছেন সেটিই সমকালীন কবিতার স্ট্যান্ডার্ড। এদিকে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় আকস্মিকভাবে এখানকার তরুণতম কবিদের কবিতা ছাপা ধীরে ধীরে উঠে যেতে থাকে। বিচিত্রার মতো পত্রিকা কবিতা ছাপা বন্ধ করে দেয়।
শেষ পর্যন্ত ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যপত্রিকার সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এ অবস্থায় আমার ধারণা নতুন প্রতিভাবান কবিরা দেশ পত্রিকা কিংবা কলকাতার লিটলম্যাগাজিনে একটি দু’টি কবিতা ছাপিয়ে স্বীকৃতির জন্য প্রয়াসী হতে বাধ্য হন। কারণ ‘রাজা’ ব্যক্তিটি অনেক তরুণ কবিকে দলে টানতে সক্ষম হলেও কাউকেই স্বীকৃতি দিতে নারাজ। সারাজীবনই যার অন্য কবিপ্রতিভাকে অস্বীকার করে কেটে গেছে তাঁর পক্ষে প্রকৃত কবি তারুণ্যের তেজ সহ্য করা মুশকিল। প্রতিভাবান তরুণ কবিপ্রতিভার তো তার কোনো দরকার নেই। দরকার হল রাজা সেজে থাকার সহায়ক শক্তির। তিনি সেইসব শক্তিধরদেরই কবি অভিধায় ভূষিত করার কৌশল অবলম্বন করেছেন।
আমাদের কবিতার বর্তমান দ্বিধাবিভক্তির ও দুর্গতির জন্য মূলত দায়ী করা হয় ‘কবিতা কেন্দ্র’ নামক কবিদের একটি ক্লাব গড়ার স্বপ্নকে। সাংবাদিকদের যেমন প্রেস ক্লাব। তেমনি কবিদের জন্য আমরা একটি কেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম। এ ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়তে হলে সরকারি সহায়তা একান্ত দরকার। সেকারণে আমরা প্রেসিডেন্ট এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতা চেয়েছিলাম। কারণ তখন তিনি রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তাছাড়া সাহিত্যশিল্প সম্বন্ধে তার একটা মমত্ববোধ ছিল। আমরা কবিতাকেন্দ্রের লোকেরা, কারোরই রাজনীতির সাথে সম্পর্ক না-থাকায়, তার রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমরা ভাবতাম ‘এশীয় কবি সম্মেলন’ করতে হলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করা জরুরী। আমাদের দাবি এরশাদ মেনে নিয়েছিলেন আমরা সফলভাবে দু’দুটি এশীয় কবিতা উৎসব পালন করি। এতে বিশ্বের বর্তমান সময়ের কয়েকজন বিশ্বকবি, যেমন ইলহান বার্ক (তুর্কী), তাহেরা সফরজাদেহ (ইরান), প্রয়াত সদচিদানন্দ বাৎস্যায়ন (ভারত), পোজ ইয়াসিমাশু ও কাজুকো শিরাইশী (জাপান), কুগোলতিনভ (প্রাক্তন সোভিয়েট রাশিয়া) ঢাকায় এসে বাংলাদেশের কবিদের অতিথি হন। তাছাড়া ইরাক, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, পাকিস্তানের কবিরা তো নিজের রাহা খরচ নিজেই বহন করে দলে দলে এসে হাজির হয়ে ঢাকার সাহিত্য প্রয়াসকে সমর্থন জানাতে থাকেন। কলকাতা থেকে আসেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও প্রফেসর শিবনারায়ণ রায়। আর সবেচেয়ে অবিশ্বাস্যভাবে আমাদের সামান্য আমন্ত্রণে ব্রিটিশ পোয়েট লরিয়েট টেড হিউজ ঢাকার এশীয় কবিতা উৎসবে পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশ গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করেন। আমাদের সাহিত্য আন্দোলনের খ্যাতি এমন কি ল্যাটিন আমেরিকার তরুণ কবিদেরও দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। পরের এশীয় কবিতা উৎসবে আমন্ত্রণ পেলে তারাও অন্তত পর্যবেক্ষক কবি হিসেবে আসতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এভাবে বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র্য দেশের সাহিত্যের খ্যাতি একটু একটু করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ সাফল্যে ভীত হয়ে আমাদের শত্রুপক্ষ এ-উৎসবকে শেষ করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। আর ঐ ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দেন ঐ ‘রাজা’ ব্যক্তিটি। এভাবেই এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সুযোগ গ্রহণ করে এশীয় কবিতা উৎসবের সকল সদস্যকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। রেডিও টেলিভিশনে এদের ব্ল্যাক লিস্টেড করা হয়। এভাবে বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যের আন্দোলনকারী সকল কবিকেই একঘরে করে রাখার চেষ্টা অব্যাহত আছে। যদিও এতে প্রকৃত কবির কোনো ক্ষতি হয় না। তবুও অব্যবহিত পরবর্তী কবির দলে পূর্ববর্তীদের সম্বন্ধে এক ধরনের বিরূপতা সৃষ্টি হওয়ার ফলে সাহিত্যের অঙ্গনে শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছে। পারস্পরিক মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়েছে। এ ধরনের পরিবেশে আধুনিক সাহিত্যে এগোয় না। যুগান্তকারী প্রতিভা নিয়ে না জন্মালে কবিকে সনাক্ত করা যায় না। আমাদের কবিতার দুর্গতির আরো একটা প্রধান কারণ হলো কবিতার একাডেমিক আলোচনা-সমালোচনা। অধ্যাপকদের দ্বারা সমকালীন কাব্যের নিয়তি-নির্ধারণ হয় না। সারা পৃথিবীর আধুনিক কবি-তরুণগণ যখন কবিতাকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গণ্ডির বাইরে নিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, তখন আমাদের দেশের তরুণ কবিদের ধারণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের তথাকথিত কোনো কাব্য-সমালোচকের উদ্ভাবনহীন ফাঁপা প্রবন্ধের কোনো প্যারাগ্রাফে তাঁদের নামটি ছাপা হলেই বুঝি জীবন ধন্য হলো। এ ধারণা কবির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। কারণ আজকাল একটু পরীক্ষা করলেই দেখা যাবে, ঐসব প্রবন্ধ-রচয়িতারা এমন কি বাংলা কবিতার সাধারণ ছন্দজ্ঞানেরও অধিকারী নন। এদের হাত থেকে মুক্তির উপায় হলো সাহিত্য তথা কাব্যের খবরদারির আসন থেকে এদের বিদ্রুপ এবং উপেক্ষার অস্ত্রে ধরশায়ী করা। যেমন ‘সমারূঢ়’ কবিতাটি লিখে কবি জীবনানন্দ দাশের মতো নির্জন মানুষও হৃদয়ের তীব্র ঘৃণার বারুদ উৎক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কবির কোনো সমালোচক থাকবে না। থাকবে মুগ্ধ পাঠক ও গুণগ্রাহীরা। কেবল একজন কবিই অন্য কবিকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করবেন। কারণ কবিত্বশক্তি জন্মগত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা মানুশকে কবি করে না। ঘষামাজা করতে করতে একদিন কেউ কবি হয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে এর পরিণামে দৈনিক পত্রিকার ম্যাগাজিন এডিটরও কবি খেতাব আদায় করে দিব্যি সভাসমিতিতে বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছে। এ ধরনের ম্যাগাজিন সম্পাদকরাই তরুণ কবির কবিতা তার পাতায় ছেপে লেখককে সম্মানী দেয়ার বদলে উল্টো কবির কাছেই লেখা প্রকাশের জন্য বিনিময় চায়। এরাই আমাদের কাব্যের দুর্গতির প্রধান কারণ। এদের হাত থেকে কবিতাকে বাঁচাতে হলে নবীন-প্রবীণ সব কবিকেই বড় পত্রিকার মোহ ত্যাগ করতে হবে। আধুনিক কবির কোনো বন্ধু হয় না। অথচ তরুণ বয়েসে কবিদের মনে সমবয়স্কদের সাথে জোট বাঁধতে খুবই সাধ জাগে। এই ইচ্ছাকে তারা বন্ধুত্বের মর্যাদা দেন। প্রকৃতপক্ষে কিছুদিন পর কবিদের ব্যক্তিগত কৃতিত্বের স্বীকৃতি শুরু হলেই ঐ জোট বা বন্ধুত্ব ভেঙে যায়। এককালের সুহৃদ পরবর্তীকালে স্থায়ী বৈরিতে পরিণত হন। এজন্যই কবিকে অন্য কবির সাথে সখ্যতা পরিহার করে চলা সাহিত্যের স্বার্থে একান্ত জরুরি। একান্ত নৈঃসঙ্গের পরিবেশ নেই বলে ঢাকার তরুণ কবিকুল খেয়োখেয়িতে লিপ্ত। এটাও তরুণ কবির ব্যক্তিগত উদ্ভাবনশক্তিকে যূথচারীদের কোলাহলের কাছে অবদমিত রাখতে বাধ্য করে। এ ক্ষতি শেষপর্যন্ত অনেক প্রতিভাবান কবিই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যূথবদ্ধভাবে রাজনীতি, ছিনতাই বা অন্য কিছু চলতে পারে। কিন্তু কবি হবেন নিঃসঙ্গ। কবির অনুরাগী কিংবা অনুরাগিণী দু’-একজন থাকতে পারে। অবস্থা বিপাকে এক আধজন প্রেমিকাও। কিন্তু কবির সাথে অন্য কবির দিবসযামিনী সৌহার্দ্য রক্ষা কবিতা নির্মাণে দারুণ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এ ক্ষতি বা দুর্গতি এখন আমাদের তরুণ কবিদের নিয়তি। কবিকে হতে হয় তার সমকালের সবচেয়ে বিদ্বান বা বিদুষী। সর্ব বিষয়ে নাক গলাবার মতো পাণ্ডিত্যে ভরপুর। বহু দেশ ভ্রমণে অভিজ্ঞ এবং নিজের দেশের মানচিত্র, প্রকৃতি এবং দৈবদুর্বিপাকে অভ্যস্ত ব্যক্তি। স্বদেশের নিসর্গ নিয়ে, পশু, পাখি, নাও-নদী সম্বন্ধে পূর্ণ অভিজ্ঞ ব্যক্তিসত্তা। আমাদের অধিকাংশ কবির এ-গুণ নেই। তারা সমকালীন বিশ্বসাহিত্য সম্বন্ধে যেমন অজ্ঞ তেমনি নিজের দেশের একটি পূর্ণ চিত্রও তাদের সমগ্র জীবনে হৃদয়ে আভাসিত হয়না। মূর্খের কবিত্ব-শক্তি ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য। একারণেই দেখা যায় আজ যে তরুণ কবির একটি-দু’টি লাইন দেখে পাঠক চমকে যান। গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাকুলতায় অসংখ্য বাজে কবিতার মিছিলে তা হারিয়ে যায়। কবিকে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু ঢাকায় যে তরুণ মাত্র ২০টি পদ্য কোনোরকমে নামিয়েছে তারই বই একুশের মেলায় ঝিলিক মারতে থাকে। এ দুর্গতি ঠেকাবে কে?
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024