অবিচুয়ারি: মাহমুদুল হক
হক স্যার বলেই আমরা তাঁকে চিনতাম। মাহমুদুল হক। চারুকলা অনুষদের প্রিন্ট মেকিং বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন, ছিলেন চারুকলা ইন্সটিউটের চেয়ারম্যান, জাতীয় জাদুঘরের ডিরেক্টর পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
জাদুঘরের দায়িত্ব পালনের সময় উনি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন, যাদুঘরের কোল ঘেঁসে শাহবাগ মোড়ে আজিজের দিকে যাইতে ফুটপাতে জনতা মুতে একদম নর্দমা বানিয়ে রাখত, পাবলিক টয়লেট ছিল যেন ওটা। হাটা যাইত না ঐ দিক দিয়া। বিকট গন্ধ। উনি সেখানে পরিস্কার করেছিলেন, মুতা বন্ধ করছিলেন।
উনাকে প্রথম আলাদা করে চিনি ৯২ সালে, উনার লগে কথা বার্তা বা উনার কাছ থেকে শিক্ষা নেবার আগেই।
২টা সোর্স থেকে তাঁর সন্মন্ধে নেগেটিভ আলাপ আমারে শুনতে হইছে।
এই ২ সোর্সের কোনটা আগে কোনটা পরে তা এখন মনে করতে পারতেছি না, তবে খুব কাছা কাছি সময়ে।
একটা সোর্স আমার সহপাঠি, তার পরিবরের অনেকেই চারুকলাতে বিভিন্ন সময়ে ছিল, তো সেই সহপাঠি জানাইত উনি ভালো লোক না, বিএনপি করে। উনাদের পরিবারের একজনের সাথে শত্রুতা আছে।
আরেক সোর্স, বিক্ষাত এক ব্যাক্তি, তার লগে দেখা হইল মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে, আমার আব্বা তখন ঢাকায় আসছেন মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে তার তোলা ২৫০টা ছবি দিতে , তো উনি আমারে সাথে নিয়ে গেলেন যে তাদের সাথে মিটিং আছে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের ট্রাস্টিদের সাথে মিটিং। সেগুন বাগিচায় গেলাম আব্বার সাথে। মিটিঙের শুরুতেই আব্বা আমারে পরিচয় করাই দিলেন যে আমি চারুকলাতে ভর্তি হইছি এইবার। এই শুনে ট্রাস্টিদের একজন কইলেন ওখানে আমার এক বন্ধু আছে, চিন? মাহামুদুল হক? আমি কইলাম নাম শুনেছি উনার, আমাদের ক্লাস নেয় না। তো এরপর উনি হাস্তে হাস্তে কইলেন উনি একটু বোকা মত আছেন, বন্ধু কিন্তু আমরা অত পছন্দ করি না।
এই কথা শুনে আমি নিজেই বিব্রত হইলাম। বন্ধু কইতেছে আবার কইতেছে পছন্দ করে না। এইটা তো তাইলে যে কইতেছে তারই সমস্যা। কিন্তু এই কথা আমিও মনে তেমন জোর দিয়ে আনতে পারলাম না সেই নাদান অবস্থায় কেননা যে কইতেছে সে তো মহান ব্যক্তি, বিরাট মানুষ। যা হোক বিরাট মানুষদের থেকে আমি দূরেই থাকা পছন্দ করি বলে এই নিয়া ভাব্লাম না আর সেই সময়ে।
অল্প কাল পরেই বুঝলাম আদতে উনি বিএনপি করতেন , আর যে ২ সোর্স এর মাধ্যমে তাঁর সন্মন্ধে নেগেটিভ আলাপ শুনলাম , তারা ২ জনেই কেবল আওয়ামীলীগ না উনারা কোলকাতার সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এইটা অনেক পরে বুঝেছি যে আওয়ামীলীগের মধ্যেও যারা কলকাতা মুখী তারা বিএনপি করাদের ২ চোক্ষে দেখতে পারে না। এমনকি বন্ধু বলেও পিছন থেকে ছুরি মারতে দিধা করে না।
হক স্যারের সরাসরি উপাকার পাইছে কত যন তা সম্ভবত গুনে শেষ করা যাবে না। চারুকলার বর্তমান খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন শিক্ষক দীর্ঘদিন খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে ছিলেন, আওয়ামী পন্থার লোক উনি, এই শিক্ষকেরও পার্মানেন্ট করার ব্যাপারে এই হক স্যার ছিলেন। এই রকম আরো শিক্ষক আছেন যারা তাঁর স্নেহ পাইছেন। এইগুলা তারা কি এখন কইবেন?
ছাত্র অবস্থায় আমি খুবি কম মিশতাম শিক্ষকদের সাথে, তেমন কথাও কইতাম না, কাজ দেখাইতাম শ্রেণী শিক্ষকদের, চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাজ দেখাইতাম, উনারা যা বলতেন তা শুনতাম। ক্লাসের বাইরে অন্য শিক্ষকদের গিয়ে কাজও দেখাইতাম না। ফলে হক সারের সাথে আমার দূরত্ত্ব ও চেনা না চেনা থাইকাই যাইতেছিল চারুকলার ছাড়ার সময়েও।
কিন্ত তাঁরে আমি ২বার খুব কাছ থেকে চেনার সুযোগ পাইলাম। ২০০০ সালে কলকাতায় এক ওয়ার্কসপে গেলাম আমরা, এই ওয়ার্কসপেরও আয়োজক ও উদ্যক্তা তিনিই ছিলেন, কয়েকবছর তখন হইত। সেই ওয়ার্ক শপের মাঝে উনি কলকাতায় আসলেন। তখন এতদিনের দূর থেকে দেখা গম্ভির মানুষটি দেখলাম মাটির মানুষ, প্রাণবন্ত, বন্ধুর মত মিশ্তেছে আমাদের সাথে।
২য় বার উনার সরাসরি হেল্প পাইলাম, ভারতে স্কলারশিপ পাইছিলাম মাস্টার্স করার, কিন্তু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন আমার কাগজ আটকায়ে রাখছিল কি এক কারনে, সেই কাগজ হাতে পাইতে উনিও সাহায্য করছিলেন, কাগজ হাতে পাইলাম যেদিন তাঁর পরের দিন কলকাতায় রিপোর্টিং করতে হবে। কেম্নে কি করবো কিছুই বুঝতেছি না, হাতে একদম টাকা ছিল না। দুপুরে কাগজ হাতে পেয়ে খুবি মন খারাপ করে চারুকলায় গেলাম, ভাব্লাম স্যারকে বলি যদি কিছুদিন সময় বাড়ানো যায়। স্যার তখন চারুকলার ডিরেক্টর। স্যার আমার কথা শুনে কইলেন টাইম বারাইতে হবে কেন, কাল্কেই যাবা তুমি। আমি তারে কইতেও পাইতেছি না যে আমার হাতে কোন পয়সা নাই। উনারে কওয়া লাগল না, উনি হয়তো আগেই আঁচ করতে পারছিলেন, নিজে থেকেই বললেন টাকা পয়সা আছে? না থাকলে আমার কাছ থেকে যাওয়ার টাকা নিয়ে যাও, অখানে গিয়ে তো পাবেই, তখন ফেরত দিয়া দিবা। উনি টাকা না দিলে আসলেই আমার যাওয়া হইত না।
এই পিতাতুল্য আচরণ উনার কাছ থেকে ছাড়া আর কারো কাছ থেকে পাই নাই। আর এইটা কেবল আমি পেয়েছি তেমন নয়। আমার জানা মতে তা অগণিত।
উনার কাজ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে নিশ্চয় তাঁর সরাসরি শিক্ষার্থীরা লিখবেন। কিন্তু আমার কাছে উনার ঐ খারাপ ইমেজ থেকে ভালো মানুষ হিসাবে উনাকে পাওয়া খুবি গুরুত্বের, স্যারকে এইভাবে আমার আবিস্কার আমাকে আমার সমাজ ও সময় চিনতে অনেক হেল্প করেছে। আমাকে চিন্তেও হেল্প করেছে। দূর থেকে একজন বড় মানুষের যে ছায়া পেয়েছি তা আজ আক্ষেপ বাড়াইতেছে , আহা কেন তাঁর আরো কাছে গেলাম না।
উনি বিএনপি করতেন , উনি ভালো মানুষ ছিলেন।
আল্লাহ উনাকে বেহেশত নসিব করবেন নিশ্চয়।
(ছবি শিল্পী রফি হকের ওয়াল থেকে )
আব্দুল হালিম চঞ্চল
Latest posts by আব্দুল হালিম চঞ্চল (see all)
- জনরোষে কি কেবল ‘ভাস্কর্য’ ভেঙ্গে পড়তেছে? - আগস্ট 11, 2024
- অবিচুয়ারি: মাহমুদুল হক - জানুয়ারি 12, 2022
- ঢাকার আর্ট সিনে নতুন কালারিস্ট জে জে আর্ট - জুলাই 29, 2020