ফিকশন: একদিন তোর হইবো রে মরণ – ২
র্যাবের হাতে হিমু গুম?
ভাবতেছিলো রূপাও তখন, কি করবে সে? রূপার চোখ খোলা, কিন্তু শে যেন কিছুই দেখতে পাইতেছে না, দেখতে চাইতেছে না। খোলা চোখে কোথায় জানি তাকায়ে আছে। ঘুম নাই। পুরা এক বোতল নিদ্রাকুসুম তেল মাথায় ডইলা ডইলা মাখলেও তাঁর ঘুম আসবে না।
এইরকম একজন রূপবতী মেয়ে রাত দুইটার সময় মগবাজার থানায় বইসা আছে এইটা থানার পুলিশদের কাছে একটা বিরাট ঘটনা। মাথার উপরে টঙ্গী ন্যাশনালের সিলিং ফ্যান ঘুরতেছে, তারপরও ওসি অপু বন্দোপাধ্যায় দরদর কইরা ঘামতেছেন। কাজ থাকলেও কেউ উনার রুমে যাওয়ার সাহস করতে পারতেছে না এখন। কারণ তাঁর সামনে শিরদাঁড়া সোজা করে রূপা বইসা আছে। পিছন থিকা তাঁর বাদামি কাঁধের উপর জমে থাকা শাদা ঘামের রেখা দেখা যায়। ঢাকা ইউনির্ভাসিটি’র ইয়াং মুসলিম ইন্টেলেকচুয়াল আবদুল্লাহ’র জন্য তাঁর এই বইসা থাকা।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
প্রথম বউয়ের সাথে ডির্ভোসের রায় হওয়ার আগেই সে রূপারে বিয়া করছে এই অভিযোগ কইরা কেউ তারে গ্রেফতার করাইছে। যেহেতু সে সরকারের সমালোচনা করে এইজন্য হয়তো কেউ এই কাজ করছে। এইটা যে কেউই ভাবতে পারে। কিন্তু সে জানে এইটা না-ভাবার পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। এইরকম কিছু হওয়ার কোন কারণই নাই।
দৈনিক এনলাইটমেন্ট গ্রুপও এই কাজ করার কথা না। কেন করবে না এইটা সে ভাবনার মধ্যেও আনতে চায় না। এইটা এতোটাই গোপন যে কখনোই এই বিষয়ে কথা না বইলাও উনারা জানেন সেইটা। সবচে যেইটা অবভিয়াস সেইটা গোপনই থাকে একরকম, না–বলা প্রেমই যেমন সবচে গভীর প্রেম, এইরকম একটা ব্যাপার। এইখানে অবশ্যই তাদের নিজেদেরকে নিজ নিজ রোলটা প্লে করতে পারতে হবে। না–জানা’র পারসপেক্টিভেই জানা ঘটনাগুলা ঘটতে থাকবে। সামনে অপেক্ষা করতেছে নয়া দিন, নয়া জীবন। সোভিয়েত রাশিয়া’র উদয়ন পত্রিকার ইমেজগুলার মতো চকচকা। সরকারের মন্ত্রীদেরও সেইটা না-জানা থাকার কথা না। একটা সিস্টেম’রে সাসটেইন করতে হইলে একটা লেভেলে সমালোচনা’রে নিতে পারতে হয়, চালু রাখতে হয়। এইটা সবাই বুঝে; এইটার বেনিফিট সবাই পায়। সুতরাং এইটা তাঁদেরও কাজ না।
এর উপরে, তাঁর প্রথম বউয়ের সাথে ডির্ভোসের ব্যাপারটা ফাইনাল। কাগজপত্র আসতে যা দেরি। সেও এইরকম ভিনডিক্টিভ মেয়ে না, যদিও সে ইমোশনাল। একদিকে রাজাকারের ফাঁসি চায়; আবার অন্যদিকে সভ্যতার বিক্যাশ চায় এবং তার মতোই সংস্কৃতিমনা। কালচারাল গ্রাউন্ডে তাদের কোন বিরোধ নাই। তাঁর স্বামীর আগের প্রেম সে মাইনা নিছে। গত এক বছর ধইরা তারা এক বাসাতেও থাকে না। হাজার হোক, তাদের মধ্যে ভালোবাসা ছিল, তাঁর এই কাজ করার কথা না। যেইখানে সম্পর্কটাই শেষ হয়া গেছে সেইখানে রিভেঞ্জের ইচ্ছা থাকার কথা না।!
তাইলে এই ভজঘট’টা পাকাইলো কে? রূপার প্রেমিক বলতে হিমুরেই সে জানে। কিন্তু হিমু ঠিক রূপার প্রেমিক না, বরং রূপা–ই হিমু’র প্রেমিকার মর্যাদা চায়। রূপার এক রকমের মোহ আছে হিমু’র প্রতি। কিশোরী বয়সে সব মেয়েদেরই এইরকম থাকে। কিন্তু একটা বয়সের পরে তারা বুঝতে পারে যে, এইরকম মিনিংলেস আবেগগুলা কোন পারমানেন্ট রিলেশনের দিকে যাইতে পারবে না। তারা মাইনা নিতে পারে, বুঝতে পারে আবেগ দিয়া দুনিয়া চলে না, তখন চলার পথে পথ পাল্টাইয়া অন্যদিকে চইলা যাইতে পারে। রূপা তা করতে পারে নাই। বয়স ত্রিশ পার হইছে কতো আগে, অথচ এখনো কিশোরী-স্বভাব রয়া গেছে তার মধ্যে। পাঠক হওয়ার মতো একটা শূণত্যার ভিতর শে থাকে; অডিয়েন্স হওয়ার মতো নিরবতা নিয়া সিনেমা-লাইফ এক্সপেক্ট করতে থাকে, জীবনানন্দের তারপর, তবুও…। এইসব নিয়াই থাকলেও হইতো, পেইন কিছুটা কম দিত। হিমু ত কোনদিনই তারে বিয়া করবে না। খালি রূপারে কেন, কাউরেই সে বিয়া করবে না। রূপারে সে পছন্দ করে এইরকম কোন ইন্ডিকেশনও সে দেখায় নাই। একদিন হিমু’র সাথে দেখা করাবে বইলা রূপা আবদুল্লাহ’রে ছবির হাটে নিয়া গেছিলো। রাত নয়টা পর্যন্ত ওয়েট করার পরও সে আসে নাই। এরপর থিকা রূপার সাথেও হিমু’র কোন যোগাযোগ নাই।
আবদুল্লাহ’র সাথে রূপার পরিচয় বইমেলায়। শে গেছিল হুমায়ূন আহমেদ’র বই কিনতে। আবদুল্লাহ তারে কইলো, আপনার মতো এইরকম একজন গভীর-সৌন্দর্য্য, যিনি কিনা হাসতেও পারেন এবং তখনো সৌন্দর্য্য ম্লান হয় না, প্রকৃত সারসের মতো উইড়া যায় না; শে কেন, শে কেন ডেপথ নাই এইরকম বই পড়বো! কেন!
রূপা তাঁর কথারে পাত্তা দেয় নাই, কিন্তু এইরকম জোর-করা পন্ডিতির ভিতর ভালোবাসার হাহাকারটা টের পায়। এইটা ভালো-লাগে তাঁর। দে স্পেন্ড সাম কোয়ালিটি টাইম টুগেদার। একটা সময় রূপা পিএইচডি করতে ইংল্যান্ডে চইলা যায়। এরমধ্যে আবদুল্লাহ ঝোঁকের মাথায় বিয়া কইরা ফেলে। রূপাও লিভ টুগেদার করছে এক ফরাসী’র সাথে, অ্যাপোলোনিয়ের–এর গভীর প্রেমের কবিতা পড়তে পড়তে। তারপর একটা সময় রূপা বুঝতে পারে যে, গভীরতা কোন সাসেটইনবেল জিনিস না, গভীরতারও গর্ত আছে অনেক।
এই বুঝতে-পারা বেশিদিন বিদেশে থাকতে দেয় নাই তারে। এখন একটা রিসার্চ গ্রুপে কাজ করে। সভা-সেমিনার করে, উন্নয়নমূলক কাজকামের এম্পটিনেসের সাথে নিজের শূণ্যতারে শে সুন্দরভাবে ম্যাচ কইরা নিতে পারে। আকাশী নীল রং তাঁর ফেভারিট কালার। কিন্তু জেমসের প্রিয় আকাশী গান’টা শুনলেই রাগে গা’টা শিরশির করে; শে একদমই নিতে পারে না। চিল্লাইয়া গান গাওয়ার কি আছে? আবদুল্লাহরও খুব একটা পছন্দ না; কিন্তু উনি হাসেন রূপা’র রাগ দেইখা, এইসব কালচার’রে পাত্তা না দিলেই তো হইলো। রূপা’র পাত্তা দেয়া লাগে, কারণ হিমু কয় যে, না, না, জেমসের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে! অডিয়েন্সের পছন্দমতো সে গান গায় না, অডিয়েন্সরে সে তার পছন্দের মধ্যে নিয়া আসে। এইটাই রিয়েল আর্টিস্টের কাজ। কিন্তু বাইরে দিয়া এমনে চিল্লাইলে ভিতরে আর কিছু থাকতে পারে নাকি? রূপা ভাবে। আর হিমু বলে যে, ভিতর-বাহির এইরকম কোন ক্যাটাগরিই আসলে এগজিস্টই করে না। হিমু তো কতো কথাই বলে। রূপা পাত্তা দিতে চায় না হিমু’রে, আবার পাত্তা না দিয়াও পারে না। রূপা বুঝতে পারে, আবদুল্রাহর সাথে দেখা হয়া যাওয়াটা ছিল তার নিয়তি। এখন যখন তারা যে যার লিমিটেশনগুলারে নিয়তি বইলা মাইনা নিতে শিখতেছে, তখনই এই অদ্ভুত ঘটনা।
তাইলে, কে এই ঘটনাটা ঘটাইলো? ওসি অপু বন্দোপাধ্যায় একদম চুপ। বাসা থিকা থানাতে নিয়া আসা পর্যন্ত কোন খারাপ কথা বলেন নাই। খালি একবার বলছে, “আপনারে আমরার সাথে যাইতে হবে। এখনই চলেন!” ব্যাস। নাটক-সিনেমাতে যেইরকম বলে। কিন্তু অপু বন্দোপাধ্যায় ইয়াং না, বয়স ষাইটের কাছাকাছি। ছাপান্ন-সাতান্ন হবে। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের লোক। হুমায়ূন আজাদের মতো বেকুব এবং এই কারণেই ঘাড়-ত্যাড়া। এতদিনেও কিলোমিটারে ঢুকতে পারে নাই। চাইলে অনেক আগেই ইন্ডিয়াতে ঢুইকা যাইতে পারতেন। কিন্তু দুর্গা দিদি’র মায়া তিনি ছাড়তে পারেন নাই। এই দেশের বাতাসে, রেললাইনের স্লিপারে কান পাতলে তিনি দুর্গা দিদি’র কথা শুনতে পান। ভাবেন যে, পারলে ইন্ডিয়াই চইলা আসুক বাংলাদেশে। এইরকম একটা নারাজি’র মধ্যেই থাকেন বেশিরভাগ সময়; এইকারণে ঝোঁকের মাথায় অ্যাক্টিভ হয়া পড়েন আর তখন ভুলগুলি করতে থাকেন। বোঝা যায় অনেকদিন ধইরা তার প্রমোশন হয় না। হবেও না। এখন ত রিটায়ারমেন্টের টাইম চইলা আসছে।
আবদুল্লাহ বারবার তারে বলার এবং বোঝানোর চেষ্টা কইরা যাইতেছে যে, কাজটা ঠিক হইতেছে না। তারে একটা ফোন করতে দেওয়া উচিত। একটা কল দিতে নিছিলো কুবের মাঝি স্যার’রে তখনই মোবাইল ফোনটা নিয়া নিছে। স্যামসাং গ্যালাক্সি ফোর এস মোবাইলটা ওসির টেবিলের ওপর রাখা। অফ করা। এর পাশে অপু বন্দোপাধ্যায়’র সিম্ফনির বাটনওলা মোবাইল সেট, দেখলেই ক্লাস’টা বোঝা যায়। রূপার পছন্দ না এই ভোটকা ফোন, কয়, টিভি কেন তুমি পকেটে নিয়া ঘুরো! রূপা নিজে কোন মোবাইল ফোন ক্যারি করে না, হিমু’র মতো।
অপু বন্দোপাধ্যায় আবদুল্লাহ’রে থানাতে আইনা সোজা হাজতে নিয়া ঢুকাইছে। একটু পরে পরে নিজ হাতে চা নিয়া আসতেছে। রাত বারোটার সময় এক প্যাকেট গরম কাচ্চি বিরানি দিয়া গেছে, ডিসপোজেবল প্লেট, স্পুন এবং স্প্রাইটের একটা ক্যানসহ। রূপার সামনেও এক প্লেট রাখা আছে। এক প্লেট খাইয়াও আবদুল্লাহ’র পেট পুরা ভরে নাই, সে ভাবতেছে আরেক প্লেট দেয়ার জন্য বলবে কিনা। খিদা থাকলেও এই পরিস্থিতিতে সেইটা বলাটা ঠিক হবে না। সে বুঝতে পারে।
কিন্তু ফোনের কথা বললেই ওসি চুপ; যেন বোবা-কালা। কোন রেসপন্স করে না। সেও খুব একটা চিন্তা করে না, কারণ মিডিয়া এখন অনেক বেশি স্ট্রং। সকালের মধ্যেই খবর হয়া যাবে। তখন খামাখা অপু বন্দোপাধ্যায়া’র চাকরিটা যাবে। এইটা ত সে না-বোঝার কথা না! তারপরও সে এই রিস্কটা কার জন্য নিতেছে? কেন নিতেছে? হোয়াই?
রূপার সাথে তার কথা হইছে। রূপা বলছে হিমু নাকি তারে ফোন কইরা মগবাজার থানায় আসতে বলছে। তাই শে এত রাতে আসছে। কিন্তু কই থিকা ফোন করছিলো সে? হিমু কই?
রূপা’রে জিগাইলে তাঁর মনোরম হাস্কি গলায় কইলো শে, র্যাব হোডকোয়ার্টারে।
হলুদ হিমু, কালা বনহুর
র্যাব হেড কোয়ার্টারের অফিসে কটকটা রংয়ের হলুদ পাঞ্জাবি পইড়া হিমু বইসা আছে। চুল কাটা হয় নাই গত তিনমাস ধইরা, শেভও করছিল মনেহেয় সপ্তাহ দুয়েক আগে। মানে, মোটেই সম্মানজনক বেশভূষা না তার। কিন্তু সে কথা কইলে এক ধরণের ধ্বনিময়তা ক্রিয়েট হয়, রাবীন্দ্রিক আভিজাত্য প্লাস আরবান উদাসিনতা টের পাওয়া যায়; বোঝা যায় এটলিস্ট শিক্ষিত মিডল-ক্লাস ফ্যামিলির পোলা। এই কারণেই হয়তো তারে দাঁড়া করাইয়া রাখে নাই। চেয়ারে বসার পারমিশন দিছে। অবশ্য যার ভিজিটিং কার্ড হিমু নিয়া আসছে, সেইটার কারণেই মেইনলি বসার অধিকার তার অর্জন করতে পারার কথা। চেয়ারে হাতল নাই, হাত দুইটা কোলের উপর রাইখা সাবমিসিভ ভঙ্গিতে বসতে হয়। অথবা খুববেশি সাহস থাকলে টেবিলের উপরে সমঝোতার ভঙ্গিতে রাখতে হয়।
যার সামনে বইসা আছে হিমু তিনি খুবই সুদর্শন একজন ইয়াং অফিসার, নামটা অন্যরকম একটু – বনহুর। উনার আম্মা স্কুলে থাকতে রোমেনা আফাজের খুব ভক্ত আছিলেন; জীবনে একটা জিনিসই চাইছিলেন জামাইয়ের কাছে, আর সেইটা হইলো ছেলের নাম। বনহুরের বয়স মিড টুয়েন্টিজে, সাতাশের বেশি হবে না। চকচকে শ্যামলা রংয়ের চেহারা। দেখলেই রেসপেক্ট করতে ইচ্ছা করে। কালো পোশাকে পুরা রাজপুত্তরের মতো লাগতেছে তারে। কলেজ–ইউনিভার্সিটির মেয়েরা, তাঁদের মায়েরা এবং শহুরে নারীবাদীরা ফ্লার্ট করার লাইগা যেইরকম ম্যাসকুলিন পুরুষ কল্পনা করতে পারে, সেইরকম ড্রিম–বয় উনি। সামনে একটা ল্যাপটপ খোলা, ডেল–এর, সিলভার কালার। পাশে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটারের মনিটর, ওইটা এইচপি’র। ব্রাউন কালারের অটবির টেবিল। কিছু কাগজপত্র, ফাইল, টিস্যু বক্স, কফি মগ, পেপার ওয়েট, পেন–হোল্ডার, স্টেশনারিজ সবকিছু পরিপাটি করে গোছানো। যেইটা যেইখানে থাকার, সেইখানেই আছে।
‘আপনার রুমাল তো যথেষ্ঠ ময়লা মনে হচ্ছে। আপনি চাইলে এই টিস্যুটা ইউজ করতে পারেন।’ বনহুর একটু হাইসা কইলেন হিমু’রে। হিমু জানে এই হাসি কতোটা ভয়ংকর হইতে পারে। যদিও দেখতে পেলব, সানি-লিওনের অয়েলি উরাতের মতোন। এই সরল সাদাসিধা কথার মিনিংটা হইলো, আপনার ক্লাস আমি জানি, সুতরাং সাবধান থাকেন।
হিমু বাধ্য মেয়ে’র মতো (মানে, ছেলেরাও বাধ্য হয়, কিন্তু মেয়েরা বাধ্য হয় – এইটা বলাটা নিয়ম, মানে, তাদেরকে তো বাধ্য হইতে হবে, তাই না? এমনিতেও, মেয়েরা ছেলেদের চাইতে বেশি বাধ্য হয় এবং চাইলে বেশি অবাধ্য হইতে পারে আসলে) রুমালটা প্যান্টের পকেটে ঢুকাইয়া টিস্যুটা হাতে নেয়। এই বাজে সময়ে শুরু হইছে সর্দি’টা। শীত চইলা গেছে আর গরম’টা হঠাৎ কইরাই চইলা আসছে। এই চেইঞ্জটা শরীর নিতে পারে নাই। আমাদের মন যতো ফেক্সিবল শরীর তো ততোটা না। শরীর বুঝতে পারে, কিন্তু রিঅ্যাকশনগুলারে আটকাইতে পারে না। মেজর বনহুরও চেইঞ্জ’টা স্মেইল করতেছেন। ডগ স্কোয়াডের কুত্তাগুলার সাথে থাকতে থাকতে উনারও কুত্তাদের মতো ক্যাপাবিলিটি’টা গ্রো করছে একটু। ডিফরেন্স হইলো কুত্তাগুলা ফিল করতে পারে, কিন্তু ওরা কইতে পারে না; খালি ঘেউ ঘেউ করে। মেজর বনহুর খালি বলতেই পারেন না, সুন্দর কইরা গুছাইয়া বলতে পারেন। মাঝখানে টিএসসি’তে আবৃত্তির কোর্সও করছিলেন। শুদ্ধ উচ্চারণের সাথে সাথে কিছু বান্ধবীও জোগাড় করতে পারছিলেন। উনি নরম কইরা চিবাইয়া চিবাইয়া কইলেন, ‘আপনি জানেন এইরকম ইনসাফিশিয়েন্ট ইনফর্মেশনের বেসিসে আমরা অপারেশনে যেতে পারি না।’
মানে হইলো, আমি যামু না; পারলে আমার বালটা ছিঁড় ব্যাটা।
এরে নাড়ানোটা সহজ হইবো না। নাড়ানোটা হিমু’র উদ্দেশ্যও না। উদ্দেশ্য হইলো ডিসট্রাক্ট করা। দেখাইতে হবে যে, টাকা আছে। কিন্তু হাতে টাকা দেয়া যাবে না। এটলিস্ট দুইটা দিন টাইম দরকার। এতো টাকার মামলা, যদি লোভ’টা হয় আর কয়েকটা ঘণ্টাও যদি সরানো যায় তাইলেও হবে। মাসুদ রানা সেইটাই বলছে হিমু’রে।
হিমু আবারো চেষ্টা করে, “আমি আমার দিক থিকা জানি যে, ইনফরমেশনটা সত্যি। কিন্তু ভেরিফাই করার রিস্কটা তো নিতে পারি না। একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আপনাদেরকে জানানোটা আমার দায়িত্ব মনে করছি বলেই বলতে আসা। আমি যতটুকু জানি, ততটুকুই বললাম। দেশের আইন-শৃংখলার রক্ষার দায়িত্বও আপনাদের, বাকিটা আপনাদের বিবেচনা। ইনভেস্টিগেট করতে যাওয়া বা না-যাওয়াটা অবশ্যই আপনাদের ডিসিশান।”
“আপনি ঘটনা’টা আরেকবার বলেন।”
“আমি থাকি নয়া পল্টনের মসজিদ গলিতে। মেসে। প্লাস্টার না দেয়া ইট সিমেন্টের একটা বিল্ডিংয়ে। নিচে গুডলাক প্রিণ্টার্স নামে একটা প্রেস আছে। তিনতলা বিল্ডিংয়ের দুইতলায় তিন রুমের বাসা। আমার রুমে আমি আর অ্যাড ফার্মের ওই কবি ফ্রেন্ডটা থাকে, নিতাই নাম ওর, আমরা কবি বইলাই ডাকি। ওর অফিসে ইন্ডিয়া থিকা এক লোক আসছে, একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ব্রান্ড এক্সিকিউটিভ, একটা রিজিওনাল ব্রান্ডের অ্যাড–এর বাংলা ভার্সন প্রিপেয়ার করতে। নরমালি বাংলাদেশের লোকজনরেই ইন্ডিয়ায় যাইতে হয়, কিন্তু এইবার ইন্ডিয়া থিকা লোক আসাটা একটু আন–ইউজ্যুয়াল। তারপরে রাতের বেলায় বাসায় ঢুকতে গিয়া দেখে যে, সে গুডলাক প্রিণ্টার্স থিকা বাইর হইতেছে! এইরকম কমদামি প্রেসে আসার কোন কারণই নাই। কবি’রেও এইখানে দেইখা সে থতমত খায়া গেছে। না–চিনার ভান কইরা হাঁইটা চইলা গেছে। পরে আমরা প্রেসে গিয়া দেখি, ম্যানেজারের টেবিলে কয়েকটা ডলার আর রূপি’র নোট পইড়া আছে। ম্যানেজারের সাথে এমনিতে আমাদের খাতির–টাতির আছে। কথার ফাঁকে ওই লোকের কথা যখন জিগাইলো কবি, ম্যানেজার কয় যে, না, এইরকম কেউ তো আসে নাই! যেহেতু ডলার–পাউন্ডের মামলা, ডেফিনেটলি কোন সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে এদের যোগাযোগ আছে। দেশে তো এমনিতেই বাজে অবস্থা; এদেরকে কেউ না কেউ ফাইনান্স করতেছে। আমার মনে হইছে এইখানে কোন ক্লু থাকতে পারে।”
“ওই ইন্ডিয়ান লোকের নাম কি?”
“দেব ডি.। দেবদাস চ্যাটার্জি।”
“কলকাতার লোক?”
“কবি এইটা কইতে পারে নাই; তবে দিল্লীতে থাকে। এমনিতে বাংলা কইতে পারে। হইতে পারে বাঙ্গালি, তবে মাইগ্রেটেড। সম্ভবত বারিধারা’র কোন গেস্ট হাউজে উঠছে।”
“আচ্ছা।”
ওয়েস্ট ইন-এ না উইঠা, বুটিক হোটেলে কেন? মেজর বনহুর’রে এখন একটু পাজলড মনে হইলো। নিজের মগের কফিতে চুমুক দিলো। হিমুরে চা-কফি অফার করাটা ঠিক হবে কিনা এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। লোকটা কনফিউজ করে দিতেছে। যদিও সে একটা স্ট্রং রেফারেন্স থিকা আসছে। কিন্তু বড়লোকের গরির আত্মীয়রাও ত থাকে। সেইক্ষেত্রে সমস্যা হইতে পারে। পরে রিগ্রেট করা লাগতে পারে যে এইরকম লোকরে সে কফি অফার করছিলো। বরং অফার না করলেই সেইফ, পরেরবার দেখা হইলে বলা যাবে, আরে প্রথমবার ত আপনারে চা-কফি’র কথা জিগাইতেই ভুলে গেছিলাম!
এই হিমু ব্যাটারেই বরং একটু ইনটারোগশেন করা দরকার আগে।
‘কুবের মাঝি স্যার’কে আপনি কিভাবে চেনেন?’
‘ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমি উনার ইউটোপিয়ান পার্টি করতাম।’ হিমু একটু একটু কইরা সুতা ছাড়ে, নাটাইয়ের।
‘তো, এতদিন পরে আবার…’ মেজর বনহুর আরো জানতে চায়।
‘দেখেন, তরুণ বয়সের যোগাযোগ তো, সবসময়েই থাকে; কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে। উনারে এখনো আমরা লিডার মানি।’
হিমু পুরা সত্যি গোপন কইরাই বলে। অবশ্য সত্যি বা মিথ্যা এইরকমই, পুরাটা বলা যায় না। কিছু না কিছু বাকি থাইকাই যাবে। পুরাটা কখনোই বলা পসিবল না। এইরকম একটা চিপাগলি থাকার কারণে নিজেরে বুঝ দেয়া যায়। মহাপুরুষ হয়া উঠার এবং থাকতে থাকার সাধনায় কতকিছু যে করতে হয় পুরুষ’রে। আসলে সম্পর্ক তো ছিল-ই, কিন্তু ইন্টেলিজেন্ট যুবক হিসাবে উনিই আগ্রহ দেখান হিমু’র প্রতি এবং তারে দলে টানার চেষ্টা করেন। হিমু কোনদিনই মিছিল-মিটিংয়ে যায় নাই। দূর থিকাই দেইখা গেছে এই যাত্রাপালা। হয়তো এখন তারা প্যাকেজ নাটক, বা ওয়েব সিরিজ; কিন্তু অই নাটক-সিনেমাই। যেহেতু সত্যি-কথা কমাইয়া বলতেছে, এই কারণে বেশি কইরা বলা লাগে। হিমু আরো অ্যাড করে, ‘এই ইনফরমেশন আমি উনারেই বলতে গেছিলাম। উনারে ডিটেইলটা বইলা বললাম যে, আপনি তো ক্ষমতায় আছেন; এই সময়ে যদি কিছু হয়, দায়ভার তো আপনার উপরেও আসতে পারে। তখন উনি আপনার রেফারেন্স দিলো। এইজন্য আসা। একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আমার কাজ এতটুকুই! নাগরিক অধিকার তো আপনাদেরই নিশ্চিত করা লাগবে।’
এই দেখা করার কথা’টা একদমই মিথ্যা না। মন্ত্রী কুবের মাঝির সাথে সে দেখা কইরা আসছে এইখানে আসার আগে। এখন এই মেজর বনহুর যখন লজিক্যালি সিকোয়েন্সগুলা মিলাইতে যাবে তখন সে দেখতে পাবে, ঠিকই তো, এইগুলা তো ঠিকই ঘটছে। এঁরা হইতেছে লজিকের গোলাম, কন্সপেরেসি থিওরী’র।
‘আচ্ছা।’ মেজর বনহুর’রে চিন্তিত মনে হয়। মাছ কিছুটা গিলছে মনে হয় আদার। ‘আপনার মোবাইল নাম্বারটা রেখে যান। আমরা যোগাযোগ করবো।’
‘আমি ত মোবাইল ফোন ইউজ করি না।’ হিমু বলে।
এইবার খুবই বিস্মিত হয় মেজর বনহুর। ভাবে যে, চা অফার করা যাইতো এটলিস্ট।
কিন্তু হিমু উইঠা দাঁড়ায়। লাস্ট ছক্কাটা মারে। বলে, “কোন আপডেট থাকলে কুবের স্যার’রে জানাইলেই হবে। উনার সাথে আমার যোগাযোগ আছে। যদি কোন দরকার হয়, আমি উনারে জানাইতে পারবো” বলে সে বাইর হয়া আসে।
টাফ জিনিস ছিল আসলে কুবের মাঝি পর্যন্ত রিচ করাটাই। ওইটা পারা গেছে। লজিক্যালি কনফিউজ করাটাই ছিল ঘটনা। ওইটা মনেহয় হইছে। ব্যস, এনাফ!
* * * * *
র্যাব অফিস থিকা বাইর হয়া খালারে ফোন দেয়ার কথা ভাবলো হিমু। এখন মোবাইল ফোনের দোকান খুঁইজা পাওয়া মুশকিল। এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে আইসা মোবাইলে ব্যালেন্স রিচার্জ করার একটা দোকান পাওয়া গেলো। হিমু’রে দেইখাই দোকানদার গফুর মিয়া হাইসা দিলো। কয়, ‘ভাই এইখানে?’ হিমু ঠিকমতো চিনতে পারে না ওরে। গফুর কয়, “ভাই মনেহয় চিনতে পারেন নাই আমারে। মহেশরে লইয়া যেই গল্পটা করলো শরৎবাবু অইখান থিকা আপনি–ই তো বাইর করলেন আমারে।” হিমু এইসবকিছু মনে করতে পারে না; কয়, “আগে মোবাইল’টা দাও, ফোন করি একটা।”
ফোন পাইয়াই খালা হড়বড় কইরা বলতে শুরু করে, “তুই কই? তু্ই জানোস সোহানা কাউরে না বইলা গাজীপুর থিকা চইলা আসছে। ঢাকায় আইসা আমারে ফোন দিয়া কয়, চিন্তা কইরো না, আমি ঠিকঠাক আছি। আরে, সব যদি ঠিকঠাকই থাকতো তাইলে তোরে গাজীপুর কেন পাঠাইলাম! বয়স হইতাছে এখনো বিয়া করার নাম নেয় না। আরে কয়দিন পরে প্রভা’র মতো ভিডিও বাইর হইলে তখন কি করবি? আর কথা যে কেমনে বলে; এই কইরা অভিনয় করতে পারবো ও? আর তোর ত খালাতো বোন; তুই আমার কোন খোঁজ-খবর তো কোনদিনও নিলি না, বোনটারেও দেখবি না!”
“খালা, আমি তো আপনার খবর নেয়ার জন্যই ফোন দিলাম। সোহানা ভালো আছে। আপনি চিন্তা কইরেন না!” ইমোশনের বিরতিতে হিমু কয়।
টক শো’র মতো খালা’র ঝড় আবারো শুরু হয়। চৈত্র মাস যেহেতু ঝড় তো হইতেই পারে।
“ভালো আছে! তুই কেমনে জানোস, তুমি কি পীর-ফকির হইছিস নাকি! আবার কোন বিপদে পড়তে যাইতেছে আমার মেয়েটা! আর আমারে আপনি কইরা বলতেছিস কেন?” এই পীর-ফকির বলাটা খালা’র একটা প্র্রিয় ফ্রেইজ। টিনের তলোয়ার দিয়া যুদ্ধ করার মতন। যুদ্ধ–টুদ্ধ ভালো জিনিস না, কখোন আবার ক্রসফায়ারে পইড়া মরতে হয়। হিমু কথার মাঝখানেই ফোন’টা রাইখা দেয়। বুঝতে পারে, খালু কিছু বলে নাই এখনো বাসায়। উনার রেফারেন্সেই মন্ত্রী কুবের মাঝির অফিসে গেছিল। রানার কথা মতো।
রানার কথা যখন ভাবতে যাবে তখনই গফুর বলে, “হিমু ভাই চা খাইবেন? নাকি ঠান্ডা আনামু?”
“ঠান্ডা আনাও। মেরিন্ডা।” হিমু বলে।
চোখের সামনে গফুর’রে ইগনোর কইরা হিমু কিছুটা উদাস হয়া থাকে। পাবলিক স্পেইসে এইরকম থাকতে হয়। এইটা নিয়ম।
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024
- ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ - আগস্ট 9, 2024