পলিটিক্যাল আলাপ (১): সমাজ-সংগঠন কেন জরুরি?
মেহরাব ইফতি দুনিয়াতে একমাত্র লোক না হইলেও মোটামুটি দুয়েকজন লোকের মধ্যে একজন যে মনে করে যে, কবিতা লেখার বাইরেও পলিটিক্স নিয়া কিছু চিন্তা আমার আছে, বা আমি করতে পারি। তো, যখনই অর লগে দেখা হয়, পলিটিক্যাল আলাপ শুরু করে আমার লগে।
ও তো ইন্ডিয়াতে পড়াশোনা করে, ওয়েস্ট বেঙ্গলে; তো, অইখানকার সিচুয়েশন নিয়া সে খুব চিন্তিত; যে ওয়েস্ট বেঙ্গলে যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসে কি হবে তাইলে? ও শুরু করলো, জিজেকের আলাপের রেফারেন্স দিয়া, যে ট্রাম্প জিতার সময়ে জিজেক কইছিল হিলারি না জিইতা ট্রাম্প জিতলে আসলে ভালো কারণ লিবারাল সিস্টেমটা যে ফাংশন করতেছে না, সেইটা আরো স্পষ্টভাবে বুঝা যাবে, ভালো হবে সেইটা। কিন্তু ইন্ডিয়াতে, রাষ্ট্র-ব্যবস্থার যেই ৩টা ইম্পর্টেন্ট পিলার – আইন-আদালত, ইলেকশন কমিশন, আর ভার্সিটিগুলা ইন্ডিপিন্ডেড ছিল; এখন বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে আইন-আদালত’রে কন্ট্রোল করা শুরু করছে, ভার্সিটিগুলাতে নিজেদের লোকজন ঢুকাইতেছে, ইলেকশন কমিশনরে দখল না করলেও ডর-ভয় দেখায়া ফেভারে কাজ করানোর চেষ্টা করতেছে। এখন ওয়েস্ট বেঙ্গলে যদিও জরিপগুলা বলতেছে, বিজেপি ক্ষমতায় আসবে না, কিন্তু পাবলিকের সাথে কথা বইলা মনে হইছে, চইলা আসবে আসলে। তখন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবে না? মুসলমানদের পুশ-ব্যাক করবে না? বাংলাদেশেরও তো সাফার করা লাগবে? ওয়েস্ট বেঙ্গলে বিজেপি ক্ষমতায় আসাটা ভালো কেমনে হয়? জিজেক যেইরকম বলছেন। একটা এনার্কি কি এর সমাধান দিতে পারবে?
আমি কইলাম, জিজেক যেই বেইজ থিকা আলাপ’টা করতে চাইছেন, সেই বেইজটারে নিয়েন না। আমি বরং আরেকটা গ্রাউন্ড সাজেস্ট করি আপনারে। আপনি ইর্ম্পটেন্ট একটা ফ্যাক্টররে বাদ দিছেন; সেইটা হইতেছে, মিডিয়া। বিজেপি সবচে আগে মিডিয়া-কালচার, বলিউড… এইসব জায়গারে দখল করছে। উনাদের কেন্ডিডেট দেখবেন বেশিরভাগই সেলিব্রেটি, সিনেমার, সিরিজের নায়ক-নায়িকা, ক্রিকেটার, গায়ক-অভিনেতা, এই-সেই। তো, এইখানে, মিডিয়ার ফাংশন’টা কি? মিডিয়া হইতেছে, আমাদের সামনে পলিটিক্যাল রিয়ালিটি’টারে তৈরি করে, বা ডিসরটেড রিয়ালিটি’টারে বারবার প্রজেক্ট করতে থাকে। এইটা আরো স্ট্রং ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারে কারণ সমাজে কানেক্টিভিটির জায়গাগুলা মিসিং, মিডিয়া অই ভ্যাকুয়ামটারে একতরফাভাবে ম্যানিপুলেট করতে পারে। (ফেসবুকে, টু্ইটারেও মোদির ক্যাম্পেইন দেখবেন।…)
করতে পারে, আরো দুইটা কারণে। এক হইলো, আপনি যেই লিবারাল ইন্সটিটিউশনগুলার কথা কইতেছেন, অইগুলা সমাজের কমন পিপলদের পারপাস সার্ভ করতে পারে নাই, বা পারে না। ইভেন আমার মতো ‘শিক্ষিত’ মানুশও চাইবো যে কোন সিচুয়েশনে আইন-আদালত এড়ায়া চলতে, কারণ খামাখা উকিল ধরো, আদালতে যাও, মামলার ডেইট পড়বে, সিস্টেম-টিস্টেম কিছুই তো জানি না, এর চে ভালো ক্ষতি যদি বেশি না হয়, চাইবো আদালতের বাইরেই জিনিসগুলারে সেটেল কইরা ফেলতে। এইরকম অন্য লিবারাল ইন্সিটিটিউশনগুলার ব্যাপারেও বলা যায়, যতগুলা ক্রিমিনাল আছে সমাজে, মানুশের হক মাইরা খায় এরা তো সব ভার্সিটি পড়া লোকজনই। এইরকম। মানে, পাবলিক সচেতন না, লিবারাল ইন্সটিটিউটের বাইরে রেসিয়াল/সাম্প্রদায়িক শক্তিরে সার্পোট করতেছে – ব্যাপারটা এইরকম না, বরং লিবারাল ইন্সিটিটউটগুলা ফেইল মারছে বইলা এইখানে ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’ স্ট্রং হয়া উঠতেছে।
মিডিয়ার একটা হোমোজিনিয়াস অডিয়েন্স দরকার। একই রকম জিনিস পছন্দ করবে, দেখবে, গসিপ করবে, রিসার্চ করবে, ইন্টারেস্টেড হবে। এই সহজ হোমোজিনিয়াস জায়গাটা হইতেছে – ধর্ম। যদি আপনি ‘৮০ দশকের লোক হন, তাইলে জানার কথা বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ইন্ডিয়ান যে সরকারি চ্যানেল, ডিডি (দূরদর্শন) চ্যানেল দেখা যাইতো। অইখানে সবচে হিট সিরিয়াল ছিল – রামায়ণ ও মহাভারত। একটা ইউনিটি, একটা অডিয়েন্স আপনি সবসময়ই পাইবেন ধর্মবিশ্বাসীদের, যাদেরকে এনগেইজ রাখতে না পারলে মিডিয়ার বিজনেস হবে না আসলে। (এইটা একটা কারণ, যেইটা নিয়া পরে আবার কথা বলতেছি।)
কিন্তু এইখানে আমি কথা বলতে চাইতেছি সেকেন্ড কারণটা নিয়া। সেইটা হইতেছে, মিডিয়া এতো পাওয়ারফুল হয়া উঠলো কেমনে? টিভি’র কারণে, মোবাইলের কারণে, টেকনোলজি’র কারণে? এইগুলা তো আছেই, কিন্তু এইগুলাসহ বা এইগুলার বাইরে এইখানে একটা ভ্যাকুয়াম আছে, যেই জায়গাতে মিডিয়া খুব ভালোভাবে তার রোল’টা প্লে করতে পারতেছে। ভ্যাকুয়ামটা তৈরি হইছে কারণ মানুশে মানুশে যোগাযোগের যেই সমাজ-সংগঠন ছিল, সেইটা আর নাই; সেইটা আর কাজ করে না এখন। ৩০/৪০ বছর আগের কথাই চিন্তা করেন, ধরেন, পাশাপাশি দুইটা গ্রামের ঘটনা, এক গ্রামের একজন আরেক গ্রামে গিয়া একটা ক্রাইম করছে, ধরেন, চুরি-ডাকাতিই করছে, অই গ্রামের লোকজন কিন্তু তারে পিটানি দিলেও মাইরা ফেলতে পারবে না, কারণ জানে, গ্রামের একটা সমাজ আছে, সে যেই গ্রামের লোক সেইখানের লোকজনরে আগে ডাকাবে, তারপরে তার বিচার করবে; যদি না ডাইকা এইটা করে, গ্রামে-গ্রামে খুনাখুনি লাইগা যাবে; এইটা খালি অন্যায় আর বিচারের ঘটনা না, সে অই গ্রামের লোক, তাদের একটা রেসপন্সিবিলিটি আছে; কেউ যদি খারাপ কাজ করে, তার দোষ তাদের উপ্রেও পড়ে; যে সবাই এইটা খেয়াল করতে পারে নাই। দেখা যাবে, যেই গ্রামের লোক চুরি-ডাকাতি করছিল, তারাই অরে ধইরা শাস্তি দিবে, বিচার করবে। এখন, এই সমাজ-সংগঠন একবারেই নাই হয়া গেছে আমাদের সমাজে। একটা কৃষক-সমাজ, একটা ছাত্র-সমাজ, একটা পাড়া-মহল্লার সমাজও নাই।
একজন ছাত্রের পকেটে ইয়াবা ঢুকায়া পুলিশ থানায় ধইরা নিয়া গেলে এলাকার ছাত্ররা আসবে না তারে বাঁচাইতে। কারণ ধরেন, ডেমরা’তে, যাত্রাবাড়ি’তে ১০০ জনের কোন ছাত্র-সংগঠন নাই, যাদের কেউ একজনরে ধইরা নিয়া গেলে বাকি ৯৯ জন আগায়া আসবে। কোন পলিটিক্যাল মুভমেন্ট, আন্দোলন-সংগ্রাম, (বালের) বিপ্লব, রেভিউশন করার দরকার নাই; জাস্ট এইটুক করবে, সমাজের জায়গা থিকা সার্পোট দিবে, এইটা নাই! আর এইরকমের কোন কিছু যেহেতু নাই, একটা ‘ঐক্য’ তো আমাদের লাগবে, সেই ভ্যাকুয়ামটা মিডিয়া ফিলাপ করে, ‘আমরা হিন্দু’ ‘আমরা মুসলমান’ – এইসব প্রপাগান্ডা দিয়া।
এখন মানুশের মধ্যে, সমাজে যে ধর্ম-ভাব নাই – তা তো না, কিন্তু মিডিয়া যেইটা ইনসার্ট করে, সেইটা যতোটা সোশ্যাল ও রিলিজিয়াস কোন জিনিস, তার চাইতে অনেক বেশি বিজনেসের এবং পলিটিক্যালি ‘সাম্প্রদায়িক’ একটা ঘটনা। আর এইটা না হইলে, অই হোমোজিনিটির জায়গাটাতে বারবার এবং বেশি কইরা সাবস্ক্রাইবার তৈরি করাটা পসিবল না। মানে, মিডিয়া যেই ‘ঐক্য’টা তৈরি করে সেইটা সমাজ-সংগঠনের পারপাসটারে ফুলফিল করে না। অইটারে ইউজ করে বরং।…
তো, সমাজ-সংগঠনের যেই কাজ, সেইটা পলিটিক্যাল সংগঠন দিয়া হবে না। কালচারাল সংগঠন দিয়াও হবে না। সমাজে যদি সমাজ-সংগঠন না থাকে পলিটিক্যাল সংগঠনগুলাও ঠিকমতো ফাংশন করবে না। সমাজ-সংগঠন হইতেছে, পলিটিক্যাল সংগঠনের বেইজটার মতন অনেকটা।
খুলনার পাটকল আন্দোলন কেন সাকসেসফুল হয় নাই? বা যে কোন পলিটিক্যাল মুভমেন্টই কেন বাংলাদেশে সাকসেসফুল হইতে পারবে না, এই সমাজ-সংগঠনের জায়গা থিকা এইটা বুঝতে পারবেন। ধরেন, একটা বিল্ডিংয়ে আগুন লাগছে, এখন দুয়েক বালতি দিয়া পানি ঢাইলা আপনি কি সেই আগুন নিভাইতে পারবেন? বরং আগুনরে আরো তাতায়া দিবেন, সে আরো আগায়া আসবে এইদিকে। তো, সমাজ-সংগঠন ধরেন, বালু’র মতন অনেকটা, আপনি ছোটখাট বালুর ব্যারিকেড যদি দিতে পারেন আগুন’টা আটকায়া যাবে; আগুন’টা থাইমা যাবে না, অন্যদিকে গিয়া পুড়াবে। পলিটিক্যাল সংগঠন আপনার লাগবে (বিশাল হোসপাইপ দিয়া আগুনের মুখে পানি মারতে হবে), কিন্তু সমাজ-সংগঠনের কোন জায়গা বা স্ট্রং বেইজ যদি না থাকে সেইটা পলিটিক্যাল মুভমেন্টগুলারে সাকসেসের দিকে নিয়া যাইতে পারবে না। সমাজ-সংগঠনগুলা না থাকলে সেই ফোর্সটা সারভাইব করতে পারবে না।
উল্টা দিক দিয়া দিল্লী কিশান মুভমেন্টও দেখেন একটা ইমপ্যাক্ট তো তৈরি করতে পারতেছে অবশ্যই, কিন্তু পলিটিক্যালি সাকসেসফুল হইতে পারতেছে না, কারণ সমাজ-সংগঠন আর পলিটিক্যাল-সংগঠন একই জিনিস না, উনারা পলিটিক্যাল এফিলিয়েশনটা ক্রিয়েট করতে পারতেছেন না। পলিটিক্যাল দাবি আদায় করাটা সমাজ-সংগঠনের পক্ষে সম্ভব না। সমাজ-সংগঠনের কাজ অই পলিটিক্যাল জায়গাটারে তৈরি করা, যেইখান থিকা পলিটিক্যাল দাবি আদায় করাটা পসিবল।
সমাজ-সংগঠন ও পলিটিক্যাল-সংগঠনের এই ডিফরেন্সের জায়গাটারে মার্ক কইরা রাখাটা দরকার।
………………………………
আমি শিওর না শহিদ কমরেড তাজুল ইসলামের ঘটনা’টা আপনারা জানেন কিনা, ১৯৮৪ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি উনি পুলিশের গুলিতে মারা গেছিলেন, আদমজী’তে হরতাল করতে গিয়া। ঢাবি’র ইকোনমিক্সের স্টুডেন্ট ছিলেন উনি, শ্রমিক-আন্দোলন করার লাইগা আদমজীতে লেবারের চাকরি নিছিলেন। আমার ধারণা, ভালো রকম অর্গানাইজ করতে পারছিলেন বইলা একটা হুমকি হয়া উঠছিলেন। তো, উনি কোন ‘সমাজ-সংগঠন’ তৈরি করতে যান নাই, উনি একটা ‘শ্রমিক-আন্দোলন’ সংগঠিত করার ট্রাই করছিলেন। দুইটা আলাদা ঘটনা।
এই যে একজন ‘শিক্ষিত’ লোক হয়া ‘অশিক্ষিতদের’ ‘সচেতন’ কইরা তোলার জন্য জান দিছেন; আমার কাছে এই ন্যারেটিভ’টা প্রব্লেমেটিক। উনি যে এইটা করেন নাই – তা তো না! উনার জীবনটাই দিয়া দিছেন! যুগে যুগে এইরকম স্যাক্রিফাইস মানুশ-জন করছে, করতেছে, করবেও। তো, আমার কথাটা কোনভাবেই এই ডেডিকেশনের জায়গাটা নিয়া না, বরং একটা ফ্রেমওয়ার্ক নিয়া কথা বলার ঘটনা।
………………………………
এইটা আরো টের পাইবেন মাওলানার ভাসানীর কথা’তে, উনি দাবি করছেন যে, বাংলাদেশে উনি শ্রেণী সংগঠন তৈরি করছেন [যেইটা ‘কমিউনিস্টরা’ দাবি করতে চায় সমাজ-সংগঠন বইলা], কিন্তু উনি যেইটা করছেন, পলিটিক্যাল কনশাসনেসের জায়গা থিকা সমাজ-সংগঠন বানাইছিলেন কৃষকদের; যেইটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হিউজভাবে কন্ট্রিবিউট করছে। কিন্তু এর পারপাস ছিল পলিটিক্যালি কনশাস একটা সমাজ-সংগঠন তৈরি করা, সমাজ-সংগঠনের জায়গাটাতে এফেক্টিভ কইরা তোলা না, যার ফলে এই ব্যাপারটা পরবর্তীতে আর এফেক্টিভ থাকতে পারে নাই। (আমার আশা আছে, বাংলাদেশে এইরকম এনথ্রোপলিজস্ট আমরা পাবো, যারা জিনিসটারে থিওরেটিক্যাল জায়গা থিকা এক্সপ্লেইন করতে পারবেন।)
যদি সংগঠনের কথা ভাবেন, এইখানে তিনটা ইন্টারসেক্ট আছে – সোশ্যাল-সংগঠন, পলিটিক্যাল-সংগঠন এবং কালচারাল-সংগঠন। কালচারাল-সংগঠনগুলা কম-বেশি পলিটিক্যাল এফিলিয়েশনের কাজটাই করে, সমাজে। বিজেপি’র ব্যাপারে বলিউড যেমন করছে। বাংলাদেশে নয়া বাকশালের ব্যাপারেও অর্গনাইজড মিডিয়া ও সলিমুল্লাহ খানদের কন্ট্রিবিউশনটারে ছোট কইরা দেখার কোন উপায় আছে বইলা আমি মনে করি না। এই কালচারাল সংগঠনের জায়গাটা ঠিক স্ট্রাকচার-সুপারস্ট্রাকচারের মামলা না, বরং ইন্টার-কানেক্টিভিটির ঘটনা।
ধরেন, যারা শিল্প-সাহিত্য করেন, উনারা পলিটিক্যাল এফিলিয়েন্সের জায়গাগুলারে বরং বেশিরভাগ সময় এড়াইতেই চান, হাইড-ই করেন, যে, আমি তো ভাই কবিতা লিখি! সাহিত্য করি! 🙂 রাজনীতি তো আমার পেশা না, এইরকম। কিন্তু ভোটার হিসাবে, সোশ্যাল এনিমেল হিসাবে পলিটিক্যাল এগজিসটেন্সের কথা যদি বাদও দেন, যে কোন সাহিত্য বা লিটারেচার কোনভাবেই সমাজের পলিটিক্যাল স্ট্রাকচারের বাইরে গিয়া কোন মিনিং তৈরি করতে পারার কথা না। সাহিত্য হইতেছে প্রাইমারি-ভাবে, এর মিনিংয়ের জায়গা থিকা একটা সোসাইটির প্রপাগান্ডা মেশিন। সরাসরি হোক আর ইনায়া-বিনায়াই হোক সমাজের সব কালচারাল এক্টিভিটি কোন না কোন পলিটিক্যাল এজেন্ডার লগে রিলিভেন্ট হয়াই সমাজে ‘সাহিত্য-উপাদান’ হিসাবে টিইকা থাকে।
এই কালচারাল-সংগঠনগুলা সবসময় ভিজিবল না বইলা মনে করাটা ঠিক হবে না যে, এইগুলা স্রেফ ব্যক্তির কাজ বা এইখানে কোন সংগঠন নাই; বরং আলাদা আলাদা ব্যক্তির কাজগুলা এইখানে একটা আইডিওলজির জায়গা থিকা কানেক্টেড থাকে। মানে, আমি খালি মার্কসবাদী সাহিত্য-সংগঠনের কথা বলতেছি না, বা সাহিত্য যে একটা ক্লাস কনশাসনেসের জায়গা থিকাই এপিয়ারড হয় এবং ক্লাসের আর্টের নিড’টারে ফুলফিল করে – তাও না, যে কোন আর্ট-ওয়ার্ক পলিটিক্যাল এফিলিয়েশনের জায়গা থিকা তৈরি যদি না-ও হয়, নতুন পলিটিক্যাল কনশাসনেসরে তৈরি করে আসলে। তো, অই জায়গা থিকা কালচারাল-সংগঠন খালি ‘বাইরের একটা ঘটনা’ না, বরং সোশ্যাল ও পলিটিক্যাল সংগঠনগুলার ইন্ট্রিগ্রাল একটা পার্ট। একটা পলিটিক্যাল দলের যে পতাকা থাকে, শ্লোগান থাকে, পছন্দের গান থাকে… এইগুলা ফ্লাওয়ারি কোন ব্যাপার না, এইগুলা বরং আরো স্ট্রংগলি সোশ্যাল ও পলিটিক্যাল জায়গাগুলারে কন্সট্রাক্ট করে। মিডিয়ার কন্ট্রিবিউশন’টা এই জায়গাটাতেও।…
মানে, সমাজ-সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও কালচারাল-ফোর্সগুলা মিইলা মিইশা থাকে; একটা আরেকটারে ইনফ্লুয়েন্স করে, তাদের ডিফরেন্সের জায়গা থিকা এবং ডিফেরন্সগুলি দিয়া। তো, এইখানে আরেকটা পয়েন্ট হইতেছে, রিলিজিয়াস অর্গানাইজেশনগুলা, মসজিদ-মন্দির ভিত্তিক কমুনিটি তো আছে সমাজে, এরা সমাজ-সংগঠন হইতে পারে কিনা? আমার ধারণা, কোন সংগঠনই সমাজের বাইরের কোন ঘটনা না, ফাংশনগুলা আলাদা, আমাদের ‘আধুনিক সেক্যুলার’ সমাজে ধর্মীয় আইডেন্টিটিগুলারে, কমুনিটিগুলারে আমরা সমাজের বাইরে ফালায় দিতে না পারলেও এক রকমের বাদাইম্মা বা আউটকাস্ট করে রেখে দিছি, এতে কইরা অই জায়গাগুলা নাই হয়া যায় নাই, বরং একটা রেজিসট্যান্সের উপায় হিসাবে পলিটিক্যাল ফোর্স হিসাবে রিভাইব করার, ফিরা আসার রাস্তাতে আছে। কিন্তু এইটা এর কাজ না। একটা সমাজে ধর্মীয়-সংগঠনগুলা থাকবেই, কিন্তু সেইগুলারে যদি কোর সমাজ-সংগঠন বা পলিটিক্যাল-সংগঠন বানায়া ফেলি এরা ধর্মের যেই জায়গা সেইখানেও এফেক্টিভ থাকতে পারবে বইলা মনেহয় না।…
২.
তো, বাংলাদেশে সমাজ-সংগঠনের জায়গাগুলা নাই হয়া গেলো কেমনে? যে কোন সোশ্যাল স্ট্রাকচারই তো ইকোনমিক অবস্থার লগে রিলেটেড। যখন এগ্রিকালচার বেইজড বা কৃষি-ভিত্তিক ইকোনমি ছিল, গ্রাম বলেন, এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি বলেন, দরকারি ব্যাপার ছিল; তারপরে যখন প্রডাকশন-বেইজ ইকোনমিতে আমরা আসছি সিঙ্গেল বা ইন্ডিডিপেন্ডেড ফ্যামিলি স্ট্রাকচার আমরা পাইতেছি; এমনকি এখন যখন ২৪/৭ সার্ভিসের সময়ে আসছি, ওয়ার্কলাইফ-ফ্যামিলিলাইফ ব্যালেন্স করাটা বরং টাফ, ইন্ডিভিজ্যুয়াল হইলেই ভালো; যার ফলে সিঙ্গেল-ইন্ডিভিজ্যুয়ালই (পুরুষ বা নারী যেইটাই হোক) বেটার, ঝামেলা কম; ফ্যামিলি ব্যাপারটা ‘ব্যাকডেটেড’ একটা ঘটনা হইতে পারতেছে, ধীরে ধীরে। কারণ, ইকোনমিক স্ট্রাকচারের লগে এইটা মিলে না, কম্পিটেবল না।
এই কারণে চাইলেই আমাদের পক্ষে পুরাতন গ্রাম-ব্যবস্থায়, পাড়া-মহল্লা কালচারে ফিরা যাওয়া পসিবল না। বরং নতুন ইকনোমিক স্ট্রাকচারের ভিতরে এলিনেশন বা ইন্ডিভিজ্যুয়ালিজমের ভ্যাকুয়াম’টারে মিডিয়া-রিয়ালিটির ভিতর দিয়া মহান না কইরা তুইলা কেমনে সমাজ-সংগঠনের স্পেইসগুলারে ক্রিয়েট করা যাইতে পারে, সেইটা নিয়া ভাবতে পারাটা দরকার। ব্যাপারটা কখনোই ইন্ডিভিজ্যুয়াল ভার্সেস সমাজ – এই বাইনারির ভিতরে নাই, বরং একটা আরেকটারে কেমনে রিলিভেন্ট কইরা তুলতেছে, ঘটনা’টা সেইখানে।…
আর মনে রাখা দরকার, চিন্তা করা আর কাজ করা, থিওরি আর প্রাকটিস – দুইটা আলাদা ঘটনা। একটা আরেকটাতে কন্ট্রিবিউট করে, কিন্তু খুব কমই সাপ্লিমেন্ট করে বা করতে পারে আসলে।
৩.
তো, কার্ল মার্কস যে পলিটিক্যাল সংগঠনের উপ্রে জোর দিছেন, এইটা ভুল – ব্যাপারটা এইরকম না, বরং আমি মনে করি, উনার চিন্তার ইন্টারপ্রিটেশনরে পলিটক্যালি রিলিভেন্ট কইরা তুলতে আরো ফেইলওর হইতেছি আমরা।
ইকোনমিক ফ্যাক্টরের বাইরেও এই সমাজ-সংগঠনরে নাই কইরা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কমিউনস্ট রাজনীতি’র এইখানে একটা কন্ট্রিবিউশন আছে বইলা আমি মনে করি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট রাজনীতি একটা ইউরোপিয়ান ইন্ডিভিজ্যুয়ালিজমের মড়া ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে নাই। ‘আমি কমিউনিস্ট রাজনীতি করি’ মানে আমি কিন্তু ভাই একটু ডিফরেন্ট, আমি ‘জমিদারের পোলা’। আর সামাজিক মানুশ মানেই হইতেছে, পটেনশিয়াল পলিটিক্যাল বোমা, এর ‘কাজে’ লাগাইতে হবে! – এইরকমের ন্যারো একটা জায়গা কইরা তোলা হইছে। যেই কারণে দেখবেন ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের’ রেভিউলেশন করার খায়েশ থিকাই জন্ম নিতেছিল সুইসাইড বোম্বার’রা।…
……………………………
“… কিন্তু মাস দেড়েক পরেই ইন্ডিয়ান হাইকমিশন থেকে আমাকে জানানো হয়, অতুল লাহিড়ী নাকি তাঁদের কাছে চিঠি লিখে অভিযোগ করেছে যে, ঢাকার মুসলমানরা আমাকে আটকে রেখেছে। ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের দায়িত্ব এখন আমাকে কিছুদিনের জন্য একটি হিন্দু পরিবারের সঙ্গে রাখা অতঃপর আমাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া। আমি অবাক হয়ে তাঁদের জানালাম যে মোটেই মুসলমানরা আমাদের আটকে রাখেননি, এটা একটা মিথ্যা, বানোয়াট অভিযোগ। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অতুল আমাকে ভালোবাসতো, কমিউনিস্ট পার্টি করতো। তাঁর মতো একজনের কাছ থেকে এতটা নীচতা আমি আশাও করিনি।”
/জীবন নদীর পাড়ে, সুমিতা দেবী
———-
১৯৫৮-তে আইয়ুব খাঁ মার্শাল ল দিলে অতুল লাহিড়ী [সুমিতা দেবী’র ফার্স্ট জামাই] ইন্ডিয়ায় চইলা যান, সুমিতা দেবী’রেও যাইতে বলেন, কিন্তু সিনেমার কাজ চলতেছিল বইলা উনি যান নাই [বা হয়তো তখন জহির রায়হানের প্রেমে পড়ছিলেন, যা-ই হোক…]। যাওয়ার সময় অতুল লাহিড়ী তারে কাগজে লিইখা দিয়া যান যে, সম্পর্ক শেষ! পরে ইন্ডিয়ায় গিয়া আবার তারে নিয়া যাওয়ার ট্রাই করেন। নানান ফন্দি-ফিকির করেন…।
সুমিতা দেবী’র বিশ্বাসটা দেখেন দুইটা জায়গায় – ভালোবাসা আর কমিউনিজম। অথচ দুইটাই ডেডলি উইপেন। দুনিয়াতে যত দাবায়া রাখার/লিমিট করার ঘটনা ঘটে তার প্রায় পুরাটাই এই ‘ভালোবাসা’র নামে। মানে, এইটা একটা লম্বা কাহিনি।…
সেকেন্ডলি, কমিউনিস্ট হওয়ার ঘটনাটা; এইটারে এলিট হিন্দুজম বইলা রিড করলে ভুল হবে আসলে। মনি সিং যে কমিউনিস্ট হইছিলেন, সেইটার সেলিং পয়েণ্ট এইটাই যে, উনি আছিলেন জমিদারের পোলা। জমিদারের পোলারাই যেইখানে কমিউনিস্ট হয়, কমিউনিস্ট হওয়ার ভিতর দিয়া আপনিও কিছুটা জমিদার হইতে পারেন তো।
এই প্রাইডটা দেখবেন বাংলাদেশের [সো-কল্ড] কমিউনিস্টদের এখনো আছে যে, উনারা ডিফরেন্ট! কথা কওয়ারই একটা প্যাটার্ন আছে যেইটা কমন পিপল থিকা আলাদা। এই ডিফরেন্সটারেই কমিউনিস্ট বইলা ভাবতে পারেন উনারা এবং অন্যরাও। জমিদার ব্যাপারটা যেহেতু পুরান হইছে কালচারালি, এইজন্য দেখবেন একটু ‘গ্রাম্য’ ও ‘গরিব’ থাকা লাগে উনাদের।
কমন পিপলদের লাইগা উনাদের দরদ আছে, এই দরদ থাকার কারণেই উনারা কমন হইতে পারেন না আর; ক্রুশিয়াল মোমেন্টগুলাতে কম্যুনাল আইডেন্টিটিগুলাতে ফেরত যাইতে হয়।
২.
ইন জেনারেল কইতে গেলে, এই যে, আইডলজি বা অ্যাবসুলেট, এর একটা ফ্ল-ই হইলো যে, অনৈতিক বা ফেইক একটাকিছুরে আবিষ্কার কইরা ফেলতে পারা। যে কোন প্রডাকশন সিস্টেমেরই বাই প্রডাক্টের মতো। আর টাইম মতো সেই ইনভিজিবল শক্রুরে দোষটা দিয়া দিতে পারা।
মানে, যদি কোন ভিলেন আবিষ্কার করতে না পারেন, আপনি হিরো কেমনে হইবেন! এইখানে পাকিস্তানের মুসলমানরা হইতেছে সুমিতা দেবীর ফার্স্ট হাজব্যান্ড কমিউনিস্ট অতুল লাহিড়ীর মেইন ভিলেন, বুর্জোয়ারা না! তখনকার সময়ে ট্রুথ হিসাবে সেইটা মোর কনভিন্সিং তো! তাই না?
/২০১৬
……………………………
আর সবচে বাজে জিনিস হইলো, কালচারালি একটা ডিসকানেক্টেড সেলফ’রে অরা ‘কমিউনিস্ট’ বানায়া তুলছে; যেই কমিউনিস্ট ফলস বিপ্লব করার ড্রিমের ভিতর দিয়া ক্যাপিটালিজমের সবচে সাচ্চা গোলাম হিসাবে নিজেরে বাঁচায়া রাখে।
এই আলাপে উনাদেরকে ‘জম্বি কমিউনিস্ট’ হিসাবে মার্ক কইরা রাখতে চাই আমি, কারণ যে কোন সমাজ-সংগঠনের বিরোধিতা করাটারেই ‘কমিউনিস্ট’ হওয়ার একটা ঘটনা বানায়া রাখছেন উনারা। আর এই সমাজ-সংগঠনরে গায়েব কইরা দেয়ার ঘটনাতে ক্যাপিটালিস্ট ইকনোমিক স্ট্রাকচারের লগে সো-কল্ড “কমিউনিস্ট কালচার”-ও একটা রিলেটেড ঘটনা বইলা আমি মনে করি।
এই জায়গাগুলারে মার্ক না কইরা রাখলে, আলাপ শুরু না করতে পারলে, এখনো ট্যাবু বানায়া রাখলে আমার মনেহয় না পলিটিক্যালি এফেক্টিভ কোনকিছু করতে পারবো আমরা।
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024
- ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ - আগস্ট 9, 2024