ফিকশন: একদিন তোর হইবো রে মরণ – ৩
মতিঝিল টু মিরপুর
বালের কি যে নিয়ম, এইদেশে। বাসে বইসা ঘামতে ঘামতে ভাবতেছিল রানা।
যেইদিন বিকালবেলা রানা মেজর রাহাত খানের রুমে গেলো সেইদিনকার দুপুরবেলার ঘটনা। ছয়ই মার্চ। সকাল এগারোটা ছয় মিনিট।
শাহবাগে বাসের মধ্যে বইসা আছে মাসুদ রানা। মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের সামনে থিকা ওঠছে সে। মিরপুর পর্যন্ত যাইতে হবে। বিকল্প পরিবহনের শাদা কালারের ছোট বাস। শাদা বলাটা মুশকিল, ময়লা বাস-ই বলা দরকার। কন্ডাক্টার হাড্ডি খিজির। বারবার আইসা রানারে দেইখা যাইতেছে, স্যারের কোন সমস্যা হইতেছে না তো! ওরে একটা চটকানা দিতে ইচ্ছা করতেছে রানার। চোয়াল শক্ত কইরা কইলো, এইটাই লাস্ট টাইম, ফুট এইখান থিকা! ভাড়া তোল ঠিক কইরা! [pullquote][AWD_comments][/pullquote]
শাহবাগ থিকা গাব্বার সিং-এর সেকেন্ড ম্যান কৃষ উঠবে এই বাসে। ঠিক পিছনের সিটের আগে ডানপাশে, জানালার ধারে। এমন একজনরে বসানো হইছে যে শাহবাগ আসার পরে উইঠা যাবে। কিন্তু বাসটা শিশুপার্কের সামনে আইসা আধাঘণ্টা ধইরা দাঁড়াইয়া আছে। পিজিতে ডাক্তাদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হইছে। পাবলিকের নিরাপত্তার লাইগা রাস্তা বন্ধ কইরা রাখছে ট্রাফিক পুলিশ।
শাহবাগের প্যাসেঞ্জার সব নাইমা গেছে। কিন্তু ওই লোকটা নামে নাই। তার মানে ইনফরমেশন ঠিকাছে। একটা সিগ্রেট ধরানো দরকার। ইলেকট্রিক সিগ্রেটটা অফিসে রেখে আসছে। বাইরে এই গরমে ফুচকা খাইতেছে দুইটা মেয়ে। কলেজের ড্রেস পড়া। হাসতেছে একটু পরে পরে। তাকাইতেছে এইদিক-ওইদিক। হিরোইন খাইয়া গাছের নিচে ঝিমাইতেছে চিকনা একটা লোক। তিনটা ঝুড়িতে ফুলগুলা আলাদা করতেছে কয়েকটা বাচ্চা পোলা। ভালো মতো রেকি কইরা নিলো রানা জায়গাটা।
বাসটাও ঝিমাইতে শুরু করলো। এখন ছাড়তেছে। পুলিশও বুঝতে পারছে, ডাক্তাররা হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারেই পাবলিক মারতে মারে। পাবলিক মারা’র লাইগা উনাদের রাস্তায় আসার দরকার নাই। মোড়টা ঘুইরাই একটান দিয়া ফুট ওভারব্রীজ পর্যন্ত চইলা আসলো ড্রাইভার। পাশে একটা বন্ধু পরিবহন, পত্রিকায় লেখে হিউম্যান হলার। ড্রাইভারের বয়স খুববেশি হইলে পনের-ষোল। এমন কঠিন চোখ-মুখ মনে হবে বয়স ত্রিশ পার হয়া গেছে। কার উপর যে তার রাগ এইটা সে জানে না। কিন্তু মারাত্মক একটা রাগ আছে তার চোখে-মুখে। হঠাৎ কইরাই জোরে স্টার্ট দিলো আর ভেতরের মানুষগুলা লইড়া-চইড়া উঠলো সবাই। স্পেইসও ক্রিয়েট হইলো, আরেকটা লোক উঠতে পারলো।
ডানপাশের লোকটা অস্থির হয়া উঠলো তখনই। জানালায় উঁকি দিয়া কারে জানি খুঁজতে থাকলো। তখনই দুইদিনের দাড়ি না কাটা শ্যামলা পঁয়তাল্লিশ বছরের একজন লোক তার কাঁধে হাত রাখলো। চমকাইয়া উঠলো সে। কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকলো শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসার চোখে, তারপর সরে আইসা তারে বসার জায়গা কইরা দিলো। যখনই সে নাইমা যাইতে থাকলো, রানা দেখলো একটা পাতলা কাগজের খাকি খাম সিটের ওপর পইড়া আছে। কৃষ তাঁর ওপর বইসা পড়লো। রানা নিশ্চিত হইলো এইটাই তাইলে কৃষ।
লোকটার চোখেমুখে অথরিটির ভাব পরিষ্কার। সারাক্ষণ জানালা দিয়া বাইরে তাকাইয়া আছে। খুব বেশি দিন সম্ভবত হয় নাই যে সে ঢাকা আসছে। দুয়েকবারের চিনা জায়গাগুলারে রিকল করতেছে। শাহবাগ থিকা ফার্মগেট। ফার্মগেটে আইসা আর বাস চেইঞ্জ করলো না সে। ফার্মগেট থিকা শ্যাওড়া-পাড়া পর্যন্ত আসলো। নামার জন্য উঠে দাঁড়াইলো কৃষ। রানাও তার পিছন পিছন। খিজিরও সামনে থিকা আগাইয়া আসছে। একরকম এসকর্ট কইরা, একজনের ধোনের সাথে আরেকজনের পাছা লাগাইয়া, আগাইতে থাকলো তারা। ভাগ্য ভালো এরা কেউই গে না তা নাইলে সিনটা বেশ ইরোটিকই হইতে পারতো বা হইলোই গে, পাবলিকলি পর্ন না হয় আমরা দেখি না, কিন্তু ইরোটিক সিন কি দেখি না! যেমন চলতি রিকশায় গার্লফ্রেন্ডরে কিস করে ইয়াং পোলাপানেরা। মাঝবয়সী মাইয়ারা ফেইসবুকে তাঁদের ইয়াং বয়ফ্রেন্ডরে কয়, কুলফি আইসক্রীম খামু আমি। এইরকম।
বাস থিকা রাস্তায় নামার লাইগা যেই পা’টা বাড়াইলো কৃষ, খিজির তার পা’টা পিছনের দিকে উঁচা কইরা দিলো। কৃষ যেহেতু সামনের দিকে তাকাইয়া কাউরে খুঁজতেছিলো সে ভাবলো যে নিজেই ষ্টেপ’টা মিস করছে।
যেমন মিস করছে আসাম ও ত্রিপুরা। ওরা যদি তখনই পূর্ব-বাংলার সাথে চইলা আসতো পাকিস্তানে, আজকে তারা ইন্ডিপিডেন্ট প্রভিন্স হিসাবেই থাকতে পারতো। ১০০ বছর পরে আইসা এখনো ‘বাঙালি হঠাও’ আন্দোলন করা লাগতো না! রানা ভাবে। কানা রে কানা, মানুষ ত প্রকৃত বস না, মেশিনই হইলো আসল! মাও-এর ‘বন্দুকের নলই আসল ক্ষমতার উৎস’ এই বাক্যের কারেক্ট ইন্টারপ্রিটেশন নকশালবাদীরাও যেমন এখনো করতে পারে নাই। অ্যাক্টিভিস্টরা তো এখন তাদেরকে ঘেরাও কইরা ফেলছে গরম গরম বাতাস দিয়া। এরা কি আর কোন কূল-কিনারা করতে পারবে রিজিওনাল পলিটিক্সের?
খিজির একটু অবাকই হইলো রানা’র স্লোনেস দেইখা। মাঝে মধ্যে কি জানি ভাবে খালি। পিছন দিক ফিরা খিজির ধইরা ফেললো কৃষ’রে ‘আরে ভাই করেন কি, করেন কি…’ বইলা। একটা হাত দিয়া হাত ধরলো, আরেকটা হাত দিয়া নাকের কাছে সুগন্ধিমাখা একটা মৌল রুমাল নিয়া রাখলো। চাকমা চিত্র আঁকা। পিছনের থিকা রানাও সোজা কইরা ধরলো তারে, যেন হেল্প করতেছে। রানা এবং খিজির কৃষরে হেল্প করতে করতে একটা সবুজ সিএনজি স্কুটারে তুইলা নিলো।
*************
কুড়ি মিনিট পরে। তখন তোমারে নাই মনে – এইরকম একটা জটিল অবস্থা, কৃষের। ধীরে ধীরে চোখ খুলে সে।
মেসবাড়ির মতো একটা ঘর। পাশাপাশি দুইটা খাট পাতা। মাঝখানে একটুখানি জায়গা। বিছানার উপর এলোমেলো করা কয়েকটা বালিশ ও চাদর। একটা খাটে কৃষ বসা, ঝিমাইতেছে; পিছনে হাত বাঁধা। কৃষের মুখামুখি খিজির বইসা আছে। রানা পাশে দাঁড়ানো। একটা প্লাস্টিকের জগ থিকা ময়লা কাঁচের গ্লাসে পানি ঢালে। সেই পানি জোরে ছুইড়া মারে কৃষের মুখে।
সে কি তিস্তার জলে হাবুডুবু খাইতেছে নাকি? কৃষ ভাবে, ধড়ফড়াইয়া উঠে। উঠতে গিয়াই টের পায় তার হাত বাঁধা পিছনে, ফারাক্কা বাঁধের মতন। খিজির ঠেলা দিয়া আবার বসায় তারে।
‘কি মামা, ঢাকায় চইলা আসছো! এখন সিনেমা হলে তোমারারেই দেহাইবো। জাগো বাবা জয় হো!’
শুরু হইলো খিজিরের খিস্তি। রানা কৃষের ঝাকড়া চুলের পিছনে টান দিয়া মুখটা উপরের দিকে তুইলা দেয়। একটা কাগজ সামনে ধইরা বলে “হু আর দে? ওয়াট আর ইউ প্ল্যানিং টু ডু ইন আওয়ার কান্ট্রি?” তারপর তারে ছেড়ে দেয়।
এইরকম আচরণে কৃষও খেইপা যায়; কয়, ‘ইউ ডোন্ট নো অ্যানিথিঙ্ক। ইউ ডোন্ট নো হুম ইউ আর ডিলিং উইথ!’
এই বাণী শোনার পর রানার কিছু বলা লাগলো না। খিজির তার হাড্ডি নামের প্রতি সুবিচার কইরা বাংলা মাইর শুরু করলো। চাইরটা চটকানা খাইয়াই মাথা ঘুইরা গেলো কৃষের। মুখ দিয়া লালা পড়তে থাকলো।
‘নাউ ইটস টাইম টু স্পিক!’ রানা কৃষের দিকে না ফিরাই বলে। কৃষ ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে। পরিষ্কার বাংলায় বলে, ‘আমরা সবাই বন্দী এইখানে। আপনারা অন্যায় করচেন। আপনারা আমায় মারতে পারেন না।’
এরপরে খিজিরের প্রতিভা আর বেশিক্ষণ দেখাইতে হইলো না। পাঁচ মিনিট পরেই ‘কচ্চি, কচ্চি…’ বলে কুঁকড়াইয়া উঠলো কৃষ। ‘দে আর দ্য কন্ট্রাক্ট ইনফরমেশন অফ সিআইএ অ্যান্ড আইএসএস এজেন্টস ইন বাংলাদেশ।’
‘এইগুলা কার কাছে দেয়ার কথা?’ রানা জিজ্ঞাসা করে।
‘র’এর কাছে।’ মুখ নিচা কইরা কয় কৃষ।
খিজির চিল্লান দিয়া ওঠে, ‘হালায় ত ডাবল এজেন্ট!’
রানা টের পায় একটা কাহিনির প্যাঁচের ভিতর পড়তে যাইতেছে সে। ইনফরমেশনের এইটা খালি শুরু।
‘হাউ কুড ইউ ডু দিস?’ রানাও জিগায় তারে।
‘বাংলাদেশে কাজ করতে হ’লে আমাদের র’এর সাথে কোয়ালিশনে যেতেই হবে। উই ক্যান্ট এভয়েড দ্যাট। জুডো’র কৌশলের মতো প্রতিপক্ষের সাথে যেতে হবে এবং অপেক্ষা করা একটা মোমেন্টের জন্য, যখন হয়তো উই ক্যান ষ্ট্রাইক ব্যাক। অথবা তোমাদের মতো অর্বাচীনের কাছে ধরা পড়া। তুমি জানো, তোমার গর্ভমেন্টের এইটা নিয়ে আরো বিপদে পড়বে। ফেলতেও পারবে না, হজমও করতে পারবে না।’ একটানে হড়বড় কইরা সে কথাগুলা বলে।
‘গর্ভমেন্টের লোক কে?’ রানা জিগায়।
কৃষ সেই নামটাই বলে যেইটা রানাও ভাবতেছিল।
‘শুয়োরের বাচ্চা, এই লিস্ট পাওয়ার পরে তোরেও যে মরতে হবে, এইটা তুই জানিস!’
‘এটা ছাড়া আমরা কি করতে পারি, দাদা!’ কৃষ হাউমাউ কইরা কানতে থাকে।
‘আগামী দুইদিন তুই এই জায়গা থিকা নড়বি না।’
‘ডি ডি চ্যানেলের মহাভারত সিরিয়াল পুরাটা দেইখা শেষ করবি।’ খিজির কাম দেয় তারে।
রানার খালি দুইটা দিন দরকার। এর মধ্যেই যা কিছু বোঝা-পড়া করা দরকার, সে কইরা নিবে। খিজিরও বুঝলো যে, কথা শেষ।
কৃষ দেখলো, তার মুখে চেপে বসতে যাইতেছে ময়লা ধরণের প্রতিদিন একটা রুমাল।
তারপর কালো বরফের ভিতর ডুবে যাইতেছিল তার চেতনা।
ঢাকা থিকা দূরে, পানাউল্লাহর চরে…
চেতনার পথে তখন পথ হাঁটতেছিল খোকা। এই কড়া রইদে বিরক্ত হইতেছিল নীলাভাবী। যদিও তাঁর ভালো লাগতেছিল, এই হেঁটে যাওয়া। কিন্তু রইদ কি আর এতো রোমাণ্টিক; মাটির শরীর থিকা সে ঘাম বাইর কইরা ছাড়ে। পারফিউমের ঘ্রাণ কতোক্ষণ আর ঢাইকা রাখতে পারবে বগলের গন্ধ। এই ভয় শে পাইতেছিল। বিআরটিসি’র এসি বাস থিকা ভৈরবে নামার পরে কমলপুরের একটা ছাপড়া দোকানে বইসা গরুর দুধের চা খাইলো ওরা। কিছুক্ষণ এই হাঁটহাঁটি করা ভালোই লাগতেছিল নীলাভাবী’র; গাছের ছায়া, দুয়েকটা রিকশা, ভ্যান, টমটম আর অনেকক্ষণ পরে পরে একটা বাস, রাস্তায়। দুপুরবেলায় মানুষজন নাই খুব একটা। শম্ভুপুর পার হওয়ার পরে একদিকে বিলের পানি আর আরেকদিকে রেললাইন। গ্রাম-বাংলা আর গ্রাম-বাংলা নাই, মেডিভেল ইংল্যান্ড যেন আরেকটা। রেললাইনটা যেন যাদু-বাস্তবতা কোন লাতিন আম্রিকার। নীলাভাবী কইলো খোকা’রে, চলো রিকশা নিয়ে যাই। খোকাও সেইটাই চাইতেছিল, টাকা না থাকাটারে সে জাস্টিফাই করতেছিল তার রোমাণ্টিকতা দিয়া, যদিও কেউ জিগাইলে সে নিজে এইটা স্বীকার করবে না; বলবে, আমার স্বীকার করার কিছু নাই!
এখন স্বীকার করার কিছু থাকুক বা না থাকুক, রিকশা নেয়াটা বেটার। আর চাইতে না চাইতেই যখন রিকশা পাওয়া, তখন জীবন’রে রোমাণ্টিক না ভাবার আর কি কারণ থাকতে পারে! রিকশাতে উইঠা খোকা নীলাভাবী’র শরীরের সুঘ্রাণ পায়। এই গন্ধও গ্রাম-বাংলারে আর গ্রাম-বাংলা থাকতে দেয় না, ঢাকা শহর বানাইয়া ফেলে। যেইখানে নীলাভাবী আছে, সেইটা আর ভৈরববাজার থাকে কেমনে; ওইটা ত তখন ঢাকা শহর। এত এত জিনিস দুনিয়ায়, অথচ ছোট্ট একটা ইলিমেন্ট দিয়াই আমরা দুনিয়ারে ডিফাইন কইরা ফেলতে পারি।
নীলাভাবী অনেকদিন ধইরাই ঢাকার বাইরে আসতে চাইতেছিল। নীলাভাবীর সাথে খোকা’র প্রথম পরিচয় ফেসবুকে। খোকারে প্রথমে পাত্তা দিতেন না উনি। একদিন থাকে তো তিনদিন নাই। এইরকম কইরা জমে নাকি। কিন্তু সে মাঝে-মধ্যে স্ট্যাটাসে আইসা এমন কমেন্ট কইরা যায় যে, উনার সারা গা কাঁপতে থাকে। ইনবক্সে আইসা এর ওর কবিতার লাইন লিইখা যায়। ব্যস, এইটুকুই। নীলাভাবী বুঝতে পারেন ইনিশিয়েটিভ আসলে উনারেই নিতে হবে। একদিন দেখা করেন, কসমো লাউঞ্জে। দেখা গেলো, লতা-পাতায় তার জামাইয়ের পরিচিত এক বন্ধুর খালাতো ভাই সে। বাসায় গিয়া নীলাভাবী তার জামাই’রে বলেন। জামাই ভাবেন, ভালোই, তাইলে তার অফিস কলিগের সাথে অ্যাফেয়ার নিয়া এত মোরাল চাপে ভুগা লাগবো না তারে। বলেন, বাসায় দাওয়াত দিতে। উদারতা দেখাইতে চান উনি। যাতে অফিসের কলিগ’রেও তার জামাইসহ বাসায় দাওয়াত করতে পারেন উনি। আফটার অল, সবকিছুই হইলো সোশ্যাল অ্যাফেয়ারস। সোশ্যাল-এর বাইরে আর কি মিনিং আছে লাইফের!
আজকে যে নীলাভাবী আর খোকা পানাউল্লাহর চরে যাইতেছে, সেইটাও একটা সোশ্যাল কজ-এরই ব্যাপার। একাত্তরে এইখানে একটা গণহত্যা হইছিল। পাকিস্তানি আর্মিরা অনেকগুলা মানুষ’রে এইখানে মাইরা তারপর গণকবর দিছে। একটা ফেইসবুক পেইজ থিকা ওরা ইনিশিয়েটিভ নিতেছে, যতগুলা গণহত্যার স্পট আছে সবগুলারে চিহ্নিত করার। তারপরে একটা আর্কাইভ করা হবে। ১৯৭১ যে ইতিহাসের একটা বড় গণহত্যা’র সময়, সেইটার ফ্যাক্টগুলা’রে ভিজিবল করা লাগবে। খোকা এই পেইজের সাথে জড়িত না; কিন্তু সে নীলাভাবী’রে এইটার কথা বলছিল। নীলাভাবী’র দেইখা খুবই অন্যরকম লাগলো। উনার বড় চাচা মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছিলেন; ভাবলো, এইটা কি রকম না, কতগুলা মানুষ’রে খামাখাই মাইরা ফেললো কতগুলা মানুষ! এমনি এমনিই! এইটার কোন মানেই নাই। উনি খোকা’রে বললেন, চলো যাই! নীলাভাবী’র আগ্রহেই এইখানে আসা। খোকার কাছে এইগুলা মোস্টলি আজাইরা লাগে। মানুষের জীবন তো একরকম আজাইরাই। কিন্তু নীলাভাবী’র আবেগ তারেও কাঁপায়।
খোকা তখন জিগায় নীলাভাবী’রে; আচ্ছা এই যে পর্ণগ্রাফি’র সাইটে গিয়া মুক্তিযুদ্ধের প্রচার, এইগুলা’রে কি আপনি সার্পোট করেন? নীলাভাবী’র হাসি পায় খোকার মুখের দিকে তাকায়া। কি যে সিরিয়াস! দুনিয়ার সবচে জটিল কোশ্চেন’টা সে খুঁইজা বাইর করছে। তাও কোন ঘরের ভিতর উত্থিত হইলে কথা ছিল; এইখানে, এই খোলা রাস্তায়, এই প্রশ্নই আসছে তার উদাসি মনে; অথবা অনলাইন দুনিয়া এইরকমই, আমাদের ভাবতে-পারাটাই আমাদের রিয়ালিটি। নীলাভাবী হেবিটুয়েটেড হওয়ার ট্রাই করতেছেন খোকার এই রিয়ালিটিতে। একটা অ্যাডভেঞ্জারই একরকমের।
নীলাভাবী বলেন, না, করি না।
খোকা স্যাটিসফাই হয় না, কয়, কেন সার্পোট করেন না?
নীলাভাবী ওই রিয়ালিটিতে ঢুকতে চান না বইলা বলেন, এইগুলা তো ভালো না।
খোকা বলে, না, উদ্দেশ্য’টা যেইরকম মহৎ, পদ্ধতিও তো একইরকমের মহৎ হওয়া দরকার। তাই না?
নীলাভাবী’র বিরক্ত লাগে এইরকমের আজাইরা পন্ডিতি, কয়, ‘তাইলে মহত্ব কি জিনিস, সেইটা তুমি আবিষ্কার কইরা ফেলছো?’
খোকা থতমত খায়; এইরকমটা সে ভাবতে পারে নাই। তখন সে চুপ কইরা যায়।
নীলাভাবী প্রসঙ্গ পাল্টায়, পানাউল্লাহর চর নিয়া আরো লাইট টাইপের কোশ্চেন করতে থাকে; যে, এইরকম প্লেইন জায়গার নামের শেষে চর কেন? আর পানাউল্লাহ বা কে? সে কি এই চর-এর আবিষ্কারক? যেমন হুমায়ূন আহমেদ-এর একটা গল্পে আছিলো না, শুভ্র’র চর? খোকার নামে কোন চর আছে নাকি? খোকার চর কোনটা?
এইরকম প্রশ্নের পর প্রশ্নে খোকার মন আবার ভালো হইতে থাকে। সে ভুইলাই যায়, কেন আর কি কারণে মন-খারাপ হইছিলো তার। আর চারপাশ এতোটাই স্মুথ যে মনেহয় সাঁতার কাটা-ই তো যায়, এই বাতাসে!
তখন তার মনেহয়, অহেতুক মরে-যাওয়া মানুষগুলার কথা। মনেহয় এই বাঁইচা থাকা, অহেতুক-ই তো, তাই না?
অথচ রানা ভাই খালি হেতু খুঁইজা বেড়ায়, হেতায় আর হোতায়; বিরক্তিকর একটা প্রাণী। দুইদিন পরে পরেই ফোন দিয়া কইবো, এইটার কোড বাইর করো, ওই সাইটার ভিত্রে ঢোকো। আর বাল, আবালের মতো বানানো এক একটা সাইট। এইগুলা পোলাপাইনেই পারে। খামাখা ওরে জড়ায় এইসবে। মানে, খোকার যে মেরিট যে আছে, এইটা তো সেইটার একটা অপমান। কয়দিন আগে ফোন কইরা কয়, এই মুক্তিযুদ্ধের যে সাইটগুলা আছে, সেইগুলা আসলে কারা চালায়, র্যাব? নাকি ইন্ডিয়ান বায়িং হাউসগুলা? এডমিন কারা কারা? তারপরে ঢুইকা নিজেই অবাক হয়া যায় খোকা, এরমধ্যে অনেকগুলার ফান্ডিং আসে আইএসএস’র কাছ থিকা! ইউএসএইডও আছে, ইন্ডিয়ান অ্যাম্বেসী, চীন, ইরান, মিডলইস্ট, আম্লীগ, বিএনপি, জামাত, কমিউনিস্ট – কারা নাই! এক একজনের এক একটা মুক্তিযুদ্ধ! দুনিয়ার সব জায়গাতে আসলে সবাই আছে বা দুনিয়া আসলে যে যেইরকম ভাবতে চায়, সেইরকম কইরাই বানাইতে থাকে। এইগুলা বুঝতে পাইরা খোকার খুব আপসেট লাগে। আর তখনই নীলাভাবী তারে ফোন দেয়। তখন সে তার ফ্রাস্টেশনের কথা নীলাভাবীর সাথে শেয়ার করতে পারে যে, প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ আসলে কুথায়! উনারও খারাপ লাগে। পরদিন সকালবেলাতেই তারা চইলা আসে। পানাউল্লাহর চরে।
কতগুলা লেইখা রাখা নাম তারা দেখতে থাকে। খোকা হঠাৎ কইরাই ভাবে, এই যে নাম, এরা তো খালি নাম না, এরা তো মানুষ ছিল, হাসতো, ভাত খাইতো, কাইজ্জা করতো, ফুটবল খেলতো, কুটনামি করতো, হয়তো মোবাইল ফোনে কথা কইতো না, ইন্টারনেট ইউজ করতো না, কিন্তু ওরাও তো মানুষ; ছিল, এখন নাই।
যেমন রানা ভাই। এই আছে তো এই নাই। খোকা রানা ভাই হইতে চায় না। সে হারাইয়া যাইতে চায় ধীরে ধীরে; এতোটাই স্মুথ যে মনে হবে, সে আসলে কোনদিন আছিলোই না, নাই-ই আসলে সে, নাই।
সে আসলে আজকে একটু হাল্কা হইতে আসছে। আজকে রাতে অনেক বড় একটা কাজ আছে ওর। সবগুলি সাইট ডাউন করতে হবে। কিশোর, মুসা আর রবিনরেও সে বইলা রাখছে। নিজেরে অনেক বড় বড় লাগে ওর। তার চাইতে বড় ব্যাপার হইলো একাও লাগে। আর এই ভাবনাটা সে পার হইতেই পারে না।
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024
- ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ - আগস্ট 9, 2024