জীবনানন্দ দাশের ‘সমারূঢ়’ নিয়া
বাংলা-কবিতার সমালোচনা নিয়া যে নেগেটিভ একটা ধারণা এগজিস্ট করে (যেমন, কবিতার কোন ক্রিটিক হয় না, এইটা খালি ফিল করার জিনিস, হাবিজাবি…), সেই জায়গাটাতে এই কবিতার কন্ট্রিবিউশন আছে। ডিটেইলসে আমার পয়েন্টগুলা বলার আগে, আসেন কবিতাটা পড়ি।
সমারূঢ়
‘বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা –‘
বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর;
বুঝিলাম সে তো কবি নয় – সে যে আরূঢ় ভণিতা:
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ‘পর
ব’সে আছে সিংহাসনে – কবি নয় – অজর, অক্ষর
অধ্যাপক, দাঁত নেই – চোখে তার অক্ষম পিচুঁটি;
বেতন হাজার টাকা মাসে – আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
যদিও সে সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিলো – হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।
(পেইজ: ২০৬, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র – জীবনানন্দ দাশ, আবদুল মান্নান সৈয়দ সংকলিত ও সম্পাদিত, ১৯৯৪।)
জীবনানন্দ দাশ-এর সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের ৩নম্বর কবিতা এইটা। কবিতার বইটা পাবলিশড হয় অগ্রহায়ণ ১৩৫৫ (ইংরেজী ১৯৪৮সনে)। লেখার সময়: বাংলা ১৩৩৫-১৩৫০ (ইংরেজী ১৯২৮-১৯৫০)।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
‘সমারূঢ়’ শব্দটার ডিকশনারি মিনিং হইলো ‘সম্যক উপরে উপবিষ্ট; বিশেষভাবে অধিষ্ঠিত’। তার মানে উপরের পজিশন। ‘সমারূঢ়’ মানে তিনি, যিনি কিছুটা উপরে আছেন। উপরে কে আছেন? ধারণা করি, যারে বিভিন্ন সময় ‘ছায়াপিন্ড’ ‘আরূঢ় ভণিতা’ ‘অধ্যাপক’ হিসাবে উল্লেখ করছেন কবি, তিনি বা তারা-ই; তারা যে ‘কবি নয়’ এইটাও বলা আছে ২বার। ধরে নিতেছি, তারা ‘সমালোচক’, ‘ব’সে আছে সিংহাসনে’। এইগুলা ত আসলে এক ধরণের ক্রোধ কবি’র দিক থিকা; উনি সেই মানুষটার বর্ণনা দিতেছেন যে কিনা নিজেরে উপরে আছে বইলা ভাবতেছে, কিন্তু আসলে উপরে নাই। সে কবিতা লিখতে চাইতো, এখন পারে না, কবিতার সমালোচনা লিখতেছে খালি। কবিতা লিখতে পারলে সে আর কবিতার সমালোচনা লিখতো নাকি! তার মানে সে যদিও নিচে আছে, কিন্তু যেহেতু কবিতা নিয়া বলতে পারে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারে, কবির চে বেশি টাকা কামাইতে পারে, ভাবে যে সে উপরে আছে; কিন্তু সে ত কবিতা লিখতে পারে না, কবি-ই না সে, কবিতার সমালোচনা কেমনে করে! এই মিহি শ্লেষের টোনটা কবিতাতে আছে।
এই টোনটাই সমালোচনার একটা ধারা হিসাবে বাংলা-সাহিত্যে আছে এখনো। যে, একটু মকারি করলাম তারে নিয়া, যে আমার লেখার ক্রিটিক করলো, এতে কইরা তার ক্রিটিকের জবাব দেন দিতে পারলাম আমি! বা এইরকম মকারি করতে পারাটাই যেন ক্রিটিক করতে পারা।
……………………………………………………………………
আর্ট, ক্রিটিক এবং মকারি
এইরকম একটা টেনডেন্সি আছে যখন আমি কোনকিছুরে মকারি করতে পারলাম, তখন তার গুরুত্ব আর নাই! কোন টেক্সটরে চিন্তার দিক থিকা বা তার সাহিত্য-মূল্যরে জিরো কইরা দিতে পারলাম। যেমন ধরেন, শামসুর রাহমান-এর কবিতার বইয়ের নাম – আমি অনাহারী; কেউ একজন কইলেন খুলে ফ্যাল (বানানে ‘য-ফলা’ দিয়া উচ্চারণটারে ক্রিটিক্যাল বা ‘আঞ্চলিক’ করা লাগবে) তোর শাড়ি! আনিসুল হক তার উপন্যাসের নাম রাখলেন ভালোবাসো, বাঁচো; কেউ একজন কইলেন, ভালোবাসো, খেঁচো! দিস আর দ্য থিংকস।
মানে, শামসুর রাহমান বা আনিসুল হক খুব ভালো কবিতা উপন্যাস লিখেন বা ব্যাপারটা খুব পবিত্র কিছু, এইসব নিয়া হাসি-ঠাট্টা করা যাইবো না, সেইটা না; বরং একটা জিনিস যেই জায়গটাতে ‘বাজে’ সেইটা না বইলা খালি মকারি করা সম্ভব বইলাই যে তারে বাতিল কইরা দেয়া যায়, এইটাই ঘটনা। এইটা এমন একটা গ্রাউন্ডে অপারেট করে যেইখানে তাদের ‘বাজে’ ধরণটা এস্কেইপের জায়গাটাই খালি খুঁইজা পায় না, রিপিটেটলি করতেও থাকতে পারে, কারণ মকারিই ত এইগুলা, সমালোচনা তো আর না! আর যারা এই ধরণের মকারি করেন তারাও ব্যাখ্যা না করতে পারাটারে এইভাবে এড়াইতে পারেন যে, এইটা নিয়া তো কথা বলার কিছু নাই, রায় ঘোষণা করেন, বাতিল! আর যারা রিসিভার এন্ডে থাকেন, তারা আরেকটু বেশি কইরাই হাসতে পারেন এবং ভাবতে পারেন যেহেতু মকারি করা যায় সেই কারণেই এরা বাতিল। এখন যে এমনেই বাতিল, তারে নিয়া আর কী কথা! ক্রিটিক করার কি আছে!
এইটা মকারিই, কোন ক্রিটিক না। কিন্তু এই মকারি আসলে কোন কিছুরেই আসলে বাতিল করতে পারে না, একটা অথরিটিরে আরেক অথরিটি দিয়া রিপ্লেস করা ছাড়া। এই পদ্ধতিতে যেই সাহিত্য’রে আপনি বাতিল কইরা দিতে চান, সমালোচক হিসাবে আপনার কাজ হইলো তারে নিয়া মকারি করা। আর্টের মানে যেইরকম অস্পষ্টতা ক্রিয়েট করতে পারা, সমালোচনাও এইরকমই, পুরাটা বলার কি দরকার, আপনারে ঠারে ঠারে বুইঝা নিতে হবে, এই বুঝতে পারাটাই আর্ট এবং আর্ট-ক্রিটিক!
ইন ট্রু সেন্স, মকারি করতে পারাটাই আসলে সাহিত্য-সমালোচনা এখন, বাংলাদেশে। ব্যাপারটা কখনোই এইরকম না যে, মকারি করা যাইবো না; বরং মকারি করাটাই যখন সাহিত্য, তখন সাহিত্য সমালোচনা’তেও এইসবই থাকার কথা। অন্য আরেকভাবে দেখতে গেলে, এইটা বিষাদ-ভারাক্রান্ত সাহিত্য-রচনারই আরেকটা সাইড-অ্যাফেক্ট হওয়ার কথা।
/২০১৪
……………………………………………………………………
জীবনানন্দ কবিতা লিইখা প্রমাণ করতে পারছেন যে, যে কবিতা লিখতে জানে না, সে যদি সমালোচনা করে, সে ইনফিরিয়র একরকমের, কারণ সে যা করে তার সোশ্যাল ভ্যালু আছে, যার ফলে আর্টিস্টিক ভ্যালু নাই কোন।
এইখানে উনার মেইন প্রপোজিশন হইতেছে, উপরে-নিচে বইলা একটা ব্যাপার অ্যাজিউম করা; কেউ নিচে না থাকলে খালি খালি তো কেউ উপ্রে থাকতে পারে না। কিন্তু আমার কথা হইতেছে, কবি বা সমালোচক কেউ ইনফিরিয়র বা সুপিরিয়র হইতে পারে না, কারণ যদিও দুইজনের মাধ্যম একটাই, ভাষা; উদ্দেশ্যটা কোনভাবে একই না; এইটা উপর-নিচ হওয়ার কোন ব্যাপার না, দুইটা জাস্ট ডিফরেন্ট প্লাটফর্ম। মনে হইতে পারে যে, কবি এত কম কথা কইয়া এতকিছু বইলা ফেলতে পারেন আর সমালোচক এত বেশি কথা কয়াও তেমন কিছুই বলতে পারেন না, কবি তো ডেফিনেটলি বেটার; মানে উপর-নিচ এর কল্পনা নানানভাবেই পসিবল একটা অপশন! এখন এই উপর-নিচ এর অপশনরেই আমি নিতে রাজি না, কারণ ‘বলতে পারা’টা কোন দাড়িপাল্লা না, যেইটাতে কবিতা আর সমালোচনা’রে মাপতে পারি আমরা। এখন সমালোচকের কাজ কি সেইটা নিয়া তো আরো কথা হইতেই পারে।
……………………………………………………………………
সমালোচনা এবং সত্য
একজন ক্রিটিকের কি কাজ, সেইটা নিয়া রঁলা বার্থ একটা জিনিস লিখছিলেন ‘ক্রিটিসিজম অ্যান্ড ট্রুথ’ নামে, যেইটা ফরাসি ভাষায় ১৯৬৬ সালে বই হিসাবে ছাপা হইছিল, তারপর ইংরেজিতে অনুবাদ হয় ১৯৮৭ সালে এবং সাউথ এশিয়ান এডিশন ছাপা হয় ২০০৫ সালে।
১৯৬৫ সালে বার্থের সমালোচনা-পদ্ধতি নিয়া Raymond Picard একটা প্রবন্ধ লিখেন “নতুন সমালোচনা নাকি নতুন প্রতারণা”; যদিও ফরাসী সাহিত্যের ১৯৫০/৬০ এর দিকের “নতুন সমালোচনা” উনার আক্রমণের জায়গা ছিল, কিন্তু এই আন্দোলন এর মূল হোতা হিসাবে তিনি রঁলা বার্থরেই বাইছা নেন। রঁলা বার্থ ১৯৬৩ সালে “রেসিন (Jean_Racine ) বিষয়ে” নাম দিয়া ৩টা প্রবন্ধ লিখেন; যেইটার ভূমিকাতে তিনি বলেন যে, এইটাতে রেসিনের তৈরী-করা দুনিয়ার অ্যানালাইসিস তিনি করতেছেন, রেসিনের না। আর পিকার্ড ছিলেন একজন রেসিন বিশেষজ্ঞ।
এরপর ১৯৬৪ সালে বার্থ আরেকটা জিনিস ছাপান “সমালোচনামূলক প্রবন্ধ” নামে, যেইখানে “দুই ধরণের রিভিউ”তে তিনি দুই ধরণের সমালোচনার কথা বলেন, ইন্টারপ্রেটেটিভ (বা নতুন) এবং প্রথাগত বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমালোচনা। পার্থক্যের মূল জায়গা হিসাবে তিনি আইডেন্টিফাই করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমালোচনা সবসময় লেখার চারপাশের ঘটনারে সম্পৃত্ত করার চেষ্টা করে, যেইটা লেখক-চরিত্রের পজিটিভ সাইকোলজির উপর নির্ভর করে এবং অনুমানমূলক সাদৃশ্যের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা দাঁড় করায় (যেমন ধরেন, অন্য কোন সাহিত্যিক রচনা, ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা), কিন্তু কোনভাবেই লেখাটারে তার নিজস্ব ব্যাখ্যামূলক একটা কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে না।
আর পিকার্ড এই জায়গাটারেই ধরেন, তিনি অনুমানমূলক সাদৃশ্যের জায়গাটারে বরং একটা সমালোচনামূলক পদ্ধতি হিসাবে বর্ণনা করেন; বার্থ যেইখানে বলেন যে, সমালোচনা হইলো দুইটা সাবজেক্টিভ-এর প্রতিযোগিতার মধ্যে একটারে সিলেক্ট করার ব্যাপার, সেইখানে পিকার্ড এর মতামত হইলো যে, সাহিত্যিক সমালোচনার ক্ষেত্রে অবজেক্টিভ জ্ঞান বইলা একটা কিছু আছে। তিনি বার্থরে অস্পষ্ট ভাষা এবং আজাইরা বুলি ব্যবহার করার জন্যও দোষ দেন। বলেন, লেখালেখি লেখকের একটা সচেতন প্রয়াসেরই জায়গা।
এর উত্তরে বার্থ একটা প্রবন্ধ লিখেন; নাম দেন, “সমালোচনা এবং সত্য”, এইটাই সেই বই। তিনি পিকার্ডের অভিযোগগুলার উত্তর দেন এবং তর্কের বিষয়গুলারে আরো এক্সপান্ড করেন। বার্থ বলেন, আসলে সমালোচনা তো এক ধরণের ভ্যালু জাজমেন্ট, তো এইটা কেমনে নিরপেক্ষ হয়? পিকার্ড আসলে নিরপেক্ষতা আর সত্য এর মুখোশ পড়তে চান (যেইটা যে কোন বুর্জোয়া মতাদর্শই করে)।
সাহিত্যিক সমালোচনাতে কি ধরণের ভাষা ব্যবহার করা যায় বা উচিত, এই বিষয়ে তিনি ডিটেইল বর্ণনা দেন। পিকার্ড (এবং তাঁর সর্মথকেরা) জোর দিতেছিলেন যে, সমালোচকদের “স্পষ্ট ভাষা” ব্যবহার করা দরকার, যেইটা মোটামুটি পড়াশোনা জানা লোকেরা পড়তে এবং বুঝতে পারবে। আর অনেক আগে থিকাই বার্থের আর্গুমেন্টটা ছিল যে, চিন্তার ক্ষেত্রে ফরাসিতে যে ভাষা নিয়মিত ইউজ করা হয় সেইটা শ্রেণী-সর্ম্পকিত একটা বিষয়, সামাজিক এবং দার্শনিক ভঙ্গির একটা ব্যাপার। আর এইভাবে দেখতে গেলে ভাষা ব্যাপারটার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে নানান ইমপ্লিকেশনস আছে। আসলে ভাষার এই বির্তকটাও ফরাসি ভাষায় বহু পুরানা… গত শতকের শুরুর দিকের দিকের প্রায়… যা-ই হোক, এই বইটাতে বার্থ আসলে নানানভাবে প্রথাগত ফরাসী সাহিত্য-সমালোচনার ভাবাদর্শরেই আক্রমণ করেন এবং নিজের সমালোচনার একটা বর্ণনা দেন।
প্রবন্ধটা ২টা ভাগে লেখা। প্রথম ভাগে প্রথাগত সমালোচনারে ক্রিটিসাইজ করা; দ্বিতীয় ভাগে তাঁর নিজের সমালোচনা-পদ্ধতির কথা বলা। প্রথমেই তিনি ‘নতুন সমালোচনা’র প্রতি আক্রমণের কথা বলছেন; যারে (নতুন সমালোচনারে) বলা হইছে চিন্তা-শূন্য, কৃত্রিম, নৈতিকভাবে ভয়ংকর এবং স্নবিশ একটা ব্যাপার; বার্থের প্রথম প্রশ্ন—এদ্দিন পরে কেন? বার্থের কথায়, দেখার মতো ঘটনাটা হইলো, সবাই মিইলা এইরকম আক্রমণগুলা করা হইতেছে; যেন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়া উঠা একটা রোগ নিরাময়ের জন্য লড়াই চালায়া যাইতেছেন তাঁর সমালোচকরা।
নতুন সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, যেইটা আসলে তারা সহ্য করতে পারতেছেন না, সেইটা হইলো—ভাষা কি কইরা ভাষা নিয়া বলে; আবার বলেন, উনারা আসলে চান যে, ‘সমালোচনা’ আসলে পুলিশ-বাহিনীর মতোই নিয়ন্ত্রিত হইতে হইবো। নিয়ন্ত্রণের সমাজ আসলে চায় নিয়ন্ত্রিত সমালোচনা! এই সমালোচনা আসলে ‘নতুন’ না, বরং ‘সম্পূর্ণ’, যেইখানে লেখক এবং ভাষ্যকারের ভূমিকাগুলারে রিলোকেট করার মাধ্যমে ভাষার প্রচলিত ধারাটারে আক্রমণ করা হয়।
কিভাবে নতুন সমালোচনা ভয়ংকর হয়া উঠে? এর একটা মজার প্রসেস আছে:
অ-মত > বিচ্যুতি > ভুল > পাপ > অসুখ > পৈশাচিকতা (খুব একটা অপরিচিত না এই প্রক্রিয়া হয়তো অনেকের কাছে…)
আপাত সত্যই আসলে সুন্দর। আর ১৯৬৫ সালে ফরাসী দেশের আপাত-সত্যগুলা কি, তার একটা সামারী তিনি হাজির করেন। প্রথমেই আসে, নিরপেক্ষতা; মালটা আসলে কি? আদিকালে এইটা ছিল যুক্তি, ন্যাচারাল, সুস্বাদু ইত্যাদি; কিছুদিন আগ পর্যন্ত লেখকের জীবন, বিভিন্ন প্রকারের নিয়ম, ইতিহাস; আর বর্তমানে (মানে অই সময়ের ফরাসী দেশে) এইটা হইলো “সহজবোধ্য সত্য”; এইখানে তিনি নিরপেক্ষতার গঠন নিয়া প্রশ্ন তোলেন, ঐতিহাসিকতার প্রসঙ্গ আনেন এবং শব্দের একপাক্ষিকতা নিয়া তিনি বলেন। একপাক্ষিক নান্দনিকতা হইলো সেইটা, যেইটা জীবনরে নিরবতার এবং কাজরে অ-গুরুত্বপূর্ণতার ভিতর ফেলে দেয়।
এরপর তিনি ‘ভালো-মান’ এবং ‘স্পষ্টতা’র জায়গাটাতে আসেন। ভালো-মান এর কথা বইলা আসলে প্রথাগত সমালোচনা কোন জিনিসটারে আটকাইয়া দিতে চায়? যেইটা লেখা হইছে সেইটারেই। লেখাটা কি সেইটা না বা তার ধারণাগুলাও না, বরং তার প্যার্টানটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়া উঠে ভালো-মান বিবেচনার ক্ষেত্রে। ভালো-মান আসলে একটা ট্যাবু, কয়েক ধরণের ভাষা ব্যবহারের বিপক্ষে। এই “ন্যাচারাল” ব্যাপারটা আসলে একটা সময়ের, একটা শ্রেণীর তৈরী নিয়ম। এই যে স্পষ্টতা, এইটা আসলে এক ধরণের লেখকদের, সমালোচকদের দিয়া একটা সময়ের জন্যই তৈরী করা হইছিল। অন্য লোক যেইটা অন্য লোকের মতো কইরা বলে, সেইটা জার্গন, আমার কাছে, যেহেতু এইটা আমার/আমাদের মতোন না, এইটা মূল্যহীন, বেহুদা একটা জিনিস; আর স্পষ্টতা যদি সেইটা না হয়, আমার ভাষা’র আগে কিভাবে ‘আমি’ থাকি?
এই নিরপেক্ষতা, ভালো-মান আর স্পষ্টতা আসলে পুরানা মাল, ১৯৬৫-এর জিনিস না, রলাঁ বার্থ রায় দেন। আর বলেন, এই পুরান সমালোচনার ব্যর্থতা হইলো যে, এঁরা সিম্বলরে দেখতে পায় না, ব্যাখ্যা করতে পারে না। আর যেহেতু বুঝতে পারে না, তাঁরা একজন চাইনিজরে বকা-ঝকা করে যে, সে কেন ফরাসী ভুলগুলা করে, যখন সে চাইনিজ ভাষা বলে!
বার্থ বলতেছেন, লেখক এবং সমালোচক, একজন সৃষ্টিকর্তা আর আরেকজন তাঁর অনুগত দাস-এর সেইদিন আর নাই। উনারা একটা জায়গা নিয়াই কাজ করতেছেন, সেইটা হইলো—ভাষা। এইখানে একটাই সমস্যা। ভাষার মিনিং যে সিঙ্গুলার না, প্লুরাল, এইটা মানতে পারাটা জরুরি।…
/২০১১
……………………………………………………………………
দুইজনের কাজ দুইটা, তাদের অবজেক্টিভ একই না; এই জিনিসটা এই কবিতাতে নাই, যার ফলে এই কবিতার সমালোচক’রে নিয়া, সমালোচনা নিয়া আরো হাসি-ঠাট্টা করা যায়।
এখন এই হাসি-ঠাট্টা আসতে পারে যখন আপনি আইডেন্টিটিটারে একটা ফিক্সড জিনিস বইলা ভাবতে পারবেন। যিনি সমালোচক তিনি আর কবিতা লিখেন না এবং যিনি কবি তিনি কবিতার সমালোচনা লিখতে পারবেন না। সিঙ্গুলারিটি’র এই বেড়াটা ইমাজিন না করতে পারলে আপনার পক্ষে ঠাট্টা’টা করা পসিবলই না। আপনারে ধইরা নিতে হবে যে বউ, সে মা হইতে পারে না, মা হইলে সে আর কখনোই প্রেমিকা হইতে পারবে না, আর এই অ্যাজাম্পশনটা ইনভ্যালিড হয়া গেলে কবিতাটা একটু ভালগারই লাগার কথা।
জীবানানন্দ কি বলছেন সেইটার চাইতে ইর্ম্পটেন্ট হইলো উনার টেক্সটের রিডিংটা কিভাবে প্রমিনেন্ট হয়া ওঠে বা উঠতে পারে। আমরা যা দেখি সেইটা রিয়ালিটি না, বরং কিভাবে আমরা দেখি, সেইটাই হইতেছে রিয়ালিটি।
২.
আবার, জীবনানন্দ’র সময় হয়তো সমালোচকরা সোশ্যালি অনেক পাওয়ারফুল ছিলেন, তারা নানান যন্ত্রণা দিছেন উনার কবিতার উল্টা-পাল্টা ব্যাখ্যা কইরা। তাই তিনি তাদের বর্তমান (অই সময়ের) অবস্থা বিবেচনা কইরা রিভেঞ্জ নিছেন; এই ‘ক্রোধ’ তিনি প্রকাশ করতেই পারেন, সেই ‘নৈতিক অধিকার’ উনার আছে। খালি প্রেম-ভালোবাসা নিয়া কবিতা লেখা হবে কেন? ক্ষোভ, ঘৃণা, জেলাসি এইসব ফিলিংস থিকাও কবিতা লেখা হয় তো!
জীবনানন্দ খেপতেই পারেন, উনার কবিতা আজাইরা সমালোচনা দেইখা। এইটা নিয়া কবিতাও লিখতে পারেন। কিন্তু যেই জায়গাটা থিকা সমালোচনারে মোকাবেলা করছেন, যে, পারলে আরেকটা কবিতা লেইখা দেখান! এর ভিতর দিয়া কবিতাটারে তো একটা ভুল-ব্যাখ্যার ভিতর দাঁড় করানো যায় না; যে, উনি সমালোচকদের সুপিরিয়র-ইনফিরিয়র বইলা ভাবেন নাই।
সমালোচনা নিয়া জীবনানন্দ’র আরো অনেক কথা থাকতে পারে, কিন্তু স্পেসিফিক্যালি এই কবিতাতে তিনি কি বলছেন, সেইটা নিয়াই আমি বলতে চাইছি। এমনিতেও এইটা জীবনানন্দের সবচে দুর্বল কবিতাগুলার একটা। এই কবিতা দিয়া জীবনানন্দের কবিতারে বিচার করতে গেলে খুবই ভুল কাজ হবে।
৩.
‘সমারূঢ়’ কবিতার একটা আদি ভার্সনও আছে। অইটা বরং বেটার। সমালোচক কি করবেন, না করবেন ভাইবা কবিতার পারপাস কি সমালোচকের জন্ম দেয়া কিনা, সেইটা নিয়া অনেক বেশি কনসার্নড ছিলেন। হেইট্রেটটা তো ছিলোই, পরে, এখনকার চালু ভার্সনটাতে সেইটা মকারিতে ট্রান্সফর্ম হয়া অইটাই মেইন ইস্যু হয়া উঠছে।
আরেকটা মজার জিনিস হইলো, এই আদি ভার্সনটাতে সমারূঢ় শব্দটার মিনিংটা যতোটা ফেক্সিবল, পরের বা এখনকার ভার্সনটাতে, আরো বেশি পোক্ত হইছে বরং। এইখানে উনার আর্গুমেন্টটা অনেকটা এইরকম যে, এইসব সমালোচনার লাইগা কি আমি কবিতা লিখছিলাম! নতুন কোন সমালোচনার জন্ম দিতে পারাটা কোন কবিতার উদ্দেশ্য হইতে পারে না, কিন্তু একটা সময়ে একটা কবিতা কেমনে রিড করা হবে, সেইটা নিয়া এক রকমের এক্সপেক্টশন তো থাকতেই পারে, কিন্তু সেইটা কবি’র ডিসাইড কইরা দিতে পারার কথা না, কোনভাবেই।
সমারূঢ়
তারপর তারা তাদের জীবনের সমস্ত শূন্যতা – বিষম শূন্যতার
কথা ভুলে যায়
কোনো এক মৃত কবির পান্ডুলিপির কাছে ধূসর আলো জ্বেলে ব’সে
লাল কালি, নীল লাল পেন্সিল, অভিধান, টিকাটিপ্পনীর
দারুণ ক্লান্তি চলে শেষ রাত পর্যন্ত
সারা রাত হন্যে শকুনের মতো এদের কালো ছায়া দেয়ালে দেয়ালে
নড়তে থাক
এদের এরকম জান্তব বেদনা দেবার জন্য তুমি কবিতা
লিখেছিলে? কবি ?
কোথায় সেই সুন্দরীরা যাদের উদ্দেশে কবিতা লিখেছিলে তুমি?
তোমার কবিতা যাদের কাছে কঠিন মেঘ পাহাড়ের মতো মনে হত?
বিচ্ছিন্ন, দূর, দানবীয়।
আহা, তাদের আজ দাঁত নেই, চোখে পিচুঁটি, ঘুম
(ধূসর সিন্দুকের মতো) তাদের অবিরল মাংস দিকে দিকে
হাঁ করে পড়ে রয়েছে।
তুমি তোমার কবিতা লিখেছিলে?
মৃত রূপসীর বসার ভিতরে অজস্র কৃমির মতো
তোমার কবিতা অনেক পন্ডিতের জন্ম দিল
জন্ম দিল আরো অনেক পন্ডিতের – অধ্যাপকের –
অধ্যাপকের বেতনের,
সংসার–সমাজের এইসব শাশ্বত ব্যবস্থার জন্ম দিল।
(পেইজ: ৬৭৮, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র – জীবনানন্দ দাশ, আবদুল মান্নান সৈয়দ সংকলিত ও সম্পাদিত। ১৯৯৩ সালে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ বই থিকা নেয়া।)
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024
- ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ - আগস্ট 9, 2024