বাংলাদেশের ছায়াছবি: আলো, অন্ধকার এবং আলো! – সালাহউদ্দিন
সালাউদ্দিন সাহেব’রে নাম বললে তেমন কেউ চিনার কথা না, কিন্তু বাংলা সিনেমা নিয়া যারা টুকটাক জানেন, তারাও উনার কাজের কথা বললে, উনারে চিনতে পারার কথা। উনি হইতেছেন ‘রূপবান’ সিনেমার ডিরেক্টর। ‘রূপবান’ বানানোর আগে বানাইছিলেন ‘যে নদী মরুপথে’ (১৯৬১) ‘সূর্যস্নান’ (১৯৬২), ‘ধারাপাত’ (১৯৬৩); রূপবানের পরে বানাইছেন ‘আলোমতি’ (১৯৬৯), ‘মেঘের অনেক রঙ’ (১৯৭৬)। (মেঘের অনেক রঙ হইতেছে বাংলাদেশের একমাত্র সিনেমা যেইখানে নায়িকা হইতেছেন একজন ‘পাহাড়ি’, বাঙালি বা বিহারি না।) ‘১৩ নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেনে’র কাহিনিও উনার লেখা। মানে, বাংলাদেশে সিনেমা বানানি’রে যারা প্যাশন হিসাবে নিছিলেন, তাদের শুরুর দিকের একজন হইতেছেন সালাহউদ্দিন।
বাংলাদেশের সিনেমা খালি জহির রায়হান, আলমগীর কবির আর ঋতিক ঘটকের বানানো একটা সিনেমা না, বরং (মিডল-ক্লাসের রুচির জায়গা থিকাও) ‘বাংলাদেশি সিনেমা’ বইলা যদি কোন জায়গারে ধরতে চান সেইটা হইতেছে, সালাউদ্দিন, খান আতা, আমজাদ হোসেন – এনারা। মুশকিল হইলো উনাদের কাজকামরে তো আমরা ইগনোর করছিই, উনাদের কথা-বার্তারেও কখনো আমলে নেয়া হয় নাই বা কন্সিডার করা হয় নাই। চিপাচাপায় যেই কয়টা লেখা পইড়া আছে সেইগুলা দেখলেও আমার ধারণা, উনাদের কাজের জায়গাগুলা সম্পর্কে কিছু আন্দাজ করা যাবে ।
উনার এই লেখার এটলিস্ট তিনটা সিগনিকেন্সরে খেয়াল করার জন্য বলবো আমরা।
এক হইলো, ১৯৮৬ সালে এইটা লিখছিলেন উনি তখনকার অবস্থা আর এখনকার অবস্থা একই না। তখন বাংলা সিনেমা পুরাপুরি ইন্ড্রাষ্ট্রি না হইলেও বিজনেস ছিল, কালচার হিসাবে মিডল-ক্লাস সোসাইিতেও ‘গ্রহণযোগ্য’ ছিল। ১৯৮০ সালে ছুটির ঘন্টা ছিল হিউজ সাকসেস। লোকজন সিনেমাহলে গিয়া সিনেমা দেখতো – এই সুখস্মৃতির বাইরেও বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকারাই ছিলেন স্টার: কবরী, ববিতা, শাবানা’র টিভি নাটকে অভিনয় কইরা ‘কালচারাল রেসপেক্ট’ কামাই করতে হয় নাই, সুবর্ণা মুস্তফা, শম্পা রেজাদের মতন।…
মানে, টিভি তো তখন ছিল, কিন্তু সিনেমায় খালি টাকা ছিল, স্টারডম ছিল না – এইটা ভাবলে ভুল হবে। সালাহউদ্দিন বলতেছিলেন এই স্টারডম এমনে এমনে টিইকা থাকবে না, যদি কালচারাল এসেট তৈরি করা না যায়।
সিনেমা বানায়া বিজনেস করা লাগবে, কিন্তু কালচারাল এসেটও বানাইতে হবে – এইটা হইতেছে উনার সেকেন্ড পয়েন্টটা। ভালো সিনেমা এবং ব্যবসা-সফল সিনেমা দুইটাই কন্টিনিউ করার ভিতর দিয়া এই কাজ করতে হবে – এইটা উনার কথা:
“তবে কোন ব্যবসা সফল ছবিতে কিছু সগুণ থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। বা কোন ভাল ছবি কিছু দর্শক সমাদৃত হলে চমকাবার কিছু নেই।”
“…যে ব্যক্তি বলেন, ‘আমাকে টাকা দিন। আমি একটি ভাল ছবি তৈরী করে দিই।’ তিনি চলচ্চিত্রকার নন। ভাল ছবি তৈরী করা ফরমায়েশী ব্যাপার নয়, ঠিকাদারীও নয়। ভাল ছবির ফর্মুলা বা সূত্র নেই।“
“ভাল ছবিকে চিহ্নিতকরণ, উৎসাহ যোগান এবং সহযোগিতা প্রদান হচ্ছে ভাল ছবি তৈরীর ক্ষেত্র প্রস্তুতের একমাত্র উপায়।”
‘ভালো ছবি’ আর ‘বাণিজ্যিক ছবি’ – দুইটা দুই দুনিয়ার ঘটনা না! এইটা নতুন কোন আর্গুমেন্টও না, কিন্তু এই জায়গাটারে সেন্টার ধইরা কেমনে আগানো যায়, সেইটা নিয়া উনার ভাবছেন, কাজও করছেন। এই জায়গাটা দরকারি।
তো, এইটা কেমনে হবে? উনি অন্য অনেক কিছুর লগে ‘চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন’, ‘শিক্ষিত লোকজনরে’ গুরুত্ব দিতে চাইছেন। এইটা উনার লেখাটার থার্ড আর ক্রশিয়াল সিগনিফেকন্স। এইখানেই উনি মেইন ভুলটা করছেন।
উনি ভাবছেন, এই ‘চলচ্চিত্র সংসদ’অলারা আসছে এফডিসি’র হাত থিকা বাংলা সিনেমারে বাঁচাইতে। অথচ কালচারাল একটা হেইট্রেটের জায়গা থিকা তারা সবসময় অপারেট করছেন (এবং করতেছেন)। ব্যাপারটা এইরকম না যে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন ‘ভালো’ বাংলা সিনেমা বানানো হয় নাই (এইটা তো আছেই), বরং যা কিছু পাবলিক ‘খায়’ সেইটা তো কোনভাবেই ‘ভালো’ সিনেমা হইতে পারে না! (এইরকম একটা জায়গা থিকা অপারেট করে।) যেইখানে পাবলিক সবসময় ফিক্সড এবং সিঙ্গুলার একটা আইডেন্টিটি এবং ‘ভালো’ সিনেমারও যেন স্ট্যান্ডার্ড একটাই!
তো, ব্যাপারটা এইটা না যে, উনারা ‘ভুল’ বুঝছেন; বরং ‘ভুল-বোঝার’ জায়গাগুলা থিকাই এর শুরু। সালাহ্উদ্দিন সাহেব বাঁইচা থাকতে বাংলা-সিনেমার এই দুশমনদেরকে দোস্ত বইলা ভাবছেন। উনি নিজেও ‘ভালো’ সিনেমাই বানাইতে চাইছেন। কিন্তু উনি যে ‘ভুল’ কইরা একটা ‘জনপ্রিয়’ সিনেমা বানাইছিলেন সেইটারে যে বেশিদূর পর্যন্ত ভুল উনি ভাবতে পারেন নাই এবং এর-ও দরকার আছে, এইটা উনি যেমন ভাবছেন; ভাবছেন ‘শিক্ষিত’ লোকজন তো তার সমাজের মানুশের কথা আরো বেশি কইরা ভাববেন! কিন্তু উনারা যে তা করেন নাই – সেইটা সময়ের সাথে সাথে আরো স্পষ্ট হইতে পারতেছে বইলা আমরা মনে করি।…
তো, বাংলা সিনেমা যারা বানাইতেছেন, ইন ফিউচারে বানাইবেন, আমাদের মনে হইছে সালাউদ্দিন সাহেবদের মতো যারা ট্রাই করছিলেন, আর পারেন নাই, ফেইলওর বইলা তাদেরকে ইগনোর না কইরা কেন আর কিভাবে উনারা পারেন নাই, সেই জায়গাগুলারে খেয়াল করতে পারেন।
/এডিটর, বাছবিচার।
……………………………..
এ বছর ১৯৮৬।
তিরিশ বছর আগে আমরা প্রথম সবাক ছায়াছবি নির্মান করি।
আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। এ বিস্তৃতি ছায়াছবির উৎপাদনে, শিল্পী ও কুশলীর সংখ্যায়, মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণে। প্রযোজকের ঘরে যথেষ্ট মুনাফা আসছে। শিল্পীদের অনেকে তারকা হয়েছেন। চলচ্চিত্র-নির্ভর অনেক পত্র-পত্রিকা ছাপা হচ্ছে।
তাই বলতে হবে, আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের অনেক উন্নতি হয়েছে । কিন্তু কিছ সমালোচক বলেন, বিদেশী ছবি আমদানী বন্ধ করে এ সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে । আসলে আমাদের ছবি চলার মত নয় ।
প্রযোজকরা বলেন, ভিডিও ক্যাসেট যখন সারা দুনিয়ায় চলচ্চিত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের এখানে যখন বিনা বাধায় ভিডিও চলছে তখনও আমাদের ছবির অগ্রগতি থেমে নেই। সুতরাং বলতেই হবে, আমাদের চিত্রশিল্প এগিয়ে চলছে।
আবার অনেকে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, ‘এর নাম কি এগিয়ে চলা? বস্তাপচা কাহিনী, স্হূল ভাঁড়ামো, অশ্লীল নাচ-গান – এ সকল উপাদানে তৈরী নিম্নমানের ছায়াছবি নিয়ে গর্ব করার। কিছু নেই। বরং লজ্জা পাওয়ার আছে।’
চলচ্চিত্র শিল্পের কর্ণধারগণ বলবেন, আপনারা লজ্জা পেতে থাকুন। আমাদের বাংলাদেশে তৈরী ছবি চলছে এবং দর্শক উৎসাহের সঙ্গে তা দেখছেন।
প্রযোজক পয়সা পাচ্ছেন। তাদের নাম ইনকাম ট্যাক্সের খাতায় উঠছে।
শিল্পীরাও পয়সা পাচ্ছেন। তারকারাও যথেষ্ট সম্মান ও সম্মানী পাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাদের নিমন্ত্রণ হচ্ছে। সে নিমন্ত্রণে তারা নিজেদের গাড়ী চড়ে যেতে পারছেন। রাজনীতিতে তাদের ডাক পড়ছে, কারণ তারা জনপ্রিয়।
প্রচুর শিল্পী-কুশলী তৈরী হচ্ছে।
সরকার প্রচুর প্রমোদকর পাচ্ছেন।
উন্নতির এতকিছু ঘটছে, তবুও আপনাদের চোখ টাটাচ্ছে কেন বুঝি না।
চোখ টাটাবার কারণ আমরাও খুঁজতে চাইছি । আপনারা টাকা পাওয়ার কথা বলছেন? যিনি পকেট মারেন, হাইজ্যাক করেন তিনিও টাকা পান। যে মহিলা বিলাসবহুল হোটেলে কোন বিদেশী বা দেশী খদ্দেরের মনোরঞ্জন করেন তিনি টাকা পান। যে সরকারী কর্মচারী ফাইল ঠেকিয়ে রেখে বাঁ হাত বাড়িয়ে দেন তিনি টাকা পান। টাকাপয়সাই যদি সাফল্যের মাপকাঠি | হয় তবে এসব ক্ষেত্রেও আমাদের হাততালি দিয়ে বাহবা দিতে হয়, যেমনটি আপনারা চান।
যারা পক্ষে, তারা বলবেন – এটা কোন তুলনা হলো না।
সমালোচক বলবেন, এটাই যোগ্য তুলনা। যাদের কথা বললাম, তারা আমদের চরিত্র হনন করছেন। আপনারাও তাই করছেন।
‘আমরা নাগরিকদের আনন্দের যোগান দিচ্ছি।’
‘সেই সঙ্গে রিপুর গোড়ায় সুড়সুড়ি দিচ্ছেন।’
‘তা আপনাদের এত পোড়াচ্ছে কেন?
‘পোড়াবে না, যদি একটি রেডলাইট এলাকা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়।’
একেবারে হাতাহাতি ব্যাপার।
সত্যি করে কি চাওয়া হচ্ছে?
যারা সত্য সুন্দরের কথা ভাবেন, যারা প্রগতির কথা ভাবেন, যারা বুদ্ধির বিকাশ ও জ্ঞানের উন্মেষের কথা ভাবেন, যারা প্রকৃতিকে জয় ও মানুষকে ভালবাসার কথা ভাবেন না কিছু বলেন।
তারা বলেন,
ভাল ছবি করুন।
সুস্থ ছবি করুন।
জীবন ঘনিষ্ঠ ছবি করুন।
তারা বলেন,
চলচ্চিত্র অমিত শক্তিশালী মাধ্যম।
একে নিম্নগামী করবেন না।
এর ধারকে ভোঁতা করে দেবেন না। এ তরবারী দিয়ে ঘাস কাটবেন না।
ভাল ছবি কি? এখানেই সমস্যা।
ধারণাটি ঝাপসা। ধারণাটি পরস্পর বিরোধী।
কেউ বলবেন, ভাল ছবি মানে,
যে ছবি দেখলে ঘুম পায়, হাই ওঠে । যে ছবি টিকেট কেটে কেউ দেখে না। বিনি পয়সাতেও অনেকে দেখে না। যে ছবি প্রযোজকের লাল বাতি জ্বালায় ।
অন্যেরা বলেন, ভাল ছবি মানে,
যে ছবি জীবনের কথা বলে। যে ছবি মানুষকে ভালবাসার কথা বলে। যে ছবি দানবের মুখোশ উন্মোচিত করে। যে ছবি মেহনতি মানুষকে মহিমান্বিত করে। যে ছবি সুন্দরকে মাতাল হতে দেয় না।
মাঝপথে তৃতীয় পক্ষ বলে ওঠেন, তাহলে বিরোধটা কোথায়?
এমন ছবি কি করা যায় না। যে ছবি ভাল ছবি এবং একই সঙ্গে যে ছবি ব্যবসা সফল ছবি।
কেউ হয়তো ফোড়ন কাটবেন, এ তো দেখছি সোনার পাথর বাটি বা কাঠালের আমসত্ত্ব ।
কেউ বলবেন, বিষয়টিকে অমনভাবে দেখছেন কেন? ভাল এবং ব্যও সমন্বয় কি সম্ভব নয়?
আসল কথা, এ সমন্বয়ের কোন সুযোগ নেই। কারণ, এ দুটো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ।
ভাল ছবি একটি স্বাধীন সৃষ্টি। একজন পরিচালকের একাগ্রতার ফসলে ব্যবসায়ের চিন্তা শুধু এক সফল উত্তরণের পথকে সংকটময় করে তুলতে পারে।
অপর পক্ষে যিনি ব্যবসার জন্যে ছবি করবেন তার জন্যে ভাল কিছু করার বাতিক শুধু বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
তবে কোন ব্যবসা সফল ছবিতে কিছু সগুণ থাকলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। বা কোন ভাল ছবি কিছু দর্শক সমাদৃত হলে চমকাবার কিছু নেই। আসল কথা, ভাল ছবির ব্যবসা সফল হওয়ার দায় কি?
কুইনাইনকে রসগোল্লা হওয়ার দায় নেই। এ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং-এর ফিল্মস্টারের পোট্রেট হওয়ার দায় নেই। মেঘনাধ বধ কাব্যের পোর্নোগ্রাফী হওয়ার দায় নেই।
ভালো ছবি মানে সৎ চলচ্চিত্রকারের স্বাধীন সৃষ্টি – যে চলচ্চিত্রকার কারো আজ্ঞাবহ নয়।
যার কর্মপ্রয়াস শুধু মানুষকে, জাতিকে ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ছায়াছবি নির্মাণ পুঁজি-নির্ভর। এ পুঁজির যোগানদার শুধু চলচ্চিত্রকার নিজে নয়, সেই সঙ্গে সমাজ ও সরকারকে এর যোগান দিতে হবে।
অপর পক্ষে যে ব্যক্তি বলেন, ‘আমাকে টাকা দিন। আমি একটি ভাল ছবি তৈরী করে দিই।’ তিনি চলচ্চিত্রকার নন। ভাল ছবি তৈরী করা ফরমায়েশী ব্যাপার নয়, ঠিকাদারীও নয়। ভাল ছবির ফর্মুলা বা সূত্র নেই। ভাল ছবি কারও নকলও নয়।
ভাল ছবি চিহ্নিত হয় ভাল দর্শক দ্বারা। আবার ভাল দর্শক তৈরী হয় ভাল ছবি দেখে।
আবার সেই প্রশ্ন, ডিম আগে না মুরগী আগে।
আর এর উত্তর হচ্ছে, দুটোই। আগে কিংবা পরে।
চলচ্চিত্র শিল্পের প্রধানাংশ ছবি দর্শক-রুচি নিম্নগামী করে আর নিম্নগামী দর্শক শ্রেণী নিম্ন রুচির ছায়াছবিকে প্রশ্রয় দিয়ে ব্যবসা সফল করে।
নিম্নগামী সকল প্রক্রিয়া সহজেই তরান্বিত হয়। তাই এই দুর্যোগ।
ভাল ছবিকে চিহ্নিতকরণ, উৎসাহ যোগান এবং সহযোগিতা প্রদান হচ্ছে ভাল ছবি তৈরীর ক্ষেত্র প্রস্তুতের একমাত্র উপায়।
ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন এ ক্ষেত্রে অবদান রাখবে, এটাই আশা করা যায়।
বাংলাদেশে ফিল্ম সোসাইটির বিকাশ, সে-ও কম দিন নয়। তেমন বড় রকম কোন অবদান না রাখলেও আজকের দিনে ভাল ছবির স্বপক্ষে যত উচ্চারণ প্রায় সবটাই তাদের কাছ থেকে আসছে।
সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি করা একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ।
তবুও মূল চলচ্চিত্র শিল্পের ধারায় দর্শক সাধারণের ছবি দেখার মানকে ধরে রাখার বা উন্নততর করার জন্য কিছু প্রক্রিয়া গ্রহণ করার দায়িত্ব সমাজের ওপর বর্তায়। ধরা হোক, নিমে বর্ণিত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করা হলো:
১। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৫/২০টি ছবি প্রতি বছর আমদানী করতে দেওয়া হবে । এ সকল ছবির উপর আমদানী কর, বিক্রয় কর প্রমোদ কর আরোপ করা। হবে না।
২। ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ ছবি নির্বাচন করবে এবং আমদানী এবং প্রদর্শন করবে।
৩। ভাষা সমস্যার জন্য এসকল ছবি ভাষান্তর করা যাবে।
৪। এ সকল ছবির বিক্রয়লব্ধ টাকা চলচ্চিত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্যয় করা হবে।
৫। বাংলাদেশে তৈরী শ্রেষ্ঠ ছবিকে প্রমোদকর মুক্ত করা হবে।
৬। যে চলচ্চিত্রকারের ছবি শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে তাকে অপর একটি ছবি করার জন্য সম্পূর্ণ মূলধন সরকার যোগাবে।
৭। বাংলাদেশ টেলিভিশন বিদেশের শুধুমাত্র ভাল ছবি প্রদর্শন করবে। ছবিতে বাংলা টাইটেল ব্যবহার করবে।
৮। দেশ ও বিদেশের ছবি নিয়ে চলচ্চিত্র উৎসব ও সেমিনার করা হবে।
উপরোল্লিখিত পদক্ষেপে কারো তেমন আক্ষেপের কারণ নেই। কিন্তু এ থেকে ভাল ছবি তৈরির একটি পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে।
বর্তমান সময়ে ব্যবসা নির্ভর ছায়াছবির চাপে ভাল ছবি তৈরীর ক্ষেত্রে একটি পরোক্ষে প্রতিরাধের সৃষ্টি হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সিনেমা শিল্পের রমরমা অবস্থা। তার কারণ হিসেবে বলা যায়,
১। বিদেশী ছবি বন্ধ । প্রতিযোগীতা নেই।
২। সরকার কর্তৃক ট্যাক্সের বোঝা লাঘব।
৩। বিদেশী বাণিজ্যিক ছবির অবাধ নকল।
৪। খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, চোরাচালান, মাদকদ্রব্য পাচার, যৌন উত্তেজক নৃত্য দৃশ্য, অকারণ উদ্ভট দেহ প্রদর্শন এবং অবাস্তব অপ্রয়োজনীয় অর্থহীন দৃশ্যের প্রতি সেন্সর বোর্ডের সহযোগীতা।
রমরমা অবস্থা বলেই মহাজন ও তারকার সৃষ্টি। মহাজনের পুঁজি ও তারকার গ্ল্যামার ভাঙ্গিয়ে অনেকে করে খাচ্ছেন। তাই অনেক তাবেদারও সৃষ্টি হচ্ছে।
তারকাদের ছবি নিয়ে রং বেরং-এর পোষ্টার, ভিউ কার্ড ও সিনে পত্রিকা বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। মহাজনরা এ সবে পূজি যোগাচ্ছেন।
তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনের বানোয়াট মুখরোচক কাহিনী ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে তাতিয়ে রাখা হচ্ছে। সিনেমা হলে এইসব তারকার একটি ছবি এলেই তারা ঝাপিয়ে পড়ে।
দর্শক পয়সা দিয়ে খুশী। মহাজন পয়সা পেয়ে খুশী।
আর তারকার একদিকে মহাজনের পয়সা আর একদিকে দর্শকের স্তুতি – এত সুখ কোথায় রাখবে!
বেশ ঘূর্ণায়মান মাতাল চক্র। থামলেই নেশা ছুটে যাবে। তাই থামা যাচ্ছে না।
কিন্তু এই কি শেষ কথা ?
(লেখাটা হারুনর রশীদের লেখা, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থিকা ছাপানো “চলচ্চিত্রকার সালাহ্উদ্দিন” (২০০৯) বইয়ের ৯৩-৯৬ পেইজ থিকা নেয়া।)
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024