ধর্ম্ম ও সমাজ – কাজী মোতাহার হোসেন (১৯২৯)
“শিখা” পত্রিকায় (থার্ড ইয়ারে) ১৯২৯ সালে কাজী মোতাহার হোসেনের এই লেখাটা ছাপা হইছিল।
কাজী মোতাহার হোসেন এবং শিখা-পত্রিকার ব্যাপারে একটা কমন মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হইতেছে যে, উনারা বাংলাদেশের সেক্যুলার আন্দোলনের লোক ছিলেন। মানে, এইভাবে দেখাটা উনাদের বলাবলির জায়গাটারে ন্যারো কইরা দেখারই একটা ঘটনা। উনারা যেইটা করতে চাইতেছিলেন, ‘আধুনিক-চিন্তা’র লগে এনকাউন্টার করতে রাজি হইছিলেন বাঙালি-মুসলমান পরিচয়ের জায়গা থিকা, যাচাই-বাছাই কইরা এর কট্টুক নেয়া যায়, কট্টুক বাতিল করা যায় – এর একটা চেষ্টা উনাদের মধ্যে ছিল। যেইটা বঙ্কিমচন্দ্রের ছিল ‘বঙ্গদর্শনে’, একটা ইন্ডিয়ান-থটের জায়গা থিকা ইউরোপিয়ান-থটরে এনকাউন্টার করতে চাইতেছিলেন।
মুশকিল হইলো, পরে জিনিসটা আর একইরকম থাকে নাই। বাংলাদেশের এখনকার ‘বিজ্ঞান-মনস্ক’ সেক্যুলারিজমের লগে কাজী মোতাহার হোসেনের এই কথা-বার্তার একটা মেজর ডিফরেন্সের জায়গা হইতেছে, মোতাহার হোসেন ধরে নিতেছেন যে, জ্ঞান-বুদ্ধি এবং ধর্ম সমাজের মানুশের ঘটনা, সমাজের মানুশদের ভিতর দিয়া এইটা তৈরি হইতে হয়, একটা বোঝাপড়ার ভিতর দিয়া চেইঞ্জও হয়। আর এখনকার ‘বিজ্ঞান-মনস্ক’ সেক্যুলারাজিমের জায়গাতে সমাজের মানুশরা হইতেছে ‘পশ্চাদপদ’ ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’, এদেরকে ‘মানুশ’ বানাইতে হবে আগে! মোতাহার হোসেনের কোর কনসার্ন হইতেছে সমাজে ব্যক্তি-মানুশের ফ্রিডম, আর এখনকার সেক্যুলারিজম মনে করে ফ্রিডমের যেই জায়গাটা আছে সমাজের মানুশ সেইখানে যাওয়ার জন্য এনাফ ‘বিজ্ঞান-মনস্ক’ হইতে পারতেছে না!
এখন মনে হইতে পারে, এইরকম জায়গায় যে যাওয়া যায়, এর আলামত তো কাজী মোতাহার হোসেনের লেখাতেই আছে! উনি তো ধর্মরে ব্যক্তির জায়গাতে রাখতে বলছেন, সৌল-সার্চিংয়ের ঘটনা বানাইছেন! আর এইটারে উনার আর্গুমেন্টের একমাত্র পয়েন্ট বানায়া ফেলার কারণেই ‘বিজ্ঞান-মনস্ক’ সেক্যুলারিজমের জায়গা থিকা দেখাটা সম্ভব হয়। যেইখানে আমরা দেখি যে, ধর্মের জায়গাতে উনি এইটারে নিছেন একটা ‘অ্যাড-অন’ হিসাবে। উনি বলতেছেন, ধর্ম ব্যক্তির ও সমাজের ফ্রিডমের জায়গায় কোন বাধা না, বরং অতীতে যখনই সমাজে এইরকম বাধাগুলা আসছে ধর্ম আইসা মানুশরে বাঁচাইছে। এখন বরং রিচুয়ালগুলারে ‘ধর্ম’ হিসাবে নেয়ার কারণে এই সমস্যাটা তৈরি হইতেছে। এইটা অবশ্যই সেক্যুলার একটা জায়গারে এক্সপ্লোর করে, কিন্তু ‘বিজ্ঞান-মনস্ক’ সেক্যুলারিজমের জায়গাটাতে আটকায়া থাকার ঘটনা আসলে না।
আমরা মনে করি, শিখা-পত্রিকা বা কাজী মোতাহার হোসেনদের লেখা-পত্র’রে এইরকম ন্যারো সেক্যুলারিজমের জায়গা থিকা দেখার আরো দুইটা কারণ আছে। এক হইতেছে, উনাদের সোশ্যাল-ক্লাস; শিখা-পত্রিকায় যারাই লিখছেন, তারা সবাই ছিলেন ‘উচ্চ-শিক্ষিত’ লোকজন; যদিও নবাব আবদুল লতিফদের “মুসলিম লিটারারি সোসাইটির” চাইতে আলাদা ছিল উনাদের ক্লাস, কিন্তু একই কারণে পুরানা ক্লাস-সিস্টেমের জায়গাতে একটা ডিপার্চারও ছিল সেইটা। কিন্তু ক্লাস হিসাবে এমার্জিং এলিট, এবং বলা যায় ঢাকা শহরের মিডল-ক্লাসের বুনিয়াদ ছিল এই ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এবং ‘শিখা’ পত্রিকা। যার ফলে, এই যে চেহারাটা দাঁড়াইছে এখন (বা প্রিসাইজলি ১৯৬০-৯০’র সময়ে) ঢাকার মিডলক্লাসের, সেইটারে অই সময়ের উপর প্রজেকশন করা যায়।
সেকেন্ড হইলো, যেইটা খুব স্পষ্ট, সেইটা হইতেছে ভাষার গোলামি। এইটা টের পাইবেন, কলকাতা যেহেতু তখনো সেন্টার, অই ভাষা-সাহিত্যের জায়গা থিকা উনারা বাইর হইতে পারেন নাই, অইটারে স্ট্যান্ডার্ড ধইরা নিয়াই আলাপ করছেন, নত হইছেন, জাস্ট একটা জায়গা-ই চাইছেন মুসলমানদের লাইগা এবং ঢাকার লাইগা যে, ‘মনে রেখো, আমিও ছিলাম!’
তো, কাজী মোতাহার হোসনের এই লেখাটারে অই সময় এবং সময়ের সোশিও-পলিটিক্যাল হিস্ট্রি’টা মাথায় রাইখা পড়লে, উনার লেন-দেনের জায়গাটারে, ব্যালেন্স করতে চাওয়ার ইচ্ছাটারে, আমরা আরো ভালোভাবে খেয়াল করতে পারবো হয়তো।
এডিটর, বাছবিচার
……………………..
পৃথিবীর অগণিত প্রতিষ্ঠানের কোনটিই প্রয়োজন ব্যতিরেকে স্থাপিত হয় নাই। আমাদের ধর্ম ও সমাজও প্রয়োজনের তাড়নায় জন্মলাভ করিয়াছে।
সমাজের প্রয়োজনীয়তা অতি সহজেই চোখে পড়ে। আত্মরক্ষা একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ক্রমবিকাশবাদের ইহাই মূল সূত্র। যখন কোটি কোটি লোক আত্মরক্ষার জন্য ব্যয় হয়, তখন প্রত্যেকে অন্যের মঙ্গলের দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া আপন আপন স্বার্থ সিদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করিলে কি মহামারী কান্ড উপস্থিত হইতে পারে, সে চিত্র স্মরণ করিলেই, সমাজ বন্ধন এবং নীতির আবশ্যকতা পরিস্কার উপলদ্ধি করা যায়। বাস্তবিক জন্মাবধি অন্যের সাহায্য ব্যতিরেকে জীবন ধারণ করা অসম্ভব। সমাজবদ্ধ হইয়া বাস করাকে মানুষের একটা মৌলিক বৃত্তি বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায়। সমাজের প্রথম অবস্থায়, শারীরিক বলে শ্রেষ্ঠ হইলেই লোকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রাপ্ত হইত, কারণ তখন শারীরিক বলের দ্বারাই অন্যের উপর নিজের ইচ্ছা ও প্রভুত্ব চালানো সম্ভবপর ছিল। কিন্তু অস্ত্র উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বলের অসুবিধা অনেকটা দূর হইয়াছে। তখন বাধ্য হইয়া লোকে সংঘবদ্ধ হইয়া পরস্পরের সুবিধার জন্য কতকগুলি নিয়ম পালন করিতে স্বীকৃত হয়। এই নিয়মগুলিই সামাজিক নিয়ম। পরস্পরে বিশ্বাস, আদান প্রদান, উপকার-প্রত্যুপকার, বিবাহ বন্ধনে পবিত্রতা রক্ষণ, সত্যবাদিতা, ক্ষমা, আত্মসম্মান বোধ প্রভৃতি সদগুণ সামাজিক প্রয়োজন হইতেই উদ্ভূত হইয়াছে। প্রকৃত পক্ষে right is Mightই আদিম নিয়ম। যখন সকলের শক্তি প্রায় সমান হইয়া উঠে, তখন বিজ্ঞেরা Right is might নীতির আদর্শ প্রচার করিতে বাধ্য হন। আজও পৃথিবীতে সমাজে সমাজে বা জাতিতে জাতিতে যে দ্বন্দ্ব ঘটিতেছে, তাহাতে সৰ্ব্বদাই কাৰ্যতঃ চণ্ড-নীতিই অনুসৃত হইতেছে। প্রবল স্বভাবতঃ দুর্বলের উপর অত্যাচার করিলেও সৰ্ব্বদা তাহার মনে ভয় থাকে, দুর্বলেরা সংঘবদ্ধ হইয়া কিম্বা অন্য উপায়ে অধিক প্রবল হইয়া উঠিলে তাহাকে পাল্টা নির্যাতন সহ্য করিতে হইবে। সে যাহা হউক, এই ভয় এবং পরিণাম দর্শিতাই নীতি বা সাধু বুদ্ধির জনক। সুতরাং সামাজিক প্রয়োজন হইতে উদ্ভূত এই নীতি জ্ঞানকে ধর্মের অন্তর্গত বলিয়া নির্দেশ করা যায় না।
এমন প্রশ্ন হইতে পারে, ধৰ্ম্ম হইতে যদি নীতিকেই বিচ্ছিন্ন করা হয়, তবে ধৰ্ম্মের কি অবশিষ্ট থাকে এবং তাহার প্রয়োজনই বা কি? অবশ্য একরূপ ব্যাপকভাবে ধরিলে যাহার যে স্বভাব সেই তাহার—যেমন আগুনের ধৰ্ম্ম দাহন করা, মস্তিষ্কের ধর্ম চিন্তা করা ইত্যাদি। এ হিসাবে বলিতে হয়, স্বভাবতঃ যাহা ঘটিয়াছে, তাহাই ধৰ্ম্ম অনুসারে ঘটিতেছে—ইহাতে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা বা তদ্রপ কোনো প্রশ্নই উঠিতে পারে না। কিন্তু ধর্মের প্রচলিত অর্থ ইহা নয়। অনেক সময় বলা হইয়া থাকে, একাগ্র সাধনাই ধর্ম। যে কোনো বিষয় যদি মানুষের মনকে অন্য সমুদয় বিষয় হইতে নিবৃত্ত করিয়া তাহার চিন্তা ও কৰ্ম্মের গতি একমুখী করিতে পারে, তবে সেইটিই তাহার ধৰ্ম্ম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কবির সৌন্দর্য চর্চাই ধৰ্ম্ম, ছাত্রের অধ্যয়নই ধৰ্ম্ম, রাজার প্রজা পালনই ধর্ম্ম ইত্যাদি। কিন্তু ধর্ম্মের প্রকৃত অর্থ ইহাও নহে। তবে ধৰ্ম্ম কি?
মানুষের মনে অসীম জিজ্ঞাসার উদয় হয়, আমি কে? কোথায় ছিলাম? কোথায় চলিতেছি? কেন চলিতেছি? অমির পরিণাম কি? এ জগতের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ কি? কোথায় তার বাসস্থান? সমুদয় ধৰ্ম্মের মূলে এই সব জিজ্ঞাসা এবং ইহার উত্তর। এ সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা দর্শন শাস্ত্রের কাজ। এখানে ধৰ্ম্ম ও দর্শন একীভূত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু পরে ভিতরে দর্শনের অতিরিক্ত আরও কিছু আছে। ধৰ্ম্মের সহিত হৃদয়ের গভীর আশা এবং কোন শক্তিমান নিয়ামক পুরুষের অস্তিত্বে প্রগাঢ় বিশ্বাস থাকাতেই ইহার দর্শন ভাগ শুধু মনের বিলাস মাত্রে পর্যবসিত না হইয়া প্রাণের স্পর্শে স্পন্দিত হইয়া উঠে। ধর্মের বিশিষ্ট রঙ মিশ্রিত না থাকিলে দর্শন কোনও দিন এত অধিক সমাদৃত হইত কিনা সন্দেহ। মানুষের কোন প্রয়োজনে দর্শনের ভিতর ধৰ্ম্মের বীজ নিহিত থাকে। সেই কথাটিই এখন একটু পরিষ্কার করিয়া বলিতে চেষ্টা করিব। মানুষ যখন বুঝিতে পারে, সে কত ক্ষুদ্র, জগতের নানা ঘটনা ও শক্তি পুঞ্জের সম্মুখে সে সামান্য তৃণের ন্যায় কাতর ও শক্তিহীন, যখন তাহার অন্তরের আকুল বাসনা মুহূর্তে ধূলিসাৎ হইয়া যায়, তাহার সন্তান পরিজন ও প্রিয়াস্পদ মৃত্যু মুখে পতিত হয়—যখন সে প্রবলের অত্যাচারে জরিত হইয়া কাহারও নিকট কোন প্রতিকার পায় না, চারিদিকে কেবলই ছলনা, কৃতঘ্নতা ও নৈরাশ্যের ছায়া দেখিতে পায়, তখন স্বভাবতঃই এক সর্বশক্তিমান, দয়াময় জগৎ কারণে বিশ্বাস এবং পরলোকে তাহার ন্যায়বিচার ও দণ্ড পুরস্কারে আস্থা স্থাপনই তাহার একমাত্র সম্বল হয়। এই সান্ত্বনাটুকু না থাকিলে মানুষের জীবন অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িত।
মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি এই যে, সে যাহা আশা করে, কিংবা যাহার অভাব অনুভব করে, সে জিনিসের অস্তিত্ব সম্বন্ধে এক প্রকার নিঃসন্দেহ হয়। সে মনে করে – তৃষ্ণা আছে বলিয়া জল আছে, শিশুর ক্ষুৎপিপাসা আছে বলিয়া মাত শুন্য আছে, স্নেহ-বৃত্তি আছে বলিয়া সন্তান আছে ইত্যাদি। বাস্তবিক মানুষ পৃথিবীতে অনেক আকাঙ্ক্ষার চরিতার্থতা লাভ এবং সঙ্গে সঙ্গে বহু ইচ্ছার নিবৃত্তির সম্ভাবনাও দেখিতে পায়। সুতরাং সদৃশ যুক্তি দ্বারা অন্তরের প্রেষণা এবং আকাঙ্ক্ষাকেই নিবর্ত্তক জিনিসের অস্তিত্বের প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করে। বাস্তবিক এগুলি তর্কের কথা নয়-হৃদয়ের কথা, যুক্তির কথা নয়—বিশ্বাসের কথা। এ বিশ্বাসের প্রয়োজন আছে। ইহা না থাকিলে মানুষের মনে কোন শান্তি থাকিত না; অনন্তের পরিমাপ করিতে অসমর্থ বুদ্ধি বিকল হইয়া যাইত। অতি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিও জ্ঞাতসারেই হউক, বা অজ্ঞাতসারেই হউক, পরিশেষে কোন না কোন বিশ্বাসে আসিয়া ঠেকে এবং সেখানেই আশ্রয় পায়। নতুবা মানুষের চিন্তা ও কর্ম নিক্ষিপ্ত ও ছিন্ন ভিন্ন হইয়া যাইত। মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি ক্রমান্বয়েই উন্নত হইতেছে, কিন্তু ইহার একটা সীমা সদাই থাকিবে। মানুষের মনে আকাঙ্ক্ষাও চিরদিনই থাকিবে। সুতরাং প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ জগতে তাহার একটা শেষ নির্ভরস্থলই ধৰ্ম্মের গোড়ার কথা। সুতরাং কোন না কোন রূপে মানুষের এই স্বাভাবিক ধৰ্ম বৃত্তিও চির জাগরূক থাকিবে। বুদ্ধির শেষ সীমা হইতে বিশ্বাসের আরম্ভ। আর বিশ্বাসের মূলেও বুদ্ধির একটা অস্পষ্ট সম্মতি আছে—নতুবা বিশ্বাসের রাজ্যে বিপ্লব উপস্থিত হইত। বিশ্বাস একটি বিস্তীর্ণ সম্ভাব্যতার ক্ষেত্র; জ্ঞানের সহিত ইহার বিরোধ হইলে এই সম্ভাব্যতার ভিত্তি ভূমিসাৎ হইয়া যাওয়ায় বিশ্বাসও অন্তর্হিত হয়। মানুষের বুদ্ধি ও জ্ঞানের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসও ক্রমশঃ পরিবর্তিত হইতেছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে লোকের জ্ঞানের স্তর যেমন ভিন্ন ভিন্ন, বিশ্বাসও সেইরূপ পৃথক। প্রত্যেক দেশের ধর্ম সম্বন্ধীয় বিশ্বাস তথাকার সাধারণ অধিবাসীদের চিন্তা ও জ্ঞানের সহিত সম পর্যায়ভুক্ত। জ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসের সংস্কার আবশ্যক এবং অবশ্যম্ভাবী, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই অবশ্যম্ভাবী ও আবশ্যক ব্যাপারটি স্বীকার করিতে এবং স্বীকার করাইতে কাৰ্যত বহু নির্যাতন বিপ্লব ও রক্তপাত উপস্থিত হয়। কারণ এই সমস্ত বিশ্বাসে বুদ্ধির একটু অস্পষ্ট সম্মতি থাকিলেও প্রধানতঃ এগুলি হৃদয়ের ব্যাপার। আবার হৃদয়ের ব্যাপার সব সময়েই অনেকখানি অন্ধ এবং রহস্যময়। কোন একটা বিশ্বাস হৃদয়ে বদ্ধমূল হইয়া গেলে তাহা উৎপাটিত করা সাধারণতঃ অত্যন্ত পীড়াাজনক। নিজেদের বিশ্বাসের প্রতি এক প্রকার অন্ধ স্নেহ উৎপন্ন হয়; এজন্য সেরূপ বিশ্বাসকে অন্ধ বিশ্বাস বলা হয়। যুগে যুগে এই অন্ধ বিশ্বাসের সহিত জ্ঞানের সংঘর্ষ চলিয়া আসিতেছে। এইখানেই ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিরোধ। শুধু বিজ্ঞান নয়, এখানে ধৰ্ম্মের সহিত যুক্তির বিরোধ ঘটে। মুশকিল এইখানেই যে, প্রাণ ও বিজ্ঞান সর্বদা পরিবর্তন ও পরিবর্বনের ভিতর দিয়া যাইতেছে—কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসের স্বাভাবিক অবস্থাই স্থিতিশীলতা। এইরূপ স্থিতিশীলতার একটি কারণ, সাধারণ লোকের নির্বিকার অনুকরণ প্রবৃত্তি, চিন্তার নিষ্ক্রিয়তা এবং জ্ঞানের স্বল্পতা। কিন্তু ইহা ছাড়াও আর একটি প্রবলতর কারণ এই যে, ধৰ্ম্ম বিশ্বাসকে সচরাচর অপৌরুষের গৌরবে ভূষিত করিয়া শাস্ত্রকে অপরিবর্তনীয় বলিয়া মনে করা হয়। মানুষ তার অতীতকে লইয়া গৌরব করিতে চায় বলিয়া মোহে পড়িয়া পুরাতনকে সনাতন বলিয়া বিশ্বাস করে। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকবার এই অপরিবর্তনীয় ধর্ম বিশ্বাসও পরিবর্ত্তিত হইয়াছে। পথিবী গোলাকার বা সমতল, আমাদের পৃথিবীটা বিশ্বের কেন্দ্র কি না, এবং সুৰ্য্য ইহার চতুর্দিক পরিভ্রমণ করিতেছে কি না, কয়দিনে পৃথিবী সৃষ্ট হইয়াছে, কতকাল পূর্বে মনুষ্য জাতির সৃষ্টি হইয়াছে প্রভৃতি নানা বিষয়ে ধৰ্ম্ম বিশ্বাস বিজ্ঞানের নিকট হার মানিয়াছে। কিন্তু ইহাতে অসাধারণ প্রতিভাশালী পুরুষকে কিরূপ তিরস্কার ও নির্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছিল, এমন কি ইহাদের কয়েকজনকে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করিতে হইয়াছিল, সে ইতিহাস বড়ই হৃদয়বিদারক। এখন বাধ্য হইয়া ধৰ্ম্ম যাজকেরা বলিয়া থাকেন ধর্ম গ্রন্থ বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য নহে। বিজ্ঞান যখন চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইতে পারিয়াছে, ধৰ্ম্ম তখন বাধ্য হইয়া নীরবতা অবলম্বন করিয়াছে। আবার, ইউনুস নবীর কেচ্ছা; হনুমান ও সুর্যের বৃত্তান্ত, ঈসা নবীর সশরীরে চতুর্থ আকাশে অবস্থান, মাটির পাখীকে ফুঁ দিয়া প্রাণবন্ত করা, পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠা; আদম নবীর পাজর হইতে হাওয়া বিবির সৃষ্টি, নুহ নবীর কির্তী, জলকে পরাবে পরিণত করা, শুকরের ভিতর শয়তানের প্রবেশ, সশরীরে বেহেশত ভ্রমণ, নবীর স্বর্গ অধিকার, মূসা নবীর নীল দরিয়া বিভক্ত করা, মোহাম্মদ নবীর চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করা, ইয়াজুজ মাজুজের কাহিনী, আসহাব কাহাফের গল্প, গঙ্গা স্নানে পাপ ক্ষয়, চাকা ঘুরাইয়া পূণ্য লাভ, বলিদানে দেবতায় তুষ্টি, সীতাদেবীর জন্ম, ঈসা নবীর মৃত্যুতে ভরে উদ্ধার, হজরত মহম্মদের শাফায়াত—অসংখ্য ধৰ্ম্ম কথা ইউরোপীয় এবং অন্য দেশীয় সাধারণ চিন্তাশীল ব্যক্তির নিকট অবিশ্বাস্য কাহিনী মাত্র; কিম্বা বড় জোর এগুলি বিশেষ বিশেষ ঘটনার রূপক বর্ণনা। বুদ্ধি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই শেষোক্ত প্রকার ব্যাখ্যার উদ্ভব হইয়াছে। কিন্তু এইরূপ ব্যাখ্যা দিবার আবশ্যকতা ইহাতেই এই সমস্ত কাহিনীর আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা প্রমাণিত হইতেছে। পৃথিবীর যাবতীয় ধৰ্ম্ম সংস্থাপকের ইতিহাসই প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের সহিত বুদ্ধি, সাধারণ জ্ঞান, মুক্ত দৃষ্টি এবং যুক্তির সংঘর্ষের ইতিহাস। লোকে যখন প্রচলিত বিশ্বাস বা সংস্কারকে সবলে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকে, তখন সে বুঝিতে পারে না যে পূর্বতন অনেক জীর্ণ সংস্কারকে দলিত করিয়া তাহার সংস্কার জন্মলাভ করিয়াছে। সংস্কার যতদিন বুদ্ধির সহিত সমান তালে চলিতে থাকে, ততদিন তাহার জীবন্ত শক্তি প্রভাবে অনেক কিছু সৃষ্টি করে। কিন্তু এই সংস্কার যখন বুদ্ধি ও বিচারকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে তখনই তাহা কুসংস্কারে পরিণত হয়। সাধারণ লোকে ধৰ্ম্মের প্রকৃত মর্ম ভুলিয়া গিয়া এই সব বাহ্য সংস্কারকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া মনে করে। এইগুলিই তাহাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয়তর—কাৰ্যতঃ তাহাদের পক্ষে ঐগুলিই ধৰ্ম্ম। ধৰ্ম্মের প্রকৃত মূল্যটি কি, এইখানেই সমস্ত গোল। এই পার্থক্য হইতেই শত সহস্র ফেরকা বা সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছে। ইহাদের পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ হইতে অশেষ অনর্থের উৎপত্তি হইয়াছে। এই সমস্ত অনর্থের প্রধান কারণ এই যে, ধর্ম বিশ্বাস মূলতঃ স্থিতিশীল এবং জাগতিক ব্যাপারাদি গতিশীল। জনসাধারণ যেন জাতীয় ধৰ্ম্ম ভাণ্ডারের খাজাঞ্জী, লাভ-লোকসানের অতীত এবং নির্বিকার। খাজাঞ্জী একেবারে যক্ষের মত ভাণ্ডার আলাইয়া বসিয়া আছে, মুদ্রাক্ষয় ত দুরের কথা, নূতন মুদ্রা দিয়া ভাণ্ডার পূর্ণ করিবারও সাহস তাহাদের নাই। ইহারা মুদ্রার প্রকৃত মূল্য নির্ধারণে অসমর্থ বলিয়া মুদ্রা বিনিময় করাকেও অত্যন্ত ভয়াবহ মনে করে। কাজেই ‘যথা পূর্বং তথা পরং’ থাকাই তাহারা সর্বাপেক্ষা নিরাপদ মনে করে।
প্রত্যেক জাতি এবং প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী আপন আপন ধর্ম বিশ্বাসকে শ্রেষ্ঠতম এবং একমাত্র সত্য বলিয়া বিশ্বাস করে। বাস্তবিক পক্ষে, পূর্বে যেমন বলা হইয়াছে, ধর্ম মানুষের মনের একটা মূল বৃত্তি। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, এই মৌলিক ধর্ম্মবৃত্তি বা প্রেরণা হইতে যে দর্শন, যে থিওরী এবং যে ধৰ্ম্ম কাহিনী বা mythology’র সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা মনুষ্যরচিত এবং প্রত্যেক দেশের ধর্ম বিশ্বাস সেই সেই দেশের জনসাধারণের জ্ঞানের পরিধি দ্বারা সীমাবদ্ধ। মনে রাখিতে হইবে, এই সমস্ত দর্শন, থিওরী এবং কাহিনী মুখ্য বস্তু নয়—মূল ধৰ্ম্ম প্রেরণাকে রূপ দিবার জন্যই তাহার একটা বহিপ্রকাশ মাত্র। লোকে এই বহিঃপ্রকাশকেই মূল বস্তু বলিয়া ধরিয়া লইয়া অনর্থক বিবাদ করিয়া মরিতেছে। সকলেই শরবত খাইতে চাহিতেছে—সেখানে কাহারও দ্বিমত নাই। কাচের গেলাসে খাইবে, না রূপার গেলাসে খাইবে, এই লইয়াই যত গোলযোগ। কিম্বা গেলাসের গায়ে কি রকম নক্সা কাটা থাকিবে, এই লইয়া বৃথা আন্দোলন। পূৰ্ব্বে বলা হইয়াছে ধর্ম মানুষের মনের একটা আকুল আকাক্ষার অপূর্ব সান্ত্বনা। সুতরাং এই সান্ত্বনা যাহাতে অনুসন্ধান ও জ্ঞান বৃদ্ধির ফলে শীঘ্র নষ্ট হইতে না পারে তাহাই করা কব্য। এরূপ করিতে হইলে ইহাকে বিন্ধান সম্মত ও যুক্তিসঙ্গত হইতে হইবে। শাস্ত্র বা ধর্ম বিশ্বাসকে অপরিবর্তনীয় মনে করিলে যে সান্ত্বনা লাভ ধৰ্ম্ম প্রবৃত্তির মূল উদ্দেশ্য, তাহাই নষ্ট হইয়া যায়। বিজ্ঞান ও যুক্তির সহিত সংঘর্ষে (অর্থাৎ জ্ঞান বিচার ও বুদ্ধির ক্রমিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে) ধৰ্ম্মের আনুষঙ্গিক বিশ্বাসগুলির যদি একটু পরিবর্তন হয়, তবে তাহা দূষণীয় নহে, বরং সেইটিই প্রয়োজন। এরূপ পরিবর্তনে প্রকৃত ধৰ্ম্মের গায়ে আঁচড় লাগে না। কাচের গেলাস ভাঙ্গিয়া গেলে রূপার গেলাসে কাজ চালাইতে দোষ কি?
শৈশব অবস্থা হইতে যৌবন অবস্থা প্রাপ্তির দিকেই মানুষের স্বাভাবিক গতি। শৈশব অবস্থায় লোকে অতিরিক্ত বিশ্বাস ও ভক্তি প্রবণ থাকে। যৌবন অবস্থায় লোকে চোখ খুলিয়া দেখিয়া শুনিয়া বুদ্ধি খাটাইয়া চলিতে চায়। মানব সভ্যতার শৈশব অবস্থা অন্য দেশে কাটিয়া গিয়াছে, আমাদের দেশেও যাইতে বসিয়াছে। যে সময় লোকে বিনা বিচারে ভক্তি গদগদ ভাবে অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করিত সে যুগ আর নাই। যে সময় লোকে অজ্ঞার বিচার না করিয়া অজ্ঞাকারীর মুখ চাহিয়াই আদেশ পালন করিত, সে যুগের অবসান হইয়াছে। বৰ্ত্তমান যুগে ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা প্রবল হইয়াছে। বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া, অভিমত গঠন করিয়া তদনুসারে চলাই বৰ্ত্তমান যুগের আদর্শ। এজন্য ভাববাদী বা পয়গম্বরদিগের যুগের অবসান হইয়াছে বলিতে হইবে। বর্তমান যুগে যাতায়াত ও সংবাদ আদান প্রদানের সুসাধ্যতার ফল, শিক্ষা ও জ্ঞান দ্রুতগতিতে প্রসারিত হইতেছে। জ্ঞান বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করিলেই লোকের মনে সতর্কতা ও সন্দেহের উদয় হয়। বর্তমান যুগের সাধারণ লোকেও জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে পূর্বকালের মুনি-ঋষি, পয়গম্বর, অবতার প্রভৃতির চেয়ে অধিক উন্নত। সুতরাং পূর্বকালে পয়গম্বরদিগের দ্বারা যে কাজ হইত, বর্তমান যুগে তাহা হইবার আশা নাই। এখন ঈসা নবী যদি সত্য সত্যই পুনরায় অবতীর্ণ হইতেন, তবে তিনি যে বিশেষ কিছু করিতে পারিতেন, এবং তাহাকে যে অধিক সংখ্যক লোকে পয়গম্বর বলিয়া স্বীকার করিত, সে বিষয় ঘোরতর সন্দেহ আছে।
পৃথিবীতে যত পয়গম্বর আসিয়াছেন, তাঁহাৱা প্রত্যেকেই আপন আপন সমাজের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে শক্তি নিয়োজিত করিয়াছেন, এবং কতকগুলি সময়োপযোগী নূতন সত্য প্রচার করিয়াছেন। যতদিন মানুষের অস্তিত্ব আছে, ততদিন এ কাজেরও সার্থকতা থাকিবে। কিন্তু কোন ব্যক্তি বিশেষ সাক্ষাৎ ভাবে আল্লাহর নিকট হইতে সকলের উপকারের জন্য আদেশ বহন করিয়া আনিতেছেন, একথা বোধ হয় এযুগের লোকে আর বিশ্বাস করিবে না। খাদ্য সাক্ষাৎ ভাবে জগদ্ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়া তাহার স্বরচিত নিয়মের বিরুদ্ধতা করিবেন, এ বিশ্বাস ক্রমান্বয়ে লোপ পাইতেছে। এজন্য পয়গম্বরদিগের ঐশ্বরিকতা কমিয়া গিয়া, তাহারা প্রতিভাশালী বিরাট মানুষে পরিণত হইতেছেন। হজরত মোহাম্মদ এ সত্যটি স্পষ্ট অনুভব করিয়াছিলেন বলিয়া, নিজেকে বার বার মনুষ্য বলিয়া প্রচার করিয়াছেন, এবং বলিয়া গিয়াছেন যে, তাহার পর আর কোন নবী আসিবেন না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইহাও বলিয়া গিয়াছেন যে, নবীর কাজ করিবার জন্য যুগে যুগে বহু লোকের আবির্ভাব হইবে। লােকে তাহাদিগকে নবী না বলিয়া মোজাদ্দাদ বা সংস্কারক বলিবে। হজরত মোহাম্মদ মানুষের ক্রমবিকাশের গতিও স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছিলেন। তাই তিনি বলিয়া গিয়াছেন, আমার অনুবীদের মধ্যে এমন অনেক লোক জন্মিবে, যাহারা ইসরাইল বংশীয় নবীদের তুল্য, হজরত মোহাম্মদের এই সমস্ত উক্তি তাহার অসামান্য প্রতিভা ও দূরদৃষ্টির পরিচায়ক।
এক ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদেরও সকলের ধর্ম ঠিক এক প্রকার নয়। প্রত্যেকের শারীরিক আকৃতিতে যেরূপ বিভিন্নতা আছে, মানসিক প্রকৃতিতেও তদ্রূপ। সংসারের বড় বড় ধৰ্ম্ম এক একটি আদর্শ মাত্র। প্রত্যেকে আপন মনের রঙে তাহার ধৰ্ম্ম রতি করিয়া লয়। প্রকৃত ধৰ্ম্ম সামাজিক ব্যাপার নহে, উহা ব্যক্তিগত। এজন্য একটা সাধারণ ছাপ মারা থাকিলেও বস্তুত পৃথিবীতে যত লোক তত মন, তত ধৰ্ম্ম। শুধু দীক্ষা দ্বারা ধৰ্ম্ম লাভ হয় না,ধৰ্মলাভ করিতে চিন্তা ও সাধনা চাই। কোন ধৰ্ম্ম, লোকের জ্ঞান ও বুদ্ধি অপেক্ষা নিম্ন হইলে যেমন তাহা উন্নতির বিরােধী হয়, আবার অধিক উন্নত হইলেও লোকে তাহার মৰ্ম্ম গ্রহণ করিতে পারে না বলিয়া তাহাতে কোন ফলোদয় হয় না। এজন্য মিশনারী প্রচেষ্টা দ্বারা সমাজে হয়ত লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু ধৰ্ম্ম হিসাবে তাহার কার্যকারিতা তত অধিক নয়। শিক্ষা ও জ্ঞানের উন্নতিই প্রচারের এক প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। জ্ঞান ও বুদ্ধির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে লোকে আপনা আপনি অধিক উন্নত ধৰ্ম্ম গ্রহণ করিবে।
আমরা মানুষের মনের যে মৌলিক বৃত্তিকে ধৰ্ম্ম নাম দিয়াছি, যাহা শাশ্বত সনাতন, সেটি অনেকখানি ধরা ছোঁয়ার বাহিরের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাহাকে রূপ দিবার জন্য অনেক সামাজিক নীতি ও রীতির আশ্রয় লইতে হইয়াছে। এই নীতি ও রীতিগুলি সাক্ষাৎভাবে ধৰ্ম্মের সহিত সংশ্লিষ্ট না থাকিলেও, পরোক্ষভাবে আছে। এইখানেই ধর্ম ও সমাজের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। এই সম্বন্ধে কথা আমাদিগকে সর্বদা মনে রাখিতে হইবে। ধর্মগ্রন্থে যাহা লেখা আছে, তাহার সমস্তই যে ধৰ্ম্ম-কথা তাহা নহে। উহার মধ্যে কোনগুলি সমাজ-কথা তাহা বাছিয়া বাহির করিতে হইবে। ধর্মের অর্থ সুবিধা বুঝিয়া একটু ব্যাপক ভাবে ধরিলে হয়ত পৃথিবীর সব কিছুকেই ইহার অন্তর্ভুক্ত করিয়া লওয়া যায়। কিন্তু তাহাতে আমাদের সান্ত্বনা মিলিবে না, অথচ কলহও বাড়িয়া যাইবে। বস্তুতঃ যে সমস্ত খুঁটিনাটি ও সামান্য ব্যাপার লইয়া হানাফী, মোহাম্মদী, আহমাদী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর রেষারেষি হইতে দেখা যায়, একটু স্থির চিত্তে ভাবিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারা যায়, সেগুলি মোটেই ধৰ্ম্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়, এমন কি অনেক স্থলে সামাজিক রীতি ব্যতীত আর কিছুই নহে। বিভিন্ন ধৰ্ম্ম-দর্শনের মধ্যে যে প্রভেদ সেটি কেবল কালচারের প্রভেদ পূর্বেই বলিয়াছি। মানুষে মানুষে সে প্রভেদ চিরকাল থাকিবেই। এক্ষেত্রে যাহারা অপেক্ষাকৃত উন্নত, তাহারা অনুন্নতদের প্রতি কৃপাপরবশ হইয়া যদি বল প্রকাশ বা অন্য উপায়ে তাহাদিগকে বাধ্য করিয়া উন্নত করিতে চান, তবে বড়ই নিষ্ঠুরতা হইবে, বেচারাদিগকে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ফেলিয়া নিৰ্যাতন করা হইবে। এরূপ ক্ষেত্রে অনুন্নত সমাজের ভিতরে ধীরে ধীরে জ্ঞানের বীজ ছড়াইয়া দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাহার ফলে উহারা যতদূর উন্নত হইবে, উহাদের জাগতিক ও ধৰ্ম্ম সংক্রান্ত ব্যাপারেও সেই অনুপাতে উন্নতি হইবে।
সমাজের স্থিতি রক্ষার জন্য অন্য কতকগুলি শাসন ও শৃঙ্খলার প্রয়োজন। কিন্তু সেগুলি যে ধর্মের খাতিরে নয়, সমাজের খাতিরেই পালনীয় একথা ভুলিলে চলিবে কেন? লোকের মনে ধর্মের নামে একটি মোহ আছে, সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মের পরিধি বাড়াইয়া সমাজ বিধিকে ধৰ্ম্মের অন্তর্গত বলিয়া ধরিয়া লইয়া এই সমাজ বিধির প্রতি মোহ জমিয়া গেলে অনর্থক বাড়াবাড়ি ও জঞ্জাল বৃদ্ধি ভিন্ন কিছুই হয় না। তাহা ছাড়া, ধর্ম গ্রন্থের যে অর্থ কয়েক শতাব্দী ধরিয়া চলিয়া আসিয়াছে, তাহাই যে চরম এ বিশ্বাসটিও বড় মারাত্মক।
বর্তমান যুগের নূতন জ্ঞানালোকে নূতন দৃষ্টিতে দেখিয়া আমাদিগকে তাহার অর্থ বুঝিতে হইবে। এস্থলে, সমাজ ব্যক্তিত্বের বিকাশের অন্তরায় হইলে, সেটা সমাজেরই দুর্ভাগ্য। ফলত মানুষের কল্যাণের জন্যই ধর্ম্ম, মানুষের জন্যই সমাজ। ধৰ্ম্ম এবং সমাজ যদি মানুষেরই অবাধ মুক্তির পথে কণ্টকস্বরূপ হয়, তবে তাহার চেয়ে দুভাগ্যের কথা আর কি হইতে পারে? উজ্জ্বলতা সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। এজন্য সমাজের লোককে শাস্তি দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু চিন্তা এবং ধৰ্ম্ম লোকের ব্যক্তিগত অধিকার। এইগুলিকে নিষ্পেষিত করিয়া ফেলা সমাজ জীবন বা জাতীয় জীবনে ঘোর কলঙ্কের কথা। মধ্যযুগে অনেক উচ্চ চিন্তা এবং উজ্জ্বল প্রতিভা সম্মানের পরিবর্তে শোচনীয় পরিণাম লাভ করিয়াছে। কিন্তু পরবর্তী যুগে লোকে ভুল বুঝিয়া তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়াছে। বৰ্ত্তমান যুগে লোকে ক্রমশঃ বুঝিতে পারিতেছে চিন্তাশীল, জ্ঞানী ও প্রতিভাবান পুরুষরাই স্থিতিশীল সমাজকে প্রবল আঘাতে জাগ্রত করিয়া উন্নতির দিকে অনেক দূর অগ্রসর করিয়া দেন। এজন্য বৰ্তমান যুগে এক সঙ্গে যত অধিক জ্ঞানী ব্যক্তির আবির্ভাব হইতেছে, এবং জগৎ যেরূপ দ্রুত গতিতে স্থায়ী উন্নতির উচ্চ হইতে উচ্চতর সোপানে আরোহণ করিতেছে, ইতিপূর্বে ইহার তুলনা পাওয়া দুষ্কর। পূৰ্ব্বে জ্ঞান ও ক্ষমতা জাতির শ্রেষ্ঠ দুই চার জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তাহারাই সমগ্র সমাজকে টানিয়া তুলিতে চাহিতেন। বর্তমানে বুদ্ধি ও চিন্তার স্বাধীনতার ফলে, অবহেলিত সাধারণ লোকেরাও মোটের উপর জ্ঞানের উচ্চতর সোপানে আরোহণ করিয়া একটু স্বাধীন আবহাওয়ার আস্বাদ পাইতেছে। একটি জাতি ভিতরের প্রেরণায় সমগ্রভাবে উন্নত হইলে তবেই তাহাকে প্রকৃত উন্নতি বলে। শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে লোকে ধৰ্ম্ম ও সমাজের সূত্রগুলি স্পষ্টরূপে অনুভব করিতে পারিবে, লোকের উদারতা বৃদ্ধি পাইবে এবং ব্যক্তিত্বের সম্মানও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাইবে। ব্যক্তিত্বের এই পরিপুষ্টির মধ্যেই জাতির ভবিষ্যৎ উন্নতির বীজ নিহিত আছে।
…………………………
শিখা পত্রিকার আরেকটা লেখা পড়তে পারেন এইখানে:
বাঙ্গালী মুসলমানের সাহিত্য-সমস্যা: কাজী আবদুল ওদুদ
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024