মাইকেল সরকিন ও মার্সেল
২০১৫ সালে আমি যখন বেঙল ইন্সটিটিউটে রিসার্চ এসোশিয়েট হিসেবে কাজ করতাম, একই সময়ে ঢাকায় হাজির হইলেন সমসাময়িক আর্কিটেকচার জগতের দুই দিকপালঃ মাইকেল সরকিন এবং জেমস টিম্বারলেক। সরকিন আসলেন বেঙলে ওয়ার্কশপ করাতে; আর টিম্বারলেক আসলেন ঢাকায় সাইট খুঁজে বের করতে, প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়ায় তাঁর গ্র্যাজুয়েট স্টুডিওর ছাত্রদেরকে ঢাকার বিভিন্ন সাইটে কাজ করতে দেন।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
মাইকেল সরকিনকে দেখে আমার মনে হইলো যেন সেই কুইন্টেসেনশিয়াল পাগলাটে প্রফেসর! খাস নিউ ইয়র্কার! চরম রসিক, ভাব দেখে মনে হবে যেন তিনি কোন কিছুকেই সিরিয়াসলি নিতে চান না। খালিদ আশরাফ তাঁকে পরিচয় করাইয়া দিতে গিয়ে বলসিলেন, “সরকিন হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যাকে আমরা সবাই ভয় পাই। বামপন্থী, ডানপন্থী, মধ্যপন্থী; ফেমিনিস্ট, এনভায়রনমেন্টালিস্ট, ক্যাপিটালিস্ট… সবাই!” তিনি ছিলেন কোক এডিক্ট, কোক মানে কোকেইন না, কোকাকোলা; বয়স্ক কাউকে আমি কখনো অমনভাবে কোক খাইতে দেখি নাই! তাঁকে যদি জিজ্ঞেস করা হইতো, আপনার লেকচার আজ কতক্ষণ চলবে, তিনি জবাব দিতেন, “এবাউট ফোর কোকস লং।”
দুইজনকে একসাথে পেয়ে, খালিদ আশরাফ তাঁদেরকে নিয়ে কনভারসেশন বসাইলেন। আলাপে আমরা যতই জানতে চাই, আমাদের এই ঢাকার কী গতি হবে, তিনি ততই বলতে চান, “কেন, ভালোই তো আছো তোমরা!” তিনি স্বীকার করলেন ঢাকার সমস্যা আছে, ডেনসিটি বেশি হওয়া ভালো, কিন্তু ঢাকা হয়তো সেই অপটিমাম লেভেলও পার করে গেসে। কিন্তু ফিরে ফিরে বলতে চাইলেন, “এপ্রিশিয়েট দা গুড থিংস ইউ হ্যাভ গোয়িং ফর ইউ”।
[youtube id=”g2unz_W8Hmk”]
তার আগেরদিন আমার উপর দায়িত্ব পড়সিলো প্রফেসর টিম্বারলেককে ঢাকায় তাঁর সম্ভাব্য সাইট দেখাইতে নিয়ে যাওয়ার। যাওয়ার কথা ছিলো হাজারীবাগের ট্যানারি আর তেজগাঁর ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইটে; কী মনে করে তিনি ঠিক করলেন হাজারীবাগ থেকে বুড়িগঙ্গার তীর ধরে, বাকল্যান্ড বাঁধ ধরে, পুরান ঢাকা পার হয়ে তেজগাঁ যাবেন। ব্যস, সর্বনাশ হয়ে গেলো! সন্ধ্যায় তাঁর লেকচার ছিলো, আমেরিকান প্রফেসর, টনটনে সময়জ্ঞান, শিডিউল উলটপালট হলে দিশা হারাইয়া ফেলেন। প্রচন্ড বিরক্ত হইলেন তিনি শিডিউল গুবলেট পাকাইয়া যাওয়ায়। তো, সরকিনের “ভালোই তো চলতেসে” শুনে তিনি আর থাকতে পারলেন না, বললেন, “একটা মিনিমাম অর্ডার, ডিসিপ্লিন তো থাকবে! এক রাস্তায় এত রকমের যানবাহন, তাও আবার রিকশাগুলা চলবে রং ওয়েতে!”
সরকিন হাসলেন, বললেন, “জেমস, তুমি মনে হয় কখনো ইন্ডিয়া যাও নাই, তাই না? গেলে দেখতা, ওদের রাস্তায় এইসবের সাথে গরুও চলে। আর জানো তো, গরুকে ট্রাফিক আইন মানানো কিন্তু খুব মুশকিল!” হো-হো করে হেসে উঠলেন তিনি। তারপর সিরিয়াস হলেন, জেমসের কথায় সায় দিলেন, ডিসিপ্লিনের গুরুত্বের কথা বললেন; কিন্তু স্মরণে রাখতে বললেন, কখনো যেন ভুলে না যাইঃ There is something very democratic about the way they negotiate their way through the streets of Dhaka!
[youtube id=”s9Rc9FzUx8Q”]
আমি আমার চিন্তাভাবনায়, লেখালেখিতে সবথেকে বেশি ধার করি (চার্লস কোরিয়ার পরে) সম্ভবত মাইকেল সরকিন থেকেই। আমি আমার টেবিলে ফিরে খাতায় ওই কথাটা লিখে রাখসিলাম, লেস্ট আই ফরগেট। আমাকে যদি তালিকা দিতে বলা হয়, গত এক দশকে শোনা কোন কোন লেকচার আমাকে সবথেকে বেশি প্রভাবিত করসে, তাহলে সরকিনের সেইদিনের কনভারসেশন এবং তার পরদিন দেয়া তাঁর ফরমাল লেকচারটাকে আমার একেবারে উপরের দিকে রাখতে হবে। এবং সম্ভবত ওই সিঙ্গেল লাইনটাকে মানতে হবে সবথেকে ইনফ্লুয়েন্সিয়াল বলে, “something very democratic about the way they negotiate their way through the streets…”
–
করোনা ভাইরাসে কোন প্রিয়জনকে কখন হারাই, সেই ভয় ছিলো মনে। খবরটা পুবদিক থেকে আসার আশঙ্কায় ছিলাম, আসলো পশ্চিম থেকে। প্রফেসর সরকিন গতকাল নিউ ইয়র্কে করোনা ভাইরাসে ভুগে মারা গেসেন, ৭১ বছর বয়সে।
প্রিয় মাইকেল সরকিন, ইউ টু গুড সান অফ আ গান, আমার ভালোবাসা জানবেন! মেই ইয়োর “ফিয়ার্স এন্ড ব্রিলিয়ান্ট” সোওল রেস্ট ইন পাওয়ার!
২.
মার্সেল আমার বাপের বয়সী, কিন্তু তাঁকে আমি আমার বন্ধু বলতে পারি। ইউরোপে এইটা একটা ভালো দিক, বয়স এখানে বন্ধুত্বের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না; এখানে আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুটা যেমন আমার থেকে ১৩ বছরের ছোট (ইন আদার ওয়ার্ডস, আমি যখন এইচএসসি দেই, ও তখনো স্কুলে ঢুকে নাই)।
হাসপাতালে আমার কেবিনে আমরা দুইজনই ছিলাম, আমি আর মার্সেল। ওর অসুখটা ঠিক কী ছিলো আমি জানি না; হুইলচেয়ার লাগতো চলতে ফিরতে, পেটে সুঁই-টুই, ক্যাথেটার ইত্যাদি লাগানো থাকতো। প্রথম দিন আমাদের বিশেষ কথা হয় নাই। বুড়া সারাদিন মনমরা হয়ে শুয়ে থাকতো, টিভি দেখতো, প্রিয় চ্যানেল ছিলো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। পরের দিন ডাক্তার আমাকে দেখে চলে যাবার সময় আমি ডাক্তারের জন্য জমাইয়া রাখা সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটা করলামঃ “এম আই এলাউড টু স্মোক?”
ডাক্তার উত্তরে “হ্যাঁ” বলার সঙ্গে সঙ্গে মার্সেল বিছানায় উঠে বসলো। ডাক্তার চলে যেতেই আমাকে অনুরোধ করলো, আমি স্মোক করতে বের হলে কষ্ট করে তাঁকে সাথে নিয়ে যেতে পারবো কিনা? “আই হ্যাভেন্ট হ্যাড আ স্মোক ইন এইট ডেইজ!” নার্সরা ওর সবরকমের যত্ন করতে রাজি ছিলো, কিন্তু স্মোক করতে নিয়ে যেতে রাজি ছিলো না। তো, সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্বের শুরু।
ভিজিটিং আওয়ার ছিলো অল্প কিছুক্ষণ, আর আমার তাও কিছু ভিজিটর আসলেও মার্সেলের কোন ভিজিটর আসতো না। তাই আমরা অনেক আলাপ করতাম। আমি এদিকওদিক ঘুরে বেড়াইয়া এসে দেখতাম খাবার চলে আসছে, কিন্তু মার্সেল বসে আছে একসঙ্গে খাবে বলে। আমার বয়স জেনে বলসিলো, তাঁর একমাত্র মেয়ে ঠিক আমারই বয়সী, ওই হাসপাতালেই জন্ম তাঁর মেয়ের। আমার কাছে বন্ধুরাই আসতো, মার্সেল একদিন জানতে চাইলো, আমার ফ্যামিলির কেউ আসে না? আমার ফ্যামিলির আমার কাছে আসতে হলে ভিসা লাগবে জানতে পেরে যেন খুব দুঃখ পাইসিলো মার্সেল, ভিসা পেতে অনেক সময় লাগে জেনে আমাকে সরি বলসিলো তাঁর দেশের হয়ে।
এক সময় ডাক্তারদের কথাবার্তায় মার্সেল বুঝতে পারলো, দেখে বুঝা না গেলেও আমার অবস্থা আসলে ওর থেকেও জটিল। আমার সার্জারির আগের দিন রাতে আমাকে বললো, “তোমার কিন্তু বয়স কম, আমি শিওর, তুমি ঠিকঠিক উতরে যাবা।” আমি বললাম, ওই ব্যাপারটাই তো আমাকে পীড়া দেয় বেশি, “আমি ছাড়া হাসপাতাল ভর্তি তো সব তোমার মতোন বুড়ারা।” আমি জানি না মার্সেল বুড়ো এই ইয়ুথ কলোকিয়াল কোথায় শিখছিলো, বললো, “তোমার বন্ধুরাও আসবে কোন একদিন এই রোগ নিয়ে হাসপাতালে, তুমি তখন ওদেরকে বইলোঃ বিন দেয়ার, ডান দ্যাট!” 😄
সার্জারি শেষে, আইসিইউতে কয়েকদিন থেকে, কেবিনে ফিরে আর মার্সেলকে পাই নাই আমি।
–
একদিন যখন আমার সিগারেট খাওয়া শেষ, ওর শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করতেসি, মার্সেলের হঠাৎ ফোন আসলো। আমি অপেক্ষা করলাম। অপেক্ষা করতে করতে আরেকটা সিগারেটও শেষ করে ফেললাম। ফোন শেষ হলে সরি বললো, যখন ওর হুইলচেয়ার টেনে নিয়ে ফিরতেসিলাম, আমাকে বললো, “ইট ওয়াজ মাই ডটার।”
আমরা যখন লিফটে, আমি আয়নায় খেয়াল করলাম, ওর দুচোখ বেয়ে পানি পড়তেসে।
–
কয়েকদিন ধরে একটা ঘটনা আমাকে খুব পুড়াচ্ছে। আমার এক বড়ভাই ইউকেতে থাকেন, গত সপ্তাহে দেশে তাঁর বাবা মারা গেসেন। তিনি দেশে যেতে পারেন নাই, যাওয়া আসা অনিশ্চিত হলেও ঝুঁকি নিয়ে তিনি যেতে পারতেন হয়তো, কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিসেন, এই অবস্থায় যাবেন না, গিয়ে বরং তাঁর মাকে, আত্মীয়স্বজনকে আরো ঝুঁকিতে ফেলবেন। আমি ব্যাপারটা মনে না আনার চেষ্টা করতেসি।
ইজরাইলের ডিফেন্স মিনিস্টার একটা প্রেস কনফারেন্স করসেন; এন্ডোর্স করবো না ওদের পুরাটা পলিসি, হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে আলাপ আছে, আমি জানি না সেই ব্যাপারে ভালো, কিন্তু সেই পলিসিতে ওরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিসে বৃদ্ধদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। এই সিদ্ধান্তটা আমার কাছে অত্যন্ত সঠিক মনে হইসে।
বেলজিয়ামের অবস্থা ভালো না, একদমই ভালো না, মিনিমাম আরো ৮ সপ্তাহ লকডাউন চলবে বলসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু আমার সকল দুশ্চিন্তা বাংলাদেশকে নিয়েই।
আগেও বলসি আমি, দেশ থেকে আসার সময় আমার মনে একটাই ভয় ছিলো, একটাই দুশ্চিন্তা, আমাকে যেন কখনো দেশ থেকে কোন খারাপ ফোনকল পাইতে না হয়।
রেদওয়ান বাশার
Latest posts by রেদওয়ান বাশার (see all)
- গনতন্ত্র কেন দরকার? - আগস্ট 10, 2024
- মাইকেল সরকিন ও মার্সেল - মার্চ 28, 2020
- প্রিয় প্রিয়ভাষিণী - মার্চ 6, 2018