অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ বাংলাদেশি সিনেমা (২)
।। আগের পোস্ট।।
“ভাতের খিদা লাগলে দাইমা গো,
দাইমা, পানিতে কি সারে গো?”
/রূপবান
শুরু’র দিকের সিনেমা…
১৯৫৯ সালে রিলিজ হওয়া ৪টা ছবিই ক্রুশিয়াল মনেহয় আমার কাছে, বাংলাদেশি সিনেমার হিস্ট্রি বুঝার লাইগা। ৪টা আলাদা আলাদা ট্রেন্ডরে লোকেট করা যাইতে পারে এখন, এই ২০২০ সালে বইসা।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
এই বছরের যেই ছবিটার নাম বেশি শোনা যায় সেইটা হইতেছে – জাগো হুয়া সাভেরা, ডিরেক্টর আছিলেন আখতার জং কারদার, উনি এসিসেন্ট হিসাবে নিছিলেন জহির রায়হান’রে, আর সিনেমার কাহিনি লিখছিলেন পাকিস্তানের উর্দু ভাষার কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির একটা অ্যাডাপ্টশন ছিল কাহিনিটা। ইন্টারেস্টিং জিনিস হইলো, এই সিনেমা পাকিস্তানের সিনেমাহলগুলাতে ‘মুক্তি’ পায় নাই, পলিটিক্যাল ঝামেলার কারণে, কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ পাইছিলো, মস্কো’তে। ইন্টারেস্টিং না ব্যাপারটা! 🙂 এখনো অনেক সিনেমাই, মানে ‘আর্ট-ফিল্ম’ কিন্তু বাংলাদেশে বানানো হয় প্রাইজ-টাইজ পাওয়ার লাইগাই, সিনেমা হলে চললে ভালো, না চললেও কোন সমস্যা নাই; বা আর্ট-কালচারের লোকজন যদি বুঝে, কথা-বার্তা কয়, তাইলেই এনাফ। যেই পাবলিক ‘আর্ট’ বুঝে না – তাদের লাইগা আমরা সিনেমা বানাবো নাকি! এইরকম যেই ধারা, সেইটার শুরু হিসাবে এই সিনেমাটারে দেখতে পারেন। দুসরা ঘটনা হইলো, তখন সমাজতন্ত্রের জয়-জয়কার, এই কারণে মার্কসিস্ট ঘরানার জিনিস প্রাইজ-টাইজ পাইতো; আর এখন দেখবেন, লিবারাল ইস্যুগুলা নিয়া অনেক হাতি-ঘোড়া মারা হয়। কারণ আপনি যদি ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ পাইতে চান, সো-কল্ড ইন্টারন্যাশনাল ইস্যুগুলার লগে আপনারে কানেক্ট করতে পারতে হবে তো! যেমন ধরেন, বাংলাদেশ’রে ইউরোপ-আম্রিকার আর্ট-অথরিটি’রা তো চিনে গার্মেন্টস দিয়া, পটেনশিয়ার টেররিস্টদের আস্তানা হিসাবে… তো, উনাদের নজরে আসতে হইলে, এইসব ইস্যু নিয়াই সিনেমা বানাইতে হবে; এইরকমের ঘটনা ‘নতুন’ কোন ব্যাপার না, সিনেমা জিনিস’টা শুরু হওয়ার সময় থিকাই ছিল। যদিও “জাগো হুয়া সভেরা” বরং এক্টা ফেইলড এটেম্পট হিসাবেই রিড করা হয় মনেহয় এখন। কিন্তু যারা ঋতিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম বা সতজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী’র ভিজ্যুয়াল পছন্দ করেন তাদের এই সিনেমার ভিজ্যুয়াল পছন্দ হওয়ার কথা; ১৯৫৯ সালের গ্রাম-বাংলা কি রকম ছিল, সেইটার দৃশ্যগুলা পাইবেন; কিন্তু মুশকিল হইলো এনগেইজমেন্ট’টা মিসিং (পুরাটাই ভাষার কারণে না), অনেকবেশি ডকুমেন্টারি মনে হওয়ার কথা; যেন বিদেশিদের ক্যামেরা, বাংলার জন-জীবনের ছবি ফুটায়া তুলতেছে! আর সবচে বড় ব্যাপার হইতেছে রানওয়ে বা আন্ডার কন্সট্রাকশন এর মতো এইটা বাংলাদেশের পাবলিকের জন্য বানানো সিনেমা না, বরং বিদেশের কাছে, মানে ইউরোপ-আম্রিকার কাছে দেখানো যে, দেখেন, বাংলাদেশ কি জিনিস! তো, এই ধারাতে এরপরে আরো অনেক ডিরেক্টর, সিনেমা পাইছি আমরা; পাইতেছি।
[youtube id=”z4t145JEBPU”]
সেকেন্ড সিনেমাটার নাম হইতেছে, আকাশ আর মাটি, ডিরেক্টর আছিলেন ফতেহ লোহানী। ফতেহ লোহানী পরে আসিয়া (১৯৬০) আর সাত রং (উর্দু, ১৯৬৫) বানাইছেন, কিন্তু কোনটাই এই সিনেমার মতোই, তেমন কোন ব্যবসা করতে পারে নাই মনেহয়। এই সিনেমাটা নিয়া তেমন কোন ইনফরমেশন নাই; তবে যট্টুক ধারণা করা যায়, এক রকমের কলকাতার আর্ট-কালচারের একটা টোন মেবি থাকার কথা, কারণ কাহিনি ছিল ইন্ডিয়ান রাইটারের (বিধায়ক ভট্টাচার্য), নায়কও ছিলেন ইন্ডিয়ান (প্রবীর কুমার)। যেইটা একদিক দিয়া পাবলিক যেমন খায় নাই, ডিরেক্টরও এক রকমের এন্টারটেইনমেন্ট সার্ভ করতে চাইছেন এক রকমের ‘শিক্ষিত মিডল-ক্লাসের’ জন্য যারা তখনো সিনেমা হলে যাইতে শুরু করে নাই, বা পরে টিভি-নাটকের কনজ্যুমার হইতে পারছেন। এই ধারাতেও সিনেমা হইছে কিছু বাংলাদেশে, এখনো হয়; কিন্তু পাবলিক যদি সিনেমাটা খাইলে ডিরেক্টর’রা চিন্তায় পইড়া যান, কি ভুল উনি করলেন! 🙂 এইরকম।
থার্ড সিনেমাটা ইর্ম্পটেন্ট। নাম – মাটির পাহাড়। ডিরেক্টর মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। উনারে চিনবেন উনার আরেকটা সিনেমার নাম দিয়া – বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২), এইটারও ডিরেক্টর উনি। ১৯৭৪ সালে “ঈশা খাঁ” নামেও একটা সিনেমা বানাইছিলেন। (মোট ৯টা সিনেমা বানাইছেন উনি।) মাটির পাহাড় সিনেমার কাহিনি, সংলাপ সৈয়দ শামসুল হকের। (সৈয়দ শামসুল হক নিজেও কিন্তু একটা উর্দু সিনেমা বানাইছিলেন ১৯৬৬ সালে “ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো” নামে।) এফডিসি থিকা মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমা এইটা। এইটা নিয়াও তেমন কোন ইনফরমেশন নাই, কিন্তু যদ্দূর ধারণা করতে পারি, এই সিনেমাও খুব একটা চলে নাই। নায়ক মেবি পশ্চিম পাকিস্তানের ছিলেন, আর হইলে এইটা তখন একটা কারণ হইতে পারে কিনা, আমি শিওর না। কিন্তু আমার ধারণা, এইটা একটা ‘গুড ট্রাই’ ছিল। হইতে পারে আইডিয়ালিস্টিক জায়গা থিকা ডিল করছেন বেশি (উনার ‘বড় ভালো লোক ছিল’ মাথায় রাইখা বলতেছি, যেইটারে বাংলাদেশি আর্ট-ফিল্ম মনেহয় আমার), কিন্তু এখন যেইটারে ‘বাংলাদেশি’ সিনেমা বলতে চাই আমরা, সেইটার কোন টোন হয়তো থাকার কথা।
লাস্ট, আর সবচে হিট সিনেমা হইতেছে, এহতেশামের, “এ দেশ তোমার আমার”। জহির রায়হান এই সিনেমাতেও এসিসটেন্ট ডিরেক্টর ছিলেন। কাহিনিটা খুবই কনটেম্পরারি। i কাহিনিটাও এতহেশাম সাহেবের লেখা, কিন্তু ইন্টারেস্টিং হইলো সংলাপ আর মিউজিক করছিলেন খান আতাউর রহমান, যিনি পরে এতহেশাম সাহেবের পপুলার ধারাটারে অনেক দূর পর্যন্ত সাবস্ক্রাইব করতে পারছিলেন। এতহেশাম সাহেব হিট সিনেমা বানাইতে পারতেন, কেমনে পারতেন, সেইটা সিনেমার কাহিনি দিয়াই টের পাওয়া যায় কিছুটা; কনটেম্পরারি ইস্যুগুলারে তিনি সিনেমায় নিয়া আসতে পারছেন। কিন্তু পপুলিস্ট সিনেমার একটা জিনিস মাথায় রাখলে মেবি ভালো; খালি বাংলাদেশেই না, হলিউড, বলিউড প্রায় সব জায়গাতেই এই টেনডেন্সিটা দেখবেন, পপুলার পলিটিক্যাল থটের জায়গাটারে এক্সপয়েট করেন। যেমন, এই সিনেমা’তে একটা সাইড রোল আছে সুভাষ দত্তের, যে নায়েব, প্যাঁচকি লাগাইতে চায়, আর সে হইতেছে হিন্দু, কানুলাল। কলকাতা’র সিনেমা’তে যেমন একটা ফানি কারেক্টার পাইবেন “বাঙ্গাল”; আবার বোম্বের হিন্দি সিনেমাতে পাইবেন “বাঙ্গালি বাবু” নামে ফানি কারেক্টার; এইকরম, কিছুদিন আগেও ছিল; এখন প্যাটার্ন’টা এতোটা স্ট্রেইট না হইলেও, প্রেজেন্সটা কাজ করেই। এই জিনিসটা মাথায় রাখলে ভালো। তবে একইসাথে একটা ভালো জিনিস হইলো, পপুলার জিনিসগুলা নিতে হেসিটেড করেন নাই উনি; হিন্দি সিনেমার ইরোটিসিজম যেহেতু পাবলিক খায়, বাঈজী নাচ রাখাটারে “ভিনদেশী সংস্কৃতি” বইলা বাদ দেন নাই। সিনেমাটার আরো কয়েকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে, রহমান সিনেমাতে ভিলেন হইলেও খান আতা’রে অনেকটাই আউট পারফর্ম করে গেছেন; যার ফলে এর পরে নায়ক হিসাবে হিট হইছিলেন। তো, এহতেশাম সাহেব ১৩টা সিনেমা বানাইছেন। উনি পপুলার সিনেমা বানাইছেন, এন্টারটেইনমেন্ট দিতে পারছেন, আর এই কারণে উনি ‘বাজে’ ফিল্ম-মেকার না মনেহয়।
[youtube id=”Ewhqh2T48-Q”]
মানে, এই ৪টা সিনেমা, পুরাপুরি আলাদা রকম না হইলেও, চার রকমের ট্রেন্ড বা ধারারে ইন্ডিকেট করে মনেহয়। কিন্তু বাংলাদেশের সিনেমা আসল ঘটনাটা আসলে ঘটে, ১৯৬৫ সালে, সালাউদ্দিন সাহেব যখন রূপবান সিনেমা বানান। বাংলাদেশি সিনেমার শুরু হিসাবে এই সিনেমাটারে নানান কারণেই মার্ক করা দরকার ।
অ্যামেচার সিনেমার তিনটা ফিচার
তো, রূপবানের আলাপ শুরু করার আগে আরো কয়েকটা জিনিস বইলা রাখা দরকার। ১৯৫৬ টু ১৯৬৫ – এই টাইমটারে প্রি-রূপবান টাইম বলতে চাই আমি, যেইটা মোস্টলি অ্যামেচার সিনেমা বানানোর যুগ। যদিও ১৯৫৭ সালে এফডিসি বানানো হইছে, সরকারি অনুদান দেয়া শুরু হইছে, দুই/চাইরটা সিনেমা হিটও হইছে, কিন্তু এন্টারটেইনমেন্ট বিজনেস হিসাবে পুরাপুরি শুরু হইতে পারে নাই।
এই সময়ের এটলিস্ট তিনটা ফিচার হাইলাইট করা যায়।
এর মধ্যে একটা হইলো, উর্দু সিনেমা। কারণ, ঢাকায় সিনেমা বানানো তো শুরু হইলো, কিন্তু কোন বাংলা সিনেমা-ই ঢাকার সিনেমা হলগুলাতে ভাত পায় নাই। ১৯৫৬ থিকা ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত টোটাল ৪৮টা সিনেমা রিলিজ হইছিল ঢাকায় (ইনক্লুডিং রূপবান), এর মধ্যে ২০টাই ছিল উর্দু। (সূত্র: উইকিপিডিয়া) ১৯৬৪ সালের ২০টা ছবির মধ্যে ৯টা আর ১৯৬৫ সালের ১১টা সিনেমার মধ্যে ৬টাই ছিল উর্দু।
পশ্চিম পাকিস্তানের হলগুলাতে তো মনেহয় কোন বাংলা সিনেমা রিলিজই দেয়া যায় নাই। ঢাকার সিনেমা হলগুলাতে আগে থিকাই হিন্দি, উর্দু, ইংলিশ সিনেমা চলতো। তো, দেশ যেহেতু পাকিস্তান, উর্দু সিনেমা তো বানানো যাইতেই পারে! এক তো হইলো, বাংলাদেশে সিনেমাহল যেহেতু খুববেশি ছিল না, একটা সিনেমা বানাইলে সেইটা যাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সিনেমাহলেও চালানো যাইতে পারে, এইজন্য উর্দুতে বানাইলে একটা ব্যবসায়িক সুবিধা থাকার কথা। আর বাংলাদেশের সিনেমাহলে যেইরকম হিন্দি আর উর্দু সিনেমা দেখানোর রেওয়াজ ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা সিনেমা মার্কেট একদমই থাকার কথা না। (আবারও বলি, কিছু ডাটা থাকলে এই জিনিসটা হয়তো আরো শিওর হয়া বলা যাইতো; কিন্তু হিস্ট্রিক্যাল পারসপেক্টিভ থিকা এইভাবে দেখাটা ভুল হবে না মনেহয়।) ১৯৬২ সালে এহতেশামের চান্দা সিনেমা হিট হওয়ার পরে এই ট্রেন্ডটা বেশ চালু হয়া উঠার কথা ঢাকায়। এখন যারা উর্দু সিনেমা বানাইতেন (ইনক্লুডিং জহির রায়হান), তাদেরকে ‘গাদ্দার’ (মানে, দেশদ্রোহী) ভাবলে ভুলই হওয়ার কথা, বরং সিচুয়েশনটা উল্টাই ছিল, একটা ‘দেশ’ বা ‘রাষ্ট্র’রে আপহোল্ড করতেন উনারা। কিন্তু যতই একটা রাষ্ট্র হোক, উর্দু তো হিন্দির মতোই, বাংলা তো আর না!
………………………………………………………………………
এইরকম একটা ধারণা আছে যে, হিন্দি সিনেমার ‘আগ্রাসনের’ কারণে বাংলা-সিনেমা চলে না আর, ১৯৮০’র দিকে ভিসিআর চালু হওয়ার পরে বাংলা-সিনেমার ‘পতন’ শুরু হইছে, তারপরে ‘ডিশ কানেকশন আসার পরে ‘অপসংস্কৃতি’র প্রভাবে মারা গেছে। কিন্তু ফ্যাক্ট হিসাবে ব্যাপারটা খুব বেশি সত্যি না।
বাংলাদেশে বা ঢাকায় থিয়েটার হলে সিনেমা দেখানো শুরু হয় ১৯২০-৩০’র দিকে, লিমিটেড স্কেলে, দুয়েকটা জায়গায়; কিন্তু ১৯৪০’র পরে ব্যাপারটা আরবান স্পেইসে পপুলার হয়া উঠার কথা। ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ৯২ টা সিনেমা হল ছিল বইলা জানা যায়, কিন্তু ১৯৬৫’র আগে অইভাবে বাংলা সিনেমা বানানো শুরু-ই হয় নাই। তো, সিনেমা হলগুলা কি দেখাইতো তাইলে? মোস্টলি হিন্দি সিনেমাই। কলকাতার স্টুডিওগুলাতেও হিন্দি আর উর্দু সিনেমাই বানানো হইতো। ১৯৬৫’তে হিন্দি সিনেমা আমদানি ব্যান করা হইলেও উর্দু সিনেমাই চলতো।
এইখানে একটা জিনিস মার্ক করা দরকার, লেখার হরফ আলাদা হইলেও ওরালি হিন্দি আর উর্দু’র ডিফরেন্স মনেহয় খুব বেশি না। আরেকটা ব্যাপার হইলো হিন্দি বা উর্দু পরে সংস্কৃতের (বা ইংরেজ কলোনিয়াল চিন্তার) খপ্পরে পড়ে নাই; যার ফলে আমাদের বলাবলির যেই বাংলা সেইটা থিকা হিন্দি বা উর্দু’র যেই ডিসট্যান্স, ফোর্ট উইলিযামের বাংলার ডিসট্যান্স তার চাইতে অনেক বেশি। (এক্সাম্পল হিসাবে আদমি আর মানুশ – এই শব্দ দুইটার কথা ভাবতে পারেন; আদমি তো আমরা বাংলায় লিখতে পারি না, অথচ বলাবলির ভিতরে ছিল না – তা মনেহয় না।)
সিনেমা হলে উর্দু সিনেমা দেখানো বন্ধ হয় স্বাধীনতার পরে, ১৯৭২/৭৩ সালের দিকে। আমদানি না করার ব্যাপারে আইন থাকতে পারে, কিন্তু সিনেমা বানানো যাবে না – এইরকম কোন শর্ত না থাকলেও, বাংলাদেশে উর্দু সিনেমা বানানো হয় নাই আর। কিন্তু ১৯৮০’র দিকে ভিসিআরে সিনেমা দেখা শুরু হয়; ম্যাস লেভেলে আসতে হয়তো ধরেন আরো ৫/৭/১০ বছর টাইম লাগে। ১৯৯০-এ তো ডিশ কানেকশনে হিন্দি চ্যানেলে সিনেমা দেখাটা আবার এভেইলেবল হয়। মানে, ১৯৫০ – ২০২০, এই ৭০ বছরের মধ্যে খুব বেশি হইলে ১০/১৫ বছর বাংলাদেশের দর্শকরা হিন্দি সিনেমা ভিউয়িংয়ের বা বাজারের বাইরে আছিলেন। এই ১০/১৫ বছর বাংলা-সিনেমার জন্য বাংলাদেশের বাজার’টা এক্সক্লুসিভ ছিল।
তো, বান্দর’রে নিয়া তো আমরা হাসাহাসি করি যে, যা দেখে তা-ই করে। কিন্তু আমরা, মানুশেরাও আমাদের দেখাদেখির বাইরে খুব কম জায়গাই এক্সপ্লোর করতে পারি তো। মানে, আমরা যা দেখি, ফিল করি, তার ভিতর দিয়াই এক্সপেরিয়েন্সের জায়গাটাতে যাইতে হয়। মিডিয়াম হিসাবে সিনেমাহল যা দেখাইতো, তা-ই তো দেখতাম; এখন মাল্টিপল মিডিয়ামের অপশন থাকলেও যা যা আমরা দেখতে পাই, সেইটা খুব বেশি ওয়াইড চয়েসের ব্যাপার না। এই লিমিটেশনের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে পারলে ভালো।
মানে, আমি বলতে চাইতেছি, হিস্ট্রিক্যালি হিন্দি সিনেমা অনেক আগে থিকাই বাংলাদেশের সিনেমা ভিউয়িংয়ের জায়গায় একটা ফেনোমেনা হিসাবে আছে। এইটিইসের ঘটনা না, এইটা। আর ছিল বইলাই ভালো বা খারাপ – এইরকম না; কিন্তু ফ্যাক্ট হিসাবে মানতে না পারলে এই নিয়া আলাপগুলা ভুলভালই হওয়ার কথা।
………………………………………………………………………
যার ফলে একদিকে যেমন সিনেমাহল ছিল না, আরেকদিকে বাংলা সিনেমা চলতো না বইলা সিনেমা হলের নাম্বার বাড়তেছিল না। ডিম আগে না মুর্গি আগে অবস্থা! সিনেমা জিনিসটা যে সিনেমাহলের লগে রিলিটেড একটা ঘটনা, এইটা মাথায় রাখাটা মনেহয় দরকার। এখনকার টিভি-মোবাইল স্ট্রিমিংয়ের যুগে সিনেমাহলের নাম্বারটা এতোটা রিলিভেন্ট না, এই কারণে পয়েন্টা মিস কইরা যাইতে পারি হয়তো আমরা।
দুসরা জিনিস হইলো, সিনেমারে ভাবা হইছে আরবান এন্টারটেইনমেন্টের ঘটনা হিসাবে। গ্রামে-গঞ্জে, মফস্বলে সিনেমা হল তো ছিল-ই না, ঢাকা বা বড় কয়েকটা শহর বাদে অন্য কোথাও সিনেমাহল থাকার কথা না। তো, সিনেমার পাবলিক রিচ যে আরবান-সেন্ট্রিক ছিল – এই বাস্তবতা’টা মনে রাখলে মনেহয় বেটার। মানে, চাইলেও হাজার হাজর মানুশের সিনেমা দেখার কোন উপায় ছিল না। এর আউটকাম হিসাবে তখনকার সিনেমার ডিরেক্টরদের ভাবতে পারার কথা, গ্রামের লোকজন তো যাত্রা-ই দেখবে, সিনেমা তো তাদের জিনিস না! বা শহরে যারা থিয়েটার দেখেন, তারা-ই হবেন সিনেমার মেইন কাস্টমার। কিন্তু বাংলাদেশে তখন শহর কই! আর শহরের লোকজনই তো কম-ই। যার ফলে, অই সময়ের সিনেমা শহরের লোকদের চোখ দিয়াই গ্রাম’রে দেখা। বা এর পরেও এই দেখার চোখ’টা খুব একটা পাল্টায় নাই খুব বেশি।
লাস্টলি, সিনেমা তো একটা টেকনিক্যাল ব্যাপার; হিন্দি সিনেমার যেই টেকনিক্যাল সুপিয়রিটি, অভারঅল যেই ভিজ্যুয়াল এক্সপেরিয়েন্স, সেইটা বাংলাদেশে বানানো সিনেমাতে থাকার কথা না। মানে, টেকনিক্যাল জায়গা থিকা ১৯৬১ সালের হিন্দি মুঘল-ই-আজম আর কখনো আসেনি যদি কম্পেয়ার করেন ভিউয়ার এক্সপেরিয়েন্সের জায়গা থিকা, বুঝতে পারার কথা বাংলাদেশের সিনেমা তখনো অ্যামেচার ঘটনাই। এমন না যে, ‘কখনো আসেনি’ খুব বাজে সিনেমা বা ‘মুঘল-ই-আজম’ ভালো; বরং ব্যাপারটারে আর্টফিল্ম বা কর্মাশিয়াল ফিল্মের জায়গা থিকা দেখার অভ্যাসের কারণেই বাংলা সিনেমার হিস্ট্রিটারে দেখতে গিয়া ভুল করতেছি আমরা। ‘ভালো’ সিনেমা বানাইতে হইলে ‘পপুলার’ হওয়া যাবে না, বা ‘পুপলার’ সিনেমা বানাইতে গেলে নাচা-গানা থাকতে হবে, ‘আর্ট’ করা যায় না – ব্যাপারগুলা এইরকম লিনিয়ার না। যে কোন আর্টের মতোই সিনেমারও ভ্যারিয়েশন আছে, নানান রকমের লেয়ার আছে, ফাংশন আছে, কোন একটা এক্সপেক্টশনের জায়গা থিকা দেখতে গেলে পুরা জিনিসটারেই মিস কইরা যাওয়া হবে। অই সময়ে ঢাকার সিনেমাগুলা টেকনিক্যালি মুম্বাই থিকা যেই রকম পিছায়া ছিল, দিন যতো গেছে ডিসট্যান্সটা ততটাই বাড়ছে।
তো, এই তিনটা কারণে – সিনেমাহলের সংখ্যা কম হওয়া ও উর্দু ভাষার সিনেমা বানাইতে যাওয়া, আরবান ও অ্যামেচার অ্যাপ্রোচের কারণে ছোট একটা অডিয়েন্সের কথা ভাবা, এবং টেকনিক্যালি আপডেটেড না হইতে পারার জায়গা থিকা বাংলা সিনেমা ১৯৬৫ সাল পর্যন্তও ‘বাংলা সিনেমা’ হয়া উঠতে পারে নাই। যেই কয়টা সিনেমাহলই ছিল, হিন্দি আর উর্দু সিনেমা দখলেই থাকার কথা। (এগেইন, ডেটা দরকার!) খেয়াল কইরা দেখবেন, আবদুল জব্বার খান যে বাংলা সিনেমা বানাইলেন সেইখানে লাহোরের লগে টেক্কা দেয়ার একটা ব্যাপারই ছিল। কিন্তু সিনেমা আমদানির জন্য কলকাতা/মুম্বাইয়ের উপ্রে কম-বেশি ডিপেডেন্সি ছিল আমাদের সিনেমা হলগুলার ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে ইন্ডিয়া থিকা সিনেমা আমদানি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত।
তরে এই ৯ বছরে যেই ২৮টা সিনেমা হইছিল, সেইগুলার যে কোন সিগনিফিকেন্স নাই – তা না। ১৯৬০ সালে এহতেশামের “রাজধানীর বুকে” (দেখেন, শহর…) হিট ছিল। রহমান আর শবনম নায়ক-নায়িকা হিসাবে এস্টাবলিশড হইতে পারছেন। অই সিনেমা একটা গান “তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো / চাঁদ বুঝি তা জানে” তো এখনো মনে করা যায়। ১৯৬১ সালে “হারানো দিন”-ও সিনেমা হলগুলাতে চলতে পারছিল। এই সিনেমারও হিট একটা গান আছে, ফেরদৌসি রহমানের গাওয়া – “আমি রূপনগরের রাজকন্যা/রূপের যাদু এনেছি”। ১৯৬১ সালের আরেকটা ক্রিটিক্যাল মুভি হইতেছ জহির রায়হানের “কখনো আসেনি”। উনি যদিও পরে সিনেমাটারে নিয়া রিগ্রেট করছেন এইভাবে যে, সিনেমাটা উনি “২০ বছর আগে বানায়া ফেলছেন”; মানে, ২০২০ সালে বানাইলেও ব্যাপারটা একই রকম থাকতো মনেহয়, মানে, সিনেমাটা সবসময় ২০ বছর ‘আগায়া’ ছিল বা আছে। মানে, সিনেমা হিসাবে এইটা অডিয়েন্সের লগে ডিসকান্টেটেড একটা ব্যাপার ছিল, এখনো তা-ই আছে। তো, এইরকমের ‘ডিসকানেক্টেড’ জায়গা থিকা ‘আমরা’ বাইর না হয়া আসতে পারলেও জহির রায়হান বাইর হয়া আসতে বেশি খুববেশি সময় নেন নাই; ১৯৬৩’তে “কাঁচের দেয়াল”-এ ‘আর্টিস্টিক বাস্তবতা’ থিকা ‘সামাজিক বাস্তবতা’তে ফিরা আসতে পারছিলেন, এমনকি পরের বছর ‘সংগম’ সিনেমা (পাকিস্তানে প্রথম রঙিন সিনেমা, কোরবানি ঈদের দিন রিলিজ হওয়া) দিয়া ‘সিনেমাটিক বাস্তবতা’র দুনিয়ার একরকমের ঢুইকা পড়তে চাইছিলেন; পরে সেইটারে ‘উর্দু বাস্তবতা’ বইলা হেইট করছিলেন কিনা জানা যায় না ঠিকঠাক মতো।… মানে, উনার সার্কেলটারে এইভাবে দেখতে পারেন। এইটা জহির রায়হানের দুর্বলতা না, বরং স্ট্রেংথের জায়গা যে উনি চেইঞ্জ হইতে পারছেন, টাইম টু টাইম।… ১৯৬২ সালের “সূর্যস্নান” এর কথাও বলেন অনেকে। ১৯৬২ সালেই ঢাকাতে প্রথম উর্দু সিনেমা বানান এহতেশাম ‘চান্দা’ নামে, রহমান আর শবনম, নায়ক-নায়িকা। এই সিনেমা পশ্চিম পাকিস্তানেও হিট হওয়ার কথা। মেবি এই সিনেমা হিট হওয়ার কারণে উর্দু সিনেমা বানানো একটা টেনডেন্সি শুরু হয় ঢাকায়। আর এই কারণে এতহেশাম ‘বাঙালি জাতীয় সংস্কৃতি’র জায়গা থিকা এখনো একটা হেইট্রেট পাইতে থাকার কথা যে, উনি তো উর্দু সিনেমা বানান! মানে, উনি যে ঢাকা-বেইজড বাংলা ও উর্দু সিনেমা বানাইতেন – এই হিস্ট্রি কিছুটা ঝাপসাই মনেহয় এখন।… এর পরে ১৯৬৪ সালে উর্দু সিনেমার দাপটের সময়ে সুভাষ দত্তের “সুতরাং” হিট হইছিল, ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজও পাইছিল একটা।
এই সময়ের সিনেমা নিয়া কথা বলতে গিয়া আলমগীর কবির দুইটা কমেন্ট করছেন:
“যেমন-তেমনভাবে ছবি করে যাওয়া আর সেইসব ছবির পুঁজি দিয়ে ভারতীয় ছবির পাকিস্তানি বাজার নষ্ট করার অদম্য সরকারি আকাঙ্ক্ষাই প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকায় চলচ্চিত্র শিল্প স্থাপনের মূল কারণ ছিল।”
“দর্শককে দোষ দেব না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার আবেগে প্রায় সব বাঙালি পরিচালকই দশর্কের অস্তিত্বের কথা ভুলে গিয়েছিলেন।” ( আলমগীর কবির, আজ ও কালের প্রেক্ষণে, ১৯৭১/১৯৭২; আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ, ২০১৮)
তো, ভারতীয় ছবির পাকিস্তানি বাজার ‘নষ্ট’ (এই অ্যাডজেক্টিভটারে ইগনোর কইরেন না, আলমগীর কবির’দেরকে যে ইন্ডিয়ার দালাল বলতেন এহতেশাম, খান আতা’রা ব্যাপারটা এতোটা মিছা কথা না) না, বরং নিজের দেশের বাজার দখল করার একটা চেষ্টা তো ছিলই; কিন্তু বাজারের চাইতে প্রেস্টিজের জায়গাটা পলিটিক্যালি বেশি জরুরি হওয়ার কথা যে, ইন্ডিয়া সিনেমা বানাইতে পারে, আমরা পারি না! এইরকম। আর ব্যাপারটা ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ বলাটাও বাড়ায়া বলা, বরং সিনেমা বানানো শিখতেছিলেন তখন বাংলাদেশের ডিরেক্টরেরা। সুভাষ দত্ত এমন একটা ঘটনার কথা বলতেছিলেন যে, উনি এতহেশাম সাহেবের কাছে গেছেন, সিনেমা বানানো শিখতে চান বইলা; এতহেশাম সাহবে বললেন, আপনি আমার কাছ থিকা কি শিখবেন, আমি নিজেই তো বানানো শিখতেছি। তো, কথাটার পুরাটাই বিনয় না আর কি।
মানে, প্রি-রূপবান পিরিয়ডের যে তিনটা ঘটনার কথা কইলাম, এই সময়ের সিনেমাগুলা এইরকমের লিমিটেশনের ভিতর দিয়াই অপারেট করতেছিল আসলে। এইগুলা ‘ভালো’ সিনেমার এগেনেস্টে ‘খারাপ’ সিনেমা – এইরকম না, বরং বলতে পারেন, বাংলা-সিনেমা শেইপ-আপ হওয়ার সময় এইটা।
তো, শুরু’র জায়গা নিয়া এতো কথা বলার কারণ এই জিনিসটারে হাইলাইট করা যে, বাংলা সিনেমা শুরু থিকাই একটা সিঙ্গেল কোন ধারা ছিল না; পলিটিক্যাল কারণে, বিজনেসের কারণে, ব্যক্তিগত প্যাশনের কারণে বা আর্ট করার তাগিদে বাংলা-সিনেমা বানানো শুরু হইছে। কিন্তু রূপবানের আগে এইগুলা মোস্টলি অ্যামেচার ঘটনাই ছিল।
এই সময়ের ডিরেক্টর হিসাবে এতহেশাম এবং সালাউদ্দিন সাহেবের নাম-ই নিতে হবে। জহির রায়হান যদিও সিনেমা বানানো শুরু করছেন, উনার এক্সপোজার আসলে ১৯৬৫’র পরেই।
পার্ট ২: রূপবান (১৯৬৫)
তো, এইরকম একটা টাইমে রিলিজ হয় রূপবান সিনেমাটা। বাংলা সিনেমা যেই অডিয়েন্সরে টার্গেট করতো (১৯৫৬ – ১৯৬৫ পিরিয়ডে) সেই লিমিটেশনগুলার ভিতর দিয়া এই সিনেমা অপারেট করে নাই। একটা জিনিস খেয়াল করবেন, এই সালাউদ্দিন সাহেব-ই কিন্তু “সূর্যস্নান” (১৯৬২) “ধারাপাত” (১৯৬৩) বানাইছিলেন যেইটার টার্গেট অডিয়েন্স ছিল ‘আরবান মিডল ক্লাস’ বা বাংলার ‘শিক্ষিত সমাজ’। কিন্তু আমার ধারণা, এখন যেমন আমরা হলিউডি বা ফরেন আর্ট-ফিল্ম দেখি, তখনকার ‘শিক্ষিত সমাজের’ও একই রকমের খাসলত থাকার কথা। এলিজাবেথ টেলর আর কেরি গ্রান্টরেই ভাল্লাগার কথা। শবনম/সুজাতা আর রহমান/ রাজ্জাক’রে উনাদের ততটুকই ‘ভালো’ লাগার কথা, যতটুক উনারা এলিজাবেথ টেলর আর কেরি গ্রান্টের ছায়া। এই ‘শিক্ষিত সমাজ’রে এইভাবে দেখতে পারাটা দরকার, যারা ইউরোপিয়ান একটা কালচারারেই কনজ্যুমার হইতে চায়, একটা ইউরোপিয়ান সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর উনাদের চাওয়াটা হঠাৎ কইরা গজাইছে এইরকম না; এখন যেমন আছে, আগেও কম-বেশি থাকার-ই কথা। এই জায়গাটারে কন্সিডার করতে পারলে তখনকার সিনেমা কেন একটা অ্যামেচার গন্ডি থিকা বাইর হইতে পারে না, এই জিনিসটা টের পাইতে পারার কথা।
মানে, এইটারে ‘শিক্ষিত সমাজের’ দোষ বইলা দেখলে ভুল হবে, কারণ ‘শিক্ষিত সমাজ’ ব্যাপারটা তৈরি হইছে আর সাসটেইন করতেছে এইরকম ইউরোপিয়ান টেস্ট, রুচি-বোধ আর চিন্তা-পদ্ধতির ভিতর দিয়াই! আপনি নিজে যদি এইরকম টেস্টের জায়গা সাবস্ক্রাইব না করেন, আপনার ‘শিক্ষিত’ দাবি করাটাই পসিবল না, অনেক বেশি ‘গ্রাম্য’ হবে আসলে ব্যাপারটা। বাংলা সিনেমাও এইরকম ‘শিক্ষিত’ হওয়ার দিকেই মনযোগী ছিল, বা এখনো এইরকমের আহাজারি করতে পারি তো যে, এই এত বছর পরেও বাংলা সিনেমা ‘শিক্ষিত’ হইতে পারলো না। তো, এই ‘শিক্ষিত’ জিনিসটারে খেয়াল করার ব্যাপার আছে।…
রূপবান সিনেমাটাতে এই ‘শিক্ষিত সমাজ’রে অডিয়েন্স হিসাবে ভাবা হয় নাই। উনারা তো সিনেমা দেখেনই, কিন্তু সো-কল্ড ‘গ্রামের মানুশ’ যারা, উনারাও যে ‘দর্শক’ হইতে পারেন, সেইটারে ‘বাস্তব’ হিসাবে নেয়া হইছে। মজার একটা জিনিস হইতেছে, সালাউদ্দিন সাহেব নিজেও নাকি খুব একটা রাজি ছিলেন না; উনি সিনেমা বানাইতে চাইতেছিলেন, কিন্তু টাকা উইঠা আসতেছিল না, তখন উনারে এফডিসি’র দুইজন লোক (সফদার আলী ভূঁইয়া ও সিরাজুল ইসলাম ভুঁইয়া। সফদার আলী ভূঁইয়া পরের বছর নিজেও “রহিম বাদশা ও রূপবান” নামে একটা সিনেমা বানাইছিলেন।) এই বুদ্ধি আর সাহস দেয়: “১৯৬৫ সালে তিনি তৈরী করেন প্রথম লোককাহিনী ভিত্তিক সিনেমা ‘রূপবান’। সালাহউদ্দিন এই সিনেমার নির্মাতা হলেও এর মুল কারিগর ছিলেন সিনেমাকর্মী সফদর আলী ভুঁইয়া ও তার ভাই সিরাজুল ইসলাম ভুঁইয়া। তাদের দীর্ঘদিনের উৎসাহ উদ্দিপনায় সালাহউদ্দিন ‘রূপবান’ সিনেমা বানান।” (https://bmdb.co/বাংলা-চলচ্চিত্রের-উত্থান/)
শেভিং ব্লেড বানানোতে দুনিয়ার যেই বিখ্যাত কোম্পানি জিলেট, অইখানে এইরকমের একটা কাহিনি আছে। এক লেবার নাকি মালিকরে বুদ্ধি দিছিলো যে, এক ব্লেডের জায়গায় দুই/তিন/চাইর ব্লেড লাগান! শেভিংয়ের এক্সপেরিয়েন্সটা আরো বেটার হইতে পারবে তখন। এর পরেরটা তো ইতিহাস!… তো, গ্রামশি কইছিলেন, ইন্টেলেকচুয়াল উইঠা আসবে ওয়ার্কিং ক্লাস থিকা, প্রাকটিক্যাল এক্সপেরিয়েন্সের জায়গাগুলা থিকা; তো সেইটা না হইলেও ইন্টেলেকচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংগুলা প্রফেশনের সাথে রিলেটেড লোকজনই আগেভাগে রিকশনাইজ করতে পারার কথা। এর একটা উদাহারণ হিসাবে এই ঘটনাটারে ফিল করতে পারার কথা।
ব্যাপারটা খালি এইরকম না যে, রূপবান ‘গ্রামের মানুশদের’ লাইগা বানানো হইছে, বরং গ্রামের মানুশ যে সিনেমা দেখতে পারে – এই জায়গাটাতে বিশ্বাস রাখা হইছে আসলে। এইটা ক্রুশিয়াল একটা ডিসিশান।
আর সিনেমা রিলিজি হওয়ার পরে দেখা গেলো, এইটা তো আসলেই ‘বাস্তব’! ‘শিক্ষিত লোকদের’ বাইরেও তো দেখি বাংলাদেশে আরো লোকজন এগজিস্ট করে! আর এরা সিনেমাও দেখতে পারে! এমনকি পর্দার ভিতরে লোকজন ঘুরা-ফিরা করে দেইখা ডরায় না! এমনো কাহিনি আছে যে, গ্রাম থিকা লোকজন শহরে আসছে খালি সিনেমাহল খুঁজতে, যে রূপবান কই দেখানো হইতেছে; আর সিনেমাহলের সামনে কাঁথা-বালিশ নিয়া ঘুমায়া সিনেমার টিকিটের লাইগা লাইন দিতেছে। মানে, সিনেমা যে খালি সেলিব্রেশন ঘটনা না, বরং একটা ওয়ে অফ লাইফ, সেই রিয়ালিটিতে ইনক্লুড করার ঘটনা। সিনেমাটা যে কি রকমের ক্রেইজ ছিল সেইটার একটু ঝলক এই নিউজে পাইবেন: https://bit.ly/2AH9rRi
রূপবান সিনেমা রিলিজ হওয়ার কারণেই, এই সিনেমা দেখানোর লাইগাই বাংলাদেশে সিনেমাহল বানানি শুরু হওয়ার কথা। মানে দেখেন, ‘সিনেমাহল নাই বইলা সিনেমা বানানো হয় নাই’ থিকা সিচুয়েশনটা পুরা ঘুইরা গিয়া হইছে যে, ‘সিনেমা দেখানোর লাইগা সিনেমাহল বানানো দরকার’! রূপবান সিনেমার পরে ১৯৬৫ – ১৯৭০ এই সময়টা হইতেছে বাংলা সিনেমা তৈরি হওয়ার সময়।
আমার এই কথাটারে জাস্টিফাই করার লাইগা নায়িকা সুজাতার একটা কমেন্ট পাইলাম: “এদেশে রূপবান’ সিনেমার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। অথচ ‘রূপবান’ এদেশ থেকে উর্দু সিনেমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। ‘রূপবান’ হিট হওয়ার পর এদেশে বাংলা সিনেমা নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়।” (https://bit.ly/2VXBgwh) যদিও উনি এই সিনেমার নায়িকা বইলা বাড়ায়া বইলা থাকতে পারেন, কিন্তু সিনেমার নাম্বার উনার কথার পক্ষে যায়। সিনেমা রিলিজ হওয়ার নাম্বারটা এইরকম:
১৯৬৫: ১১
১৯৬৬: ২৫ (এর মধ্যে ৩টা আবার নতুন রূপবান। জহির রায়হানও বানান বেহুলা, ইবনে মিজান বানান জরিনা সুন্দরী, গুনাই বিবিরে নিয়া দুইটা সিনেমা, মহুয়া নিয়াও একটা সিনেমা হয়।)
১৯৬৭: ২৪
১৯৬৮: ৩৪
১৯৬৯: ৩১
১৯৭০: ৪৩
তো, গ্রামের লোকজনের পছন্দের কাহিনি নিয়া বানানো হইছিল বইলাই রূপবান হিট হইছিল, এইরকম না। লোকজন আরেকটা রিজনের কথা বলেন, সেইটা হইতেছে ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে কলকাতা থিকা হিন্দি সিনেমা আমদানি করা বন্ধ হয়া গেছিল বইলা এগজিসটিং সিনেমাহলগুলাও নিজেদের ব্যবসা বাঁচানোর লাইগা রূপবান’রে প্রমোট করার কথা। কিন্তু এইটাই যদি ঘটনা হইতো, তাইলে সাত রং (মে, ১৯৬৫), নদী ও নারী (জুলাই, ১৯৬৫)-ও হিট হওয়ার কথা। যুদ্ধটা একটা ফ্যাক্টর অবশ্যই, কিন্তু এইটারে মেইন ফ্যাক্টর হিসাবে হাজির করলে সেইটা এক রকমের ইন্টেলেকচুয়াল জাউরামিই হবে আসলে।…
আরেকটা জিনিস হইতেছে, যাত্রাপালার কাহিনি বইলা হিট হইছিল। কিন্তু ঘটনাটারে খালি এর ভিতরে রিডিউস করলেও ভুলই হবে। বরং রূপবান সিনেমা পরে ‘লোককাহিনি’ (খুবই ফানি একটা টার্ম) নিয়া সিনেমা বানানির একটা ট্রেন্ড শুরু হইছিল, যেইটা এখনো চালু আছে। ১৯৬০/৬৫ সালে বাংলাদেশের কালচারাল সিনারিওতে যাত্রা অবশ্যই একটা পপুলার ভিজ্যুয়াল ফর্ম হওয়ার কথা, টিভি তখনো চালু হয় নাই অইভাবে, আর বিফোর ‘৮০/’৯০ মাস লেভেলে পৌঁছাইতে পারার কথা না। এখন যাত্রাতে যেই কাহিনি আপনি দেখতেছেন, সেইটা অবভিয়াসলি সিনেমার পর্দা আরো রিয়েল লাগার কথা। কিন্তু ঘটনাটা এইটা না যে, আসেন একটা ‘উন্নতমানের যাত্রা’ দেইখা যান! বরং আপনার যারা যাত্রা দেখেন, সিনেমাও দেখতেও পারেন তো! রূপবান যাত্রা’রে সিনেমার পর্দায় নিয়া আসার ঘটনা না, যাত্রার দর্শকরে সিনেমার দর্শক হিসাবে মাইনা নেয়ার ঘটনা।
আর এইরকম একটা ধারণা চালু আছে যে, পাবলিকের লাইগা সিনেমা বানাইতে হইলে সহজ-সরল প্রেমের কাহিনি, নাচা-গান, ‘বুদ্ধিহীন’ ‘কম আর্টের’ সিনেমা বানাইতে হবে। অথচ রূপবানের কাহিনিটা দেখেন, কি রকমে “সমাজ-বাস্তবতাহীন” একটা গল্প। বারো দিনের বাচ্চার লগে বারো বছরের মেয়ের বিয়া! তারপরে বারো বছরের একটা মেয়ের বারো বছরের স্ট্রাগল। মেইনলি দুঃখ-দুদর্শারই কাহিনি। বানানো একটা দুঃখ-দুর্দশার লগে যেইখানে আমাদের লাইফের স্ট্রাগল, বিপদ-আপদ আর দুঃখ-দুর্দশাগুলারে ফিল করা যায়। ব্যাপারটা এইরকম না যে, লোকজন খালি মজা পাওয়ার লাইগা সিনেমা দেখতে আসে বা কষা ‘জীবনের মানে’ বুঝতে আসে; বরং একটা রিয়ালিটিরেই নিতে আসে যারে সে নিজের লাইফের সাথে কোন না কোনভাবে কানেক্ট করতে পারে। রূপবান সিনেমার কাহিনি যতোই ফ্যান্টাসি হোক, এর ফিলিংগুলা খুববেশি আন-নোন ছিল না মনেহয় বাংলাদেশের মানুশের কাছে। রূপবান সিনেমার সাকসেসের জায়গাটাতে এই কানেকশনের জায়গা গ্রসলি ইগনোর করা হয় বইলাই আমার মনেহয়।
তো, রূপবানরে নিয়া কথা-বার্তা নাই কেন? পপুলার এভারেজ সিনেমা বইলা? বা ছোটলোকের আর্ট বইলা? এইগুলা পুরান আমলের মার্কসিস্ট কথা-বার্তা। আমি বরং বলবো, ক্লাস-হেইট্রেটটারে অন্য একটা জায়গা থিকা দেখেন। ক্লাস বা কালচার বেশিরভাগ সময় একসেস বা এফোর্ড করতে পারার ঘটনা; টাকা তো দরকারই, কিন্তু টাকা থাকলেই আপনি সেই কালচারে সবসময় একসেস পাইবেন না। যেমন ধরেন, ফাইভ ষ্টার হোটেলের রেস্টুরেন্টগুলাতে চা’র দাম ৫০০ টাকা কেন রাখা হয়? খালি এস্টাবিশেন্ট খরচ বেশি বইলা? তা তো না, একটা কারণ এইটাও যে, চা’র দাম যদি ৫০ টাকাও হয়, আমরার মতন মিডল-ক্লাস লোকরাও মাসে একবার কইরা যাওয়া শুরু কইরা দিবো, এইটারে ঠেকানোটা তো দরকার! এইরকমভাবে, সিনেমা যদি গরিব আর গ্রামের লোকেরা বুইঝা ফেলে এইটা আর্ট হিসাবে কি এতোটা দামি থাকতে পারবো আর? মানে, পয়েন্টটা এইটা না যে, গ্রামের লোকেরা, গরিব লোকেরা সিনেমা দেখতে পারবে না বা অদের জন্য সিনেমা বানানো যাবে না, বরং অরা তো আসলে ‘সিনেমা বুঝে না!’ – এই জায়গাটা এস্টাবলিশড করাটা হইতেছে ক্লাস-হেইট্রেটের ঘটনা। সুজাতা যে বলতেছেন, উর্দু সিনেমারে ঢাকা থিকা হটায়া দিছিলো, এই প্রমাণ করার মতো ডেটা বা ইনফরমেশন কি থাকার কথা না, কোথাও না কোথাও? কিন্তু এই নিয়া যে কোন আলাপ পাইবেন না, এর কারণ ‘এইগুলা হইতেছে গ্রামের লোকদের লাইগা বাাননো সিনেমা, আসল সিনেমা না’।
বাংলা সিনেমা নিয়া ‘শিক্ষিত সমাজের’ এই ক্লাস-হেইট্রেট এখনো চালু আছে বইলাই ‘রূপবান’ সিনেমার সিগনিফিকেন্সরে কখনোই স্বীকার করা হয় নাই, বরং রূপবানের দেখাদেখি বানানো জহির রায়হানের ‘বেহুলা’রে নিয়া মাতামাতি আছে; এমনো দেখছি একলগে বলা হয় যে, “তখন ‘লোককাহিনি’ নিয়া বানানো সিনেমা যেমন, বেহুলা, রূপবান, গুনাইবিবি’র কারণে বাংলা সিনেমা ঘুরে দাঁড়ায়”… আরে বাল! এর আগে বাংলা সিনেমা ছিলো’টা কই? রূপবান দিয়াই তো শুরু! রূপবান যদি বানানো না হইতো জহির রায়হানের বেহুলার বানানোর কোন কারণই নাই! (এই হিস্ট্রিক্যাল সত্যিটার আরো কতদিন যে আমরা লুকায়া রাখতে চাইবো, আল্লা মালুম!)
মানে, এই রূপবান সিনেমার অডিয়েন্সের উপ্রে বেইজ কইরা মিডল-ক্লাসের বাংলা সিনেমা বানানি শুরু হয়। বাংলা সিনেমা দেখার দর্শকও যে আছে এই ‘সত্য’ হঠাৎ কইরা সামনে চইলা আসে। আর যেহেতু নতুন নতুন সিনেমা হল বানানো হয়া গেছে নতুন সিনেমা বানানোর একটা ডিমান্ডও তৈরি হয়। স্টিভ জবের একটা প্রেসনোট আছে অ্যাপেলের আইপড লঞ্চ করার সময়, অইখানে বলা হইতেছিল, মেশিন কিভাবে ডিমান্ড জেনারেট করতেছে। এখন মোবাইল আছে বইলাই মোবাইল কনটেন্টের দরকার পড়তেছে তো আমরার, এইরকম।…
কিন্তু রূপবান’রে একটা জনরা হিসাবেই নেয়া হয়, একটা রিডিউসড মিনিংয়ের ভিতরে যে, ‘গ্রামের মানুশদের’ লাইগা ‘লোককাহিনি’র সিনেমা বানানো যাইতে পারে। আর এইরকমের আন্দাজটাই এখনো চালু আছে।
[youtube id=”aeqfausAd_A”]
রূপবান সিনেমার কাহিনি’টা যদি খেয়াল করেন, পুরা ঘটনাটার শুরু একটা সেলফ-রিয়ালাইজেশনের ভিতর দিয়া যে, রাজার ভুলে রাজ্যের প্রজাদের আজকে বাজে অবস্থা! এখনকার ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে’ প্রজা মানে নাগরিকদের এর যে বড় ড্রিম আর কি হইতে পারে যে, রাজা বুঝতেছেন তার ভুল! তো, ভুল’টা কি? ভুল হইতেছে, রাজা আটকুঁইড়া, মানে, বাচ্চা পয়দা দিতে পারে না। রি-প্রডাকশন ক্যাপাবিলিটি তার নাই; অথচ সিনেমা জিনিসটাই হইতেছে একটা রি-প্রডাকশন সিস্টেম, বারবার দেখানো যাইতেছে! ‘সভ্যতা’ মানেই হইতেছে একটা রি-প্রডাকশন ক্যাপাবিলিটি, যে এক বই বারবার পড়তে পারবেন, এক সিন বারবার রিউইন্ড, ফরোয়ার্ড কইরা দেখতে পারবেন! আর সেইখানে রাজা হইতেছেন, আটকুঁইড়া! প্রজারা যারে রাজা হিসাবে চায় না, তিনি তো রাজা থাকতে পারেন না! এই সেলফ-রিয়ালাইজেশন একজন রাজা’র মনে হইতেছে! এই ফ্যান্টাসি কি রকমের ডেমোক্রেটিক – এইটা তখনকার এবং এখনকার কমিউনিস্টরা বিপ্লবের নেশায় মনেহয় খেয়াল করার টাইমই পান নাই।
মুশকিল হইলো, সিনেমা বা আর্টরে যে আমরা “রিয়ালিটি” বা বাস্তবতা হিসাবে রিড করতে চাই; যেহেতু কাহিনি’টা কল্পিত রাজ্যের ঘটনা, এইটা যেন বাস্তব জিনিসগুলারে রিফ্লেক্ট করতে পারবে না! অথচ দেখবেন ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ বইলা যে আমরা লুঙ্গি তুইলা নাচি, সেইটারে ভয়ানক ‘বাস্তবতা’ বইলা মানতে রাজি থাকি আর একইসাথে রূপবান’রে দেখি ফোকলোর হিসাবে; তো, এইগুলা যতোটা না আলাদা, তার চাইতে অনেক বেশি “শিক্ষিত” বাটপারিরই ঘটনা।
রূপবান যখন সিনে আসে, তখন তাঁর দাইমা’র ফার্স্ট ডায়ালগ’টা হইতেছে, পড়ালেখা করা লাগবে না? মানে, ‘নারী শিক্ষা’ সাজেশন তো 🙂 তখন রূপবান তখন বলে, ‘যৌবন-জ্বালা’র কথা… “ভাতের খিদা লাগলে পরে/পানিতে কি পেট ভরে গো”; সরাসরি বলতেছে শে, সেক্সের কথা! আবার দেখেন, রাজা মুসলমান, জ্যোতিষী কিন্তু হিন্দু… রাজা উজির’কে কিন্তু রিকোয়েস্ট করেন ‘ভাই’ বইলা, যেন রাজা আরেকটা মানুশ-ই, প্রভু বা মালিক না। আরেকটা জিনিস হইলো, একবার বলতেছে, মাতা, পিতা; আরেকবার বলতেছে আম্মা, আব্বা… এই সিনেমা যারা বানাইছেন, তাদের অই অস্বস্তি তো ছিলই যে ‘লিখিত’ বাংলায় কথা বলা লাগবে; আবার শহরের লোকজনরে অডিয়েন্স থিকা এক্সক্লুড করার কথাও মনেহয় ভাবেন নাই।
রূপবান (১৯৬৫) সিনেমার কাহিনিটাতে যে কোন ভিলেন নাই – তা না; তাজেলর বাপ হইতেছে ভিলেন-টাইপ কারেক্টার; কিন্তু আসল ভিলেন হইতেছে, নিয়তি! এইরকম ইউনিভার্সাল হিউম্যান এগজিসটেন্সের ক্রাইসিস’রে ‘গ্রাম্য’, ফ্যান্টাসি কাহিনি বইলা রিড কইরা আসতেছেন, বাংলাদেশের সিনেমা ক্রিটিক’রা। অন্য সব কারেক্টার; যেমন, একটা বাটপারের কারেক্টার আছে ছোট, নদীর মাঝি’রে ঠকায়া সোনার মোহর নেয়; সমসাময়িক ‘বাস্তবতা’র রিফ্লেকশন তো! যেইটা এই সিনেমার রিডিংয়ের ক্ষেত্রে গ্রসলি ইগনোর করা হয়।
রূপবান সিনেমার হিট হওয়ার হিসাবে বলা হয় গানগুলা খুব হিট হইছিল, কিন্তু এই সিনেমা যে বাংলাদেশের ফার্স্ট এবং একমাত্র মিউজিক্যাল ফিল্ম (বেদের মেয়ে জোসনা’র নামও আসতে পারে পরে) – এই কথাটাই কেউ কওয়ার সাহসটা করতে পারলেন না।
একটা হিস্ট্রি’রে একবার গোপন করা হইলে পরে মাইনা নিতে অনেক টাইম লাগে আসলে। রূপবান সিনেমারে একটা সিগনিফেকন্ট ঘটনা হিসাবে পয়লা দফা স্বীকারই করা হয় নাই; আর এখন যখন এর নাম নেয়া হয়, সেইটা হিট-সিনেমা, গ্রাম্য সিনেমা, লোক-কাহিনি নির্ভর সিনেমা, বাঙ্গালি মুসলমানের সিনেমা (পথের পাঁচালী’রে বাঙ্গালি হিন্দু’র সিনেমা বলেন না কেন!)… এইসব জার্গনের ভিতরে রিডিউস করার ট্রাই করা হয়। এইরকম রিডিংয়ের দুইটা ঘটনার কথা বলতেছি; একটা আলমগীর কবিরের; উনি বলছেন: “কোনমতে জোড়াতালি বাজেটে তৈরি করা… ‘রূপবান’… মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে। এই ছবি বিপুল আর্থিক সাফল্য লাভ করে, যার ফলে সালাহ্উদ্দিন তাঁর আগের ছবি নির্মাণের ঋণ পরিশোধ করেও কিছু লভ্যাংশ রাখতে সক্ষম হন।… এ ছবিটিই এ দেশের চিত্রশিল্পকে নিশ্চিত ভরাডুবি থেকে রক্ষা করে।…গ্রামাঞ্চলে যেসব মানুষ ছবি দেখাকে ‘পাপ’ মনে করত, তাদের সেই ধর্মীয় কুসংস্কার মুছে যায়, তৈরি হয় ছবির ব্যাপক দর্শক।” (বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পঁচিশ বছর, আলমগীর কবির, ১৯৮১)
অনেক ভুল কথা উনি বলছেন, অইগুলা … দিয়া পার করছি। তারপরও দুইটা ভুল কথা থাইকা গেলো – এক হইতেছে, ‘গ্রামাঞ্চল’ আর একটা হইতেছে ‘ধর্মীয় কুসংস্কার’। ‘রূপবান’-এ ‘ধর্মীয়’ কি জিনিস ছিলো, যে ‘কুংসস্কার’ কাইটা গেলো? এইগুলা সেক্যুলার ধর্মের লোকজনের অন্ধত্ব না, রিয়ালিটিরে দেখতে না-চাওয়ার ইচ্ছা আসলে। রূপবানের কাহিনি পাবলিক’রে কানেক্ট করছে, কেমনে করছে – সেইটা আলমগীর কবিরে’রা বুঝেন না বইলা ‘ধর্মীয় কুসংস্কার’ নাম দিছেন। আর ঘটনা’টা ‘গ্রামাঞ্চল’ এর মানুশ না, বরং ‘বাংলার মানুশ’। যেই পাবলিক উনাদের ‘আদর্শ’ ও ‘ভালো’ সিনেমা দেখেন না, তাদেরকে ‘গ্রামাঞ্চল’ বইলা টিটকারি করা-ই একরকম।
আরেকটা এক্সাম্পল হইলো, জাকির হোসেন রাজু’র; উনার বইয়ে (বাংলাদেশি সিনেমা অ্যান্ড ন্যাশনাল আইডেন্টিটি: ইন সার্চ অফ দ্য মর্ডান?) রূপবান নামে একটা সাব-চ্যাপ্টার রাখলেও উনার রিডিংয়ে এই সিনেমারে দেখছেন “বাঙালি মুসলমানের” এর কালচারাল হেরিটেজ হিসাবে; মানে, হিন্দুরা কি এই যাত্রা দেখে না? এই যাত্রা “মুসলমান” কেমনে হইলো? হইতে ভাটি-অঞ্চলের জিনিস, একটা সার্টেন লোকেশনের, কিন্তু ধর্মের কেমনে বলা যায়? মানে, কি রকম বাজে উদ্দেশ্য নিয়া এই ক্যাটাগরিগুলা করা, তা-ও এই ২০১৪ সালে আইসা! জাকির হোসেন রাজু কাহিনিও লেখছেন ভুল যে, নায়ক আরেক মেয়ে’র প্রেমে পড়ে (He becomes a handsome man and fall in love with another woman), হোয়ারঅ্যাজ সিনেমা’তে ঘটনা হইলো, তাজেল রহিমের প্রেমে পড়ে। রূপবানের আলাপে যেই জিনিসটা সবসময় মিসিং সেইটা হইতেছে, এইখানে ফিমেইল কারেক্টারগুলা খুবই অ্যাক্টিভ; রূপবান তার যৌবনজ্বালার কথা কইতেছে, তাজেল রহিম’রে প্রপোজ করতেছে, যেইটা রবীন্দ্রনাথের বোবা নায়িকা’রা তো পারেই না, মানিক বন্দোপাধ্যায়ে আইসাও তাদের আমতা আমতা-ই করা লাগতেছে। এমনো কথা জাকির হোসেন রাজু কইছেন (এবং উনিই প্রথম ও একমাত্র না) যে, মুসলমান ধর্মের ব্যাপার-স্যাপার আছে বইলা নাকি “গ্রামের মানুশেরা” “ধর্মের বাঁধা ভিঙ্গাইয়া” সিনেমা দেখা শুরু করতে পারছে! আমি ডাউটফুল, রূপবান সিনেমা’টা উনি দেখছেন কিনা! মানে, ব্যাপারটা খুবই সিম্পল, আপনি (গ্রামের না, বরং) এই দেশের পাবলিকের জন্য সিনেমা বানাইতেছেন না, তখন পাবলিক কেন সিনেমা দেখতে আসবে! যখন আপনি পাবলিকের জন্য সিনেমা বানাইছেন, তখন তারা দেখতে আসছে। যখন দেখছে তাদের লাইফরে কানেক্ট করা যাইতেছে সিনেমার (বাস্তবতা বা ফ্যান্টাসি যা-ই বলেন, তার) ইমোশনের লগে, তারা খুশি হইছে, বারবার দেখছে। এইখানে, মুসলমান, মর্ডানিটি চুদানো (রিমেম্বারিং মুহাম্মদ খসরু) যাবে না – তা না, কিন্তু এর স্পেইস খুবই লিমিটেড; বরং এইভাবে দেখার তরিকা’টা বাংলা সিনেমার জায়গাটারে একটা ইলিউশ্যনারি স্পেইসই বানায়া রাখতেছে আসলে।
রূপবানরে নিয়া আরো ৬টা সিনেমা বানানো হয়; এর পরের বছরগুলাতেই ৪টা: রহিম বাদশা ও রূপবান (১৯৬৬), আবার বনবাসে রূপবান (১৯৬৬), রূপবান (১৯৬৬) রূপবানের রূপকথা (১৯৬৮) (এইগুলারে মেবি ‘নকল’ রূপবান বইলা দেখতো লোকে :)। পরে আরো ২টা: রঙিন রূপবান (১৯৮৪/৮৫), আজকের রূপবান (২০০৫)। এর বেশিও হইতে পারে। আমি এই কয়টাই পাইলাম। কলকাতাতে ও একটা সিনেমা হইছিল ‘রূপবান কন্যা’ নামে। এইগুলার কোনটাই অইরকম হিট না হইলেও, ফ্লপও হয় নাই মনেহয়।
রূপবানের পরে সালাউদ্দিন সাহেব বানান তের নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন (১৯৬৬), যেইটা মেবি ঢাকা শহরের ‘কমন’ পিপলের একটা ডিপ্টিকশন হওয়ার চেষ্টা ছিল। মানে, এই রূপবানের সাকসেসর জায়গাটা থিকাই ডিরেক্টর-প্রডিউসার’রা টের পান যে, সিনেমা পাবলিকের লাইগাই বানাইতে হবে; এই রিয়ালাইজেশনের জায়গা থিকাই তখন গ্রাম-শহর, ফোক-মর্ডান মিলায়া-মিশাইয়া সেভেনটিইজ, এইটিইসে গিয়া ঢাকায় বানানো সিনেমাগুলা হয়া উঠতে ‘বাংলা সিনেমা’।…
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024
- ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ - আগস্ট 9, 2024