জগৎ শেঠ – রজনীকান্ত গুপ্ত (১৮২২)
বঙ্গদর্শন পত্রিকার ৯৮ নাম্বার সংখ্যায় (অগ্রহায়ণ, ১২৮৯ বাংলা সনে) এই লেখাটা ছাপা হইছিল। খুব অথেনটিক হিস্ট্রিক্যাল ডকুমেন্ট হিসাবে এই লেখাটারে নিলে ভুলই হবে।
জগৎ শেঠ যে একজন মানুশ না, বরং একটা উপাধি সেইটা বলতে গিয়া হিস্ট্রিরে পারসোনাল কিছু ঘটনার ভিতর দিয়াই দেখা হইছে, একটা হিস্ট্রোরিক কোন জায়গা থিকা এতোটা না। জগৎ শেঠের সিগনিফিকেন্সটারে বুঝতে হইলে অই সময়ের বাংলাদেশের ইকনোমিক সিস্টেমটা কিভাবে ফাংশন করতো, সেই ফ্রেমওয়ার্কটার ভিতর থিকা দেখতে পারাটা দরকার। আর যখন এই মানি সার্কুলেশনের ক্ষমতা’টা ইংরেজদের দখলে চইলা আসলো তখন জগৎ শেঠের কোন সিগনিফিকেন্স আর থাকার কথা না, ছিলও না। এই আলাপটা যে নাই – তা না, বেইজ হিসাবে এইটা নাই।
সেকেন্ড হইলো, অনেক ঘটনার রেফারেন্স থাকলেও মেজর ডিসিশানগুলা একটা স্পেকুলেশনের জায়গা থিকা বলা হইছে। স্পেকুলেশন বইলাই ভুল না, কিন্তু স্পেকুলেশনের বেইজগুলা যেহেতু মিসিং, কোন হিস্ট্রিক্যাল ট্রুথ হিসাবে নেয়াটাও রিস্কি হওয়ার কথা। একটা ন্যাশনালিস্টিক প্লেজারের জায়গা থিকা ঘটনাগুলারে বলা হইছে। কিন্তু অনেকগুলা ইনফরমেশন এইখানে আছে। জগৎ শেঠরে নিয়া পপুলার যতো আলাপ আছে এখন পর্যন্ত, তার প্রায় সবগুলাই মেবি এই লেখাটা থিকাই একস্ট্রাক্ট করা। যার ফলে, একটা হিস্ট্রিক্যাল ডকুমেন্ট হিসাবে, একটা সময়ের হিস্ট্রি-রিডিং হিসাবে এই লেখাটারে রিকগনাইজ করাটা দরকার।
ই. হা.
…………………………
অনেকের বিশ্বাস, জগৎ শেঠ একজন লোকের নাম। মার্শমান সাহেবের কল্যাণে এই কথা দেশময় রাষ্ট হইইয়াছে। পাঠশালার ছেলেরা জগৎ শেঠকে একটী লোক বলিয়াই জানে। আমাদের স্কুলে প্রকৃত ইতিহাসের চর্চ্চা হয় না, তাই এইরূপ দুই একটী ভ্রম থাকিয়া যায়। জগৎ শেঠ কোন মানুষের নাম নহে। একটী উপাধি মাত্র। শ্রেষ্ঠি শব্দের অপভ্রংশে শেঠ হইয়াছে। শ্রেষ্ঠি বৈশ্যদের উপাধি। হিন্দু রাজাদের অধিকারকালে বৈশ্যেরা ধনরক্ষকের কাজ করিতেন। অসময়ে তাহারা রাজাকে টাকা ধার দিতেন। মুসলমান নবাবদের অধিকার কালে সেই শেঠেরা ধনরক্ষক হন, সময়ে অসময়ে টাকা ধার দিয়া নবাবের সাহায্য করেন। এই সময়ে শেঠদিগের অসীম ক্ষমতা । ধনে,মানে, খ্যাতিতে, ইহারা এই সময়ে ভারতবর্ষের অনেক জমীদারের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। বৰ্ক সাহেব উল্লেখ করিয়াছেন, শেঠদিগের কারবার ইংলণ্ডের ব্যাঙ্কের ন্যায় বিস্তৃত। ইহা অত্যুক্তি নহে। শেঠগণ ভারতবর্ষে ধনকুবের ছিলেন। ইহারা ভারতবর্ষের “রথচাইল্ড” বলিয়া বর্ণিত হইতেন। এক সময়ে ইহারা আপনাদের ক্ষমতাবলে দিল্লীর আমখাঁসেও আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন। ইহাদের অর্থ, ইহাদের প্রভুশক্তি ও ইহাদের মন্ত্রণা অনেক সময়ে দিল্লীর বাদশাহকে রক্ষা করিয়াছিল। বাঙ্গালার ইতিহাসের অনেক প্রধান প্রধান ঘটনার সহিত শেঠদিগের সংস্রব আছে। শেঠগণ এক সময়ে বাঙ্গালার নবাবকে রক্ষা করিয়াছিলেন, এবং এক সময়ে সেই নবাবেরই বিরুদ্ধে উঠিয়া, তাহাকে হতমান ও হতসর্ব্বস্ব করিয়া, শ্বেতপুরুষকে তাহার সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন ।
যে শেঠবংশের কথা বলা যাইতেছে, তাহা দুই শত বৎসরের অধিক প্রাচীন নহে। রাজপুত হইতে এই বংশের উৎপত্তি হইয়াছে। মাড়য়ারীগণ শেঠদিগের মূল। শেঠ খেতাম্বরীর জৈন সম্প্রদায়ভুক্ত। যোধপুর রাজ্যের অন্তর্গত নাগর ইহাদের আদি বাসস্থান। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইহাদের আদিপুরুষ হীরানন্দ শাহ অর্থ উপার্জ্জন মানসে পাটনায় আসিয়া বাস করেন। হীরানন্দের সাত পুত্র। ইহারা সকলেই ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন স্থলে আপনাদের কারবার চালাইতে আরম্ভ করেন। জ্যেষ্ঠের নাম মাণিকচাঁদ। ইনি ঢাকায় আসিয়া বাস করেন। শেঠগণ এই মাণিকচাঁদকেই বাঙ্গলায় আপনাদের বংশের স্থাপনকর্তা বলেন। ঢাকা এই সময়ে বাঙ্গালার রাজধানী এবং এবং প্রধান বানিজ্য ব্যবসার স্থান । মানিকচাঁদ এইখানে আপনার ভাগ্য পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হন। বাঙ্গালার নবাবী এই সময়ে মুর্ষিদ কুলি খাঁর হাতে ছিল। মাণিকচাঁদ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দেখাইয়া অল্প সময়ের মধ্যেই মুর্ষিদ কুলির প্রিয়পাত্র হইয়া উঠেন। ১৭০৪ অব্দে মুর্ষিদ কুলি খাঁ ঢাকা হইতে মুর্ষিদাবাদে যাইয়া রাজধানী স্থাপন করিলে মাণিকচাঁদ মুর্শিদাবাদে আইসেন। এইখানে তাহার ক্ষমতা বাড়িয়া উঠে। মাণিকচাঁদ নবাবের দক্ষিণ হস্ত হন। তাহার পরামর্শ অনুসারে রাজ্যের সকল কার্য্য নিৰ্ব্বাহ হইতে থাকে। যে সমস্ত জমীদার ও তহশীলদার নবাব সরকারে রাজস্ব দিতেন, তাহাদের সকলকেই মাণিকচাঁদের হাতে টাকা দিতে হইত। ইহা ছাড়া প্রতি বৎসর যে দেড় কোটী টাকা রাজস্ব দিতে হইত, তাহাও মাণিকচাঁদেরর হাত দিয়া যাইত। নবাব অনেক সময়ে নিজের টাকাকড়ি মাণিকচাঁদের ধনাগারে জমা রাখিতেন। মুর্ষিদ কুলি খাঁ দিল্লীর সম্রাট ফিরোক্ শাহকে অনুরোধ করিয়া ১৭১৫ অব্দে মাণিকচাঁদকে “শেঠ” উপাধি দেন। এই সময় হইতে মাণিকচাঁদ ও তার সন্তানগণ মুর্ষিদাবাদের কৌন্সিলের প্রধান সভা হন। শাসনসংক্রাস্ত সকল বিষয়েই ইহাদের আধিপত্য থাকে। ইহারা অনেক সময়ে অনেক বিষয়ে দিল্লীর দরবারের প্রধান প্রধান ওমরাহকে পত্র দিখিয়া আপনাদের মতামত নির্দ্দেশ করিতে থাকেন।
মাণিকচাঁদ নিঃসন্তান ছিলেন। । ফতেচাঁদ নামে তাহার একটী ভ্রাতৃপুত্রকে তিনি দত্তকপুত্র লন। ফতেচাঁদও “শেঠ” উপাধি পাইয়াছিলেন। সম্রাট ফিরোক শাহ ইহাকে বড় ভাল বাসিতেন। ১৭২২ সালে মাণিকচাঁদের মৃত্যু হয়। ফতেচাঁদ তাহার পদ অধিকার করেন। কেহ কেহ কহেন, ১৭২৪ অব্দে ফতেচাঁদ যখন দিল্লীতে উপস্থিত হন, তখন সম্রাট মহম্মদ শাহ তাহাকে “জগৎ শেঠ” উপাধি দান করেন। আবার কেহ কেহ কহেন, ফতেচাঁদ ফিরোক্ শাহের নিকট হইতে এই উপাধি প্রাপ্ত হন। যাহা হউক, ফতেচাঁদই যে সকলের আগে “জগৎ শেঠ” উপাধি পাইয়াছিলেন, ইহা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন। ফতেচাঁদের বড় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, দিল্লীর দরবারে তাহার বড় সুখ্যাতি। কোন সময়ে মুর্ষিদ কুলি খাঁ সম্রাটের বিরাগভাজন হওয়াতে বাঙ্গালায় নবাবী পদ ফতেচাঁদকে দিবার কথা হয়। কিন্তু মুর্ষিদ কুলি খাঁ শেঠবংশের সহায় ছিলেন, এজন্য ফতেচাঁদ এই পদ গ্রহণ করেন নাই; বরং সম্রাটের সহিত নবাবের মিল করিয়া দিয়া উপকারীর প্রত্যুপকার করেন। এবিষয়ে দিল্লী হইতে যে ফৰ্ম্মান প্রচার হয়, তাহাতে লেখা ছিল, “ফতেচাঁদের বিশেষ চেষ্টায় ও প্রার্থনায় বাঙ্গলার নবাব দিল্লীর সম্রাটের অনুগ্রহভাজন হইলেন।” নবাব শাসনসংক্রান্ত সমুদয় বিষয়ে ফতেচাঁদের পরামর্শ লইতেন। এই সময় হইতে ফতেচাঁদের সন্তানগণ দিল্লীর দরবারে প্রসিদ্ধ হন। বাঙ্গালার নবাবকে কোন সময়ে খেলাত দেওয়া আবশ্যক হইলে, সেই সঙ্গে জগৎ শেঠকেও খেলাত দেওয়া হইত। বাদশাহের নিকট ফতেচাঁদ মণিখচিত একটী উৎকৃষ্ট সিলমোহর উপহার প্রাপ্ত হন। ইহাতে “জগৎ শেঠ” উপাধি ক্ষোদিত ছিল। শেঠবংশীয়গণ বহুকালপর্য্যন্ত এই মোহরটী যত্নের সহিত রাখিয়াছিলেন।
মুর্ষিদ কুলি খাঁর মৃত্যু হইলে সুজাউদ্দৌলা বাঙ্গালার নবাব হন। ফতেচাঁদ সুজাউদ্দৌলার কৌন্সিলের চারি জন সভ্যের মধ্যে একজন সভ্য ছিলেন। এই নবাব, ফতেচাঁদের পরামর্শ অনুসারে, চৌদ্দ বৎসর বাঙ্গালার শাসনকার্য্য নির্ব্বাহ করেন। ইহার পর সরফরাজ খাঁ বাঙ্গালার সুবাদার হইলেও ফতেচাঁদ কৌন্সিলের পদ ত্যাগ করেন নাই। কিন্তু শেষে সরফরাজের ইন্দ্রিয়পরতা ও যথেচ্ছাচারে ফতেচাঁদ বড় বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। শীঘ্র উভয়ের মধ্যে অসদ্ভাব জন্মিল। ইতিহাসলেখক অৰ্ম্মি সাহেব কহেন, ফতেচাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধু পরমা সুন্দরী ছিলেন। নবাব তাহার রূপলাবণ্যের বিষয় অবগত হইয়া তাহাকে দেখিতে ইচ্ছা করেন। ফতেচাঁদ নবাবকে এই অনুচিত কাজ হইতে বিরত করিবার জন্য অনেক চেষ্টা পাইলেন, কিন্তু ইহাতে কোন ফল হইল না। দুরাচার নবাব আপনার জিদ বজায় রাখিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইলেন। ফতেচাঁদ নিরূপায় হইলেন। যুবতী পুত্রবধু নবাবের ঘরে প্রেরিত হইলেন। নবাব কিয়ৎক্ষণমাত্র নয়নযুগল পরিতৃপ্ত করিলেন। যুবতী অকলঙ্কিত শরীরে ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু এই ঘটনায় ফতেচাঁদের হৃদয়ে বড় আঘাত লাগিল। অসৃস্পশ্যা অন্তঃপুরবাসিনী বধূ পরধর্ম্মাক্রান্ত পরপুরুষের মুখ দেখাতে ফতেচাঁদ আপনাকে বড় অপমানিত জ্ঞান করিলেন। এ বিরাগ, এ অপমান ও এ ক্ষোভ তিনি আর ভুলিতে পারিলেন না। ক্ষোভে, রোষে ও অপমানে ফতেচাঁদ আপনার বংশের মঙ্গল বিধাতা মুর্ষিদ কুলি খাঁর বংশধরের পক্ষ ছাড়িয়া আলিবর্দ্দি খাঁর সহিত মিশিলেন ।
কিন্তু শেঠবংশীয়গণ এই ঘটনাটী আর এক ভাবে প্রকাশ করিয়া থাকেন । তাহারা কহেন, মুর্ষিদ কুলি খাঁ মাণিক চাঁদের নিকট সাত কোটী টাকা গচ্ছিত রাখিয়াছিলেন। এই টাকা আর তাহাকে ফিরাইয়া দেওয়া হয় নাই। ইহার পর সরফরাজ্ খাঁ এই টাকার জন্য ফতেচাঁদকে পীড়াপীড়ি করাতে তিনি নবাবকে কিছু কাল অপেক্ষা করিতে কহেন। এই সময়ে আলিবর্দ্দী খাঁ বেহারে বিদ্রোহী হইয়াছিলেন। ফতেচাঁদ এই অবসরে তার সহিত মিশেন। এই বিদ্রোহের ফল বাঙ্গালার ইতিহাসপাঠকের অবহিত নাই। গড়িয়ার যুদ্ধে সরফরাজ নিহত হন, এবং আলিবর্দ্দী, বাঙ্গালা, বেহার ও উড়িষ্যার শাসনদণ্ড গ্রহণ করেন।
১৭৪৪ অব্দে ফতেচাঁদের মৃত্যু হয়। তাহার দুটী ছেলে, পিতা বাঁচিয়া থাকিতেই, এক একটী পুত্র রাখিয়া, পরলোক গমন করিয়াছিলেন। ফতেচাঁদের জ্যেষ্ঠ পৌত্রের নাম মহাতাব রায়, এবং কনিষ্ঠ পৌত্রের নাম স্বরূপচাঁদ। মহাতাব রায় “জগৎ শেঠ” এবং স্বরূপচাঁদ “মহারাজ” উপাধি পাইয়া, দুই জনেই একত্রে আপনাদের কারবার চালাইতে লাগিলেন। এই সময়ে শেঠদিগের বাণিজ্যলক্ষ্মীর বড় উন্নতি। কথিত আছে, তাহাদের মূলধন দশ কোটী টাকা হয়। ১৭৪২ অব্দে মারহাট্টা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত মুর্ষিদাবাদ লুঠিয়া লন। ইহাতে শেঠদিগের আড়াই কোটী টাকা অপহৃত হয়। মুসলমান্ ইতিহাসলেখক (সয়ের মতাক্ষরীম প্রণেতা গোলাম হোসেন) কহিয়াছেন, শেঠগণ এক কোটী টাকার বিল দেখিবামাত্র টাকা দিতে পারিতেন। প্রবাদ আছে, শেঠেরা ইচ্ছা করিলে টাকা সাজাইয়া সুতির নিকট ভাগীরথীর মুখ বুজাইয়া ফেলিতে পারিতেন । নবাবের শাসনসময়ে টাকা রাখিবার জন্য দেশের সকল স্থানে ক্ষুদ্র ধনাগার ছিল না। জমিদারগণ রাজস্ব আদায় করিয়া মুর্ষিদাবাদের ধনাগারে জমা করিয়া দিতেন। মুর্ষিদ কুলি খাঁর প্রবর্ত্তিত নিয়ম অনুসারে রাজস্বঘটিত বার্ষিক বন্দোবস্তের সময় সকল জমিদারকেই আপনাদের হিসাবাদি পরিষ্কার করিবার জন্য মুর্ষিদাবাদে শেঠদিগের ব্যাঙ্কে আসিতে হইত।
নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ যখন কাশীমবাজারের কুঠী আক্রমণ করেন, সেই সময়ে ইংরাজেরা ১২ লক্ষ টাকা দিয়া অব্যাহতি পান। এই টাকা শেঠদিগের দ্বারা প্রেরিত হইয়াছিল।
বার্টসন সাহেব, ১৭৬০ অব্দে যে বিবরণ লিখেন, তাহাতে জানা যায়, জগৎ শেঠ শতকরা অর্দ্ধ মুদ্রা দিয়া মুর্ষিদাবাদের টাকাশাল হইতে টাকা প্রস্তুত করিয়া লইতেন।
১৭৫৩ অব্দে বিলাতের ডিরেক্টর্ সভা কলিকাতার কৌন্সিলের অধ্যক্ষকে কলিকাতায় একটী টাকাশাল স্থাপন করিবার অনুরোধ করেন, কিন্তু কৌন্সিলের অধ্যক্ষ শেঠদিগের ধনবাহুল্যের উল্লেখ করিয়া এই অনুরোধ রক্ষায় অসমর্থ হন। এসম্বন্ধে তিনি ডিরেক্টরদের স্পষ্টাক্ষরে লিখেন, “আমরা নবাবকে যত টাকা দিব, জগৎ শেঠ তাহা অপেক্ষা অনেক টাকা দিয়া নবাবকে বশীভূত করিবেন । সুতরাং নবাবের নিকট হইতে টাকশাল স্থাপনের অনুমতি পাইবার সম্ভাবনা নাই।” ইহার পর ডিরেক্টর্ সভার অধ্যক্ষ কলিকাতার কৌন্সিলকে জগৎ শেঠের অজ্ঞাতসারে অতি গোপনে দিল্লীর দরবার হইতে অনুমতি আনিবার পরামর্শ দিলেন। তদানুসারে দুই লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া ১৭৫৭ অব্দে ইংরাজেরা কলিকাতায় টাকশাল স্থাপন করেন। কিন্তু জগৎ শেঠের সহিত প্রতিদ্বন্দীতা করিয়া কার্য্য করা তাহাদের পক্ষে সহজ হয় নাই। ডগলাস নামে একজন সমৃদ্ধিপন্ন ব্যবসায়ীর সহিত কোম্পানীর টাকা লেনা দেনা ছিল। কলিকাতায় টাকশাল হওয়ায় এক বৎসর পরে ডগলাস ইংরাজদের মুদ্রিত টাকা লইয়া কারবার চালাইতে অসম্মত হইলেন। তিনি বলিলেন “জগৎ শেঠ মুর্ষিদাবাদের টাকার মূল্য অনায়াসে কম করিয়া আপনার কারবার চালাইবেন; কিন্তু তিনি তাহার সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া ইংরাজদের মুদ্রিত সিক্কা টাকার মূল্য কম করিতে পারেন না।” শেঠেরা কেমন সমৃদ্ধিপন্ন ও কেমন ক্ষমতাশীল ছিলেন, ইহাতে সুন্দর বুঝা যাইতেছে।
১৭৫৬ অব্দে আলিবর্দ্দী খাঁর মৃত্যু হয়। এই অবধি শেঠদিগের সহিত ইংরাজদিগের সম্বন্ধ বাড়িতে থাকে। নবাব সেরাজউদ্দৌলা কলিকাতা আক্রমণ ও অবরোধ করিলে ইংরাজেরা পলাইয়া পলতার নিকট উপস্থিত হন এবং জাহাজে থাকিয়াই নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করিবার গূঢ় মন্ত্রণা করেন। এই সময়ে ইংরাজেরা জগৎ শেঠকে হাত করিবার চেষ্টা পান। ২২ এ জুন কলিকাতা নবাবের অধিকৃত হয়। ২২ এ আগষ্ট কলিকাতার কৌন্সিল নবাবের সহিত সম্মিলনের অভিপ্রায়ে জগৎ শেঠকে একখানি পত্র লিখিবার প্রস্তাব করেন।
মীর জাফর প্রভৃতি সেরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতিগণ পূর্নীয়ার শাসন কর্ত্তা সকৎজঙ্গের বিরুদ্ধে গেলে, বাঙ্গালার নবাবের সহিত জগৎ শেঠের অসদ্ভাব জন্মে। জগৎ শেঠ স্বয়ং চেষ্টা করিয়া দিল্লী হইতে সমর আনিয়া নবাবকে দেন নাই, এই তাহার এক অপরাধ। তাহার আর এক অপরাধ, নবাব তাহাকে বনিক্দের নিকট হইতে তিন কোটী টাকা তুলিয়া দিতে বলেন; কিন্তু জগৎ শেঠ মহাতাব রায় ইহাতে এই উত্তর করেন, যে এরূপে টাকা তুলিতে গেলে অতিশয় অত্যাচার হইবে। এই কথা শুনিয়া নবাব ক্রুদ্ধ হইয়া তাহার মুখে মুষ্টাঘাত করিলেন এবং তাহাকে কারাগারে বদ্ধ করিয়া রাখিলেন। এই কারণেই সিরাজের কপাল পুড়ে।
অপমানিত হইয়া মহাতাব রায় ইংরাজদের সহিত মিশিয়া সিরাজউদ্দৌলাকে পদচ্যুত করিতে যথাশক্তি চেষ্টা পাইতে লাগিলেন। ১৭৫৬ অব্দের ২৩ এ নবেম্বর কৌন্সিলর সভ্যগণ পূর্ব্বের ন্যায় পলতাতেই থাকিয়া গোপনে চক্রান্ত করিতে থাকেন। তাহাদের অনুরোধে মেজর ফিলপাট্রিক্ জগৎ শেঠকে একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন। পত্রে এই লিখিত ছিল, “ইংরাজেরা সমুদয় বিষয়ের সুবন্দোবস্ত করিবার জন্য কেবল জগৎ শেঠের উপরেই নির্ভর করিতেছেন।” প্রকাশ পাইলে পাছে নবাব তাদের উপর নিষ্ঠুরাচরণ করেন, এই ভয়ে শেঠেরা প্রকাশাভাবে কার্য্যক্ষেত্রে নামিলেন না বটে, কিন্তু তাহাদের প্রধান কর্ম্মকর্ত্তা রণজিৎ রায়কে কর্ণেল ক্লাইবের সহিত সমুদয় বিষয়ের বন্দোবস্ত করিবার অনুমতি দিলেন। ১৭৫৭ অব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের যে সন্ধিপত্র অনুসারে সিরাজউদ্দৌলা ইংরাজদের সমুদয় প্রার্থনা পূর্ণ করেন, তাহা এই রণজিৎ রায়ের উদ্যোগেই সম্পন্ন হয়।
ইহার পর ক্লাইব চন্দননগর অধিকার করিলেন। নবাবের সহিত ইংরাজদের আবার যুদ্ধ বাধিয়া উঠিল। এই সময় শেঠেরা ইংরাজদের বিশেষ সহায়তা করিতে লাগিলেন। তাহাদের গৃহে সিরাজউদ্দৌলার পদচ্যুতির ষড়যন্ত্র হইতে লাগিল। তাহাদের প্রদত্ত অর্থে ইংরাজদের বল দ্বিগুণ হইয়া উঠিল ।
এই ষড়যন্ত্রের ফল প্রসিদ্ধ পলাশির যুদ্ধ। ১৭৫৭ অব্দের ৩০ এ জুন (পলাশির যুদ্ধের সাত দিন পরে) জগৎ শেঠের গৃহে ষড়যন্ত্রকারিদের প্রাপ্য বিষয়ের মীমাংসা হইল। এই খানেই শ্বেত ও লোহিত বর্ণ সন্ধিপত্রের মর্ম্ম বাহির হয়। এইখানেই উমীচাঁদের মাথায় বজ্র পড়ে।
ইহাতে শেঠদিগের কি লাভ বা কি ক্ষতি হইয়াছিল, ইতিহাসে তাহার কোন নির্দেশ নাই। ইংরেজ দরবারে শেঠদিগের সম্মান ও সদর যে বাড়িয়া উঠে, তাহা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়া থাকেন। শেঠদিগের মন্ত্রণা ও অর্থবলেই ইংরাজদিগের আধিপত্য লাভ হয়। ১৭৫৯ অব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নবাব মীর জাফর ও জগৎ শেঠ মহাতাব রায় কলিকাতায় আইসেন। কেবল নবাবের অভ্যর্থনার জন্য ইংরাজেরা ৮০,০০০ টাকা ব্যয় করেন। আর জগৎ শেঠের পরিচর্য্যার জন্য ১৭,৩৭৪ অর্কট মুদ্রা ব্যয়িত হয়।
ইহার পর নবাব মীর কাসেমের সময়ে জগৎ শেঠ মহাতাব রায়ের কপাল ভাঙ্গিল। ইংরাজদের সহিত শেঠদিগের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। মীর কাসীম তাহাকে সন্দেহ করিতেন। ইংরাজদের সহিত যুদ্ধ বাধিয়া উঠিলে নবাব তাহাকে ও মহারাজ স্বরূপ চাঁদকে কারারুদ্ধ করিয়া মুঙ্গেরের দুর্গে আনেন। ইহাতে ইংরাজ গবর্ণর ১৭৬৩ অব্দের ২৪এ এপ্রিল নবাবকে এই মৰ্ম্মে একখানি পত্র লিখেন “আমি এইমাত্র অলিয়টের পত্রে অবগত হইলাম, মহম্মদ তকি খাঁ ২১এ তারিখ রাত্রিতে জগৎ শেঠ ও স্বরূপচাঁদের গৃহে যাইয়া তাহাদিগকে হীরা ঝিলে আনিয়া সৈন্যগণের পাহারায় রাখিয়াছেন। আমি ইহাতে বড় বিস্মিত হইতেছি। যখন আপনি নবাবী পদ গ্রহণ করেন, তৎকালে, আমার, আপনার ও শেঠদিগের সাক্ষাতে স্থির হইয়াছিল, যে আপনি শাসনসংক্রান্ত বিষয়ে শেঠদিগের পরামর্শ লইবেন, এবং কখনও তাহাদিগকে কোন প্রকারে অপদস্থ বা হৃতসর্ব্বস্ব করিবেন না। যখন আমি আপনার সহিত মুঙ্গেরে সাক্ষাৎ করি, তখনও আমি এ সম্বন্ধে এইভাবে আপনাকে অনেক কথা কহিয়াছিলাম, আপনিও শেঠদিগেৱ কোন অনিষ্ঠ করিবেন না বলিয়াছিলেন। এখন তাহাদিগকে ঘর হইতে বাহির করিয়া আনিয়া অবরুদ্ধ করা অন্যায় হইয়াছে। ইহাতে তাহাদের সম্মানের সম্পূর্ণ হানি হইয়াছে। আমাদেরও সন্ধিবন্ধন শিথিল হইয়াছে, এবং আপনার ও আমার সম্মান বিনষ্ট প্রায় হইয়া উঠিয়াছে। সকলেই আমাদের দুর্ণাম করিবে। পূর্ব্বকার নবাবের কেহ কখন শেঠদিগকে এমন অপদস্থ করেন নাই।” ইত্যাদি। কিন্তু গবর্ণরের এই অনুরোধ বিফল হইল। উদয়নালার যুদ্ধে পরাজয়ের পর মীর কাসেম ক্রোধে অধীর হইয়া পাটনায় ইংরাজদিগকে হত্যা করিলেন, সেই সঙ্গে মহাতাব রায় ও স্বরূপচাঁদও নৃশংসরূপে নিহত হইলেন ।
মহাতাব রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম কুশলচাঁদ এবং স্বরূপচাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম উদয়চাঁদ। বাদশাহ শাহ আলম কুশলচাঁদকে “জগৎ শেঠ” ও উদয় চাঁদকে “মহারাজ” উপাধি দিলেন। ইহারা উভয়েই একত্র হইয়া পূর্ব্বের ন্যার আপনাদের কারবার চালাইতে লাগিলেন।
মীর কাসেম যখন মহাতাব রায় ও স্বরূপচাঁদকে কারারুদ্ধ করেন, তখন মহাতাবের কনিষ্ঠ পুত্র শেঠ গোলাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদের কনিষ্ঠপুত্র বাবু মিহিরচাঁদ আপন আপন পিতার সঙ্গে ছিলেন। এই অপ্রাপ্তবয়স্ক ভ্রাতৃদ্বয় শেষে অযোধ্যার উজীরের হাতে পড়েন । ইহাদের কারামুক্তি প্রার্থনা করিলে উজীর বহুসংখ্য অর্থ চাহিলেন। কুশলচাঁদ ও উদয়চাঁদ এজন্য ক্লাইবকে একখানি অনুনয়পূর্ণ পত্র লিখিয়া আপনাদের দীনতা ও দূরবস্থার বিষয় জানাইলেন, কিন্তু এই বিনয়পূর্ণ প্রার্থনায় ক্লাইবের হৃদয় গলিল না। ক্লাইব কঠোরভাবে ১৭৬৫ অব্দের নবেম্বর মাসে তাহাদের পত্রের এই উত্তর দিলেন, “আমি যেরূপ যত্নের সহিত আপনাদের পিতার পক্ষ সমর্থন করিয়াছি এবং এই পরিবারের অন্যান্য ব্যক্তিদের প্রতি যেরূপ সৌহার্দ্দ দেখাইয়া আসিতেছি, তাহা আপনার অবিদিত নাই। এখন আপনাদের প্রতিপত্তি রক্ষার ও সাধারণের উপকারের জন্য আপনাদিগকে কি কি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে, তাহা আপনারা বিশেষরূপে বিবেচনা করিতেছেন না ; এজন্য আমার বড় ক্ষোভের উদয় হইতেছে। আমি দেখিতেছি, আপনাদের সমস্ত ধন আপনাদের ঘরে রাশীকৃত হইয়া রহিয়াছে। আমি জানিয়াছি, যখন জমিদারদিগের নিকট গবর্ণমেন্টের পাঁচ মাসের খাজানা বাকি রহিয়াছে, তখন আপনারা তাহাদের নিকট হইতে আপনাদের পিতার প্রদত্ত ঋণের টাকা আদায়ের জন্য তাহাদিগকে পীড়াপীড়ি করিতে ত্রুটী করেন নাই। আমি কখনই এমন কঠোর কার্য্যপ্রণালীর অনুমোদন করিতে পারি না। আপনারা এখনও সাতিশয় সমৃদ্ধিপর বংশ বলিয়া প্রসিদ্ধ। কিন্তু আমার আশঙ্কা হইতেছে, বুঝি আপনাদের এই অর্থকামুকতাই শেষে আপনাদের উন্নতির প্রতিকূল হইয়া দাঁড়ায়, এবং আপনারা সকল সময়ে সাধারণের উপকারে উদ্যত্ত বলিয়া আমার যে সংস্কার আছে, তাহাও বুঝি নষ্ট হয়।”
শেঠেরা ইহার পরবৎসর ইংরাজদের নিকট ৫০/৬০ লক্ষ টাকা দাবী করেন। এই টাকায় ২১ লক্ষ, মীর জাফর ও কোম্পানীর সৈন্যের ব্যয় নির্ব্বাহ জন্য, মীর জাফরকে দেওয়া হইয়াছিল। ক্লাইব এই ২১ লক্ষ টাকার দেনা স্বীকার করেন, এবং ইহা কোম্পানী ও নবাব উভয়েই সমান অংশে শোধ করিবেন বলিয়া মত প্রকাশ করেন। এই বৎসর কলিকাতার কৌন্সিল শেঠদিগের নিকট আবার দেড় লক্ষ টাকা কর্জ্জ করিতে উদ্যত হয়।
ক্লাইবের যত্নে যখন কোম্পানী বাঙ্গালার দেওয়ানী প্রাপ্ত হন, তখন কুশলচাঁদ জগৎ শেঠ কোম্পানীর ব্যাঙ্কর হন। এই সময় কুশলচাঁদের বয়স আঠার বৎসর।
লর্ড ক্লাইব কুশলচাঁদকে বার্ষিক তিন লক্ষ টাকা দিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। কিন্তু কুশলচাঁদ ইহা লইতে সম্মত হন নাই। কুশলচাঁদের মাসিক ব্যয় লক্ষ টাকা ছিল। ঊনত্রিশ বৎসর বয়সে তাহার মৃত্যু হয়। কুশলচাঁদ জীবদ্দশায় আপনাদের পুণ্যক্ষেত্র পরেশনাগ পাহাড়ে অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া যান।
অনেকে অনুমান করেন, কুশলচাঁদের অপরিমিত ব্যয়েই শেঠদিগের দৈন্যদশা উপস্থিত হয়। কিন্তু ইহার আর কয়েকটী কারণ আছে। ১৭৭০ অব্দের দুর্ভিক্ষে শেঠেরা বিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিলেন। ইহার পর ওয়ারেণ, হেষ্টিংস্ ১৭৭২ অব্দে গবর্ণমেন্টের ধনাগার মুর্ষিদাবাদ হইতে কলিকাতায় উঠাইয়া আনেন। এই জন্য ক্রমে তাহাদের দুরবস্থা হয় । শেঠেরা আপনাদের অবনতির আরও একটী কারণ নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। তাহারা কহেন, কুশলচাঁদ বহুসংখ্য অর্থ মাটীতে পুতিয়া রাখিয়াছিলেন। হঠাৎ তাহার মৃত্যুকাল উপস্থিত হইলে তিনি সে কথা কাহাকেও বলিয়া যাইতে পারেন নাই। আর কেহ্ই এ বিষয় অবগত ছিলেন না । সুতরাং যেখানকার টাকা সেইখানেই রাহিল।
ইহার পর শেঠদিগের অধঃপতনের কথা। এ কথা অতি সামান্য। কুশলচাঁদের পুত্র ছিল না। ইনি ভ্রাতৃপুত্র হরকচাঁদকে দত্তকপুত্র করেন। ইংরাজেরা দিল্লীর দরবারের অনুমতি না লইয়াই ইহাকে “জগৎশেঠ” উপাধি দেন। হরকচাঁদের প্রথমে অর্থের বড় অসচ্ছল হইয়াছিল, শেষে তিনি তাহার পিতৃব্য গোলাপচাঁদের সম্পত্তি পাইয়া কিছু সচ্ছল হন। হরকচাঁদ প্রথমে অপুত্রক ছিলেন। পুত্রকামনায় কোন বৈরাগীর পরামর্শে জৈনধৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া বৈষ্ণবধৰ্ম্ম অবলম্বন করেন। শেষে তাঁহার দুই পুত্র জন্মে। জ্যেষ্ঠ পুত্র ইন্দ্রচাঁদ “জগৎ শেঠ” উপাধির অধিকারী হন। ইন্দ্রচাঁদের পুত্র গোবিন্দচাঁদ পিতৃসম্পত্তি সমুদয় নষ্ট করিয়া ফেলেন। গবর্ণমেণ্ট গোবিন্দচাঁদকে কোন উপাধি দেন নাই। সুতরাং তাহারা পাঁচ পুরুষ ধরিয়া যে বহুমানিত “জগৎ শেঠ” উপাধি অধিকার করিয়া আসিতেছিলেন, তাহা ইন্দ্রচাঁদের সঙ্গেই লোপ পায়। গোবিন্দচাঁদ কিছু দিন পূর্ব্বপুরুষের সঞ্চিত মণিমুক্তা প্ৰবালাদি বেচিয়া দিন কাটান শেষে কোম্পানী তাহার পূর্ব্বপুরুষের কৃত উপকার মনে করিয়া তাহার বার্ষিক ১২০০০ টাকা বৃত্তি নির্দ্দিষ্ট করিয়া দেন। কিন্তু সে কথা তুলিয়া আর কাজ কি ?
যাহারা ব্যবসায় করে, সাধারণতঃ তাহাদিগকেই শেঠ বলা যায়। বাঙ্গলার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে শেঠ উপাধিধারী অনেক লোক বাস করে। ইহাদের সহিত মুর্ষিদাবাদের বিখ্যাত জগৎশেঠের কোন সংস্রব নাই। নবার আলিবর্দি খাঁ ১৭৫১ অব্দের ৩০এ মে কলিকাতার কৌন্সিলের সভাপতিকে লিখেন, “আমি শুনিলাম, রামকৃষ্ণ শেঠ নামে এক ব্যক্তি মুর্ষিদাবাদে কর না দিয়া, কলিকাতায় থাকিয়া ব্যবসায় চালাইতেছে। ইহাতে আমি বিস্মিত হইতেছি, এবং অনুমান করিতেছি, এই ব্যক্তি কাহারও ভয়ে ভীত নহে। আমি আপনাকে লিখিতেছি, আপনি একজন চোপদার পাঠাইয়া তাহাকে ধরিয়া আনিবেন, এবং যত শীঘ্র পারেন, এখানে পাঠাইয়া দিবেন। আমি যেমন লিখিলাম তদানুসারেই যেন কাজ হয় ।” এই পত্র পাইয়া কৌন্সিলের অধ্যক্ষ নবাবকে লিখেন, “রামকৃষ্ণ শেঠ কোম্পানীর দাদন লইয়া দ্রব্যাদি যোগাইয়া থাকে। তাহার নিকট কোম্পানীর অনেক টাকা পাওনা আছে। এজন্য তিনি তাহাকে অবরুদ্ধ করিতে পারেন না।” রেবারেণ্ড লঙ্গ সাহেব কলিকাতার যে শেঠবংশের উল্লেখ করিয়াছেন, বোধ হয় সেই বংশীয়। কিন্তু বিখ্যাত জগৎশেঠের সহিত ইহাদের কোন সম্বন্ধ নাই। লর্ড ক্লাইবের চন্দননগর আক্রমণ প্রসঙ্গে ইতিহাসলেখক অৰ্ম্মি সাহেব উল্লেখ করিয়াছেন, শেঠদিগের সহিত ফরাসীদিগের বন্ধুত্ব ছিল। মহাতাব রায় ও স্বরূপচাঁদ ফরাসী গবর্ণমেন্টকে দেড় কোটী টাকা কর্জ্জ দিয়াছিলেন । অনেকের বিশ্বাস, পলাশির যুদ্ধের পূৰ্ব্বে শেঠগণ ইংরাজদিগকে অনেক টাকা দেন। ব্রিটিশ সৈন্যের তরবারি ও সঙ্গীনের ন্যায় জগৎ শেঠের মন্ত্রণা ও জগৎ শেঠের অর্থ ইংরাজকে বাঙ্গালার সিংহাসনে বসাইয়াছে।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024