বিরাজনৈতিক শিল্পসাহিত্যর বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলুন!
শিল্পসাহিত্য এবং রাজনৈতিকতা পৃথকীকরণের মত এক ভয়ংকর মুমূর্ষু পথে আমরা দৌড়াইতেছি কখনো স্বেচ্ছায় বা হেজিমনিক্যালিই। শিল্পকে তুমুল স্বতন্ত্রতায় রাখার স্বার্থে প্রায়শই বিরাজনীতি এবং পাওয়ার প্র্যাক্টিসিং কে খুব আদর করেই রাখা হয় শিল্পসাহিত্য মহলে। শিল্পের ‘স্বতন্ত্রতা’টা ব্যাপারটারে খুবই ঐশ্বরিক করে তোলবার চেষ্টাটাও দেখা যায় । শিল্প স্বাধীন ও স্বতন্ত্র- এ ব্যাপারে নানাবিধ মতামত চালু আছে, শিল্পের গুণগত স্বাধীনতার প্রতি কনসার্ন আমিও রাখি কিন্তু মানুষ, জীবন ও সম্পূর্ণ অরাজনৈতিকতার মধ্য দিয়ে শিল্পের স্বতন্ত্রতা এইখানে কেবলই প্রচলিত ব্যবস্থার ধারক ও বাহকের অধিক কিছু হইতে পারে নাই। শিল্প ও সাহিত্য এইখানে যে ভূমিকায় আবির্ভূত হবার কথা ছিলো, অন্তত মধ্যবিত্তের প্রোডাক্ট হিসেবেও চিন্তা ও প্রাক্টিসে যে রেনেসাঁসের আহ্বান ও আবেদন তৈরি করবার দায় বহন করে, তা থেকে আমাদের সাহিত্যিকরা স্বাতন্ত্র্যবাদীতার অজুহাতে কেবলই দমন করে গেছে মানুষের চাওয়ার প্রতিফলন। আর বারবার এই প্রাক্টিস দাঁড়িয়েছে প্রচলিত সমাজের নিপীড়কদেরই পক্ষে। এ এক তুমুল আফসোসের ব্যাপার যে আমাদের কোন সাহিত্যিক হিরো নাই, যা আছে সবই বাজারের উৎকৃষ্ট খাসির রানের অধিক কিছু না। অথচ জন্মযুদ্ধের ভিতর দিয়া তৈরি এই ভূখন্ড ও তার শিল্পচর্চা গণমানুষের পক্ষে দাড়াবার যে ওয়াদা নিয়ে হাজির হয়েছিলো, তা আমাদের সাহিত্যিকরা গলা টিপে হত্যা করেছে।
শিল্প যখন এক্সিস্টিং সোসাইটির ভাঙনের ইশতেহার না হয়া, কেবলই মুখরোচক হয়ে ওঠার দিকে যাত্রা করে তখন আমাদের মাথায় আসে মুখরোচকতার চর্চা, আমাদের ভেতর পুশ করে কে বা কারা। কোথা থেকে আসে আমাদের বাজারের জনপ্রিয় অগা মগা ছগা শিল্পী লেখকরা। আর কেনইবা চিন্তার বীজ বা বিচি না গজানো কিশোরী ও কিশোরের দল তাদের অটোগ্রাফের মোহে লাইন দিয়া খাড়ায় থাকে। মূলত তারা খুঁজে পায় মাংস, চর্বি আর মশলার মিশ্রণে নারী ও নিপীড়ত মানুষেরে নিয়া ফ্যান্টাসি ও রম্য-রসিকতা। যা যায় বাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় হইতে, তা মূলত বাজারের ইন্ধনেই তৈরি। আর এই বাজারি সাহিত্য আমাদের সেই ভয়ানক শত্রু পুঁজিবাদ, ভয়ংকর প্রাক্টিস ভোগবাদ, যেই দুইটার প্রধান সেনাপতি পুরুষতন্ত্রের রিপ্রেজেন্টেটর হিসেবে হাজির হয়। আর নারী হিসেবে আমি দাঁড়িয়েই, চোখ মেললেই দেখতে পাই আরও সহজে শিল্প বিষয়ক অরাজনৈতিক “স্বাধীনতা”তে সবচেয়ে বেশি লাভবান হইতে পারে একমাত্র পুরুষতন্ত্র।
কলোনিয়াল হ্যাংওভারে ভরা শৈল্পিক সত্ত্বাদের এই স্বতন্ত্রতার কচকচানির চর্চা এইখানে প্রাচীন। রবীন্দ্রনাথের একটা আঙুল বাড়িয়ে দেওয়া আছে তাদের মুষ্টিবদ্ধতায়। রবীন্দ্রনাথ, আমাদের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ বাঙালী নারীর যে চিত্র নির্মাণ করেছে, তা এক এস্থেটিক ভোগ্যপণ্যের অধিক কিছুই না। এইখানে নারীর শ্রমজীবী চেহারাকে খুন করে রবীন্দ্রনাথ হাজির করেছে ম্রিয়, ক্লেশ আর কেবলই পুরুষের দৃষ্টিনন্দিত এক প্রতিমা হিসেবে। আর আমার হৃদয় মার্সিয়া করে ওঠে। পূর্ববঙ্গের বৃহত্তম শহরের নারীরা এখানে যতবার গিয়েছে মুক্তির সন্ধানে চিন্তাশীল মানুষদের কাছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা কেবলই এলিট পণ্য হিসেবে, মর্ডানিস্ট পণ্য হিসেবে হাজির হয়েছে। তারা চিন্তার সেই মহলের কাছে গেছে যারা নারী অধিকারের মোড়কে ক্ষমতার পদলেহন করছে। তারা এইখানকার নারী ও নিপীড়িত জনগনের মধ্যিকার মিলন ও সংগ্রামের প্রধান গণশত্রু হিসেবে অবস্থান করছে। রবীন্দ্রনাথসহ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথত্তোর অন্যান্য মহারথীগণ শিল্পের ভেতর নারীর যে রুপবতী, দমে থাকা নির্মল চেহারা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এইখানে সেটা কেবলই পরম্পরার নষ্ট বীজের উদগিরণ ছাড়া কিছুই নির্মাণ করেনি বাঙলা সাহিত্যের পৃষ্ঠাজুড়ে। আর যতবার এই অভিযোগ তোলা হয়েছে, ততবার স্বাতন্ত্র্যতা স্বাতন্ত্র্যতা স্বাতন্ত্র্যতা করে গলা উঁচিয়ে নিজেদের অপরাধকে জাস্টিফাই করে গেছে।
শিল্পের বাণিজ্যিকীকরণ এখানে অরাজনৈতিক শিল্পীদের সাহচর্যে এইরকম পুরুষতান্ত্রিকতার মধ্যে ফুলেফেঁপে ওঠবার কথা ছিল ধারাগতভাবেই। নারী যেইখানে শিল্পের অন্যতম আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন, সেইখানের শিল্প স্বতন্ত্রতা নিয়ে হাকডাক করা শিল্পীদের আমি সমষ্টির শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করি। শিল্পসাহিত্যের প্রতিষ্ঠান ও পজিশনের রিপ্রেজেন্টটররা ক্ষমতার চমৎকার দালালীপনার মধ্য দিয়ে নিজেরে তৈরি করেছে। এই দালালীভরা সাহিত্য, ক্ষমতার শৈল্পিকতা- সর্বোপরি ক্ষমতাই নারীর আজন্ম শত্রু। নারীকে অধঃস্তন করে রাখার কিছু নান্দনিক শৈল্পিক তরিকা দেখতে পাবেন এইখানকার শিল্পসাহিত্যে। কিন্তু ওইটারে শিল্পের স্বতন্ত্রতা বলেই ছেড়ে দেওয়া হয় বারবার!
আরও এক চটকদার জিনিস হলো বঙ্গের পোস্টমর্ডানিজম। যৌনতারে শিল্পায়িত করতে গিয়ে নারীরে কি ভীষণ ভাবে ব্যবহার করা হইছে তা একটু খেয়াল করে দালালীবিহীন চোখে দেখলেই ধরা যায়। বঙ্গে পোস্টমর্ডানিজমীয় গিমিকবাজী বারবার রাজনৈতিক দায় থেকে সাহিত্য ও সাহিত্যিককে অবমুক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেছে, যাচ্ছে। পোস্টমর্ডানিজমের খোলসে যা দাঁড়াইছে সেটা হলো ইউরোপীয় বুর্জোয়া কলোনিয়াল ফ্যান্টাসি যা নারীরে সর্বদাই পণ্যায়িত করার হেজিমনি তৈরি করেছে নারীবাদের নাম ধরে। যৌনতা বা নগ্নতা নিয়ে নারীর স্বাধীনতার বিপ্লব ঘটাইতে চাইয়া তারা বারবার নারীরে পুঁজিবাদের একটা বড় প্রোডাক্ট বানায়া তুলছে। লিবারেল নারীরাও যখন এই বাজে চর্চার মধ্যে মাথা উঁচিয়ে দেয় তখন বড়ই দুঃখ করে ওঠে মন, দুঃখ করে ওঠে রোজা লুক্সেমবার্গের আত্মা। বঙ্গে নারীবাদের সংগ্রাম বেশিরভাগ ভুল মানুষের হাতে গিয়ে পড়ছে, যার ফলে নারীবাদের রাজনৈতিক গতি মাঠে হাঁটু ভেঙে থুবড়ে পড়েছে। নারীবাদের শুরু যে শুধু যৌনস্বাধীনতা দিয়েই করতে হয় না, শুরুটা হওয়া উচিৎ শ্রেণিসচেনতার মধ্য দিয়ে – এটা বুঝতে তাদের কোথায় সমস্যা তা আমরা জানি। মর্ডানিজমের ঘোর ও পুঁজিবাদী ব্যক্তিস্বাধীনতা চর্চা, ভোগ ও সুবিধাবাদ বারবার এদেরকে সঠিক সংগ্রাম থেকে দূরে রেখেছে। আর এই সমস্ত পুরুষতন্ত্র ও ক্ষমতাকে আড়াল করণীয় ভুল পথের চর্চাই, স্বাতন্ত্র্যতাবাদী শিল্পের প্রাক্টিসিংই নারীকে তার বিপ্লবী পদার্পণ থেকে দূরে রেখেছে।
বঙ্গের তথাকথিত নারীবাদ বর্তমানে পিংপং বলের মত করুণভাবে নাচতেছে নিওলিবারেল আর ইউরোপীয় ভাবধারায় বুঁদ হওয়া নারীবাদীদের হাতে৷ যে ভূমিতে শ্রেণিবৈষম্য মানুষের গলায় পা তুলে দাড়ায়া আছে সেইখানে শুধু শোয়ার স্বাধীনতা বা পোশাকের স্বাধীনতার মত ব্যক্তিবাদী শর্ত কোনোভাবেই এখানের নারীবাদ না৷ ভূখণ্ডের রাজনীতি সর্বদা নির্ভরশীল রাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর। নারীবাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন৷ অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতি ডিঙিয়ে কিভাবে এখানের নারীবাদীরা শুধু ব্যক্তিবাদী আলাপ নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারেন- জানিনা! আবার কোনো কোনো নারীবাদী(!) তো ক্ষমতারে আয়ত্ত করতে পুরুষের বিরুদ্ধে (তারা জানেন না যে ফাইট পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে -যার শিকার পুরুষ স্বয়ং) ফ্যাসিবাদী নারীবাদও কায়েম করার চেষ্টা করেন। তারা মুক্তির দিশা না হয়ে নিজেরাও বন্দী হয়েছে আর বন্দী করেছে আমার সংগ্রামী সাথীদের এক ভয়ংকর হেজিমনির ভেতর।
এইসব শিল্পবিষয়ক পুরুষতান্ত্রিক ম্যানিপুলেশন থেকে নারীর দ্রুতবেগে বের হয়ে আসতে হবে, বিরাজনৈতিক শিল্পরে প্রোমোট করার বিরোধিতা করতে হবে। নারীবাদী সংগ্রাম নিশ্চয়ই শ্রেণিসংগ্রামের অংশ। পুরুষতন্ত্র ও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রাম। নারীর যুদ্ধটা সবসময়ই ক্ষমতার সাথে। তার সময়ের ক্ষমতাসীনের সাথে এবং ক্ষমতা লালনকারী (শিল্পসাহিত্য) সবকিছুর সাথে। নারীবাদী সংগ্রামের রাস্তা অবশ্যই সর্বহারার সংগ্রামের দিকে। নারীরে বুঝতে হবে যে নারী সর্বহারাদের ভেতরেও চূড়ান্ত সর্বহারা, প্রান্তিকের ভেতর প্রান্তিক। শুধু স্বৈরাচার উৎখাত হইলেই পুরুষতন্ত্র উৎখাত হয়ে যাবে এমন নিশ্চয়তা নাই, শ্রেণিহীন সমাজের দিকে না এগোনো পর্যন্ত নারীর বিপ্লবী সংগ্রাম বহাল রাখতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত নারী সমাজে ‘তারা’ থেকে ‘আমরা’য় পরিণত না হচ্ছে। যে কোনো স্বতন্ত্রতার আলাপেই আরও বেশি সতর্ক থাকতে সেটার বিরাজনৈতিকতা নিয়ে। যত বেশি বিরাজনৈতিকতা প্রশ্রয় পাবে, ক্ষমতা তত বেশি ঘায়েল করবে নারীকেই সর্বদা- সেটা শিল্পসাহিত্যের মেকাপ লাগিয়ে অথবা অন্য যে কোনোভাবে।
—
২৩ জানুয়ারি, ২০২০।